০৯. রাজভবনের কথা

রাজভবনের কথা আর কাকে বলবে? না বলে মনে শান্তি পায় না ক্যাপ্টেন রায়। লাটসাহেবের অসহায় অবস্থার কথাও বলে।

বিশ্বাস করুন ব্যারাকপুরের গঙ্গার ধারে ওই বাগানবাড়ি আর দার্জিলিং গভর্নমেন্ট হাউসে ছাড়া অন্য কোথাও যেতে হলেই লাটসাহেবকেও চীফ মিনিস্টারের মুখের দিকে চেয়ে থাকতে হয়।

মণিকা অবাক হয়ে বলে, রিয়েলি?

কত সরকারি অনুষ্ঠানে লাটসাহেবকে নেমন্তন্ন করেও পরে ক্যানসেল করা হয় চীফ মিনিস্টারের ইচ্ছায়…

হাঁটু দুটোকে দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে বসে থাকতে থাকতে মণিকা আবার প্রতিবাদ করে, কি যা তা বলছেন?

ভ্রু কুঁচকে মুহূর্তের জন্য কি যেন ভাবে মণিকা। তারপর আবার বলে, আপনি এ-ডি-সি বলে ইউ কান্ট সে হোয়াট এভার ইউ লাইক।

ক্যাপ্টেন রায় হাসে। হাসতে হাসতে চেয়ে থাকে মণিকার দিকে। কিছু বলে না, যেন বলতে চায় না।

ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে মণিকাও হাসে, কি? ভেবে দেখছেন এবারে কি বানিয়ে বানিয়ে বলবেন?

ক্যাপ্টেন হাসতে হাসতেই বলে, মিথ্যা কথা বলে আমার কি লাভ? তাছাড়া আপনাকে আমি মিথ্যা কথা বলব?

কথাটা বড় ভালো লাগে মণিকার। সংযত সংহত পরিবেশের মধ্যেও একটু যেন নিবিড়তা অনুভব করে।

চোখ দুটো বড় বড় করে মণিকা বলে, আমাকে মিথ্যা কথা বলতে নেই?

একটু ভেবে উত্তর দেয় ক্যাপ্টেন, না, ঠিক তা নয়; তবে আপনাকে মিথ্যা কথা বলে আমিই মনে মনে শান্তি পাব না।

লাটসাহেবের দুরবস্থার আরো অনেক কাহিনি মণিকাকে বলেছিল ক্যাপ্টেন রায়। যাকে প্রতি পদক্ষেপে স্যালুট করব, যাঁর হুকুম তামিল করাই আমাদের কাজ, তার এই অসহায় অবস্থা দেখে আমাদেরই খারাপ লাগে।

সরকারি-বেসরকারি অফিসে ছোট-বড় অফিসারদের অপমান দেখতে দেখতে অভ্যস্ত থাকেন। তাদের সহকর্মীরা কিন্তু আর্মিতে এসব দেখা দুর্লভ ব্যাপার, অসম্ভব ব্যাপার। তাই তো এ-ডি-সি-র চাকরি করতে এসে ক্যাপ্টেন রায় মনে মনে আহত হন প্রতি পদক্ষেপে। উত্তরবঙ্গের সর্বনাশা বন্যার খবর কলকাতায় পৌঁছাবার পর পরই লাটসাহেব ঠিক করলেন নিজের চোখে দেখে আসবেন মানুষের দুঃখ-দুর্দশা। রাইটার্স বিল্ডিংস-এ লাটসাহেবের অভিপ্রায়ের খবর। পৌঁছাবার একটু পরই লাটসাহেবের সেক্রেটারিকে জানান হলো, না না, এক্ষুনি লাটসাহেবের যেতে হবে না। সমস্ত সরকারি কর্মচারীরা উদ্ধার কার্যে ব্যস্ত। লাটসাহেব গেলে এইসব জরুরি কাজকর্ম বন্ধ করে তার দেখাশুনা করতে হবে সমস্ত সরকারি কর্মচারীদের।

অথচ…

দুদিন পরই চীফ মিনিস্টার নিজে গেলেন নর্থ বেঙ্গল।

মণিকা ঠিক বুঝতে পারে না তাৎপর্য, তাতে কি হলো?

প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর যে ভি-আই-পি প্রথম যান, তার ছবি, নিউজ খবরের কাগজে বেশি ছাপা হয়। ফিল্ম ডিভিশনের নিউজ রিলে বা রেডিওতে বেটার কভারেজ পায় সুতরাং…

রাজভবনের জীবন গতানুগতিকভাবে কাটে। সেই একই ইউনিফর্ম, স্যাফরন আর্ম-ব্যাচ; সেই সেলাম দেওয়া, সেলাম নেওয়া। সেই সভা-সমিতি, ডিনার-ড্যান্স-কটেল।

ক্যাপ্টেন রায় অভিনবত্ববোধ করে না এই নিত্য নৈমিত্তিক জীবনে। সকাল থেকে সন্ধ্যা, কত জনের সঙ্গে দেখা হয়, আলাপ হয়। হাসি-ঠাট্টা গল্প-গুজবও হয় কিন্তু তাদের সঙ্গে নিবিড় হয়ে মিশতে উৎসাহবোধ করেন না। এসব কথা মণিকা জানে।

বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজের বার্ষিক উৎসবে যোগদান করার জন্য লাটসাহেবের সঙ্গে ক্যাপ্টেন রায়ও দুদিন বাঁকুড়া ঘুরে এল। মফঃস্বল শহরে গভর্নর এলেই একটু বেশি হৈ চৈ হয়। বাঁকুড়াতেও তার ব্যতিক্রম হলো না। বৃদ্ধ লাটসাহেবের পক্ষে এসব সহ্য করা সহজ নয়।

কলকাতায় ফিরেই লাটসাহেব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। হিজ একসেলেন্সির সব প্রোগ্রাম-এনগেজমেন্ট বাতিল করা হলো। চীফ মিনিস্টারও তখন কলকাতার বাইরে। গভর্নরের দস্তখতের জন্য সরকারি কাগজপত্র আসাও কদিন বন্ধ ছিল।

অনেকদিন পর সেদিন আবার মণিকা এসেছিল ক্যাপ্টেনের সঙ্গে গল্প করতে। বড় সোফাটায় দুটো পিলো মাথায় দিয়ে ক্যাপ্টেন কাত হয়ে শুয়ে শুয়ে গুল্প করছিল মণিকার সঙ্গে। হঠাৎ টেলিফোন বাজল। বেশ বিরক্ত হয়েই ক্যাপ্টেন উঠে গেল টেলিফোন ধরতে।

ডান হাত দিয়ে চেয়ারটা টানতে টানতেই বাঁ হাত দিয়ে রিসিভারটা তুলল, ক্যাপ্টেন রয় হিয়ার?

একটু পরেই ক্যাপ্টেনের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল, গুড আফটারনুন, মিস গুপ্তা। কেমন আছেন?

মিস গুপ্তা শুনতেই মণিকা ঘাড় বেঁকিয়ে একবার ক্যাপ্টেনকে দেখল।

একটু পরে ক্যাপ্টেন মিস গুপ্তাকে বলল, মিঃ গর্ডন বোধহয় এ মাসের শেষের দিকে কলকাতা আসছেন। আই উইল সার্টেনলি ইনফর্ম ইউ হোয়েন হি কামস।

ক্যাপ্টেন একটু থামল। মণিকা আর একবার দেখল, হাসল।

নো নো মিস গুপ্তা। বিরক্ত হবে কেন? ইট ইজ এ প্রিভিলেজ টু গেট এ কল ফ্রম ইউ।

ক্যাপ্টেন টেলিফোন নামিয়ে রেখে ফিরে আসতেই মণিকা বলল, আই অ্যাম সরি।

কেন?

আমার জন্য একটু প্রাণ খুলে কথা বলতে পারলেন না?

ক্যাপ্টেন একটু মুচকি হাসল। চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি।

নিচের ঠোঁটটা একটু কামড়ে মণিকা বলে, ট্রাই এগেন অ্যান্ড এগেন। নাউ ইউ হ্যাঁভ মাই বেস্ট উইসেস।

.

কলকাতা রাজভবনের একটা ট্রাডিশন আছে, মর্যাদা আছে, মোহ আছে। সমাজের পাঁচজনের মধ্যে একজন হতে হলে রাজভবনের সঙ্গে একটু মিতালি থাকা প্রয়োজন।

এতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। লাটসাহেবের উমেদারী করে অনেকেই সমাজে এই স্বীকৃতি লাভ করেন। যারা পলিটিক্স করেন, স্বপ্ন দেখেন রাইটার্স বিল্ডিং-এর দোর গোড়ায় সাব ইন্সপেক্টর সেলাম দিচ্ছে, তাদের ইষ্টদেবতা লাটসাহেব নয়। যারা পলিটিসিয়ান কাম সোস্যাল ওয়ার্কার কাম বেনামী বিজনেসম্যান, যারা অন্য কোথাও কল্কে পান না, তারাই লাটসাহেবের সান্নিধ্য লাভের জন্য একটু বেশি লালায়িত।

এদের ড্রইংরুমে, অফিস ঘরে লাটসাহেবের ফটো লটকান থাকে। সুতরাং চিনতে কষ্ট হয়। রাজভবনের সঙ্গে আরো বহু ধরনের মানুষের যোগাযোগ আছে। কারণে, অকারণে। প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে। এদের সবাইকেই চেনা যায়, জানা যায়, বোঝা যায়।

বোঝা যায় না, জানা যায় না আরতি সরকার, শ্যামলী গুপ্তা, অলকা মিত্র, উজ্জ্বলা সেনকে। বাইরের কেউ জানতে না পারে, বুঝতে না পারে কিন্তু এ-ডি-সি? নাটকের অন্তিম দৃশ্য দুচোখ। দিয়ে না দেখলেও সব কিছু বুঝতে পারে, জানতে পারে।

ক্যাপ্টেন টেলিফোন শেষ করে ও পাশের সোফায় বসে একটা সিগারেট ধরাল। দৃষ্টিটা হয়তো মুহূর্তের জন্য ইউক্যালিপটাস গাছের ফাঁক দিয়ে একটু ঘুরে এলো।

মণিকা একটা ছোট্ট দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, মনটা একটু উদাস হয়ে গেল, তাই না?

মুচকি হাসতে হাসতে চেয়ে রইল ক্যাপ্টেনের দিকে।

ক্যাপ্টেন হাসল। আমার ওপর রাগ হয়েছে তো?

না, রাগ করব কেন?

মিস গুপ্তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বললাম বলে।

আফটার অল আপনি একজন আর্মি অফিসার; তারপর আবার এ-ডি-সি। সুতরাং আপনার সঙ্গে যে শুধু মণিকা ব্যানার্জির আলাপ নেই…।

ক্যাপ্টেন বাধা দেয়, তবু বলবেন রাগ করেননি?

না না, রাগ করব কেন?

আপনার সামনে থেকে সিগারেট তুলে নিলাম, কই আপনি তো লাইটার জ্বেলে ধরলেন না?

মণিকা লজ্জা পায়। সরি।

ক্যাপ্টেন কিন্তু মনে মনে খুশি হয়। ভালোবাসা না থাকলে কি ঈর্ষা আসে?

মিছিমিছি সন্দেহ করবেন না। এখানে চাকরি করতে এসে আপনাদের কলকাতার অনেক কিছু জানলাম! ভবিষ্যতে সুযোগ এলে আপনাকে বলব।

মণিকা, আবার একটু মুচকি হাসে। মিস গুপ্তার স্টোরি বলার দিন কি অ্যাট-অল আসবে?

আই হোপ সো বাট ইট ডিপেক্স অন ইউ।

তার মানে?

শ্যামলী গুপ্তার স্টোরি এখন আমি বলতে পারব না, আপনি শুনতেও পারবেন না।

কেন?

ক্যাপ্টেন একটু ভাবে। আমাদের পরিচয়টা আরো একটু গভীর না হলে ওইসব মেয়েদের কাহিনি বলতে ও শুনতে দুজনেরই লজ্জা করবে।

টানা টানা ভ্রূ দুটো উঁচু করে মণিকা বলে, ইজ, ইট সো রোমান্টিক?

নট রোমান্টিক বাট ভালগার!

মণিকা সঙ্গে সঙ্গে বলে, শুনেছি অধিকাংশ পুরুষই ভালগারিটি পছন্দ করে।

মিছিমিছি কথা কাটাকাটি করে চলে দুজনে বেশ কিছুক্ষণ।

শেষে মণিকা বলে, তর্ক করছি বলে কি একটু কফিও খাওয়াবেন না।

ক্যাপ্টেন লজ্জিত হয়। হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, আপনার সঙ্গে কথা বলতে গেলে আর সব কিছু গুলিয়ে ফেলি।

শ্যামলীর সঙ্গে কথা বলার সময় তো মনে হলো না কিছু গুলিয়ে ফেলেছেন?

কান্ট ইউ ফরগেট শ্যামলী?

এমন একটা রোমান্টিক ক্যারেকটারকে চট করে ভোলা যায় না?

একটু থেমে মণিকা আবার জানতে চায়, আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে কি গুলিয়ে ফেললেন?

আমার কলিগ ন্যাভাল এ-ডি-সি ও তাঁর স্ত্রী আপনাকে নিয়ে যেতে অনুরোধ করেছে।

কোথায়?

এইতো নর্থ গেটের সামনেই ওদের কোয়ার্টারে।

কেন বলুন তো?

কেন আবার? আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চায়।

আপনি বুঝি ওদের কাছে আমার কথা বলেছেন?

বলেছেন মানে? রেগুলার আপনার কথা বলি।

সব কিছু বলেছেন?

ওদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখবার মতো এখনও তো কিছু হয়নি। তেমন কিছু হলে নিশ্চয়ই বলব না।

কথাটা শুনেই মণিকার সারা মুখটা লাল হয়ে ওঠে। সলাজ চোখের দৃষ্টিটা আনত হয়। ক্যাপ্টেন মুগ্ধ হয়ে দেখে।

কয়েক মিনিট এমনিভাবে কেটে গেল।

তারপর ক্যাপ্টেন বলল, সুড আই টেল মাই কলিগ অ্যান্ড হিজ ওয়াইফ দ্যাট ইউ আর হিয়ার?

বলুন।

ক্যাপ্টেন টেলিফোনে লেফটেন্যান্ট ভাটিয়াকে জানাল, মণিকা ইজ হিয়ার।

ভাটিয়া কি যেন বলল।

অ্যাডমিরাল ইজ কামিং? ওয়ান্ডারফুল!

ক্যাপ্টেন রিসিভারটা নামিয়ে রাখতেই মণিকা প্রশ্ন করল, অ্যাডমিরাল কে?

ভাটিয়ার স্ত্রী সুনীতা। ওকে আমি অ্যাডমিরাল বলি।

ক্যাপ্টেন আবার একটা সিগারেট তুলতেই মণিকা বলল, আবার সিগারেট ধরাচ্ছেন যে?

তাতে কি হলো?

জামা-কাপড় চেঞ্জ করবেন না?

অ্যাডমিরালের ওখানে যাবার জন্য পায়জামা-পাঞ্জাবিই যথেষ্ট।

না না। চেঞ্জ করে নিন।

ক্যাপ্টেন চেঞ্জ করে বেরুতে না বেরুতেই সুনীতা এসে মণিকার সঙ্গে আলাপ জমিয়েছিল।

গুড আফটার নুন অ্যাডমিরাল! কখন এলেন?

সুনীতা বলল, আর কথা নয় চলুন তাড়াতাড়ি। মণিকার দিকে ফিরে বলল, চলুন ভাই।

পরিচিতের সীমা যখন ছড়িয়ে পড়ে তখন সবার ভালো লাগতে নাও পারে কিন্তু স্বীকৃতি যখন ছড়িয়ে পড়ে আপন পর পরিচিত-অপরিচিতের মধ্যে তখন সবার ভালো লাগে। মণিকারও!

ক্যাপ্টেনের সঙ্গে একটা সুন্দর মিষ্টি প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, সে সম্পর্ক অসামাজিক না হলেও সামাজিক নয়। কিছুটা স্নেহমমতা ভালোবাসা। বাংলাদেশের বাইরে বিদেশে বেশ। কয়েক বছর কাটিয়ে কিছুটা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের জন্য মা-বাবা মণিকাকে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে মেলামেশা করতে বাধা দেননি। কিন্তু বৃহত্তর সমাজের কাছে এই পরিচিতির স্বীকৃতি মণিকা আশা করে না।

লেফটেন্যান্ট ভাটিয়া ও সুনীতার কাছে সেই স্বীকৃতি পেয়ে বড় ভালো লাগল মণিকার।

আপনি শুনে অবাক হবেন ইওর গ্রেট ফ্রেন্ড নেভার টোল্ড আস এনিথিং অ্যাবাউট ইউ।

সুনীতা বাঁকা চোখে ক্যাপ্টেনের দিকে কটাক্ষ করে মণিকাকে বলল।

মণিকা একটু হাসে। বলে, আমার সম্পর্কে কিছুই বলবার নেই।

আপনার বলবার কিছু না থাকলেও আমাদের শোনার অনেক কিছু আছে।

এবার ক্যাপ্টেন বলে, সুনিতা, ডোন্ট ট্রাই টু রিড বিটুইন দি নাইন্‌স্‌।

আমরা দুজনে কথা বলছি। এর মধ্যে তো আপনার মাথা গলাবার দরকার নেই।

বেশ লাগে মিসেস সুনীতা ভাটিয়াকে।

পরে মণিকা ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞাসা করেছিল, এদের সঙ্গে আগে পরিচয় করিয়ে দেননি কেন বলুন তো?

আগে আমার সঙ্গে ভালো করে পরিচয় হোক।

হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ভালো করে পরিচয়?

আই মিন হোয়াট আই সে।

ক্যাপ্টেন একটু থামে। একবার দেখে নেয় মণিকাকে। মণিকাও ক্যাপ্টেনের দিকে ফিরে দেখে। মাঝপথে দেখা হয়।

এমন খুশির আমেজের সময়ই মণিকার মনে পড়ে মিস শ্যামলী গুপ্তার কথা।

তারপর বলুন মিস গুপ্তার কি ব্যাপার।

এত গল্প-গুজব হাসি-ঠাট্টার পরেও মিস গুপ্তাকে ভোলেননি?

ভুলব কেমন করে? গভর্নরের এ-ডি-সি-র সঙ্গে কলকাতার টপ-এর সোসাইটি গার্লের পরিবারে এমন ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের ব্যাপারে কার জানার আগ্রহ হয় না বলুন?

ক্যাপ্টেন বলে, ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছি আপনার সঙ্গে আর লোকের আগ্রহ হবে মিস গুপ্তার খবর জানতে?

আমার মতো সাধারণ মেয়েকে নিয়ে দুনিয়ার কেউ আলোচনা করবে না।

ফোর্ট উইলিয়ামের পাশ দিয়ে হেস্টিংস-এর দিকে এগোতে এগোতে ক্যাপ্টেন একটা চাপা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে, আই উইস আই কুড সে হোয়াট আই ফিল লাইক সেইং।

কি বলতে চান বলুন। আমি কি আপনাকে বারণ করছি?

বারণ করেননি ঠিকই, তবুও…

ক্যাপ্টেন আর এগোতে পারে না।

মণিকাও নিশ্চয় জানতে চায় ক্যাপ্টেনের মনের কথা। নদীর পাড় দিয়ে হাঁটলে তো কোনোদিনই নদী পার হতে পারবেন না…

মণিকাকে আর বলতে হয় না।

ক্যাপ্টেন বলল, তবে বলছেন এবার নদীতে ঝাঁপ দিতে পারি?

মণিকা মজা করে। সাহস থাকলে নিশ্চয়ই ঝাঁপ দেবেন।

সাহস না আগ্রহ?

দুই-ই?

একটু পরেই মণিকা আবার বলল, চলুন আমাকে পৌঁছে দেবেন।

এক্ষুনি?

অনেকক্ষণ তত বেরিয়েছি।

ক্যাপ্টেন মনে মনে বলে, আচ্ছা মণিকা এখনও তোমার বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছা করে? ভালো লাগে?

মনে মনে আরো কত কথা জানতে চায়, বলতে চায়, শুনতে চায় কিন্তু পারে না।

ক্যাপ্টেন ওইসব ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে যায়।

কি ভাবছেন?

ক্যাপ্টেনের হুঁশ ফিরে আসে। না, না কিছু ভাবছি না।

এমন কি ভাবছেন যা বলতে এত সঙ্কোচ?

একটু শুকনো হাসি হাসল ক্যাপ্টেন। বলে, ঠিকই ধরেছেন। বড় সঙ্কোচ, বড় দ্বিধা। কবে যে এর থেকে মুক্তি পাব।

আর দেরি করে না। একটা ট্যাক্সি কাছে আসতেই দুজনে হাত তুলল। থামাল। চড়ল।

বাড়ি পৌঁছেই মণিকা সামনের বাঁ দিকের ঘরে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, মা, বাবা কোথায়?

ডক্টর চৌধুরি এসে তোর বাবাকে নিয়ে গেলেন।

ক্যাপ্টেনকে দেখে মিসেস ব্যানার্জি খুশি হলেন, এসো, এসো ভিতরের ঘরে চলো।

এবার মণিকার দিকে ফিরে বললেন, এতক্ষণ বেরিয়েছিস, একটা টেলিফোন তো করতে পারতিস।

মণিকার জবাব দেবার আগেই ক্যাপ্টেন বলল, আর বলবেন না মাসিমা। আমার কলিগ এ-ডি-সি ভাটিয়ার স্ত্রীর সঙ্গে এমন গল্পের মশগুল হয়েছিলেন যে অনেক বলবার পরও উঠেছিলেন না!

হাতের ব্যাগটা ছুঁড়ে দূরের সোফায় ফেলে মণিকা বলল, আপনি কটা মার্ডার করেছেন। বলুন তো?

মার্ডার? চমকে ওঠে ক্যাপ্টেন।

এমন সুন্দর করে যে মিথ্যা কথা বলতে পারে, সে মার্ডার করে না?

ক্যাপ্টেন এবার মিসেস ব্যানার্জির সাহায্য সহানুভূতি চায়, দেখছেন মাসিমা, কি বলছেন?

আঃ। কি যা তা বলছিস? মণিকাকে শাসন করে ক্যাপ্টেনকে বললেন, যাও বাবা, তুমি ও ঘরে গিয়ে বসো আমি আসছি।

খালি হাতে আসবেন না। প্লেট ভর্তি করে কিছু আনবেন।

সবাই হাসে!

হাসি চাপতে চাপতেই মণিকা জানতে চায়, এমন করে বলতে আপনার লজ্জা করে না?

সরি! খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে আবার লজ্জা কিসের?

মা-মাসির কাছে আবার লজ্জা কিসের?-বলেই মিসেস ব্যানার্জি চলে গেলেন।

মণিকা ক্যাপ্টেনকে নিয়ে ওপাশের বসার ঘরে এসে বলল, বসুন।

ক্যাপ্টেন বসল না। আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো মণিকার কাছে। খুব কাছে। একেবারে মুখের কাছে, কানের পাশে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বলল, আপনাকেই প্রথম মার্ডার করব। রক্তটা বড় চঞ্চল হয়ে উঠেছে। খুব বেশি দিন ধৈর্য ধরতে পারব না।

ক্যাপ্টেন কোনোদিন এত কাছে, এত নিবিড় হয়ে এগিয়ে আসেনি। ক্যাপ্টেনের টানা বড় বড় নিশ্বাস মণিকার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল। অপারেশন থিয়েটারের ক্লোরফর্মের মতো ক্যাপ্টেনের নিশ্বাস যেন মণিকাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। মুখে কিছু বলল না। শুধু অবাক-বিস্ময় মাখা মুগ্ধ নয়নে চাইল ক্যাপ্টেনের দিকে।

মণিকা চলে যাবার একটু পরেই মিসেস ব্যানার্জি এলেন।

টুকটাক কথাবার্তা বলার পর মিসেস ব্যানার্জি বললেন, একবার তোমার সঙ্গে এলাহাবাদ ঘুরে আসব।

নিশ্চয়ই। মা-বাবা ভীষণ খুশি হবেন।

ঘরে ঢুকতে গিয়ে মণিকার কানে কথাটা গিয়েছিল।

তুমি ওর কথা বিশ্বাস কর মা?

কেন করব না?

গুরুজনেরা যখন কথা বলেন তখন মাঝখান থেকে হঠাৎ কোনো কথা না বলাই ভদ্রতা। ক্যাপ্টেন বেশ গম্ভীর হয়ে বলে।

মণিকা হাসি চাপতে পারে না, আপনিও আমার গুরুজন নাকি?

ক্যাপ্টেন আবার মিসেস ব্যানার্জির শরণাপন্ন হয়। আচ্ছা মাসিমা উনি আমার চাইতে বয়সে ছোট না?

তা তো বটেই।

আজকের থেকে আমি আর আপনাকে আপনি বলব না। ক্যাপ্টেন সাফ জানায় মণিকাকে। মিসেস ব্যানার্জির দিকে ফিরে বলল, ঠিক বলেছি না মাসিমা?

ও যখন তোমার চাইতে বয়সে ছোট তখন আর আপত্তি কি!

মণিকা প্রতিবাদ করতে যাবার আগেই ক্যাপ্টেন বলল, দেখ তো মণিকা, আমার চা-টা হলো কিনা।

মিসেস ব্যানার্জি তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন, না, না, আমিই যাচ্ছি।

মিসেস ব্যানার্জি চলে যাবার পরই মণিকা বলল, আজ আপনার কি হয়েছে বলুন তো?

ক্যাপ্টেন হঠাৎ মণিকার হাতটা চেপে ধরে বলে, তোমার কিছু হয়নি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *