০২. নীচের তলায় দুটো ঘরে

নীচের তলায় দুটো ঘরে সুবিনয় ও সুবীর নিজেদের ব্যবস্থা করে নিয়েছিল। সুবীর এসে সুবিনয়ের ঘরে ঢুকল।

কখন এল রে?

সন্ধ্যাবেলা। সুবিনয় বলল।

ঐ বাঘের মত কুকুরটাও সঙ্গে এনেছে নাকি?

হ্যাঁ। আরও আছে—

আর কে এল আবার?

ড্রাইভার কাম বডিগার্ড নেপালী বাহাদুর, আর এক্স-মিলিটারী পার্সোন্যাল রামদেও।

হুঁ।

সুবীর পকেট থেকে সিগারেট কেসটা বের করে, তা থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করল। নিঃশব্দে গোটা-দুই টান দিল।

এখনও জেগে আছেন?

বোধহয় তোমার ফেরবার প্রতীক্ষ্ণতেই জেগে ছিলেন।

তাই নাকি?

তাই তো মনে হচ্ছে।

কেন?

বলে দিয়েছেন কাল থেকে নাকি রাত ঠিক সাড়ে দশটায় গেট বন্ধ হয়ে যাবে।

গেট বন্ধ হয়ে যাবে!

হ্যাঁ।

তাহলে তো এখানে আমার পোষাবে না সুবিনয়।

কটা দিন একটু তাড়াতাড়ি ফেরবার চেষ্টা কর না।

থাম্ তো তুই। রাত এগারোটা সাড়ে-এগারোটার আগে কোন ভদ্রলোক আজকালের দিনে বাড়ি ফিরতে পারে নাকি? ওসব আমার দ্বারা হবে না।

সুবিনয় মৃদু হাসল। তারপর জিজ্ঞাসা করে, কিছু সুবিধে হল?

সুবীরের চাকরিটা টেম্পোরারী ছিল, মাসখানেক হল চাকরি গিয়েছে, সে আবার একটা চাকরির চেষ্টা করছে।

না।

নটরাজনের সঙ্গে দেখা করেছিলে?

করেছিলাম।

কি বললে সে?

বললে এখনও কিছু স্থির হয়নি। ঐ পোস্টটার জন্য তোদের অফিসে দিন পনেরো বাদে একবার খোঁজ নিতে বলেছেন।

ঠিক আছে। আমাদের সার্কুলেশন ম্যানেজার মিঃ গিল বম্বে থেকে ফিরুক, তাকে আবার আমি বলব।

কবে ফিরবে রে?

দিন সাত-আট বাদে বোধ হয়।

এদিকে পকেট তো আমার গড়ের মাঠ! নেহাৎ থাকা-খাওয়ার ভাবনা নেই এখন—

পরশু পঁচিশ টাকা নিলে যে!

পঁচিশ টাকা একটা টাকা নাকি?

তা এত রাত হল কেন ফিরতে?

মিত্ৰাণীকে নিয়ে সিনেমায় গিয়েছিলাম।

সুবীর চরিত্রে একটু ঢিলেঢালা, দিলদরিয়া ভাব, যা উপার্জন করে দুহাতে খরচ করে। কাল কি হবে তার জন্য কোন চিন্তাই নেই যেন।

পোশাক-পরিচ্ছদেও একটু বাবু গোছের।

সুবিনয় কিন্তু সুবীরের ঠিক বিপরীত। সঞ্চয়ী, গোছানো চিরদিনই।

সুবিনয়!

কি?

কাল আমাকে আরও কিছু দিতে পারিস?

কত?

এই গোটা কুড়ি টাকা!

দেব।

মাসের শেষ, তোর অসুবিধা হবে না তো আবার?

না। চল ওঠ, এবার খাবে চল। না খেয়ে এসেছ!

বিশেষ কিছু খাইনি—একটা কাটলেট আর এক কাপ চা। চল, খিদে পেয়েছে দারুণ।

ডাইনিং হলে দুজনে খেতে বসে।

চিকেন স্টু ও পুডিং দেখে খেতে বসে সুবীর বলে, আরে বাবা, এ যে রাজকীয় ব্যাপার! প্রিয়লাল, এসব কখন রাঁধলি রে!

আজ্ঞে কত্তাবাবুর বেয়ারা বেঁধেছে–রামদেও।

আই সি!

সুপ থেকে একটুকরো চিকেন তুলে নিয়ে চিবুতে চিবুতে সুবীর বলে, বেঁধেছে তো খাসা!

সুবীর চিরদিনই একটু ভোজনবিলাসী।

ঐ সময় জ্যাকি এসে ঘরে ঢুকে সুবীরের গায়ের গন্ধ শুঁকতে থাকে। ভয়ে সুবীর সিঁটিয়ে ওঠে। হাত থেমে যায় তার।

বলে, ওরে বাবা, এটা আবার এখানে কেন?

সুবিনয় বললে, কিছু বলবে না। গন্ধ শুঁকে চিনে নিচ্ছে।

বিশ্বাসও নেই কিছু—সুবীর বলে।

জ্যাকি গন্ধ শুঁকে চলে গেল ঘর থেকে।

খাওয়া-দাওয়ার পর দুজনে ঘর থেকে বেরুল। বারান্দায় আসতেই অন্ধকারে নজরে পড়ে বারান্দার শেষপ্রান্তে কে যেন আবছায়া দাঁড়িয়ে আছে।

সুবীর প্রশ্ন করে, কে? কে ওখানে?

আমি বাহাদুর হুজুর।

সেই নেপালীটা বুঝি সুবিনয়? সুবীর শুধায়।

হ্যাঁ।

যে যার ঘরে গিয়ে অতঃপর খিল তুলে দিল।

জামা-কাপড় বদলে সুবীর শ্লিপিং-সুটটা পরে নিল। একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘরের আলো নিভিয়ে জানলার সামনে এসে দাঁড়াল।

ভাল লাগছে না সুবীরের, কাল এখান থেকে চলে যেতে পারলে ভাল হত কিন্তু উপায় নেই।

গত মাস থেকে চাকরি নেই। টেম্পোরারি চাকরি অবিশ্যি যাবে জানতই, তাছাড়া ডেপুটি ম্যানেজার মিঃ সিংয়ের সঙ্গে আদৌ বনিবনা হচ্ছিল না।

হয়ত এত তাড়াতাড়ি চাকরিটা যেতও না, আর মাস দুই থাকত—কিন্তু সিং-এর সঙ্গে হঠাৎ সেদিন চটাচটি হতেই পরের দিনই চাকরিটা গেল।

পরের দিন অফিসে গিয়েই নোটিস পেল। ডেপুটি ম্যানেজারের নোটিস। মাইনে বুঝে নিয়ে তাকে চলে যেতে বলা হয়েছে। সুবীরও চলে এসেছিল সোজা টাকাকড়ি বুঝে নিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে। চাকরি আজও একটা জোটেনি। তাহলেও এখানে সে থাকবে না। থাকতে সে পারবেও না। তবে একটা চাকরি চাই সর্বাগ্রে। এখানে অন্ততঃ থাকা-খাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ছিল সে। তাছাড়া মিত্ৰাণীর হোস্টেলটাও কাছে।

শ্যামবাজার থেকে মাস দুই হল মিত্ৰাণী কাছেই এখানকার একটা মেয়েদের হোস্টেলে উঠে। এসেছে।

হেঁটে যেতেই পারা যায় মিত্ৰাণীর হোস্টেলে। মিত্ৰাণীর কথা মনে পড়তেই অন্ধকারে সুবীরের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে, বয়স কত হল মিত্ৰাণীর! মনে মনে একটা হিসাব করে সুবীর।

খুব কম করেও ত্রিশের কাছাকাছি তো হবেই। চাকরিই তো করছে দশ বছর। এখনও মিত্ৰাণী ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে। বেচারী! আজকের দিনে ঘর বাঁধার ব্যাপারটা যেন এতই সহজ!

মিত্ৰাণী এখনও জানে না বছর দুই আগেই তার পার্মানেন্ট চাকরিটা গিয়েছে। তারপর দু জায়গায় টেম্পোরারি কাজ করল। শেষ চাকরিটাও মাসখানেক হল গিয়েছে।

ব্যাপারটা জানলে অত উৎসাহের সঙ্গে বলত না, আমি আড়াইশো মত পাই, তুমিও তিনশো সাড়ে তিনশো পাও। দুজনের বেশ ভাল ভাবেই চলে যাবে। একটা দুঘরওয়ালা ফ্ল্যাট।

নাঃ, একটা চাকরি যোগাড় করতে হবেই।

.

