০৬. ভারতবর্ষের প্রথম নাগরিক

ভারতবর্ষের প্রথম নাগরিকই রাষ্ট্রপতি ভবনের প্রধান আবাসিক। সেই উনিশ শ বাহান্ন সালে চাকর রাজেন্দ্রপ্রসাদ এই প্রাসাদে ঢোকেন। তারপর কতজনেই রাষ্ট্রপতি হলেন।

গণতান্ত্রিক ভারতের সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে কোন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকার দেয়নি কিন্তু দিয়েছে অকল্পনীয় সম্মান। সমগ্র রাষ্ট্রের তিনি প্রতীক। তাঁরই নামে চলে সরকার। স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীর তিনিই সর্বাধিনায়ক। তাঁরই আমন্ত্রণে সংখ্যা-গরিষ্ঠ দলের নেতা হন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীদের সংবিধানের প্রতি আনুগত্যের শপথ ও মন্ত্রগুপ্তি নিতে হয় এই রাষ্ট্রপতির কাছেই। সুপ্রীম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিরা তাঁরই কাছ থেকে নিয়োগপত্র পান। রাষ্ট্রদূতরাও তাই। ভারতস্থ বিদেশী রাষ্ট্রদূতরাও তাঁদের পরিচয়পত্র রাষ্ট্রপতির করকমলে সমর্পণ করে কাজ শুরু করেন। আরো কত কি। ক্ষমতা না থাক, এই সম্মানের কি মূল্য নেই? যাকে-তাকে কি এই সম্মান দেওয়া যায়? নাকি উচিত?  

ষাট-সত্তর কোটি ভারতবাসীর পরম সৌভাগ্য প্রথম দিকে এমন এক একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, যাদের নিয়ে গর্ব করা যায় কিন্তু পরবর্তীকালে এমন এক একজনকে এই অভূতপূর্ব সম্মান পাবার অধিকার দেওয়া হয়েছে, যাদের কীর্তি কাহিনী জানলে সমস্ত ভারতবাসী মাথা হেঁট করবেন।

এমন এক ব্যক্তি একবার রাষ্ট্রপতি হলেন, যার সীমাহীন দৈন্যের কথা বলে শেষ করা যাবে না। দিল্লীতে এই ভদ্রলোকের অনেক আত্মীয়-স্বজন ছিল। তারা চাকরি-বাকরি ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। থাকতেন নিজেদের আস্তানাতেই কিন্তু সেসব বাড়িতে রান্নাবান্নার কোন ব্যবস্থা ছিল না। ঐ ভদ্রলোক যখন রাষ্ট্রপতি তখন রাষ্ট্রপতি ভবনের গাড়ি ছুটে বেড়াতে সারা দিল্লী। ঐসব গাড়ি করে রাষ্ট্রপতির আত্মীয়-স্বজনরা প্রতিদিন সকালেসন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি ভবনে এসে সরকারী তহবিলের সর্বনাশ করে খাওয়া-দাওয়া করতেন।

রাষ্ট্রপতি ভবন সংলগ্ন জমিতে শুধু ফুলের বাগানই নেই, চাষ হয় অনেক কিছুর। ধান-গম থেকে আলু-পটল-পেঁয়াজ-টমাটো। আমরা কত কি। এসব চাষ হয় রাষ্ট্রপতি ভবনের প্রয়োজনেই কিন্তু ঐ মহাপুরুষটি এইসব আলু-পেঁয়াজ দেশের বাড়িতে নিয়ে যেতেন নিয়মিত।

রাষ্ট্রপতি ভবনের সবাই এ খবর জানতেন কিন্তু বাইরের কেউ রাষ্ট্রপতির এই লোভের কথা জানতেন না। কথায় বলে, চোলে, জ দিল, গোর একদিন।

রাষ্ট্রপতি সপরিবারে নিজের দেশে যাবেন। দিল্লীর পালাম বিমানবন্দরে ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিশেষ বিমানটি দাঁড়িয়ে। ম্যামপ-এর পাশেই কমাণ্ডার অব দ্য এয়ার ক্রাফট ও অন্যান্য বিমান কর্মীরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে। অন্যান্য উচ্চপদস্থ অফিসার ও পুলিশ অফিসাররাও রাষ্ট্রপতির জন্য অধীর প্রতীক্ষায়।

নিয়ম অনুযায়ী ভি-আই-পি কনভয়ের আগেই এলো মালপত্র। রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবার এবং রাষ্ট্রপতির সহযাত্রী রাষ্ট্রপতি ভবনের অফিসার ও কর্মীদের মালপত্র বিমানে ভোলা শুরু হল। প্রায় সব মাল উঠে গেছে। এমন সময় কয়েকটা বস্তা তুলতে গিয়েই বিভ্রাট। হঠাৎ একটা বস্তা বিমানের দরজার কাছ থেকে মাটিতে পড়লেই কয়েক মণ পেঁয়াজ ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।

সবাই অবাক। রাষ্ট্রপতি বস্তা বোঝাই পেঁয়াজ নিয়ে যাচ্ছেন! মুখে কেউ কিছু না বললেও লজ্জায় ঘেন্নায় সবাই মুখ নীচু করলেন।

ইতিমধ্যে স্বয়ং রাষ্ট্রপতি সদলবলে হাজির। একবার আড়চোখে বস্তামুক্ত পেঁয়াজগুলোর গড়াগড়ি দেখে বিমানকর্মী ও অন্যান্যদের সঙ্গে করমর্দন করে বিমানে উঠলেন কিন্তু পেঁয়াজগুলো আবার সংগ্রহ করে বস্তাবন্দী হয়ে বিমানে তোলার পরই ভারতের রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিশেষ বিমান আকাশে উড়ল।

আমাদের সৌভাগ্য আমরা এমন মহামান্য রাষ্ট্রপতিও পেয়েছি যার সুযোগ্যা সহধর্মিণী চোর।

রাষ্ট্রীয় সফরে রাষ্ট্রপতি গিয়েছেন এক প্রতিবেশী রাষ্ট্রে। সঙ্গে তাঁর সহধর্মিণী। মাননীয়া ফার্স্ট লেডি অব ইণ্ডিয়া। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও তাঁর স্ত্রীর জন্য সম্মানে অতিথিসেবক রাষ্ট্রপ্রধান রাষ্ট্রীয় ভোজেরে আয়োজন করেছেন এক বিখ্যাত হোটেলে। রূপার কাটলারী দেখে মাননীয়া রাষ্ট্রপতির পত্নী আর লোভ সামলাতে পারলেন না। ভোজনসভা শেষে ঘরে ফেরার সময় তিনি কয়েকটা ছুরি-কাঁটা চামচ ইত্যাদি শাড়ির মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে চলে এলেন।

এই রাষ্ট্রপতি ও তাঁর সহধমির্ণী গিয়েছেন দূর প্রাচ্যের একটি দেশে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও দলের সদস্যদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে এক বিখ্যাত হোটেলে। রাষ্ট্রপতির ঘরের মধ্যে ও বাইরে অমূল্য শিল্প সামগ্রী দিয়ে সাজান হয়েছে সরকারী উদ্যোগে। তার কয়েকটি বড় পছন্দ হল মাননীয় রাষ্ট্রপতি-পত্নীর। যথারীতি তিনি দুচারটে তুলে নিজের ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রাখলেন দেশে নিয়ে যাবার জন্য।

সুখের কথা কোন দেশের কোন চুরি করা জিনিষই আমাদের রাষ্ট্রপতি ভবন পর্যন্ত পৌঁছায়নি। রাষ্ট্রপতি-পত্নীর স্বভাবের কথা আমাদের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দপ্তরের ভালভাবেই জানা ছিল। তাই তো এই রাষ্ট্রপতি কোন দেশে রাষ্ট্রীয় সফরে গেলেই নিরাপত্তা কর্মীরা ছাড়াও দুচারজন ঝানু গোয়েন্দা পাঠানো হত। এইসব ঝানু গোয়েন্দারা চুরি করা জিনিষপত্র আবার চুরি করে যথাস্থানে রেখে দিতেন।

আরেক রাষ্ট্রপতির কাহিনী প্রায় অমৃত সমান।

ভারতীয় সংসদীয় প্রতিনিধিদল চলেছে অস্ট্রেলিয়া। প্রতিনিধি দলে দুএকজন মহিলা সদস্যও আছেন। বিমানে এক মহিলা সদস্যর পাশেই বসেছেন পরবর্তী কালের এক রাষ্ট্রপতি।

দিল্লী থেকে পার্থ। পার্থ থেকে ক্যানবেরা। এক মহাদেশের দুটি প্রান্ত। দীর্ঘ পথ। সারারাত ধরে বিমান চড়ার পরই ক্যানবেরা পৌঁছানো যাবে। নৈশভোজন শেষ। প্লেনের উজ্জ্বল আলোগুলো আর জ্বলছে না। সারা প্লেনে আবছা আলো। প্রায় সব যাত্রীই সীট ঠিক করে কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমোচ্ছন। কয়েকজন যাত্রী মাথার উপরের আলো জ্বেলে বইপত্র পড়ছেন।

ভারতীয় সংসদীয় প্রতিনিধি দলের সবাই ঘুমুচ্ছেন। ভাবী রাষ্ট্রপতির পাশের মহিলা সদস্যাও ঘুমুচ্ছেন। উনি ঘুমের মধ্যেই অনুভব করলেন শাড়ির মধ্যে দিয়ে কি যেন একটা কিছু আস্তে আস্তে তাঁর শরীরের উপর দিকে এগুচ্ছে। হঠাৎ খুব বেশী অস্বস্তি বোধ করতেই উনি খপ করে চেপে ধরলেন।….

শাড়ির মধ্যে কোন পোকা-মাকড় ঢোকেনি। ভাবী রাষ্ট্রপতি হাতই শাড়ির তলা দিয়ে…

এই মহিলা সদস্যটির সৎ সাহসের খ্যাতি ছিল এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় ইনি পার্লামেন্টের সেন্ট্রাল হলে প্রকাশ্যে বলতেন, দোহাই, এই চরিত্রহীন লোকটিকে ভোট দেবেন না।

এসব কথা লিখতেও ঘেন্না হয় কিন্তু তবু না লিখে পারি না। সাধারণ রক্ত-মাংসের মানুষের মধ্যে নানা রকমের দুর্বলতা থাকবেই কিন্তু যারা সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্ণধার হবেন, তাদের মধ্যে দৈন্য, মালিন্য ও চারিত্রিক দুর্বলতা থাকলে সমাজ বা রাষ্ট্র কিভাবে চলবে? ষাট কোটি মানুষের মধ্যে কী এমন একজনকে পাওয়া যায় না যার বিদ্যা বুদ্ধিমনীষা ত্যাগ-তিতিক্ষা ও চরিত্র আমাদের অনুপ্রাণিত করবে?

আজকাল রাজনৈতিক জগতের আরশোলা-টিকটিকিদের ঔদ্ধত্য দেখলেই মনে পড়ে যায় আমাদের প্রথম রাষ্ট্রপতি ডক্টর রাজেন্দ্রপ্রসাদের কথা। একবার কলকাতা থেকে প্রকাশিত পদ্মপুরাণের কয়েকটি খণ্ড ওঁকে উপহার দিতে গেছি। এডিসি আমাকে রাষ্ট্রপতির স্ট্যাডিতে ঢুকিয়েই চলে গেলেন।

বিরাট স্ট্যাডির এক কোণায় বসেছিলেন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ। আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন। আমি ওঁর কাছে যেতেই উনি আমার পায় হাত দিয়ে প্রণাম করতে উদ্যত হলেন। আমি ছিটকে দূরে সরে গেলাম কিন্তু উনি বার বার আমাকে প্রণাম করার চেষ্টা করলেন।

তুমি ব্রাহ্মণ। তোমাকে প্রণাম করব না?

আমি সবিনয়ে নিবেদন করলাম, আপনি আমার পিতৃতুল্য। তাছাড়া অন্যান্য সবদিক দিয়েই আপনি আমার শ্রদ্ধেয়। তাই আমিই আপনাকে প্রণাম করব।

উনি তবুও নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত উনি হাত জোড় করে নমস্কার করে আমাকে আগে বসিয়ে তারপর নিজে বসলেন।

শুধু ব্রাহ্মণকেই উনি প্রণাম করতেন না। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে গুণীজ্ঞানী বা প্রবীণদেরও উনি প্রণাম করতেন। সংস্কৃত ও উর্দু ভাষার বিশিষ্ট পণ্ডিতদের রাষ্ট্রীয় সম্মানে সম্মানিত করা শুরু হয় ওঁরই উদ্যোগে।

এই চারিত্রিক মাধুর্য ও বিনয় আজ কোথায়?

মনে পড়ছে আরো একটা ঘটনা। রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ রাষ্ট্রীয় সফরে জাপান গিয়েছেন। একদিন এক রাষ্ট্রীয় ভোজের ঠিক আগে সহযাত্রী রাষ্ট্রপতি ভবনের এক কর্মী হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হলে উনি ভোজসভা বাতিল করতে উদ্যত হয়েছিলেন। তারপর প্রবীণ অফিসারদের পরামর্শে উনি ভোজসভায় যোগদান করলেও আবার রোগীর শয্যাপার্শে ফিরে আসেন।

মানুষের প্রতি এই দরদ, ভালবাসা না থাকলে কি সবার শ্রদ্ধা লাভ করা যায়?

আবার নিরীহ মানুষটি কত স্পষ্ট বক্তা ছিলেন ভাবলেও অবাক হতে হয়। ভারত সফর শেষে রাণী এলিজাবেথ দিল্লী ত্যাগ করার প্রাককালে উনি জানতে পারেন, রাজেন্দ্রবাবু ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হবার কাহিনী নিয়ে একখানা অতি গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন। সবিস্ময়ে রাণী এঁকে বললেন, সারা জীবনই নানা কাজে ব্যস্ত থেকেছেন। এই বই লেখার সময় পেলেন কখন?

রাজেন্দ্রপ্রসাদ নির্বিকারভাবে বললেন, আপনার বাবার জেলখানায় এত দীর্ঘদিন থেকেছি যে এ বই লিখতে কোন অসুবিধে হয়নি।

শুধু রাণী বা প্রিন্স ফিলিপ না, উপস্থিত ভারতীয় অফিসাররাও রাজেন্দ্রবাবুর স্পষ্টবাদিতার প্রমাণ পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন।

এই ধরণের মানুষ কি আবার রাষ্ট্রপতি হবেন না?

.

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীর নানা দেশের মানুষকে শিখিয়েছিল যে রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ বিশ্বের শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানা দেশের মধ্যে নিয়মিত বোগাযোগ রাখেন কূটনৈতিক মিশনের কূটনৈতিকরা কিন্তু সব সময় এই যোগাযোগের মাধ্যমেই সংশ্লিষ্ট দেশের ও বৃহত্তর ক্ষেত্রে বিশ্ব শান্তির স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব হয় না। যা প্রয়োজন তা হচ্ছে মাঝে মাঝে রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ। সে যোগাযোগ কখনও চিঠিপত্রের মাধ্যমে, কখনও বা ব্যক্তিগত দেখাশুনা-কথাবার্তার দ্বারা।

রাষ্ট্রনায়কদের রাষ্ট্রীয় সফর হয় আরো একটি কারণে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর মানচিত্র বড় দ্রুত গতিতে বদলাতে শুরু করে। নানা মহাদেশের নানা দেশ একের পর এক স্বাধীন হতে শুরু করে এবং কয়েক বছরের মধ্যেই জন্ম নেয় তৃতীয় বিশ্ব (থার্ড ওয়ার্লড কানট্রিস)। এই তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সব দেশই জন্ম নেয় নানা সমস্যার মধ্যে এবং সেসব সমস্যার সমাধানের জন্য এই সব দেশের রাষ্ট্রনায়ক অন্যান্য বহু দেশের সাহায্য ও সহযোগিতার প্রয়োজন অনুভব করলেন। প্রধানতঃ এই প্রয়োজনের তাগিদেই শুরু হল অন্য দেশের কর্ণধারদের আমন্ত্রণ জানান।

উন্নতশীল দেশের কর্ণধাররা অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রনায়কদের রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রণ জানান আরো একটি বিশেষ কারণে। বহু উন্নতশীল দেশেই গণতন্ত্র নেই, অনেক সময়ই একনায়কত্বের অধিকারীরা নিজেদের ভাবমূর্তি ও ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রনায়কদের রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রণ জানান।

এ ছাড়াও আরো একটি কারণ থাকে রাষ্ট্রীয় সফরের পিছনে। কোন কোন দেশ ও রাষ্ট্রপ্রধানরা অন্য দেশের রাষ্ট্রনায়কদের সার্টিফিকেট বড় পছন্দ করেন। আবার কিছু কিছু রাষ্ট্রনায়ক অন্য দেশে রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়ে নিজের গুরুত্ব বাড়ান।

যাইহোক ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার পর আমাদের রাষ্ট্রনায়করা যেমন রাষ্ট্রীয় সফরে নানা দেশে গিয়েছেন, সেই রকম বহু দেশের রাষ্ট্র নায়করাও আমাদের দেশে এসেছেন রাষ্ট্রীয় সফরে।

এই সব রাজা-রাণী বা প্রেসিডেন্ট-প্রাইম মিনিস্টারকে সাদরে অভ্যর্থনা জানান হয় দিল্লীর পালাম বিমানবন্দরে। দুপক্ষ থেকে দুটি ভাষণে পরস্পরকে মহান বলে উল্লেখ করা, মাননীয় অতিথির স্টেট ড্রাইড রাষ্ট্রপতি ভবনে অভ্যর্থনা, অবস্থান, রাজঘাটে শ্রদ্ধার্ঘ, পার্লামেন্ট বক্তৃতা, কটেজ ইণ্ডাষ্ট্রীজ এম্পোরিয়ামে কিছু অতি মূল্যবান জিনিষপত্র কেনা, রাষ্ট্রীয় ভোজ, কূটনৈতিক সম্বর্ধনা, নাগরিক সম্বর্ধনা ইত্যাদির খবর সব কাগজেই প্রকাশিত হয় ও দেশবাসী জানতে পারেন। কিন্তু এইসব রাষ্ট্রীয় সফরের কিছু নেপথ্য কাহিনী থাকে বা এইসব সফরের সময় এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা কোনদিনই সংবাদপত্রে ছাপা হয় না।

আইসেনহাওয়ার, ক্রুশ্চেভ, বুলগানিন, চু এন লাই, হো চি মীন, কুইন এলিজাবেথ, প্রিন্স ফিলিপ, নাসের, টিটো, সোয়েকৰ্ণ, ভরোশিলভ, জনসন, হারল্ড ম্যাকমিলান, ছারল্ড উইলসন, নক্রমা, উ নু ও আরো অনেক রাষ্ট্রনায়কদের কখনও দূর থেকে, কখনও খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। অনেক রাষ্ট্রপ্রধানদের সফরে আমিও সঙ্গী হয়েছি সাংবাদিক হিসেবে। এইসব সফরের সময় অনেক কিছু জেনেছি, দেখেছি। তার অনেক কিছুই ভুলে গেছি কিন্তু কিছু ঘটনা এখনও মনে আছে।

মনে পড়ছে কুইন এলিজাবেথের সফরের কথা।

নেহরু কিছু কিছু রাষ্ট্রপ্রধান ও রাষ্ট্রনায়কদের সফরের ব্যাপারে একটু অতিরিক্ত উৎসাহী হয়ে উঠতেন ও তাদের সফর সর্বতোভাবে আনন্দদায়ক ও সাফল্যজনক করার জন্য বিন্দুমাত্র ত্রুটি করতেন না। কুইন এলিজাবেথ ও প্রিন্স ফিলিপের ভারত সফরের আগেও বহু গণ্যমান্য বরেণ্য রাষ্ট্রপ্রধান ও রাষ্ট্রনায়করা দিল্লীর রাষ্ট্রপতি ভবনে থেকেছেন এবং নিঃসন্দেহে ভালভাবেই থেকেছেন। তবুও কুইন এলিজাবেথ আসার আগে নেহৰু অতি উৎসাহী হয়ে তাদের জন্য রাষ্ট্রপতি ভবনের ঘরগুলি নতুন করে সাজাবার হুকুম দিলেন। মহীশূর থেকে চন্দন কাঠ এনে নতুন খাট তৈরি হল। প্যানেলিংও হল চন্দন কাঠের। বাথরুম। কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয়ে পৃথিবীর আধুনিকতম ও সর্বাধিক মনোরম ব্যবস্থা করা হল। শুধু তাই নয় ঘরগুলির পুরানো আসবাবপত্র, পেন্টি, সিল্কের পর্দা সরিয়ে সবকিছু নতুন করা হল। এক কথায় এলাহি ব্যাপার। জ্যাকুলিন কেনেডি যখন দিল্লী সফরে এসে তিনমূর্তি ভবনে ছিলেন, তখন তাঁর জন্যও অনুরূপ এলাহি ব্যাপার হয়।

যাইহোক কুইন এলিজাবেথের সঙ্গে সারা দেশ ঘোরার সময় কয়েকটা মজার ঘটনা ঘটে। কুইনের সঙ্গে আমরা সত্তর-পঁচাত্তরজন। সাংবাদিক ঘুরছিলাম। তার মধ্যে জনদশেক মাত্র ভারতীয়, বাকি সব সব বিদেশী। তখন দিল্লী-লণ্ডন-দিল্লীর বিমান ভাড়া ছিল তিন হাজারের কিছু বেশি। আর কুইনের সঙ্গে ঘোরার জন্য আমরা এক একজন সাংবাদিক ভারত সরকারকে বিমান ভাড়া বাবদ দিয়েছিলাম প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকা। এ ছাড়া হোটেল, খাওয়া-দাওয়া ও স্থানীয় যানবাহনের খরচ বাবদ দিই আরো কয়েক হাজার টাকা। সব টাকাই আগাম দিতে হয়েছিল সরকারকে। বলা বাহুল্য সব সাংবাদিকের জন্যই একই বিধিব্যবস্থা ও সুযোগ-সুবিধা করা হয়েছিল।

অঘটন ঘটল জয়পুরে।

গুরমুখ নীহাল সিং তখন রাজস্থানের রাজ্যপাল। রাজ্যপালের অন্যতম পুত্র নীহাল সিং স্টেটসম্যানের প্রতিনিধি হয়ে আমাদেরই সঙ্গে কুইন্স প্রেস পার্টিতে ছিলেন। হঠাৎ দুপুরবেলায় রামবাগ প্যালেসে বসে আমরা খবর পেলাম রাজভবনে কুইন ও প্রিন্স ফিলিপের জন্য রাজ্যপাল আয়োজিত প্রাইভেট লাঞ্চে রাজপাল তার পুত্রকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। খবরটা যখন এলো তখন লাঞ্চ প্রায় শেষ। খবরটা সব সাংবাদিককেই বিচলিত করল এবং বিচলিত হবার দুটি কারণ ছিল। প্রথমতঃ কুইন্স প্রেস পার্টির সব সদস্যই সমান অধিকার পাবার অধিকারী এবং কোন কারণেই বিশেষ একজন কোন বিশেষ সুযোগ– সুবিধা দেওয়া যেতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ কুইন কোন রাজনৈতিক বক্তৃতাদি দিতেন না বলে অন্য ধরণের বৈচিত্রময় খবরই সাংবাদিকদের পরিবেশন করতে হত। সে ক্ষেত্রে যদি কোন সাংবাদিক একাকুইনের কোন অনুষ্ঠানের কোন ধরণের কথাবার্তা গল্পগুজব তাঁর পত্রিকায় রিপোর্ট করেন, তাহলে অন্য সংবাদপত্র প্রতিনিধিদের পেশাগত আপত্তি থাকার অবশ্যই কারণ আছে।

যাই হোক হিন্দুস্থান টাইমস্-এর শ্ৰীমতী প্রমীলা কলহান ও আমি খবরটির সত্যাসত্য যাচাই করার জন্য রাজ্যপালের কাছে গেলাম। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে উনি আমাদের বললেন, নীহালকে লাঞ্চে ডেকেছিলুম। তাছাড়া চীফ সেক্রেটারীকে বলেছি, কুইন ও প্রিন্সের সঙ্গে ওকে সাওয়াই মধুপুর ফরেস্ট যাবার ব্যবস্থা করে দিতে।

শুনে আমরা দুজনেই হতবাক। কোন প্রতিবাদ ও তর্ক না করে আমরা ফিরে এসে কুইন্স প্রেস পার্টির ভারপ্রাপ্ত অফিসার মিঃ মেননকে সবকিছু বলে প্রতিকার দাবী করলাম। এখানে বলা প্রয়োজন যে এই অফিসারটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রচার দপ্তরের অধিকর্তা ও একজন অতি বিখ্যাত ভূতপূর্ব রাষ্ট্রদূতের জামা ছিলেন। সাংবাদিকদের তার সঙ্গে অনেক তর্ক-বিতর্ক হল। সব শেষে উনি বললেন, যদি কেউ ভাল পরিবারের ছেলে হয় বা ভাল পারিবারিক যোগাযোগ থাকে, তাহলে তিনি কী করবেন?

ভদ্রলোকের কথার প্রতিবাদ করলেন অনেকেই। আমি ওকে বললাম, আমি গরীব স্কুলমাস্টারের ছেলে। বাপের সুপারিশ বা শ্বশুরমশায়ের কৃপায় আমি কুইল প্রেস পার্টিতে আসিনি বা কোন সুযোগ-সুবিধা চাই না। যাদের নিজেদের উপর আস্থা নেই এবং যারা অকর্মন্য তারাই বাপ-শশুরের নাম ভাঙিয়ে কাজ হাসিল করে।

আমার কথায় ভদ্রলোক তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন।

কুইন্স প্রেস পার্টির সম্মানে মুখ্যমন্ত্রী মোহনলাল সুখাদিয়ার পার্টির সময় হয়ে এসেছিল বলে তর্ক-বিতর্ক ঐখানেই থামল। ঐ পার্টিতে গিয়েই সুখাদিয়াকে সবকিছু বলে জানালাম, একজন সাংবাদিককে বিশেষ সুযোগ দেওয়া ও প্রেস পার্টির ভারপ্রাপ্ত অফিসারের নিন্দনীয় মনোভাবের প্রতিবাদে আমরা কেউ কুইন-এর খবর পাঠাব না। আমরা নেহরুকে সব জানিয়ে টেলিগ্রাম পাঠাব, তাও ওকে বললাম।

সবকিছু শুনে সুখাদিয়া কি খুশি। উনি রাজ্যপালের বিরুদ্ধে অনেক কথা জানিয়ে আমাকে বললেন, টেলিগ্রাম এখুনি টাইপ করে আমাকে দাও। আমি ওয়ারলেস-এ পাঠিয়ে দিচ্ছি।

আমি মহা উৎসাহে টেলিগ্রাম টাইপ করলাম। প্রেরকদের মধ্যে সবার প্রথমে নাম রইল আমার ও প্রমীলাদির। দুচারজন সাংবাদিক নিজেদের নাম দিতে ভয় পেলেন বলে তাদের নামের উল্লেখ করা হল না।

আমি টেলিগ্রামের কপি সুখাদিয়াকে দিতেই উনি সঙ্গে সঙ্গে চীফ-সেক্রেটারীর হাতে দিয়ে বললেন, এটা এখুনি পুলিশ ওয়ারলেস-এ পাঠিয়ে দিন।

তখন বিকেল সাড়ে চারটে-পাঁচটা হবে।

রিসেপসন-ককটেল-ডিনার ইত্যাদি সেরে আমরা রামবাগ প্যালেসে ফিরলাম অনেক রাত্রে। বোধ হয় বাবোটা-সাড়ে বারোটা হবে। আমি আর আমার রুমমেট ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মিঃ দার জামাকাপড় বদলে শুতে যাচ্ছি, এমন সময় কে যেন দরজায় ঠক্ ঠক্ আওয়াজ করলেন। দরজা খুলতেই দেখি, একজন আর্মি মেসেজার। উনি সেলাম করে যে সীল করা খামটি দিলেন, সেটা খুলে দেখি প্রাইম মিনিস্টারের টেলিগ্রাম–সব সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহের সমান সুযোগ পাচ্ছেন না জেনে অত্যন্ত দুঃখিত হলাম। যাই হোক ভারত-বৃটেনের মৈত্রীর স্বার্থে ও রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি যথোচিত সম্মান দেখানোর জন্য রাণীর সফরের সংবাদ পরিবেশন বন্ধ না রাখলে অত্যন্ত সুখী হব। ভবিষ্যতে আপনাদের কাজে কোন অসুবিধা হবে না এবং সেজন্য প্রয়োজনীর ব্যবস্থা করছি। আমি আর দার প্রায় দৌড়ে গিয়ে প্রমীলাদিকে সবার আগে খবর দিলাম। স্বাভাবিক ভাবেই একটু হৈ চৈ শুরু হল সাংবাদিকদের মধ্যে।

আধঘণ্টা পরেই আবার টেলিগ্রাম। কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতার মন্ত্রী বি. ভি. কেশকার লিখেছেন, আপনাদের অসুবিধার খবর জেনে দুঃখিত। যাই হোক অনুগ্রহ করে রাণীর সফরের খবর পরিবেশন করা বন্ধ করবেন না। প্রাইম মিনিস্টার যথোচিত ব্যবস্থা নিচ্ছেন।

এর কিছুক্ষণ পরেই আবার দরজায় করাঘাত। রাত তখন দুটো আড়াইটে হবে। দরজা খুলে দেখি, ভারতীয় বিমান বাহিনীর জনপ্রিয় জনসংযোগ অফিসার উইং কমাণ্ডার মালিক। উনি ঘরে ঢুকেই আমাকে বললেন, তুমি যে কি কেলেঙ্কারী করে!

কেন?

আমাকে কুইন্স প্রেস পার্টির চার্জ নিতে হবে। আর যে স্পেশ্যাল প্লেনে এসেছি, সেই প্লেনেই এখুনি মেননকে ফেরত পাঠাতে হবে।

আমি আনন্দে উইং কমাণ্ডার মালিককে জড়িয়ে ধরে বললাম, আপনার দ্বিধা করার কোন কারণ নেই। এই সুখবরটা আমিই মেননকে জানিয়ে আসছি।

উনি হাসতে হাসতে বললেন, মেননের অনেক উপকার করেছ। তোমাকে ওর আর উপকার করতে হবে না।

গভীর রাত্রে মেনন যখন অখোবদনে রামবাগ প্যালেস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে বললাম, বন ভয়েজ, হাপি ল্যাণ্ডিং।

দুপুরবেলায় যিনি বাঘের মত হুঙ্কার দিচ্ছিলেন, এই গভীর রাত্রে তিনিই মুষিকের মত রামবাগ প্যালেস থেকে বেরিয়ে গেলেন।

হ্যাঁ, যে নীহাল সিংকে নিয়ে এতকিছু ঘটল, তিনি কিন্তু নীরব। তাঁর মধ্যে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখলাম না। সেদিন থেকে নীহাল সিংকে শ্রদ্ধা করতে শুরু করি।

জয়পুর রাজভবনের লাঞ্চে রাণীর গল্পগুজবের খবর স্টেটসম্যানে ছাপা হয়নি। দিল্লীতে ফিরে শুনেছিলাম, নেহরু নিজে স্টেটসম্যানের সম্পাদক জনসনকে সব জানিয়ে বলেছিলেন, আপনি যা ভাল মনে করেন, তাই করবেন। আদর্শবান সাংবাদিক হিসেবে জনসন ঐ সংবাদ প্রকাশ করা উচিত মনে করেননি।

রাণী এলিজাবেথের সঙ্গে সারা ভারত নেপাল সফরের সময় নানা ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল এবং তার মধ্যে দুটি-একটি অভিজ্ঞতার কথা বোধ হয় সারা জীবনেও ভুলব না।

রাণীর সফরের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক ছিল না। তিনি ও প্রিন্স ফিলিপ প্রায় টুরিস্টের মতই সারা দেশ ঘুরছিলেন। তার সঙ্গে ব্রিটেন ও কমনওয়েলথের প্রধান হিসেবে যথোচিত আদর-আপ্যায়ণ ইত্যাদি।

আমাদের কুইন্স প্রেস পার্টির দিন শুরু হতো সাত-সকালে রাণীর লেডি-ইন-ওয়েটিংয়ের ব্রিফিং দিয়ে। উনি সেই সাত সকালেই আমাদের জানিয়ে দিতেন, সেদিন রাণী কখন কার ডিজাইন ও কোথায় তৈরি করা কি ধরনের পোশাক পরবেন। কখন কি গহনা ব্যবহার করবেন।

এর পর রাণী ও প্রিন্স ফিলিপ, লর্ড মার্লবোরা, শ্ৰীমতী বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত প্রভৃতির সঙ্গে প্রাতঃকালীন শুভেচ্ছা বিনিময় করেই আমরা ভিভিআইপি পার্টির সঙ্গে নানা দ্রষ্টব্য দেখতে যেতাম। দুপুরে প্রাইভেট লাঞ্চ। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর আবার ঘোরাঘুরি। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ককটেল এবং ব্যাংকোয়েট বা বিশেষ ভোজসভা। মোটামুটি এই ছিল সারাদিনের প্রোগ্রাম।

রাণী যখন যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁকে দেখতে আসতেন। পথে-ঘাটে সর্বত্র সব সময় ভীড় হতো। এ তত গেল সাধারণ মানুষের কথা। যারা তথাকথিত গণ্যমান্য বা বিশিষ্ট তাদের মধ্যেও রাণী সম্পর্কে অস্বাভাবিক আগ্রহ দেখতাম। রাণীর কোন না কোন অনুষ্ঠানে যোগ দেবার জন্য অসংখ্য গণ্যমান্য মানুষের যে হাংলামী দেখতাম, তা ভাবলে অবাক লাগে। রাণীকে একটু কাছ থেকে দেখে বা তাঁর কোন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তথাকথিত সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য বহু ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা এবং মেয়েরা যে কি করতেন, তার পুরো বৃত্তান্ত লিখতেও ঘেন্না হয়। তবু কিছু না লিখে পারছি না।

