১০. এই রাজভবনে বসেই একদিন

এই রাজভবনে বসেই একদিন পলিটিক্যাল লিডারের কাছে পুরনো দিনের গল্প শুনছিল ক্যাপ্টেন রায়। গভর্নরের সঙ্গে একদল পুরনো দিনের বিপ্লবীদের মিটিং ছিল। মিটিং শেষে সবাই চলে গেলেন। শুধু গেলেন না উনি। গভর্নরের প্রোগ্রাম সম্পর্কে এ-ডি-সি-র সঙ্গে কথাবার্তা। বলছিলেন।

কথায় কথায় আলোচনার মোড় ঘুরে যায়।

জীবনে এই দ্বিতীয়বার গভর্নমেন্ট হাউসে এলাম।

মাত্র দুবার?

হ্যাঁ। পুরনো দিনের বৃদ্ধ বিপ্লবী একবার যেন চারপাশটা দেখে নিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পর আজই প্রথম গভর্নমেন্ট হাউসে এলাম।

তাই নাকি?

বিপ্লবী ঘোষ মশাই একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যাঁ, আজই প্রথম।

ক্যাপ্টেন রায় জানতে চাইল, এর আগেও কি গভর্নরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন?

বৃদ্ধ আর হাসি চাপতে পারলেন না।

ক্যাপ্টেন অবাক হয় ওর হাসি দেখে। জিজ্ঞাসা করে, হাসছেন যে?

হাসি থামার পর ঘোষ মশাই শোনালেন পুরনো দিনের সে কাহিনি।

পুলিশ কমিশনার টেগার্ড সাহেবের নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছ। বিপ্লবীদের অ্যারেস্ট করে লালবাজারে আনার পর টেগার্ড সাহেব তাদের প্রথম অভ্যর্থনা জানাতেন মুখে থুতু ছিটিয়ে…

ক্যাপ্টেন অবাক হয়, থুতু ছিটিয়ে?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। বিপ্লবীদের হাজির করা মাত্রই উনি আগে ওদের মুখে থুতু ছিটিয়ে দিতেন। টেগার্ড সাহেবের সঙ্গে সর্বদা একটা হেড কনস্টেবল ও একজন সি-আই-ডি ইন্সপেক্টর থাকত। ওরা দুজনে অকথ্য অত্যাচার করতে ওইসব বিপ্লবীদের ওপর। টেবিলের ওপর বসে চুরুট খেতে খেতে টেগার্ড সাহেব সে দৃশ্য উপভোগ করতেন আর মাঝে মাঝে খেয়াল খুশি মতো বিপ্লবী ছেলেমেয়েদের কাপড় তুলে বিশেষ বিশেষ স্থানে জ্বলন্ত সিগার চেপে ধরতেন।…

ক্যাপ্টেন শিউরে উঠে। বলেন কি জ্বলন্ত সিগার চেপে ধরতেন?

ইয়েস ইয়েস জ্বলন্ত সিগার! আপনার সঙ্গে যিনি কথা বলছেন তাঁর দেহেও এমনি অনেক স্মৃতিচিহ্ন আজও দেখতে পাবেন।

মাই গড!

জ্বলন্ত সিগার তবু সহ্য করা যেত কিন্তু ওই দুজনের অত্যাচার সহ্য করা যেত না।

নিউ ইয়ার্স ইভ-এ তখন গভর্নমেন্ট হাউসে বিরাট পার্টি হতো। টেগার্ড সাহেবও আসতেন। জানতাম টেগার্ড সাহেবের ওই দুজন সাকরেদ একটু আধটু প্রসাদ পাবার পর নিজেদের সামলাতে পারবে না। তাই ওদের সঙ্গে একটু মোলাকাত করার জন্য…

গভর্নমেন্ট হাউসে এসেছিলেন?

হ্যাঁ।

কিভাবে এলেন?

বৃদ্ধ আবার একটু হাসলেন। একজন গেস্টের ড্রাইভার হয়ে এসেছিলাম।

তারপর?

তারপর আবার কি? মাত্র একটা কার্তুজই খরচ করেছিলাম…

গভর্নমেন্ট হাউসে ফায়ারিং-এর খবর শুনেই উত্তেজিত হয় এ-ডি-সি। দেন হোয়াট হ্যাপ?

বিশেষ কিছু না। টুকটাক আদর-আপ্যায়ন ও বিচারের প্রহসনের পর কিছুদিনের জন্য আন্দামান সেলুলার জেলে…

ঘোমশাই আর এগোতে পারলেন না। তিন-চারজন সোসাইটি লেডি গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে এ-ডি-সি-র ঘরে ঢুকলেন। ধন্যবাদ জানিয়ে একজন বললেন, উই উইল বি কামিং টু ইউ এগেন আফটার এ ফিউ ডেজ।

উইথ প্লেজার। আই উইল বি অলওয়েজ অ্যাট ইওর সার্ভিস। ক্যাপ্টেন ঈষৎ মাথা নিচু করে হাসি হাসি মুখে কথাকটি বলে বিদায় জানাল।

মেয়েরা চলে যাবার পর ঘোমশাই বললেন, তখনকার দিনে পুরুষের চাইতে মেয়েরাই বেশি গভর্নমেন্ট হাউসে আসত, আজকালও কি…

ঘোষমশাই আরো একটু কিছু বলে বোঝাতে চেয়েছিলেন তখনকার দিনে যেসব মহিলারা আসতেন তারা বিশেষ সতী-সাধ্বী পতিপ্রাণা ছিলেন না। আজকাল কি শুধু সোশ্যাল ওয়ার্কাররাই আসেন?

ক্যাপ্টেন কোনো জবাব দেয়নি। হঠাৎ টেলিফোন তুলে উত্তর এড়িয়ে গেল।

বৃদ্ধ বিদায় নেবার আগে বললেন, এইসব মেয়েদের দেখলে গান্ধীজির একটা কথা মনে হয়।

কোন কথা?

কদিন কলকাতা থেকে অনেক ঘোরাঘুরি করেও গান্ধীজি রাস্তাঘাটে মেয়েদের বিশেষ দেখতে পেয়ে বলেছিলেন, বাঙালি মেয়েরা কি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছে?

আর আজকাল?

আফটারনুন ডিউটি। বিশেষ কাজের চাপ ছিল না। অফিসে বসে বসে একটার পর একটা সিগারেট খেতে খেতে ঘোষ মশাই-এর কথা ভাবছিল ক্যাপ্টেন। হঠাৎ রিভলভিং চেয়ারটা ঘুমিয়ে নিয়ে পাম গাছের ফাঁক দিয়ে দূরের আকাশ দেখল। মনে পড়ল মিস শ্যামলী গুপ্তা ও আরো অনেকের কথা।

আবার সিগারেট টানে। চারপাশটা ধোঁয়ায় ভরে যায়। রাজভবনের শত শত অতিথির আগমন ও বিদায়ের ভিড়ের মধ্যেও মিস গুপ্তার আকস্মিক দৃষ্টি এড়ায় না। সোশ্যাল ওয়ার্কারের ছদ্মবেশে একটু যোগাযোগ, ঘনিষ্ঠতা, পরে ইন্ডিয়ান হসপিটালিটির অছিলায় হোটেলে… গেস্টহাউসে থিয়েটার রোডের ফ্ল্যাটে আরো নিবিড়, আরো আপনভাবে মেলামেশা।

চমৎকার!

আর্মি অফিসারের পোশাকে, হাতে স্যাফরন কালারের আমডব্যাচ পরে এ-ডি-সির চাকরি করতে এসে বেশি কথাবার্তা বলতে পারে না ক্যাপ্টেন। বয়স তো হয়েছে, বুদ্ধি তো আছে, রক্তমাংসের মানুষের ইন্দ্রিয়ের জ্বালা তো অনুভব করতে পারে, উপলব্ধি করতে পারে। সব কিছুই বুঝতে পারে, কিন্তু বলতে পারে না।

মণিকাকে বলতেও দ্বিধা হয়।

মণিকা বসে থাকতে থাকতেই মিস গুপ্তার টেলিফোন এসেছিল বলে ওর কথাই সে বার বার জানতে চায়, শুনতে চায়। মিস গুপ্তার মতো আরো কতজনেই তো ক্যাপ্টেনকে টেলিফোন করে, নানা সময় দেখা সাক্ষাৎ করে, হাসি-ঠাট্টা করে। তাদের কথা মণিকা জানে না; তাই শুনতেও চায় না।

ক্যাপ্টেন কিছু বলতে পারে না। বলতে দ্বিধা হয়, লজ্জা হয়, ঘেন্না হয়।

বাংলাদেশের বাইরে বড় হয়েছে, উত্তর-পশ্চিমে চাকরি করেছে। তাইতো বাংলাদেশকে স্বর্গ মনে করত। গভর্নরের এ-ডি-সি হবার মোহ তার ছিল না কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে এত নিবিড় পরিচয় হবার সুযোগ পাবে বলেই এই চাকরি নিয়েছিল। মনে মনে অনেক শ্রদ্ধা-ভক্তি নিয়ে এসেছিল বাংলাদেশে। ক্যাপ্টেন ভাবত ডেভিড হেয়ার, মেকলে বাংলাদেশে ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার করেছিলেন কিন্তু উত্তর-পশ্চিম ভারতের মতো পাশ্চত্যের নোংরামি এখানে পাত্তা পায়নি।

এ-ডি-সি-র চাকরি করতে এসে সব গোলমাল হয়ে গেল।

মণিকাকে অনেক অনুরোধ করেছিল, প্লিজ! ওদের কথা বলতে অনুরোধ করো না।

কেন বলো তো তুমি সব সময় ওদের কথা লুকোতে চেষ্টা করো?

ক্যাপ্টেন মনে মনে ঠিক করল, না। আর লুকোবে না। সব কথা খুলে বলবে। হাজার হোক মণিকাকে নিয়ে ও ভবিষ্যৎ জীবনের স্বপ্ন দেখে। মনে হয় মণিকার মনেও টুকরো টুকরো স্বপ্ন জমতে শুরু করেছে। ঈশান কোণের কালো টুকরো মেঘের মতো ছোট-ছোট সন্দেহের কারণের মধ্যেও অনেক অশান্তির সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে। রোগের জীবাণুর মতো সন্দেহের জীবাণুকেও নিপাত করতে হয়। তাছাড়া মণিকার কাছে লুকোবার কী আছে?

বৃদ্ধ বর্মিজ অধ্যাপকের খবর নিতে গিয়ে তোমাকে দেখেই আমি চমকে উঠেছিলাম।

কেন?

ফ্লাওয়ার ভাস-এর ফুল দেখতেই অভ্যস্ত ছিলাম। তোমাকে দেখে মনে হয় যেন ভোরবেলার শিশির ভেজা চন্দ্রমল্লিকা। চমকে যাব না? ক্যাপ্টেন যেন গর্বের সঙ্গে চাপা হাসি হাসতে হাসতে মণিকার দিকে তাকাল।

লম্বা লম্বা ভ্রু দুটোকে কুঁচকে উপরে টেনে মণিকা জানতে চাইল, তার মানে?

তার মানে তোমাকে দেখেই শুধু সুন্দরী নয়, পবিত্র মনে হয়েছিল।

ক্যাপ্টেন বেশ সিরিয়াসলি বললেও মণিকা পাত্তা দিল না। তুমি কি ফ্ল্যাটারি শুরু করলে?

নট অ্যাট অল।

তবে।

তবে শোন।

তারপর ক্যাপ্টেন ধীরে ধীরে শুরু করেছিল, দুটি অপরূপা সুন্দরী বা যুবকের মধ্যেও পার্থক্য থাকে।

থাকেই তো।

কিসের পার্থক্য?

অনেক কিছুরই পার্থক্য থাকতে পারে।

পার্থক্য থাকে শুধু মাধুর্যের। দেহ আর মনের সমন্বয়ে জন্ম নেয় মাধুর্য। দুটি মেয়ে সুন্দরী হতে পারে কিন্তু দুজনের মাধুর্য কিছুতেই সমান হতে পারে না।

মণিকা তখনও তর্ক করে, তা তো হবেই।

কেন বলো তো?

মণিকা একটু থমকে দাঁড়ায়। দৃষ্টিটা সরিয়ে ঘুরিয়ে নেয় প্রায় নির্জন বোটানিকসের চারপাশ। হাঁটতে হাঁটতেই আনমনে দুটো একটা গাছের পাতা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে। বাতাসে এক গোছা চুল মুখের ওপর এসে পড়েছে। তাদের শাড়ির আঁচলটা খানিকটা বন্ধন মুক্ত করে উড়ে বেড়াচ্ছে।

ক্যাপ্টেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখে। চুম্বক যেমন লোহাকে টানে, সমুদ্র যেমন নদীকে আকর্ষণ করে ক্যাপ্টেনও মনে মনে তেমনি একটা দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভব করল।

মনে মনে বলল, মণিকা, যুগ যুগ আগে তুমিই বোধহয় হিমালয় দুহিতা পার্বতী ছিলে, তোমাকে দেখেই বোধহয় মহাদেবের…

মাথাটায় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মুখের ওপর পড়া চুলগুলো সরাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে মণিকা ফিরে বলল, কিছু বলছ?

ক্যাপ্টেন চমকে উঠে। না, না, কিছু বলছি না।

মনে হলো কি যেন বলছিলে।

কই না তো।

কিন্তু আমার যে মনে হলে তুমি বলছিলে।

ক্যাপ্টেন হাসে। তুমি কি বলতো?

হঠাৎ একথা জিজ্ঞাসা করছ?

তুমি কেমন করে বুঝলে আমি কিছু বলছিলাম।

মনে হলো যেন তোমার কথা শুনতে পেলাম।

ক্যাপ্টেন ভীষণ খুশি হলো কথাটা শুনে। আনন্দ খুশিতে সারা মুখটা জ্বল জ্বল করে উঠল। মণিকার দিকে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, তোমার হাতটা দাও তো।

মণিকা কোনো প্রশ্ন করল না, প্রতিবাদ করল না। হাতটা বাড়িয়ে দিল।

ক্যাপ্টেন মণিকার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে ওকে একটু টানল। মণিকা হঠাৎ যেন বড় বেশি কাছে এলো।

ক্যাপ্টেন বলল, থ্যাঙ্কস, মেনি মেনি থ্যাঙ্কস মণিকা। আর আমার ভয় নেই।

মণিকার ইরানি ঠোঁটের কোণায় একটু তৃপ্তির হাসির রেখা ফুটে উঠল।

কি হলো?

কি হয়নি বলো?

ক্যাপ্টেনের হাতের মুঠোয় তখনও মণিকার হাত। তখনও দুজনে দুজনকে বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে দেখছে। মণিকা একটি কথাও বলল না।

সত্যি, মনে মনে তোমাকে অনেক কথা বলেছিলাম। ভাবতে পারিনি তুমি জানতে পারবে, বুঝতে পারবে।

মণিকা দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে নিয়েছে। ক্যাপ্টেন প্রায় কানে কানে ফিস ফিস করে বলল, আমার মনের কথাও যখন শুনতে পাও তখন আর আমার ভয় নেই, চিন্তা নেই।

ক্যাপ্টেন এবার আস্তে আস্তে হাতটা ছেড়ে দিয়ে আলতো করে ডান হাত দিয়ে ওকে একটু জড়িয়ে ধরে বলল, এবার তোমাকে সব কথা বলব। কিছুই লুকাব না।

আনত নয়নেই মণিকা প্রশ্ন করে, কথা দিচ্ছ?

হ্যাঁ।

শুধু রূপ নয়। রূপসী অনেকেই। শ্যামলীও। কিন্তু লাবণ্য? সবার থাকে না। গন্ধ-স্পর্শ-রূপলাবণ্য সব নিয়েই ভালো লাগা। ফুলের মতো মানুষেরও রূপ-লাবণ্যই শেষ কথা নয়। সৌরভই বড় কথা। মানুষেরও সৌরভ আছে, গন্ধ আছে। যে মেয়েদের সে সৌরভ নেই, মিষ্টি গন্ধ নেই, তাদের রূপ-লাবণ্যের কি মূল্য?

মণিকা কিছুতেই এসব বিশ্বাস করত না। তর্ক করত।

আমি কি গোলাপ যে আমার গন্ধ থাকবে, সৌরভ থাকবে?

প্রত্যেক মানুষেরই দেহের একটা গন্ধ আছে…

গন্ধ আছে?

নিশ্চয়ই আছে। প্রতিটি অঙ্গের একটা গন্ধ আছে। সব অঙ্গের গন্ধ মিলিয়েই দেশের গন্ধ…

আবার মাঝপথে বাধা দেয় মণিকা। কই আমি তো আমার দেহের কোনো গন্ধ পাই না।

পাবে না। তুমি তোমার দেহের গন্ধের সঙ্গে এত বেশি পরিচিত যে তা অনুভব করা সম্ভব নয়, কিন্তু তুমি তোমার মাকে কাছে একটু টেনে নিও, একটু জড়িয়ে ধরো, একটা অতি পরিচিত সুন্দর গন্ধ পাবে।

ক্যাপ্টেন একটু যেন সরে বসে। মুখটা মণিকার কানের কাছে নিয়ে একটু ফিস ফিস করে বলে, আমার দেহের গন্ধ পাচ্ছ!

মণিকা হাসতে হাসতেই ভ্রু কুঁচকে বলে, আঃ কি যা তা বলছ?

আর একদিন মধ্যমগ্রামের ফার্মে গিয়ে ক্যাপ্টেন আরো অনেক কথা বলেছিল।

একটা ছোট্ট বাচ্চাকে কোলে তুলে নিও। একটা সুন্দর মিষ্টি গন্ধ পাবে…

ফার্মের মধ্যে ছোট্ট রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে মণিকা জবাব দেয়, বাচ্চাদের গন্ধ থাকে বলে কি বুড়োদেরও থাকবে?

একশো বার থাকবে। দেহ, মন, বয়স ও চরিত্র পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের গন্ধ বদলায়।

মণিকা তর্ক করে না কিন্তু ক্যাপ্টেনের যুক্তি মেনে নেয় বলেও মনে হয় না।

পরে ওই ছোট্ট কটেজের বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে ক্যাপ্টেন বলেছিল, শ্যামলীর রূপ আছে, যৌবন আছে, কিন্তু লাবণ্য নেই। প্রথমদিন তোমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তোমার লাবণ্য আর সৌরভে মুগ্ধ হয়েছিলাম।

মণিকা ডান হাতে চায়ের কাপ ধরে থাকল কিন্তু বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, কচু!

ক্যাপ্টেন মুচকি হেসেছিল। মনে মনে বলেছিল, কিভাবে তোমাকে এসব কথা বোঝাই বলতো? দেহমনের অপব্যবহার হলে রূপ থাকতে পারে কিন্তু লাবণ্য-সৌরভ নষ্ট হয়ে যাবেই।

চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে ওই মুচকি হাসতে হাসতেই বলেছিল, শ্যামলীর রূপ-যৌবনের চাইতে তোমার লাবণ্য-সৌরভ অনেক বেশি লোভনীয়।

আঃ কি অসভ্যতা করছ? বোঝাবার ক্ষমতা নেই, শুধু অসভ্যতা করতে পারো।

সামনের চেয়ারে বসে ক্যাপ্টেন একটু সামনের দিকে ঝুঁকে বলে, বিয়ের আগে এর চাইতে বেশি বোঝান যায় না। বুঝলে?

মণিকা তিড়িং করে এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, তোমার মতো অসভ্য আর্মি অফিসারকে বাংলাদেশের মেয়ে বিয়ে করবে?

মেয়েরা অনেক কথাই এড়িয়ে যায়, স্বীকার করতে লজ্জাবোধ করে কিন্তু তাই বলে মনে মনে অনুভব করে না, তা নয়। বাড়ি ফিরে গিয়েও বার বার মনে পড়েছিল ক্যাপ্টেনের কথা। মনে মনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিচার করেছিল।

কলেজে বোজ অর্পিতার পাশে বসত কিন্তু যেদিন অর্পিতা না আসত সেদিন লিলির পাশে ওকে বসতে হতো, সেদিন কি বিশ্রী লাগত! কেন অধ্যাপক মঙের ছেলে? জান সিস্টার, বাড়িতে ঢুকেই আমি বুঝতে পারি তুমি আছ কি নেই।

মণিকা জানতে চাইত, কেমন করে?

মেয়েদের একটু ফ্লেবার আছে। মা-মারা যাবার পর সে গন্ধ আর পেতাম না। কিন্তু তুমি আসা-যাওয়া শুরু করার পর আবার যেন সেই হারিয়ে যাওয়া গন্ধটা খুঁজে পাচ্ছি।

তবে কি ক্যাপ্টেনের কথাই ঠিক? উপরের ঘরে একলা শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে দূরের আকাশ দেখতে দেখতে কতবার ভাবছিল এইসব কথা। পাশ ফিরল। ও পাশের ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে অনেকক্ষণ ধরে দেখল। নিজের সৌরভে যেন নিজেই মাতাল হলো।

শুধু সে রাত্রে নয়, পরের কয়েকটা দিন নিজেকে নিয়েই মেতে রইল মণিকা। একটু একলা থাকলেই বড় বেশি নিজেকে দেখে। আপাদ-মস্তক দেখে। সর্বাঙ্গ দেখে। ওর লাবণ্য আছে? সৌরভ আছে?

আছে বৈকি! তা নইলে রাজভবনের আকর্ষণ তুচ্ছ করে ক্যাপ্টেন ছুটে আসে? হাই সোসাইটিতে একটু মর্যাদা পাবার জন্য কলকাতার কত মেয়ে এ-ডি-সি-র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চায়। ক্যাপ্টেনের সঙ্গেও তো কত মেয়ের আলাপ। তবুও যখন ক্যাপ্টেন।

যেন আরো ভালো লাগে। বড় বেশি ভালো লাগে। কৃতজ্ঞতায় সারা মনটা ভরে যায়। বড় দেখতে ইচ্ছে করছে। শুধু দেখতে? সামান্য একটু আদর করতে, একটু ভালোবাসতে। একটা গান শোনাতেও ইচ্ছে করছে।

গভর্নরের ওপর ভীষণ রাগ হয় মণিকার। এত ট্যুরে যাবার কোনো অর্থ হয়?-প্রতি মাসেই ট্যুর? যেন ক্যানভাসার, হেড অফিসে বেশিদিন থাকার হুকুম নেই। আচ্ছা ট্যুরে যাবে যাও, বক্তৃতা দিতে ভালো লাগে, দাও। তাই বলে সব সময় ক্যাপ্টেন রায়কে কেন? আর কি কোনো এ-ডি-সি নেই? আচ্ছা ও যদি ম্যারেড হতো? ছেলে-মেয়ে থাকত?

ছি, ছি। এমন করে একজন ইয়ংম্যানের লাইফ নষ্ট করে?

কলকাতা থেকে বর্ধমান-বাঁকুড়া-বীরভূম ঘুরে আসতে কতদিন লাগে? একদিন-দুদিনই তো যথেষ্ট! সাতদিন ধরে ঘুরে বেড়াবার কোনো অর্থ হয়? বর্ধমান পাবলিক লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা দিবস পালন করতে গভর্নরের যাবার কি দরকার? দেশে কি কোনো শিক্ষাব্রতী নেই? ভি-আই-পি চাই? ভালো কথা? ভাইস চ্যান্সেলার বা এডুকেশন মিনিস্টার তো আছেন। আরো বড় ভি-আই-পি? কেন চীফ মিনিস্টার? তার তো কাজ আছে, লাটসাহেবের মতো বক্তৃতা দিলেই চলবে না!

বর্ধমান পাবলিক লাইব্রেরিতে যাবার তবু অর্থ হয় কিন্তু দুর্গাপুরে? লাটসাহেব কি ইঞ্জিনিয়ার? কলকারখানা দেখে উনি কি বুঝবেন? বুঝি আর না বুঝি তবুও যেতে হবে। লেকিন, মাগার করে বক্তৃতা দিতে দিতে ওয়ার্কারদের বলতে হবে দেশের ফয়দার জন্য আরো পরিশ্রম করতে হবে, আরো ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। না জানি দেশের ফয়দার জন্য লাটসাহেব নিজে কত খাটছেন, কত ত্যাগ স্বীকার করছেন।

মেজাজ গরম হয়ে যায় মণিকার।

দুর্গাপুর থেকেও ফিরবেন না। রামপুরহাটে সিল্ক উইভার্স কোঅপারেটিভেও যেতে হবে। কেন? দুচার গজ সিল্কের কাপড় প্রেজেন্ট পাবেন বলে?

গভর্নরের ওপর যত রাগ হয়, ক্যাপ্টেনকে তত বেশি ভালো লাগে, তত বেশি কাছে পেতে ইচ্ছা করে।

জানালা দিয়ে দূরের আকাশের তারাগুলো দেখে। চোখের পাতা দুটো ভারী হয়ে আসে। তবুও মনে হয় ওরা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *