১৩. ডাঃ সানিয়ালের ঘরে বসেই

ডাঃ সানিয়ালের ঘরে বসেই কিরীটী অপেক্ষা করছিল এবং মিনিট পনের-কুড়ি বাদেই দুঃশাসন চৌধুরী সেই ঘরের মধ্যে এসে প্রবশ করলেন।

কিরীটী আহ্বান জানায়, আসুন, বসুন।

দুঃশাসন চৌধুরীর জবানবন্দি।

কিরীটী প্রশ্ন করছিল এবং দুঃশাসন চৌধুরী জবাব দিচ্ছিলেন।–

সর্বপ্রথম একটা কথা আপনার সম্পর্কে আমার জানা প্রয়োজন মিঃ চৌধুরী।

বলুন?

আপনি গতকাল রাত্রে বলেছেন মৌচীতে আপনার মাইকার ব্যবসা ছিল এবং আপনি সে ব্যবসা আপনার দাদা রায়বাহাদুরের ইচ্ছেয় তুলে দিয়ে এখানে চলে এসেছিলেন গত কয়েক মাস হল, তাই তো?

হ্যাঁ।

সেখানে আপনার ব্যবসা কেমন চলছিল?

ভালই।

কিছু মনে করবেন না, যখন ব্যবসা তুলে দিয়ে এখানে চলে আসেন তখন হাতে আপনার liquid cash কত ছিল?

প্রশ্নটা দাদার হত্যার ব্যাপারে একান্তই অবান্তর নয় কি মিঃ রায়? দুঃশাসনের কণ্ঠস্বরটা একটু উগ্র বলেই মনে হয় যেন কিরীটীর।

অবান্তর হলে অবশ্যই এ প্রশ্নটা আপনাকে আমি করতাম না মিঃ চৌধুরী।

কিন্তু যদি জবাব না দিই?

অবশ্য জবাব দেওয়া-না দেওয়াটা আপনার একান্ত ইচ্ছাধীন, তবে আমার প্রশ্নের জবাবটা দিলে কিছুটা সন্দেহের হাত থেকে আপনি নিষ্কৃতি পেতেন।

সন্দেহ! কি বলতে চান আপনি?

বলতে চাই যে, আমার ধারণা রায়বাহাদুরের হত্যাকাণ্ডটা সম্পূর্ণ অর্থঘটিত। অর্থই অনর্থ ঘটিয়েছে।

আপনি তাহলে বলতে চান যে, সম্পত্তির লোভেই দাদাকে কেউ হত্যা করেছে?

নিশ্চয়ই। হঠাৎ কঠোর শোনায় যেন কিরীটীর কণ্ঠস্বরটা।

কয়েকটা মুহূর্ত অতঃপর দুঃশাসন চৌধুরী চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন, আমাকেও কি তাহলে আপনি ঐদিক দিয়েই সন্দেহ করছেন মিঃ রায়?

শুধু আপনাকেই নয় মিঃ চৌধুরী, এ বাড়ির প্রত্যেককেই—এখানে গতরাত্রে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, বিশেষ করে নিহত রায়বাহাদুরের আপনারা আত্মীয়-স্বজনের দল সে সন্দেহের দিক থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছেন না পুলিসের বিচারে বা বিশ্লেষণে।

কিন্তু আপনি!

আমিও ঐ কথাই বলব।

বলছেন কি? তাহলে আপনার কি ধারণা আমরাই, দাদার আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কেউ-না-কেউ দাদাকে হত্যা করেছি অর্থের লোভে কাল রাত্রে?

অতীব দুঃখের সঙ্গে অপ্রিয় ভাষণ আমাকে করতে হচ্ছে মিঃ চৌধুরী, আপনার অনুমানই সত্য।

মুহূর্তকাল দুঃশাসন চৌধুরী চুপ করে যেন কতকটা হতভম্বের মতই বসে রইলেন। তাঁর বাকশক্তি যেন লোপ পেয়েছে। কিরীটীও চুপ করে বসে থাকে।

হঠাৎ আবার দুঃশাসন চৌধুরীই প্রশ্ন করলেন, তাহলে আমাকেও আপনি দাদার হত্যাকারী বলে সন্দেহ করছেন?

তার আগে আমি জিজ্ঞাসা করি, এ ব্যাপারে আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন?

কিরীটীর প্রশ্নটা যেন অতর্কিতে দুঃশাসন চৌধুরীকে একটা নাড়া দিল। কতকটা হতচকিত ও বিহ্বল কণ্ঠেই দুঃশাসন চৌধুরী জবাব দেন, আমি!

হ্যাঁ। আপনার কি কারও ওপর সন্দেহ হয়?

না। একটু ইতস্ততঃ করেই জবাবটা দিলেন দুঃশাসন চৌধুরী।

আচ্ছা আপনার দাদার কোন শত্রু ছিল বলে আপনার মনে হয়?

বলতে পারি না।

ইদানীং কিছুকালের মধ্যে বা পূর্বে আপনার দাদার সঙ্গে এ বাড়ির কারও কোন মনোমালিন্যের কোন কারণ ঘটেছিল বা ছিল বলতে পারেন?

তেমন কিছু বলতে পারি না। তবে এক মধ্যে মধ্যে শকুনির সঙ্গে দাদার খিটিমিটি হত। তাছাড়া আর কারও সঙ্গে কিছু শুনিনি। একটা কথা অবিশ্যি—ইদানীং দাদা তো সকলের প্রতিই বীতরাগ হয়ে উঠেছিলেন।

শকুনিবাবুর সঙ্গে খিটিমিটি হবার কারণ কি? জানেন কিছু?

বলবেন না ওটার কথা। একটা হতচ্ছাড়া scoundrel। ঐ যে বাড়িতে দাদার নোগশয্যার পাশে নার্স দেখেছেন—ঐ মেয়েটাকে শকুনি বিয়ে করতে চায়। এক পয়সার মুরোদ নেই, মামাদের ঘাড়ে বসে খাবে, তার ওপরে বিয়ের শখ বাবুর!

কেন, শকুনিবাবু কি কিছু করেন না?

আড্ডা দেওয়া ছাড়া কিছু করে বলে তো জানি না। যেমন হয়েছেন আমাদের কাকা সাহেবটি তেমনি ঐ হতচ্ছাড়া বোম্বেটে শকুনিটা। একজন বসে বসে বাঈজী আর মদে টাকা উড়োচ্ছন, আর একজন ক্লাব থিয়েটার আর আড্ডাবাজি করে টাকা উড়োচ্ছন।

কিন্তু আমি যতদূর রায়বাহাদুরের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বুঝেছিলাম, আপনাদের কাকা অবিনাশবাবুর প্রতি রায়বাহাদুরের কোন বিতৃষ্ণা বা বিরাগ ছিল বলে তো মনে হয়নি।

ঐ তো হয়েছিল মুশকিল! একটা অসম্ভব faith ছিল কাকার প্রতি দাদার, এবং দাদা ওঁকে বরাবরই প্রশয়ই দিয়েছে।

হুঁ। কিরীটী অতঃপর কিছুক্ষণ আত্মচিন্তাতেই বোধ হয় বিভোর হয়ে থাকে।

আবার প্রশ্ন শুরু করে কিরীটী।

আপনি কাল রাত্রি সাড়ে তিনটে থেকে আপনার দাদার হত্যাসংবাদ পেয়ে দাদার ঘরে  আসবার আগে রাত চারটে পর্যন্ত সময়টা কোথায় ছিলেন?

নিজের ঘরে জেগেই ছিলাম।

কেন, আপনি তো ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলেন, তাতেও আপনার ঘুম হয়নি?