রাণী আমেদাবাদ থেকে করাচী যান। সেখানে থেকে পূর্ব পাকিস্তানে। সেখান থেকে ফিরে দ্বিতীয় পর্যায়ের ভারত সফর শুরু হয় দুর্গাপুর থেকে। ভারতীয় সাংবাদিকদের পাকিস্তান সরকার ভিসা না দেওয়ায় কুইন্স প্রেস পার্টিকে নিয়ে এয়ার ইণ্ডিয়ার সুপার কনস্টেলেশন বিমানটি রাণী পৌঁছবার আগের দিনই দিল্লী থেকে পানাগড় পৌঁছে যায়। সেখান থেকে দুর্গাপুর।

সেদিন সন্ধ্যায় ও রাত্রে সাংবাদিকদের কোন কাজ ছিল না বলে জমিয়ে আড্ডা দেবার ব্যবস্থা হল। কিছু সাংবাদিক ও টি. ভি. ক্যামেরাম্যান শুধু আড্ডা দিয়ে এমন একটি সন্ধ্যা ও রাত্রি নষ্ট করতে চাইলেন না; তাই ওরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন দুর্গাপুরের এদিক ওদিক আর আসানসোলের আশেপাশে ঘুরতে। কুইন্স প্রেস পার্টির এইসব রসিক সাংবাদিকরা বোধ হয় দুখানা গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু ফিরে এলেন পাঁচ-সাতখানা গাড়ি করে। সে সব গাড়ি বোবাই। হয়ে এলেন দুর্গাপুর-আসানসোল-বার্ণপুর শিল্পাঞ্চলের বেশ কিছু গণ্য মান্য অফিসার ও তাদের স্ত্রী ও বোনেরা। কুইন্স প্রেস পার্টির সদস্যদের সঙ্গে সারা রাত্রি মদ খাওয়া আর নাচ-গান করা কি কম সৌভাগ্যের কথা? ওদের খুশি করলে রাণীকেও খুব কাছ থেকে দেখা যাবে। হয়ত রাণীর সঙ্গে ছবিও উঠতে পারে। এসব কী সব অফিসার ও তাদের স্ত্রী-বোনের ভাগ্যে হয়?

আহা! এই পরম সৌভাগ্য লাভের আশায় কিছু অফিসারের স্ত্রী ও বোনেরা হাসতে হাসতে কিভাবে নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছিলেন।

তবে আরো মজার ঘটনা দেখেছিলাম এক দেশীয় রাজ্যের রাজপ্রাসাদে। রাণী এলিজাবেথ ও প্রিন্স ফিলিপ ভারত সফরে এসে নানা জায়গা ঘুরতে ঘুরতে ঐ দেশীয় রাজ্যের রাজধানীতে এলেন। রাজপ্রাসাদে তাদের সম্বর্ধনার এলাহি ব্যাপার। অনেক অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল রিসেপসন। কুইন্স পার্টির সম্মানে ছিল ককটেল। বিরাট প্রাসাদের কয়েকটি ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ থেকেই রাণী ও প্রিন্স ফিলিপ বিদায় নিয়েছেন। বিদায় নিয়েছেন লর্ড মার্লবোরা, শ্ৰীমতী বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, ব্রিটিশ হাইকমিশনার ও আরো কয়েকজন। আনন্দ উৎসবে আমরাও মেতে আছি। রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে কিন্তু ককটেল চলছে। চলছে নাচগান হৈ-হুঁল্লোড়। রসিকের দল তখনও মত্ত থাকলেও ঘড়ির কাঁটা মাঝ-রাত্তির ছুঁই ছুঁই করছে দেখেই. দু একজন বন্ধুকে নিয়ে পার্টি ছেড়ে বেরুলাম। হঠাৎ মনে হল, দেখি তত অন্যান্য স্বরে কি হচ্ছে। একটি ঘর পেরিয়ে দ্বিতীয় ঘরে ঢুকেই চক্ষু ছানাবড়া। কয়েকজন সুন্দরী যুবতী ও বন্ধু প্রায় উলঙ্গ হয়ে মেঝেয় গড়াগড়ি দিচ্ছেন কিন্তু কয়েকজন অতি রসিক ইংরেজ ও ভারতীয় অফিসাররা চূড়ান্ত প্রমত্ত অবস্থায় তাদের জড়িয়ে রয়েছেন। আহা! সে কি দৃশ্য। বুদ্ধ গান্ধীর দেশের সামান্য মৰ্ত্তবাসী হয়ে অমরাবতী-অলকানন্দর দৃশ্য। দেখে আমি তাজ্জব। একটু এগিয়ে না গিয়ে পারলাম না কিন্তু কাছে যেতেই চমকে উঠলাম। সবাইকে চিনতে পারলাম না কিন্তু দুজন নায়িকাকে দেখেই চিনলাম এবং বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। এই দুজন শুধু বাঙালী মেয়েই নন, কলকাতার অতি বিখ্যাত পরিবারের কন্যা ও বধূ! খ্যাতি, যশ, অর্থ, প্রতিপত্তি–সব কিছু এই পরিবারের আছে এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই ভারতবর্ষের নানা দেশীয় রাজ্যের রাজপরিবারের সঙ্গে এদের গভীর হৃদতা আছে। এরা অবশ্যই সেই সূত্র ধরে রাণীর সফর উপলক্ষে কলকাতা থেকে ওখানে গিয়েছিলেন।

যাই হোক পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট খেতে গিয়েই দেখি, ঐ দুজন বাঙালী নায়িকা একটা টেবিলে বসে আছেন। চেহারা দেখেই বুঝলাম, রাত্রে ওদের উপর দিয়ে সাইক্লোন বয়ে গেছে। ওদের কাছে গিয়ে মাথা নীচু করে হাসি মুখে বললাম, গুড মর্ণিং।

ওরা দুজনেই হেসে বললেন, মর্ণিং!

এবার সোজাসুজি বাংলায় বললাম, কাল রাত্রের পার্টিটা খুব জমেছিল, তাই না?

ওরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি কুইন্স পার্টিতে আমার মত একটি বঙ্গজ সন্তান থাকতে পারে। তাই আমার কথায় ওরা দুজনে চমকে উঠে কোন মতে বললেন, হ্যাঁ।

আবার আমি বললাম, কাল রাত্রে আপনাদের দুজনকে দেখে খুব ভাল লাগল। কুইনের সঙ্গে এত ঘুরছি কিন্তু আপনাদের মত এমন প্রাণবন্ত ও স্ফুর্তিবাজ মেয়ে দেখিনি। রিয়েলি আই ওয়াজ ভেরি ভেরি হ্যাপি টু সী ইউ ইন সাচ এ মুড লাস্ট নাইট।

আমি আর এক মুহূর্ত দেরি না করে অন্য টেবিলের দিকে এগুলাম। ওরা নির্বাক হয়ে বসে রইলেন।

এই সফরের সময় আরো অনেক মজার ঘটনা ঘটেছিল।

কুইন্স প্রেস পার্টির আমরা সবাই এয়ার ইণ্ডিয়ার একটা সুপার কনস্টেলেশনে ঘুরতাম। ইণ্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একজন আঞ্চলিক অধিকর্তা মিঃ শ্রীবাস্তব ছিলেন কুইন্স পার্টির এয়ার মুভমেন্ট অফিসার। উনিও আমাদের প্লেনেই সফর করতেন। রাণী ঘুরতেন তার রয়্যাল ব্রিটানিকাতে। আমাদের প্রেস পাটির প্লেনে একজন মাত্র এয়ার হোস্টেস ছিলেন। আর কয়েকজন স্টুয়ার্ট। এয়ার হোস্টেস মেয়েটি অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ছিল। রঙ একটু চাপা হলেও মেয়েটি অত্যন্ত সুন্দরী ছিল এবং তাকে নিয়ে কুইন্স প্রেস পার্টিতে বেশ সরস আলোচনা হতো।

মিঃ শ্রীবাস্তব বেশ বয়স্ক ছিলেন এবং দেখতেও বিশেষ ভাল ছিলেন না। কালো মোটা ও মুখে বসন্তের দাগওয়ালা এই প্রবীণ অফিসারটি সুযোগ পেলেই এয়ার হোস্টেস মেয়েটির গায়ে হাত দিয়ে কথাবার্তা বলা বা আইল দিয়ে যাতায়াতের সময় একটু ধাক্কা লাগাতে বড় ভালবাসতেন। আমি বেশ বুঝতে পারতাম মেয়েটি ওর এই ব্যবহার একটুও পছন্দ করেন না কিন্তু মুখে কিছু বলার সাহস হয় না। আর লক্ষ্য করতাম একজন স্টুয়ার্টের কাছে ও যেন একটু বেশী সহজ ও ঘনিষ্ঠ। অনুমান করলাম, ওদের মধ্যে ভালবাসা আছে।

আমি একদিন মিঃ শ্রীবাস্তবকে হাসতে হাসতে বললাম, আমার মত ইয়াং স্যাণ্ডসাম লোক থাকতে আপনি কেন মেয়েটির সঙ্গে খাতির করার চেষ্টা করেন?

এই ঘটনার পর মিঃ শ্রীবাস্তব সত্যি একটু সংযত হলেন এবং মেয়েটি ও স্টুয়ার্ট আমার খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।

কলকাতা থেকে আমাদের প্লেন মাদ্রাজ রওনা হওয়ার পর পরই প্রেস লিয়াজো অফিসার আমাদের হাতে মাদ্রাজের প্রোগ্রাম, নানা অনুষ্ঠানের নেমন্তন্ন কার্ড, থাকা ও গাড়ির বিধিব্যবস্থার কাগজপত্র হাতে দিলেন। মাদ্রাজে রাণীর সম্মানে রাজভবনে যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তাতে বিখ্যাত অভিনেত্রী ও নৃত্য শিল্পী পদ্মিনীর নাচ ছিল। আমাদের প্রেস প্লেনের কমাণ্ডার অব দ্য এয়ারক্রাফটকে এই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ-লিপি দেওয়া হলেও বিমানের আর কোন কর্মীকে আমন্ত্রণ করা হয় না। প্লেনের মধ্যে ঘোরাঘুরি করার সময় এয়ার হোস্টেস আর ঐ স্টুয়ার্টের কথাবার্তা শুনে বুঝলাম, ওরা পদ্মিনীর নাচ দেখতে খুবই ইচ্ছুক কিন্তু দেখা হবে না।

আমি সঙ্গে সঙ্গে ঐ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আমার কার্ডটি এনে স্টুয়ার্টকে দিয়ে বললাম, আপনি এই কার্ড নিয়ে চলে যাবেন। আর মেয়েটিকে বললাম, আমাদের রওনা হবার আগে আপনি একটা সুন্দর শাড়ি পরে হোটেলে আমার কাছে আসবেন এবং আমি আপনাকে নিয়ে যাব।

প্রেস পার্টির কোন সদস্যরই কোন অনুষ্ঠানে যোগ দেবার জন্য কার্ড লাগত না। কারণ আমরা সব সময় ভিআইপি কনভয়ের গাড়িতেই যেতাম। তাই সেদিন সন্ধ্যায় এয়ার হোস্টেস মেয়েটিকে নিয়ে আমি নির্বিবাদে রাজভবনে পৌঁছলাম। অনুষ্ঠান হলে প্রবেশের সময় আমি আলতো করে মেয়েটির হাত ধরে প্রবেশ করলাম। প্রবেশদ্বারের অফিসাররা ভাবলেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী।

হলে প্রবেশ করেই আমি মেয়েটিকে বললাম, যান, আপনার বন্ধুর কাছে গিয়ে বসুন।

অশোককুমারের দৌলতে পদ্মিনীর সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল। তাই অনুষ্ঠান শেষে আমি ওদের সঙ্গে পদ্মিনীর পরিচয় করিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বললাম, জানেন, আমি আর এই বিমান সেবিকাটি কয়েক মিনিটের জন্য স্বামী-স্ত্রীর অভিনয় করেছি।

আমার কথায় সবাই হেসে উঠলেন।

এমন সময় হঠাৎ আমাদের পুরনো বন্ধু ও ফিল্ম ডিভিশনের ক্যামেরাম্যান রাও মঞ্চে এসে আমাকে বলল, পদ্মিনী যদি আবার নাচেন তাহলে আমি ভাল করে তুলে নিতাম।

রাও এর অনুবোধ পদ্মিনীকে জানাতেই উনি আবার পর্দার আড়ালে বেশ কিছুক্ষণ নাচলেন। এয়ার হোস্টেস ও স্টুয়ার্ট মহা খুশি। পদ্মিনীকে ধন্যবাদ জানিয়ে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে আসতেই রাও হাসতে হাসতে বলল, জানিস, আমার ক্যামেরায় ফিল্মই ছিল না।

রাও আবার হাসতে হাসতে বলল, অত কাছ থেকে অমন একজন অভিনেত্রী ও ডালারের নাচ দেখার লোভ কী ছাড়া যায়?

রাণী এলিজাবেথের সফরে আবো কিছু মজার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। মনে পড়ছে আমেদাবাদের কথা।

আনুষ্ঠানিক নৈশ ভোজের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে রাজভবনের বিস্তীর্ণ লনে। সবরমতীর তীরে আজকের এই রাজভবনেই এককালে প্রথম ভারতীয় আই-সি-এস সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর বাস করতেন এবং সে সময় রবীন্দ্রনাথও এখানে এসেছেন। যাই হোক অন্যান্য নানা অনুষ্ঠানের পর গুজরাটীদের বিবাহ উৎসবও রাণী ও প্রিন্স ফিলিপকে দেখান হয়। অনুষ্ঠান শেষে রাণী ও প্রিন্স ফিলিপ মঞ্চে উঠে সমস্ত শিল্পীদের সঙ্গে মিলিত হন ও তাদের অভিনন্দন জানান। হঠাৎ ফিলিপ নকল বিবাহ অনুষ্ঠানের বরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি সত্যিকার স্বামী-স্ত্রী?

সলজ্জ হাসি হেসে ছেলেটি বলল, না।

প্রিন্স এবার গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করলেন, তুমি কি বিবাহিত?

না।

এবার বিবাহের পাত্রীকে প্রিন্স জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের দেশে তো অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে হয়। তা তোমারও কি বিয়ে হয়ে গেছে?

মেয়েটি একটু হেসে বলল, না।

অনুষ্ঠানের গণ্যমান্য দর্শকদের সামনেই প্রিন্স ওদের দুজনের লেখাপড়া ও পরিবারের খোঁজখবর নিলেন। জানা গেল, দুটি ছেলেমেয়েই অত্যন্ত সম্রান্ত পরিবারের সন্তান ও দুজনেই উচ্চশিক্ষা লাভ করেছে। এবার প্রিন্স ওদের দুজনকে একটু কাছে নিয়ে বললেন, তোমাদের দুজনকেই দেখতে অত্যন্ত সুন্দর। এবার তোমরা বল, দুজনে দুজনকে পছন্দ হয় কিনা।

প্রিন্সের প্রশ্ন শুনে বিশিষ্ট অতিথিরা হেসে ওঠেন আর লজ্জায় ছেলেমেয়েটি মুখ নীচু করে হাসে।

ওদের পাশে দাঁড়িয়ে রাণী, শ্ৰীমতী বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, লর্ড মার্লবোরা, গুজরাতের গভর্ণর ও মুখ্যমন্ত্রী হাসেন।

প্রিন্স চুপ করে থাকেন না। বলেন, আমি জানি, এ দেশের ছেলেমেয়েরা অধিকাংশ সময়ই নিজেদের পছন্দমত বিয়ে করতে পারে না। তাই বলছি, তোমরা খোলাখুলি বল বিয়ে করবে কিনা। প্রিন্স একটু হেসে বললেন, তোমরা বিয়ে করতে চাইলেও হয়তো বাবা মার আপত্তির জন্য বিয়ে করতে পারবে না। তাইতো তোমরা যদি

তোমাদের মনের ইচ্ছা আমাকে জানাও, তাহলে এখনই তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা আমি পাকাপাকি করে দিতে পারি।

প্রিন্সের কথায় আমরা সবাই হো হো করে হাসি।

মঞ্চ থেকে নেমে আসার আগে প্রিন্স বললেন, আমার মনে হয়, তোমাদের বিয়েতে তোমাদের অভিভাবকরা আপত্তি করবেন না। যাই হোক আমি তোমাদের দুজনকে শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলাম।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি একটু দীর্ঘই ছিল। তারপর এইসব ঘটনার জন্য অনেক রাত হয়ে যায়। অনুষ্ঠান শেষে আমরা রাণী ও প্রিন্সের পিছন পিছন হাঁটছি। আমার বিশেষ বন্ধু ওকুইন্স প্রেস পার্টির অন্যতম সদস্য গার্ডিয়ান পত্রিকার মাইকেল ওয়াল হঠাৎ ঘড়ি দেখেই আমাকে বলল, নিমাই, আর দুঘণ্টা পরেই তো লগেজ হাওভার করতে হবে। আজ আর ঘুম হবে না।

এই প্রসঙ্গে দুএকটি কথা বলা প্রয়োজন। ভিভিআই-পির সঙ্গে সফর করা নিশ্চয়ই বিশেষ সৌভাগ্যের ব্যাপার। অনেক বিচিত্র ও অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় হয় এইসব সফরে কিন্তু সেই সঙ্গে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়।

রানী এলিজাবেথের ভারত সফরের সময় প্রেস পার্টির জন্য এয়ার ইণ্ডিয়ার একটা আলাদা বিমান ছিল। রাণীর রয়্যাল ব্রিটানিকা বিমান ছাড়ার আধঘণ্টা আগেই কুইন্স প্রেস পার্টির বিমান রওনা হত এবং নতুন শহরে-নগরে রাণীর স্বাগত অভ্যর্থনা আমরা কভার করতাম। রাণীকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য বিমানবন্দরে যে গণ্যমান্যবরেণ্যরা উপস্থিত থাকতেন, তারাও আমাদের সৌভাগ্য দেখে ঈর্ষান্বিত হতেন। ভি-ভি আই-পির সহযাত্রী বলে তখন আমরাও ভি-আই-পি। আমাদের থাকা-খাওয়া গাড়ি-ঘোড়া ঘোরা-ফেরার তদারক করতেন অতি উচ্চপদস্থ অফিসারের দল। শুধু কি তাই? আমাদের মালপত্র দেখাশুনার জন্য ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চপদস্থ অফিসার ও একদল সাধারণ অফিসার নিযুক্ত থাকতেন। তবে আমাদের বিমান রওনা হবার চার ঘণ্টা আগে আমাদের মালপত্র, ওদের হাতে দিয়ে দিতে হতো। তারপর সব মালপত্র নিয়ে একখানি বিমান রাণীর বিমান ছাড়ার তিন ঘণ্টা আগেই পরবর্তী গন্তব্যস্থলে রওনা হতো এবং সেখানে আমাদের পৌঁছবার বহু আগেই আমাদের মালপত্র যার যার নির্দিষ্ট ঘরে পৌঁছে যেত। অর্থাৎ রাণী কোন শহর থেকে সকাল আটটার সময় রওনা হলে আমাদের মালপত্র জমা দিতে হতে রাত সাড়ে তিনটেয় এবং সেজন্য এর ঘণ্টাখানেক আগেই আমাদের বাথরুমে ঢুকতে হতো ও সাড়ে তিনটের মধ্যেই সাজগোজ সারতে হত। রাত একটা পর্যন্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ককটেল পার্টিতে থাকার পর রাত সাড়ে তিনটের মধ্যে সারাদিনের মত তৈরী হয়ে নেওয়া নিশ্চয়ই খুব সুখকর নয়। তাই আমেদাবাদ রাজভবন থেকে বেরুবার সময় ওয়াল আমাকে বলল, আজ আর ঘুম হবে না।

পরের দিন সকালেই রাণীর করাচী যাত্রা। তাছাড়া রাণীর সফরসূচীর বিন্দুমাত্র অদলবদল তো হবে না। তাই আমি মাইকেল ওয়াকে বললাম, এখন ঘুমুলে নিশ্চয়ই ঠিক সময় তৈরী হওয়া যাবে, না। গল্প করেই আমাদের সময় কাটাতে হবে।

আমাদের ঠিক সামনেই হাঁটছিলেন রাণী, প্রিন্স ফিলিপ, লর্ড মার্শবোরা ও ব্রিটেনে নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার শ্রীমতী বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত। রাণী মাইকেল ও আমার কথা শুনতে পেয়েই লর্ড মার্ক্সবোরাকে বললেন, লর্ড, প্লীজ চেক আপ হোয়াট দ্য প্রেস বয়েজ বিহাইণ্ড মী আর সেইং।

সঙ্গে সঙ্গে লর্ড মার্লবোরা একটু পিছিয়ে এসেই মাইকেলকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি বলাবলি করছিলে তা কুইন জানতে চাইছেন।

কুইনের নাম শুনেই রাজভক্ত মাইকেলের চক্ষু ছানাবড়া। লজ্জায় সে প্রায় মারা যায় আর কি। ওর অসহায় অবস্থা দেখে আমিই লর্ড মার্লবোরাকে বললাম, ঘণ্টা আড়াই পরেই প্রেস পার্টির লগেজ হাণ্ডওভার করতে হবে। তাই বলছিলাম, আজ আর ঘুম হবে না।

লর্ড মার্লবোরা সঙ্গে সঙ্গে রাণীকে সে কথা জানালেন এবং রাণী সঙ্গে সঙ্গে শ্রীমতী পণ্ডিতকে বললেন, আমরা আপনার দেশে কাল সকালে যদি একঘণ্টা বেশি থাকি তাহলে কি আপনাদের খুব অসুবিধে হবে?

শ্ৰীমতী পণ্ডিত সঙ্গে সঙ্গে বললেন, এ তো পরম সৌভাগ্যের কথা।

এবার রাণী লর্ড মার্লবোরা ও ভারতস্থ ব্রিটিশ হাই কমিশনারকে বললেন, আপনারা এখুনি প্রেসিডেন্ট আয়ুবকে জানিয়ে দিন, আমি একঘণ্টা দেরিতে পাকিস্তান পৌঁছব। দ্য বয়েজ মাস্ট হাভ সাম শ্লিপ। একটু না ঘুমুলে ওরা সারাদিন কাজ করবে কি করে?

রাণীর এই সিদ্ধান্তের জন্য সাংবাদিকরা সে রাত্রে সত্যি একটু ঘুমিয়েছিলেন।

এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ছে ঠিক বিপরীত একটি অভিজ্ঞতার কথা।

প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গে নির্বাচনী সফরে গেছি মধ্যপ্রদেশ। সারা দিনে উনি দশ-বারোটা নির্বাচনী সভায় ভাষণ দিচ্ছেন এবং সেইসঙ্গে শত শত মাইল ঘুরতে হচ্ছে। কখনও কখনও হঠাৎ পথের ধারের জনতার অনুরোধেও প্রধানমন্ত্রী দুপাঁচ মিনিট বক্তৃতা দেন। কখনও আবার হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে আশেপাশের গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলেন। সুযোগ পেলে ওদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে একটু-আধটু রসিকও করেন।

সাধারণ মানুষ নেহরুকে চুম্বকের মত টানত এবং তাই আমরা যে কজন সাংবাদিক ওঁর সঙ্গে সফর করছিলাম, তাদের প্রতি মুহূর্ত অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হতো। হাজার হোক নেহরু। ওঁর সবকিছুই তো নিউজ। নেহরুর এই ধরণের সফর কভার করার একটা সমস্যা ছিল। উনি এক এক সময় ভাবাবেগে এমন এক একটি মন্তব্য করতেন, যা ঔরই আর একটি মন্তব্যের ঠিক বিপরীত। একই দিনে অনেক সভাসমিতিতে বক্তৃতা দিলে এই ধরণের সমস্যা দেখা দিত। নেহরুর প্রতিটি মন্তব্যে দেশের মধ্যে ও বিদেশে নানা রকম প্রতিক্রিয়া হতো বলে এই ধরণের পিরীতধর্মী মন্তব্য রিপোর্ট করা সম্পর্কে আমাদের যেমন সমস্যা দেখা দিত, সেই রকম সতর্ক থাকতে হতো। তবে অধিকাংশ সময়ই নেহরু নিজে এই সমস্যার সমাধান করে দিতেন।

ঐ মধ্যপ্রদেশ সফরের সময় আমরা ( নেহরুর সফর সঙ্গী সাংবাদিকরা) প্রত্যেকটি সভার আলাদা আলাদা রিপোর্ট পাঠাতাম না। সারা দিনের সব সভার মূল ও প্রধান প্রধান বক্তব্যগুলিকে নিয়ে একটা বড় রিপোর্ট লিখতাম এবং সে খবর পাঠাবার আগে নেহরু নিজে একবার দেখে দিতেন। এইভাবেই দুটো দিন কাটল।

তৃতীয় দিনেও ঐ একই কর্মসূচী। সকাল আটটা-সাড়ে আটটায় ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা। তারপর পাঁচ-সাতটা ছোট-বড় মিটিং-এর পর চার-পাঁচশ মাইল দূরে কোন শহরে বা গ্রামের সরকারী আস্তানায় মধ্যাহ্ন ভোজন। আধঘণ্টার বিশ্রামের পরই আবার যাত্রারম্ভ। রাত সাড়ে আটটা-নটায় রাত্রি যাপনের জন্য যেখানে পৌঁছলাম তা সত্যিই হট্ট মন্দির। অত্যন্ত ছোট দুখানি পাকা ঘর। এখানে প্রধানমন্ত্রীর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে এবং তার সহযাত্রী সরকারী অফিসার ও সাংবাদিকদের জন্য তাঁবুর ব্যবস্থা হয়েছে। যাইহোক আমরা পৌঁছবার পরই মিলেমিশে রিপোর্ট তৈরী করলাম এবং তারপর নেহরুকে দেখাবার জন্য ওঁর ঘরে গিয়ে দেখি, উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর উনি ঘুমুচ্ছেন বলে আমরা ওঁর ঘুম ভাঙান অনুচিত মনে করে আবার সবাই মিলে রিপোর্টটিকে ভালভাবে দেখলাম। তারপর আমরা দুতিনজনে একটা জীপ নিয়ে মাইলখানেক দূরের টেলিগ্রাফ অফিসে গেলাম। টেলিগ্রাফ অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী আমাদের প্রেস টেলিগ্রামের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন এবং আমরা তার হাতে মেসেজ দেবার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তার কাজ শুরু করলেন। কয়েক মিনিট পরেই আমরা আরেকটা জীপগাড়ীর আওয়াজ পেলাম কিন্তু ভাবলাম বোধ হয় কোন সরকারী অফিসার টেলিগ্রাম পাঠাতে এসেছেন এবং আমরা কেউই সেদিকে খেয়াল করিনি। হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে টেলিগ্রাফ অফিসের ভিতরে তুকে টেলিগ্রাফিস্টকে বকুনি দিতেই আমরা সবাই ভুত দেখার মত চমকে উঠি। উনি টেলিগ্রাফিস্টকে বললেন, এরা সবাই আমার সম্পর্কে আজেবাজে রিপোর্ট পাঠাচ্ছে, তা জানেন?

নেহরুর কথায় ভদ্রলোকের হৃদপিণ্ডের স্পন্দনও বোধ হয় থেমে যায়।

এবার প্রধানমন্ত্রী আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, তোমরা ভালভাবে দেখেশুনে রিপোর্ট পাঠাচ্ছ তো?

হা।

ব্যস! তাহলে ঠিক আছে। হাসতে হাসতে নেহরু টেলিগ্রাফিস্টকে বললেন, তাড়াতাড়ি খবর পাঠান। তা না হলে কাল সকালেই কাগজে বেরুবে কি করে?

টেলিগ্রাফিস্ট ভদ্রলোক অভাবনীয়ভাবে ভারতভাগ্যবিধাতার সান্নিধ্য লাভ করে আনন্দে খুশিতে নিউজ পাঠাতে শুরু করলেন এবং আমরা সবাই ক্যাম্পে ফিরে এলাম। নেহরু তার নিজের ঘরে গেলেন। আমরাও যে যার তাঁবুতে এসে জামাকাপড় বদলে ও মশারী ঠিকঠাক করেই শুয়ে পড়লাম। আমরাও অত্যন্ত ক্লান্ত ছিলাম। তাই শোবার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত তখন গভীর।

অঘোরে ঘুমুচ্ছি কিন্তু মশার কামড়ে পাগল হয়ে যাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত ঘুম ভেঙে যেতেই অবাক-মশারী উধাও। অন্য সাংবাদিক বন্ধুদেরও মশারী উধাও। আশ্চর্য কাণ্ড! চারদিকে সশস্ত্র পুলিশের পাহারা এবং এই অবস্থায় আমাদের মশারী চুরি করল কে? তাঁবুর বাইরে পাহারারত সশস্ত্র পুলিশকে প্রশ্ন করে কিছুই জানা গেল না। অনেকক্ষণ অনেককে জিজ্ঞাসা করার পর একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার চাপা হাসি হেসে নেহরুর ঘরের দিকে ইসারা করলেন।

নেহরুর ঘরে গিয়ে দেখি, উনি বই পড়ছেন এবং আমাদের দেখেই হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন, কি? ঘুম হলো না?

আমরা ওঁর ঘরের মধ্যে পাকৃত মশারী দেখে হাসতেই উনি বললেন, তোমাদের জন্য আমি বিছানা ছেড়ে টেলিগ্রাফ অফিস যাই। তোমরা যখন আমার ঘুম ভাঙ্গিয়েছ, তখন আমিই বা কেন তোমাদের ঘুমুতে দেব?

আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠি।

সেদিন বাকি রাতটুকু নেহরু আর আমরা কজনে গল্প করেই কাটিয়ে দিই।

পরদিন ভোরবেলায় নেহরু হাসতে হাসতে আমাদের বললেন, পুলিশে এফ-আই-আর করনি তো? এফ-আই-আর করলে ওরা আমাকে চুরির দায়ে গ্রেপ্তার করবে।

ঐ একরাত্রির আনন্দের জন্য সমস্ত নির্বাচনী সফরের ক্লান্তি দূর হয়ে গিয়েছিল।

ভিআই-পি কথাটি আমাদের দেশে বড়ই অপব্যবহার করা হয় এবং দিন দিন এই অপব্যবহার বাড়ছে। প্রথম যখন রিপোর্টার হলাম, তখন বিদেশী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আমাদের রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী ভি-আই-পি ছিলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীরাও ভি আই-পি ছিলেন ঠিকই কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা সরকারী অনুষ্ঠান ও নিজ নিজ রাজ্যের মধ্যে সীমিত ছিল। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা কোন রাজ্যে সফরে গেলে তাঁরা রাজভবনে থাকতে পারতেন এবং তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হতো ঠিকই কিন্তু আজকের মত তারা পুলিশের গাড়ির শোভাযাত্রার শোভা বর্ধন করতেন না। দিল্লীতেও তাদের সঙ্গে সব সময় একজন সাধারণ পোষাকের নিরাপত্তা কর্মী থাকলেও বাড়ির দরজায় সঙ্গীনধারী মোতায়েন ছিল না। সঙ্গীনধারী মোতায়েন থাকত শুধু রাষ্ট্রপতি ভবনে ও প্রধানমন্ত্রী নেহরুর তিনমূর্তি ভবনে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের বাংলোয় প্রথম সশস্ত্র প্রহরী মোতায়েন করা হয় চীন-ভারত যুদ্ধের সময়। যুদ্ধ শেষ হবার পর সশস্ত্র প্রহরীরা ব্যারাকে ফিরে যায়।

ভি-আই-পি কনভয়ের অগ্রগামী পুলিশের গাড়িতে সাইরেন ব্যবহার প্রথম চালু হয় বম্বেতে এবং তার জন্য মহারাষ্ট্র সরকারকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নিতে হয়। ভারতবর্ষের অন্যান্য শহরের চাইতে বোম্বেতেই মোটর গাড়ির সংখ্যা সর্বাধিক ও গতিও অত্যন্ত বেশী। তাই দ্রুতগামী যানবাহনকে অনেক দূর থেকে সতর্ক করার জন্যই এই সাইরেন ব্যবহার চালু হয়। শুধু তাই নয়। বিশেষ বিশেষ ভি-আই-পির বিশেষ বিশেষ স্থানের গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে যোগদানের সময়ই এই সাইরেন ব্যবহার চালু ছিল এবং এখনও এই ব্যবস্থা সত্যিকার ভি-আই-পিদের জন্যই নিদিষ্ট আছে। কিছু কিছু রাজ্যে পশুপালন ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রীর গ্রাম গঞ্জ সফরের সময়েও এই সাইরেন ব্যবহার হচ্ছে।

ভি-আই-পি গাড়ির সামনে লাল আলো? পৃথিবীর বহু দেশেই অ্যাম্বুলেন্স বা ফায়ার বিগ্রেডের গাড়ির সামনে লাল-নীল ফ্লিকারিং আলো থাকে কিন্তু ভি-আই-পি গাড়ির সামনে নৈব নৈব চ। এখনও দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রীর গাড়িতে লাল আলো নেই। যাই হোক এই সব ব্যবস্থাই নাকি নিরাপত্তার জন্য। কমিউনিষ্ট ও একনায়কতন্ত্রের দেশগুলিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সত্যি অভাবনীয় কঠোর। তবে কমিউনিষ্ট দেশে এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা এমনই যে তা সাধারণের দৃষ্টি গোচরে পড়ে না। এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত নগ্ন ও প্রকট শুধু একনায়কতন্ত্রের দেশগুলিতে। এই ধরণের অমার্জিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে এই সব ডিক্টেটররা দেশের মানুষকে ভয় করেন। সব গণতান্ত্রিক দেশেও ভি-আই-পিদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তা কঠোরতম কিন্তু ভারতবর্ষের মত এমন অমার্জিত নয়। লরী ও জীপ ভর্তি সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে মন্ত্রীদের সফর করা কোন সভ্য দেশে দেখা যাবে না।

সুইজারল্যাণ্ডের রাষ্ট্রপ্রধান সাধারণ মানুষের সঙ্গে ট্রামে চড়ে অফিস যান। সুইডেন প্রভৃতি দেশের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে সশস্ত্র বা নিরস্ত্র প্রহরী তো দূরের কথা, কোন ব্যক্তিগত কর্মচারীও থাকেন না। কোন দর্শনার্থী গেলে প্রধানমন্ত্রী নিজেই তাকে অভ্যর্থনা করবেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও অফিস দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রীটে কোন অর্ডালী-চাপরাশী-বেয়ারা বা কলিং বেলের ব্যবস্থা নেই। কোন কর্মচারীকে দরকার হলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নিজে তার ঘরে গিয়ে ডেকে আনেন–জন, উড ইউ প্লীজ ড্রপ ইন? আর গণতান্ত্রিক প্রগতিবাদী পশ্চিমবঙ্গের সাব-রেজিষ্ট্রাররাও ঘণ্টা বাজিয়ে একজন বেয়ারাকে তলব করেন ও জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের বাংলোয় টেলিফোন ধরে একজন সিপাই! মন্ত্রী-সেক্রেটারিরা তো চন্দ্র-সূর্যের মতই বহুদূরের বাসিন্দা। গরীব মানুষের টাকায় এই বিলাসিতা সত্যি বিস্ময়কর। যাই হোক এ দেশে খুদে ভি-আই-পিদেরও ঢং দেখে হাসি পায়।

জীবনে কত অসংখ্য ভিআইপি দেখলাম, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও নানা রকম কায়দা-কানুন করে সাধারণ মানুষ থেকে দূরে থাকাই, আমাদের বাচাল বক্তৃতা-শ্লোগান সর্বস্ব ভিআই-পিদের স্বপ্ন ও সাধনা। মনে পড়ে মার্শাল টিটোর কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চল্লিশ ডিভিশন নাৎসী সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে বিশ্বের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন মার্শাল টিটো। যুদ্ধবিগ্রহ শত্রু-মিত্র অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে তার মত অভিজ্ঞ রাষ্ট্রপ্রধান বিরল। ইতিহাসের সেই অমর নায়ক এসেছেন ভারত সফরে এবং ঘুরতে ঘুরতে কলকাতা।

রাজভবন থেকে মার্শাল টিটোর বেরুবার তখনও দেরি আছে। তা হোক। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দপ্তর ও পশ্চিমবঙ্গ কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কর্ণধাররা অনেক আগেই রাজভবন পৌঁছে গেছেন এবং কনভয়ের গাড়ি ঠিক মত দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার ও নিরাপত্তা কর্মীদের নির্দেশ দিচ্ছেন। হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে মার্শাল টিটো সিঁড়ি ভেঙে নেমে এসে ওদের সামনে হাজির। একা মার্শাল টিটোকে সামনে দেখে গোয়েন্দা দপ্তরের বড় কর্তাদের বিস্ময় আরো বেড়ে গেল। তাছাড়া প্রেসিডেন্টের রওনা হবার কি সময় হয়ে গেল? ওরা সবাই ঘড়ি দেখেন। মার্শাল টিটো হেসে বললেল, না না, আমার রওনা হবার সময় হয়নি। ব্রেকফাস্ট হয়ে গেছে। তাই ঘরের মধ্যে বসে না থেকে বেরিয়ে এলাম।

গোয়েন্দা বিভাগের বড় কর্তারা এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

আপনারা কি করছেন?

মার্শাল টিটোর প্রশ্নের উত্তর দিতে এগিয়ে এলেন গোয়েন্দা দপ্তরের একজন প্রবীণ অফিসার। তিনি সবিনয়ে বললেন, ইওর একসেলেনসী, আমরা আপনার নিরাপত্তা কর্মী! তাই সবাইকে একটু বুঝিয়ে দিচ্ছি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহানায়ক মৃদু হেসে বললেন, এত ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা সত্ত্বেও কি আপনারা গ্যারান্টি দিতে পারেন আমার কোন বিপদ হবে না?

কি জবাব দেবেন? আমতা আমতা করতে লাগলেন গোয়েন্দা দপ্তরের বড় কর্তারা।

এবার মার্শাল টিটো বললেন, কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থাই সব বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে পারে না। একজনের নিরাপত্তার জন্য। শত সহস্র নিরাপত্তা কর্মী নিয়োজিত থাকলেও একজন সাধারণ মানুষ ইচ্ছা করলেই অঘটন ঘটাতে পারেন।

গোয়ন্দা বিভাগের একজন অফিসার সাহস করে বললেন, ইওর একসেলেনসী, আমরা তো চেষ্টা করব যাতে অঘটন না ঘটে।

মার্শাল টিটো হেসে বললেন, তা ঠিক কিন্তু অতিরিক্ত কিছু করলে, অনেক সময় হিতে বিপরীত হয়।

এই নিরাপত্তার ব্যাপারে একটি মজার ঘটনা না বলে পারছি না।

তৈল সমৃদ্ধ একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এসেছেন দিল্লীতে। আছেন রাষ্ট্রপতি ভবনে। নৈশ ভোজনের বেশ কিছু পরে ঐ দেশের রাষ্ট্রদূত একজন সুন্দরী যুবতাঁকে নিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানের ঘরে ঢুকলেন কিন্তু কিছুক্ষণ পরে রাষ্ট্রদূত একা বেরিয়ে এলেন এবং ভারপ্রাপ্ত ভারতীয় নিরাপত্তা অফিসারকে জানালেন, মেয়েটি সারারাত-ঐ ঘরেই থাকবে। ভাল কথা। রাষ্ট্রদূত চলে যাবার একটু পরেই খবর পাওয়া গেল, ঐ রাষ্ট্রপ্রধানের সহযাত্রী দুজন নিরাপত্তা কর্মী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে ঐ ঘরে ঢুকেছে। খবর শুনেই ভারতীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা দপ্তরের কর্তারা মাথায় হাত দিয়ে বসলেন! যদি ওরা দুজন রাষ্ট্রপ্রধানের কোন ক্ষতি করে? অথচ ওঁর নিরাপত্তার দায়িত্ব তো ভারতের। কি করা যায়? ঘরের দরজা খুলতে বলা অসম্ভব। হাজার হোক রাষ্ট্রপ্রধান। তার উপর উনি এখন চিত্তবিনোদনে ব্যস্ত। এ সময় কি মহামান্য অতিথিকে বিরক্ত করা যায়? সারারাত মহা উৎকণ্ঠায় কাটালেন আমাদের নিরাপত্তা-গোয়েন্দা বিভাগের কর্তারা। তারপর ভোরবেলায় ঐ সশস্ত্র প্রহরী দুটি ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই ভারতীয় অফিসাররা তাদের জিজ্ঞাসা করলেন–আপনারা ঘরে ঢুকেছিলেন কেন?

আমরা পাহারা দিচ্ছিলাম।

পাহারা?

হ্যাঁ। রাষ্ট্রপ্রধানের খাটের তলায় বসে সারারাত পাহারা দিয়েছি।

সেকি?

হা! ঐ মেয়েটি যদি রাষ্ট্রপ্রধানের কোন ক্ষতি করে। তাই ওঁর নির্দেশ অনুযায়ী আমরা রোজ রাত্রেই এই রকম পাহারা দিই।

ওদের কথা শুনে ভারতীয় অফিসাররা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।

কিছু কিছু স্বদেশী-বিদেশী ভি-আই-পি নিরাপত্তার নামে অতিরিক্ত কিছু তামাসা সত্যি পছন্দ করেন। অনেকে ঠিক বিপরীত। যেমন মার্শাল টিটো। হো-চি-মিন আর একজন বিশ্ববরেণ্য নেতা যাকে এই বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন দেখেছি। শুধু তাই নয়। দুটি এনগেজমেন্টের মাঝের সময়টুকু তিনি নিজের ঘরে শুয়ে-বসে কাটাতেন না। হাতে সময় পেলেই উনি লনে বসে সাংবাদিক ও অফিসারদের সঙ্গে গল্প করতেন। হো-চি-মিনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল। অন্যান্য ভিভিআই-পিদের মত উনি বার বার পোষাক বদল করতেন না। একটা জামা-প্যান্টেই সারা দিন কাটাতেন! দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে চার্চিল, স্ট্যালিন, মাও সে তুঙ ও ছাগলকে আমি দেখিনি। আর অধিকাংশ রাষ্ট্রনায়ককেই আমি দেখেছি কিন্তু তাদের মধ্যে হো-চি-মিনের চাইতে সহজ সরল অনাড়ম্বর কাউকে দেখিনি। নতুন দেশ ও নতুন জাতির জন্মদাতা ও বিশ্ববরেণ্য নেতা হয়েও উনি ভুলে যাননি, এককালে লণ্ডনের কার্লটন হোটেলে বাসন মাজতেন।

তবে অন্যান্য সব ভি-ভি-আই-পিদের চাইতে ক্রশ্চভের সফর কভার করার সময় সাংবাদিকদের অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হতো। উনি যে কখন কি করবেন, তা কেউ জানতেন না। তাছাড়া ওঁর সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বুদ্ধি এত প্রখর ছিল, তা সত্যি ভাবা যায় না। এর সঙ্গে ছিল ওঁর অসম্ভব স্মৃতিশক্তি ও রসজ্ঞান। ভারত সফরের সময় নানা বিষয়ে নানা জায়গায় ওঁর মন্তব্য কিংবদন্তি হয়ে আছে। তাই সেসব কথার পুনরাবৃত্তি না করে অন্য দুএকটি ঘটনা বলব।

দিল্লীতে ক্রশ্চভের সাংবাদিক সম্মেলন। প্রায় ছসাত শ দেশী বিদেশী সাংবাদিক জড় হয়েছেন। হবে না কেন? ওঁর প্রত্যেকটি কথাই তো তাৎপর্যপূর্ণ। তাছাড়া ওঁর মত উপস্থিত বুদ্ধি সম্পন্ন ও রসিক নেতার সাংবাদিক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আনন্দই আলাদা। ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে সঙ্গে নানা দেশের সাংবাদিকরা প্রশ্ন করছেন এবং ক্রশ্চভ তার জবাব দিচ্ছেন। এইভাবে সময় চলে যাচ্ছে। হঠাৎ আমার খেয়াল হয়, আর তো বিশেষ সময় নেই কিন্তু সে সময় উনি একদল আমেরিকান সাংবাদিকদের একটির পর একটি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। মার্কিন সাংবাদিকরা যেমন কড়া কড়া প্রশ্ন করছেন, উনি তাদের আরো কড়া জবাব দিচ্ছেন হাসতে হাসতে। শুনতে সবাই মশগুল।

ক্রশ্চভের আশেপাশের কূটনীতিবিদ ও অফিসাররা বার বার ঘড়ি দেখতেই আমার খেয়াল হল, আর এক মিনিটও নেই। আমি আর এক মুহূর্ত নষ্ট না করে চিৎকার করে উঠলাম, মিষ্টার চেয়ারম্যান, স্যার! আপনি কি শুধু আমেরিকান সাংবাদিকদেরই প্রশ্নের জবাব দেবেন?

উনি হাসতে হাসতে জবাব দিলেন, আমি যে এতক্ষণ আমেরিকান সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলাম, তা বুঝতেই পারিনি। এবার আমেরিকান সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে মুচকী হেসে বললেন, আমি আপনাদের যা বলেছি, সব ভুলে যান। তারপর আমাকে বললেন, আপনার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কি ভারত ত্যাগ করতে পারি?

ভারত কি আপনাদের বন্ধুত্বের উপর নির্ভর করতে পারে?

একশ বার। ভবিষ্যত নিশ্চয়ই প্রমাণ করবে, আমরা ভারতের সত্যিকার বন্ধু!

ভারত ত্যাগের ঠিক আগের দিন সন্ধ্যায় চেয়ারম্যান ক্রশ্চভের সম্মানে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বেনেদিকভের পার্টি। সে পার্টিতে প্রধান মন্ত্রী নেহরু, উপরাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণণ থেকে শুরু করে রাজধানী দিল্লীর সব বিখ্যাত ব্যক্তিদের সমাবেশ হয়েছে। এ ছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা তো আছেনই। একদল সাংবাদিকের মধ্যে আমিও নিমন্ত্রিত হয়ে সে পার্টিতে গেছি। ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছি এদিক-ওদিক কিন্তু ক্রশ্চভ, নেহরু ও রাধাকৃষ্ণণের চারপাশে অনেকের ভিড় বলে ওদের কাছে যাচ্ছি না। হঠাৎ সোভিয়েত দূতাবাসের একজন উচ্চপদস্থ কূটনীতিবিদ আমাকে এসে বললেন, আপনি আমার সঙ্গে আসুন।

তারপর উনি আমাকে সোজা ক্রশ্চভের সামনে হাজির করে বললেন, এই যে ওকে ধরে এনেছি।

ক্রশ্চভ আমার সঙ্গে করমর্দন করে বললেন, সেদিন সাংবাদিক সম্মেলনে আপনার প্রশ্নের জবাব দিয়ে আমি সত্যি খুশি হয়েছি। এই কথাটা জানাবার জন্যই আপনাকে খুজছিলাম।

আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমার বিস্ময় কেটে যাবার পর সেদিনই আমি বুঝেছিলাম, নেহরু-ক্রশ্চভের আলোচনায় সত্যিকার ভারত-সোভিয়েত বন্ধুত্বের বনিয়াদ তৈরী হয়েছে এবং আগামী দিনের ইতিহাস তা প্রমাণ করবে। এত বছর পর আজ নিঃসঙ্কোচে বলা যায়, ভারতবর্ষের বহু সঙ্কটে যে বন্ধু রাষ্ট্র সব সময় পাশে দাঁড়িয়েছে, তার নাম সোভিয়েত ইউনিয়ন। কাশ্মীর, চীন-ভারত যুদ্ধ ও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন যেভাবে ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার তুলনা বিরল।

ক্রশ্চভ সম্পর্কে আরো একটি ঘটনার উল্লেখ না করে পারছি না।

আজ খবরের কাগজের পাতায় মানুভাই শা’র নাম ছাপা হয় না। আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসে যে রকম ডিফেন্স পলিসির জন্মজাতা হিসেবে কৃষ্ণমেনন, অয়েল পলিসির জন্মদাতা হিসেবে কেশবদেও মালব্যর নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে, সেইরকম রপ্তানী বানিজ্যের মূল বনিয়াদ তৈরীর জন্য মানুভাই শার নাম সবার মনে রাখা উচিত। মানুভাই মন্ত্রী হিসেবে যেমন খ্যাতি অর্জন করেন, পার্লামেন্টিরিয়ান হিসেবেও সবার মন জয় করেন।

যাই হোক মস্কোয় ভারত মেলার আয়োজন হলো মানুভাই শার উদ্যোগে। উনি বুঝেছিলেন, ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক বনিয়াদ গড়ে তুলতে হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য অপরিহার্য এবং ভারত-সোভিয়েত বানিজ্যের খানিকটা সাম্য রক্ষা করতে হলে আমাদের রপ্তানী বাড়াতেই হবে। সোভিয়েত দেশে আমাদের রপ্তানী বৃদ্ধি করার জন্যই সেবার ভারত মেলার আয়োজন হয়। দিল্লী থেকে মস্কো রওনা হবার আগেই মানুভাই জানতেন, ক্রশ্চভের পক্ষে মেলার উদ্বোধন করা সম্ভব হবে না। কারণ ঠিক ঐ সময় মস্কোয় পূর্ব ইউরোপের কমিউনিষ্ট পার্টির প্রধানদের সম্মেলন হবে। তাছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ ব্যক্তিগত দূত হ্যারিম্যানও ঠিক এ সময় সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। তবু মানুভাই প্রধানমন্ত্রী নেহরুর একটা চিঠি নিয়ে গেলেন।

মস্কোয় পৌঁছে মানুভাই ক্রশ্চভকে নেহরুর চিঠি দিতেই উনি ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললেন, নে, নো, ভেরি বিজি। কান্ত গো। সরি।

ক্রশ্চভ ব্যস্ত বলে সোভিয়েত বিদেশ বানিজ্য মন্ত্রী ভারত মেলার উদ্বোধন করবেন বলে সব ঠিক। আমন্ত্রণপত্র বিলি হয়ে গেছে। বক্তৃতা ছাপান হয়েছে। মেলার উজ্যোগ-আয়োজন সব শেষ।

সেদিন বিকেলেই মেলার উদ্বোধন। মানুভাই সারা সকাল মেলার মাঠে কাটিয়ে দুপুরে হোটেলে এসেছেন। খাওয়া-দাওয়া করে যথারীতি খালি গায় শুয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন। হঠাৎ টেলিফোন-হ্যালো!

স্পীক টু চেয়ারম্যান, স্যার।

ক্রশ্চভ স্পীকিং! আই কাম, ইওর একজিবিশন।

সঙ্গে সঙ্গে ওদিক থেকে টেলিফোন লাইন কেটে গেল।

হতভম্ব হয়ে মানুভাই নিজের বিছানায় বসে আছেন। ঠিক বুঝতে পারছেন না কি ঘটে গেল। এমন সময় ঘরে ঘন্টা বাজতেই উনি যেন সম্বিত ফিরে পেলেন। ঘণ্টা শুনে ভাবলেন নিশ্চয়ই আমাদের দূতাবাস থেকে কেউ এসেছেন।

দরজা খুলতেই সোভিয়েত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুজন অফিসার মানুভাইকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন ইওর একসলেনসী, চেয়ারম্যান আপনাদের ভারত মেলার উদ্বোধনে আসছেন, সে খবর নিশ্চয়ই পেয়েছেন?

হ্যা এক্ষুনি চেয়ারম্যান টেলিফোন করেছিলেন।

চেয়ারম্যান যখন যাচ্ছেন তখন আপনার বক্তৃতার নিশ্চয়ই কিছু পরিবর্তন হবে। আপনি যদি অনুগ্রহ করে বক্তৃতার প্রথম প্যারাটা লিখে দেন, তাহলে আমরা তা ছাপাবার ব্যবস্থা করতে পারি।

কিন্তু সময় তো বিশেষ নেই।

তা হোক। তবু আমরা চেষ্টা করব।

শুধু মানুভাইএর বক্তৃতার প্রথম প্যারা না, চেয়ারম্যান ক্রশ্চভের নামে নতুন আমন্ত্রণ পত্রও ছাপা হলো। এবং শত শত অতিথিরা এই নতুন আমন্ত্রণলিপি নিয়েই উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এলেন। মানুভাইএর বক্তৃতার প্রথম পাতাও নতুন করে ছাপা হয়ে এলো ঠিক সময়। এত অল্প সময়ের মধ্যে কিভাবেই যে এসব ছাপা হলো এবং শত শত অতিথিদের কাছে পৌঁছে গেল, তা ভেবে মানুভাই ও ভারতীয় দূতাবাসের সবাই বিস্মিত না হয়ে পারলেন না।

ক্রশ্চভ একলা না, রাষ্ট্রপতি মিকোয়ানও এলেন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে। ভারত মেলার শেষ প্রান্তে কাঞ্চনজঙ্ঘার পটভূমিকায় দার্জিলিং তৈরি করা হয়েছিল এবং সেখানে কয়েকটি ভারতীয় সুন্দরী দার্জিলিং এর চা পরিবেশন করছিল। ক্রশ্চভ ঐ সুন্দরীদের দেখেই হাসতে হাসতে বললেন, এদের যদি আগে দেখতাম, তাহলে কি আমি আমার স্ত্রীকে বিয়ে করতাম?

ওঁর কথায় সবাই হাসেন।

তারপর মিকোয়ানকে বলেন, মেয়েরা কেউ আপনাকে পছন্দ করবে না। ওরা আমাকেই চায়। আপনি দূরে দাঁড়ান।

এইসব হাসি-ঠাট্টা চলতে চলতেই ক্রশ্চভ হঠাৎ গী হয়ে মাভাইকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা তো আমাদের আরো চা বিক্রী করতে চান, তাই না?

ইয়েস ইওর একসেলেনসী!

কাল সকাল এগারটায় আমার সঙ্গে দেখা করবেন।

এই কথা বলেই ক্রশ্চভ চলে গেলেন।

সোভিয়েতে চা রপ্তানীর ব্যাপারে যত চিঠিপত্র ও কথাবার্তা হয়েছে, সে সম্পর্কে কাগজপত্র জোগাড় করার জন্য মস্কোর ভারতীয় দূতাবাস এবং দিল্লীর পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সারারাত টেলে মেসেজ লেনদেন হলো। মানুভাই ও অফিসাররা সারারাত ও সকাল সেসব নিয়ে পড়াশুনা ও আলাপ-আলোচনা করে যথাসময়ে, ক্রেমলিনে হাজির হলেন। সোভিয়েত পররাষ্ট্র বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের সবাইও হাজির। ঠিক এগারটার সময় ক্রশ্চভ ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকেই বললেন, ভেরি বিজি, ভেরি বিজি। দুতিন মিনিট থেকেই আমি পালাব।

তারপর অন্য কিছু বলার আগেই ক্রশ্চভ গড় গড় করে বলে গেলেন, ভারত এই সময় এই সব প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা তার এইসব জবাব দিয়েছি। এখনই আমরা এত চা কিনব, পরে এত কিনব এবং ভারতকে এইসব ব্যবস্থা করতে হবে।

এইটুকু বলেই উনি আবার ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলেন।

এত বছরের কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে এক সপ্তাহ পরে দুই দেশের প্রতিনিধি দল দেখলেন, ক্রশ্চভ যা বলেছেন, তাই আদর্শ সমাধান এবং ক্রশভের প্রস্তাব অনুযায়ী দুই দেশের ধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো।

সে সময় সেই অসম্ভব ব্যস্ততা ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আলাপ আলোচনার মাঝে ক্রশ্চভ যে কিভাবে চায়ের ব্যাপারে এত খবর জানলেন, তা মানুভাই ভেবে পেলেন না।

ক্রশ্চভ সত্যি অনন্য পুরুষ ছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *