১২. কিরীটী পকেট থেকে তার নোট বুকটা

কিরীটী পকেট থেকে তার নোট বুকটা বের করল এবংনিম্নলিখিত কথাগুলো মনে মনে পর্যালোচনা করে এক, দুই, তিন ক্রমিক নম্বর দিয়ে পর পর লিখে যেতে লাগল।

১। রায়বাহাদুর যে গতরাত্রে ঠিক চারটের সময় নিহত হবেন সেটা তিনি অন্ততঃ এখন বোঝা যাচ্ছে জানতেন।

[টীকা: তাঁর এরূপ বদ্ধমূল ধারণা হওয়ার সত্যি কোন কারণ ছিল কি? না ডাক্তার যা বলছেন ব্যাপারটা সম্পূর্ণ একটা hallucination—তাই? এবং তা যদি হয় তাহলে কেন হল ঐ রকম একটা hallucination এবং তার কারণ কি?]

২। ধারণা থেকে আর যাই হোক রাত্রি পৌনে চারটে থেকে চারটের মধ্যে যে তিনি নিহত হয়েছেন এ স্বতঃসিদ্ধ।

[টীকা: কাজেই ব্যাপারটা যেখানে স্বতঃসিদ্ধ সেখানে hallucination-এর theory কতদুর প্রযোজ্য?]

৩। ঐ পনের মিনিট সময়ের মধ্যে বাড়ির প্রত্যেকেই কে কোথায় ছিল এবং কে কি অবস্থায় ছিল?

[টীকা : প্রত্যেকের জবানবন্দি কি বিশ্বাসযোগ্য? গান্ধারী দেবীর জবানবন্দির মধ্যে প্রায় সবটাই মিথ্যে। তিনি জেগেই ছিলেন এবং কেন ছিলেন? জেগে থাকবার কি তাঁর কোন কারণ ছিল?]

৪। ঐ সময় গান্ধারী দেবীর শয়নঘরের পাশের ঘরে রুচিরা কি করছিল?

 [টীকা: যতদুর মনে হচ্ছে ঐ সময় কেউ না কেউ তার ঘরে এসেছিল। কে তার ঘরে এসেছিল? সমীরবাবু কি?]।

৫ রুচিরা ও সমীরবাবুর মধ্যে সত্যিকারের কোন ভালবাসা ও understanding আছে কি?

[টীকা: সম্ভবতঃ পরস্পর পরস্পরকে ভালবাসে না। গান্ধারী দেবীর কথাবাতা থেকেই সেটা কিছু প্রমাণিত হয়েছে। আরও বিশদ আলোচনার প্রয়োজন। একটা ব্যাপারে কেমন

যেন সন্দেহ হয়। ডাঃ সমর সেনকে দেখে রুচিরা অমন করে তাকিয়ে ছিল কেন?]

৬৷ ঐ পনের মিনিট সময়ের মধ্যে কে সুলতা করকে কফি দিতে এসেছিল সত্যি সত্যি? সুলতা বলছে অবিশ্যি ডাঃ সানিয়ালই তাকে কফি দিতে এসেছিলেন। কিন্তু তা অসম্ভব। কারণ ডাঃ সানিয়াল তখন তার ঘরেই ছিল। তাই যদি হয় তাহলে কে ডাঃ সানিয়ালের ছদ্মবেশে তাকে গতরাত্রে কফি দিতে গিয়েছিল? আর ছদ্মবেশধারীকে সুলতা কর চিনতেই বা পারল না কেন? না চেনবার তো কথা নয়। ডাক্তারকেও একবার কথাটা জিজ্ঞাসা করা প্রয়োজন।

[টীকা: বিশেষ উল্লেখযোগ্য এবং প্রধান সূত্র।]

৭। হত্যার ব্যাপারে এ বাড়ির কার কার interest থাকা সম্ভব।

[টীকা: বলতে গেলে রায়বাহাদুরের আত্মীয়দের মধ্যে প্রত্যেকেরই। কিন্তু তাহলেও কার ওদের মধ্যে interest সর্বাপেক্ষা বেশী ছিল বা থাকতে পারে। দ্বিতীয় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সূত্র।]

৮৷ রায়বাহাদুরের সত্যি কোন উইল আছে কি?

