১৬. সবাই রুদ্ধ নিশ্বাসে

সবাই রুদ্ধ নিশ্বাসে যেন কিরীটীর কথা শুনতে থাকে।

কিরীটী বলে, আপনারা হয়ত সবাই জানেন গত ২৩শে জুলাই এই অঞ্চলে রাত দশটা পঁয়তাল্লিশ থেকে সোয়া এগারোটা পর্যন্ত ইলেকট্রিক কারেন্ট বন্ধ থাকায় এই অঞ্চলটা ঐ আধ ঘণ্টা সময় অন্ধকার হয়ে ছিল। সেই সময়ের মধ্যেই হত্যাকারী এই ঘরের মধ্যে কৌশলে ব্রজদুলালবাবুর মৃত্যু-ফাঁদ পাতে—যে ফাঁদে ব্রজদুলালবাবু অবধারিত ভাবে পা দেন নিজের অজ্ঞাতেই।

মৃত্যুফাঁদ! মৃদুকণ্ঠে কথাটা উচ্চারণ করে সাধন মিত্র।

হ্যাঁ, মৃত্যুফাঁদ। ডেথ-ট্র্যাপ। এবং মৃত্যুফাঁদটা কি ছিল জানেন—একটা টেবিল ল্যাম্প?

টেবিল-ল্যাম্প? কথাটা বলে যেন হাঁ করে তাকায় সাধন মিত্র কিরীটীর মুখের দিকে।

হ্যাঁ মিঃ মিত্র, একটা টেবিল-ল্যাম্প। যে টেবিল-ল্যাম্পটা ঐ ত্ৰিপয়ের উপরে বরাবর থাকত এবং যেটা সে-রাত্রে ব্রজদুলালকে হত্যা করবার পর হত্যাকারী সেই রাত্রেই সরিয়ে ফেলে ঐ নতুন টেবিল-লাম্প ঐখানে রেখে দেয়।

ঐ টেবিল-ল্যাম্পটা—

একটা নতুন ল্যাম্প। এবং অরিজিন্যাল ল্যাম্পটা সরিয়ে ঐ নতুন ল্যাম্পটা রেখেই হত্যাকারী সে রাত্রের তার হত্যার নিদর্শন রেখে গিয়েছে তার নিজের অজ্ঞাতে। এমনিই হয়, ভগবানের বিচারে পাপের ছাপ এমনি করেই হত্যাকারী তার অজ্ঞাতে রেখে যায়। আর ঐ ল্যাম্পটাই আমাকে সত্যের সন্ধান দিয়েছে।

সুখময় মল্লিক বলেন, ব্যাপারটা কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারছি না মিঃ রায়।

কেন বুঝতে পারছেন না সুখময়বাবু? ময়না তদন্তের রিপোর্ট থেকে আমরা জেনেছি সেরাত্রে হাই ভোলটেজের ইলেকট্রিক কারেন্ট পাস করবার জন্যই ব্রজদুলালবাবুর আকস্মিক মৃত্যু ঘটেছিল, কেমন কিনা?

হ্যাঁ।

সেই কারেন্ট পাস করানো হয়েছিল, যে টেবিল-ল্যাম্পটার কথা বলছি সেটারই ভিতর দিয়ে।

কিন্তু সেই অরিজিন্যাল টেবিল-ল্যাম্পটি গেল কোথায়? প্রশ্ন করেন সুখময় মল্লিক।

মিস রেবেকা মণ্ডলকে জিজ্ঞাসা করুন, উনিই হয়ত বলতে পারবেন কোথায় সে ল্যাম্পটা।  

কিরীটীর মুখ থেকে কথাটা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সকলের দৃষ্টি যেন একসঙ্গে গিয়ে পড়ল ঘরের মধ্যে দণ্ডায়মানা রেবেকার উপরে।  

রেবেকা প্রথমটায় বোধ হয় একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে ওঠে, হোয়াট ড়ু ইউ মিন! এ কথার আপনার অর্থ কি মিঃ রায়, আমি জানতে চাই। ইট ইজ নট অনলি ইনসালটিং-ড্যামেজিং টু।

কিরীটী মৃদু হেসে একবার রেবেকার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, অবশ্যই ড্যামেজিং মিস মণ্ডল এবং ড্যামেজিং যে হতে পারে সেটা অন্ততঃ আপনার মত বুদ্ধিমতী মেয়ের পক্ষে পূর্বেই বোঝা উচিত ছিল।

What do you mean? কি বলতে চান আপনি?

বলতে চাই ল্যাম্পটা আপনারই ঘরে আলমারির টানার মধ্যে পাওয়া গিয়েছে।

What? কি বললেন?

যা বললাম তা তো আপনার অজানা নয় মিস মণ্ডল।

সাজানো-মিথ্যা একটা ষড়যন্ত্র!

কোর্টে তাই বলবেন—বলেই জীবনের দিকে তাকিয়ে কিরীটী শুধায়, ল্যাম্পটা কোথায় তুমি পেয়েছিলে জীবন?

আজ্ঞে সেক্রেটারী মেমসাহেবের ঘরে—

চিৎকার করে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে রেবেকা, জীবন, ইউ লায়ার–

লায়ার ও নয় মিস মণ্ডলল্যাম্পটা সত্যিই ও আপনার ঘরে পেয়েছিল। ওকে আমি বাড়ির সর্বত্র ল্যাম্পটা খুঁজে দেখতে বলেছিলাম। ও আপনার ঘরে আলমারির ড্রয়ারের মধ্যেই। সেটা খুঁজে পেয়ে আমাকে পৌঁছে দেয়।

সুশান্ত জড়িত কণ্ঠে বলে ওঠে, তাহলে মেমসাহেব, তুমিই–  

না সুশান্তবাবু—ঠিক উনি নন—যদিও উনি সাহায্যকারিণী ছিলেন সে-রাত্রের ব্যাপারে। কিরীটী বলে ওঠে।

সাধন মিত্র এতক্ষণ একপাশে চুপ করে যেন পাথরের মতই দাঁড়িয়েছিল।

সমস্ত মুখখানা তখন তার ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য।

তার দিকে তাকিয়ে এবার কিরীটী বললে, সাধনবাবু, নারীর মন বড় বিচিত্র বস্তু! তা হলেও এটা আপনার মত একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তির অন্ততঃ বোঝা উচিত ছিল। যে নারী একজনের সঙ্গে স্বার্থের জন্য প্রেমের খেলা খেলতে পারে, সে আর একজনের সঙ্গেও পারে। এখন বোধ হয় বুঝতে পারছেন, ইউ হ্যাভ বিন ডিসিঙ্! আপনিও প্রতারিত হয়েছেন!

সাধন মাথা নীচু করে।

কিরীটী বলে, তবে আপনার দুঃখের কোন কারণ নেই। ঐ রেবেকা মণ্ডল যেমন আপনাকে প্রেমের ব্যাপারে প্রতারণা করেছে তেমনি নিজেও প্রতারিত হয়েছে। ও জানে না এখনও যে, ও নিজে যেমন আপনার সঙ্গে প্রেমের খেলা খেলেছে, তেমনি প্রশান্ত সাহাও ওর সঙ্গে নিতান্তই স্বার্থের খাতিরেই প্রেমের খেলা খেলেছে এতদিন।

সহসা যেন রেবেকা পাগলের মতই চিৎকার করে ওঠে, না–না—এ অসম্ভব—

কিরীটী ওই সময় বলে ওঠে, না প্রশান্তবাবু, এ ঘর থেকে বেরুবার চেষ্টা করবেন না–

প্রশান্ত সবার অজ্ঞাতে দরজার দিকে এগুচ্ছিল পায়ে পায়ে, হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়।

কিরীটী সুখময়ের দিকে তাকিয়ে বলে, মিঃ মল্লিক, পুট হিম আণ্ডার অ্যারেস্ট।

সুখময় মল্লিক সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে প্রশান্তর হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেন।