১১. রাতের তারা মিলিয়ে যায়

রাতের তারা মিলিয়ে যায় ভোরের আকাশে। কিন্তু রাতের স্বপ্ন? সে তো মিলিয়ে যায় না, হারিয়ে যায় না।

ঘুমের ঘোরেই মণিকা বিছানায় এপাশ ওপাশ করে, হাতটা যেন কাকে খুঁজছে।

সারাদিনই খোঁজে। দৃষ্টিটা চলে যায় কতদূরে, এ-ডি-সি ক্যাপ্টেন রায়ের কাছে।

মাকে ধরা দেয় না, কিন্তু নিজের কাছে? প্রতি মুহূর্তে ধরা পড়ে। ধরা পড়ে সকালে, দুপুরে। সন্ধ্যায়, রাত্রে।

নীচের থেকে বাবার গলার আওয়াজ শুনতে পায়, হ্যাগো, খুকু কোথাও বেরিয়েছে নাকি?

শুয়ে শুয়েই টাইমপিসটা দেখে। ছি, ছি! এত বেলা পর্যন্ত শুয়ে আছে? তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে। সারা রাত্তিরের স্বপ্ন বিধ্বস্ত চোখেমুখে একটু জল দিয়ে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। ঢিলেঢালা জামাকাপড় ঠিক করে নেয়। তারপর ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে চিরুনিটা তুলতে গিয়েই থমকে যায়।

…কদিন তোমার চিন্তায় চিন্তায় কি হয়েছি বলো তো! এবার ট্যুর থেকে ফিরে এসো। মজা দেখাব। তোমার জন্য কী বেইজ্জত হচ্ছি দেখছ? সাড়ে আটটা বাজে, এখনও আমি নীচে নামিনি।…

মাথার ওপর দিয়ে কোনোমতে চিরুনিটা বুলিয়ে নিয়ে দুহাত দিয়ে খোঁপা করে নেয়। হড়মুড় করে নেমে যায় সিঁড়ি দিয়ে।

সিঁড়ির মুখেই মা-র সঙ্গে দেখা। কাল কত রাত্তির অবধি নভেল টভেল পড়লি?

মণিকা মুহূর্তের জন্যে ভাবে। এই বিপদে লজ্জার হাত থেকে বাঁচবার জন্য এমন বুদ্ধি দেবার জন্য ভীষণ ভালো লাগে মা-কে। জড়িয়ে ধরে মা-কে। কি করে বুঝলে বলতো মা?

তুই মা হলে তুইও বুঝবি।

মণিকা আর দাঁড়ায় না মা-র সামনে, চলে যায় বাবার স্টাডিতে।

তুমি আমাকে ডাকছিলে বাবা?

হাতের বইটা নামিয়ে রেখে ডক্টর ব্যানার্জি বললেন, না ডাকছিলাম না। তবে আজ তুই চা দিতে এলি না দেখে খোঁজ করছিলাম।

কাল শুতে শুতে একটু রাত হয়েছিল বলে আজ উঠতে বড্ড দেরি হয়ে গেছে।

মণিকা বেরিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ ওর বাবা ডাক দিলেন, হ্যারে তোর মনে আছে তো আজ বলাই-এর ওখানে যেতে হবে?

মাথাটা ঘুরিয়ে পিছন ফিরতে গিয়ে আলতো করে বাঁধা খোঁপাটা খুলে গেল। মুখে কিছু বলল না, ভ্রু কুঁচকে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

কিরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলি যে? ভুলে গিয়েছিলি বুঝি?

হ্যাঁ, ঠিক মনে ছিল না।

মণিকা চলে যায়। একটু দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়ে আস্তে আস্তে ধীর পদক্ষেপে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যায়।

দ্বিধা হবে না?

ডক্টর ব্যানার্জি বলাই বলতে অজ্ঞান। একে বাল্যবন্ধুর ছোট ভাই, তারপর নিজের প্রিয় ছাত্র। সেবার হাই ফার্স্ট ক্লাশ পেয়েছিল একমাত্র ওই। তাছাড়া সে কৃতী, সে সাকসেসফুল। ডক্টর ব্যানার্জির দূর্বলতা থাকার কারণ আছে বৈকি!

নিজের ঘরে চুপ করে বসে থাকতে থাকতেই মণিকা ভাবে, বাবার জন্য মা-ও বলাই-বলাই করে অস্থির। তাছাড়া মাসিমা-মাসিমা করে ন্যাকামি করে যে!

একটা ফ্রেঞ্চ কনস্ট্রাকশন ফার্মের রিজিওন্যাল রিপ্রেজেনটেটিভকে নিয়ে এত মাতামাতি করার কি আছে? না হয় হাজার হাজার টাকা রোজগারই করেন! ঘন ঘন বিদেশ গেলেই কি মাথা কিনে নিয়েছে?

সব কথা মা-বাবাকে বলা যায় না। মণিকাও বলেনি কিন্তু তাই বলে তো সে কথা ভুলে যায়নি।

কলকাতায় হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করছে। বাবা-মা রেঙ্গুনে। হঠাৎ একদিন বিকেলবেলা ভিজিটিং আওয়ার্সে জামা-কাপড়, খাবার-দাবারের কয়েকটা প্যাকেট নিয়ে কৃতী বলাই হাজির হলো মণিকার হোস্টেলে। মণিকা প্রথমে চিনতে পারেনি।

বলাই বুঝতে পারল। কি চিনতে পারছো?

একটু লজ্জিত হয়ে মণিকা বলল, ঠিক মনে পড়ছে না।

আমি বলাইদা। তোমার বাবার ছাত্র। এবার মনে পড়েছে?

মনে পড়বে না? বাবার অন্তরঙ্গ বন্ধু কানাইবাবু। ওর রাঙা জেঠু। একে তার ছোট ভাই, তারপর বাবার প্রিয় ছাত্র।

খুশিতে মণিকা হাসে। আপনি বলাইদা?

হ্যাঁ।

বারান্দায় দাঁড়িয়েই কথা হচ্ছিল।

চলুন ভিজিটার্স রুমে গিয়ে বসি।

উত্তর দেবার আগেই হাতের ঘড়িটা দেখল। ওদিকে তাকিয়ে ইসরায় ড্রাইভারকে গাড়ি ঘোরাতে বলল।

না, আজ আর বসব না। আমি আজকাল প্রায়ই রেঙ্গুনে যাতায়াত করি আর সময় পেলেই তোমার বাবার কাছে চলে যাই। মাসিমা এগুলো তোমার জন্য পাঠিয়েছেন…।

একটু তো বসবেন?

বলাই আদর করে মণিকার গালে একটা খোঁচা দিয়ে বলল, না, না আজ আর বসব না।

কোটের পকেটে হাত দিয়ে দুটো চিঠি বের করে মণিকার হাতে দিল, এই চিঠি দুটো রাখো। একটা তোমার আরেকটা তোমার হোস্টেল সুপারিন্টেন্ডেন্টের।

এক কাপ চাও খাবেন না?

এবার স্নেহের শাসন। তুমি ছোট হয়ে আমাকে কি খাওয়াবে, আমি তোমাকে খাওয়াব।

সেদিন বলাইদা আর অপেক্ষা করল না। চলে গেল।

বলাইয়ের গাড়িটা গেট দিয়ে বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ওই দিকেই চেয়ে রইল মণিকা। বেশ লাগল। হাসি-খুশি-প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা একটা সার্থক মানুষ মনে হলো বলাইদাকে।

ডক্টর ব্যানার্জি হোস্টেল সুপারিন্টেন্ডেন্টকে জানিয়েছিলেন যে আমার বাল্যবন্ধু ও মণিকার লোক্যাল গার্ডিয়ান প্রফেসর কানাই সরকারের অনুপস্থিতিতে তার ভাই ও আমার ছাত্র বলাই সরকার মণিকাকে দেখাশুনা করবে।

রাঙা জেই তখন প্রায়ই কলকাতার বাইরে যেতেন। ছোটখাটো নানা কারণে মণিকার বেশ অসুবিধাই হতো। দু-একদিনের ছুটি পেলেও রাঙা জেঠুর চিঠির অভাবে চুঁচুড়ায় ছোট মাসির কাছে যেতে পারত না। তাইতো বাবার চিঠিটা পেয়ে মণিকা খুশি হয়েছিল।

বলাই মাসে দু-একদিন কয়েক মিনিটের জন্য মণিকাকে দেখে যেত। সব সময়ই কিছু না কিছু প্রেজেন্টেশন, খাবার-দাবার নিয়ে আসত। কদাচিৎ কখনও সময় থাকলে একটু আধটু গল্পগুজব করত দুজনে। কখনও কখনও আরো দুচারজন মেয়ে ঘিরে বসত, গল্প করত।

বলাই ব্যাংককে বদলি হবার আগে মণিকা বলেছিল, আপনি চলে যাবার আগে আমাকে একবার উঁচুড়া ঘুরিয়ে দেবেন।

একটা ছুটির দিনে সকালে বলাই নিজেই গাড়ি নিয়ে হাজির হলো মণিকার হোস্টেলে। একদিনের ছুটিতে মণিকা চললো মাসির বাড়ি। বলাইদার গাড়িতে চড়ে চুঁচুড়া যেতে মণিকার সে কি আনন্দ!

ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড দিয়ে যাবার সময় বলাই জিজ্ঞাসা করল, সোজা মাসির বাড়িই যাবে?

কেন আপনি অন্য কোথাও যাবেন?

স্টিয়ারিং ডান হাতে ধরে বাঁ হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট তুলে নিতে নিতে জবাব দেয় বলাই, তুমি চাও তো খানিকটা ঘুরে আসতে পারি।

ছুটির দিনে এমন মুক্তির আনন্দের আমন্ত্রণ পেয়ে মণিকা মনে মনে চঞ্চল হয়, উত্তেজিত হয়। অথচ…

কোথায় যেতে চান?

আমি তো ফুরসৎ পেলেই হাজারিবাগ চলে যাই।

হাজারিবাগ?

সিঁথির মোড় ছাড়িয়ে টবিন রোডের মোড় পার হলো।

হাজারিবাগ বলে চমকে ওঠার কি আছে? দরকার হলে একদিনেই ঘুরে আসা যায়।

একদিনেই?

নিশ্চয়ই।

ডানলপ ব্রিজের কাছে বলাই স্টিয়ারিং ঘোরাল। ট্রেন লাইন ধরে গাড়ি চললো দক্ষিণেশ্বর-বালি ব্রিজের দিকে।

একবার মনে হলো ঘুরেই আসে হাজারিবাগ। বেশ মজা হবে। আবার ভাবে, না, না। একলা একলা বলাইদার সঙ্গে যাওয়া কি ঠিক হবে?

গাড়ি বালি ব্রিজে। গঙ্গার হাওয়ায় চুলগুলো উড়ে উড়ে মণিকার মুখে পড়ছে। আঁচলটাও উড়ছে। বলাই একবার দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে দেখে নেয়।

শেষ পর্যন্ত উঁচুড়া ঘুরেই এলো। তুবও বেশ ভালো লাগল। কলেজ-হোস্টেলের নিয়মতন্ত্রের বাইরে এই একদিনের মুক্তির আনন্দ যেন ভোলা যায় না।

বলাই সিঙ্গাপুর বদলি হবার পরও মনে পড়ত। মাঝে মাঝে। কখনও কখনও। কলেজের ঘণ্টা, হোস্টেলের ঘণ্টা, আর ওই উঁচু লোহার গেটটার মধ্যে নিজেকে বন্দী করে রাখতে রাখতে হাঁপিয়ে উঠলেই মনে পড়ত।

উপরের ঘরে চুপ করে বসে বসে সেসব কথা মনে পড়ছিল মণিকার। হাঁটুর পর কনুই রেখে হাতের পর মুখ দিয়ে কিছুটা উদাস হয়ে ভাবছিল।

রাতের স্বপ্ন চোখে নিয়েই ঘুম থেকে উঠেছিল। বেশ লাগছিল। আলাপের পর রাগ শুরু হবার মুখেই সেতার থেমে গেলে যেমন বিরক্ত লাগে, ঠিক তেমনি অস্বস্তিবোধ করছিল মনে মনে।

শুধু চুঁচুড়া ঘুরেই যদি সব শেষ হতো তাহলে হয়তো এমন বিচ্ছিরি লাগত না। বি-এ পরীক্ষা দিয়ে রেঙ্গুনে যাবার পর যদি…

ভারতেও খারাপ লাগে মণিকার। বার বার সরিয়ে দেয় টুকরো টুকরো চিন্তার মেঘগুলো। আকাশটা একটু পরিষ্কার হলেই দেখতে পায় ক্যাপ্টেনকে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আবার কোথা দিয়ে যে ওই স্মৃতি বোঝাই মেঘগুলো হাজির হয় তা মণিকা বুঝতে পারে না।

তাছাড়া ভীষণ অস্বস্তিবোধ করছে। ক্যাপ্টেনকে নিয়ে মনে মনে অনেকদূর এগিয়েছে। ভবিষ্যতের ছবিটাও মোটামুটি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। ঠিক এমন সময় মনটা বিক্ষিপ্ত হবে, ভাবতে পারেনি।

উপর থেকে নীচে নেমে এলো। এঘর-ওঘর ঘোরাঘুরি করল। খবরের কাগজটা একবার হাতে তুলে নিয়ে চোখ বুলিয়েই নামিয়ে রাখল। এমন বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে কাগজ পড়া যায়?

সিঁড়ি দিয়ে দু-এক ধাপ উপরে উঠতেই মা পিছন থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, কিরে তুই বাথরুমে-টাথরুমে যাবি না? কখন জলখাবার খাবি?

মণিকা পিছন ফিরে বলল, শরীরটা যেন কেমন করছে। এক্ষুনি কিছু খাব না।

কিছু ঔষধপত্র খাবি?

না, না। একটু শুয়ে থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে।

উপরে নিজের ঘরে সত্যি মণিকা শুয়ে পড়ল। এই সকালবেলাতেই দিনের শেষের ক্লান্তি আর অবসাদ যেন ওকে ঘিরে ধরল।

…রেঙ্গুন। ইউনিভার্সিটির পাশেই ইউনিভার্সিটি এভিনিউ ও প্রোম রোডের প্রায় কোণাতেই ডক্টর ব্যানার্জির কোয়ার্টার। কলকাতা থেকে এসে ভীষণ ভালো লাগল এই কোয়ার্টারকে। চার পাঁচখানি বড় বড় ঘর। তাছাড়া প্যাগোডার মতো একটা ছোট্ট আউট হাউস ধরনের আরেকটা ঘর সামনের লনের এক কোণায়। পিছনের দিকটা আরও চমৎকার। গাছপালা লতাপাতা। একটা ছোট্ট বটানিক।

বাড়িতে ঢুকে এক মিনিট বসল না, মুখে একটু জল পর্যন্ত দিল না। প্রায় ঘণ্টখানেক ধরে শুধু বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখল!

মা, তুমি যে এখানে এসে একেবারে সিজনড় ইন্টিরিয়র ডেকরেটর হয়ে গেছ দেখছি।

মিসেস ব্যানার্জি মুচকি হাসেন। আমি কিছু করিনি। প্রায় সারা বাড়িটাই বলাই সাজিয়ে দিয়েছে।

প্রথমটা শুনে চমকে উঠেছিল মণিকা। বলাইদা রেঙ্গুনে?

উপরের ঘরে চুপটি করে শুয়ে শুয়ে মনে করছিল সেসব স্মৃতি। প্রথম কিছুদিনের মিষ্টি স্মৃতি। হৈ হৈ করার কথা! উঃ! কি ঘুরেই বেড়িয়েছে। সারা শহরটাকে চষে খেয়েছে দুজনে। তারপর গেছে রয়্যাল লেকের ওরিয়েন্ট ক্লাবে।

সাপুড়ের মতো শুধু বাঁশি বাজিয়েই চলেছিল বলাই। আর যেন কোনো অভিসন্ধি ছিল না ওর। ছেলেদের মতো সারা পুকুর জুড়ে জাল ফেলেছে, বুঝতে দেয়নি শিকারের পরিকল্পনা। অনেক পরে ধীরে ধীরে জাল গুটিয়ে এনেছে। সাপুড়ের মিষ্টি বাঁশি আর শোনা যাচ্ছিল না। থেমে গেছে। শিকার যে হাতের মুঠোয়। তখন আর বেরুবার পথ নেই, পালাবার উপায় নেই।

সকালেই বেরিয়েছে মণিকাকে পেণ্ড দেখিয়ে আনবে বলে। বিকেলেই ফিরবে! পোম রোড দিয়ে এসে মন্টগুমারি স্ট্রিট পার হয়ে বলাই নিজের বাড়ির সামনে গাড়ি থামাল।

চল একটু নামি।

কেন?

একটু কিছু খেয়ে নেব!

সে কি? আপনি ব্রেকফাস্ট করেননি?

না।

মণিকা একটু রাগারাগি করলেও শেষ পর্যন্ত উপরে গেল।

অ্যাপার্টমেন্ট হাউস। ভিতরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করল।

মণিকাকে ভিতরের স্টাডিতে নিয়ে বলল, একটু বসো।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভিতর থেকে কতকগুলো বিরাট বিরাট প্যাকেট নিয়ে এলো। এই নাও এগুলো তোমার।

তার মানে?

আবার তর্ক। আবার কথা কাটাকাটি। শেষ পর্যন্ত খুলল।

কপালে হাত ঠেকিয়ে মণিকা বললে, মাই গড! করেছেন কি?

আবার তর্ক করছ? এই জাপানিজ সিল্কের শাড়িটা পরবে?

না, না। এখন নতুন শাড়ি পরব কেন?

আবার কেন? সব কেন-র কি কারণ থাকে?

হাউ ডু ইউ লাইক দিস কিমানো?

মণিকা আর জবাব দেয় না। শুধু বিস্ময়ে চেয়ে থাকে বলাই-এর দিকে।

একটা অনুরোধ রাখবে?

বলুন।

আগে বলো রাখবে কিনা?

পারলে নিশ্চয়ই রাখব।

না পারার মতো কিছু বলব না।

তাহলে নিশ্চয় রাখব।

কথা দিচ্ছ?

হ্যাঁ।

আমাকে ছুঁয়ে বলল।

মণিকা হেসে ফেলে। কি ছেলেমানুষি করছেন।

মণিকা ওর গায়ে হাত দিতেই বলাই ওই হাত ধরে টেনে নিল, লক্ষ্মীটি এই কিমানোটা পর।

অবাক বিস্ময়ে হাসিতে-খুশিতে ভ্রু-দুটো টেনে উপরে তুলে মণিকা বলল, এই কিমানোটা পরব।

হ্যাঁ।

আমি তো কিমানো পরতে জানি না।

উপরের ঘরে শুয়ে শুয়ে সব ভাবছিল। পাশ ফিরে শুয়ে ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে মনে মনে কত প্রশ্ন আসে। কত কথা আসে। কত ভাবনা আসে।

বিছানা ছেড়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসল। অনেকক্ষণ ধরে নিজেকে দেখল। সেদিন কিমানো পরাতে গিয়ে বলাইদা যে হঠাৎ পাগলামি করেছিল, আমার জীবন বসন্তের যে মধু…

না, না। আর ভাবতে চায় না মণিকা। কিন্তু ভয় করে। ধরা পড়বে না তো ক্যাপ্টেনের কাছে? স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হবে না তো?

সেই একটা দিনের স্মৃতি যখন মনে পড়ে, মণিকা শিউরে ওঠে। একটা দিন কোথায়? কয়েক ঘণ্টা! না তাও না। বড় জোর আধ ঘণ্টা। বরং পনের-বিশ কি পঁচিশ মিনিটই হবে। কিন্তু ওই কয়েকটা মিনিটেই জীবনের বনিয়াদ ধরে টান পড়েছিল। ঝড় বৃষ্টি বা সাইক্লোন নয়। ভূমিকম্প। পলকেই সবকিছু। দীর্ঘদিনের সাধনায়, অনন্ত পরিশ্রম করে যে সৌধ সৃষ্টি হয়, প্রকৃতির খামখেয়ালীপনা যাকে স্পর্শ করতে পারে না, সেই তারও জীবনসঙ্কট উপস্থিত হয় ওই কয়েকটি মুহূর্তের ভূমিকম্পে।

সেদিনের ওই কয়েকটা মিনিটেই মণিকার জীবন নাট্যে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করল। এতে অভিনবত্ব কিছু নেই। এই পৃথিবীতে কোটি-কোটি বলাইদা ছড়িয়ে আছে। শিক্ষাদীক্ষা আচার আদর্শের পিছনে লুকিয়ে থাকে ইন্দ্রিয়। লোলুপ ইন্দ্রিয়। শিকারি ইন্দ্রিয়। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে ওদের ওই লোলুপ ইন্দ্রিয়ের কাছে বলিদান যাচ্ছে কত মণিকার যক্ষের ধন। কোনো না কোনো বলাইয়ের হাতে তিলে তিলে সঞ্চিত যক্ষের ধন হারাতেই হয়। কিন্তু তার পরিবেশ আছে, মানসিক প্রস্তুতি আছে। যেখানে সে প্রস্তুতি নেই, সহজ সরল স্বাভাবিক পরিবেশ নেই, নেই সামাজিক স্বীকৃতি, সেখানেই দ্বিধা, সঙ্কোচ। মনের মধ্যে কত প্রশ্ন আসে যায়। যে চাওয়া, যে। পাওয়ার মধ্যে পরিপূর্ণ তার সৌন্দর্য নেই, সৃষ্টির আনন্দ নেই, যে স্ফুলিঙ্গ কল্যাণ দীপশিখা জ্বালায় না কিন্তু সারা জীবন মনকে তিলে তিলে দগ্ধ করে-মণিকা তা ভুলবে কেমন করে?

তাছাড়া বলাইদা কেমন শঠতা করে, চতুরতার সঙ্গে…

মণিকা রাগে জ্বলে ওঠে। না, কিছুতেই ওর ওখানে নেমন্তন্ন খেতে যাবে না। বাবা-মা বললেও না। কোনো অছিলায় এড়িয়ে যাবে।

মুহূর্তের মধ্যে কেমন যেন নিঃসঙ্গ বোধ করে মণিকা। নাকি অসহায়! ওই মুহূর্তের জন্যই।

ক্যাপ্টেনের নির্ভর নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের কথা মনে পড়ে। কতদিন ঘুরে বেড়িয়েছে ওর সঙ্গে। কত জায়গায়। কত বিচিত্র পরিবেশে। সকাল, সন্ধ্যায়। কখনও বা রাত্রে। কলকাতায়, উপকণ্ঠে। গ্র্যান্ড, গ্রেট ইস্টার্ন, ব্লফক্স, বা ক্যালকাটা ক্লাবে, ফোর্ট উইলিয়ামের অফিসার্স মেসে। লাঞ্চ, ডিনার ককটেল ক্যাবারেতেও। রাজভবনের ঘরে একা একা কাটিয়েছে সারা দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা। কিন্তু কই, কোনো দিনের জন্যও বলাইয়ের মতো কোনো সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে ওর যৌবন দুর্গ আক্রমণ করেনি? দখল করতে চায়নি! বড় জোর হাতটা চেপে ধরে মুখের কাছে এগিয়ে এনে ফিস ফিস করে বলেছে, এই ধূসর জীবনের গোধূলিতে আর কতদিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করব?

নয়তো বলত, জানত, Waiting is the hardest time of all.

মণিকা বলত, Everything comes to those who can wait.

ক্যাপ্টেন হাতটা আর একটু চেপে ধরে বলেছে, সেই ছবি দোলা খায় রক্তের হিল্লোলে, সে ছবি মিশে যায় নিঝর-কল্লোলে…

সুরের দোলা মণিকার মনেও ঝঙ্কার দেয়। হাঁটু মুড়ে বসে হাঁটুর পর মুখ রেখে একটু হাসে। একবার দেখে নেয় ক্যাপ্টেনকে। চোখের কোণায় স্বপ্নের বিদ্যুৎ-স্পর্শ।

ক্যাপ্টেন বলে, উত্তর দিতে পারছ না তো?

সত্যি উত্তর চাও?

নিশ্চয়ই।

মণিকা একটু ভাবে। একটু ডুব দেয়। হয়তো একটু অনুভব করে তবে শোন—

ধরা সে যে দেয় নাই, দেয় নাই,
যারে আমি আপনারে সঁপিতে চাই।
কোথা সে যে আছে সঙ্গোপনে
প্রতিদিন শত তুচ্ছের আড়ালে আড়ালে।

আরো কত কি হতো! কিন্তু ও তো কোনোদিন কোনো অন্যায় দাবি করেনি।

অন্যায়?

মাঝে মাঝেই মনে হতো ক্যাপ্টেন অপূর্ণতার বেদনায় বড়ই পীড়িত। মণিকারই খারাপ। লাগত। কখনও কখনও মনে হতো, সব কিছু উজার করে ক্যাপ্টেনকে সুখী করে, পরিপূর্ণ করে, পরিতৃপ্ত করে।

পারত না। মনের ইচ্ছা মনেই থাকত। প্রকাশ করত না। তবুও দ্বন্দ্ব দেখা দিত মনের মধ্যে। কেন নিজের দাবিতে এগিয়ে আসতে পারে না? যেদিন সে দাবি নিয়ে এগিয়ে আসবে; আমাকে আমন্ত্রণ জানাবে, আমাকে প্রাণের মধ্যে টেনে নেবে, সেদিন তো আমি বাধা দেব না, আপত্তি করব না। বরং ওর ঐশ্বর্যে নিজেকেও…

দূরের শূন্য আকাশের দিকে চেয়ে আরো কত কি ভাবে মণিকা।

এক্ষুনি যদি ওকে পেতাম তাহলে হয়তো আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতাম না। বাবা-মাকে বলতাম…

সত্যই কি বলতে পারতাম?

কেন বলব না? অন্যায় কিছু নয়।

সম্ভব হলে আজই সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে লাল টকটকে বেনারসি পরে যেতাম ওই ব্রিলিয়ান্ট বলাইয়ের…

বহু অসম্ভবের মতো এটাও সম্ভব হলো না মণিকার। তবে নিজে গেল না। বাবা-মাকে বললে শরীরটা খারাপ।

ডক্টর ব্যানার্জি দু-একবার বললেন। তুই বাড়িতে শুয়ে থাকবি আর আমরা নেমন্তন্ন খেতে যাব?

তাতে কি হয়েছে? আমি কি কোনোদিন নেমন্তন্ন খাইনি?

কিন্তু ও তোর কথা বার বার করে বলেছিল।

এ-কথার কি জবাব দেবে মণিকা। মনে মনে ভাবল, বার বার করে, বলবে না? কিমানো পরাবার স্মৃতি কি ভুলতে পারে? তাছাড়া হয়তো নতুন করে…।

মা বললেন, থাক থাক। ও বরং নাই গেল। আজ সকাল থেকেই ওর শরীরটা ঠিক নেই।

ওঁরা চলে গেলেন। মণিকা ডক্টরের স্টাডিতে গিয়ে বসল। চাকরটা ঘরদোর ঠিক করতে ভিতরে চলে গেল।

কিছুক্ষণ পরে চাকরটা এসে একটু ছুটি চাইল। দিদিমণি, আমি একটু ঘুরে আসব?

হাতের কাগজ থেকে মুখ না তুলেই বললে, যা। তাড়াতাড়ি আসিস।

দরজাটা আটকে দেবেন।

দিচ্ছি।

একটু পরে দরজাটা বন্ধ করে আসতে আসতেই টেলিফোন বেজে উঠল।

কি হলো তুমি এলে না?

না।

শরীর খারাপ?

হ্যাঁ।

একটু ঘুরে গেলে মন ভালো লাগত না?

না।

বাড়িতে একলা একলা…

খুব ভালো লাগছে।

আমি তোমাকে নিয়ে আসব?

কেন টোকিও থেকে আবার নতুন কিমানো এনেছেন নাকি?

আর নয়। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভার নামিয়ে রাখল মণিকা।

টেলিফোন রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেও মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না; দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না সেই স্মৃতি। সেই কয়েকটি মুহূর্তের বিন্দু বিন্দু অনুভবের টুকরো টুকরো স্মৃতি। অন্যায় হলেও অবিস্মরণীয়। রিসিভার নামিয়ে রাখলেই কি সেসব ভুলা যায়!

কত প্রশ্ন, পাল্টা প্রশ্ন আসে মনে। সে কথা সবাই জানে, যার সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনা, লজ্জা-ঘৃণার অনুভূতি আর পাঁচজনে ভাগ করে নেয়, তার জন্য বেশি চিন্তা করতে হয় না। কিন্তু যে কথা যে কাহিনি, যে ইতিহাস বাইরের দুনিয়ার কেউ জানে না, যে আনন্দ বেদনার ভাগ অপরকে দেওয়া যায় না, তা যেন কিছুতেই ভুলা যায় না।

সন্ধ্যায় অন্ধকারটা একটু গাঢ় হলো। শূন্য বাড়িটায় নিঃসঙ্গ মণিকার মনও যেন অন্ধকারে ভরে গেল। চেয়ারে বসে টেবিলে পা দুটো তুলে দিয়ে হাতে পেন্সিল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতেই একবার নিজেকে দেখে। ভালো করে দেখে।

হঠাৎ বেল বেজে উঠল। চারটা নিশ্চয়ই বিড়ি খেয়ে ফিরে এসেছে। মণিকা উঠল না। চুপ করে বসে বসেই আরো ভালো করে নিজেকে দেখল। নিশ্বাসটা যেন একটু চঞ্চল, বুকের স্পন্দন যেন একটু বেশি জোরে শোনা যাচ্ছে।

আবার বেল বাজল। পর পর দুবার বাজল।

বেশ বিরক্ত হয়ে মণিকা উঠে গেল দরজা খুলতে।

ক্যাপ্টেন? ফিরে এসেছে। মণিকা থমকে দাঁড়ায়, চমকে ওঠে।

তুমি?

দরজার ওপাশে দাঁড়িয়েই ক্যাপ্টেন জবাব দেয়, সন্দেহ হচ্ছে নাকি?

ক্যাপ্টেন ভেতরে পা দিয়ে ওর ঠিক সামনে দাঁড়াতেই মণিকা যেন মাতাল হয়ে ওঠে। দুটো হাত দিয়ে ক্যাপ্টেনের গলাটা জড়িয়ে ধরে বলে, কি আশ্চর্য লোক বলতো তুমি।

ক্যাপ্টেন অবাক না হয়ে পারে না। এই সেই মণিকা? যার গাম্ভীর্য, যার সংযম, যার সংযত আচরণ দেখে সে এক ধাপ এগোতে পারত না, এই সেই মণিকা? হঠাৎ এমন কালবৈশাখীর মাতলামির নেশা চাপল কেন ওর মাথায়?

কেন বল তো?

দরজার মুখেই বড় বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিল দুজনে। তবু হুঁশ নেই।

ক্যাপ্টেন হুঁশ ফিরে পায়। কি ব্যাপার? বাড়িতে কেউ নেই নাকি?

না।

কেউ না?

না।

সত্যি?

সত্যি।

চাকরটাও নেই?

না।

এবার ক্যাপ্টেন নিজেই দরজাটা বন্ধ করে মণিকাকে একটু কাছে টেনে নেয়। হাত দিয়ে মুখটা একটু তুলে ধরে।

কি হয়েছে?

মণিকা জবাব দেয় না, দিতে পারে না। সে কি বলতে পারে যে নেকড়ে বাঘটা তাকে একবার আক্রমণ করে পরাজিত করেছিল, যে একবার তার রক্তের স্বাদ পেয়েছে, যৌবনের উপবন উপভোগ করেছে, সে আশেপাশেই রয়েছে? একথা কি বলা যায়?

ক্যাপ্টেন ডান হাত দিয়ে মণিকার চিকন কোমরটা জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে উপরে উঠে যায়।

দূরের আকাশে মিট মিট করে তারা জ্বলছে, আশেপাশের বাড়িগুলোতে আলো জ্বলে উঠছে। মণিকার অন্ধকার ঘরে এবার জ্বলে উঠল দুটি হৃদয় প্রদীপ।

মণিকা যেন আত্মসমর্পণের প্রস্তুতিতে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। নদীর জলে যখন শূন্য কলসি ভরা হয়, তখন বগ বগ করে কত আওয়াজ, কত বুঁদ বুদ। যখন ভরে যায়? সব কলরব-কোলাহল স্তব্ধ হয়।

মণিকাও পূর্ণ মন নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসেছিল ক্যাপ্টেনের পাশে।

আরও কয়েকটা অপ্রত্যাশিত সম্ভাবনার মুহূর্ত কেটে গেল।

অফিসার্স মেসে, ক্লাবে-হোটেলে, পার্টিতে-ডিনারে বা কখনও কখনও মানুষের ভিড় থেকে দূরে, বহু দূরে ক্যাপ্টেন অনেক মেয়ের দেখা পেয়েছে। দেখা পেয়েছে রাজভবনে, দুর্গাপুর স্টিল টাউনের রানিকুঠিতে, জলপাইগুড়ির সার্কিট হাউসে। দেখা পেয়েছে নানা বেশে, নানা রং-এ নানা পরিবেশে। কিন্তু স্তব্ধ পরিবেশে এমন আত্মসমর্পণের নেশায় মশগুল আর কাউকে দেখেনি।

একি সেই মণিকা? নাকি অপারেশন থিয়েটারের পেসেন্ট? ক্লোরোফর্ম করা হয়ে গেছে! সার্জেন যা খুশি…

ক্যাপ্টেন ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নেয় মণিকাকে। একটু বেশি কাছে। এমন করে আর কোনোদিন কাছে টানেনি। অন্যদিন হলে মণিকা হয়তো লজ্জায় মুখে কিছু বলত না তবে হাতটা নিশ্চয়ই সরিয়ে দিত। সরিয়ে দেবে না কেন? এত অর্থপূর্ণ জড়িয়ে ধরাকে এখনই মেনে নেবে কেন? আজ কিছু বললে না।

মণিকা?

কথা বলে না।

আজ তোমার কি হয়েছে বলতো?

আরো কয়েকবার পীড়াপীড়ির পর ছোট্ট জবাব দেয় মণিকা, শরীরটা ভালো নেই।

শরীর না মন?

জবাব আসে না এ প্রশ্নের।

তোমার শরীর খারাপ লাগছে?

না।

দেখে মনে হচ্ছে তুমি বড় ক্লান্ত।

মণিকা আবার চুপ করে যায়।

দুটো বালিশ টেনে ক্যাপ্টেন এবার মণিকাকে শুইয়ে দেয়। একটু হাত বুলিয়ে দেয় ওর মাথায়, মুখে।

মণিকা এবার ক্যাপ্টেনের হাতটা নেয় দুহাতের মধ্যে।

ক-দিন ধরেই তোমার কথা ভাবছি।

ক্যাপ্টেন খুশি হয়। কেন?

সে কথার জবাব দেয় না মণিকা। শুধু বলে, তুমি আমাকে খুব ভালোবাস, তাই না?

ক্যাপ্টেনের মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। তাই নাকি?

সেই আবছা অন্ধকারেই জানালা দিয়ে ঠিকরে পড়া সামান্য আলোতেই দেখা গেল মণিকার মুখেও বেশ একটা চাপা তৃপ্তির হাসি।

তুমি এত ভালো কেন বলতো?

তুমি খারাপ হতে দাও না বলে।

যদি কোনোদিন না দিই?

তোমারই লোকসান

বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মণিকা বললে, ঘোড়ার ডিম!

হঠাৎ খুব জোরে বেল বেজে উঠল। চমকে উঠল দুজনে।

মণিকা তাড়াতাড়ি উঠে বসে আলতো করে খোঁপাটা বাঁধতে বাঁধতে বললে, চাকরটা এসেছে নিশ্চয়ই।

প্রায় সারা বাড়ি অন্ধকার। শুধু নিচের বারান্দায় একটা আলো। দুজনেই একটু লজ্জিত হয়ে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এলো।

ক্যাপ্টেন চলে গেল ডক্টর ব্যানার্জির স্টাডিতে। মণিকা টেবিল ল্যাম্পটার সুইচ টিপেই দরজা খুলতে চলে গেল।

দরজা খুলেই মণিকা চিৎকার করে বললে, এই তোর এক্ষুনি আসা হলো? তাড়াতাড়ি দুকাপ কফি কর।

মণিকা স্টাডিতে আসতেই ক্যাপ্টেন বললে, তুমি তো দারুণ মেয়ে!

একটু অবাক হয়ে মণিকা জানতে চাইল, কেন?

ক্যাপ্টেন সে কথার জবাব না দিয়ে হাসতে হাসতে বললে, তোমাকে দেখে যতটা সহজ-সরল মনে হয় তুমি তা না।

মণিকার মনে খটকা লাগে। ওর অতীত জীবনের কোনো ইঙ্গিত পেল নাকি?

একটু চিন্তিত হয়ে ভ্রু কুঁচকে মণিকা জানতে চাইল, এতদিন পর হঠাৎ একথা বলছ?

নিজের অন্যায় ঢাকা দেবার জন্য চাকরটাকে বেশ সুন্দর ধমক দিলে তো!

মণিকা আশ্বস্ত হয়। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলে, অন্যায় আমার না তোমার?

আমি কি অন্যায় করলাম?

আমাকে একলা পেয়ে তোমার এমন সময় আসাটাই অন্যায় নয়?

সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন জবাব দিল, দরজা দিয়ে ঢুকতে না ঢুকতেই তুমি গলা জড়িয়ে ধরবে বলেই তো এলাম।

রবিশঙ্করের সেতারের সঙ্গে এ যেন আল্লারাখার তবলা! যেমন প্রশ্ন তেমন জবাব।

টেবিলের ওপাশ থেকে মণিকা এ-পাশে এসে দুহাত দিয়ে ক্যাপ্টেনের মুখটা চেপে ধরে বলে, বার বার বললে আর কোনোদিন অমন করে কাছে টেনে নেব না।

মণিকার হাতটা সরিয়ে ক্যাপ্টেন একটু চাপা গলায় জানতে চাইল, বার-বার না বললে রোজ রোজ অমন করে আদর করবে তো?

জানি না।

কফি এলো। ঘরের কোণায় বড় সোফাটার সামনের টেবিলে কফির কাপ দুটো নামিয়ে রেখে চাকরটা জিজ্ঞাসা করল, দিদিমণি কিছু খাবেন?

না।

সারাদিনই তো কিছু খেলেন না।

তুই যা। তোর আর মাতব্বরি করতে হবে না।

চাকরটা চলে গেল।

কি ব্যাপার খাওনি কেন?

তোমার জন্য।

আমার জন্য?

আবার কি? তুমি একলা একলা স্ফুর্তি করবে, ঘুরে বেড়াবে আর আমি এখানে একলা-একলা…

মণিকা আর বলতে পারে না।

নিঃসঙ্গতার এত বেদনা? ক্যাপ্টেন জানত না, ভাবত না।

মাসিমা-মেসোমশাই কোথায়?

নেমন্তন্নে গেছেন।

তুমি গেলে না?

না।

কি বললে?

বললাম শরীর খারাপ।

ক্যাপ্টেন একটু ভাবল। কফির কাপে একবার চুমুক দিল।

চল একটু ঘুরে আসবে।

এখন?

হ্যাঁ।

ফিরতে ফিরতে তো অনেক রাত হয়ে যাবে।

কখন ফিরতে চাও?

কিন্তু বাবা-মার সঙ্গে বেরুলাম না…।

শেষ পর্যন্ত সেদিন আর বেরুল না। ঠিক হলো পরের দিন বেরোবে। ক্যাপ্টেন হাতের প্যাকেটটা মণিকাকে দিয়ে বললে, এটা মাসিমাকে দিও।

ক্যাপ্টেন ফিরে এল রাজভবনে। বড় কৌচটায় হেলান দিয়ে শুয়ে-শুয়ে পরপর দুটো সিগারেট খেল।

চুপচাপ শুয়ে-শুয়ে কত কি ভাবছিল ক্যাপ্টেন। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে। তা নিজেও বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণ পর বিরাট ট্রে করে আমজাদ ডিনার নিয়ে এসে দেখল এ-ডি-সি সাহেব ঘুমোচ্ছেন। দু-একবার ডাকল। শেষ পর্যন্ত জবাব না পেয়ে আবার ওই ট্রে নিয়েই ফিরে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *