• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • লেখক
  • My Account
  • লেখক
  • My Account
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা PDF ডাউনলোড

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

নিউরন ম্যাপিং

লাইব্রেরি » মুহম্মদ জাফর ইকবাল » সায়েন্স ফিকশন সমগ্র » রবোনগরী » নিউরন ম্যাপিং

নিউরন ম্যাপিং

লিলি, আমি জানি তুমি বিশ্বাস করবে না প্রফেসর খোরাসানী তার মাথার সাদা চুলকে হাত দিয়ে পিছনে ঠেলে দিয়ে উত্তেজিত গলায় বললেন, কিন্তু আমার নিউরন ম্যাপিং যন্ত্র শেষ হয়েছে।

হৃতযৌবনা লিলি ক্লান্ত চোখে তার খ্যাপাটে এবং প্রায় বাতিকগ্রস্ত স্বামীর দিকে তাকালেন, তিনি আগেও অনেকবার তার মুখে এই কথা শুনেছেন, কাজেই কথাটি বিশ্বাস করবেন কি না বুঝতে পারলেন না। প্রফেসর খোরাসানী দুই পা এগিয়ে এসে তার স্ত্রীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উত্তেজিত গলায় বললেন, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না?

না। লিলি নিচু গলায় বললেন, আমি একবার তোমার কথা বিশ্বাস করে তোমাকে বিয়ে করেছিলাম, আজ দেখ আমার কী অবস্থা!

তোমার এই অবস্থা দূর হয়ে যাবে লিলি।

আমি বিশ্বাস করি না–লিলি গলায় বিষ ঢেলে বললেন, তোমার কোনো কথা আমি বিশ্বাস করি না।

প্রফেসর খোরাসানী কাতর গলায় বললেন, বিশ্বাস কর লিলি, সত্যি আমার কাজ শেষ হয়েছে। যার জন্যে আমি আমার সারা জীবন নষ্ট করেছি, অপেক্ষা করে করে তুমি তোমার সারা জীবন শেষ করে এনেছ, সেই কাজ শেষ হয়েছে।

লিলি স্থির চোখে তার বৃদ্ধ স্বামীর দিকে তাকালেন, মুখের কুঞ্চিত চামড়া, নিষ্প্রভ চোখ, সাদা শণের মতো চুল– এই কি তার যৌবনের স্বপ্নরাজ্যের সেই রাজপুত্র? তার এখন আর বিশ্বাস হয় না। কিন্তু সত্যিই যদি এই অথর্ব বৃদ্ধ তার কাজ শেষ করে থাকে তাহলে কি তার সেই যৌবনের রাজপুত্র আবার তার কাছে ফিরে আসবে না? তিনি নিজেও ফিরে পাবেন তার হৃত যৌবন? লিলি বয়সের ভারে ন্যুব্জ দেহে হঠাৎ করে অনভ্যস্ত এক ধরনের উত্তেজনার শিহরন অনুভব করলেন। 

খোরাসানী নিচু হয়ে তার স্ত্রীর শীর্ণ হাত ধরে বললেন, তুমি আমার জন্যে তোমার সারা জীবন নষ্ট করেছ লিলি। আমি তোমাকে সব ফিরিয়ে দেব। তোমার জীবন যৌবন সবকিছু।

লিলি জ্বলজ্বলে চোখে তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, সত্যি?

সত্যি লিলি। এস আমার সাথে, আমি তোমাকে দেখাই।

প্রফেসর খোরাসানী স্ত্রীর হাত ধরে তাকে নিউরন ম্যাপিং মডিউলের সামনে নিয়ে গেলেন। কোথায় মাথাটি স্ক্যানারের নিচে রাখতে হয়, স্ক্যানার কীভাবে মস্তিষ্কের নিউরন স্ক্যান করে, কীভাবে তার ভিতরের সুষম সামঞ্জস্য খুঁজে বিশাল সম্ভাব্য সূত্রকে কমিয়ে আনে, কীভাবে সেটা কম্পিউটারের মেমোরিতে সাজিয়ে রাখা হয় এবং কীভাবে একজন মানুষের পুরো স্মৃতি, তার চিন্তাভাবনা, কল্পনা, স্বপ্ন–সাধ সবকিছু সরিয়ে যন্ত্রের মাঝে এনে বন্দি করে। রাখা যায় বুঝিয়ে দিলেন। মানুষের সেই স্মৃতি, সেই স্বপ্ন–সাধ, কল্পনা, ভালবাসা সবকিছু তখন বিপরীত একটা প্রক্রিয়ায় নূতন একজন মানুষের মস্তিষ্কে অনুপ্রবেশ করিয়ে দেয়া যায়। লিলি বিজ্ঞানী নন, খোরাসানীর সব কথা তিনি বুঝতে পারলেন না, কিন্তু তবু ভাসা ভাসা ভাবে কীভাবে একজন মানুষের শরীরে অন্য একজন মানুষকে প্রবেশ করিয়ে দেয়া যায় তার মূল ভাবটা ধরে ফেললেন। তিনি কাঁপা গলায় বললেন, তুমি সুন্দরী একজন যুবতী মেয়েকে এনে তার শরীরে আমাকে ঢুকিয়ে দেবে?

হ্যাঁ। খোরাসানী মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, তোমার মস্তিষ্কের নিউরন কীভাবে সাজানো আছে সেটা রেকর্ড করা থাকবে এই মেগা কম্পিউটারের বিশাল মেমোরিতে। সেই সাজানো নিউরনের সমস্ত তথ্য একটু একটু করে পৌঁছে দেয়া হবে সুন্দরী কমবয়সী একটা মেয়ের মাথায়। সেই মেয়েটা তখন একটু একটু করে হয়ে যাবে তুমি।

আর সেই মেয়েটা?

প্রফেসর খোরাসানী দুর্বল গলায় বললেন, মেয়েটা পাবে তোমার শরীর।

আমার শরীর? এই শরীর!

হ্যাঁ–তবে বেশিক্ষণের জন্যে নয়।

লিলি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বেশিক্ষণের জন্যে নয় কেন?

প্রফেসর খোরাসানী কঠোর মুখ করে বললেন, কেন এসব নিয়ে তুমি মাথা ঘামাচ্ছ লিলি? মহৎ কিছুর জন্যে সব সময় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। আমার আর তোমার জীবনের জন্যে সাধারণ দুজন মানুষ ত্যাগ স্বীকার করবে। আমি আর তুমি একজন সুদর্শন মানুষ আর একজন সুন্দরী মেয়ের শরীর নিয়ে নেব। যন্ত্রটা যেভাবে কাজ করে তার ফল হিসেবে সেই মানুষ আর মেয়েটি পাবে আমাদের শরীর। তারা চাইলেও পাবে, না চাইলেও পাবে! কিন্তু সেই শরীরে তাদের আটকে রেখে কী লাভ? সেটা হবে তাদের জন্যে একটা যন্ত্রণা

লিলির চোখ হঠাৎ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করতে থাকে, তার মানে তাদেরকে তুমি মেরে ফেলবে?

প্রফেসর খোরাসানী বিরক্ত হয়ে বললেন, আহ লিলি, তুমি ঘুঁটিনাটি জিনিস নিয়ে বড় বেশি মাথা ঘামাও। সেই মানুষ দুটিকে নিয়ে কী করা হবে সেটা তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও। যদি তুমি নূতন দেহ নিয়ে নূতন জীবন শুরু করতে চাও তাহলে আমার আর তোমার এই জীর্ণ দেহ নিয়ে অন্য কোনো মানুষকে ঘোরাঘুরি করতে দেয়া যাবে না লিলি। তাছাড়া

তাছাড়া কী?

তাছাড়া আমরা যদি কোনো দেহকে হত্যা করি সেটা হবে আমাদের নিজেদের দেহ। আত্মহত্যা করতে পারলে সেটা অপরাধ নয় লিলি। প্রচলিত আইনে এটা খুন নয়, এটা আত্মহত্যা!

লিলির চোখ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করতে থাকে। তিনি তার বুকের ভিতরে এক ধরনের শিহরন অনুভব করেন। একই সাথে আনন্দ এবং ভয়ের শিহরন!

.

প্রফেসর খোরাসানী এবং লিলি তাদের জন্যে যে দুজন মানুষকে বেছে নিলেন তাদের নাম যথাক্রমে জসিম এবং সুলতানা। জসিম চাকরিচ্যুত একজন যুবক, যে ওষুধের ফ্যাক্টরিতে কাজ করত, কয়দিন আগে সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। সুলতানা মফস্বলের মেয়ে, চাকরির সন্ধানে শহরে এসেছে। খবরের কাগজে খোরাসানী এবং লিলি যে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন সেটা পড়ে সে দেখা করতে এসেছিল। বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল :

শহরের উপকণ্ঠে বৃদ্ধ দম্পতির দেখাশোনা করার জন্যে ২০–২৫ বছরের পুরুষ সাহায্যকারী এবং মহিলা পরিচারিকা প্রয়োজন। থাকা, খাওয়া, সাপ্তাহিক ছুটি এবং আকর্ষণীয় মাসিক ভাতা দেয়া হবে। পড়াশোনা অথবা অন্য কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলে ক্ষতি নেই তবে শারীরিক সুস্থতাকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। পাসপোর্ট সাইজের ছবি এবং পারিবারিক তথ্যসহ যোগাযোগ করুন।

বিজ্ঞাপন দেখে জসিম এবং সুলতানার মতো আরো অনেকেই যোগাযোগ করেছিল। খোরাসানী আর লিলি সেখান থেকে বেছে সুদর্শন এবং সুন্দরীদের আলাদা করে ডেকে পাঠালেন। যদিও তাদের সাথে গৃহ পরিচর্যা, রান্না–বান্না, স্বাস্থ্যবিধি এই ধরনের বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হল কিন্তু তাদের প্রকৃত নজর ছিল এই যুবক এবং যুবতীদের শরীরের দিকে। অন্য সময় হলে কমবয়সী এই যুবক–যুবতীর সুন্দর সুঠাম দেহ দেখে তারা এক ধরনের ঈর্ষা অনুভব করতেন, কিন্তু এখন ঈর্ষার বদলে তাদের ভিতরে সূক্ষ্ম আত্মপ্রসাদের বোধ জেগে উঠছিল। আর কয়দিনের মাঝেই এই দেহগুলোর কোনো–কোনোটি হবে তাদের। ব্যাপারটা এখনো তারা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।

প্রফেসর খোরাসানী এবং লিলি অন্য অনেকের মাঝে থেকে জসিম এবং সুলতানাকে বেছে নিলেন তাদের পারিবারিক অবস্থার জন্যে। তারা দুজনেই আত্মীয়–পরিজনহীন, দুজনেই নিঃসঙ্গ এবং পরিচিত জগৎ থেকে এই দুজন হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেলে খুব বেশি মানুষ তাদের জন্যে বিচলিত হবে না। জসিম এবং সুলতানাকে ডাক্তার দিয়ে ভালো করে পরীক্ষা করিয়ে খোরাসানী এবং লিলি তাদের নিজেদের বাসায় উঠে আসতে বললেন।

নিউরন ম্যাপিং শুরু করার জন্যে প্রফেসর খোরাসানী এবং লিলি আরো মাসখানেক সময় নিলেন। জসিম এবং সুলতানার দৈনন্দিন কাজকর্ম তারা ঘুঁটিয়ে ঘুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন, নূতন পরিবেশে দুজনেই চমৎকারভাবে মানিয়ে নিয়েছে। খোরাসানী এবং লিলি একা একা জীবন কাটিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন, কাজেই জসিম এবং সুলতানার কাছে তাদের দাবি ছিল খুব কম।

নিউরন ম্যাপিঙের জন্যে শেষ পর্যন্ত যে দিনটি বেছে নেয়া হল সেটি ছিল একটি বর্ষণমুখর রাত, আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছে, বিজলি চমকে চমকে উঠছে, বাতাসের ঝাঁপটায় জানালা কেঁপে কেঁপে উঠছে। জসিম আর সুলতানার রাতের খাবারের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়া হয়েছে, তারা ঘুমে অচেতন হয়ে থাকলে দীর্ঘ সময়।

খোরাসানী আর লিলি নিউরন ম্যাপিং যন্ত্রটি চালু করে জসিম এবং সুলতানাকে আনতে গেলেন। জসিমের ঘরে উঁকি দিয়ে তারা আবিষ্কার করলেন ঘরটি শূন্য। ঘুমের ওষুধের প্রতিক্রিয়া শুরু হবার আগেই নিশ্চয়ই কোথাও গিয়েছে। দুজনে সুলতানার ঘরে এসে আবিষ্কার করলেন সেখানে জসিম এবং সুলতানা আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে ঘুমোচ্ছে। নিসঃঙ্গ দুজন তরুণ–তরুণীর মাঝে যে এক ধরনের ঘনিষ্ঠতার সৃষ্টি হয়েছে তারা সেটি আঁচ করতে পেরেছিলেন কিন্তু সেই ঘনিষ্ঠতা কোন পর্যায়ে গিয়েছে তারা বুঝতে পারেন নি। খোরাসানী এবং লিলি দুজনে মিলে সুলতানাকে আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে ধরাধরি করে উপরে নিয়ে এলেন। নিউরন ম্যাপিং যন্ত্রের নিচে রাখা বড় ট্রলিতে শুইয়ে রেখে তাকে স্ট্র্যাপ দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নিলেন। পাশাপাশি অন্য একটি ট্রলিতে লিলি শুয়ে পড়লেন। খোরাসানী তাকেও স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধতে গেলেন, লিলি আপত্তি করে বললেন, আমাকে বাধছ কেন?

খোরাসানী মৃদু হেসে বললেন, তুমি যদি সবসময় তুমিই থাকতে আমার বাঁধার দরকার ছিল না। কিন্তু খানিকক্ষণ পর তোমার শরীরে ওই মেয়েটি এসে হাজির হবে–তখন সে এটা মেনে নেবে না, ছটফট করবে, চিৎকার করে বাধা দেবে

লিলি মাথা নাড়লেন, বললেন, তা ঠিক। বাধ, আমাকেই তাহলে শক্ত করে বাঁধ!

খোরাসানী শক্ত করে বাঁধতে বাঁধতে বললেন, তোমাকে আমি অনেকবার দেখিয়েছি কী করতে হবে, আমার নিজের বেলায় পুরো ব্যাপারটা করতে হবে তোমার। মনে আছে তো?

মনে আছে।

তখন তোমার অবশ্যি থাকবে নূতন শরীর!

তা ঠিক–লিলি লোভাতুর দৃষ্টিতে ট্রলিতে শুইয়ে রাখা সুলতানার শরীরের দিকে তাকালেন, একটু পরেই সেটা তিনি পেয়ে যাবেন সেটা এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।

খোরাসানী তার যন্ত্রপাতির প্যানেলে ঝুঁকে পড়লেন, মনিটরের দিকে তাকিয়ে সুইচ স্পর্শ করতেই নিউরন ম্যাপিঙের যন্ত্রটা একটা ভোতা শব্দ করে কাজ করতে লাগল। তিনি তার স্ত্রীর দিকে তাকালেন, চোখ বন্ধ করে নিশ্চল হয়ে শুয়ে আছে, সেখানে নিশ্চয়ই এখন সুলতানা এসে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। মেয়েটি যখন সেটা বুঝতে পারবে কী করবে কে জানে? খোরাসানী জোর করে চিন্তাটা তার মাথা থেকে সরিয়ে দিয়ে সুলতানার দেহের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। আর কিছুক্ষণেই এই শরীরটি হবে তার স্ত্রীর। খোরাসানী জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকেন, অনভ্যস্ত উত্তেজনায় তার শরীরে শিহরন বয়ে যেতে থাকে।

পুরো ব্যাপারটি শেষ হতে হতে প্রায় ভোররাত হয়ে গেল। খোরাসানী এবং লিলি কোনোরকম সমস্যা ছাড়াই জসিম আর সুলতানার শরীরে স্থানান্তরিত হয়েছেন, ব্যাপারটিতে অভ্যস্ত হওয়া দূরে থাকুক তারা এখনো সেটা বিশ্বাসই করতে পারছেন না। তারা অবাক বিস্ময়ে নিজেদের দেখছেন, কিছুক্ষণ আগেও যখন দু পা যেতেই তারা হাঁপিয়ে উঠতেন এখন হঠাৎ করে সমস্ত শরীরে এসে ভর করেছে এক বিস্ময়কর সজীবতা, অচিন্তনীয় শক্তি। নির্জীব দেহের বদলে প্রাণশক্তিতে ভরপুর তাজা তরুণ দেহ, তার মাঝে হঠাৎ করে আবিষ্কার করছেন এক ধরনের শারীরিক কামনা। তারা একজন আরেকজনকে দেখে একটু পরে পরে চমকে উঠছেন, তারপর ভুল বুঝতে পেরে নিজেরাই খিলখিল করে হেসে উঠছেন।

জ্ঞান ফিরে পাবার পর খোরাসানী এবং লিলির দেহে জসিম আর সুলতানা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। সুলতানার দেহে লিলিকে দেখে জসিম খোরাসানীর শরীরের ভিতর থেকে কাতর গলায় ডেকে বলল, সুলতানা, আমার কী হয়েছে? আমাকে বেঁধে রেখেছে কেন?

লিলি সুলতানার দেহ নিয়ে এগিয়ে এসে বললেন, আমি তোমার সুলতানা নই!

তাহলে সুলতানা কই?

লিলি তার এককালীন শীর্ণ দেহটি দেখিয়ে বললেন, ওই যে তোমার সুলতানা! তোমার ভালবাসার মেয়ে।

খোরাসানীর দেহটি লিলির শীর্ণ দেহটি দেখে চমকে উঠে মাথা নেড়ে বলল, কী বলছ তুমি?

ঠিক এ রকম সময় খোরাসানী একটা সিরিঞ্জে করে খানিকটা বিষ নিয়ে এলেন। তীব্র বিষ, রক্তের সাথে মিশে গেলে কিছুক্ষণের মাঝেই শরীরের স্নায়ু বিকল হয়ে দেহ অসাড় হয়ে যাবে, হৃৎপিণ্ড থেমে যাবে। খোরাসানীকে দেখে জসিম ভয়ানক চমকে উঠল, আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল, কারণ সেটি তার নিজের শরীর। সে হতচকিত চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দুর্বল গলায় বলল, তুমি কে?

খোরাসানী মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, আমি হচ্ছি তুমি। কিংবা যদি ইচ্ছে কর তাহলে বলতে পার তুমি হচ্ছ আমি।

জসিম খোরাসানীর দেহ থেকে বিভ্রান্ত শূন্য দৃষ্টিতে নিজের দেহের দিকে তাকিয়ে রইল। খোরাসানী বললেন, পুরো ব্যাপারটা তোমার পক্ষে বোঝা কঠিন। কাজেই ধরে নাও এটা হচ্ছে একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন। আমি তোমাকে একটা ইনজেকশান দিচ্ছি, তুমি তাহলে দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে।

খোরাসানী সিরিঞ্জ নিয়ে এগিয়ে এলেন, জসিম তার রুগণ দুর্বল দেহে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল কিন্তু লাভ হল না, তার শিরার মাঝে ভয়ঙ্কর একটি বিষ প্রবেশ করিয়ে দেয়া হল।

সিরিঞ্জে বিষ ভরে খোরাসানী যখন লিলির শীর্ণ দেহে আটকে থাকা সুলতানার দিকে এগিয়ে গেলেন সে কাতর গলায় বলল, এটা কি সত্যি? নাকি মিথ্যা?

লিলি বললেন, তোমার কী মনে হয়?

মিথ্যা! নিশ্চয়ই মিথ্যা!

লিলি খিলখিল করে হেসে উঠলেন, বললেন, নাগো ঘাগী বুড়ি,! এটা মিথ্যা না! এটা সত্যি

খোরাসানী যখন লিলির শীর্ণ হাতের একটি শিরায় বিষ প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছিলেন সেই দেহে আটকে থাকা সুলতানা বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে ছিল আতঙ্ক, অবিশ্বাস এবং গম্ভীর হতাশা।

.

খোরাসানী এবং লিলির দেহ–যে দেহ দুটিতে জসিম এবং সুলতানার মৃত্যু ঘটেছে, খোরাসানী এবং লিলি তাদের নিজেদের বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিলেন। পুরো ব্যাপারটিকে জোড়া আত্মহত্যা হিসেবে দেখাতে হবে, আগে থেকে তার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। আত্মহত্যার আগে লিখে যাওয়া চিঠিটা অনেক আগেই লিখে রাখা হয়েছে, গুছিয়ে লেখা চিঠি, মৃত্যুর পরে সেটা প্রকাশ করার কথা। সুদীর্ঘ চিঠি, সেটা শুরু হয়েছে এভাবে : “আমি এবং আমার স্ত্রী জীবনের ভারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমাদের শরীর দুর্বল, জীবনীশক্তি তার শেষ বিন্দুতে এসে পৌঁছেছে। দৈনন্দিন কাজও আমরা আর নিজেরা করতে পারি না, এক একটি দিন এখন আমাদের জন্যে এক একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। আমাদের জীবনকে এভাবে টেনে নিতে নিতে আমরা আজ সত্যিই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তাই অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করেছি পৃথিবী থেকে আমরা বিদায় নেব সম্মানের সাথে। আমরা দুজন একজন আরেকজনের জীবনসঙ্গী এবং জীবনসঙ্গিনী হিসেবে কাটিয়ে এসেছি, পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার সময়েও আমরা একজন আরেকজনের হাত ধরে বিদায় নেব।….”

চিঠির পরের অংশে কীভাবে আত্মহত্যা করবে তার বর্ণনা দেয়া আছে। মৃত্যু নিয়ে দার্শনিক কথাবার্তা আছে, ব্যাপারটিকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করা আছে। সুন্দর করে লেখা হয়েছে, পড়তে গিয়ে চোখের কোনায় পানি এসে যেতে পারে। চিঠির শেষ অংশে জসিম আর সুলতানার কথা লেখা এভাবে :

“মৃত্যুর আগে আগে আমরা জসিম আর সুলতানাকে এনেছিলাম আমাদের দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করার জন্যে। তারা দুজন আমাদের দুই অথর্ব বৃদ্ধ–বৃদ্ধার দিকে ভালবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। বেশিদিন আমরা তাদের ভালবাসার স্পর্শ নিতে পারি নি কিন্তু যেটুকু নিয়েছি তাতে মুগ্ধ হয়েছি। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তাদের জীবন সুন্দর হোক। আমাদের যৎকিঞ্চিত সম্পত্তি, বাড়িঘর তাদের দান করে গেলাম– দুজনে এটি দিয়ে যেন তাদের জীবন শুরু করতে পারে। পৃথিবী থেকে বিদায়। সবার জন্যে রইল প্রাণভরা ভালবাসা।….”

চিঠির নিচে প্রফেসর খোরাসানী এবং লিলি পরিষ্কার করে স্বাক্ষর দিয়েছেন, আজকের তারিখ লিখে দিয়েছেন।

চিঠিটা ভাঁজ করে টেবিলের পাশে রাখা হল, তার কাছে রাখা হল, বিষ–মাখানো ইনজেকশানের সিরিঞ্জ। খোরাসানী এবং লিলির দেহ শুইয়ে রেখে চাদর দিয়ে বুক পর্যন্ত ঢেকে দেয়া হল, হাতগুলো বুকের উপর ভাজ করে রাখা, চোখ দুটি বন্ধ।

সবকিছু শেষ করে জসিম এবং সুলতানার দেহে খোরাসানী এবং লিলি মাত্র অভ্যস্ত হতে শুরু করেছেন ঠিক সেই মুহূর্তে নিচে দরজায় শব্দ হল, সাথে সাথে দুজনেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলেন। রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছে, এই সময়ে কে আসতে পারে?

খোরাসানী এবং লিলি একজন আরেকজনের দিকে আতঙ্কিত চোখে তাকালেন এবং ঠিক তখন দরজায় আবার শব্দ হল, এবারে আগের থেকেও জোরে। খোরাসানী পা টিপে টিপে নিচে এসে উঁকি দিলেন, বাইরে বেশ কয়জন পুলিশ শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। খোরাসানী আবার চমকে উঠলেন, এত রাতে পুলিশ কেন এসেছে? দরজায় আবার শব্দ হল, খোরাসানী নিজেকে সামলে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।

দরজা খোলার আগে খোরাসানী একবার লিলির দিকে তাকালেন, লিলি দরজা ধরে পাংশু মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন, দুর্বলভাবে হেসে খোরাসানীকে একটু সাহস দেবার চেষ্টা করলেন।

দরজা খোলার সাথে সাথে প্রায় হুড়মুড় করে ভিতরে পুলিশগুলো ঢুকে পড়ল, অফিসার ধরনের একজন খোরাসানীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি জসিম?

খোরাসানীর প্রথম প্রতিক্রিয়া হল অপমান এবং ক্রোধ, তিনি একজন সম্মানী, বিজ্ঞানী, এর আগে কেউ তাকে এভাবে হেয় করে সম্বোধন করে নি। কিন্তু তিনি দ্রুত তার অপমান এবং ক্রোধকে নিবৃত্ত করে নিলেন কারণ তিনি আর প্রফেসর খোরাসানী নন, সত্যিই তিনি জসিম, একজন পরিচারক। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ আমি জসিম।

সাথে সাথে একজন কনস্টেবল তাকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল, তিনি আর্তনাদ করে বললেন, কী হয়েছে? কী হয়েছে?

কী হয়েছে জান না? পুলিশ অফিসার ধমক দিয়ে বললেন, ফাজলামোর আর জায়গা পাও না?

আরেকজন কনস্টেবল বলল, স্যার মেয়েছেলেটাকেও বাঁধব?

হ্যাঁ, হ্যাঁ বেঁধে ফেল, ছেড়ে দিও না যেন।

কিছু বোঝার আগেই লিলিকে, যে সুলতানার দেহে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, হাতকড়া দিয়ে বেঁধে ফেলা হল। লিলি ভয়ার্ত গলায় বললেন, কী হয়েছে? কী করেছি আমরা?

পুলিশ অফিসারটি মুখ ভ্যাংচে বললেন, ন্যাকামো দেখে মরে যাই! কিছু যেন জানে না। এক সপ্তাহ থেকে তোমাদের ওয়াচ করা হচ্ছে।

আমাদের? খোরাসানী কাঁপা গলায় বললেন, ওয়াচ করা হচ্ছে?

হ্যাঁ। যখন দেখেছি প্রফেসর সাহেবের বাড়ির জিনিসপত্র চুরি করে বিক্রি করা শুরু করেছ সাথে সাথে তোমাদের পিছু লোক লাগানো হয়েছে! আজ যখন বিষ কিনলে

বিষ? আ–আ–আমি বিষ কিনেছি?

পুলিশ অফিসার প্রফেসর খোরাসানীর সাথে কথা বলার কোনো উৎসাহ দেখালেন না, একজনকে বললেন, যাও দেখি, প্রফেসর সাহেবকে ডেকে আন, তার জিনিসপত্র চিনে নিন।

কনস্টেবলটি ভিতরে চলে গেল, পুলিশ অফিসার তার হাতের ব্যাগ থেকে কিছু জিনিসপত্র বের করে টেবিলে রাখতে লাগলেন, ঘড়ি আংটি ছোটখাটো সোনার গয়না। প্রফেসর খোরাসানী চিনতে পারলেন এগুলো তার এবং লিলির। জসিম এবং সুলতানা গোপনে বিক্রি করেছে?

ঘরের ভিতর থেকে হঠাৎ ভয়ার্ত গলার স্বর শোনা গেল, কনস্টেবলটি ছুটতে ছুটতে এসে বলল, স্যার! সর্বনাশ হয়ে গেছে!

পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে?

মেরে ফেলেছে।

মেরে ফেলেছে?

জি স্যার, দুজনকেই। প্রফেসর খোরাসানী আর তার স্ত্রী। দুজনেই ডেড।

পুলিশ অফিসার রক্তচোখে খোরাসানীর দিকে তাকালেন, তারপর হিসহিস করে বললেন, স্কাউনড্রেল! মার্ডারার!

খোরাসানী শুষ্ক গলায় বললেন, এটা আত্মহত্যা। এটা মার্ডার না। আপনি দেখেন খোঁজ নিয়ে।

তুমি কেমন করে জান?

আমি– আমি জানি। দেখেন চিঠি লেখা আছে—

পুলিশ অফিসার চোখ ঘোট ঘোট করে বললেন, আর চিঠিতে কী লেখা আছে বলব?

কী?

লেখা আছে সমস্ত সম্পত্তি তোমাদের দিয়ে গেছেন, তাই না?

খোরাসানী হঠাৎ তার সজীব দেহ নিয়েও দুর্বল অনুভব করতে থাকেন। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বললেন, কি–কি–কিন্তু 

তোমাদের মতো কেস আমরা অনেক দেখেছি। বুড়ো স্বামী–স্ত্রীকে মেরে বলবে আত্মহত্যা, দেখা যাবে চিঠিতে লিখা সমস্ত বাড়িঘর লিখে দিয়ে গেছে। আমরা কি কচি খোকা, নাকি আমাদের নাক টিপলে দুধ বের হয়?

খোরাসানী কী বলবেন বুঝতে পারলেন না, ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে রইলেন। পুলিশ অফিসার ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে বললেন, শুধু যে সম্পত্তি দিয়ে চিঠি লিখে গেছে তাই না, হাতের লেখাটাও তোমার! তাই না?

প্রফেসর খোরাসানী মাথা নাড়লেন, না!

দেখি একটা কাগজ দাও দেখি, পুলিশ অফিসার একজন কনস্টেবলকে ডেকে বললেন, এই ব্যাটা ধড়িবাজের হাতের লেখার একটা নমুনা নিয়ে নিই!

প্রফেসর খোরাসানীর হাতকড়া খোলা হল, তাকে একটা কাগজ আর কলম দেয়া হল, পুলিশ অফিসার ধমক দিয়ে বললেন, লেখ।

কী লিখব?

তোমার নাম লেখ।

প্রফেসর খোরাসানী অন্যমনস্কভাবে নিজের নাম স্বাক্ষর করলেন এবং হঠাৎ করে তার মনে পড়ল আত্মহত্যার চিঠিতে এই নাম হুবহু এভাবে স্বাক্ষর করা আছে। নিজের অজান্তে তিনি মৃত্যু পরোয়ানাতে স্বাক্ষর করে দিয়েছেন!

ঘণ্টাখানেক পর দেখা গেল পুলিশের গাড়িতে করে জসিম এবং সুলতানা নামের দুজন কমবয়সী তরুণ–তরুণীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কেউ জানতে পারল না প্রফেসর খোরাসানী এবং তার স্ত্রী লিলিকে হত্যা করার জন্যে প্রফেসর খোরাসানী এবং তার স্ত্রীকেই গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।

Share on FacebookShare on TwitterShare on WhatsAppShare on TelegramShare on SMS
Category: রবোনগরী
পূর্ববর্তী:
« দ্বিতীয় অনুভূতি
পরবর্তী:
ব্যাংক ডাকাত »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