না।

আর একটা কথা, আপনি ডাঃ সানিয়ালের ঘরে কাল রাত্রে যখন ঘুমের ওষুধ চাইতে আসেন, তখন বলেছিলেন গত এক মাস ধরে আপনি এ বাড়িতে আসা অবধি নাকি অনিদ্রা রোগে ভুগছেন, আবার দালাল সাহেবের কাছে কিছুক্ষণ পরেই জবানবন্দিতে বললেন, মাত্র দশদিন আপনি এখানে এসেছেন। কোন্ কথাটা আপনার সত্যি?

দুটোই সত্যি। স্থির কণ্ঠে দুঃশাসন চৌধুরী বললেন।

কি রকম? বিস্মিত দৃষ্টিতে কিরীটী চৌধুরীর মুখের দিকে তাকাল।

মাসখানেক হল আমি বম থেকে এখানে এসে পৌঁছেছি এবং এই জায়গায় থাকলেও এ বাড়িতে ঠিক আমি ছিলাম না।

কি রকম?

এখান থেকে মাইল পনের দূরে আমাদের একটা কোলিয়ারিতে গোলমাল চলছিল, এখানে। এসে পৌঁছবার পরই সেখানে আমাকে দাদা অসুস্থ বলে তার নির্দেশে চলে যেতে হয়। এই সবে সেখান থেকে দিন দশেক হল এই বাড়িতে ফিরে এসেছি।

কিরীটী দুঃশাসন চৌধুরীর জবাবে কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবে, তারপর আবার তাঁর মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন শুরু করে, দালাল সাহেবের কাছে জবানবন্দিতে আপনি রুচিরা দেবীর কথায় অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছেন, আপনি রায়বাহাদুরের নিহত হওয়ার সংবাদটা নাকি তাঁকে আদৌ দেননি। অথচ রুচিরা দেবী জোর দিয়ে বলছেন—

সে মিথ্যে কথা বলছে। আমি কেবল বৃহন্নলাকে সংবাদটা দিয়েছিলাম।

হুঁ। আচ্ছা রায়বাহাদুরের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে যে ভৃত্যটিকে আপনি দেখেছিলেন তার নাম কি?

কৈরালাপ্রসাদ।

কতদিন সে এখানে আছে?

দাদার খাসভৃত্য, শুনেছি বছর পাঁচেক সে এ বাড়িতে কাজ করছে, ইদানীং রোগীর ঘরের যাবতীয় ফাইফরমাশই সে খাটত।

লোকটা বিশ্বাসযোগ্য নিশ্চয়ই?

হ্যাঁ, সেই রকমই তো মনে হয়।

আচ্ছা আপনি যদি রুচিরা দেবীকে সংবাদটা না দিয়ে থাকেন, তাঁকে কে ঐ সংবাদটা দিতে পারে বলে আপনার মনে হয়?

বলতে পারি না।

আপনি কি বিয়ে করেছেন?

কিরীটীর প্রশ্নটা যেন অত্যন্ত অতর্কিত ভাবেই আসে। এবং প্রশ্নের জবাবটা সঙ্গে সঙ্গে না দিয়ে একটু যেন ইতস্ততঃ করেই দুঃশাসন চৌধুরী বললেন, না।

আর একটি কথা মিঃ চৌধুরী, রায়বাহাদুরের যে বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল গতকাল রাত ঠিক চারটের সময়ই তাঁর মৃত্যু হবে বা কেউ তাঁকে হত্যা করবে—এ ধরণের বদ্ধমূল ধারণা হবার কোন কারণ ছিল বলে আপনি জানেন কিছু?

না। সত্যি কথা বলতে কি মিঃ রায়, ব্যাপারটাকে তো আমি শোনা অবধি হাস্যকর বলেই কোন গুরুত্ব দিইনি গোড়া থেকেই।

আচ্ছা আপনি এবার যেতে পারেন। বৃহন্নলা চৌধুরীকে একটিবার পাঠিয়ে দিন এ ঘরে।