পরের দিন দেখা হল সুবীরের গগনবিহারীর সঙ্গে। সামান্যই কথাবার্তা হল। তার মধ্যে বিশেষ যে কথাটা সেটা হচ্ছে তার চাকরি ও উপার্জন সম্পর্কে।

তাহলে বি.এ.টাও পাস করতে পারনি?

গগনবিহারী বললেন। পরীক্ষা দিইনি।

দিলে অন্ততঃ নির্বুদ্ধিতা প্রকাশ করা হত না। তা কোথায় চাকরি করছ?

ঐ একটা মার্চেন্ট অফিসে। কোনমতে ঢোঁক গিলে কথাটা উচ্চারণ করল সুবীর কতকটা যেন ভয়ে-ভয়েই।

মাইনে কত?

শ-দুই মত।

ঠিক আছে, যোগজীবন আসুক, তাকে বলবখন তোমার কথা।

আমি তাহলে উঠি?

হ্যাঁ, এস।

সুবীর উঠে দুপা এগিয়েছে, পিছন থেকে গগনবিহারী ডাকলেন, হ্যাঁ শোন, আর একটা কথা—

থেমে ঘুরে তাকাল সুবীর গগনবিহারীর মুখের দিকে।

রাত ঠিক সাড়ে দশটায় আজ থেকে কিন্তু গেট বন্ধ হয়ে যাবে, বুঝেছ?

হ্যাঁ।

যাও।

সুবীর ঘর ছেড়ে চলে গেল।

নীচে এসে নিজের ঘরে ঢুকতেই দেখে সুবিনয় বসে আছে।

সুবিনয় জিজ্ঞাসা করল, কি বললেন মামা, সুবীরদা?

সুবীর খাটের উপর থপ করে বসে পড়ে বললে, ইম্পসিবল।

কি হল?

এখানে বাস করা আমার চলবে না সুবিনয়। এত কড়াকড়ি, এত নিয়মকানুন—এ তো কয়েদখানা!

একটা কথা বলব সুবীরদা?

কি?

বলছিলাম ভাল একটা যা হোক চাকরিবাকরি না পাওয়া পর্যন্ত—

তার আগেই মৃত্যুরেব ন সংশয়!

পাগলামি করো না সুবীরদা। যা বলি শোন, হুট করে একটা কিছু করে বসোনা। তাছাড়া রাজীব ওদেশ থেকে আর ফিরবে না, মামার যা কিছু তো তুমিই পাবে।

আমি?

হ্যাঁ, তুমি ছাড়া আর কে আছে বল?

তাহলে বলব সুবিনয় তুমি ভুল করেছ।

ভুল করেছি!

হ্যাঁ। আমি ঐ চীজটিকে এক আঁচড়ে চিনে নিয়েছি ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে।

তার মানে?

মানে অতীব সরল, অতীব প্রাঞ্জল।

হেঁয়ালি রাখ তো।

শোন, ঘরে ঢুকে কি দেখলাম জান?

কি?

যত রাজ্যের বিলিতী আমেরিকান আর ফ্রেঞ্চ ম্যাগাজিন।

হ্যাঁ, সঙ্গে দু-বাক্স ভর্তি ম্যাগাজিন ও বইপত্র এসেছে কাল দেখছিলাম।

ঐ ম্যাগাজিনগুলো কিসের জানো?

কিসের?

যত নগ্ন মেয়েদের মানে ন্যাংটো মেয়েদের ছবিতে ভরা। আর সেই ছবিগুলো বসে উল্টে উল্টে দেখছেন তোমার মামাবাবু।

সত্যি!

এক বর্ণ মিথ্যে নয়। ঐ ম্যাগাজিনগুলো দেখে বুঝে নিয়েছি, ওঁর মনের অলিতেগলিতে

এই বয়সেও কোন রসের প্রবাহ চলেছে।

কিন্তু–

ছি ছি, বুড়ো হয়েছেন, সাতকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছেন, এখনও ঐসব পর্ণোগ্রাফি নিয়ে মজে আছেন! এই মানুষ দেবে আমায় সম্পত্তি? একটি কপর্দকও নয়!

সুবিনয় আর কোন কথা বলে না।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, যাই উঠি, অফিসের বেলা হল।

টাকাটা দিয়ে যেও কিন্তু–

হ্যাঁ, মনে আছে।

সুবিনয় উঠে পড়ল।

.

দিনচারেক বাদে এলেন যোগজীবন সান্যাল, কলেজ-জীবনের সহপাঠী গগনবিহানীর এবং দুজনের মধ্যে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতা। যোগজীবনও দীর্ঘদিন সেন্ট্রালের বড় চাকরি করে রিটায়ার করেছেন। যোগজীবন একা আসেননি, সঙ্গে তাঁর ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের বোন শমিতা।

শমিতার গায়ের রংটা কালো হলেও সারা দেহ জুড়ে যেন একটা অপূর্ব যৌবনশ্রী। যৌবন যেন সারা দেহে টলমল করছে।

যেন উপচে পড়ছে কানায় কানায়। বেশভূষাও অনুরূপ। শমিতা এম.এ পাশ—কোন এক বেসরকারী কলেজের অধ্যাপিকা। ভালবেসে একজনকে বিবাহ করেছিল, কিন্তু সে বিবাহ দুবছরের বেশি টেকেনি, ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল সেও আজ বছর পাঁচেকের কথা।

শমিতা এসেছিল নিজেই ইচ্ছা করে গগনবিহারীর সঙ্গে দেখা করতে, কারণ যোগজীবনের বাড়িতে গগনবিহারীর ছাত্রজীবনে যখন যাতায়াত ছিল তখন থেকেই বালিকা শমিতাকে চিনতেন গগনবিহারী।

যোগজীবনের ছোট বোন ওঁকেও দাদা বলে ডাকত। গগনবিহারী ভালও বাসতেন।

শমিতা যোগজীবনের সঙ্গে গগনবিহারীর ঘরে ঢুকে একেবারে হৈ-হৈ করে উঠল, তোমার উপরে ভীষণ রাগ করেছি গগনদা!

কেন বল তো? গগনবিহারী হাসতে থাকেন।

চারদিন এসেছ অথচ একটিবার আমাদের ওখানে গেলে না দেখা করতে।

আর দুদিন অপেক্ষা করলে না কেন? দেখতে যেতাম কিনা?

সত্যি বলছ যেতে?

পরীক্ষা করা উচিত ছিল আগে।

যোগজীবন বলেন, শমির সঙ্গে তুমি কথায় পারবে না গগন।

গগনবিহারী নিঃশব্দে মৃদু মৃদু হাসেন আর দুচোখের দৃষ্টি দিয়ে স্বল্প বেশবাসের ফাঁকে ফাঁকে শমিতার যে উগ্র যৌবন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সেই যৌবনকে যেন উপভোগ করতে থাকেন।

শমিতা ঐ সময় বলে, শোন গগনদা, দাদার সঙ্গে তোমার এখানে আসার আমার আরও একটা উদ্দেশ্য আছে কিন্তু–

তাই নাকি!

হ্যাঁ।

তা উদ্দেশ্যটা কি?

আমাদের একটা ক্লাব আছে—

ক্লাব! তা ক্লাবের নাম কি?

ক্লাবের নাম মরালী সঙ্ঘ।

বেশ নামটা তো!

যোগজীবন বলেন, ঐসব করছে আর কি! তা বাপু বলেই ফেল না গগনকে কি করতে হবে!

পেট্রোন হতে হবে।

পেট্রোন?

হ্যাঁ।

গগনবিহারী হাসতে হাসতে বলেন, তা দক্ষিণা কত?

পেট্রোনের কোন ধার্য দক্ষিণা নেই—তাঁরা যা-ই দেবেন তাই গ্রহণীয় হবে।

সুবীর একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল নিঃশব্দে।

যোগজীবন আসছেন বলে গগনবিহারী তাকে ঘরে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, সুবীর দেখছিল তার কাকার দুচোখের লুব্ধ দৃষ্টি কেমন করে লেহন করছে শমিতার যৌবনকে।

ঠিক আছে, বস—আসছি।

গগনবিহারী উঠে গেলেন এবং একটু পরে চেক-বইটা হাতে ঘরে এসে খস খস করে একটা দেড় হাজার টাকার চেক লিখে শমিতার দিকে চেকটা ছিঁড়ে এগিয়ে ধরলেন, নাও।

চেকটায় একবার চোখ বুলিয়ে শমিতা বললে, মেনি মেনি থ্যাংকস্। আজ সন্ধ্যায় তাহলে আসছ?

কিন্তু আমি তো তোমাদের ক্লাব চিনি না।

আমি নিজে এসে নিয়ে যাব, শমিতা বললে।

বেশ, কখন আসবে?

সাড়ে সাতটায়। আমি তাহলে এখন উঠি গগনদা!

এখুনি উঠবে কি, চা-টা খাও। সুবীর?

কাকা!

রামদেকে চা দিতে বল।

সুবীর ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তার সমস্ত মনটা জুড়ে তখন একটা ভরন্ত উজ্জ্বল যৌবন যেন নানা রংয়ের তুলি টেনে চলেছে!

.

চা-পর্ব শেষ হবার পর শমিতা চলে গেল।

গগনবিহারী তখন সুবীরের পরিচয় দিলেন, যোগজীবন, এই ভাইপোটির একটা কিছু ব্যবস্থা করে দিতে পার? তোমার তো অনেকের সঙ্গে পরিচয় আছে!

কতদূর লেখাপড়া করেছে? যোগজীবন প্রশ্ন করেন।

আরে তাহলে আর ভাবনা ছিল কি! আই.এ. পাস করে শর্টহ্যান্ড টাইপ-রাইটিং শিখেছে। অবিশ্যি একটা অফিসে কাজ করছে, মাইনে তেমন সুবিধার নয়।

যোগজীবন বললেন, বলবখন দু-একজনকে।

সুবীর ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

তারপরও ঘণ্টাখানেক দুই বন্ধুতে আলাপ-সালাপ হল।

দুজনেরই স্ত্রী-বিয়োগ ঘটেছে।

গগনবিহারীর তবু এক ছেলে আছে, যোগজীবনের তাও নেই।

যোগজীবন একসময় জিজ্ঞাসা করেন, ছেলের খবর কি তোমার, ফিরছে কবে?

সে আর ফিরবে না।

সে কি হে!

হ্যাঁ, সেখানেই বিয়ে-থা করে সংসার পেতেছে। যাক গে যা খুশি তার করুক।

আমার তো তবু শমিকে নিয়ে একরকম জীবন কেটে যাচ্ছে। তোমার তো তাহলে দেখছি একা একা খুবই কষ্ট হবে হে।

সেই জন্যেই তো ভাগ্নে আর ভাইপোটাকে এখানে এনে রেখেছি। গগনবিহারী বললেন।

.

ঐদিন সন্ধ্যায় শমিতা এল গগনবিহারীকে নিতে নিজেরই গাড়িতে।

সুবীর নীচের বারান্দায় একটা আরামকেদারায় বসে একটা পিকটোরিয়াল ম্যাগাজিনের পাতা উল্টোচ্ছিল।

।মনে মনে সে স্থির করে রেখেছিল কাকা গগনবিহারী বের হয়ে যাবার পরেই সে বেরুবে।

শমিতা এল সাড়ে সাতটা নাগাদ প্রায়। দূর থেকে দেখতে পেল সুবীর শমিতাকে। সকালের বেশভূষায় তবু তার কিছু আব্রু ছিল, কিন্তু সন্ধ্যার বেশভূষায় সুবীরের মনে হল তাও বুঝি নেই।

পরচুলা দিয়ে উঁচু করে খোঁপা বাঁধা। পরনে ফিনফিনে দামী আমেরিকান নাইলনের শাড়ি, গলা ও বগলকাটা অনুরূপ এক জামা গায়ে—যার তলা থেকে ব্রেসিয়ার ও দেহের প্রতিটি ভাঁজ ও উদ্ধত উচ্ছল যৌবন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

শমিতা তার সামনে দিয়ে উপরে চলে গেল এবং মিনিট কয়েক বাদে গগনবিহারীকে নিয়ে নেমে এল। গগনবিহারীও সাজের কসুর করেননি। দামী ব্লু রংয়ের টেরিউল স্যুট, গলায় দামী টাই। দুজনে গাড়িতে উঠল, গাড়ি চলে গেল।

.

তারপর তিনটে মাস।

প্রতিদিন সন্ধ্যায় গগনবিহারীবের হয়ে যান মরালী সঙ্ঘে এবং ফেরেন রাত সাড়ে এগারোটায়। রাত সাড়ে দশটায় গেট বন্ধ হয়ে যায়, তবে রাত সাড়ে এগারোটায় একবার খোলে। কাজেই সুবীরের কোন অসুবিধাই হয় না।

তাছাড়া যোগজীবনের চেষ্টায় সুবীরের একটা ভাল চাকরিও জুটে গিয়েছিল ইতিমধ্যে। গগনবিহারী যেন এক নতুন মানুষ হয়ে ওঠেন।

সুবীর ও সুবিনয় আরামেই কাটায়। গগনবিহারীর সঙ্গে তাদের বড় একটা দেখাই হয় না। ওরা যে দুজন ঐ গৃহে আছে তাও যেন গগনবিহারীর মনে পড়ে না।

মধ্যে মধ্যে গগনবিহারী যেদিন ক্লাবে যান না শমিতাই আসে। রাত সাড়ে এগারোটা বারোটা পর্যন্ত থাকে সে এবং ঐ সময়টা একমাত্র রামদেও ব্যতীত কারও উপরে যাবার হুকুম নেই।

সিঁড়ির নীচে বাহাদুর বসে থাকে। সুবিনয় ও সুবীরের সঙ্গে জ্যাকির বেশ ভাব হয়ে গিয়েছে।

আরও তিন মাস পরে হঠাৎ আর একজনের আবির্ভাব ঘটল ঐ বাড়িতে। রামদেওর তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী রুক্মিণী।

রুক্মিণীর বয়স সতের কি আঠার। সবে যৌবনে পা দিয়েছে। যৌবন যেন টলমল করছে রুক্মিণীর সারা দেহে। দেহাতী গাঁয়ের মেয়ে হলে কি হবে রুক্মিণী রীতিমত চটুল। লাজলজ্জার তেমন বালাই নেই। সারা বাড়ি সে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায়।

সন্ধ্যায় সাজগোজ করে, খোঁপায় ফুল গোঁজে। গুনগুন করে গান গায়। রুক্মিণীর স্থান হল উপরেই রামদেওর ঘরে।

রুক্মিণী ঐ গৃহে আসবার দিন কুড়ি-বাইশ বাদেই আকস্মিক ঘটনাটা ঘটল।

একদিন প্রত্যুষে—

হঠাৎ বাহাদুরের চেঁচামেচিতে সুবিনয়ের ঘুমটা ভেঙে গেল।

সুবীর গতরাত্রে গৃহেই ফেরেনি। সুবিনয়কে সে বলেই গিয়েছিল, রাত্রে হয়তো ফিরবে না–কোথায় এক বন্ধুর বিয়েতে বরযাত্রী হয়ে যাবে।

সুবিনয় বাহাদুরের চেঁচামেচিতে চোখ মুছতে মুছতে বাইরে এসে জিজ্ঞাসা করল, কি রে, ব্যাপার কি?

সাব—

বাহাদুর আর বলতে পারে না। গলা আটকে যায়।

কি হয়েছে সাহেবের?

সাব খতম হো গিয়া—

খতম হো গিয়া! সে কি রে!

হাঁ। চলিয়ে—উপরমে চলিয়ে—

ত্বরিত স্খলিত পদে সুবিনয় উপরে উঠে গেল।

গগনবিহারী আসবার পর থেকে আর সে উপরে ওঠেনি। প্রয়োজনও হয়নি তার।

গগনবিহারীর শয়নকক্ষে ঢুকে থমকে দাঁড়াল সুবিনয়।

ঘরের মেঝেতে গগনবিহারীর মৃতদেহটা পড়ে আছে। পিঠে একটা ছোরা বসানো আমূল—চাপ চাপ রক্ত চারদিকে জমাট বেঁধে আছে।

সঙ্গে সঙ্গে ও চোখ বোজে।