০৮. সেতারে ভৈরো আলাপ

বাঈজী সেতারে ভৈরো আলাপ করছিল ও চাপা কণ্ঠে গুনগুন সুর ভাঁজছিল।

আর অবিনাশ চৌধুরী সেই ঘরের বিস্তৃত গালিচার ওপরে একটা জাপানী ঘাসের চটি পায়ে ইতস্তত পায়চারি করছিলেন এবং নিম্নস্বরে আপন মনে আবৃত্তি করছিলেন :

নারায়ণ! নারায়ণ বল কত বাকী
আর। শত পুত্রহারা কাঁদিছে গান্ধারী,
শত পুত্রবধূ তার! রক্ত শবে পরিকীর্ণ
কুরুক্ষেত্র ভূমি! অক্ষৌহিণী নারায়ণী
সেনা হয়েছে নিঃশেষ।

মুষ্টিবদ্ধ হাত দুটি পিছনে রেখে অবিনাশ চৌধুরী পায়চারি করছিলেন।

ভোরের প্রসন্ন আলো মুক্ত বাতায়নপথে ঘরের মধ্যে বিস্তৃত রক্তবর্ণ গালিচার উপরে এসে লুটিয়ে পড়েছে।

সহসা একসময় বাঈজীর দিকে ফিরে চেয়ে অবিনাশ চৌধুরী বলেন, মুন্নাবাঈ, এখন গান থাক! আজকে তোমার বিশ্রাম— তুমি যাও।

বারেকের জন্য মাত্র অবিনাশ চৌধুরীর দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে মুন্নাবাঈ নিঃশব্দে সেতারটা একপাশে গালিচার ওপরে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল।

খেয়ালী অবিনাশ চৌধুরীর বিচিত্র মতিগতির সঙ্গে সে বিশেষ পরিচিত।

এবং নিঃশব্দেই সে তার নির্দিষ্ট ঘরে যাবার জন্য দরজার দিকে পা বাড়ায়।

পাশেরই সংলগ্ন একটি নাতিপ্ৰশস্ত ঘর মুন্নাবাঈয়ের জন্য নির্দিষ্ট।

মুন্নাবাঈ তার ঘরে এসে প্রবেশ করল।

আধুনিক রুচিসম্মত ভাবে ঘরটি তার সুসজ্জিত।

মুন্নার সমস্ত অন্তরের মধ্যেই তখনও যেন ভৈরো রাগের একটা সুর-মন্থন চলেছে।

প্রত্যুষের প্রসন্ন আলোয় সমস্ত অন্তর জুড়ে তার তখন যেন ভৈরো রাগের রঙ লেগেছে। জেগেছে সুর।

মেঝেতে বিস্তৃত পুরু গালিচার একপাশে রক্ষিত নিজের তানপুরাটা টেনে নিয়ে কোলের কাছে মেঝেতে গালিচার ওপরই বসে মুন্না বাঈজী।

তানপুরার তারে মৃদুমন্দ অঙ্গুলি চালনা করতে করতে সে গুনগুনিয়ে ওঠে–

ধন ধন সুরত কৃষ্ণ মুরারে
সুলছানা গিরিধারী
সব সুন্দর লাগে
অত পিয়ারী।

নিঃশব্দ পদসঞ্চারে কখন ইতিমধ্যে একসময় যে রুচিরা বাঈজীর ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করেছিল তা সে টেরও পায়নি।

রুচিরা এ বাড়িতে বেশী একটা থাকে না।

সে কলকাতায় কলেজে পড়ে। মধ্যে মধ্যে ছুটিছাটায় কেবল কখনও বেড়াতে আসে, আবার ছুটি ফুরোলেই কলকাতায় ফিরে যায়।

এ বাড়ি সম্পর্কে তার এই কারণেই বোধ হয় এতটুকুও কৌতূহল কোনদিন ছিল না।

এ বাড়ির আবহাওয়া হতে শুরু করে এই বাড়ির লোকগুলিও যেন কেমন তার নিকট অদ্ভুত বিচিত্র বলে মনে হয়।

কেমন যেন একটা চাপা গুমোট ভাব, একটা বিকৃত শাসনের নাগপাশ যেন এই বাড়ির প্রাণকে চেপে রেখেছে অষ্টপ্রহর।

এখানে প্রত্যেকেই প্রত্যেক হতে স্বতন্ত্র, কেউই যেন কারও আপনার নয়।

কারও সঙ্গে কারও যেন বিন্দুমাত্রও মনের যোগাযোগ নেই। কারও জন্য কারও যেন এতটুকু সমবেদনা স্নেহ বা ভালবাসা নেই।

মনে হয় কেমন প্রত্যেকেই যেন একটা কুৎসিত স্বার্থের ঘূণাবর্তের মধ্যে পাক খেয়ে খেয়ে এ বাড়ির আবহাওয়াকে বিষাক্ত ও ঘোলাটে করে রেখেছে।

কেউ কাউকে বিশ্বাস পর্যন্ত যেন করে না।

এবং যতবারই সেই কারণে রুচিরা এখানে এসেছে এবং যে কদিন থেকেছে, নিজেকে যেন এ বাড়ির সকল কিছু থেকে কতকটা ইচ্ছে করেই পৃথক করে রেখেছে, নিজের স্বাতন্ত্র নিয়ে দিনগুলো কাটিয়েছে।

আর একটা কথা। এ বাড়িতে এসে থাকাকালীন সময়ে তবুও কদাচিৎ কখনও অন্য সকলের ঘরে গেলেও এবং একটা-আধটা কথা কারও সঙ্গে বললেও, কেন যেন আজ পর্যন্ত ছুটিছাটা উপলক্ষে ইতিপূর্বে সে এ বাড়িতে যতবার এসেছে কোনবারই দাদু অবিনাশ চৌধুরীর মহলে সে প্রবেশ করেনি এবং সেই কারণেই বোধ হয় বাঈজীকে দেখেনি বা দেখতে পায়নি। অবিশ্যি বাঈজীর এ বাড়িতে এই প্রথম পদার্পণ নয়।

গতকাল প্রত্যুষে তাই সে যখন অন্দরের বাগানে বেড়াচ্ছিল, এক মুহূর্তের জন্য দূর থেকে ভ্রমণরতা বাঈজীকে দেখেই সে যেন চমকে উঠেছিল।

চমকাবার অবিশ্যি কারণও ছিল। মুখটা যেন কেমন দূর থেকেই চেনা-চেনা লেগেছিল। কোথায় কবে যেন সে এ মুখটির সঙ্গে বিশেষ ভাবেই পরিচিত ছিলও। কিন্তু ভেবে কিছুই ঠিক করতে পারছিল না।

অবশেষে আর কৌতূহলকে দমন করতে না পেরে আজ খোঁজ করতে করতে বাঈজীর ঘরে এসে নিজেই প্রবেশ করেছে।

বাঈজী তানপুরায় ভৈরো রাগ আলাপ করছিল। আপন মনেই বাঈজী আলাপ করছিল, রুচিরা যে তার ঘরে এসে ঢুকেছে সে টেরও পায়নি। চেয়েছিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুচিরা বাঈজীর দিকে। কণ্ঠস্বর ও বসবার ভঙ্গীটি পর্যন্ত তার যেন কতই না পরিচিত।

কে—কে ঐ বাঈজী?

দাদুর গান-বাজনার প্রচণ্ড নেশা আছে ও জানত এবং মধ্যে মধ্যে নাকি বাঈজীরা দাদুর কাছে গানের মুজরা নিয়ে আসে এ গৃহে দু-চার-দশ দিনের জন্য।

সে কারণে বাঈজীর প্রতি আকৃষ্ট হয়নি সে, হয়েছিল গতকাল সন্ধ্যায় দূর থেকে উদ্যানে ভ্রমণরতা বাঈজীকে দেখে।

আলাপ শেষ হতেই তানপুরাটা কোলের কাছে নামিয়ে রেখে গুনগুন করে তখনও সুর ভাঁজতে ভাঁজতে সামনের দিকে তাকাতেই বাঈজীর সামনে দর্পণে প্রতিফলিত ঠিক পিছনেই নিঃশব্দে দণ্ডায়মানা রুচিরার প্রতিকৃতির প্রতি দৃষ্টি পড়তেই চমকে বাঈজী ফিরে তাকায়।

পরস্পরের সঙ্গে চোখাচোখি হল। কিছুক্ষণ পরস্পর পরস্পরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। কথা বলে প্রথমে এবারে রুচিরাই, সাবিত্রী না? এতক্ষণে রুচিরা চিনতে পেরেছে বাঈজীকে।

বাঈজী আর কেউ নয়, সাবিত্রী। বেথুনে ম্যাট্রিক পড়বার সময় তার সহপাঠিনী তো ছিলই, রুচিরার সঙ্গে হোস্টেলের একই ঘরে বাসও করেছিল সে কয়েক মাস।

অত্যন্ত অন্তরঙ্গতা একদিন ছিল ওদের পরস্পরের মধ্যে।

রুচি!

