১০. কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলে না

অতঃপর উভয় পক্ষই কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলে না।  

সুখময় মল্লিক বোধ হয় ভাবছিলেন, আর কি প্রশ্ন তাঁদের থাকতে পারে সাধন মিত্রকে।  

কিরীটীর মুখের দিকে তাকান সুখময় মল্লিক।  

কিরীটী একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করছিল একটা জ্বলন্ত কাঠি দিয়ে, সিগারটা ধরে উঠলে কাঠিটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে ফেলে দিয়ে তাকাল আবার সাধন মিত্রের মুখের দিকে।

আচ্ছা মিঃ মিত্র, মিঃ সাহার আত্মীয়স্বজন কে কোথায় আছে জানেন কিছু?

তাঁর বড় ভাইয়ের দুটি ছেলে ও একটি মেয়ে আছে জানি।

দুই ছেলে, এক মেয়ে?

হ্যাঁ। এবং তাঁদের সম্পর্কে যতটুকু জানি—একজন প্রশান্ত সাহা, বেশীদূর লেখাপড়া শেখেননি, এই কলকাতা শহরেই অ্যালান ইলেকট্রিক্যালস কোম্পানীতে চাকরী করেন। বিয়ে-থা শুনেছি করেননি। দ্বিতীয় সুশান্ত সাহা আই. এ. পর্যন্ত পড়েছিলেন, শেয়ার মার্কেটের দালাল, ভালই বোধ হয় উপায় করেন। তবে নেশা ও রেসের মাঠে শুনেছি পকেট সর্বদাই খালি থাকে। ভাইঝি শ্রীমতী দেবী, হাসপাতালের নার্স। বিয়ে-থা করেননি।

তাঁরা এ বাড়িতে যাতায়াত করেন না?

শ্ৰীমতী দেবী দু-একবার মনে পড়ে এসেছেন। তবে ভাইপোদের কখনও তিনি বাড়িতে ঢুকতে দিতেন না। তবু অবিশ্যি মধ্যে মধ্যে সুশান্ত ঝড়ের মত তাঁর অফিসে গিয়ে হাজির হতেন।

কেন?

টাকার জন্য।

টাকা দিতেন মিঃ সাহা ভাইপোকে?

দিতেন। ভীষণ চটে রাগারাগি করতেন, কিন্তু দিতেন। কারণ আমার মনে হয়েছে বরাবর, ঐ জুয়াড়ী, নেশাখোর উচ্ছৃঙ্খল লোকটাকে মুখে রাগারাগি করলেও উনি ভালই বোধ হয় সত্যি বাসতেন তাঁকে ভাইপো-ভাইঝিদের মধ্যে।

আচ্ছা, প্রশান্তবাবু আসতেন না কখনও তাঁর কাকার কাছে?

না। আসতে তাঁকে কখনও দেখিনি।

আচ্ছা সাধনবাবু, কোন উইল মিঃ সাহা করে গিয়েছেন বলে জানেন?

করেছেন বলেই জানি।

নিশ্চয় করে জানেন না কিছু।

না। তবে আপনি সাহা কোম্পানীর সলিসিটার রূপচাঁদ চ্যাটার্জীকে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন। তিনি সব জানেন।  

সাধন মিত্রের কথাটা শেষ হল না, ঘরের মধ্যে সুট-পরিহিত সাতাশ-আঠাশ বৎসরের একটি সুশ্রী যুবক এসে ঢুকল।  

আগন্তুক কারোর দিকে না তাকিয়ে একেবারে সোজাসুজি সাধনের দিকেই তাকিয়ে বলে, এই যে সাধন মিত্তির, হোয়াট অল দিস? কাকা নাকি সুইসাইড করেছে?

সাধন মিত্র কোন জবাব দেয় না। তার আগেই সুখময় মল্লিক আগন্তুকের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন, কে আপনি জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?  

সুখময়ের প্রশ্নে আগন্তুক ফিরে তাকাল সুখময়ের দিকে, কে আমি? ইয়েস পুলিস অফিসার,

অফ কোর্স ইউ ক্যান আস্ক দ্যাট। আমার নাম সুশান্ত সাহা।

আপনি কার কাছে শুনলেন সুশান্তবাবু যে আপনার কাকা সুইসাইড করেছেন?

কার কাছে আবার—আজ অফিসে গিয়েই তো শুনলাম।

আজ কখন অফিসে গিয়েছিলেন আপনি? কিরীটী এবারে প্রশ্নটা করল।

কেন, দুপুরবেলা।

আপনার দাদা কোন সংবাদ পাননি?

গড নোস!

আপনি দেননি?

নো স্যার।  

কেন?

কেন আবার কি? ইট ইজ দেয়ার হেডেক, নট মাইন। কথাটা বলে সুশান্ত সাহা ঘর থেকে। বের হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কিরীটীর ইঙ্গিতে সুখময় তাকে ডাকল, সুশান্তবাবু, কোথায় যাচ্ছেন?

উপরে।

কিরীটী বলে, এখন যাবেন না।

যাব না? বাট হোয়াই? কেন যাব না বলুন তো? তাছাড়া who are you?

আমি থানার ও সি—সুখময় বললেন।

O.C.–I see! তা আমি উপরে যাব না কেন—শুনতে পারি কি?

জীবিত থাকতে তিনি আপনার এবাড়িতে আসা যখন পছন্দ করতেন না তখন তাঁর উইল না জানা পর্যন্ত আপনাকে তো আমরা এ বাড়ির উপরে যেতে দিতে পারি না!

পারেন না! বাঁকা দৃষ্টিতে তাকাল সুশান্ত সুখময়ের দিকে।

না।

ননসেন্স! আমার নিজের কাকার বাড়ি এটা—আর আমরাই তাঁর সব।

তা আমরাও জানি সুশান্তবাবু-তবু সেটা এখনও প্রমাণসাপেক্ষ। কিরীটী শান্তকণ্ঠে বলে।

মানে! কি আবার প্রমাণসাপেক্ষ—আমরা তাঁর ভাইপো কিনা?

না। তাঁর মৃত্যুর পর আপনাদের এ বাড়িতে প্রবেশের কোন সত্যিকারের আইনত অধিকার আছে কিনা সেইটাই প্রামণসাপেক্ষ।

প্রমাণসাপেক্ষ। তা আমাদের নেই তো কার আছে শুনি? আইনত তাঁর যাবতীয় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী আমরা ছাড়া আর কারা?

কথাটা আপনার যেমন মিথ্যা নয় সুশান্তবাবু তেমনি এও মিথ্যা নয় যে জীবিত থাকাকালীন কোনদিন আপনাদের এখানে তিনি প্রবেশ করতে দেননি।

কে বললে?

যেই বলুক কথাটা যে সত্যি, আপনি কি অস্বীকার করতে পারেন?  

নিশ্চয়ই করি। নিশ্চয়ই ঐসব আজগুবী কথা সাধন মিত্তির বলেছে আপনাদের! ও কে? দেখে নেব সাধন মিত্তির, আমিও সুশান্ত সাহা–

কথাটা বলে সাধনের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বোধ হয় ঘর থেকে পুনরায় বেরিয়ে যাবার জন্য পা বাড়ায় দরজার দিকে সুশান্ত।

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী আবার বাধা দেয়, যাবেন না সুশান্তবাবু, আপনার সঙ্গে আরও কিছু আমাদের কথা আছে।

ঘুরে দাঁড়াল সুশান্ত সাহা দরজার মাঝবরাবর গিয়ে এবং জ্ব-দুটো কুঁচকে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বলে, কথা আছে—আমার সঙ্গে?

হ্যাঁ।  

কিন্তু আমার আপনার সঙ্গে কোন কথা নেই। বলে আবার পা বাড়াবার চেষ্টা করে সুশান্ত।

বাধা দিলেন এবারে সুখময় মল্লিক, আপনার না থাকলেও আমাদের আছে। দাঁড়ান।

আমি যদি না শুনি আপনাদের কথা, আমাকে জোর করে শোনাবেন নাকি?

শান্ত কণ্ঠে এবার কিরীটীই বলে, প্রয়োজন হলে শোনাতে হবে বৈকি। শুধু আপনি কেন, তাঁর আত্মীয়স্বজন বা পরিচিতদের মধ্যে প্রত্যেকেই যাঁরা তাঁর সম্পত্তির ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড তাঁদের প্রত্যেককেই আমাদের প্রয়োজন। কারণ—

কারণ?

কারণ—ব্রজদুলালবাবু আত্মহত্যা করেন নি, তিনি নিহত হয়েছেন।

কি—কি বললেন?

বললাম কেউ তাঁকে হত্যা করেছে এবং তাদেরই কারও পক্ষে সেটা সম্ভব বেশী যারা তাঁর সম্পত্তির ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড ছিল।

সুশান্ত অতঃপর কিছুক্ষণ যেন কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে, তারপর শান্ত কণ্ঠে বলে, আই সি! তাহলে আপনার ধারণা আমাদের মধ্যেই কেউ-না-কেউ তাঁকে হত্যা করেছি তাঁর সম্পত্তির লোভেই?

আপাততঃ সেটাই কি স্বাভাবিক ভাবে মনে হয় না সুশান্তবাবু?

চমৎকার। তাহলে এই ধরে নেব যে আপনারা আমাকে কাকার সম্ভাব্য হত্যাকারী হিসাবে অ্যারেস্ট করবেন?

না, অ্যারেস্ট করছি না।

তবে? যতক্ষণ না আপনাদের প্রত্যেকের উপর থেকে পুলিসের সন্দেহ সম্পূর্ণভাবে দূর হয়, আপনারা প্রত্যেকেই সন্দেহের তালিকার মধ্যে থাকবেন। বললে আবার কিরীটী।

হুঁ। তাহলে এখন আমাকে কি করতে হবে সেটা জানতে পারি কি?

হ্যাঁ, যতক্ষণ না এই ব্যাপারের সম্পূর্ণ মীমাংসা হয় আপনি এ বাড়িতে যেমন ঢুকতে পারবেন না তেমনি আপনার বর্তমান কলকাতার রেসিডেন্স থেকে কোথাও যেতে পারবেন না পুলিসের পারমিশন ব্যতীত।

বেশ তাই হবে।

আপনি এবারে যেতে পারেন।

সুশান্ত সাহা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।