১৭. সেই গগনবিহারীর গৃহে

রাত দশটায়।

সেই গগনবিহারীর গৃহে। তাঁর শয়নকক্ষে–যে কক্ষে কয়েক রাত্রি আগে আততায়ীর ছুরিকাঘাতে তিনি নিহত হয়েছিলেন।

ঘরের মধ্যে উপস্থিত যোগজীবনবাবু, অমলেন্দুবাবু, শমিতাদেবী, সুবীর, সুবিনয়, বাহাদুর, কিরীটী, অরূপ ও ডাঃ অধিকারী–কিরীটীর পরিচিত একজন ডাক্তার।  

কিরীটী সম্বোধন করে বলে, আপনারা সকলেই হয়ত একটু অবাক হয়েছেন কেন এভাবে সকলকে আপনাদের আমরা এ সময় এই ঘরে আসতে বলেছিলাম কথাটা ভেবে। আসতে বলেছিলাম এই কারণেই যে–কিরীটী একটু থেমে আবার বলে, আমরা মানে অরূপবাবু, গগনবিহারীর হত্যাকারী কে জানতে পেরেছেন। হি ওয়ান্টস টু আনমাস্ক হিম্ বিফোর অল অফ ইউ!

সকলেই পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়।

একটা ভয়–একটা সন্দেহ যেন সকলেরই দৃষ্টিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

কিন্তু সব কথা বলবার আগে শমিতা দেবী, আপনাকে আমি অনুরোধ করছি, সেরাত্রে গগনবাবুর টেলিফোন পেয়ে এ–ঘরে পা দেবার পর কী আপনি দেখেছিলেন–কী হয়েছিল বলুন?

আমি তো সকালেই বলেছি।

আপনি বলেছেন গগনবাবুকে আপনি মৃত দেখেন। কিন্ত তা তো নয়। হি ওয়াজ স্টীল লিভিং–তখনও তিনি বেঁচেই ছিলেন এবং সে–সময় তিনি ফুললি ড্রাঙ্কড়। বদ্ধ মাতাল। কি, তাই নয়?

শমিতা বোবা। পাথর।

বলুন? আমার কথা কি মিথ্যে?

না, তিনি বেঁচেই ছিলেন।

এবং আপনার উপস্থিতিতেই হি ওয়াজ স্ট্যান্ড।

হ্যাঁ। কিন্তু আমি–আমি হঠাৎ ঘর অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় বুঝতে পারিনি কে তাকে ছোরা মেরেছিল।

সব বলুন।

ঘরে ঢুকতেই গগনবাবু বলেন তাঁকে বিয়ে করার জন্য বিয়ে করলে সব সম্পত্তি তিনি আমার নামে লিখে দেবেন।

শমিতার বিবৃতি।

শমিতা ঝড়ের মতই এসে ঘরে ঢুকেছিল, ফোন করেছিলেন কেন?

শমি, এস। গগনবিহারী দু হাত বাড়িয়ে দেন শমিতার দিকে।

ডোন্ট টাচ মি।

ডোন্ট বি কুয়েল মাই ডার্লিং। আই লাভ ইউ। আই ওয়ান্ট ইউ বলে টলতে টলতে গিয়ে গগনবিহারী দু হাতে ঝাঁপটে ধরেন শমিতাকে বুকের উপরে।

দুজনে একটা ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায়। তারপরই হঠাৎ গগনবিহারী একটা আর্ত চিৎকার করে ওঠেন। ঠিক ঐ সময় ঘরের আলোটা দপ করে নিভে যায়।

গগনবিহারীর আলিঙ্গন শিথিল হয়ে যায়। তিনি মাটিতে পড়ে যান। কয়েটা মুহূর্ত অতঃপর স্তব্ধ হয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে শমিতা। তারপর একসময় আলোটা জ্বলতেই তার নজরে পড়ে রক্তের স্রোতের মধ্যে গগনবিহারী পড়ে। ঘরময় কাচের চুড়ি। শমিতার ডান হাতের কজীতেও কেটে গিয়েছে, শমিতা ভয়ে তাড়াতাড়ি ভাঙা চুড়িগুলো মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিয়ে ঘর ছেড়ে যখন পালাতে যাবে সিঁড়িতে রামদেওর সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়।

শমিতা থামল।

তারপর? কিরীটী শুধায়।

আমি প্রথমে বাড়ি যাই। সেখান থেকে আবার ক্লাবে ফিরে যাই। এর বেশী কিছু আর আমি জানি না। বিশ্বাস করুন–

অরূপ!

বলুন।

রামদেওকে নিয়ে এস এ ঘরে।

অরূপ বের হয়ে গেল।

রামদেও! অধোস্ফুট কণ্ঠে সুবীর বলে।

হ্যাঁ। সুবীরবাবু, দুভাগ্য খুনীর, রামদেও ধরা পড়েছে পরশু রাত্রে মোকামা জংশনে। বলতে বলতে হঠাৎ কিরীটী সুবিনয়ের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলে, উঁহু সুবিনয়বাবু, দরজার দিকে এগুবার চেষ্টা করে কোন লাভ নেই। দি ক্যাট ইজ অলরেডি আউট অফ দি ব্যাগ! তাছাড়া এ বাড়ির চারদিকে পুলিস।

অরূপ এসে ঘরে ঢুকল রামদেওকে সঙ্গে নিয়ে। মাত্র কটা দিনেই লোকটার চেহারা যেন শুকিয়ে গিয়েছে। একমুখ দাড়ি, রুক্ষ চুল, মলিন বেশ, চোখের কোলে কালি। বিষণ্ণ, ক্লান্ত।  অরূপ, তুমি সঙ্গে করে যে লৌহবলয় এনেছ–সে দুটি আমাদের সুবিনয়বাবুর হাতে আপাতত পরিয়ে ওকে নিশ্চিন্ত কর।  

কিরীটীর কথায় অরূপ যেন কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।

সুবিনয় বলে ওঠে, এসবের মানে কি কিরীটীবাবু? আপনার কি ধারণা আমিই মামাকে হত্যা করেছি?

ধারণা নয় সুবিনয়বাবু–ইটস্ এ ক্রুয়েল ফ্যাক্ট! কই অরূপ—

অরূপ এগিয়ে সুবিনয়ের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল।

সুবীর বলে ওঠে ঐ সময় এতক্ষণ পরে, সুবিনয় তুমি! তুমিই তাহলে কাকাকে খুন করেছ?

এ মিথ্যে মিথ্যে সুবীরদা। চেঁচিয়ে ওঠে সুবিনয়, ইট ইজ প্রিপ্রোস্টারাস!

কিরীটী এবারে রামদেওর দিকে তাকাল, রামদেও!

রামদেও কেমন যেন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে কিরীটীর মুখের দিকে।

ডাঃ অধিকারী?

বলুন।

সঙ্গে আপনার সিরিঞ্জ ওপেথিডিন অ্যামপুল একটা এনেছেন তো– যা আনতে বলেছিলাম?

হ্যাঁ।

রামদেকে একটা পেথিডিন ইনজেকশন দিন।

সবাই নির্বাক।

ডাঃ অধিকারী কিরীটীর নির্দেশে রামদেকে একটা পেথিডিন ইনজেকশন দিয়ে দিলেন।

মিনিট কয়েক পরেই রামদেওর চেহারার পরিবর্তন হয়।

চোখের মণি দুটো চকচক করতে থাকে।

রামদেও? কিরীটী আবার ডাকে।

জী!

বল সে রাত্রে তুমি কেন পালিয়েছিলে? আমি বলছি তুমি তোমার সাহেবকে খুন করনি–তুমি নির্দোষ।

আমি খুন করিনি।

বললাম তো, আমি তা জানি।

আমিও সে রাত্রে বার বার বাবুজীকে (সুবিনয়কে দেখিয়ে বলেছিলাম, আমি কিছু জানি , আমি খুন করিনি কিন্তু উনি বললেন, উনি দেখেছেন আমাকে খুন করতে সাহেবকে। পুলিসকে উনি বলে দেবেন। সেই ভয়েই আমি পালাই।