এতক্ষণে বাঈজীরও কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

হ্যাঁ। আশ্চর্য! কিন্তু তুই এখানে? রুচিরা প্রশ্ন করে।

মৃদু হাসির একটা আভাস যেন খেলে যায় বাঈজীর ওষ্ঠের ওপরে, হ্যাঁ। আজ আমার পরিচয় আর সাবিত্রী নয়, আজ আমি মুন্না বাঈজী।

মুন্না বাঈজী!

হ্যাঁ। কিন্তু তুই এখানে? কিছুই তো বুঝতে পারছি না রুচি! সাবিত্রী দ্বিতীয়বার আবার প্রশ্ন করে।

এটা তো আমার মামার বাড়ি। তুই তো জানিস মামাদের পয়সা ও দয়াতেই আমি মানুষ।

হ্যাঁ হ্যাঁ, ভুলে গিয়েছিলাম—কত দিনকার কথা। প্রায় তিন-চার বছর হবে, তাই না?

তা হবে বৈকি।

রায়বাহাদুর—যিনি গতকাল—

হ্যাঁ, তিনিই আমার মামা। আর অবিনাশ চৌধুরী—ওঁর কাকা হলেন আমার দাদু।

ও।

সাবিত্রী যেন হঠাৎ চুপ করে গেল।

খোলা বাতায়ন-পথে দৃষ্টি প্রসারিত করে অতঃপর নিঃশব্দে বসে রইল কিছুক্ষণ সাবিত্রী।

রুচিরা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তখন সাবিত্রী— মুন্না বাঈজীর দিকে।

সাবিত্রী!

তার সহপাঠিনী সাবিত্রী—যার রূপের ও কণ্ঠের খ্যাতি একদিন সমস্ত কলেজ ছাত্রীদের মধ্যে হিংসার বস্তু ছিল!

লেখাপড়ায় সাবিত্রী কোন দিনই ভাল ছিল না তেমন, অত্যন্ত সাধারণ শ্রেণীর ছাত্রী ছিল।

কিন্তু তবু সারা কলেজে তাকে চিনত না এমন কেউ ছিল না, তার মধুক্ষরা কণ্ঠের জন্য।

নিঃশব্দে সাবিত্রী বসে আছে।

খুব প্রত্যুষেই বোধহয় স্নান করেছে। পরিধানে সাদা মিলের নরুণপাড় একটা ধুতি। দু কাঁধের ওপর দিয়ে সিক্ত চুলের গোছা বুকের দুপাশে বিলম্বিত।

কপালে দুই জ্বর মধ্যস্থলে একটি বোধ হয় শ্বেতচন্দনের টিপ।

সিঁথিতে বা কপালে এয়োতির চিহ্নমাত্রও নেই। অথচ সাবিত্রী তো বিবাহিতাই ছিল যতদূর ওর মনে পড়ে। ওর সমগ্র চোখেমুখে যেন একটা বিষণ্ণ করুণ দুঃখের ও ক্লিষ্ট যাতনার ছায়া।

রুচিরা আবার মৃদু কণ্ঠে ডাকে, সাবিত্রী!

সাবিত্রী রুচিরার ডাকে যেন হঠাৎ চমকে ওঠে।

এবং অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে বলে এবারে, সাবিত্রীকে হঠাৎ আজ এই বেশে সামান্য এক বাঈজীর পরিচয়ে এতদিন পরে দেখে খুব চমকে গিয়েছিস, না? আয়, বোস। রুচিরার দিকে তাকিয়ে সাবিত্রী রুচিরাকে আহ্বান জানায়।

না। কিন্তু—

ও, তুই তো শুনেছিলি যে স্বামীর ঘরে যাবার পর সাবিত্রী আফিং খেয়ে আত্মহত্যা করেছিল—

না।

শুনিসনি? আশ্চর্য!

না, শুনিনি। আবার কিছুক্ষণ কতকটা যেন আত্মচিন্তায় বিভোর হয়েই সাবিত্রী নিঃশব্দে যেমন বসে ছিল তেমনি বসে থাকে।

হঠাৎ আবার সাবিত্রী কথা বলে, সত্যি ভাই, আমার নিজেরই কি এক এক সময় কম আশ্চর্য লাগে! বাপ মা নাম রেখেছিল সাবিত্রী। দিদিমার মুখে খুব ছোটবেলায় গল্প শুনেছিলাম,যমের গ্রাস থেকে স্বামীকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে সাবিত্রী হয়েছিল সতী-সীমন্তিনী, নারীকুলে ধন্যা গরবিনী। আর আমিও সাবিত্রী—স্বামীকে নিজ হাতে হত্যা করে হয়েছি মুন্না বাঈজী! আমিও নারীকুলে অনন্যা, কি বলিস!

একটানা কথাগুলো বলে হাসতে লাগল সাবিত্রী। চোখেমুখে একটা নারকীয় জঘন্য উল্লাস যেন উপচে পড়তে থাকে।

সাবিত্রীর কথায় রুচিরা যেন সত্যিই একেবারে বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গিয়েছিল।

কি বলছিস তুই সাবিত্রী! স্বামীকে হত্যা করেছিস?

হ্যাঁ। কেন, বিশ্বাস হচ্ছে না? এই হাত, এখনও এতে—ভাল করে চেয়ে দেখ, হয়তো হত্যার রক্ত লেগে আছে।

কেমন একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে যেন সাবিত্রী তাকিয়ে আছে রুচিরার দিকে।

ঘৃণা, বিদ্বেষ, আক্রোশ সব কিছুই যেন সাবিত্রীর দুই চোখের দৃষ্টির মধ্যে ঐ মুহূর্তে একসঙ্গে ফুটে উঠেছে।

দাঁড়া, দরজাটা ভাল করে বন্ধ করে দিয়ে আসিবলতে বলতে হঠাৎই যেন সাবিত্রী উঠে গিয়ে ঘরের দরজার কপাট দুটো বন্ধ করে দিয়ে ফিরে এল। এবং যেখানে বসেছিল সেইখানেই এসে বসল।

সাবিত্রী আবার বলে, ভাগ্যি সাবিত্রীর রূপ ছিল— বোকা পুরুষগুলোর চোখ-ঝলসানো রূপ ছিল, নচেৎ এত বড় কোনদিন কি হতে পারতাম! গরীবের ঘরে জন্মেছিলাম, কিন্তু সেই রূপের দৌলতেই তো ধনীর ঘরে বিকিয়ে গেলাম, সে-সব কথা তো তুই জানিসই।

হ্যাঁ, কিন্তু মৃদুকণ্ঠে কি বলতে গিয়েও যেন থেমে গেল রুচিরা।

রূপের দৌলতে ধনীর ঘরের বধূ হবার সৌভাগ্যটুকুই কেবল সেদিন আমি তোকে বলেছিলাম রুচি, কিন্তু সে ধনীর ঘরের বধূর দৈনন্দিনের পরবর্তী যে দুঃখ ও লাঞ্ছনার কাহিনী সেটা সেদিন তোকে আমি শোনাইনি।

সাবিত্রী!

তাই। ধনীর পুত্রবধূ সাবিত্রীর কাহিনীই সেদিন তুই শুনেছিলি ভাই কিন্তু শোনানো হয়নি তোকে কেমন করে সেই বধূকে একদিন অনন্যোপায় হয়ে আজকের এই বাঈজীতে রূপান্তরিত হতে হল।

রুচিরা চেয়ে থাকে সাবিত্রীর মুখের দিকে।

একটা দীর্ঘশ্বাস রোধ করে সাবিত্রী আবার বলতে শুরু করে :

উঃ! যখন ভাবি না সেদিনকার কথাগুলো, ঘৃণায় লজ্জায় আর ধিক্কারে যেন মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছা করে। তখন কি জানি কেন কলেজে পাঠিয়েছিল আমায়! খেয়াল—লম্পট, ধনী স্বামীর খেয়াল! আমায় কলকাতায় পড়তে পাঠালে। ছোট শহরের এক স্কুলে পড়ছিলাম, সেখান থেকে ছাড়িয়ে এনে কলকাতায় ভর্তি করে দিল বেথুনে। ধনীর খেয়াল কিনা তাই হঠাৎ একদিন ডাক এল আবার স্বামীর ঘরে ফিরে যাবার, পড়াশুনায় ইস্তফা দিয়ে মধ্যপথেই।

হ্যাঁ, মনে আছে পরীক্ষার মাত্র দিনকয়েক আগে তুই পরীক্ষা না দিয়েই স্বামীর ঘর করতে চলে গেলি।

স্বামীর ঘরই বটে। তবে ভেতরের ঘর নয়, বাইরের ঘর। স্বামীর বিলাসভবন বাগানবাড়িতে, নাচঘরে।

বলিস কি!

এক বর্ণও মিথ্যে নয়। এবং সেই বাগানবাড়িতে গিয়েই শুনলাম বিবাহিতা হলেও স্বামীর গৃহের অন্দরমহলে প্রবেশের নাকি আমার কোন অধিকার নেই—আমি সেখানে অহেতুক অনাবশ্যক বোঝা মাত্র।

কেন? প্রশ্নটা না করে চুপ করে থাকতে পারে না রুচিরা, তোকেও তো তিনি বিয়েই করেছিলেন।

তা করেছিলেন বটে, তবে ঘরে তাঁর প্রথম বিবাহিতা গৃহলক্ষ্মী ছিলেন। আমার স্বামীর প্রথমা পত্নী। তাঁর সন্তানের জননী। তাঁর ছাড়পত্রে আগেই শীলমোহর পড়ে গিয়েছিল কিনা।

সে কি! তুই শুনিসনি কিছু বিয়ের সময় যে তাঁর আগের স্ত্রী বর্তমান ছিল!

গরীব কন্যাদায়গ্রস্ত মা-বাপ আমার, তার ওপরে বিনা পণে এত বড় ঘরে এমন পাত্রে বিয়ে, তাঁরা হয়ত তাই আর কিছু শোনাটা প্রয়োজন মনে করেননি, কারণ জানবার কথা তো তাঁদেরই, আমার তো নয়। আমি তো তখন বাংলা দেশের বিয়ের কনে মাত্র। দেওয়া না-দেওয়ার ক্ষমতাটা তো ছিল তাঁদেরই হাতে। আইনগত জন্মস্বত্ব সেদিন তো তাঁদের হাতেই ছিল।

হুঁ, তারপর?

তারপর আর কি! ঘর যেখানে জলসাঘর, সেখানে গৃহস্থ বধূর পরিণতি কি হতে পারে এ তত সহজেই বুঝতে পারিস।

স্বামী হয়ে তোকে—

মুহূর্তে যেন সাবিত্রীর দুই চক্ষুর তারা রুদ্র তেজে জ্বলে ওঠে।

তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে, স্বামী! কাকে তুই স্বামী বলিস! যে তার নিজের বিবাহিতা স্ত্রীকে অনায়াসে লম্পটের ক্ষুদার অনলে সমর্পণ করতে পারে সে কি স্বামী? নাই বা হল এটা আইনগত সিদ্ধ বিয়ে, তবু তো অগ্নি-নারায়ণশিলা সাক্ষী রেখেই আমাদের বিয়েটা হয়েছিল। মন্ত্র ও সেই অনুষ্ঠানকে না হয় সে অস্বীকার করলে, কিন্তু দায়িত্ব নীতি বা রুচি বলে কি কিছুই নেই? ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মতই যেন একটা চাপা আক্রোশে ফুলতে থাকে সাবিত্রী।

বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গিয়েছে যেন রুচিরা।

সাবিত্রী বলতে থাকে, কিন্তু আমিও তাকে ক্ষমা করিনি। অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছি। কিন্তু বাকি একজনকে এখনও খুঁজে সামনে পাইনি। সঙ্গীতপিপাসু সে, তাই গানের মুজরা নিয়ে বাগানবাড়িতে বাগানবাড়িতে গানের আসরে আসরে হানা আজও দিয়ে বেড়াচ্ছি, কারণ জানি একদিন-না একদিন তার সন্ধান পাবই। সেই দিন—বলতে বলতে সহসা মুন্না বাঈজী কোমর থেকে একটা তীক্ষ্ণ ধারাল ছুরি বের করে। ছুরির চকচকে অগ্রভাগটা যেন জিঘাংসায় হিলহিল করে ওঠে।

রুচিরা চমকে উঠে দু পা পিছিয়ে যায়।

সাবিত্রী খিলখিল করে হেসে ওঠে এবং হাসতে হাসতেই আবার ছুরিটা কোমরে গুঁজে রাখতে রাখতে বলে, ভয় পেলি রুচি? সম্মানের সঙ্গে গৃহের আব্রু নিয়ে নারীর মর্যাদায় তোরা

প্রতিষ্ঠিত; অপমানিত লাঞ্ছিত নারীত্বের মর্মন্তুদ জ্বালা যে কী—কেমন করে তারা বুঝবি ভাই! কি যন্ত্রণায় তারা নিশিদিন ছটফট করে মাথা খুঁড়ে মরে কেমন করে তোরা বুঝবি!

সাবিত্রীর দু চোখের কোণ বেয়ে অশ্রুর ধারা নেমে আসে।

আর নির্বাক বিস্ময়ে সেই দিকে তাকিয়ে বসে থাকে রুচিরা যেন পাথরের মত।