[টীকা: থাকাটাই সম্ভব। তবে হয়ত এখন আর পাওয়া যাবে না খুঁজে।]

৯। শকুনি ঘোষের ঘরের মধ্যে প্রাপ্ত কাপড়ের মধ্যে রক্তের দাগ ছিল। রক্ত কোথা থেকে এল তার সেই পরিত্যক্ত পরিধেয় বস্ত্রে এবং সেই বস্ত্র সিক্তই বা ছিল কেন?

[টীকা: রক্তের কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করে দেখতে হবে।]

১০৷ গান্ধারী দেবী শকুনির নিকট কাকে এই হত্যার ব্যাপারে সন্দেহ করেন বলতে এসেছিলেন, এবং ঘরের মধ্যে তাকে দেখতে পেয়ে ব্যাপারটা চেপে গেলেন।

[টীকা: বিশেষ উল্লেখযোগ্য তৃতীয় সূত্র।]

.

বর্তমানে সর্বাগ্রে এই দশটি পয়েন্টের মীমাংসার একটা আশু প্রয়োজন। ঐ পয়েন্টগুলোর একটা সুমীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত রায়বাহাদুরের হত্যার ব্যাপারটা একটা রহস্যের অন্ধকারে অস্পষ্টই থেকে যাবে।

কিরীটী চিন্তা করতে থাকে—এখন কোন পথে অগ্রসর হওয়া যায়।

বাইরে ঐ সময় জুতোর শব্দ পাওয়া গেল। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দুঃশাসন চৌধুরী ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন।

কিরীটীর দুঃশাসন চৌধুরীর মুখের দিকে চেয়ে মনে হয়, এক রাত্রের শেষের দিকের মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই যেন ভদ্রলোকের মনের মধ্যে একটা ঝড় বয়ে গিয়েছে। চোখে মুখে একটা সুস্পষ্ট ক্লান্তির ও দুশ্চিন্তার আভাস যেন স্পষ্ট।

আসুন মিঃ চৌধুরী। কিরীটী আহ্বান জানায়, বসুন।

নির্দিষ্ট চেয়ারটার ওপর বসতে বসতেই ক্লান্ত অবসন্ন কণ্ঠে দুঃশাসন চৌধুরী বললেন, ব্যাপারটা কি হল বলুন তো মিঃ রায়? শেষ পর্যন্ত দাদার অনুমানই সত্য হল নাকি? সত্যি কথা বলতে কি মিঃ রায়, আমি যেন এখনও ঠিক ব্যাপারটার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।

আপনি এসেছেন মিঃ চৌধুরী ভালই হল। পুলিসের সমস্ত ব্যাপারটা পুরোপুরি হাতে নেওয়ার আগে আমি আপনাদের সকলের সঙ্গে আর একবার খোলাখুলি আলোচনা করব ভেবেছিলাম।

বলুন কি জানতে চান! আর সত্যি কথা বলতে কি মিঃ রায়, আমি যেন সত্যিই puzzled হয়ে আছি।

পাজল শুধু আপনিই নন দুঃশাসনবাবু, প্রত্যেকেই হয়েছেন।

আচ্ছা আপনার এ ব্যাপারে কি ধারণা বলুন তো মিঃ রায়?

সে কথা বলবার আগে একবার আপনাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই আমি আলোচনা করে নিতে চাই। দালাল সাহেব বিকেলেই আসবেন বলে গেছেন। তাঁর আসবার আগেই এ ব্যাপারটা আমি শেষ করে দিতে চাই।

বলুন আমাকে কি করতে হবে?

প্রত্যেকের সঙ্গে আমি আলাদা আলাদা ভাবে আলোচনা করব। এবং আপনাকেই সেই। ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

বেশ।

অনুগ্রহ করে তাহলে পনের মিনিট বাদে ডাঃ সানিয়ালের ঘরে এলে আমি খুশি হব।

বেশ তাই হবে।

দুঃশাসন চৌধুরী অতঃপর ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন কেমন শ্লথ ক্লান্ত পায়ে।

কিরীটীর মনে হয়, হঠাৎ দুঃশাসন চৌধুরী তার ঘরে কেন এসেছিলেন? কোন কথা বলতে কি?

কি কথা?

দুঃশাসন চৌধুরী কি কিছু জানেন এবং জেনে বিশেষ কারণেই সেটা গোপন করে যাচ্ছেন? লোকটা ধূর্ত নিঃসন্দেহে এবং বময় নিজের ব্যবসা গুটিয়ে বাংলা মুলুকে চলে এসেছেন—শুধু মাত্র কি রায়বাহাদুরের অনুরোধেই, না অন্য কোন কারণে?