০৪. নিষ্ঠাবান গান্ধীবাদী ও কংগ্রেসী

নিষ্ঠাবান গান্ধীবাদী ও কংগ্রেসী হিসেবে রাজেন্দ্রপ্রসাদ সুপরিচিত ছিলেন। গান্ধীজির নেতৃত্বে যে কটি উজ্জ্বল তারকার তেরঙ্গার নীচে সমাবেশ হয়, রাজেনবাবু তাঁদের অন্যতম ছিলেন। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের চাইতে বিহার ও উড়িষ্যার মানুষ অনেক বেশি বিনয়ী হন। ভারতবর্ষের প্রথম রাষ্ট্রপতি হয়েও বাজেন্দ্রপ্রসাদ বিহারের অতি সাধারণ মানুষের মতই বিনয়ী ছিলেন।

কংগ্রেসের বহু নেতাই অত্যন্ত ভাল ছাত্র ছিলেন। যারা ভাল ছাত্র ছিলেন না, তাঁরাও সুপণ্ডিত ছিলেন। মেধায় রাজেন্দ্রপ্রসাদ ও মৌলানা আজাদ, বিদ্যা-বুদ্ধি পাণ্ডিত্যে নেহরু ও সরোজিনী নাইডু এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় সর্দার প্যাটেল অতুলনীয় ছিলেন। নেহরু, মৌলানা আজাদ ও সরোজিনী নাইডু নিজেদের বিদ্যা-বুদ্ধি পাণ্ডিত্য ও আভিজাত্যের জন্য সব সময় সচেতন থাকতেন বলেই সাধারণ মানুষের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেন। অসাধারণ ব্যক্তিত্বের জন্য সর্দার প্যাটেলের কাছেও অতি সাধারণ মানুষ আসতে দ্বিধা করত কিন্তু রাজেন্দ্রপ্রসাদ চিরকালই নিছক সাধারণ মানুষ ছিলেন।

কলকাতায় রিপোর্টারী করার সময় দু চারটে সভাসমিতি ও সমাবর্তনে রাজেনবাবুকে দেখেছি দূর থেকে কিন্তু দিল্লীতে গিয়ে যেদিন প্রথম কাছ থেকে দেখি, সেদিন চমকে উঠেছিলাম।

এক বিখ্যাত পণ্ডিতের টীকাসহ পদ্মপুরাণ প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতায়। ওদেরই একজন আমাকে চার খণ্ডের পদ্মপুরাণ পাঠিয়ে ডাঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদকে দেবার অনুরোধ করেছিলেন। আমার অগ্রজ প্রতিম রাজেন্দ্রলাল হাণ্ডা তখন রাষ্ট্রপতির প্রেস সেক্রেটারি। ওকে সব কথা জানাতেই উনি বললেন, এই বই যদি রাষ্ট্রপতি ভবনের লাইব্রেরী বা সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েট লাইব্রেরীতে থাকে তাহলে প্রেসিডেন্ট এগুলি গ্রহণ করতে পারেন না। দু চারদিন পর ঐ দুটি লাইব্রেরীতে খোঁজখবর নেবার পর মিঃ হাণ্ডা আমাকে জানালেন, না, কোন লাইব্রেরীতেই পদ্মপুরাণের ঐ টীকা নেই। তুমি পরশুদিন সকাল নটায় এসে প্রেসিডেন্টকে বইগুলি দিও।

পৌনে নটায় রাষ্ট্রপতি ভবনে হাজির হয়ে এ-ডি-সির ঘরে গেলাম। কয়েক মিনিট পরে এ-ডি-সি আমাকে রাষ্ট্রপতির স্টাডিতে পৌঁছে দিয়েই বিদায় নিলেন।

রাষ্ট্রপতি ভবনের এই স্টাডি রুম একতলায়। ঘরখানি বড়। ঘরের চারপাশের আলমারীতে বই। তিন কোণায় তিনটি সোফ সেট। এক কোণায় বিরাট সেক্রেটারিয়েট টেবিল। ঘরখানির পশ্চিম দিকেই মুঘল গার্ডেন। এই ঘরে বসেই রাষ্ট্রপতি সরকারী কাজকর্ম ও লোকজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করেন।

প্রবেশ দ্বারের ঠিক কোণাকুণি উল্টোদিকের সোফায় রাজেন্দ্রপ্রসাদ বসে ছিলেন। আমি ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়ালেন। আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম। তারপর ওঁর কাছাকাছি হতে উনিই এগিয়ে এলেন। একেবারে মুখোমুখি হতেই উনি আমার পায়ে হাত দেবার চেষ্টা করতেই আমি বিদ্যুৎ গতিতে পিছিয়ে এলাম। অবাক বিস্ময়ে বললাম, এ কী করছেন?

রাষ্ট্রপতি শান্তভাবে বললেন, আপনি ব্রাহ্মণ। আপনাকে প্রণাম করব না?

অসম্ভব।… না, না, তা হতে পারে না।

কেন হতে পারে না? উনি প্রশ্ন করতে করতেই আবার আমার দিকে এগিয়ে আসেন।

আমি কিছুতেই ওঁকে প্রণাম করতে দিই না, সেন্টার টেবিলের অন্যদিকে চলে যাই। রাষ্ট্রপতি আবার আমাকে ধরার চেষ্টা করেন, আমি আবার ঘুরে যাই।

বেশ কয়েক মিনিট ধরে চেষ্টা করার পর ব্যর্থ হয়ে রাজেন্দ্রপ্রসাদ দুহাত জোড় করে মাথা নীচু করে আমাকে নমস্কার করলেন। তারপর আমার হাত ধরে আগে সোফায় বসিয়ে উনি আমার পাশে বসলেন।

ব্রাহ্মণ হলেই তাকে প্রণাম করতে হবে, আধুনিক কালের মানুষ তা মনে করে না। আমিও করি না। এর মধ্যে কোন যুক্তিও দেখতে পাই না। বোধ হয় শুধুই সংস্কার। রাষ্ট্রপতির মধ্যে এ ধরণের সংস্কার না থাকাই কাম্য কিন্তু ভারতবর্ষের প্রথম নাগরিকের এই বিনয় দেখে আমি বিমুগ্ধ না হয়ে পারিনি। বিদ্যা দদাতি বিনয় আজ বোধ হয় আর সত্য নয়। আধুনিক সভ্যতার প্রথম বলিদান বোধ হয় বিনয়। অতি সাধারণ গরীব-দুঃখী মানুষ বিনয়ী হয় কিন্তু শিক্ষিত ও ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষের মধ্যে বিনম্রভাব সত্যি দুর্লভ। কলকাতা কর্পোরেশনের কোন কাউন্সিলারের মধ্যে যে বিনম্রভাব দেখিনি এবং আশাও করিনি, তা স্বয়ং রাষ্ট্রপতির মধ্যে দেখে সত্যি ওঁর প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মন ভরে গেল।

পরে মিঃ হাণ্ডাকে এই ঘটনার কথা বলতে উনি হেসে বললেন, আওয়ার প্রেসিডেন্ট ইজ লাইক দ্যাট। উনি শুধু ব্রাহ্মণকেই প্রণাম করেন না, উনি সমস্ত প্রবীণদের, গ্রামের স্কুলের পুরনো মাস্টারমশাই ও মৌলানা সাহেবদের ছাড়াও পীর সাহেবদের প্রণাম করেন।

হাণ্ডা সাহেব একটু থেমে বললেন, ডোন্ট ফরগেট সংস্কৃত ও আরবী ভাষার বিশিষ্ট পণ্ডিতদের রাষ্ট্রীয় সম্মান দেবার ব্যবস্থা ওঁরই উদ্যোগে চালু হয়েছে।

রাজেন্দ্রপ্রসাদ রাষ্ট্রপতি হলেও নিছক সাধারণ মানুষের মত জীবন কাটাতেন। পশ্চিমী আদব-কায়দা বা বিলাস-ব্যসনের প্রতি তাঁর কোন আগ্রহ ছিল না। খেতেন ডাল-ভাত রুটি-তরকারি। সঙ্গে ঘরে পাতা একটু দই। স্ত্রী রাজবংশী দেবী পূজাপার্বণ আর নাতি নাতনীদের নিয়েই দিন কাটাতেন আর পাঁচজন সাধারণ ঠাকুমা দিদিমার মত। স্বামী রাষ্ট্রপতি হলেও তিনি কখনই তার সঙ্গে কোন অনুষ্ঠানে যেতেন না। এ নিয়ে দিল্লীর রাজনৈতিক মহলের পশ্চিমী আলোকপ্রাপ্তদের হাসাহাসির অন্ত ছিল না। চীন বা রাশিয়ার নেতারা তাদের স্ত্রীদের পাদপ্রদীপের আলোয় আনেন না বলে কোন সমালোচনা হয় না কিন্তু নিজের দেশের রাষ্ট্রপতির স্ত্রী সে কাজ করলে পশ্চিমী ভাবধারার ক্রীতদাসদের মধ্যে ছি ছি পড়ে যায়। সত্যি বিচিত্র দেশ! মজার কথা ডাঃ রাধাকৃষ্ণণ বা ডাঃ জাকির হোসেনের স্ত্রীও শ্রীমতী সরস্বতী গিরির মত স্বামীর উপগ্রহ হয়ে বিচরণ করতেন না কিন্তু তার জন্য তাদের নিয়ে কাউকে হাসাহাসি করতে দেখিনি। কথায় বলে, যাকে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা!

রাজেন্দ্রপ্রসাদ ভোজনরসিক ছিলেন না। তাই রাষ্ট্রপতি ভবনের ভোজসভার ব্যাপারে তিনি পুরোপুরি ভাবেই মিলিটারী সেক্রেটারির উপর নির্ভর করতেন এবং আশা করতেন মিলিটারী সেক্রেটারি অতিথি অভ্যাগতদের রুচি ও প্রয়োজন অনুযায়ী খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করবেন। রাজেনবাবুর ভোজসভার খাবার-দাবার নিয়েও দিল্লীর নানা মহলে অত্যন্ত রুচিবিরুদ্ধ সমালোচনা হত। অনেকেই কথায় কথায় নেহরুর ভোজসভার উল্লেখ করে বলতেন, হ্যাঁ, ওখানে খেয়ে সত্যি মন ভরে। মজার কথা, তিনমূর্তি ভবনেও খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করতেন রাষ্ট্রপতির মিলিটারী সেক্রেটারির অধীনস্থ সরকারী অতিথি আপ্যায়ন বিভাগ (গভর্ণমেন্ট হসপিটালিটি অর্গানিজেশন)।

এই প্রসঙ্গেই রাষ্ট্রপতির এক মিলিটারী সেক্রেটারি কথা মনে পড়ছে। তাঁর নাম ডাঃ বিমানেশ চ্যাটার্জী। ভদ্রলোক ডাক্তারী পাশ করে অবিভক্ত বাংলায় সরকারী চাকরি করতেন। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর ডাক্তার হন। যুদ্ধ ফেরত ক্যাপ্টেন (নাকি মেজর?) চ্যাটার্জী অবিভক্ত বাংলার শেষ গভর্ণর বারোজের স্টাফ অফিসার হন এবং ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট কলকাতা পুলিশ হাসপাতালে তাঁর পুলিশ-সার্জেনের পদে যোগদানের কথা ছিল। ইতিমধ্যে শ্রীরাজাগোপালাচারীর ঔদার্যে উনি লাটসাহেবের মূখ্য স্টাফ অফিসার হয়ে রাজভবনে থেকে গেলেন। রাজাজী লর্ড মাউন্টব্যাটনের পর প্রথম ভারতীয় গভর্ণর জেনারেল হয়ে দিল্লী যাবার সময় বিমানেশ চ্যাটার্জীকেও সঙ্গে নিয়ে গেলেন এবং তথাকথিত বাঙ্গালী-বিরোধী বলে পরিচিত রাজাজীর সুপারিশ ও অনুগ্রহেই অসামান্য ক্ষমতাসম্পন্ন মিলিটারী সেক্রেটারি হলেন। রাজাজী বিদায় নিলেন; গণতান্ত্রিক ভারতের প্রথন রাষ্ট্রপতি হলেন ডক্টর রাজেন্দ্রপ্রসাদ। বিমানেশ চ্যাটার্জীও বিদায় নেবার জন্য প্রস্তুত কিন্তু রাজেন্দ্রপ্রসাদ তাঁকে বললেন, আপনি যে কাজ করছিলেন, সেই কাজই করুন। আপনি থাকলে আমার বাংলায় কথাবার্তা বলার অভ্যাসটা ঠিক থাকবে। বিমানেশ চ্যাটার্জী থেকে গেলেন এবং রাজেনবাবুর সুপারিশেই উনি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন।

রাজেন্দ্রপ্রসাদের আমলে কিছুকাল কাজ করার পরই মেজর জেনারেল চ্যাটার্জী বুঝলেন, নেহরু-রাজেনবাবুর সম্পর্কটা বিশেষ মধুর নয় এবং গভর্ণমেন্ট হসপিটালিটি অর্গানিজেশনের প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি ভবনের ভোজসভা ও অতিথি আপ্যায়নকে উপেক্ষা করে তিনমূর্তি ভবনের দিকে একটু বেশি দৃষ্টি দিতে শুরু করলেন। চাকুরি থেকে অবসর নেবার সময় যত এগিয়ে আসে মেজর জেনারেল চ্যাটার্জী তত বেশি মাথাইয়ের প্রিয়পাত্র হবার জন্য সচেষ্ট হন। দিল্লীর রাজ নৈতিক মহলের অনেকেই মনে করতেন, মেজর জেনারেল চ্যাটার্জীর জন্যই নেহরু-রাজেন্দ্রপ্রসাদের সম্পর্ক এত তিক্ত হয়। সত্য-মিথ্যা জানি না কিন্তু মেজর জেনারেল চ্যাটার্জী অবসর গ্রহণ করার পর প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী নেহরুর সুপারিশেই তিনি মরিসাসে ভারতীয় কমিশনার নিযুক্ত হন। মজার কথা, এর পরেও রাজেন্দ্রবাবু রাষ্ট্র পতি ভবনের এক বাঙালী ডাক্তারকে কর্ণেল থেকে ধাপে ধাপে তুলতে তুলতে মেজর জেনারেল করে দেন।

রাজেন্দ্রপ্রসাদ নাকি প্রাদেশিক মনোভাবাপন্ন ছিলেন কিন্তু তিনি যে কত বাঙালীর উপকার করেছেন তার ঠিকঠিকানা নেই। কলকাতার বন্ধুবান্ধব ও সহপাঠীদের অনুরোধ মত তিনি অনেক অপাত্রেরও উপকার করেছেন। আকাশবাণীর এক বড়কর্তা তো আজও তার অনুগ্রহের ফল ভোগ করছেন।

এমন বিনম্র ও সরল মানুষ হয়েও রাজেন্দ্রপ্রসাদ কখনও কখনও চরম অপ্রিয় সত্য বলতে দ্বিধা করতেন না।

রাণী এলিজাবেথ ও তাঁর স্বামী প্রিন্স ফিলিপ ভারত সফর শেষ করে দিল্লী ত্যাগ করার ঠিক প্রাক্কালে রাষ্ট্রপতি ভবনে রাজেনবাবুর সঙ্গে ওঁদের নানা কথাবার্তা হচ্ছিল। কথায় কথায় রাজেনবাবুর বই লেখার কথা উঠতেই রাণী এলিজাবেথ বললেন, চিরকালই তো ব্যস্ততার মধ্যে কাটালেন। তবে এত লেখার সময় পেলেন কী করে?

রাজেনবাবু একটু ম্লান হাসি হেসে নিবিবাদে বললেন, আপনার বাবার জেলখানায় এত দীর্ঘ কাল কাটিয়েছি যে আরো অনেক বেশি লেখা উচিত ছিল।

রাণী চুপ। একটি কথা আর তার মুখ দিয়ে বেরুল না। চীফ অব প্রটোকল এস, আর, এ. বেগ কোনমতে অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিকে মোড় ঘুরিয়ে দেন।

রাজেনবাবুর এই মন্তব্যের জন্য নেহরু অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। পুরনো কাসুন্দি ঘেটে ভারত ব্রিটেনের সম্পর্ক তিক্ত করা তিনি আদৌ সমর্থন করতেন না। ভারত ব্রিটেনের সম্পর্ক তিক্ত হোক–তা রাজেন্দ্রপ্রসাদও চাইতেন না কিন্তু মাউন্টব্যাটন-দম্পতির প্রভাবে তিনি ইংরেজের প্রতি বেশি বন্ধুত্ব-ভাবাপন্নও হননি।

***

ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী সাঁচীতে ডক্টর সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেবার পর থেকেই আমি ওঁকে নিয়মিত চিঠি পত্র লিখতাম। দু চারদিনের মধ্যেই উনি চিঠির জবাব দিতেন। যতদিন কলকাতায় থেকেছি, ততদিনই এই চিঠিপত্রের লেনদেন চলেছে। কলকাতায় আসার আগেই উনি আমাকে জানিয়ে দিতেন এবং আমিও সব সময় দমদম বিমানবন্দরেই ওঁর সঙ্গে দেখা করতাম।

উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ কলকাতায় এলেই লেকের ধারে শরৎ চ্যাটার্জী এভিনিউ-এ বন্ধুগৃহে থাকতেন। কখনই রাজভবনে থাকতেন না। যতদূর মনে পড়ে একবার পশ্চিমবঙ্গ সরকার এর প্রতিবাদ জানান। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ওঁকে রাজ ভবনে থাকার কথা বললে উনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, চিরকাল যখন বন্ধুর বাড়ি থেকেছি, এখনও থাকব। ভারতবর্ষের উপরাষ্ট্রপতি হয়েছি বলে বন্ধুর বাড়ি ত্যাগ করতে পারি না। এ কথা শোনার পর নেহরু আর কিছু বলেন না।

উনিশ নম্বর শরৎ চ্যাটার্জী এভিনিউর মিঃ মজুমদার মারা গেলেও রাধাকৃষ্ণণ তার ছেলেমেয়েদের সন্তানতুল্য স্নেহ করতেন। এবং তাঁরাও ওঁকে পিতৃতুল্য শ্রদ্ধা করতেন। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ কলকাতায় এলে আমিও সারাদিন ঐ বাড়িতেই কাটাতাম। সাধারণত রাধাকৃষ্ণণের কলকাতা সফরের সময় ওঁর সহকারী একান্ত সচিব মিঃ বসু সঙ্গে  আসতেন কিন্তু তিনি আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখাশুনা করার অবাধ স্বাধীনতা পেতেন। মিঃ মজুমদারের ছেলে বিজয়দা, মেয়ে বীণাদি ও আমিই রাধাকৃষ্ণণের ব্যক্তিগত সচিবের কাজ করতাম। দু-একবার কলকাতা থেকে আশেপাশের রাজ্যে সফরের সময় রাধাকৃষ্ণণ আমাকে সঙ্গেও নিয়েছেন। মন ভরে যেত ওঁর সান্নিধ্য লাভ করে।

দিনে দিনে সম্পর্ক আরো গভীর, আরো নিবিড় হয়। কলকাতায় থাকতে কাজকর্মে দিল্লী গেলে উপরাষ্ট্রপতির সরকারী বাসভবন ২ নম্বর কিং এডওয়ার্ড রোডেই সারাদিন কাটাতাম। আস্তে আস্তে আমাদের সম্পর্ক পারিবারিক পর্যায়ে পৌঁছায়। যে কোন ব্যাপারেই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা দিলেই আমি ওঁর পরামর্শ ও উপদেশ চাইতাম। এর কারণ ছিল। নেহরু ও রাধাকৃষ্ণণের পাণ্ডিত্য, ঔদার্য, মনুষ্যত্ববোধ আমাকে সব সময় আকর্ষণ করত। নেহরু প্রধানমন্ত্রী থাকায় সব সময় তাঁর কাছে যাওয়া সম্ভব ছিল না এবং সম্ভব হলেও উচিত মনে হত না, কিন্তু নিছক অধ্যাপকের মত রাধাকৃষ্ণণের বাড়িতে অবাধ গতি ছিল সবার।

অদ্ভুত মানুষ ছিলেন সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ। প্রথম জীবনে ছাত্র ও পরবর্তী জীবনে দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে দেশেবিদেশে সমান খ্যাতি অর্জন করার পর স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রদূত হয়ে মস্কো গেলেন। সেটা ১৯৪৯ সালের কথা। মার্শাল স্তালিন তখন জীবিত ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর বিশ্বের কমিউনিষ্ট দুনিয়ার কর্ণধার। ঈশ্বরে একান্ত বিশ্বাসী রাধাকৃষ্ণণকে নেহরু মস্কোয় পাঠাবার জন্য অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন এবং যা কেউ আশা করেননি, যা কোনদিন ঘটেনি, তাই ঘটল। ১৯৫২ সালে উপ-রাষ্ট্রপতি হয়ে ভারত প্রত্যাবর্তনের আগে স্বয়ং স্তালিন রাধাকৃষ্ণণকে ডেকে পাঠালেন ঐতিহাসিক ক্রেমলিনে। সারা বিশ্বের কূটনৈতিক জগৎ চমকে উঠে নজর দিলেন দার্শনিক রাধাকৃষ্ণণের দিকে।

মস্কো থেকে দিল্লী। গণতান্ত্রিক ভারতের নতুন সংবিধানের প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি।

সংবিধান অনুযায়ী উপ-রাষ্ট্রপতির প্রধান কাজ হচ্ছে রাজ্যসভা পরিচালনা করা। চেয়ারম্যান। আর রাষ্ট্রপতি অসুস্থ হলে বা কোন কারণে রাষ্ট্রের কাজ করতে অক্ষম হলে অস্থায়ীভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব বহন করা। এ ছাড়া আছে নানা আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব।

উদ্যোগ ভবনের ঠিক পূর্ব দিকেই কিং এডওয়ার্ড রোডের (বর্তমানে মৌলানা আজাদ নোড ) দুনম্বর বাংলো ছিল তখন উপ-রাষ্ট্রপতি ভবন। না, প্রধান ফটকে কোন সশস্ত্র প্রহরী ছিল না। উন্মুক্ত ফটকের ভেতর দিয়ে ফুলের বাগানের মাঝখানের কঁকর বিছানো পথ ধরে এগিয়ে গেলেই ইংরেজ আমলের ভাইসরয় কাউন্সিলের সদস্যের জন্য তৈরি বাংলো। কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলেই বিরাট বারান্দা। বারান্দার বাঁদিকেই উপ-রাষ্ট্রপতির সেক্রেটারিয়েট। মিঃ ব, মিঃ ফাঁদকে ও আরো দু-একজন মাত্র কাজ করছেন। কোন দর্শনার্থী এলেই ভিতরে খবর চলে যাবে! দু-এক মিনিটের মধ্যেই ডাক পড়বে ভিতরে। ড্রইংরুমে নয়, অফিস ঘরেও নয়, একেবারে সোজা শোবার ঘরে।

হ্যাঁ, দার্শনিক উপ-রাষ্ট্রপতি ডক্টর সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ শোবার ঘরেই সবার সঙ্গে দেখাশুনা করতেন। একজনের শোবার মত পুরনো আমলের খাট। মাথার দিকে গোটা দুয়েক বালিশে হেলান দিয়ে বসে রাধাকৃষ্ণণ সব সময় পড়তেন। বিছানার সর্বত্র বই আর অসংখ্য পত্র-পত্রিকা। ঘরের মধ্যেও সর্বত্র বই আর বই। হাতের কাগজ বা বই পাশে সরিয়ে রেখেই উনি লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন। পরণে একটা ধুতি আর শার্ট। হয়তো একটা চাঁদরও। চোখে পুরু লেন্সের সোনালী ফ্রেমের চশমা! সৌম্যদর্শন জ্ঞানপিপাসু রাধাকৃষ্ণণ উপ-রাষ্ট্রপতি হয়েও সেই অতীত দিনের অধ্যাপকই ছিলেন। মাদ্রাজ, অন্ধ্র, কলকাতা, বেনারস আর অক্সফোর্ড, শিকাগো, হাবার্ট, প্রিন্সটন, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা করার সময়ও ঠিক একই ভাবে জীবন কাটাতেন। কুশ্চেভ, বুলগানিন, লেডী মাউন্টব্যাটনের মত রাষ্ট্রীয় অতিথিরা এলেই রাধাকৃষ্ণণ শুধু ড্রইংরুমে বসে কথাবার্তা বলতেন। অনেক বিদেশী রাষ্ট্রদূতরাও শোবার ঘরে বসেই ওঁর সঙ্গে কথাবার্তা আলাপ-আলোচনা করতেন। সমিতি বা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যাবার সময় মাথায় পরতেন বিখ্যাত পাগড়ী আর গায়ে চড়াতেন ঘিয়ে রঙের সেই বিখ্যাত লম্বা কোট। ব্যস। মোটর গাড়ি চড়তেন ঠিকই কিন্তু তাতে না থাকত লাল আলো বা রাষ্ট্রীয় পতাকা। সামনে পিছনে থাকত না পুলিশের কোন গাড়ি বা পাইলট।

উপ-রাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণণের বাংলোয় চাকর-বাকর বেয়ারা-চাপরাশী বা অর্ডারলী দেখা যেত না। পুত্র ডাঃ গোপালকে মাঝে মাঝে দেখা গেলেও স্ত্রী বা পুত্রবধূ নিজেদের কাজেই ব্যস্ত থাকতেন বাড়ির ভিতরে। কোন দিন কোন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে বা সরকারী সফরে ওঁরা কেউই রাধাকৃষ্ণণের সঙ্গে যাননি। শুধু দুবেলা খাবার সময় রাধাকৃষ্ণণ বাড়ির ভিতরে যেতেন, অন্য সব সময় ঐ নিজের শোবার ঘরে। কদাচিৎকখনও পায়চারী করতেন বারান্দায় বা সামনে-পিছনের লনে।

অধ্যাপনা জীবনের ব্যক্তিগত সচিব নাটা শাস্ত্রী ঐ বাড়িতেই আউট হাউসে থাকতেন এবং রাধাকৃষ্ণণের বইপত্তর ও অন্যান্য লেখালেখির ব্যাপারে সাহায্য করতেন। নাটা শাস্ত্রী কোন সরকারী কাজ করতেন না বা উপ-রাষ্ট্রপতির ঐ এক ঘরের সেক্রেটারিয়েটেও বসতেন না। বস্তু বা ফাঁদকে বাড়ি থেকে যাতায়াত করতেন সাইকেলে। নাটা শাস্ত্রী, বসু বা ফাঁদকের বাড়িতে কোন টেলিফোনও ছিল না। এক কথায় সব মিলিয়ে এক অতি অনাড়ম্বর ছবি।

এলো ১৯৬১। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ রাষ্ট্রপতি হয়ে চলে গেলেন রাষ্ট্রপতি ভবনে। গান্ধীজির বুনিয়াদী শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম রূপদাতা জামিয়া মিলিয়া খ্যাত বিহারের রাজ্যপাল ডাঃ জাকির হোসেন হলেন উপ-রাষ্ট্রপতি। ইতিমধ্যে ২ নম্বর কিং এডওয়ার্ডে রোডের বাংলোর জায়গায় নির্মান ভবন তৈরি হবে বলে ঠিক হওয়ায় ৬ নম্বর কিং এডওয়ার্ড রোডের বাংলো হল নতুন উপ-রাষ্ট্রপতি ভবন।

ডাঃ জাকির হোসেনও শিক্ষাজগতের মানুষ ছিলেন। পাণ্ডিত্যও ছিল যথেষ্ট। তবে ওঁর মত সৌন্দর্য ও রুচিবোধ শুধু নেহরুরই ছিল। তাই উপ-রাষ্ট্রপতি ভবনের চেহারা বদলে গেল। জাকির হোসেনের নিজস্ব তত্বাবধানে ও পছন্দমত তৈরি হল সুন্দর ফুলের বাগান। ওঁর গোলাপ প্রীতি সর্বজনবিদিত। অশ্য ও বিচিগোলাপে ভরে গেল চারদিকের বাগান। নিজে পরিচর্যা করে তৈরি করলেন আরো কত ফল-মূলের গাছ। ঘরদোরের চেহারাও বদলে গেল। সুন্দর কার্পেট ও দামী সোফার চাইতে জাকির হোসেন সাহেবের ব্যক্তিগত সংগ্রহের পেন্টিং ও আর্ট কালেকশন সবার দৃষ্টি কেড়ে নিত। কথাবার্তা, পড়াশুনা, চালচলন, ঘরদোর, বাগান, কাজকর্ম-জাকির হোসেন সাহেবের সব কিছুতেই সৌন্দর্যপ্রীতি ও রুচিবোধের পরিচয় ছিল। দর্শনপ্রার্থীদের বিদায় জানানোর জন্য উনি সব সময় বাংলোর শেষ দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিতেন। বাধাকৃষ্ণণের মত জাকির হোসেন সাহেবেরও পরিবারের কারুর সঙ্গে সরকারী কোন ব্যাপারে সম্পর্ক ছিল না।

এলো ১৯৬৭। ডাঃ জাকির হোসেন রাষ্ট্রপতি হলেন। বিখ্যাত শ্রমিক নেতা প্রগতিশীল ভি. ভি. গিরি উপ-রাষ্ট্রপতি হয়েই সব উল্টে দিলেন। যে সব বৈশিষ্ট্যের জন্য উপ-রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতি ভবন সবার মন জয় করেছিল, তার কিছুই রইল না এই জনদরদী প্রগতিবাদী শ্রমিক নেতার আমলে।

ডক্টর রাধাকৃষ্ণণ বা ভক্টর জাকির হোসেন সাহেবের পাণ্ডিত্য বা বিমুগ্ধ মন সবার হতে পারে ন–কিন্তু সারল্য, রুচি, সৌজন্য?

গদীতে বসার পরই ভি. ভি. গিরি জানালেন, এই বাংলোয় তার অফিস ও বাসস্থানের স্থান সঙ্কুলান সম্ভব নয়। সুতরাং লক্ষ টাকা ব্যয়ে তৈরি হল নতুন অফিস-বাড়ি। হোম মিনিস্ট্রিতে চিঠি দিলেন, আরো কয়েকটা এয়ার-কণ্ডিশনার চাই; চিঠি পেয়ে হোম মিনিস্ট্রি অবাক। সরাসরি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান না করে হোম মিনিস্ট্রি নতুন উপ-রাষ্ট্রপতিকে জানাল, উপ-রাষ্ট্রপতি রাজ্যসভার চেয়ারম্যান এবং তাই তাঁর অফিস ইত্যাদির ব্যাপারে বিধি-ব্যবস্থা করার দায়িত্ব রাজ্যসভার। সুতরাং আপনি অনুগ্রহ করে এই রাজ্যসভার সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। চিঠি গেল রাজ্যসভার সচিবের কাছে। সচিবও অবাক। প্রচলিত নিয়মানুসারে রাজ্যসভার চেয়ারম্যান অফিসে একটি ও বাড়িতে একটি এয়ারকসিনার পেতে পারেন কিন্তু তার বেশি কী করে দেওয়া যায়? রাজ্যসভার সচিব গোপনে প্রধানমন্ত্রী শ্ৰীমতী গান্ধীকে ব্যাপারটি জানালেন। শ্রীমতী গান্ধী একটু মুচকি হেসে বললেন, স্বয়ং ভাইস-প্রেসিডেন্ট যখন চাইছেন, তখন না বলবেন কী করে?

এখানেই শেষ নয়। দ্বারে নিযুক্ত হল সশস্ত্র প্রহরী। নিযুক্ত হলেন এভি-সি। গাড়ির সামনে দেখা গেল পুলিশ পাইলট ও পিছনে পুলিশের নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়ি। আরো কত কি!

জীবনে বহু জ্ঞানী, গুণী ও বিখ্যাত মানুষের সাহচর্যে এসেছি কিন্তু সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের মত অনন্য পুরুষ খুব কম দেখেছি। স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রথম নাগরিক হয়েও তিনি যে অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন; তা সত্যি বিস্ময়কর ছিল।  

দু নম্বর কিং এডওয়ার্ড রোডের মত রাষ্ট্রপতি ভবনেও রাধাকৃষ্ণণ প্রায় সারা দিনই কাটাতেন তার নিজের ছোট্ট ঘরে। সেই একটি সিঙ্গল খাটে আধশোয়া অবস্থায় বসে বসে দুনিয়ার সবকিছু পড়া দেখে সত্যি অবাক হয়ে যেতাম। অধ্যাপক রাধাকৃষ্ণণ, দার্শনিক রাধাকৃষ্ণণ, রাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণণের কাছে কত রকমের বই, পত্রপত্রিকা এবং রিপোর্ট আসত তার ঠিক-ঠিকানা নেই। অবিশ্বাস্য হলেও উনি সব কিছু পড়তেন। সিনেমা পত্রিকা? মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের মুখপত্র? হ্যাঁ, তাও পড়তেন।

একদিন সকালে আমি ওঁর ঘরে গেছি। উনি কি একটা পত্রিকা পড়ছিলেন। পাশে আরো অনেক রকমের পত্রপত্রিকা পড়ে আছে। হঠাৎ উনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, আর ইউ এ ফ্যান অব মীনাকুমারী অর বৈজয়ন্তীমালা?

প্রশ্ন শুনে আমি চমকে উঠি। হাসি।

হাসছ কী? এর পর তখনকার তিন-চারটে হিন্দী ছবির নাম করে গম্ভীর হয়ে বললেন, এই ছবিগুলোতে ওরা খুব ভাল অভিনয় করেছে, তা তুমি জানো?

আমি মীনাকুমারী বা বৈজয়ন্তীমালা সম্পর্কে কোন কথা না বলে বললাম, আপনি সিনেমার খবরও পড়েন।

কেন পড়ব না?

সিনেমা দেখার অবকাশ তাঁর ছিল না কিন্তু সব খবরাখবর রাখতেন এবং রাজ্যসভার কাজ পরিচালনার সময় কখনও কখনও এমন ছোটখাট টিকা-টিপ্পনী দিতেন যে এক মুহূর্তে সব উত্তেজনা থেমে যেত। ভূপেশদা (গুপ্ত) মাঝে মাঝে এমন তর্ক-বিতর্ক করতেন যে কংগ্রেস সদস্যরা ক্ষেপে উঠতেন। এই রকম তর্ক-বিতর্কের সময় একবার সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ হাসতে হাসতে বললেন, ভূপেশ, ডানদিকের সদস্যরা ( অর্থাৎ কংগ্রেসী) ভাবছে তুমি কে. এন. সিং-এর মত ভিলেনের ভূমিকায় নেমেছ কিন্তু আমি জানি তুমি অশোককুমারের মত আদর্শ নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতে চাইছ। তাই না?

চারদিক থেকে হহহহ করে হাসি উঠতেই তর্ক-বিতর্কের যবনিকা।

আরেকবারের কথা মনে পড়ছে। এই রকমই তর্ক-বিতর্কের সময় রাধাকৃষ্ণণ গম্ভীর হয়ে কংগ্রেস সদস্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনারা বাড়িতে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করতে পারেন কিন্তু ভূপেশের যে সুযোগ নেই বলেই এখানে এসে চেঁচামিচি করে। তবে আমি নিশ্চিত যে আজকের মত ভূপেশ আর আপনাদের সঙ্গে ঝগড়া করবে না।

এক কথা লিখতে গিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে এলাম, কিন্তু উপায় নেই। রাধাকৃষ্ণণ এবং জাকির হোসেন যত দিন উপ-রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যসভার চেয়ারম্যান ছিলেন, তত দিন বিরোধী পক্ষের এক চুল অধিকারও সরকার কেড়ে নিতে পারেননি। সরকারের কাজকর্মের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা করার পূর্ণ সুযোগ তারা পেয়েছেন এবং এই দুজন পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির সামনে কোন সদস্যই কোন দিন অশালীন কিছু করতে সাহস করেননি। সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলব, সরকারও বিরোধীদের গুরুত্ব পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করে তাদের দায়িত্ব পালনে অযথা বিঘ্ন সৃষ্টি করেননি। রাধাকৃষ্ণণ বা জাকির হোসেন আইনজ্ঞ ছিলেন না, কিন্তু তাদের ন্যায়-অন্যায় উচিত অনুচিতবোধ এত প্রখর ছিল যে সরকার ও বিরোধীপক্ষের কেউই কোন আক্ষেপ বা অভিযোগ করার অবকাশ পাননি। প্রকৃতপক্ষে এই দুজনের সময় রাজসভার আকর্ষণই অন্য রকম ছিল। ভি. ভি. গিরি এই গদীতে (উপ-রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যসভার চেয়ারম্যান ) বসার সঙ্গে সঙ্গেই সে আকর্ষণ শেষ হয়ে যায়, পাক ও জাত্তির আমলে অধঃপতন স্থায়ী রূপ নেয়।

যাই হোক, সৰ্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ যে কত অনাড়ম্বর জীবন পছন্দ করতেন, তার জ্বলন্ত উদাহরণ দেখা যেত তাঁর বিদেশ সফরের সময়। উপ-রাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণণকে প্রায়ই রাষ্ট্রীয় সফরে যেতে হত নানা দেশে এবং স্বাভাবিক ভাবেই উনি ওই সব দেশে রাষ্ট্রীয় অতিথি হতেন। সুতরাং দলবল নিয়ে সফরে গেলে কোন অসুবিধা হত না, কিন্তু না, তিনি কখনই তা করতেন না। সব সময় একা যেতেন। একবার নেহরু ওঁকে বললেন, হাজার হোক আপনি আমাদের ভাইস প্রেসিডেন্ট, বিদেশ সফরে আপনার সঙ্গে অন্তত দু-একজন অফিসার ও দু-একজন ব্যক্তিগত কর্মচারী থাকা একান্তই দরকার। 

হোয়াই? রাধাকৃষ্ণণ বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, যাতায়াত করি এয়ার ইণ্ডিয়া প্লেনে এবং প্লেনে এত যত্ন পাই যে অন্য কারুর সাহায্য দরকার হয় না। আর বিদেশের মাটিতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় দূতাবাসের লোকজনই আমার দেখাশুনা করে। তাছাড়া সর্বত্রই আমার দু-চারজন ছাত্রছাত্রীকেও পেয়ে যাই। ওরাও কী আমার কম সাহায্য করে?

দ্যাট আই এগ্রি– নেহরু তবুও বললেন, এ সব সত্ত্বেও আপনার সঙ্গে দু-একজন থাকা দরকার। তাছাড়া এতে তো আমাদের বিশেষ খরচা নেই। আপনি তো সর্বত্রই স্টেট গেস্ট।

রাধাকৃষ্ণণ এবার হেসে বললেন, কিন্তু যাতায়াতের প্লেন ভাড়া তো আমাদের সরকারকেই দিতে হয়। সুতরাং লোকজন সঙ্গে নিয়ে সরকারের সে টাকাটাই বা নষ্ট করি কেন?

নেহরু আর কিছু বলতে পারেননি।

সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ এই রকমই সুবিবেচক ছিলেন। বাহ্যিক আড়ম্বর বা ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধার জন্য জনসাধারণের অর্থের অপ ব্যবহার করতে তিনি আদৌ অভ্যস্ত ছিলেন না। পরবর্তী কালে দিল্লীতে ও বিভিন্ন রাজ্যে কত প্রগতিবাদী জনদরদী নেতাই তো দেখলাম কিন্তু তাদের অধিকাংশের মধ্যেই এই রকম সুবিবেচনার ছিটে-ফোঁটাও দেখতে পেলাম না।

সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের ছাত্ৰপ্ৰীতি দেখেও স্তম্ভিত হয়ে যেতাম। মনে পড়ছে লক্ষ্ণৌয়ের একটা ঘটনা।

মাত্র একদিনের সফর। সকালে গিয়ে বিকেলেই ফিরবেন। একটির পর একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা। মাঝে রাজভবনে মধ্যাহ্ন ভোজন এবং সামান্য কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম। রাজভবনের মধ্যাহ্ন ভোজনে আমন্ত্রিত হয়েছেন লক্ষৌয়ের বহু রথী-মহারথী কেষ্টবিষ্টুর দল। রাধাকৃষ্ণণ অথা কথাবার্তা বলে সময় নষ্ট না করে আমন্ত্রিতদের সবাইকে নমস্কার করেই সোজা খাবার টেবিলে বসলেন। খাওয়া দাওয়া শেষ করেই উনি আমাকে বললেন, চল, একটু ঘুরে আসি।

বললাম, চলুন।

উত্তরপ্রদেশ সরকারের চীফ সেক্রেটারি পাশেই ছিলেন। এবার রাধাকৃষ্ণণ তাকে বললেন, আমি একটু বেরুব।

তখনই কোথাও বেরুবার প্রোগ্রাম ছিল না। তাই চীফ সেক্রেটারি সবিনয়ে দিবেদন করলেন, বাট স্যার, ইওর নেক্সট প্রোগ্রাম ইজ…

ইয়েস আই নো। ঠিক সময়েই আমি আবার রাজভবনে ফিরে আসব।

চীফ সেক্রেটারি আর কোন কথা বলতে সাহস করলেন না। তাড়াতাড়ি দু-চারজনের সঙ্গে ফিস ফিস করে কথা বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণও অতিথিদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলেন।

নির্দিষ্ট গাড়িতে চড়তে গিয়েই রাধাকৃষ্ণণ দেখলেন, সামনে পিছনে পুলিশের বেতার গাড়ি, সশস্ত্র পুলিশের জীপ, স্বরাষ্ট্র সচিব ও প্রটোকল অফিসারের গাড়ি-টাড়ি ছাড়াও পুলিশের মোটর সাইকেল আউট রাইডার। এ সব দেখেই রাধাকৃষ্ণণ পাশে দাঁড়ানো চীফ সেক্রেটারিকে বললেন, আমি এক ছাত্রের বাড়ি যাচ্ছি। কোন পুলিশের গাড়ি যেন এই গাড়ির সামনে পিছনে না থাকে।

চীফ সেক্রেটারি হতভম্ব কিন্তু কী করবেন? রাজভবনের চত্বরে পড়ে রইল পুলিশের সব গাড়ি।

আমাদের গাড়ি রাজভবন থেকে বেরুতেই রাধাকৃষ্ণণ ড্রাইভারকে বললেন, টার্ন রাইট।

কিছু দূর যাবার পর উনি আমাকে বললেন, বাঁদিকের থার্ড রাস্তায় ঢুকেই ডানদিকে ঘুরতে হবে।

গাড়ি সে রাস্তায় ঢোকার পর কখনো সোজা, কখনো ডাইনে বয়ে করে একটা ভাঙাচোরা বাড়ি নজরে পড়তেই রাধাকৃষ্ণণ আমাকে বললেন, ঐ পুরানো বাড়িটার সামনে গাড়ি থামাও।

গাড়ি থামল ঐ বাড়ির সামনে।

এবার উনি আমাকে বললেন, দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকলেই দেখবে দড়ি ঝুলছে। ঐ দড়ি টানলে ওপরে ঠং ঠং করে ঘণ্টা বাজবে। ঘণ্টা বাজলেই একটা মেয়ে বেরিয়ে আসবে। ওকে বলবে, আমি এসেছি। সব শেষে বললেন, বাংলাতেই কথা বোলো। ওরা বাঙালী।

গাড়ি থেকে নামলাম। দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখি, হ্যাঁ, দড়ি ঝুলছে। দড়িটা টানতেই ওপরে ঠুং ঠাং আওয়াজ হল। মধ্য বয়সী একজন মহিলা ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কাকে চাই?

বললাম, ভক্টর রাধাকৃষ্ণণ এসেছেন।

আনন্দে, খুশিতে ভদ্রমহিলা প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, স্যার এসেছেন! উত্তেজনায় সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ নেমেই আবার ওপরে উঠে গেলেন। চিৎকার করে কাকে যেন বললেন, স্যার এসেছেন। আমি নিয়ে আসছি। তারপর উনি তর তর করে নেমে এলেন।

ওকে দেখেই রাধাকৃষ্ণণ গাড়ি থেকে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করলেন, গৌরী (?) হাউ আর ইউ? হাউ ইজ অমল (?)?

ভদ্রমহিলা ওঁকে প্রণাম করে বললেন, এখন একটু ভাল।

তারপর রাধাকৃষ্ণণ ওপরে উঠলেন।

মাঝারি সাইজের একখানা ঘর। ঘরের একপাশে চৌকির ওপর অমলবাবু শুয়ে। ঘরের চারদিকে কয়েকটা আলমারী ও শেলফে বই। পড়ার টেবিলেও অনেক বই ও কাগজপত্র। রাধাকৃষ্ণণকে দেখে অমলবাবু উঠে বসার চেষ্টা করতেই উনি বাধা দিলেন। চেয়ারটা চৌকির পাশে টেনে নিয়ে বসে রাধাকৃষ্ণণ ওর মাথায় হাত রাখলেন। তারপর বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর গৌরীদেবীর কাছ থেকে মেডিকেল রিপোর্টগুলো নিয়ে বললেন, আমি দিল্লীর দু-একজন ভাল ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে ওদের মতামত জানিয়ে দেব। আর ওরা যদি বলেন, দিল্লী যেতে, তাহলে চলে এসো। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। আমি নীরবে মুগ্ধ হয়ে সব কিছু শুনি।

রাধাকৃষ্ণণ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। অমলবাবু শুয়ে শুয়েই ওঁকে প্রণাম করার চেষ্টা করলেন। উনি বাধা দিয়ে বললেন, থাক যাক। আগে সুস্থ হয়ে নাও, তারপর প্রণাম করো।

গৌরী একে প্রণাম করলেন, রাধাকৃষ্ণণ ওর মাথায় হাত দিয়ে বললেন, তোমার শরীর যেন ঠিক থাকে।

পনেরো-বিশ মিনিট। না, আর সময় নেই। ধীরে ধীরে রাধাকৃষ্ণণ নেমে এলেন।

রাজভবনে ফেরার পথে গাড়িতে রাধাকৃষ্ণণ আমাকে বললেন, এরা দুজনেই আমার কাছে পড়েছে।

এবার আমি বলি, তা বুঝেছি। তাছাড়া এত অলি-গলি পার হয়ে ও বাড়িতে যেতেই বুঝলাম, ওখানে আপনার যাতায়াত আছে।

রাধাকৃষ্ণণ একটু হেসে বললেন, ছাব্বিশ সাতাশ বছর আগে একবারই এই বাড়িতে এসেছি। তারপর ওরাও অনেক ঘুরেফিরে এখানে ফিরে এসেছে।

ছাব্বিশ-সাতাশ বছর আগে ওই একবারই এসেছিলেন? আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করি।

ইয়েস।

আমি ওঁর স্মৃতিশক্তি দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *