০২. মিস বিশ্বাসের কথা

মিস বিশ্বাসের কথা মনে হতেই ক্যাপ্টেন রায় হাসেন। হাসবেন না? সে তো এক মহাভারত! শেষ নেই তার কীর্তির, তার কাহিনির।

অশোকস্তম্ভ মার্কা সিগারেট কেস থেকে অশোকস্তম্ভ আঁকা বিলেতী কোম্পানির একটা সিগারেট বের করলেন। টেবিলের ওপাশ থেকে লাইটারটা টেনে নিয়ে জ্বালতে গিয়ে কি যেন ভাবলেন।

কি আর ভাববেন?

ভাবছিলেন ডায়মণ্ডহারবার রোডের সরকার বাড়ির কথা। আদিনাথ সরকার, দিবানাথ সরকার ও সতীনাথ সরকার। তিন ভাই। তিন রত্ন? মণিমাণিক্য হীরা-জহরত বললেও অত্যুক্তি হবে না। বাংলাদেশের উর্বর জমিতে বিনা কসরতে ধান, পাট আর বিপ্লবী হতে পারে কিন্তু শিল্পপতি হওয়া দুর্লভ ব্যাপার। রাজস্থানের মরুভূমির প্রাণহীন, হৃদয়হীন বীজ, বাংলাদেশের জল হাওয়ায় শুধু বড়বাজারে নয় সর্বত্রই পল্লবিত হয় কিন্তু বাংলার বীজ ডালহৌসী-ক্লাইভ স্ট্রিটে পুঁতলেও কৌনোদিন ফল ধরে না। বিধাতার এই নির্মম রসিকতাকে উপেক্ষা করে যে মুষ্টিমেয় কটি বাঙালি পরিবার লক্ষ্মীর কৃপা লাভ করতে পেরেছেন, সরকার বাড়ি তার অন্যতম।

আদিনাথ তো সাক্ষাৎ দেবতা। চেহারাটা দেখলেই ভক্তি আসে। সেকালের প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। ছাত্রজীবন শেষ করে পিতৃপদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রথমে ক্যানিং স্ট্রিট ও কলেজ স্ট্রিট। পরে মিশন রো। আরো পরে ব্রেবোর্ন রোড। হাজার। লাখ। কোটি। না জানি কত কোটি।

এখন বয়েস হয়েছে। টাকা পয়সা স্পর্শ করলে রামকৃষ্ণের মতো জ্বালা অনুভব না করলেও ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন। এখন সাধুসঙ্গ আর সৎ কাজেই নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। পরলোকগতা স্ত্রী নীহারিকা দেবীর নামে কলকাতার উপকণ্ঠে নীহারিকা মাতৃসেবাসদনে নিত্য কত নারীর সেবা হচ্ছে। কত সহায় সম্বলহীনার শিশু পৃথিবীর প্রথম আলো দেখছে এই মাতৃসেবাসদনে।

সিগারেট জ্বালতে গিয়ে লাইটারটা হাতে নিয়ে এত কথা মনে পড়ার কথা নয়। কিন্তু কি করবে ক্যাপ্টেন রায়? হিজ এসেলেন্সী জগৎপতি বাজপেয়ী পাঁচ পাঁচ বছরের দুটি টার্মে বাংলাদেশের গভর্নর থাকায় এই সরকার বাড়ির সঙ্গে তার নিবিড় যোগাযোগ না হয়ে পারেনি।

ঠাকুরপুকুর ছাড়িয়ে বেশ কিছু এগিয়ে গেলে নীহারিকা মাতৃসেবাসদন। মেটারনিটি আর জেনারেল ওয়ার্ড আগের থেকেই ছিল কিন্তু সার্জিক্যাল ওয়ার্ড না থাকায় বড়ই অসুবিধা হচ্ছিল। চটপট অপারেশন করলে যাদের বাঁচান যেত তারাও পি-জি-তে যাবার পথে অ্যাম্বুলেন্স বা ট্যাক্সিতেই প্রাণ হারাতেন। আদিনাথবাবু মনে মনে বড় কষ্ট পেতেন। বছরের পর বছর নিঃশব্দে এই মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করেছেন। ভাবতেন, হয়তো আশেপাশে সরকারি হাসপাতালে কিছু একটা ব্যবস্থা হবে। বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও কিছু হল না। রাইটার্স বিল্ডিং-এ দরখাস্ত পাঠান হল নানা মহল থেকে। না, তবু অচলায়তন নড়ল না।

এম-এল-এ বিনোদবাবু যখন এসে বললেন, সামনের বছরের বাজেটে ইনকুড করার জন্য কত অনুরোধ করলাম কিন্তু তাও সম্ভব হল না।

অচঞ্চল আদিনাথবাবু বললেন, আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। মার যদি ইচ্ছা থাকে, তবে…

মাস ছয়েক পরে বিনোদবাবুকে সঙ্গে নিয়ে আদিনাথবাবু এলেন রাজভবনে। ক্যাপ্টেন রায় সেদিন ডিউটিতে ছিলেন না। কিন্তু যেদিন সকালে নীহারিকা মাতৃ সেবাসদনের সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের ও অপারেশন থিয়েটারের ওপেনিং করতে গভর্নর গিয়েছিলেন, ক্যাপ্টেন রায় সেদিন ডিউটিতে ছিলেন।

সরকার বাড়ির সঙ্গে সেই তার প্রথম পরিচয়।

তারপর গত দশ বছরে কত শত অনুষ্ঠানে কত শতবার দেখা হয়েছে দিবানাথ ও সতীনাথ সরকারের সঙ্গে। শুধু দেখা সাক্ষাৎ আলাপ-পরিচয় নয় সতীনাথের সঙ্গে আজ তাঁর গভীর

এই সতীনাথই দিয়েছিল লাইটারটা। রনসনের বেস্ট কোয়ালিটি। আঙুল দেবার আগেই যেন জ্বলে ওঠে। সে আগুন বাড়ান যায়, কমান যায়। কখনো দপ করে জ্বলে, কখনও ধীরে ধীরে জ্বলে। দিনের আলোয় সে আগুনের শিখা নজরে পড়ে না অপরিচিতের চোখে।

লাইটারটা নিয়ে আরো একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার পর ক্যাপ্টেন রায় সিগারেট ধরালেন। এক গাল ধোঁয়া ছাড়লেন।

আবার নজর পড়ল লাইটারটার উপর। আপন মনেই মুচকি হাসল। এতো লাইটার নয়, যেন সতীনাথ সরকারের জীবন্ত প্রতিমূর্তি। চক্ চল্ ঝক ঝক করছে উপরটা। দেখে বুঝা যায় না, একটা আগ্নেয়গিরি। কল্পনা করা যায় না, এর ভেতর এত আগুন লুকিয়ে আছে। রনসন লাইটারের মতো সে আগুন দিনের আলোয় মিশে যায় কিন্তু সন্ধ্যার পর ফ্রি স্কুল স্ট্রিট আর পার্ক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটগুলোতে আলো জ্বলে উঠলে…

হঠাৎ ঘড়ির দিকে নজর পড়তেই সতীনাথের চিন্তা কোথায় লুকিয়ে পড়ল। এনগেজমেন্ট ডায়েরির দিকে তাকাতে না তাকাতেই টেলিফোন বেজে উঠল।

এ-ডি-সি হিয়ার।

মুহূর্তের জন্য ওপাশ থেকে কি যেন শোনার সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, সেন্ড হিম আপ।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেন রায়। টেবিলের ওপাশ থেকে টুপিটা নিয়ে মাথায় দিলেন। ইউনিফর্মটা একটু টেনে টুনে ঠিক করে আর এক ঝলক ঘড়িটা দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

বেয়ারা টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

ক্যাপ্টেন রায় বললেন, নেক্সট ভিজিটার্স আসছেন।

রাজভবনের বেয়ারা চাপরাশীদের একটু ইঙ্গিত করলেই কাজ হয়। তাছাড়া এরা এদের কাজকর্ম দায়িত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। সরকারি দপ্তরখানায় আই-সি-এস সেক্রেটারিরা ঘন্টা বাজিয়ে বাজিয়ে হাঁপিয়ে যান কিন্তু বেয়ারাদের দর্শন পান না। যে হেড অ্যাসিসট্যান্ট সেক্সন অফিসারদের ভয়ে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়, সেই তাদের টেবিলের ঘণ্টাটা দেখবেন। ঠং ঠং করে বাজাতে বাজাতে ঘণ্টার মাথাগুলো বেঁকে তুবড়ে গেছে, হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বেয়ারা-চাপরাশীর দল নির্বিকার। একটু চেঁচামেচি হয়তো শুনতে হয়, তবে বেয়ারা-চাপরাশীর দল ওসব গ্রাহ্যই করে না।

রাজভবন সরকারি পয়সায় চললেও অনেকটা বড় বড় হোটেলের মতো। ইসারা-ইঙ্গিত ফিসফিসই বেশি।

রাজভবনকে হোটেল বললেও অন্যায় হবে না। ভি-আই-পির দল তো এখানেই আতিথ্য গ্রহণ করেন। কখনও স্বদেশি, কখনও বিদেশি। কেউ একদিন বা কেউ এক সপ্তাহের জন্য। পার্থক্য শুধু একটাই। ক্যাশিয়ার-একাউন্টেন্টের কাউন্টার এখানে নেই। আর নেই আগমন নির্গমনের সময় ওই বিরাট লম্বা খাতায় দস্তখতের পর্ব। ছোটখাটো পার্থক্য আরো আছে।

বেয়ারাকে ভিজিটার আসার কথা বলেই ক্যাপ্টেন রায় এগিয়ে গিয়ে গভর্নরের ড্রইংরুমের দরজায় দু-একবার নক করেই ভেতরে গেলেন।

গভর্নর এ-ডি-সি-কে দেখেই বুঝলেন, পরবর্তী দর্শনার্থী হাজির।

মিঃ জগতিয়ানী গভর্নর সাহেবের দুহাত ধরে বিদায় নিয়ে ক্যাপ্টেন রায়ের সঙ্গে বেরিয়ে এলেন।

করিডোরে এসে দুজনে হ্যাঁন্ডসেক করলেন।

ক্যাপ্টেন রায় বললেন, আপনার সঙ্গে আলাপ করে বেশ লাগল।

ওসব ফর্মালিটি ছেড়ে দিন। একদিন সন্ধ্যাবেলায় চলে আসুন আমার ভবানীপুরের বাড়িতে। তেলেভাজা মুড়ি খেতে খেতে আড্ডা দেওয়া যাবে আর আমার মেয়ের গান শুনে আসবেন।

সিঁড়ির দিকে এগুতে এগুতে ক্যাপ্টেন রায় জিজ্ঞাসা করলেন, কি গান?

হিন্দী ফিল্মের গান না, পিওর বাংলা গান।

আচ্ছা।

আচ্ছা-টাচ্ছা নয়, একদিন আসুন।

সিঁড়িতে পা দিয়ে মিঃ জগতিয়ানী পিছন ফিরে তাকিয়ে বললেন, ভয় নেই, আমি ব্যবসাদার হলেও আপনাকে এক্সপ্লয়েট করব না।

না, না, ও কি বলছেন।

মিঃ জগতিয়ানী বিদায় নিলেন। ক্যাপ্টেন রায় অফিসে আসতে না আসতেই পরবর্তী দর্শনার্থী মিস্টার আর কে চ্যাটার্জি এলেন।

ক্যাপ্টেন রায় উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, গুডমর্নিং স্যার।

গুডমর্নিং।

আবার বেয়ারার তলব। ছাপান স্লিপ গেল হিজ এসেলেন্সির কাছে। বেয়ারা ঘুরে এল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।

ক্যাপ্টেন রায় উঠে দাঁড়িয়ে মাথায় টুপিটা দিয়ে এক পা এগিয়ে বললেন, ইয়েস স্যার, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড…

আবার ড্রয়িংরুমের দরজায় দুবার নক করে ক্যাপ্টেন রায় ভিতরে গিয়ে বললেন, ইওর এসেলেন্সি! মিঃ আর কে চ্যাটার্জি ইজ হিয়ার।

 মিঃ চ্যাটার্জিকে এগিয়ে দিয়ে এ-ডি-সি পিছিয়ে এলেন। মাথাটা একটু নীচু করে বিদায় নিলেন গভর্নরের কাছ থেকে।

এ-ডি-সি সাহেব বেরুতে না বেরুতে বেয়ারা ট্রে-তে করে চা-স্ন্যাকস্ নিয়ে ঢুকল।

ক্যাপ্টেন রায় নিজের ঘরে ফিরে এসে টুপিটি খুলে চেয়ারে বসে আবার একটা সিগারেট খাবার জন্য সিগারেট কেস আর লাইটারটা তুলে নিলেন। একটু অন্যমনস্কভাবে লাইটারটা জ্বালাতে গিয়ে হঠাৎ দপ করে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। চারপাশে দরজা-জানলা খোলা। সূর্যের আলোয় ভরে আছে সারা ঘর। তবুও এমন বিশ্রীভাবে লাইটারটা জ্বলে উঠল যে চোখ দুটো যেন সহ্য করতে পারল না।

ক্যাপ্টেন রায়ের মনে পড়ল। হ্যাঁ, এই দিনের বেলাতেও সতীনাথ সরকার কখনও কখনও জ্বলে ওঠে। দপ করে জ্বলে ওঠে, দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ক্যাপ্টেন রায়ের মতো বন্ধুদের চোখগুলো সহ্য করতে পারে না।

প্রথম প্রথম কষ্ট হয়, অসহ্য মনে হতো ক্যাপ্টেনের। মনটা বিদ্রোহ করতে চাইত, সৈনিক হয়েও ধৈর্যচ্যুতি ঘটত কিন্তু মডার্ন সোসাইটির সৌজন্য বজায় রাখবার জন্য কিছু করতে পারত না। প্রায় মুখ বুজে সহ্য করত।

লাইটারের আগুনটা অমন দপ করে, দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠায় ক্যাপ্টেন মুখ সরিয়ে নিয়েছিলেন সিগারেটটা জ্বালাতে পারেননি। ফ্রেম কন্ট্রোলকে ঘুরিয়ে আবার লাইটারটা জ্বালিয়ে সিগারেট ধরালেন ক্যাপ্টেন। প্রায় অদৃশ্য এক শিখা! মুহূর্তের জন্য বেশ লাগল দেখতে। শুধু যেন একটা ইঙ্গিত, একটা ইসারা। একটা নিমন্ত্রণ। একটা স্বপ্ন, একটা আশা। ভবিষ্যতের প্রত্যাশা।

মোগলের প্রাসাদ বা আলাউদ্দীন খিলজীর হারেমের অনতিদূরে বসে নয়। যমুনা পারে গুলবাহারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা পারস্য-সুন্দরীদের দেখতে দেখতেও নয়, ডালহৌসী পাড়ার রাজভবনে বসে বসেই ক্যাপ্টেন রায়ের মনটা যেন একটু চঞ্চল হয়। একটু বিচলিত হয়।

সরকারি বা বেসরকারি দপ্তরে বসে মন চঞ্চল হতে পারে না। চারপাশে লোকজন গিজ গিজ করছে। বক বক করতে হয় সারাক্ষণ। তাছাড়া পরিবেশ।

রাজভবনে তো সে বালাই নেই। এ-ডি-সি-র অফিস থেকে জানলা দিয়ে দেখা যায় ফুলের জলসা, সবুজের মেলা।

আর?

আর দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ। দুটো ডানায় ভর দিয়ে উড়ে বেড়ায় ছোট্ট ছোট্ট পাখি। কতটুকুই বা ওদের প্রাণশক্তি? কতটুকুই বা সামর্থ্য? তবুও স্বপ্ন দেখার শেষ নেই। অফুরন্ত ওদের সাধ। উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ায় সীমাহীন নীল আকাশের বুকে।

রাজভবনে ওই দপ্তরে বসে নীল আকাশ দেখতে দেখতে ক্যাপ্টেনও উড়ে ঘুরে বেড়ান দিগন্ত বিস্তৃত পরিচিতের মহাকাশে। এ যেন সেই পথ হারানোর অধীন টানে অকুলে পথ আপনি টানে।

সিগারেটে একটা টান দেন। একবার লাইটার দেখেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দৃষ্টিটা ঘুরে আসে ফুলের জলসায়, সবুজের মেলায়, নীল আকাশের কোলে।

পর পর দুটো টান দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়ায় ভরিয়ে দিলেন ঘরটা, এ-ডি-সি ক্যাপ্টেন কমল রায়। রিভলবিং চেয়ারটা ঘুরিয়ে একটা টি-পাই এর ওপর পা দুটো তুলে দিয়ে বাইরে চেয়ে রইলেন।

কি ভাবছিলেন কে জানে? হয়তো সতীনাথবাবুর কথা। হয়তো বিভ্রান্ত মন চাইছিল মণিকার আশ্রয়। হয়তো বা অন্য কিছু, অন্য কাউকে!

হঠাৎ লাল আলোর ঝলকানি অনুভব করতেই মুহূর্তের মধ্যে মাথায় টুপি চাপিয়ে এ-ডি-সি ক্যাপ্টেন রায় ছুটে গেলেন গভর্নরের কাছে।

মর্নিং ভিজিটার্স চলে যাবার পর রাজভবনের প্রথম অধিবেশন শেষ হয়। খুব জরুরী কাজ থাকলে অবশ্য রাজ্যপালকে পাঁচ-দশ মিনিট আরো থাকতে হয়। জরুরী কাজ মানে কয়েকটা দস্তখত। অটোগ্রাফ। নিজের বিচার, বুদ্ধি, বিবেচনা-কিছুরই প্রয়োজন নেই। কোনো চিন্তাভাবনা না করেই রাজ্যপালকে অর্ডিন্যান্স বা বিল বা অন্য কোনো দলিলে দস্তখত দিতে হয়।

এমন ধরনের জরুরী কাগজপত্রে রাজ্যপালের দস্তখত দরকার হলে মর্নিং ভিজিটার্স চলে যাবার পর সেক্রেটারি টু দি গভর্নর নিয়ে আসেন এইসব কাগজপত্র। পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যেই রাজ্যপালের বিবেচনার পর্ব শেষ হয়। তারপর দস্তখত। অটোগ্রাফ।

গভর্নর অন্দরমহলে প্রস্থান করলে রাজভবনের প্রাণহীন নাটকের প্রথম অঙ্ক শেষ হয়।

এ-ডি-সি ফিরে আসেন নিজের অফিসে। রিভলবিং চেয়ারে দেহটা এলিয়ে পা দুটো তুলে দেন টেবিলের ওপরে। অশোকস্তম্ভ মার্কা সিগারেট ধরিয়ে ভর্তি করে দেন ঘরটা।

দুটো একটা টান দিতে না দিতেই পিছনের ওই বিরাট জানলা দিয়ে একটা দমকা হাওয়া আসে। সিগারেটের ধোঁয়া কোথায় হারিয়ে যায়, লুকিয়ে যায় ক্যাপ্টেন রায় তা নিজেই বুঝতে পারেন না। হাতের রনসন লাইটারটা বড় স্পষ্ট করে দেখতে পান।

ইতিমধ্যে বুড়ো রমজান এসে গেছে। রোজ যেমন আসে। এক পট দার্জিলিং টি, কিছু স্ন্যাকস, কিছু পেস্ট্রি, কিছু নাট নিয়ে। রমজান আপন মনে এক কাপ চা তৈরি করে এগিয়ে দেয় ক্যাপ্টেন রায়ের সামনে। লিজিয়ে সাব, চা খান।

লাইটারটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে সম্বিত ফিরে পান আনমনা ক্যাপ্টেন রায়। রমজানের কথা শুনে একটু মুচকি হাসেন।

কিঁউ সাব? হাসেন কেন? রমজান জানতে চায়।

সাধারণ বেয়ারা-চাপরাশীর দল অফিসারদের সঙ্গে ঠিক এভাবে কথা বলার সাহস বা প্রশ্রয় না পেলেও রাজভবনে এসব সম্ভব। এখানে বেয়ারা চাপরাশীরা যে বড় বেশি ঘনিষ্ঠ। বড় বেশি কাছের মানুষ। দু চোখ ভরে ওরা যে সবকিছু দেখেছে। মুখে কিছু বলে না, বলতে পারে না, বলতে চায় না। কিন্তু মনে মনে তো সবকিছু জানে, বোঝে।

তাছাড়া রমজানের কথা স্বতন্ত্র। রিটায়ার করার পর দু-দুবার এক্সটেনশন পেয়েছে স্বয়ং গভর্নরের সুপারিশে। রমজানের কনিষ্ঠ সহকর্মীরাও আপত্তি করেনি। বরং তাদেরই সম্মিলিত অনুরোধে রমজানের চাকরির মেয়াদ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। হয়তো ভবিষ্যতেও হবে।

প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে রমজান কাজ করছে এই রাজভবনে। নিজের হাতে কাজ শিখিয়েছে। তার সব তরুণ সহকর্মীদের। ওদের সবাইকে পুত্ৰতুল্য জ্ঞান করে প্রবীণ রমজান। রমজান। রাজভবনের প্রধানতম কর্মী। সবার কাছেই ওর বিশেষ মর্যাদা।

তাইতো এ-ডি-সি সাহেবের মুচকি হাসি দেখে রমজান তার কারণ জিজ্ঞাসা করতে পারে।

ক্যাপ্টেন রায় জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা রমজান তুমি তো প্রায় তিরিশ-চল্লিশ বছর এই কলকাতা শহরের এই রাজভবনে কাটালে।

হাঁ সাব, করিব তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর হবে বৈকি।

তবে তুমি বাংলা বলতে পার না কেন?

হাসতে হাসতে রমজান বলে, এহি বাত সাব?

রমজান হারিয়ে যায় সেই সুদূর অতীতে। স্কুল-কলেজের কিছু ছেলেমেয়েরা পরীক্ষায় পাশ করার জন্য সেসব দিনের দুচার পাতা ইতিহাস মুখস্থ করলেও আর সবাই ভুলে গেছে। কলকাতা শহরের রাস্তা থেকে মুছে গেছে সেসব দিনের স্মৃতি। সেদিনের এসপ্লানেড, হেস্টিংস, ডালহৌসীর চরিত্র চেহারা হারিয়ে গেছে। কলকাতার মানুষ ভুলে গেছে কারমাইকেল, রোনাল্ডসে, স্টেইনলি, জ্যাকসন, অ্যান্ডারসন, ব্রেবোর্নের কথা।

রমজান যেন ক্যাপ্টেন রায়ের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই রাজভবনটা পুরো একটা চক্কর দিয়ে আসে। কুর্নিস করে আসে রোনাল্ডসে, স্টেইনলি জ্যাকসন, অ্যান্ডারসনকে।

সাব, বাংলা জানে বৈকি! তবে আমি তো পুরান জমানার লোক। আংরেজি ছাড়া আর কিছু চলত না এই গভর্নমেন্ট হাউসে।

ফর্ক দিয়ে এক টুকরো রুটি মুখে পুরে ক্যাপ্টেন রায় রমজানের কথা শোনেন। একটু যেন অবাক হয়েই পুরান জমানার কথা শোনেন।

ক্যাপ্টেন সাব, আমি যখন ছোঁকরা বয়েসে নোকরিতে ঢুকি, তখন বাঙালিবাবুরা এই গভর্নমেন্ট হাউসে ঢুকতে পেত না…

কেন যাঁরা গভর্নমেন্ট হাউসের অফিসেই কাজ করতেন?

না, তারাও না। সাধারণ বাঙালি কেরানীবাবুরাও অন্দরে আসতে পারতেন না। কার্জন সাহেবের আমলে বাংলা দুটুকরা করার সময় যে মুভমেন্ট হল, তাতে আংরেজদের বড় ডর লেগেছিল। বাঙালি পুলিশ পর্যন্ত এই গভর্নমেন্ট হাউসে ডিউটি দিতে পারত না।

আচ্ছা?

জি সাব।

চায়ের পেয়ালায় শেষ চুমুক দিতে দিতে ক্যাপ্টেন রায় জানতে চাইলেন, তুমি চাকরি পেলে কি ভাবে?

সে তো আর এক কাহানি। তবে তখন আপকান্ট্রি মুসলমানদের নোকরি মিলত। আমার এক চাচা জ্যাকসন সাহেবের এক দোস্তের খাস বেয়ারা ছিল। সেই সাহেবের দয়াতেই আমি ছোঁকরা বয়সে গভর্নমেন্ট হাউসে নোকরি পাই।

ভারি মজা লাগে রমজানের কথা শুনতে। তা তুমি ছোঁকরা বয়সে কি কাজ করতে?

এই কলকাত্তা শহরের বড় বড় সাহাবদের মেমসাহেবদের দল রোজ সকালে হেস্টিংসের মাঠে গলফ খেলতে যেতেন। কোনো কোনোদিন লাটসাহেবের মেমসাহেবও যেতেন। আমি যেতাম মেমসাহেবদের সঙ্গে বল কুড়িয়ে দেবার জন্য।

কথাগুলো বলতে বলতে রমজানের চোখমুখগুলো একটু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। যেন একটু গর্ব হয় সেদিনের স্মৃতি রোম-হন করতে।

মেমসাহেব আমাকে খুব পসন্দ করতেন…

আর এক পেয়ালা চা শেষ করে ক্যাপ্টেন রায় প্রশ্ন করেন, কেন?

রমজান হঠাৎ একটু হাসে। একটু যেন জোরেই হাসে। রাজভবনের শান্ত শীতল, প্রাণহীন পরিবেশে সে হাসি যেন বেমানান।

ক্যাপ্টেন একটু বিস্মিত না হয়ে পারেন না। কি ব্যাপার, হাসছ কেন?

বড় মজা হতো ও জমানায়। রোজ সন্ধ্যার পর খানা-পিনার পার্টি হতো। এই কলকাতার সব বড় বড় সাহেবরা আসতেন দিল্লি, বিলাইতের সাহেবরাও আসতেন। লাচ, গান আর শরাব চলত রাত একটা, দুটো, তিনটা পর্যন্ত…

রোজ হতো?

হ্যাঁ সাব, রোজ। এখনকার মতো তখন লাটসাহেব রোজ লেকচার দিতে বাইরে যেতেন না। লাটসাহেব সাল মে দো-চোর বাইরে খানাপিনা করতেন। বাকি রোজ সন্ধ্যায় লাটসাহেবেই অন্যদের খানাপিনার পার্টি দিতেন। আর ওইসব পার্টিতে কি ভয়ানক বদমাইশি হতো…

ক্যাপ্টেন রায়ের আগ্রহ বাড়ে, কেন? পার্টিতে আবার কি বদমাইশি হতো?

ডান হাতটা কপালে ঠেকিয়ে বৃদ্ধ রমজান বলে, আরে সাব! মাত পুছিয়ে। বোতল বোতল শরাব খাবার পর কি আর হুশ থাকে? সাহেব-মেমসাহেবরা বেহুশ হবার পর বদমাইশি হতো।

রমজান একটু থেমে আবার ঠিক করে মনে করে নেয়।

সাহাব-মেমসাহাবের দল বেহুশ হবার পর বেয়ারা-চাপরাশীরা মজা শুরু করত। কেউ শরাব খেত, কেউ চোরি করত, কেউ আবার…

রমজান আর এগোতে পারে না। বলতেও দ্বিধা হয়, সঙ্কোচ হয়। লজ্জাও করে ঘৃণাও করে।

ক্যাপ্টেন রায়ের বুঝতে অসুবিধা হয় না।

তা মেমসাহেব তোমাকে কেন ভালোবাসতেন?

আমি ছোঁকরা ছিলাম বলে ওদের চোরি করাতে আমার ডর লাগত, খারাপ লাগত। পারলে ওদের চোরির জিনিস আমি ফিরিয়ে দিতাম। মেমসাহেবকে সাবধান করে দিতাম। তাইতো…

শুধু সেদিন সকালে নয় আরো কতদিন বসে বসে এই গভর্নমেন্ট হাউসের কত কাহিনি শোনেন ক্যাপ্টেন রায়। আজকের রাজভবনের সঙ্গে সেদিনের গর্ভনমেন্ট হাউসের কত পার্থক্য। এক যুগ নয়, বহু যুগের ব্যবধান। ইউনিয়ন জ্যাক থেকে তেরঙ্গা। ভারতবর্ষের ইতিহাসের অনন্য স্মৃতি লুকিয়ে আছে এই রাজভবনের সর্বত্র। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডাইরেক্টরদের সঙ্গে লর্ড ওয়েলেসলির ঐতিহাসিক ঝগড়া হয় রাজভবনে। মেকলের সঙ্গে বেন্টিক-এর বির্তক হয় ওই পাশের কাউন্সিল চেম্বারে।

রমজান তখন গভর্নমেন্ট হাউসে চাকরি পায়নি, তবে শুনেছে। অনেকের কাছে শুনেছে। শুনেছে লর্ড ক্যানিং-এর কাহিনি। স্বেচ্ছাচারী ক্যানিং যখন এই গভর্নমেন্ট হাউসে ছিলেন তখন তার বিরুদ্ধে ঝড় উঠেছিল। কলকাতার ইংরেজরা ওই ওপাশের টাউন হলে বসে সভা করে দাবি জানিয়েছে, গো ব্যাক ক্যানিং। পরবর্তীকালে আই সি-এস লরেন্স লর্ড লরেন্স হয়ে গভর্নর জেনারেল হলে এই গভর্নমেন্ট হাউসের লনে ক্রিকেট খেলেছেন আর কলকাতার হাজার হাজার মানুষ সে খেলা দেখে হাততালি দিয়েছে শীতকালের দুপুরে।

ক্যাপ্টেন সাব, কি হয়নি এই গভর্নমেন্ট হাউসে। অ্যান্ডারসন সাহাব যখন লাটসাহেব তখন তার মেয়েকে বিয়ে কি গড়বড়ই না হল।

কি হয়েছিল?

কি হয়নি তাই বলুন। সুইসাইড পর্যন্ত হয়ে গেছে ওই লেড়কির জন্য।

কই তাতো কখনো শুনিনি।

এই রমজান ছাড়া আর কেসে কাহিনি বলবে বলুন। আমার চোখের সামনে হয়েছে…

জ্যাকসনের পর বাংলার গভর্নর হয়ে এলেন স্যার জন অ্যান্ডারসন। সঙ্গে এলেন লেডি অ্যান্ডারসন ও তার দুই মেয়ে। ছেলেটি পড়াশোনার জন্য বিলেতেই রইল। মেয়ে দুটির নাম রমজানের মনে নেই। ঠিক বয়স কত ছিল তাও মনে নেই। তবে মনে আছে মেয়ে দুটি সুন্দরী ও শিক্ষিতা ছিল এবং ওদের নিয়ে গভর্নমেন্ট হাউসের অফিসারদের মধ্যে বেশ চাঞ্চল্য দেখা দেয়।

স্যার জন যখন কলকাতা এলেন, তখন ভারতবর্ষের রাজনীতিতে মোড় ঘুরেছে। ডালহৌসী বা ক্যানিং-এর যুগ বহুদিন আগে শেষ হয়েছে। রাউলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগ, খিলাফত আন্দোলন, এক প্রস্থ অসহযোগ আন্দোলনের ঝড় বয়ে গেছে ভারতবর্ষের ওপর দিয়ে। গুলি-গোলা, বোমা-পটকাও শুরু হয়েছে নানা দিকে। বাংলাদেশ তখন টগবগ করে ফুটছে। অ্যান্ডারসন সাহেবকে তাই গভর্নমেন্ট হাউসে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই সরকারি কাজে মন দিতে হল। মিলিটারি আর পুলিশ অফিসারদের নিয়ে বসতে হতো রোজ সকালে। ঘন ঘন দিল্লীতেও যেতে হতো শলা-পরামর্শের জন্যে।

চাকরি করতে এসে কেমন যেন ঘাবড়ে গিয়েছিলেন এই স্যার জন অ্যান্ডারসন। চব্বিশ ঘণ্টা সন্ত্রাসবাদীদের ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত থাকতেন। গভর্নমেন্ট হাউসের বাইরে বেরুতেন না বিশেষ। লেডি অ্যান্ডান্সনও স্বামীর জন্য বড়ই চিন্তিত থাকতেন। তাইতো স্বামীর সান্নিধ্য তিনি বিশেষ ত্যাগ করতেন না।

মাঝখান থেকে বিপদে পড়ল মেয়ে দুটি। বিলেত থেকে সদ্য আগতা যুবতী মেয়েদের পক্ষে ওই গভর্নমেন্ট হাউসের মধ্যে বন্দিনী থাকা বিশেষ আনন্দের নয়। কদিন পরেই ওরা ছটফট করতে শুরু করল। লেডি অ্যান্ডারসন দু-চারদিন গঙ্গার ধার, ফোর্ট উইলিয়াম আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখবার পর মেয়েদের বললেন এই শহরে আর যেদিকে যাবে, সেখানেই টেরোরিস্টে ভর্তি। তাছাড়া ডার্টি সিটি! কি আর দেখবে?

মেয়ে দুটি কিন্তু ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারল না। একদিন সুযোগ সুবিধা মতো লাঞ্চের সময় একেবারে খোদ মিলিটারি সেক্রেটারিকে ওরা জিজ্ঞাসা করল, আমরা একটু বাইরে ঘোরাঘুরি করতে পারি না?

কেন পারবে না? কর্নেল উত্তর দেন।

ওই যে মা বললেন চারপাশে টেরোরিস্ট…

কর্নেল সাহেব হেসে বললেন, না, না, তোমাদের ওসব ভয় নেই। তবে গভর্নমেন্ট হাউসের গাড়ি চড়ে, পুলিশ নিয়ে ঘোরাঘুরি করলে বিপদ আছে। সাধারণ মেয়েদের মত ঘুরলে কেউ কিছু বলবে না। বরং ইউ কান্ট গেট এ মোর ফ্রেন্ডলি প্লেস দ্যান দিস সিটি!

রমজান বলল, ব্যাস! উসকে বাদ লেড়কিদের আর গভর্নমেন্ট হাউসে দেখাই যেতো না। কোনোদিন লাঞ্চ খেতেন না, কোনোদিন ডিনার খেতেন না। আবার কোনো কোনো দিন পিকচার দেখে রাত বারোটার পরে গভর্নমেন্ট হাউসে ফিরতেন।

ক্যাপ্টেন রায় জিজ্ঞাসা করলেন, ওরা একলা একলাই ঘুরে বেড়াত?

রমজান হেসে ফেলে, আরে সাব, জোয়ান লেড়কি কভি আকেলে আকেলে ঘোরাঘুরি করে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *