১৪. মা-র সঙ্গে কথা বলার পর

মা-র সঙ্গে কথা বলার পর ক্যাপ্টেনের খেয়াল হল, শরীরটা ঝরঝরে হয়েছে। মনেই হচ্ছে না গতকাল অসুস্থ ছিল। তাছাড়া মা-র আসার খবর পেয়ে যেন মনটাও বেশ খুশিতে ভরে গেল।

ক্যাপ্টেন উঠে গিয়ে জানালার ধারে দাঁড়াল। ঝুঁকে দেখল গাছপালার পাতায় পাতায় সূর্যের আলো লুকোচুরি খেলছে। সামনের লতায় পাতায় শিশির খুঁজে না পেলেও রাত্রির শান্তি তখনও দিনের কল্লোলে একেবারে হারিয়ে যায়নি।

একটু জোরে জোরে নিশ্বাস নিল। বুকটা জুড়িয়ে গেল। গঙ্গার ঠাণ্ডা হাওয়া যে তখনও কলকাতার লক্ষ লক্ষ মানুষের দীর্ঘনিশ্বাসের ভয়ে পালিয়ে যায়নি। বেশ লাগল।

বাতাস যেন ওর কানে কল্যাণের আগমনী বার্তা পৌঁছে দিয়ে গেল। ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে ক্যাপ্টেন মনের আনন্দে দু লাইন গানও গাইল-অরূপবীণা রূপের আড়ালে লুকিয়ে বাজে, সে বীণা আজি উঠিল বাজি হৃদয় মাঝে। অরূপবীণা…।

তাইতো! মণিকা বা মাসিমাকে তো বলা হল না মা আসছেন। আসছেন মানে? আজই, বোম্বে মেলে রওনা হচ্ছেন।

জানো মণিমালা, এক্ষুনি মা ট্রাংক কল করেছিলেন।

কি ব্যাপার?

তোমাকে দেখতে আসছেন…

সত্যি? বলে ফেলেই বোধহয় মণিকার ভীষণ লজ্জা হল। হয়তো এমন করে আগ্রহ দেখান ঠিক হয়নি। হয়তো বাবা-মা কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন। দাঁড়াও খবরটা মা-কেও দিচ্ছি।

খবরটা শুনে মণিকারও মাও খুশি হলেন। সত্যিই যে খুশি হয়েছিলেন, তা বোঝা গেল পরের দিন সকালে হাওড়া স্টেশনে।

ক্যাপ্টেন বেশ খানিকটা আগেই স্টেশনে পৌঁছেছিল। দমদমে একজন গেস্টকে সি-অফ করে সোজা এসেছিল। ফুল ইউনিফর্মে। সঙ্গে তকমা আঁটা উর্দিপরা অর্ডালি লখন সিং। রাজভবনের গাড়ি থেকে লখন সিং-কে নিয়ে নামতেই প্ল্যাটফর্মের কিছু লোক একবার দেখে নিল। জি-আর-পির একটা কনস্টেবল সেলামও দিল।

ক্যাপ্টেন গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট শেষ করল। একবার হাতের ঘড়িটা দেখল। ট্রেন আসতে মিনিট পনেরো বাকি। প্লাটফর্মে পায়চারি করার জন্য একটু এগোতেই ক্যাপ্টেন আবাক হয়ে গেল।

একি মাসিমা, আপনিও এসেছেন? এক মুহূর্ত থেমে জিজ্ঞাসা করল, কার সঙ্গে এলেন?

উনিও এসেছেন।

সে কি? মেলোমশাইও এসেছেন?

শুধু ক্যাপ্টেন নয়, ওর মা ট্রেন থেকে নেমেই ওদের পেয়ে অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছিলেন। একি আপনারা কষ্ট করে এলেন কেন? মণিকাই তত নিয়ে যেতে পারত।

ডক্টর ব্যানার্জি বললেন, আপনি দয়া করে আমাদের ওখানে আসছেন আর আমরা আসব না।

মণিকার মা বললেন, আপনার কথা এত শুনেছি যে দেখার আগ্রহটা চেপে রাখতে পারলাম না?

ক্যাপ্টেনের মা বললেন, আমিও কি আপনাদের বিষয়ে কম জানি? আপনাদের না দেখলেও আপনারা আমার অপরিচিত নন।

একটু পরে জিজ্ঞাসা করলেন, মণিকা বাড়িতেই আছে?

ওর মা জানালেন, হ্যাঁ।

গাড়িতে মালপত্র চাপানো হতেই ওরা রওনা হলেন।

দুটো গাড়ি পর পর থামতেই মণিকা বেরিয়ে এসে ক্যাপ্টেনের মাকে প্রণাম করল। ওর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন, দীর্ঘজীবী হও মা!

সবাই মিলে ড্রইংরুমে গিয়ে বসে খোসগল্প শুরু করলেন। খানিকটা পরে মণিকার মা ভেতরে চলে গেলেন। নিশ্চয়ই সংসারের তদারকির জন্য। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে ক্যাপ্টেনের মাকে বললেন, আর এখন গল্প করবেন না! এবার হাত মুখ ধুয়ে ব্রেকফাস্ট করে নিন।

ক্যাপ্টেন সঙ্গে সঙ্গে জানাল, মাসিমা, আমি যত বেশি খাই, আমার মা তত কম খান। ব্রেকফাস্ট-ট্রেকফাস্টের ঝামেলা মার নেই।

সে কি? এখন কিছু খাবেন না?

মিসেস ব্যানার্জি একটু অবাক হলেন।

সকালে আমি কিছু খাই না।

সারা রাত ট্রেন জার্নি করে এসে একটু কিছু মুখে দেবেন না, সে কি কথা?

ব্যানার্জি-দম্পতি সত্যি একটু অস্বস্তিবোধ করছিলেন। তাইতো ক্যাপ্টেন আবার বলল, স্নান-টান সেরে এক গেলাস সরবৎ ছাড়া আর কিছু খান না।

চলুন আপনারা ব্রেকফাস্ট খাবেন। আমি বসে বসে গল্প করব এখন।

এতক্ষণে মণিকা বলল, আপনি বরং স্নানটা সেরে নিন।

একটু গল্প-টল্প করি। তারপর স্নান করব এখন। এত ব্যস্ত হবার কিছু নেই।

মণিকার মা আবার ভেতরে চলে গেলেন। ক্যাপ্টেনের মা এবার মণিকাকে বললেন, চল মা, তোমাদের বাড়িটা ঘুরে দেখি।

মণিকা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আসুন।

একতলা ঘুরে দোতলায় গিয়ে মণিকা বলল, এটাই আমার ঘর।

তা আমি জানি।

মণিকা ঘাড় ঘুরিয়ে পাশ ফিরে চাইল। আপনি জানেন?

হ্যাঁ মা। আমি জানি। মানিক আমাকে সব কিছু লেখে।

সব কিছু? মণিকা লজ্জায় রক্তিম হয়ে ওঠে।

আমি তোমার এই ঘরে তোমার কাছেই থাকব কেমন?

নিশ্চয়ই।

তাছাড়া এ বাড়িতে তুমিই তো আমার সব চাইতে আপন।

মণিকা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।

ক্যাপ্টেনের মা এবার মণিকার মুখোনা তুলে ধরে বললেন, সত্যি বলছি মা। মানিকের চিন্তায় আমি রাত্রে ঘুমুতে পারি না। কোন দোষ না করলেও ভগবান ওকে বড় শাস্তি দিয়েছেন।

মণিকা একবার মুহূর্তের জন্যে ওর দিকে তাকিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে নিল।

ক্যাপ্টেনের মা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।

মণিকা কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারল না কিন্তু অজস্র অজানা সম্ভাবনার জন্য বিশ্রী অস্বস্তিবোধ করল সারাদিন।

শুধু কি অস্বস্তি?

উৎকণ্ঠাও। ক্যাপ্টেনের জন্য একটা চাপা উৎকণ্ঠাও বোধ করল। জীবনে কী এমন আঘাত পেয়েছে ও? তাই কি ও এতটা সংযত, সংহত?

সমবেদনাও বোধ করল। মনটা ভীষণ নরম হয়ে গেল। নিজের সমস্ত অন্তর দিয়ে ভালোবেসে ওর অতীত জীবনের সব দুঃখ, সব অভাব মুছে ফেলে দিতে চাইল।

সারাটাদিন বেশ কাটল। হাসি, গল্প, গান। রেঙ্গুনের গল্প, এলাহাবাদের গল্প। ক্যাপ্টেনের ছোটবেলার গল্প। আরো কত কি। বুড়ো অধ্যাপক মঙকে নিয়েই কাটল বেশ কিছুক্ষণ।

ব্রেকফাস্টের পরেই ক্যাপ্টেন চলে গিয়েছিল গভর্নমেন্ট হাউসে। অনেক কাজ ছিল। তবুও ঘন্টায় ঘন্টায় টেলিফোন করছিল। মাকে, মাসিমাকে, মণিকাকে।

তুমি কখন বেরুবে?

কোথায় আর বেরুব?

বিজয়া মাসিমার সঙ্গে দেখা করবে না?

আজকে আর যাচ্ছি না।

এমনি তো একটু ঘুরতে বেরুবে।

নারে বাবা না। আজ আমি কোথাও বেরুব না। এদের সঙ্গে গল্পগুজব করি। কাল-পরশু দেখা যাবে।

ক্যাপ্টেন বুঝল জোর আড্ডা জমেছে। তাহলে আজ আর আমাকে দরকার নেই?

দরকার থাক আর নাই থাক, তোর কাজকর্ম শেষ হলে চলে আসিস।

পরে একবার মণিকাকে জিজ্ঞাসা করল, মাকে কেমন লাগছে?

তোমার চাইতে ভালো।

নিশ্চয়ই! সে বিষয়ে আবার ডাউট আছে নাকি? আফটার অল সি ইজ মাই মাদার।

তাই নাকি?

এক্সকিউজ মি ইওর এক্সেলেন্সি! ডু ইউ নিড ইওর এ-ডি-সি এনি টাইম টু-ডে?

মণিকা ফিস ফিস করে বলেছিল, আই ডোন্ট নিড ইউ বাট তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো।

বিকেলে দিকে ক্যাপ্টেন এসেছিল। কিছুক্ষণ গুল্পগুজব করে চলে যাচ্ছিল। মা বললেন, আমার ফেরার টিকিটটা কাটতে ভুলিস না।

তুমি কবে যাবে?

ভাবছি পরশু চলে যাব।

মিসেস ব্যানার্জি প্রতিবাদ করলেন সঙ্গে সঙ্গে। তাই কি হয়? সপ্তাহ খানেক তত থাকুন, তারপর দেখা যাবে।

ওকে যে একলা রেখে এসেছি। বেশি দিন থাকি কি ভাবে?

হঠাৎ মণিকা বলে ফেলো, তাহলে এখন এলেন কেন?

কি করব মা? অনেকদিন ছেলেটাকে দেখি না; তাছাড়া তোমাদের দেখতেও ভীষণ ইচ্ছা করছিল।

মিসেস ব্যানার্জি বললেন, তাই বলে আপনি পরশু যেতে পারবেন না।

ক্যাপ্টেন বলল, তুমি বরং আজকের দিনটা চিন্তা কর। কাল আমাকে তোমার ডিসিশন জানিয়ে দিও।

তোর ওসব চালাকি ছাড়। এই করে করে তুই আমাকে সেবারের মতো করবি ভাবছিস, তাই না?

সত্যি সেবার মাকে মীরাটে আনিয়ে কি কাণ্ডটাই না করেছিল। আজ না কাল, কাল না পরশু করতে করতে তিন সপ্তাহ কাটিয়ে দিয়েছিল।

ক্যাপ্টেন চলে যাবার পর ওর মা মীরাট ষড়যন্ত্রের কাহিনিটা শোনালেন। মানিকটা যে কী, বুঝি না। এত বড়ো হল কিন্তু এখনও ছেলেমানুষি গেল না।

রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর ডক্টর ব্যানার্জি স্টাডিতে বসে বসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব হল। অনেক কথার মাঝখানে ডক্টর ব্যানার্জি হঠাৎ বললেন, একটা ভালো ছেলের হাতে এই মেয়েটাকে তুলে দিতে পারলে আমরাও দুজনে বেরিয়ে পড়তে পারি।

ওর জন্য আর এত দুশ্চিন্তার কি আছে? মণিকার মতো মেয়েকে ঘরে নিতে পারলে অনেকেই খুশি হবেন।

ব্যস। ওই পর্যন্তই। দুপক্ষের কেউই আর এগোতে পারেননি। ডক্টর ব্যানার্জি তাড়াহুড়ো করতে চাননি। ক্যাপ্টেনের মা এগোতে পারেননি নিজের সংকোচের জন্য।

গল্পটল্প করে উপরে যেতে যেতে অনেক রাত হয়ে গেল।

আমার জন্য তোমার শুতে শুতে অনেক রাত হয়ে গেল, তাই নাম মা?

না, না, এমন কি রাত হল?

সেই শুরু।

ক্যাপ্টেনের মা শোবেন বলে মণিকার ঘরে নীচের থেকে একটা খাট এনে পাতা হয়েছে। দুটো সিঙ্গলবেডের খাটের মাঝে বেশ খানিকটা ফাঁক।

খাটটা একটু এগিয়ে নিই, কি বল মা! এত দূরে থাকলে তোমার সঙ্গে গল্প করব কেমন করে।

মণিকাই খাট দুটোকে টেনে পাশাপাশি করল।

দুজনেই শুয়ে পড়লেন।

তোমার এত কাছে শুলে তোমার অসুবিধে হবে না তো?

না, না, অসুবিধে হবে কেন? আমি তো ভেবেছিলাম এই একটা খাটেই শোব কিন্তু মা বললেন আপনার কষ্ট হবে।

তারপর কিছু মামুলি কথাবার্তা।

মানিকের চিঠিতে পড়তাম তোমরা খুব ভালো লোক কিন্তু সত্যি ভাবিনি তোমরা এত ভালো।

মণিকা প্রথমে কিছু জবাব দেয় না। চুপ করে থাকে। একটু পরে বলে, নিশ্চয়ই খুব বাড়িয়ে বাড়িয়ে লেখেন।

খানিকটা লজ্জা-দ্বিধার সঙ্গে কথা কটা বলল। ক্যাপ্টেনের মা-র কাছে ক্যান্টেনকে কি বলে উল্লেখ করবে ভেবে পাচ্ছিল না। ক্যাপ্টেনকে ক্যাপ্টেন বলাটা উচিত মনে হল না। উনি বা ও বলতেও লজ্জা করল।

বাড়িয়ে লেখার ছেলে ও না! তুলাদণ্ডের বিচার করে ও কথা বলে, চিঠি লেখে…

কথাটা শেষ হবার আগেই একটা ছোট্ট দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।

…ওরা বাব জাজ হয়েও বিচারে ভুল করেছেন কিন্তু মানিক?…

আবার থামলেন। আবার বললেন, অসম্ভব।

মণিকাটা চুপ করে শুয়ে আছে। মুখোমুখি।

মানিক যে বিচারে ভুল করে না, তার প্রমাণ চাও?

মণিকা হাসল। আপনি মা হয়ে ওকে বেশি চিনবেন, না কি আমি?

প্রফেসর মঙকে দেখাশুনা করতে গিয়ে যখন তোমার সঙ্গে, তোমার বাবা-মার সঙ্গে ওর আলাপ হল তখনই আমাকে জানাল। আজ সারাদিন তোমাদের সঙ্গে মেলামেশা করতে করতে ওর সেই চিঠিটার কথা ভাবছিলাম।

কেন?

আলোটা জ্বাল।

মণিকা উঠল। আলোটা জ্বালল।

আমার স্যুটকেসটা খোল।

মণিকা সুটকেসটা খুলতেই বললেন, উপরের শাড়িটার তলায় একটা লম্বা খাম আছে না?

শাড়িটা তুলতেই খাম পেল।

এদিকে নিয়ে এসো।

মণিকা খামটা নিয়ে খাটের উপর বসল।

ক্যাপ্টেনের মা বললেন, ভেতরের চিঠিটা পড়ে দেখ।

আপনার চিঠি আমি পড়ব?

পড় না। মার কাছে লেখা ছেলের চিঠি পড়তে লজ্জা কি?

ছোট্ট চিঠি।-প্রফেসর মঙ যে আসছেন, সেকথা তোমাকে আগেই জানিয়েছি। সেদিন ওই বৃদ্ধ অধ্যাপককে দেখতে গিয়ে আলাপ হল একটা বাঙালি মেয়ের সঙ্গে। মণিকা ব্যানার্জি। তারপর ওর বাবা-মার সঙ্গে। ডক্টর ব্যানার্জি রেঙ্গুন ইউনিভার্সিটিতে ছিলেন এবং সেই সূত্রে ওদের আলাপ ও ঘনিষ্ঠতা। তুমি তো জান আমি তোমার কোলের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারলেই সবচাইতে ভালো থাকি। খুব বেশি লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করতে আমার মোটেও ভালো লাগে না, পছন্দও করি না। বিশেষ করে মেয়েদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে আমার অনেক দ্বিধা অনেক ভয়। তবুও ওদের সবার সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করলাম। ডক্টর ব্যানার্জি দেবতুল্য লোক আর ওর স্ত্রী? মাসিমা? তোমার দ্বিতীয় সংস্করণ। তোমার এই হ্যাংলা ছেলেটাকে কি আদর-যত্ন করেই খাওয়ান।…

চিঠিটা পড়তে পড়তেই মণিকা হাসল।

হাসছ কেন?

এইসব হ্যাংলা-ট্যাংলা লেখার কোন মানে হয়।

উনিও হাসতে হাসতে বললেন, ওর কথা বাদ দাও।

মণিকা আবার চিঠিটা পড়তে শুরু করল…মণিকা? রূপ-যৌবন শিক্ষা-দীক্ষা থাকা সত্ত্বেও কৃষ্ণচূড়ার মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে নিজের অহমিকা প্রচার করতে শেখেনি কিন্তু কাছে এলেই রজীনগন্ধার মতো সৌরভে ভরিয়ে দেয় সবাইকে। গভীরতা আছে কিন্তু উচ্ছলতা নেই। তুমি যখন কলকাতা আসবে, তখন আলাপ করিয়ে দেব। নিশ্চয়ই ওদের সবাইকে তোমার ভালো লাগবে।…

চিঠিটা পড়া শেষ হল। তবুও মণিকা মনে মনে আবৃত্তি করল, কৃষ্ণচূড়ার মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে নিজের অহমিকা প্রচার করতে শেখেনি কিন্তু কাছে এলেই রজনীগন্ধার মতো সৌরভে ভরিয়ে দেয় সবাইকে।

চিঠিটা খামে ভরে আবার সুটকেসের মধ্যে রেখে সুইচটা অফ করল। ক্যাপ্টেনের মা-র পাশে শুয়ে পড়ল।

তোমাদের সঙ্গে দুচার দিন মেলামেশা করেই ওই চিঠি লিখেছিল…

রাত্রিতে নিস্তব্ধতার মধ্যে দুজনে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর ক্যাপ্টেনের মা বললেন, অনেক আশা নিয়ে তোমার কাছে এসেছি কিন্তু…

গলা দিয়ে যেন কথা বেরুতে পারল না।

মণিকা একটু অস্থির, একটু চঞ্চল হয়ে উঠল, কিন্তু কি…

তুমি কি আমাদের ক্ষমা করতে পারবে?

একি বলছেন আপনি?

ঠিকই বলছি মা।

মণিকা একটু থতমত খায়। তবু বলে, আপনারা আবার অন্যায় কি করলেন যে ক্ষমা চাইছেন?

হয়তো ইচ্ছা করে করিনি কিন্তু ঘটনাচক্রে অন্যায় করেছি বৈকি।

গলার স্বরটা ভেজা ভেজা। হয়তো দুএক ফোঁটা চোখের জল পড়তেও শুরু করেছে। মণিকা সাহস দেবার জন্য বলল, কিছু না কিছু অন্যায় সব মানুষেই করে তার জন্য এত…

ঘটনাটা যে বড়ই লজ্জার, বড়ই দুঃখের।

ওই অন্ধকারের মধ্যে ছলছল জলভরা কাতর দুটি চোখ দেখতে পেল মণিকা। ওসব ভুলে যান। অত চিন্তা করার কি আছে?

তুমি ক্ষমা করলে, তুমি ভিক্ষা দিলে হয়তো সত্যি ভুলে যাব, হয়তো…

ছি ছি, আপনি অমন করে বলবেন না। মণিকা দুটি হাত দিয়ে বৃদ্ধার দুটি হাত চেপে ধরল।

এই রাত্রির অন্ধকারেও তোমাকে সে কথা বলতে ভয় করছে, লজ্জা করছে…

কি দরকার সে কথা বলার?

তোমাকে না বললে তো চলবে না মা।

আমাকে?

হ্যাঁ মা।

মণিকা ঘাবড়ে গেল। আপনি কাঁদছেন?

মণিকা তাড়াতাড়ি উঠে বসে হাত দিয়ে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিল। আপনি একটু ঘুমোন।

সারাটা বুকের মধ্যে তোলপাড় করছে। তোমাকে সবকথা না বলা পর্যন্ত আমার চোখে ঘুম আসবে না।

বলুন না কি কথা।

বলব?

নিশ্চয়ই।

সবকথা শোনার পর আমাকে, মানিককে, মানিকের বাবাকে ক্ষমা করতে পারবে কি? ঘেন্নায় আমাদের দূরে ঠেলে দেবে না তো?

মণিক দুহাত দিয়ে ক্যাপ্টেনের মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার ওইসব কথা বলছেন?

বলব না মা?

রাত্রি আরো গম্ভীর হল। গম্ভীর হল দুটি প্রাণ, দুটি মন ক্যাপ্টেনের মা আর দূরে সরে থাকতে পারলেন না, লুকিয়ে রাখতে পারলেন না মনের কথা।

…তিন পুরুষ ধরে এলাহাবাদে ওদের বাস। যথেষ্ট সম্মান সম্রম নিয়েই বাস করছিলেন। আজও সে সম্মান সম্রম নষ্ট হয়নি সত্য কিন্তু হঠাৎ একটা ভূমিকম্পে সারা সংসারটা ভেঙেচুরে ছারখার হয়ে গেল।

ভূমিকম্প?

তার চাইতেও খারাপ মা। মানিক কমিশনড়…অফিসার হল। ওর বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগে পড়লাম আমরা দুজনে। বেনারসের একটা মেয়ে পছন্দ করা হল। বাবা-মা নেই। গরিব মাসির কাছে মানুষ হয়েছে। দেখতে শুনতেও বেশ। তাছাড়া বি-এ পাশ ছিল। জাস্টিস রায়ের ছেলের সঙ্গে বিয়ে হবে শুনে ওরা তো হাতে স্বর্গ পেলেন।…

মণিকা একটু উতলা হয়ে পড়ে, তারপর?

খুব ধুমধাম করে বিয়ে-বৌভাতও হল। মানিকের একদম ছুটি ছিল না বলে বৌভাতের পরের দিনই চলে গেল পাঠানকোট।

মণিকা পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে শুনল।

মাস খানেক বেশ কাটল। খুব আনন্দে কাটল। কিন্তু তারপর একদিন কয়েক মিনিটের মধ্যে…

থেমে গেলেন। আর যেন বলতে পারছিলেন না। গলার স্বরটা আরো ভারি হয়ে উঠেছিল। লজ্জায়, ঘেন্নায়, দুঃখে কিছুক্ষণ বাক-শক্তি রহিত হয়ে বসে রইলেন।

না, না, চুপ করে বসে থাকলে চলবে কেন? এই রাত্রির অন্ধকারের মধ্যেই সব কিছু বলতে হবে, সব কিছু ফয়সালা করতে হবে।

…আমি গঙ্গা পুজো দিতে গিয়েছিলাম ত্রিবেণীতে। সঙ্গমে সন্ধ্যার সময় একলা একলা যাওয়া ঠিক হবে না বলে চাকরটাও গিয়েছিল আমার সঙ্গে। ফাঁকা বাড়িতে শুধু পুত্রবধূকে পেয়ে ওর মাথায় যে কি ভূত চাপল, জানি না। হঠাৎ উত্তেজনায় উনি কয়েক মুহূর্তের জন্য পশু হয়ে গিয়েছিলেন।…

আবার একটু থামতে গিয়েছিলেন। উত্তেজনায় সারা শরীর কাঁপছে। গলা দিয়ে কথা বেরুচ্ছে। তবুও থামতে পারলেন না।

…এই কলঙ্ক নিয়ে মেয়েটা বাঁচতে চাইল না। আলমারির লকার থেকে রিভলভার বের করে নিজেকে শেষ করে দিল…

মণিকা তাড়াতাড়ি দুহাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল, সে কি?

হ্যাঁ মা।

এখানেই শেষ করেননি সে সর্বনাশা কাহিনি। বলেছিলেন কিভাবে সব ব্যাপারটা ধামা চাপা দেওয়া হয়। দুনিয়ার সবাই জানল, জাস্টিস রায়ের পুত্রবধু হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে কিন্তু স্তম্ভিত জাস্টিস রায় স্ত্রীর কাছে, একমাত্র পুত্রের কাছে সব কথা বলেছিলেন। নিজের অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা ভিক্ষা করেছিলেন।

জানো মা, ওর মতো দেবতুল্য মানুষ হয় না। কিন্তু তবুও কেমন করে মুহূর্তের উত্তেজনায় উনি এমন কাজ করলেন, তা ভেবে পাই না। মানিককে উনি নিজের প্রাণের চাইতেও ভালোবাসেন। তবুও এসব হল কেমন করে, ভেবে পাই না।

কাঁদতে কাঁদতে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন বৃদ্ধা।

তারপর থেকে মানিক আর এলাহাবাদ যায়নি। আর ওর বাবার অবস্থা দেখলে তুমি চোখের জল রাখতে পারবে না। এত বড় অন্যায় করেও কোনো শাস্তি না পেয়ে মানুষটা যে কিভাবে তিলে তিলে দগ্ধ হচ্ছে, প্রতি মুহূর্ত জ্বলেপুড়ে মরছে, তা তুমি চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না মা…

মণিকাও স্থির থাকতে পারেনি। রায় পরিবারের সর্বনাশা কাহিনি শুনতে শুনতে চোখের দৃষ্টিটা ঝাঁপসা হয়ে গেছে।

এই অর্ধমৃত স্বামী আর ঘর ছাড়া পুত্র নিয়ে আমি যে কিভাবে বেঁচে আছি, তা ভাবতে পার মা? মানিককে কি আমি কোনোদিন ঘরে ফিরিয়ে নিতে পারব না? ওর বাবা কি মৃত্যুর আগে আর মানিককে দেখতে পারবে না?…

না, না, আর না। আত্মসমর্পণ করতে লজ্জা কি? এই বাকি রাতটুকুর মধ্যে যদি আত্মসমর্পণ করে ক্ষমা না পাই, তবে তো ভোরের আলোয় মুখ দেখাতে পারব না।

দুহাত দিয়ে মণিকার মুখোনা চেপে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলেন, তুমি কি পার না মা আমাদের সবাইকে ক্ষমা করতে, আমাদের সবাইকে বাঁচাতে?

মণিকাও হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। ক্যাপ্টেনের মা-র বুকের মধ্যে নিজের মুখটা লুকিয়ে রেখে শুধু একবার চীৎকার করে বলে উঠল, মা!

মা?

মণিকা আবার কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল, অমন করে কাঁদতে নেই মা!

মা?

আমি তোমার মা? তুমি আমাকে মা বলে ডাকলে? তুমি কি আমাদের ক্ষমা করলে মণিকা? মণিকা আর একটি কথারও জবাব দিতে পারল না।

অনেকক্ষণ কেটে গেল।

একটু আলোটা জ্বালবে মা?

কেন?

তোমাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছা করছে মা।

মণিকা তবুও চুপ করে বুকের মধ্যে মুখটা লুকিয়ে রেখে পড়ে থাকে। ক্যাপ্টেনের মা আস্তে আস্তে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, একটু আলোটা জ্বাল না মা! তোমাকে যে ভীষণ দেখতে ইচ্ছা করছে।

নববধূর মতো দ্বিধা সংকোচে ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে আলো জ্বেলেই মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।

ক্যাপ্টেনের মা তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে নিজের চোখের জল মুছে উঠে গেলেন মণিকার কাছে। আঁচল দিয়ে মণিকার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে ওর কপালে একটা চুমু খেলেন।

মণিকা ঝপাং করে একবার ওর পা ছুঁয়ে প্রণাম করেই দুহাত দিয়ে গলাটা জড়িয়ে ধরল।

আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। আনন্দেও দুজনের চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।

হঠাৎ মণিকার মুখটা তুলে ধরে বললেন, একটা জিনিস দেখবে?

কি?

এসো।

নিজেই নিজের স্যুটকেসটা খুলে কাপড়-চোপড়ের নীচে থেকে একটা ফটো বের করে বললেন, মানিক কমিশন অফিসার হবার পর ওর বাবার সঙ্গে এই ছবিটা তোলা হয়।

মণিকা একটু অবাক হয়েই ফটোটা দেখল। পুত্রের গর্বে জাস্টিস রায়ের চোখ মুখ জ্বল জ্বল করছে। অথচ এই মানুষটাই…।

দুর্ঘটনা কার জীবনে কখন ঘটে যায় তা বলা যায়?

হঠাৎ দুজনের খেয়াল হল পূর্বের আকাশটা ফর্সা হয়ে উঠেছে। মণিকা সুইচটা অফ করে দিয়ে বলল, মা, এসব কথা কিন্তু আমার বাবা-মা বা অন্য কাউকে বলবেন না।

আচ্ছা।

আর এলাহাবাদে গিয়েই একবার বাবাকে পাঠিয়ে দেবেন।

দেব?

নিশ্চয়ই! কয়েকটা মুহূর্তেই দুর্ঘটনা ঘটে কিন্তু ওই কটা মুহূর্তটা তো জীবন নয়। জীবন অনেক বড়। অনেক ব্যাপ্ত।

.

তিন মাস পর।

ক্যাপ্টেন, আর্মি হেড কোয়াটার্সে ট্রান্সফার হল। ইমিডিয়েটলি জয়েন করতে হবে। তাইতো বাসা ভাড়া করে কলকাতাতেই সব কাজ সেরে নেওয়া হল।

ওয়ান আপ দিল্লি মেলের এয়ার-কন্ডিসন বগীর সামনে বেশ ভিড় জমে গেছে। জনে জনে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিল ওরা দুজনে। গুরুজনদের প্রণাম করল, মাথায় তুলে নিল আশীর্বাদ।

দশ-পনের দিনের মধ্যেই আসবেন তো বাবা?

আসব মা।

ঠিক বলছেন তো?

জাস্টিস রায় হাসতে হাসতে বললেন, তুমি আমার মা, তুমি আমার চিফ জাস্টিস! তোমাকে কি মিথ্যা কথা বলতে পারি?

সবাই হাসল। বৃদ্ধ আমজাদ শুধু একবার মাথা নিচু করে চোখ দুটো মুছে নিল।

ট্রেন ছাড়ল।

কুপের মধ্যে গিয়েই ক্যাপ্টেন একে একে সব লাইটগুলো অফ করে দিল।

একি? এখুনি আলো অফ করছ কেন?

মণিকাকে দুহাত দিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল, মণিমালা এখনও আলো অফ করব না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *