০৬. ডায়না-ডরোথির বেলেল্লাপনার কাহিনি

রমজানের কাছে শুধু ডায়না-ডরোথির বেলেল্লাপনার কাহিনির মধ্যে ডুবে থাকতে পারেন না ক্যাপ্টেন রায়। আমজাদের দেওয়া ব্রেকফাস্ট খেয়ে সকাল বেলায় লাটসাহেবের সেবা করতে গিয়ে যে-সব দর্শনার্থীর সঙ্গে পরিচয় হয়, তাতে মন ভরলেও খেয়াল চরিতার্থ করা যায় না। তার জন্য চাই ইভনিং ডিউটি বা ট্যুর। সব ট্যুর, সব ইভনিংই রঙিন হয় না কিন্তু ঘুরে ফিরে রংমশালের রঙিন আলো নজরে পড়বেই।

স্কোয়াড্রন লিডার সিং এয়ারফোর্সে ফিরে গেছে অথচ পরবর্তী নেভাল এ-ডি-সি তখনও এসে পৌঁছাননি। কয়েক মাসের জন্য একজন আই-পি-এস পুলিশ অফিসার এ-ডি-সি-র কাজ করছিলেন। লাটসাহেবের ও রাজভবনের কতকগুলো আদব-কায়দা-নিয়ম-কানুন ও বৈশিষ্ট্য আছে। অনেক নিয়ম-কানুন আদব-কায়দার কথাই ফাইলে লেখা থাকে না। অনেকটা বিয়েবাড়ির স্ত্রী-আচারের মতো আর কি! বিয়ের মন্ত্র পাঁজি-পুঁথিতে পাওয়া যায় কিন্তু স্ত্রী আচার কোথাও লিখিত পাওয়া যায় না। দেখে শুনেই ওসব শিখতে হয়। লাটসাহেব ও রাজভবনের ক্ষেত্রে পাঁজি-পুঁথির মন্ত্রের চাইতে স্ত্রী আচারের প্রাধান্য ও গুরুত্বই বেশি। নতুন কোনো এ-ডি-সি-র পক্ষে এসব রপ্ত করা সহজ নয়।

টুকটাক সভা-সমিতিতে রাজ্যপালের অনুগমন করা বা ক্যাজুয়াল ভিজিটার্সদের রাজ্যপালের ড্রইংরুমে পৌঁছে দেবার কাজ নতুন এ-ডি-সি করলেও সব গুরুত্বপূর্ণ কাজই ক্যাপ্টেন রায়কে করতে হতো।

কাজের কি শেষ আছে এ-ডি-সি-র? কি না করতে হয় তাকে? লাভ-ম্যারেজের পর একলা স্বামীর ঘর করতে গিয়ে মেয়েদের যে অবস্থা হয়, এ-ডি-সিদেরও অনেকটা সেরকম। কলেজ-ইউনিভার্সিটি, কফি-হাউস-সিনেমাহল, লেক-ডায়মন্ডহারবার-দীঘার পর ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের সিংহদ্বার টপকে স্বপনচারিণীকে সংসার জীবনে প্রবেশ করতে হয়। চাল-ডাল-আটা-ময়দা হাঁড়ি-কড়া-হাতা-খুতীর তদারকি করতে হয়, ইন্টিরিয়র ডেকরেটর হয়ে ওল্ড ওয়াইন ইন নিউ বটল-এ চালাতে হয়, সন্ধ্যার স্তিমিত আলোকে স্বামীকে গান শোনাতে হয় অথবা ট্যাক্সিতে যাবার সময় স্বামীর কাঁধে মাথা রেখে ন্যাকামির অভিনয় করতে হয়। আরো কত কি করতে হয়। মান-অভিমান রাগ-অনুরাগের দোলনায় দোল খেতে খেতে নার্সিংহোম ঘুরে আসার পরও স্বামীকে খুশি করার জন্য অভিসারিকা সাজতে হয়।

একটা স্বামীকে তাল দিতেই স্বপনচারিণীর প্রাণান্তকর অবস্থা হয়। আর-এ-ডি-সি-কে? নিত্য নতুন স্বামীর মনোরঞ্জন করতে হয় তাকে। রাজভবনে নিত্য অতিথিদের আগমন। অতিথি সকারের দায়িত্ব গভর্নরের ডেপুটি সেক্রেটারির কিন্তু তাদের অভ্যর্থনার দায়িত্ব এ-ডি-সি-র নয়। কলকাতার বাইরে লাটসাহেবের ট্যুর ডিউটিতে থাকলে তো কথাই নেই। বেয়ারা, চাপরাশি, অর্ডালী থাকলেও সব দায়িত্বই এ-ডি-সি-র। লাটসাহেবের পোশাক-আশাক খাওয়া-দাওয়া ওষুধ-পত্র ইত্যাদি ইত্যাদি সব কিছুই এ-ডি-সি-কে দেখতে হয়। এইখানেই শেষ নয়।

এক একজন লাটসাহেবের এক একরকম বাতিক থাকে। যে লাটসাহেব নরম বালিশে শুতে পারেন না, তার ট্যুর প্রোগ্রাম ঠিক হবার পরই ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে এ-ডি-সি-র টেলিগ্রাম পাঠাতে হয়, অ্যারেঞ্জ শক্ত বালিশ ফর গভর্নর অ্যাট সার্কিট হাউস স্টপ কনফার্ম স্টপ এ-ডি-সি গভর্নর। লাটসাহেব কি খাবেন, কি ভাবে তা রান্না হবে এবং সে খাবার অল্প না বেশি গরম খেতে উনি পছন্দ করেন, তার ছাপান সার্কুলার আছে। সুতরাং এ-ডি-সি-কে তা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাতে না হলেও লাটসাহেবের খাবার আগে চেক-আপ করে দেখতে হয় সার্কুলারের ইজ্জত রক্ষা করা হয়েছে কিনা।

এইখানেই শেষ নয়। রাজ্যপাল ভাব ভোলা বলে তার পোশাক-আসাকের দিকেও তীক্ষ্ণ নজর দিতে হয়।

আরো কিছু?

আরো কিছু আছে তবে হয়তো প্রকাশ্যে নয়। রাজাগোপালাচারী বা কৈলাশনাথ কাটজু বা হরেন মুখুজ্জের মতো গভর্নর আজ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজকাল অনেক রাজ্যপাল দিনে প্রহিবিশন কাউন্সিলের সভাপতিত্ব করলেও সন্ধ্যার পর স্কচ মার্কা দাওয়াই না খেলে পারেন না। সমস্ত লোকচক্ষুর আড়ালে এ-ডি-সি-কেই গেলাস বোতল সোডার ব্যবস্থা করতে হয়। একজন অতি বিশ্বস্ত বেয়ারা সাহায্য করে মাত্র। অনেক রাজ্যপাল তো পুরনো দিনের বান্ধবী দেখলে বর্তমান ভুলে যান। কোনো কোননা ক্ষেত্রে সদ্য পরিচিতাকে পুরনো দিনের বান্ধবী বলে। চালাতে স্যুট-টাই পরা রাজ্যপালরা দ্বিধা করেন না।

ক্যাপ্টেন রায় অবশ্য ভাগ্যবান। ওর গভর্নরের বোতল বা বান্ধবীর রোগ নেই কিন্তু চাকরি করতে গিয়ে অন্য রাজ্যপালদের এসব রোগের কথা জানতে বাকি নেই। রাজভবনের বা সরকারি গাড়িতে নয়, সন্ধ্যার পর প্রাইভেট গাড়িতে লাটসাহেব যান বান্ধবী সন্দর্শনে। ব্যবস্থা করতে হয় এ-ডি-সি-কেই। সবাইকে বলতে হয়, আই অ্যাম সরি স্যার, হিজ একসেলেন্সি ইজ নট ওয়েল।

রমজানের কাছে ডায়না-ডরোথির কাহিনি শুনতে ভালো লাগে কিন্তু চমক লাগে না ক্যাপ্টেন কমল রায়ের। তখনকার মতো এখনও সন্ধ্যার পর চোখের দৃষ্টিটা রঙিন হয়, রক্ত একটু বেশি দ্রুত চলাচল করে, নিশ্বাসে আগুনের হলকা ভেসে আসে।

মারাঠা রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন মিশ্র যখন আসাম গভর্নরের এ-ডি-সি ছিলেন, তখন তার কাছে কত কি শুনত! ঘন ঘন কলকাতা থাকতেন লাটসাহেব আর ক্যাপ্টেন রায়কেই তো খবর দিতে হতো মিসেস সরকারকে।

.

বত্রিশ বছর দেশ সেবার পর ট্যান্ডন সাহেব যেদিন রিটায়ার করলেন, সেইদিন সন্ধ্যাবেলাতেই রাষ্ট্রপতি ভবনের ইস্তাহারে তার পুরস্কার ঘোষণা করা হল।…দি প্রেসিডেন্ট ইজ প্লিজড টু অ্যাপয়েন্ট…। ট্যান্ডন সাহেব আসামের গভর্নর হলেন। প্রেসিডেন্ট একটুও খুশি হননি তার। অ্যাপয়েন্টমেন্টে। সরকারি অফিসে বড় বড় অফিসারদের পৌষ মাস খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ট্যান্ডন সাহেবের এমন দুর্দিনে তাকে রাষ্ট্রপতির সেক্রেটারি করার প্রস্তাব করা হয়। প্রেসিডেন্ট নিজে ফাইলের উপর মন্তব্য লিখেছেন, এনি ওয়ান বার্ট মিঃ ট্যান্ডন! সেই ট্যান্ডনকে প্রেসিডেন্ট ইজ প্লিজড় টু অ্যাপয়েন্ট…।

দশ চক্রে ভগবান ভূত! ক্ষেত্র বিশেষে ও প্রয়োজন মতো অপ্রিয় অফিসারদের প্রমোশন দিয়ে দিল্লী থেকে বিতাড়ন করা হয়। ট্যান্ডন এমনি একজন অপ্রিয়-ভাগ্যবান। বত্রিশ বছর সরকারি চাকরি করতে গিয়ে কি না করেছেন?

আমাদের দেশে বিদ্যাসাগর-বিবেকানন্দের জীবনী ছাপা হয়। কিন্তু যদি এইসব দেশপ্রেমিক একসেলেন্সিদের জীবনী ছাপা হতো, তাহলে উপন্যাস লেখার প্রয়োজন হতো না। লিখলেও বিক্রি হতো না। মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব এক হাতে পবিত্র কোরাণ অন্য হাতে ধারালো ছোরা নিয়ে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন বলে আজও তার নিন্দা ছাপা হচ্ছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। কিন্তু যেসব বেইমান মীরজাফরের দল এন্ডারসন বা ডায়ারে কৃপালাভ করার জন্য নিরস্ত্র মানুষের উপর গুলি চালিয়েছে, কিশোর-কিশোরীদের ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়েছে, তাদের নিন্দা কোনো ইতিহাসের পাতায় লেখা হল না। লেখা হল না আরো কিছু…।

পুরোদমে তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে। গ্রামের চাষীদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে সৈন্যদের খাওয়াবার ব্যবস্থা হল। দেশের লোকদের মুষ্টিভিক্ষা দেবার জন্য চালু হল রেশনিং। পেটের ক্ষুধা, দেহে লজ্জা নিবারণের জন্য যা যা প্রয়োজন, তার সব কিছুই রেশনিং-এর আওতায় এল। এক মুষ্টি অন্নের জন্য, এক টুকরো কাপড়ের জন্য দেশের কোটি কোটি মানুষ হাহাকার করে উঠল।

দেশের মানুষের এই সর্বনাশের দিনেই ট্যান্ডন সাহেবের পৌষ মাস ছিল। ট্যান্ডন হলে ডেপুটি কন্ট্রোলার জেনারেল অফ রেশনিং। গাল ভরা নাম হলেও আন্ডার সেক্রেটারির চাকরি আর কি! ইংরেজ কোনো গোলমালকেই বিশ্বাস করত না। ডিফেন্স বা হোম ডিপার্টমেন্টে যে দুচারজন ইন্ডিয়ান অফিসার ছিলেন, তাদের কাউকেই কোনো গুরুত্বপূর্ণ বা গোপনীয় কাজের ভার দেওয়া। হতো না। আর যাদের দায়-দায়িত্ব দেওয়া হতো না, তারা পেতেন গাল ভরা নামে পোস্ট! ডেপুটি কন্ট্রোলার জেনারেল অফ রেশনিং ছিল এমনি এক পদ! দায়-দায়িত্ব বিশেষ না থাকলেও কয়েক হাজার লোকের অস্থায়ী চাকরি নেবার মালিক ছিলেন ট্যান্ডন সাহেব এবং সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে কার্পণ্য করেননি তিনি।

চাকরির উমেদারী করতে আসার সময়ই কাপুর স্ত্রী কমলাকে নিয়ে এসেছিলেন ট্যান্ডন সাহেবের কাছে।

সাব ছোটা সে এক নোকরি দে দিজিয়ে। বড়ই বিপদে পড়েছি।

চাকরি-বাকরি নেই তো বিয়ে করলে কেন?

কাপুর আর কমলা মাথা হেঁট করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

এক গাদা বাচ্চা-কাচ্চাও হয়েছে নিশ্চয়ই?

কমলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। কাপুর চাপা গলায় জবাব দেয়, না সাহেব, এখনও বাচ্চা-কাচ্চা হয়নি।

লোদি রোডের বাংলোর বারান্দার দু-চারবার পায়চারি করে ট্যান্ডন সাহেব বললেন, চাকরি তো টেম্পোরারি।

তাতেই রাজি স্যার।

ঠোঁটটা কামড়ে এক ঝলক বিদ্যুৎ দৃষ্টি দিয়ে কমলাকে দেখে বললেন, রেশনিং-এর চাকরিতে তো কেবল বাইরে বাইরে ঘুরতে হবে। তারপর একটু চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, অবশ্য তাতে অ্যালাউন্স পাবে।…

হাঁ সাব তাতে অসুবিধা হবে না।

তোমার ফ্যামিলিকে কে দেখাশুনা করবে?

কাপুর শুধু চাকরিই পেল না, তিন মাসের মধ্যে পারচেজ ইন্সপেক্টর হল। সরকারের চাল-আটা কিনতে ঘুরে বেড়াত নানা দেশ। সরকারি অ্যালাউন্স ছাড়াও উপরি-পাওনাও আসতে লাগল দু-পকেট ভরে।

ট্যান্ডন সাহেব প্রথমে সপ্তাহে একদিন, তারপর দুদিন, তারপর রোজ সন্ধ্যায় বেঙ্গলি মার্কেটের ফ্ল্যাটে গিয়ে কমলার দেখাশুনা শুরু করলেন। আরো কতজনকে দেখাশুনা করতেন কে জানে? কেউ টু শব্দটি করতে পর্যন্ত সাহস করত না। টেম্পোরারি চাকরি। মুহূর্তের মধ্যে তাসের ঘর লুটিয়ে পড়বে।

ফুড ডিপার্টমেন্টের পুরনো কর্মচারীরা জানলেও এসব কাহিনি ক্যাপ্টেন রায় জানেন না। তবে হিজ একসেলেন্সি ট্যান্ডন কলকাতা এসে সন্ধ্যার অন্ধকারে ছোট্ট প্রাইভেট গাড়ি চড়ে বেহালায় মিসেস সরকারের কাছে রোজ ডিনার খেতে যেতেন, তা তো জানেন।

.

উর্দুতে একটা কথা আছে, আই-ই তো ঈদ, নেহি তো রোজা। জুটল তো ভুরিভোজন, নয়তো অনশন। কথাটা বার বার মনে পড়ছিল ক্যাপ্টেন রায়ের।

সেদিন সকালে লাট সাহেবের কোনো ভিজিটার্স ছিলেন না। আগের দিন রাত্রি দশটা পর্যন্ত কুমারী পদ্মাবতীর নাচ দেখে এসে কি পরের দিন সকালে কাজ করা যায়? লাটসাহেব তো আর রাইটার্স বিভিং-এর লোয়ার ডিভিশন কেরানী নন। সরকারি বা বেসরকারি ডিনার অথবা অন্য কোনো প্রোগ্রামের জন্য রাত্রি নটা সাড়ে নটা পর্যন্ত লাটসাহেব এনগেজড থাকলে পরের দিন সকালে কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকে না। সরকারি প্রোগ্রাম থাকলে অবশ্য আলাদা কথা। পাঁচ হাজার টাকার চাকরির জন্য যদি ভোরে উঠে গান্ধী ঘাটে মালা দিতে হয় বা দমদম এয়ারপোর্টে অজ্ঞাত অপরিচিতিকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে অভ্যর্থনা জানাতে হয় তো সে আলাদা কথা। অন্যথায় ছাপানো এনগেজমেন্টের কাগজে চব্বিশ পয়েন্টের মোটা মোটা হরফে লেখা থাকবে নো এনগেজমেন্ট ইন দি মর্নিং।

সাধারণত রাজভবনের অফিসাররাও জরুরি কাজ না থাকলে ওই সময় লাটসাহেবকে বিরক্ত করেন না। সকালে তাই ক্যাপ্টেন রায় সোজা এসেছেন নিজের অফিসে। কিছু কাজকর্ম ছিল। কিন্তু ঠিক মন বসল না। পাশের জানালা দিয়ে চেয়ে রইলেন দূরের নীল আকাশের দিকে।

ক্যাপ্টেন একটা সিগারেট ধরালেন। আপন মনে ভাবছিলেন গত রাত্রের কথা। ক্যাপ্টেন ট্রাই দিস ফাস্ট দিস ইজ কোলেটা পোজারস্কী।

আই-ই-তো ঈদ, নেহি তো রোজা।

এলাহাবাদ ইস্টার কলেজে পড়বার সময় কথাটা শিখেছিল মাথুরের কাছ থেকে।…সতীর্থ অশোক বাজপেয়ী আবার নতুন করে ভালোবাসল চন্দ্রাবলীকে। সিভিল লাইল-এর নির্জন পথে ঘন ঘন দেখা গেল দুজনকে। ক্লাস ফাঁকি সাইকেল নিয়ে যমজবাগের দিকে উধাও হবার খবরও শোনা যেত মাঝে মাঝেই। অভয়া, গার্গী, ডলিদের নিয়ে যা হতো, চন্দ্রাবলীকে নিয়ে অশোক শুধু তার পুনরাবৃত্তি করছিল। নতুন কিছু নয়।

ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা, ছাত্রীদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা গেল। রাগে দুঃখে, হিংসায় অনেক ছেলেমেয়েই অস্থির হয়ে উঠল। উত্তেজনা অস্থিরতা যখন চরমে, তখন মাথুর বলেছিল, এই তো দুনিয়া! আ-ই তো ঈদ, নেহী তো রোজা।

হাসতে হাসতে মাথুর বলেছিল, অশোকের ঈদ, আমাদের রোজা!

ইস্টার কলেজের দিনগুলো বহুদূরে চলে গেছে। বহুদিন পর এ-ডি-সি-র চাকরি করতে এসে ক্যাপ্টেন রায়ের বড় বেশি মনে পড়ছে মাথুরের কথা, আই-ই তো ঈদ…

অ্যান্ডারসন, বারোজ বা লর্ড কেসি যখন বাংলার লাট ছিলেন, তখন আই-সি-এস, আই-পি-এস ছাড়া কিছু রায়-সাহেব খান-সাহেব-রায়-বাহাদুর-খান-বাহাদুরের দল সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেতেন। দেশ স্বাধীন হবার পর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার নিয়মও পাল্টে গেল। শুধু বাংলায় নয়, সারা দেশেই। সরকারি পৃষ্ঠপোশকতার জোয়ার ভাটা হতো। কখনও কুমিল্লা, কখনও শ্রীরামপুর! কখনও বরিশাল, কখনও বাঁকুড়া! কখনও ব্রাহ্মণ, কখনও বদ্যি। মাদ্রাজে ব্রাহ্মণ-নাদার, অন্ধে, কামারেড্ডি, পাঞ্জাবে পাঠান-সর্দার-জাঠ। উত্তরপ্রদেশে ব্রাহ্মণ-কায়স্থ। ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের বাংলাদেশে যখন নন্-ম্যাট্রিকুলেট নেতাদের রাজত্বে ঘোর কলিকাল চলছে, তখন যে কজন ব্যর্থ কেরানী রেসের ঘোড়ার মতো একলাফে অফিসার হয়েছিলেন, রাজ্যপালের স্পেশাল সেক্রেটারি মিঃ সরকার তাদের অন্যতম। যে সরকার ধুতি-পাঞ্জাবি পরে গ্যালিফ স্ট্রিটের ট্রামে চড়ে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ফুড ডিপার্টমেন্টের তিন তলার কোণার হল ঘরের হাতল ভাঙা চেয়ারে বসতেন, তিনি হঠাৎ থ্রি পিস স্যুট করে সত্যমেব জয়তে মার্কা গাড়িতে ঘোরা-ঘুরি শুরু করলেন।

ক্যাপ্টেন রায়ের এসব জানার নয়। তবে খটকা লেগেছিল রাজভবনের ক্লার্কদের কথাবার্তা শুনে। মিঃ সরকারকে ওরা সবাই সরকার মশাই বলতেন। এবার গভর্নরের সঙ্গে জলপাইগুড়ি ট্যুরে গিয়ে ডেপুটি কমিশনারের কাছে সরকারের ইতিহাস জানতে পারেন। .ইউ নো ক্যাপ্টেন রয়, দিস ফেলো ওয়াজ এ ক্লার্ক আন্ডার মি।

সেই সরকার আজ শেরওয়ানি-চুড়িদার পরে, গভর্নরের বি টিম। মালেশিয়া পার্লামেন্টারি ডেলিগেশনের সদস্যরা তো সরকারকেই ইওর একসেলেন্সি বলে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন।

এক্সকিউজ মি স্যার! আই অ্যাম স্পেশাল সেক্রেটারি টু হিজ একসেলেন্সি…

ডেলিগেশনের নেতা হাসতে হাসতে মন্তব্য করেছিলেন, বাট ইউ লুক লাইক এ গভর্নর।

সেই সরকার সাহেবের মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে গত রাত্রে ডিনার খেয়েছেন ক্যাপ্টেন রায়। লক্ষ লক্ষ সরকারি কর্মচারী জীবন ভোর রোজা পালন করা যেমন সত্য, স্পেশাল অফিসার-স্পেশাল সেক্রেটারিদের ঈদটাও তেমনি সত্য।

রাজভবনের হেড কুক পেরেরা সাহেবের খানা এ-ডি-সি-দের অপরিচিত নয় কিন্তু তবুও সরকার সাহেব বার বার বললেন, সুড আই গিভ ইউ অ্যানাদার কোলেটা পোজারস্কি? রাশিয়ান অন্যান্য খাবারের চাইতে এই চিকেন কাটলেটটা আমার সব চাইতে ভালো লাগে।

না, না, থ্যাঙ্ক ইউ! অলরেডি অনেক খেয়েছি…

ইউ মাস্ট হ্যাঁভ এনাদার! এসব কোনো হোটেল রেস্তোরাঁয় পাবেন না। আমার স্ত্রী নিজে হাতে…

কোথায় শিখলেন?

সী লানটি ইট ফ্রম রাশিয়ানস হু কেম উইথ ক্রুশ্চেভ অ্যান্ড বুলগানিন।

আই সী! একটা দিন!

ক্যাপ্টেন মনে মনে পেরেরাকে ধন্যবাদ জানায়।

.

প্রাইম মিনিস্টার, হোম মিনিস্টার বা অন্যান্য রাজ্যের গভর্নর ছাড়াও বহু অতিথির আগমন হয় রাজভবনে। প্রেসিডেন্ট বা প্রাইম মিনিস্টারের মতো ভি-আই-পি-দের সিকিউরিটির জন্য, নিরাপত্তার জন্য রাজভবনের থাকতেই হয়? এদের পক্ষে অন্যত্র থাকা নাকি নিরাপদ নয়।

ভারতবর্ষের মতো সিকিউরিটির কদর্যতা আর কোথাও দেখা যাবে না। নিজের দেশের মানুষকে এমন ভাবে দূরে বহুদূরে রাখার নজির আর কোনো দেশে নেই। লর্ড ওয়েলেসলি, স্যার জন অ্যান্ডারসনই আমাদের পূর্বসুরী থেকে গেলেন। স্যার জন অ্যান্ডারসন প্রতিটি ভারতবাসীকে সন্দেহের চোখে দেখতেন; মনে করতেন প্রতি ভারতবাসীর পকেটেই টাইম বোমা থাকে। সরকারি গোলামের দল কনস্টেবল সাবইনসপেক্টরদের বিশ্বাস করবেন কিন্তু হেডমাস্টার-প্রফেসর ভাইস চ্যান্সেলারকেও ঠিক সন্দেহের ঊর্ধ্বে মনে করতে পারেন না।

আর্মিতে সিকিউরিটি হচ্ছে মূলমন্ত্র। দেশরক্ষার জন্য গোপনে কত কি করতে হয়। একজন সুবেদার বিশ্বাসঘাতকতা করলে দেশের কি ভীষণ সর্বনাশ হতে পারে কিন্তু সেখানেও মানুষকে এমনভাবে ঘৃণা অবিশ্বাস করা হয় না।

রাজভবনের ভি-আই-পি সিকিউরিটির ব্যবস্থা দেখে ক্যাপ্টেন রায় স্তম্ভিত হন। অজ্ঞাত জুজুর ভয়ে এদের কাণ্ডকারখানা দেখে হাসিও পায়।

পাবে না?

ওই বিরাট লোহার ফটকের ওপাশ থেকে যারা রাজভবনকে দেখে, বর্শা হাতে নিয়ে ঘোড়-সওয়ার পুলিশ দেখে যারা শুধু মজা পায়, তারা না হয় সব কিছু জানে না, জানতে পারে না। যারা কালে কস্মিনে রাজভবনে আসেন বা মার্বেল হলে কাউন্সিল চেম্বারে ভি-ভি-আই-পি দর্শনের পরম সৌভাগ্যলাভ করেন, তারাও হয়তো সবাইকে চিনতে পারেন না। কিন্তু এ-ডি-সি তো সবাইকে চেনেন, জানেন। সবকিছুই দেখেন।

গেটের বাইরে দুচারটে বেতার গাড়ি, দুচার লরি বোঝাই সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী। ভিতরে? ভিতরে প্রতি পদক্ষেপে ভি-ভি-আই-পি-দের অভিভাবকের দল। বাছাই করা অভিভাবকের দল। রাজভবনের বারান্দায় লিফট-এর পাশে, প্রিন্স অফ ওয়েলস স্যুইটের মুখে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারদের অমন করে চৌকিদার দারোয়ানী করতে দেখে ক্যাপ্টেন রায় না হেসে পারেন না। রাজভবনের বাইরে থেকে কামানের গোলা ছুঁড়লেও যেখানে পৌঁছাবে না, সেখানেও এই সতর্কতা? নাকি মেন গেটের সশস্ত্র বাহিনীকে পরাস্ত করে যদি কোনো অবিমৃষ্যকারী ঢুকে পড়ে ভিতরে?

এসব ভি-ভি-আই-পি এলে রাজভবনের সমস্ত কর্মচারীদের প্রাণান্তকর অবস্থা হয়। সমস্ত কাজকর্ম জীবনযাত্রা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। ঠিক কাজের চাপ, দায়িত্বের বোঝ যে খুব বেশি থাকে তা নয়। অধিকাংশ সময়েই অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় অথবা খিদমদগার হয়ে। দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। গভর্নরের সেক্রেটারি, স্পেশাল সেক্রেটারি, ডেপুটি সেক্রেটারি, এ-ডি-সি থেকে বেয়ারা-চাপরাশিদের ওই একই অবস্থা। মনে মনে বিরক্তবোধ করে সবাই, মুখে প্রকাশ করে না কেউই। বিদেশি ভি-আই-পি এলে বেয়ারা-চাপরাশিদের অদৃষ্টে কিছু প্রাপ্তিযোগ ঘটে। আর ইন্ডিয়ান ভি-আই-পি এলে প্রাইভেট সেক্রেটারির বাথ টাওয়েলের হিসাব মেলার জন্য মাইনে থেকে খেসারত দিতে হয়।

সহিদাদুল্লা তো স্পষ্টই বলে, আরে ছোড়িয়ে সাব-। বড়া মিনিস্টার বা লাটসাব হলেই দিল বড় হয় না। আমরা গরিব হতে পারি কিন্তু বাথরুম থেকে তোয়ালে বা ড্রইংরুম থেকে বই নিয়ে চলে যাব না।

গঙ্গা সিং বলেছিল, কি আর বলব সাহেব? কিছু কিছু সাহেব আছেন যারা ডিনারের ফলমূল পর্যন্ত নিয়ে যেতে দ্বিধা করেন না।

অবাক হয়ে ক্যাপ্টেন রায় বলেছিলেন, কি বলছ?

বিশ্বাস না হয় হেড ক্লার্কবাবুকে জিজ্ঞাসা করবেন। ওর কাছে আরো অনেক কিছু জানতে পারবেন।

এসব নোংরামি ঘাঁটাঘাঁটি করতে ক্যাপ্টেন রায় উৎসাহবোধ করেন না। হেডক্লার্ক মজুমদার বাবুকে তিনি কিছুই জিজ্ঞাসা করেননি তবুও কানে ভেসে এসেছে অনেক কাহিনি।

ভি-আই-পি-দের নামে স্পেশাল সেক্রেটারি বা ডেপুটি সেক্রেটারিরও উপরি পাওনা নেহাত মন্দ হয় না। ফরেন ভি আই পি এলে প্রতিটি গেস্টের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয় ইমপোর্টেড ওয়াইন বা অ্যালকোহলের বোতল। সবাই মদ খান না; খেলেও এক বোতল কেউই খান না, খেতে পারেন না। পরের দিন সকালে পুরুত ঠাকুর ডেপুটি-স্পেশাল সেক্রেটারির বাড়িতে পৌঁছে যায় এই বোতল বোতল নৈবেদ্য। সীল ভাঙা বোতল তো আর কোনো গেস্টকে দেওয়া যায় না।

ক্যাপ্টেন রায় এসব জানতেন না। একবার আমজাদ আলি এক বোতল স্কচ পৌঁছে দেয় ওর ঘরে। হঠাৎ এক বোতল স্কচ পেয়ে মনটা আনন্দিত হলেও বিস্মিত হয়েছিলেন।

কি ব্যাপার? স্কচের বোতল?

জি হ্যাঁ সাব। এটা আপনার।

বোতলটা হাতে নিয়ে নাড়া চাড়া করতে করতে এ-ডি-সি সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, টাকা দিতে হবে না?

নেহি সাব। টাকা পয়সা দিতে হবে না।

গভর্নর সাব পাঠিয়েছেন?

এবার আমজাদ হেসে ফেলে, না সাব লাটসাব কি শরাব পাঠাতে পারেন?

তবে?

আমজাদ আর চেপে রাখতে পারেনি। গড় গড় করে সব বলেছিল।

বোতলটা ফেরত দিয়ে সাহেবকে আমার সেলাম দিও।

পরে একদিন আমজাদকে বলেছিলেন, একটু আধটু ড্রিংক করি বটে তবে বিনা পয়সায় নয়। আর্মি অফিসারদের কাছে মদ জোগাড় করা খুব কঠিন কাজ নয়। দরকার হলে আমি ফোর্ট উইলিয়াম ক্যান্টিন থেকেই আনতে পারব।

ওই ঘোড়ার আস্তাবল বা মোটর গ্যারেজের উপরে যে অফিসারগুলো থাকে, তাদের মনোবৃত্তি যে কেমন বিচিত্র হয়!

যাকগে ওসব। রাজভবনে তো শুধু ভি-ভি-আই-পি-রাই থাকেন না, আরো অনেকে থাকেন। এখানে এক অতিথির আগমন হয়েছিল বলেই তো মণিকার সঙ্গে ক্যাপ্টেন রায়ের প্রথম আলাপ হয়।

ক্যাপ্টেন কমল রায়ের মানসী, মণিমালা মণিকা ব্যানার্জি।

…রেঙ্গুন ইউনিভার্সিটির রেক্টর উ মঙ এলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ভাষণ দিতে। বার্মার সঙ্গে ভারতের বিশেষ সম্পর্কের কথা বিবেচনা করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে রাস্ত্রীয় অতিথি হবার সাদর আমন্ত্রণ জানান। উ ম সানন্দে সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তারপর মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ মতো পশ্চিমবাংলার গভর্নর তাকে তিনদিনের জন্য শক্তিগত অতিথি হবার অনুরোধ জানান।

এসব ক্যাপ্টেন রায় জানতেন। উ মঙকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে গিয়েছিলেন ওর সহকর্মী। পরের দিন সকালে গভর্নরের সঙ্গে উ মঙের সৌজন্য সাক্ষাৎকার করার দায়িত্ব ছিল ক্যাপ্টেন রায়ের। যেসব অতিথিদের সঙ্গে প্রাইভেট সেক্রেটারি থাকেন না, তাদের এনগেজমেন্ট প্রোগ্রাম সম্পর্কে এ-ডি-সিদের একটু খেয়াল রাখতে হয়।

আমজাদের ব্রেকফাস্ট খেয়ে, সিঁড়ির মুখে লর্ড ওয়েলেসলীর পেন্টিং-এর সামনে থমকে দাঁড়িয়ে ভক্তি জানিয়ে ক্যাপ্টেন রায় ঠিক আটটায় গভর্নরকে সেলাম জানাতে গেলেন।

প্লিজ লুকআফটার প্রফেসর মঙ। হাজার হোক বৃদ্ধ মানুষ, তারপর সাহায্য করার কেউ নেই।

মাথা নিচু করে এ-ডি-সি জানান, সার্টেনলি স্যার।

ইফ দেয়ার ইজ নো আদার সিরিয়াস ওয়ার্ক তাহলে এই তিনদিন তুমি ওর সঙ্গে সঙ্গে একটু থেকো।

পারফেক্টলি অল রাইট, স্যার! আমি তিনদিনই ওর সঙ্গে থাকব।

গভর্নরের প্রস্তাবে ক্যাপ্টেন খুশিই হন! এসব গেস্টদের দেখাশুনা করতে কোনো ঝামেলা নেই। গভর্নরের সঙ্গে ওর দেখা করার কথা পৌনে নটায়! তবুও সওয়া আটটা বাজতে না বাজতেই ক্যাপ্টেন রায় প্রফেসর মঙের দরজায় নক করলেন।

মিনিট খানেক পরে যিনি দরজা খুলে দিলেন, ঠিক মহিলাও নন, একজন যুবতী। সাধারণ ভারতীয় মেয়েদের মতো শাড়ি পরা মেয়ে। দেখে অধ্যাপক মঙের স্ত্রী বা মেয়ে বলেও মনে হল না।

তবে?

মনের দ্বিধা মনেই রাখলাম! গুডমর্নিং।

আই অ্যাম ক্যাপ্টেন রয়, এ-ডিসি টু দ্য গভর্নর।

বিচিত্র ঔৎসুক্যভরা সলজ্জ দৃষ্টি দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে এ-ডি-সি-কে দেখে নেবার পর উনি বলেছিলেন, গুডমর্নিং!

তারপর মিষ্টি গলায় শুদ্ধ বাংলায়, আসুন ভিতরে আসুন।

বাচালতা, চপলতা এ-ডি-সি-র জন্য নয়। মুখে কিছু বলেননি ক্যাপ্টেন রায়। তবে মুচকি হেসে ভালো করে একবার দেখেছিলেন তার ভবিষ্যৎ জীবন-সম্রাজ্ঞীকে।

সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ অধ্যাপক বড় কৌচের একপাশে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন।

এক্সকিউজ মি স্যার, আমি গভর্নরের এ-ডি-সি ক্যাপ্টেন রয়।

কাম অন অফিসার, এদিকে বসো।

সম্মানিত অতিথিদের পাশে বসার বাধা না থাকলেও চলন নেই। ক্যাপ্টেন রায় সঙ্কোচের সঙ্গে সকৃতজ্ঞ হয়ে ধন্যবাদ জানালেন, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার!

মণিকার বেশ লাগছিল। কথায় কথায় থ্যাঙ্ক ইউ।

গোল গোল রূপোর ফ্রেমের মধ্য দিয়ে বৃদ্ধও একটু সকৌতুক দৃষ্টি দিয়ে দেখে নিলেন ক্যাপ্টেন রায়কে।

.

তিনটি দিন বেশ কেটেছিল। ক্যাপ্টেন রায়ের স্মৃতিতে অমর অক্ষয় হয়ে রয়েছে ওই তিনটি অবিস্মরণীয় দিনের কথা, কাহিনি।

অধ্যাপক মঙ যখন রেঙ্গুনে ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলার, মণিকার বাবা ডক্টর ব্যানার্জি তখন ওখানে ভিজিটিং প্রফেসর হয়েছিলেন দুবছরের জন্য। মণিকা তখন ভিক্টোরিয়াতে বি-এ পড়ে। একমাত্র সন্তান হয়েও বাবা-মার সঙ্গে রেঙ্গুনে যেতে পারেনি। হোস্টেলেই থাকত। ছুটিতে রেঙ্গুনে যেতো।

অধ্যাপক মঙ মণিকাকে বলতেন, মাই সুইট লিটল মাদার।

পরে এই বৃদ্ধের আগ্রহেই মণিকা রেঙ্গুনে এম-এ পড়ে।

অধ্যাপক ডক্টর ব্যানার্জিকে আরো দুবছর রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে রেখেছিলেন শুধু মণিকার জন্য। এম-এ পাশ করার পর সবাই চলে এলেন কলকাতা।

ব্যানার্জি পরিবার কলকাতা চলে এলেও ভুলতে পারলেন না স্নেহাতুর বৃদ্ধ অধ্যাপক মঙকে। আর মণিকা? সে তো সারা জীবনেও ভুলতে পারবে না তার এই বৃদ্ধ সন্তানকে। বিপত্নীক অধ্যাপক মঙের একমাত্র পুত্র-উ থান একেবারে উত্তরে কাচিনে হীরার কারখানায় কাজ করত। বছরে একবারের বেশি ছুটি পেত না। পুরনো দুটি কর্মচারী ছাড়া বৃদ্ধকে দেখার কেউ ছিল না। মণিকা মনে মনে বড় দুঃখ পেত বৃদ্ধের কথা ভেবে। তাইতো বড় বেশি জড়িয়ে পড়েছিল বৃদ্ধের সঙ্গে।

বিকালবেলায় দুজনে মিলে বেড়াতে যেতেন। কোনোদিন গোল্ডেন প্যাগোডায় বা ইনিয়া লেকের ধারে। অথবা অন্য কোথাও। কত কথা হতো দুজনের।

আচ্ছা আংকেল, আপনার ছেলের বিয়ে দিচ্ছেন না কেন?

মণিকা জানতে চাইতো।

বৃদ্ধ হাসতে হাসতে জবাব দেন, ঠিক বলেছ মা। একবার একটি মেয়ে পছন্দও হয়েছিল কিন্তু মেয়েটির জন্মবার নিয়েই গণ্ডগোল হল।

অবাক হয় মণিকা, তার মানে?

বুঝলে তোমাদের মতো আমাদের বিয়েরও কতকগুলো নিয়ম-কানুন আছে। ছেলেমেয়ের জন্মবার এক হলে আমাদের বিয়ে হয় না।

তাই নাকি?

থানানের জন্ম সোমবার। মেয়েটিও সোমবারে জন্মেছে। তাই…

আরো তো মেয়ে আছে।

নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ একটা চাপা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন, আছে বৈকি মা। তবে বিয়ে-টিয়ে কি চটপট হবার জিনিস?

মণিকা তবুও থামে না। কিন্তু আপনি কতকাল এমনি একলা একলা কাটাবেন?

ইনিয়া লেকের জলে হয়তো মুহূর্তের জন্য নিজের অদৃষ্টের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান। সব মেয়েই যে তোমার মতো আমার কথা ভাববে তার কি মনে আছে?

না, না, ওকি কথা বলছেন? তাছাড়া নাতি-নাতনি তো আপনার কাছে থাকতে পারবে।

অত শত আমি আশা করি না। নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ নিরাশক্তের মতো জবাব দেন।

গোন্ডেন প্যাগোডার ধারে বেড়াতে বেড়াতে কোনো কোনোদিন বৃদ্ধ বলেন, তার চাইতে তুমি বিয়ে কর। আমি কলকাতায় তোমার কাছেই থাকব আর মাঝে মাঝে একটু বোদ্ধগয়া ঘুরে আসব।

বৃদ্ধের সঙ্গে মণিকার সম্পর্কই আলাদা। আমার স্বামী যদি খারাপ হয়?

মণিকার মাথায় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মঙ বললেন, এই বুঝি দুষ্টুমি শুরু হল?

এই অধ্যাপক মঙ আর মণিকাকে নিয়ে তিনটি দিন ক্যাপ্টেন রায়ের বড় আনন্দে কেটেছিল।

ক্যাপ্টেন, ইউ উইল নেভার ফাইন্ড এ বেটার গার্ল দ্যান মণিকা। বৃদ্ধ যেন একটু গর্ব অনুভব করেন মণিকার কথা বলতে। আত্ম তৃপ্তিভরা হাসি মুখে একবার মণিকাকে দেখে নিয়ে বলেন, লেখাপড়ায় যদি আর একটু ভালো হতো…

মণিকা সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছিল বলে বুড়োর মনে বড় দুঃখ।

…গান বাজনা আর সংসারের প্রতি এত আকর্ষণ হলে কি লেখাপড়া হয়?

বৃদ্ধ প্রশ্ন করেন ক্যাপ্টেন রায়কে।

ক্যাপ্টেন রায় এ প্রশ্নের কি জবাব দেবে? কথার মোড় ঘোরাবার জন্য মণিকার দিকে ফিরে বলে, একদিন গান শোনাবেন তো?

বৃদ্ধ গর্জে ওঠেন, হোয়াট ডু ইউ মিন বাই শোনাবেন তো? আজ ইভনিং…এ-ই এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে ফিরে এলে গান হবে।

পাশের কৌচে মুখ নিচু করে বসে থাকে মণিকা।

বৃদ্ধের প্রস্তাবে খুশি হয় ক্যাপ্টেন রায়, খুব ভালো হবে।

বাট…। বৃদ্ধ যেন কোথায় খটকা বোধ করলেন।

ক্যাপ্টেন আর মণিকা একসঙ্গেই বৃদ্ধের দিকে তাকায়।

তোমাদের এই রাজভবনে ঠিক জমবে না। তার চাইতে অন্য কোথাও…

এশিয়াটিক সোসাইটিতে অধ্যাপক মঙের সম্বর্ধনা সভা শেষ হবার পর সন্ধ্যার অন্ধকারে তিনজনে চলে গিয়েছিল শহর থেকে দূরে।

বৃদ্ধ বলেছিলেন, শুরু কর মা, সময় নষ্ট করো না।

মণিকা জানতে চাইল, শুধু গীতাঞ্জলির গান?

একশো বার!

একের পর এক গান শুনিয়েছিল মণিকা।

গান শুনতে শুনতে বিভোর হয়েছিলেন অধ্যাপক মঙ। বেশ কিছুক্ষণ পরে সম্বিত ফিরে এলে বললেন, ওনলি এ সঙ, ফিলসফার লাইক টেগোর ক্যান রাইট দিস। এমন করে আত্মসমর্পণ আর কে করতে পারে?

কলকাতা ফেরার পথে অধ্যাপক এ-ডি-সি-কে বলেছিলেন, শুধু গভর্নমেন্ট হাউসের মধ্যে নিজেকে বন্দী করে রেখো না। মাঝে মাঝে আমার মায়ের কাছে গিয়ে গান শুনে এসো।

এক ঝলক মণিকাকে দেখে নিয়ে ক্যাপ্টেন রায় বলেছিলেন, স্যার আপনি চলে গেলে কি উনি চিনতে পারবেন?

এবার আর মণিকা চুপ করে থাকেনি, বরং আপনিই চিনতে পারবেন না। গভর্নমেন্ট হাউসে থেকে কি আমাদের মতো সাধারণ মেয়েদের মনে রাখা সম্ভব?

তাই নাকি?

অধ্যাপক মঙের কলকাতা ত্যাগের পূর্বসন্ধ্যায় ব্যানার্জিগৃহে ক্যাপ্টেন রায়ের প্রথম পদার্পণ হয়। সে সন্ধ্যায় বাইরের বিশেষ কেউ ছিলেন না। শুধু তরুণ বার্মিজ কলাল জেনারেল এসেছিলেন, সরকারি পদমর্যাদার জন্য নয় ডক্টর ব্যানার্জির ছাত্র হিসেবে। ভাত মাছ তরকারি রান্না করেছিলেন মণিকার মা। মণিকা রান্না করেছিল মঙের প্রিয় মহিঙ্গা।

ক্যাপ্টেন রায় অবাক হয়েছিলেন, আপনি বার্মিজ রান্নাও জানেন?

এই একটু আধটু।

মণিকার মা বললেন, আমি এতদিন রেঙ্গুনে থেকেও শিখতে পারলাম না অথচ মণিকা… খেতে খেতে হঠাৎ থেমে গেলেন অধ্যাপক মঙ, গতজন্মে ও বার্মিজ ছিল।

ক্যাপ্টেন রায় হাসতে হাসতে বলেন, মনে হয় আপনার কথাই ঠিক।

সে রাত্রে বিদায় নেবার সময় ডক্টর আর মিসেস ব্যানার্জি দুজনেই বলেছিলেন, সময় পেলেই চলে এসো।

নিশ্চয়ই।

পরের দিন সকালে অধ্যাপক মঙ বেনারস চলে গেলেন। এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে অনেকেই এসেছিলেন। ডক্টর ব্যানার্জি আর মণিকাও এসেছিল। ডক্টর ব্যানার্জি ভাইস চ্যান্সেলার ডক্টর সেনগুপ্তের সঙ্গে চলে গেলেন। ক্যাপ্টেন রায় মণিকাকে বললেন, যদি আপত্তি না থাকে তো আমার আস্তানায় এক কাপ কফি খেয়ে যান।

রাজভবনের গাড়িতে ক্যাপ্টেন রায় আর মণিকা রওনা হল গভর্নমেন্ট হাউসের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *