১৩. কলিং বেলের শব্দে

কলিং বেলের শব্দে দরজা খুলে দিয়ে সুভদ্রা যেন একটু অবাকই হয়, কিরীটীবাবু আপনি!

হ্যাঁ, একটা কথা গত সন্ধ্যায় জিজ্ঞাসা করা হয়নি। চলুন না ভিতরে।

আসুন। অনাসক্ত গলায় সুভদ্রা কিরীটীকে যেন আহ্বান জানালে।

গত রাত্রের সেই ঘর। শয্যাটা এলোমেলো হয়ে আছে এখনও। তখনও গুছিয়ে পাট করা হয়নি শয্যাটা।  

কিরীটী একবার আড়চোখে শয্যাটা দেখে নিলে। শুনলাম শ্যামলবাবু যাত্রাদলের চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন? কিরীটী কথাটা বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুভদ্রার মুখের দিকে তাকাল।

তাই নাকি! শুনিনি তো–কে বললে?

শুনলাম। তাহলে আপনিও বোধ হয় ঐ দল থেকে চলে যাবেন?

না। তা কেন যাব?

যাবেন না! শ্যামলবাবু চলে যাবেন, অথচ আপনি—

তার যদি না পোয় তো সে চলে যাবে, আমি চাকরি ছাড়তে যাব কেন?

শ্যামলবাবু যদি আপত্তি করেন?

করবে না—আর করলেই বা!

তা আপনাদের বিয়েটা কবে হচ্ছে?

বিয়ে?

হ্যাঁ, শ্যামলবাবুর আর আপনার?

হন্তদন্ত হয়ে ঐ সময় রাধারমণ পাল এসে ঘরে ঢুকল, সুভদ্রা, শুনেছ?

রাধারমণ পাল কিরীটীকে লক্ষ্য করেনি প্রথমটায়, কিন্তু কথাটা বলতে গিয়ে হঠাৎ নজরে পড়ে গেল কিরীটীকে।

একটু থেমে, যেন থতমত খেয়ে বললে, কিরীটীবাবু, আপনি?

কি হয়েছে পাল মশাই? কিরীটী শান্ত গলায় প্রশ্ন করল।

সুজিতকে গতরাত্রে সে যখন বাড়ি ফিরছে, তার গলির মধ্যে কারা যেন পিছন থেকে ছোরা মেরেছে।

সে কি! একটা ভয়ার্ত স্বর যেন বের হয়ে এল সুভদ্রার কণ্ঠ থেকে।

রাতে কখন? কিরীটী আবার শান্ত গলায় প্রশ্ন করল, মানে রাত কটা হবে?

ও তো বলছে রাত প্রায় বারোটা সোয়া-বারোটা হবে।

সুজিতবাবু এখন কোথায়?

বাঙ্গুর হাসপাতালে—কেবল একটু আগে হাসপাতাল থেকে আমাকে অফিসে ফোন করেছিল।

কে?

সুজিত।

আঘাতটা খুব বেশি হয়েছে?

কিরীটী পুনরায় শান্ত গলায় প্রশ্ন করে।

না, খুব বাঁচা বেঁচে গিয়েছে। বাঁ দিককার ঠিক কাঁধের নীচে নাকি হাতের উপর দিয়ে গিয়েছে।

এখন তিনি কোথায়?

তার বাসা কালীঘাটে। আমি তো সেখান থেকেই আসছি।

প্রাণের কোন আশঙ্কা নেই তো পাল মশাই? সুভদ্রা এতক্ষণে প্রশ্ন করে।

নাঃ, খুব বেঁচে গিয়েছে এযাত্রা। নেহাৎ বোধ হয় পরমায়ু ছিল। কিন্তু আমি ভাবছি সুভদ্রা, কে এভাবে আমাদের সর্বনাশ করছে! সেদিন সামন্ত মশাই গেলেন, কাল আবার সুজিতের প্রাণ নেওয়ার চেষ্টা—

পাল মশাই!

হঠাৎ কিরীটীর ডাকে রাধারমণ পাল ওর দিকে ফিরে তাকাল।

বলতে পারেন, হরিদাস সামন্তর কি চোখের অসুখ ছিল?

না তো। কেন?

না—আচ্ছা, আপনাদের দলের আর কেউ কি ইতিমধ্যে চোখের ব্যাপারে ভুগছিলেন?

কেন, আমিই তো কিছুদিন থেকে কষ্ট পাচ্ছি—চোখের ডাক্তার দেখছেন আমার চোখ, চন্দননগরে যেদিন পালা গাইতে যাই তার পরের দিনই বিকেলে ওষুধ লাগিয়ে চোখের ডাক্তারের কাছে আমার যাবার কথা ছিল।

গিয়েছিলেন?

না—দেখছেন তো কি ঝঞ্ঝাটের মধ্যে কটা দিন যাচ্ছে!

তা ঠিক। তা ডাক্তারটি কে?

ডাঃ চ্যাটার্জি, ধর্মতলার আই-স্পেশালিস্ট।

যে ওষুধটা লাগাবার কথা ছিল সে ওষুধটা তৈরী করানো হয়েছিল?

হ্যাঁ, এখনও আমার অফিস-ঘরেই বোধ হয় রয়েছে।  

ফিরে গিয়ে অফিস-ঘরে ওষুধটা আছে কিনা আমাকে একবার জানাবেন—বাড়িতে আমায় ফোন করে আর ঘণ্টা তিনেক বাদে।

বেশ।

ভুলবেন না যেন। আচ্ছা আসি, নমস্কার।

কিরীটী আর দাঁড়াল না। ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

কিরীটী গৃহে ফিরে এল। সুব্রত তখন কৃষ্ণার সঙ্গে গল্প করছিল।

সোফায় বসতে বসতে কিরীটী বললে, মিলে গেছে—দুয়ে দুয়ে চার।

হত্যাকারী তাহলে—

হ্যাঁ। সুব্রতর প্রশ্নের উত্তরে কিরীটী বললে, নিজের হাতেই নিজের মৃত্যুবাণ তুলে দিয়েছে আমার হাতে।

সুব্রত ও কৃষ্ণা দুজনেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।

কিন্ত কোন প্রশ্ন করল না, কারণ ওরা তো জানেই—নিজে থেকে মুখ না খুললে ও-মুখ খোলানো যাবে না।

.

বিকেলের দিকে তিনটে নাগাদ রাধারমণ পালের ফোন এল কিরীটীর কাছে।

সংক্ষিপ্ত দু-চারটে কথা হল। তারপর কিরীটী ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রেখে দিল।

সুব্রত কিরীটীর বাড়িতে ছিল। যায়নি–কৃষ্ণা যেতে তাকে দেয়নি।

কৃষ্ণা, আর একপ্রস্থ চা হলে মন্দ হত না—সুব্রত বললে।

সুব্রতর কথায় কৃষ্ণা উঠে গেল ঘর থেকে।

সুব্রত বললে, চা খেয়ে এবারে যাব।

বোস না, ব্যস্ত কি!

কিরীটী তাকে থাকবার অনুরোধটা জানাল বটে, কিন্তু সুব্রতর মনে হয় কিরীটী যেন একটু অন্যমনস্ক—কেমন যেন ভিতরে ভিতরে একটা অস্থিরতা।

সুব্রত জানে কোন রহস্যের শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছালে কিরীটী অমনি ভিতরে ভিতরে কেমন যেন অস্থির হয়ে ওঠে।

কথা বলে কম এবং সংক্ষিপ্ত। বোঝা যায় ও যেন কথা বলতে চায় না।

কিরীটীর দিকে তাকাল সুব্রত। কিরীটী সোফার উপর হেলান দিয়ে বসে। মুখে জ্বলন্ত সিগার। ধূমপান করছে কি করবে বোঝবার উপায় নেই।

গ্রীষ্মের শেষ প্রহরের ম্লান আলো বাইরে। জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে।

ওর বসবার ভঙ্গিতে নিস্তব্ধতার মধ্যে যেন একটা প্রতীক্ষ্ণর ইঙ্গিত।

কিরীটী কি কারও জন্যে অপেক্ষা করছে? কিংবা কোন সংবাদের জন্য কান পেতে আছে যেন!

কৃষ্ণা জংলীর হাতে ট্রেতে চা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আবার ঘরের কোণে টেলিফোনটা বেজে উঠল।

 কিরীটী যেন একটু দ্রুত চঞ্চল পদবিক্ষেপেই এগিয়ে ফোনের রিসিভারটা তুলে নিল, কিরীটী রায়–কে, সুশান্তবাবু? বলুন, তারপর কৃষ্ণনগরে গিয়েছিলেন? হ্যাঁ হ্যাঁ, মারা গেছে অনেক দিন আগে? হুঁ! ছবি আঁকার অভ্যাস ছিল—ঠিক আছে, ঠিক আছে, ধন্যবাদ।

কিরীটীর কণ্ঠস্বরে চোখে-মুখে যেন একটা চাপা উত্তেজনা স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে।

রিসিভারটা নামিয়েই আবার তুলে নিয়ে ডায়েল করে কিরীটী, হ্যাঁ, হ্যাঁআমি কিরীট রায়-এ্যা, সব ব্যবস্থা করে রাখবেন, ঠিক রাত এগারোটায় যেমন বলেছি মিন্টু করবেন, হ্যাঁ, যেখানে বলেছি সেখানেই।

আবার ফোন নামিয়ে ডায়েল করল কিরীটী কাকে যেন, আমি কিরীটী রায় কথা বলছি যে দুটি ছেলেকে নজর রাখতে বলেছিলেন, তারা যেন এক মুহূর্তের জন্যও নজর না সরিয়ে নেয়। হ্যাঁ, ইনস্ট্রাকশন দিন—সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বাড়িতে ফোন করবে, আপনাকেও সংবাদটা দেবে।

কিরীটী ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রেখে পুনরায় এসে সোফায় গা ঢেলে দিল।

কিরীটীর চোখে-মুখে দুপুর থেকে যে দুশ্চিন্তাটা প্রকট হয়ে উঠেছিল সেটা যেন আর অবশিষ্ট নেই।

মনে হচ্ছে শেষ দাবার চালটি যেন দিলি! সুব্রত বললে।

সূত্রগুলো সবই হাতের মধ্যে এসে গিয়েছে, একটা জায়গায় শুধু একটা ছোট্ট গিট, সেটা খুলতে পারলেই–

 কিরীটীর কথা শেষ হল না, আবার ফোন বেজে উঠল।

কিরীটী এগিয়ে গিয়ে রিসিভারটা হাতে তুলে নিল, কিরীটী রায়। কে, পাল মশাই? তবে কি আপনি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন চন্দননগরে? নেননি—আপনার অফিস-ঘরেই ছিল? আমিও সেই রকমই অনুমান করেছিলাম। খুঁজে পাবেন না তাও জানতাম, কাল সকালে আসবেন।

কিরীটী রিসিভারটা নামিয়ে রেখে দিল, তারপর কৃষ্ণার দিকে ফিরে বললে, কৃষ্ণা, আমি পাশের ল্যাবরেটরী ঘরে আছি। যে কোন সময় একটা ফোন আসতে পারে, এলে আমাকে ডেকো। সুব্রত, যাস না—হয়তো বেরুতে হতে পারে রাত্রে।

 কিরীটী আর কোন কথা বললে না, ঘর থেকে বের হয়ে গেল।