১০. রোগা প্যাঁকাটির মত চেহারা

রোগা প্যাঁকাটির মত চেহারা। তোবড়ানো গাল, কোটরগত চক্ষু দীর্ঘ অত্যাচারের সাক্ষ্য দেয়। দুই চোখে ভীত-সন্ত্রস্ত চাউনি।

আপনারই নাম দোলগোবিন্দ? কিরীটীর প্রশ্ন।

আজ্ঞে, সিকদার।

আপনার সেরাত্রে লাস্ট সিনে চাকরের পার্টে প্রক্সি দেওয়ার কথা ছিল না?

আজ্ঞে।

তবে যাননি কেন?

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘু

মিয়ে পড়েছিলেন!

হ্যাঁ, মানে, ভীষণ ঘুম পাচ্ছিল। ঘু

মোতে ঘুমোতেই বুঝি কোথাও চলে গিয়েছিলেন?

আজ্ঞে!

তবে সে রাত্রে অত খুঁজেও আপনাকে পাওয়া গেল না কেন?

আজ্ঞে, পুকুরের পাড়ে—

পুকুরের পাড়ে!

হ্যাঁ, বড্ড গরম, তাই পুকুরের ধারে সিঁড়ির উপরে গিয়ে বসেছিলাম একটু। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি।

তারপর ঘুম ভাঙল কখন?

পরের দিন সকালে?

তারপর কি করলেন?

তখন শুনলাম হরিদাসদা খুন হয়েছেন—সেই শুনে ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম।

কার কাছে শুনলেন?

রাধার কাছে।

পাল মশাই, রাধা দেবীকে ডাকুন তো!

রাধারমণ কিরীটীর নির্দেশে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন আবার। ঠিক ঐ সময় কৃষ্ণভামিনী এক কাপ চা হাতে ঘরে এসে ঢুকল।

চা—

রাখুন ওখানে।

কৃষ্ণভামিনী চায়ের কাপটা পাশের একটা টুলের উপরে নামিয়ে রাখল।

রাধারাণী এসে ঘরে ঢুকল রাধারমণ পালের সঙ্গে।

রাধারাণী দেবী আপনার নাম?

আজ্ঞে।

আপনি দোলগোবিন্দবাবুকে পরের দিন সকালবেলা দিঘির পাড়ে দেখেছিলেন?

কে বললে?

কেন উনি বলছেন?

ও মাগো, কোথা যাব গো—হ্যাঁরে হাড়হাবাতে অলপ্পেয়ে অনামুখখা, তোর সঙ্গে আমার দেখা হল পরের দিন সকালে কখন রে?

রাধা, মানে তুই–  

দোলগোবিন্দর মুখের কথাটা শেষ হতে পারল না।

রাধা চোখ পাকিয়া চিৎকার করে উঠল, বদমায়েসী করবার আর জায়গা পাওনি হতচ্ছাড়া  ড্যাকরা! খেংরে বিষ ঝেড়ে দেব তোমার!

সে কি রাধা, তুমি আমায় বললে না—দেখুন স্যার, ও মিথ্যে বলছে, নচেৎ আমি জানব কি করে যে হরিদাসদা খুন হয়েছে?  

রাধারাণী প্রায় তখুনি ঝাঁপিয়ে পড়ছিল দোলগোবিন্দর উপর, কিরীটী বাধা দিল, থামুন। থামুন, কি করছেন আপনারা, যান রাধারাণী দেবী, আপনি এ ঘর থেকে চলে যান।

রাধারাণী গজরাতে গজরাতে ঘর ছেড়ে চলে গেল।

দোলগোবিন্দবাবু! কিরীটী ডাকল।

কেঁদে ফেললে দোলগোবিন্দ, বিশ্বাস করুন স্যার, আমি কিছু জানি না, কিছু দেখিনি সে-রাতে। ওসব খুনোখুনির মধ্যে আমি ছিলাম না।

আপনি সে-রাতে সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে কোথায় ছিলেন দোলগোবিন্দবাবু, অর্থাৎ তৃতীয় অঙ্কের মাঝামাঝি সময়?

ঠিক মনে পড়ছে না। কাঁদতে কাঁদতে বললে দোলগোবিন্দ।

মনে পড়ছে না?

আজ্ঞে না।

ঐ সময় হরিদাসবাবুর ঘরে গেছেন একবারও?

না তো!

কাউকে সে-ঘরে যেতে দেখেছেন?

কাকে দেখব।

কাউকে দেখেছেন কিনা তাই জিজ্ঞাসা করছি। মনে করে দেখুন না, কিংবা মনে করে দেখুন তো, কেউ আপনাকে একটা চিঠি দিয়েছিল কিনা শ্যামলবাবুকে দিতে!

চিঠি?

হ্যাঁ, একটুকরো কাগজ?

কাগজ–শ্যামলকুমারকে দিতে!

হ্যাঁ, দিয়েছিল কেউ আপনাকে—তাই না?

হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আমাকে নয়, ভোলাকে-কে যেন একটা কি ভোলার হাতে দিয়ে বললে সেটা শ্যামলকুমারকে দিতে, হরিদাসদা দিয়েছেন।

কে সে?

অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারিনি, তাছাড়া আসরে তখন আমার যাবার কথা, আমার পার্ট ছিল।

মেয়েছেলে, না কোন পুরুষ?

মনে হচ্ছে মেয়েছেলে।

কে বলে মনে হয় সে আপনাদের দলের?

চিনতে পারিনি–ঠিক বুঝতে পারিনি।

রাধারমণবাবু?

আজ্ঞে?

আপনার দলের কজন স্ত্রীলোক আছেন?

চারজন। কৃষ্ণভামিনী, সুভদ্রা, রাধারাণী আর ফুল্লরা।

ফুল্লরা কে?

যে সে-রাত্রে নায়কের ছোট বোন সেজেছিল।

তাকে একবার ডাকবেন এ ঘরে?

রাধারমণ তখুনি ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

দোলগোবিন্দবাবু!

আজ্ঞে।

আপনার দেশ কোথায়?

বর্ধমানে।

টাউনে?

না, মেমারীতে-সুভদ্রার মাসী যেখানে থাকে।

সুভদ্রার মাসীকে আপনি চেনেন?

চিনব না কেন—একই পাড়ায় তো।

তাহলে সুভদ্রাকেও আপনি চেনেন?

ও যখন মেমারীতে ছিল তখন চিনতাম, তাছাড়া বাড়িতে তো আমি খুব একটা যাই না।

বাড়িতে আপনার কে কে আছে?

কেউ নেই, এক বিধবা পিসি।

বিয়ে-থা করেননি?

করেছি। স্ত্রী এখানেই আমার সঙ্গে বেলেঘাটায় থাকে।

শেষ কবে সুভদ্রাকে আপনি মেমারীতে দেখেন?

তা বছর দশেক আগে হবে। ও বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে।

পালিয়ে?

হ্যাঁ, শুনেছিলাম তাই।

কার সঙ্গে? ওখানকারই কারও সঙ্গে কি?

তা জানি না, স্ত্রীর মুখে পরে আমি কথাটা শুনেছিলাম।

সুভদ্রাকে তারপর কবে আবার দেখলেন?

এখানেই—বছর তিনেক আগে এ দলে এসে।

এ দলে কতদিন আপনি আছেন?

তিন বছর।

তার আগে?

অন্য দলে অভিনয় করতাম।

সে দল ছেড়ে দিলেন কেন?

মিথ্যে বলব না হুজুর, আপনি পুলিসের লোক, চুরির দায়ে আমার চাকরি যায়।

চুরি?

হ্যাঁ, সব মিথ্যে—কিন্তু প্রমাণ করতে পারলাম না।

রাধারমণ ঐ সময় ফুল্লরাকে নিয়ে এসে ঘরে ঢুকলেন।

ফুল্লরার বয়স বছর কুড়ি হবে। বেশ ফরসা গায়ের রং, দোহারা চেহারা। মুখটা গোল, চক্ষু দুটি চঞ্চল।

একই নাম ফুল্লরা, রায় মশাই। রাধারমণ বললেন।

তোমার নাম ফুল্লরা?

আজ্ঞে। গলাটি মিহি ও মিষ্টি সুরেলা।

কিরীটীর মনে পড়ল মেয়েটি পালায় সে-রাত্রে চমৎকার গান গেয়েছিল।

তুমি সে-রাত্রে শ্যামলবাবুর হাতে একটা চিঠি দিয়েছিলে?

কে বললে?

দিয়েছিলে কিনা তাই জিজ্ঞাসা করছি।

না তো!

দোলগোবিন্দবাবু, দেখুন তো—সে রাত্রে ও-ই কি শ্যামলবাবুর হাতে চিঠিটা দিয়েছিল?

দোলগোবিন্দ তাকাল ফুল্লরার দিকে। ফুল্লরাও তাকিয়ে থাকে – কুঞ্চিত করে দোলগোবিন্দর দিকে। কয়েকটা মুহূর্ত, তারপর দোলগোবিন্দ মাথা নেড়ে বলে, আজ্ঞে না।

ফুল্লরার ভ্রূযুগল সরল হয়ে আসে।

ঠিক আছে, তোমরা যেতে পার।

দোলগোবিন্দ আর ফুল্লরা ঘর ছেড়ে চলে গেল।

আর কাউকে ডাকব রায় মশাই? রাধারমণ শুধালেন।

না, থাক।

সবাই আছে ও ঘরে।

থাক, প্রয়োজন নেই।

চা-টা তো ঠাণ্ডা হয়ে গেল রায় মশাই। আর এক কাপ চা আনি?

না, এবারে আমি যাব। আচ্ছা চলি, নমস্কার।

কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

.

দুই দিন পরে। দ্বিপ্রহরে কিরীটী ও কৃষ্ণার মধ্যে কথা হচ্ছিল। গতকাল সকালে আবার কিরীটী বর্ধমানে মেমারীতে গিয়েছিল, ফিরেছে রাত্রে।

কৃষ্ণা সেই সম্পর্কেই কথা বলছিল, কাল হঠাৎ আবার বর্ধমানে গিয়েছিলে কেন বললে তো?

আগের বার সুভদ্রার মাসীর খোঁজ পাইনি, তাই আবার গিয়েছিলাম যদি তার দেখা পাই।

দেখা হল?

না।

কেন, বাড়িতে ছিল না বুঝি?

বছরখানেক আগে তার মৃত্যু হয়েছে।

সে কি! তবে যে সুভদ্রা তোমাকে বলেছিল!

এখন দেখছি তোমার কথাই ঠিক কৃষ্ণা।

তোমাকে সেদিনই আমি ইঙ্গিত দিয়েছিলাম না, সুভদ্রাকেই আমার সন্দেহ হয়।

সন্দেহ যে আমারও হয় না তা নয়, তবে—

তবে আবার কি?

তার গর্ভের সন্তানই সব যেন কেমন এলোমেলো করে দিচ্ছে।  

ঐ মেয়েটি একটি সাংঘাতিক চরিত্রের এ তুমি জেনে রেখো।

সেটা যে বুঝিনি তা নয় কৃষ্ণা, কিন্তু তার গর্ভের সন্তানই যে আমার সব হিসাব গোলমাল করে দিচ্ছে।

ওদের মত মেয়ের আবার সন্তানধারণ!

তুমি যে দেখছি, না বিইয়েই কানাইয়ের মা হয়ে বসলে!

ঠাট্টা করছ?

পাগল! যাও গলাটা শুকিয়ে গিয়েছে, এক কাপ চা আন তো।