০৫. বৃহন্নলা চৌধুরী কেমন যেন

বৃহন্নলা চৌধুরী কেমন যেন বিহ্বল দৃষ্টিতে দালাল সাহেবের মুখের দিকে চেয়ে বলে, বলুন!

আশা করি আপনাকে যা যা জিজ্ঞাসা করব তার সঠিক জবাব পাব।

নিশ্চয়ই।

গলার স্বরটা মৃদু।

রাত তিনটে থেকে এ ঘরে আসবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আপনি কি আপনার ঘরেই ছিলেন?

হ্যাঁ। সন্ধ্যে থেকেই শরীরটা আমার আজ ভাল ছিল না। তাছাড়া ডাঃ সানিয়াল বলেছিলেন ভয়ের কোন কারণ নেই, তাই নিজের ঘরেই ঘুমিয়ে ছিলাম।

সে ঘরে আর কেউ ছিল?

না। আমি একাই এক ঘরে শুই বছরখানেক যাবৎ।

আপনার স্ত্রী ও ছেলে।

পাশের ঘরে তারা শোয়।

কার কাছে এ দুঃসংবাদ প্রথমে পেয়ে তাহলে আপনি এঘরে আসেন?

কাকাই গিয়ে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে সব কথা বলেন।

কাকা মানে দুঃশাসনবাবু?

হ্যাঁ।

এবারে কিরীটী প্রশ্ন করে, হুঁ, আচ্ছা বৃহন্নলাবাবু, আপনার বাবা যে রাত্রে মারা যাবেন এ কথা আপনাকে বলেছিলেন কি কখনও?

বলেছিলেন। কিছুদিন থেকে প্রত্যেকের কাছেই তো ও কথা বলেছেন তিনি।

আচ্ছা হঠাৎ ঐ ধরনের কথা বলবার তাঁর কোন সঙ্গত কারণ থাকতে পারে বলে আপনার মনে হয় কি বৃহন্নলাবাবু? দালাল সাহেব প্রশ্ন করেন।

কি জানি, আমি তো দেখতে পাই না।

এমন সময় ঘরের মধ্যে সকলকে বিস্মিত ও সচকিত করে অপূর্ব একটি নারীকণ্ঠ শোনা গেল।

বৃহন্নলা! দাদাকে নাকি সত্যিসত্যিই কে খুন করেছে?

যুগপৎ ঘরের মধ্যে উপস্থিত সব কটি প্রাণীই সেই নারীকণ্ঠ শুনে ফিরে তাকায়।

মধ্যবয়সী অপূর্ব সুন্দরী এক নারী ও তার পার্শ্বে এক অপূর্ব সুন্দরী কুড়ি-একুশ বৎসর বয়স্কা যুবতী।

শুধু অপূর্ব সুন্দরীই নয় সেই যুবতী, রূপের যেন তার সত্যিই তুলনা নেই।

কি রূপ!

চিত্রকরের আঁকা যেন একখানা ছবি।

চোখের দৃষ্টি যেন ফেরানো যায় না।

দুটি অসমবয়েসী নারীমূর্তিকে দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না যে একে অন্যের প্রতিচ্ছায়া। অর্থাৎ মা ও মেয়ে।

সকলেই বর্ষীয়সী নারীর প্রশ্নে স্তম্ভিত, নির্বাক।

বৃহন্নলা চৌধুরীই কথা বলে প্রথমে, পিসিমা!

কিরীটী এতক্ষণে চিনতে পারে, ইনিই দুর্যোধন চৌধুরীর বিধবা ভগিনী গান্ধারী দেবী। বৃহন্নলার পিসিমা এবং তাঁর পার্শ্বে দাঁড়িয়ে গান্ধারী দেবীর একমাত্র কন্যা রুচিরা দেবী।

রুচিরার অপূর্ব রূপলাবণ্যের কথা কিরীটী রায়বাহাদুরের মুখে ইতিপূর্বে শুনেছিল বটে তবে ভাবতে পারেনি যে রুচিরা সতিসত্যিই অমনি রূপবতী।

মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে কিরীটী রুচিরার দিকে এবং শুধু কিরীটীই নয়, ডাঃ সমর সেনও বিস্ময়ে যেন অভিভূত হয়ে রুচিরার দিকে চেয়ে ছিল পলকহীন দৃষ্টিতে।

আপনিই রায়বাহাদুরের বোন? সহসা কিরীটী গান্ধারী দেবীর দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ। মৃদুকণ্ঠে গান্ধারী দেবী প্রত্যুত্তর দেয়।

আপনার দাদা রায়বাহাদুর যে নিহত হয়েছেন কার মুখে শুনলেন?

রুচি আমাকে একটু আগে গিয়ে বলল।

কে? রুচিরা দেবী, মানে আপনার মেয়ে?

হ্যাঁ।

এবারে কিরীটী রুচিরার মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল, আপনি বলেছেন আপনার মাকে যে আপনার মামা নিহত হয়েছেন?

হ্যাঁ।

আপনি কি করে জানলেন সে কথা?

আমি–রুচিরা একবার মার মুখের দিকে চেয়ে কিরীটীর মুখের দিকে ফিরে তাকিয়ে কেমন যেন ইতস্তত করে।

হ্যাঁ, আপনি জানলেন কি করে? আমি তো জানি আপনারা দক্ষিণের মহলে থাকেন, তাই না?

হ্যাঁ।

তবে?

আমাকে ছোটমামাবাবুই তো গিয়ে বলে এসেছেন।

কি বললি, আমি বলে এসেছি? বিশ্বাস করবেন না, মিথ্যে কথা—দুঃশাসন চৌধুরী হঠাৎ রূঢ়-কঠিন প্রতিবাদে চিৎকার করে ওঠেন এবং যুগপৎ সকলেই তাঁর মুখের দিকে তাকায়।

মিথ্যে কথা বলছি? কি বলছ ছোটমামাবাবু? একটু আগে গিয়ে তুমি আমাকে বলে আসোনি যে বড়মামাবাবুকে ছোরা দিয়ে কে যেন খুন করেছে! সেই কথা শুনেই তো আমি মাকে গিয়ে খবর দিয়েছি।

Its a damn lie! ডাহা মিথ্যে কথা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দুঃশাসন চৌধুরী আবার প্রতিবাদ জানায়, কখন তোর ঘরে আমি গিয়েছিলাম রে মিথুক? আমি তো বৃহন্নলাকে ডাকতে গিয়েছিলাম। তার ঘরেই ছিলাম।

ছোটমামা, মিথ্যে কথা বলে কোন লাভ নেই। তোমার কীর্তির কথা জানতে তো আর কারও বাকি নেই।

রুচিরা!

বিশ্রী কণ্ঠে দুঃশাসন চৌধুরী গর্জন করে ওঠেন। সামান্য একটা কথাকে কেন্দ্র করে বাদ-প্রতিবাদে মুহূর্তে কক্ষের মধ্যে যেন একটা বিষের হাওয়া জমাট বেঁধে ওঠে।

কিরীটী দেখল তিক্ত ব্যাপারকে আর বেশীদূর গড়াতে দেওয়া উচিত হবে না।

সে ধীর শান্ত কণ্ঠে বলে, দুঃশাসনবাবু, বাদানুবাদের কোন প্রয়োজন নেই। সত্যকে কেউই আপনারা গোপন করে রাখতে পারবেন না, সময়ে সবই জানা যাবে। তারপর দুঃশাসন চৌধুরীর দিকে ফিরে বলে, দুঃশাসনবাবু, আপনি কিছুক্ষণের জন্য যদি একটু স্থির হয়ে ওই চেয়ারটায় বসেন—আমি রুচিরা দেবীকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।

কিন্তু রুচিরাকে দুঃশাসন চৌধুরী কি যেন প্রতিবাদ জানাতে শুরু করতেই কিরীটী তাঁকে। পুনরায় বাধা দিল, না, এখন আর একটি কথাও নয়। আপনাকে যখন আমি প্রশ্ন করব আপনার। যা বলবার বলবেন।

বেশ। তাই হবে। গজগজ করতে করতে দুঃশাসন চৌধুরী অনতিদূরে রক্ষিত চেয়ারটার উপরে গিয়ে উপবেশন করলেন।

রুচিরাকে প্রশ্ন করবার আগে একটা ব্যাপার কিরীটীর চোখে পড়েছিল। রুচিরা ঘরে ঢোকার পর হতেই ডাঃ সমর সেনের দিকে মধ্যে মধ্যে আড়চোখে সে তাকাচ্ছিল। এবং শুধু সে নয়, ডাক্তার সেনও।

কিন্তু কিরীটী যেন ব্যাপারটা আদৌ লক্ষ্য করেনি এইভাবে রুচিরাকে অতঃপর প্রশ্ন শুরু করে।

রুচিরা দেবী, বলুন তো এবারে, ঠিক কতক্ষণ আগে আপনার ছোটমামা দুঃশাসন চৌধুরী আপনাকে গিয়ে রায়বাহাদুরের মৃত্যুসংবাদ দিয়েছিলেন?

তা ঘণ্টাখানেক!

বলতে বলতে কিরীটী একটিবার নিজের হাতঘড়িটার দিকে চেয়ে বললে, বেশ, এখন বলুন exactly, দুঃশাসনবাবু আপনাকে গিয়ে কি বলেছিলেন?

ছোটমামাবাবু আমার ঘরে গিয়ে বললেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে, বড়মামাবাবুকে নাকি ছোরা মেরে কে খুন করেছে!

ঐ কথা বলেই তিনি চলে আসেন, না তারপরেও ঘরে ছিলেন?

চলে আসেন।

হুঁ। এক ঘণ্টা আগে যদি দুঃশাসনবাবু আপনাকে খবরটা দিয়ে থাকেন, চারটে বাজবার কয়েক মিনিট আগেই বলুন খবরটা উনি আপনাকে দিয়েছেন, তাই নয় কি?

হ্যাঁ, তাই হবে।

বেশ। আচ্ছা একটা কথা রুচিরা দেবী, দুঃশাসনবাবু যখন আপনার ঘরে যান আপনার ঘরের দরজা কি খোলা ছিল?

হঠাৎ কিরীটীর শেষ প্রশ্নে রুচিরা দেবী কেমন যেন একটু থতমত খেয়ে যায়।

কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ঘরের দরজা বন্ধ ছিল।

ঘরের আলো জ্বালা ছিল, না নেভানো ছিল?

আর একবার চমকে ওঠে রুচিরা, মৃদু কণ্ঠে বলে, জ্বালানোই ছিল।

আপনি জেগে, না ঘুমিয়ে ছিলেন?

ঘুমিয়ে ছিলাম।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটী রুচিরা দেবীর মুখের দিকে তাকায়।

ঠিক আছে রুচিরা দেবী, আপনি আপাততঃ আপনার ঘরে যেতে পারেন। পরে প্রয়োজন হলে আপনাকে আমরা খবর দেব।

নিঃশব্দে রুচিরা কক্ষ ত্যাগ করে চলে গেল।

এবং ঘর ছেড়ে যাবার আগে কিরীটী লক্ষ্য করে আর একবার ডাঃ সেনের দিকে নিমেষের জন্যে তাকাল।

কিরীটী একবার মৃত রায়বাহাদুরের বোনের দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে ডাকে, গান্ধারী দেবী!

কিরীটীর ডাকে রুচিরার মা একটু যেন চমকে উঠেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।

এখানে আপনি কতদিন আছেন?

বছর মোল হবে। আমার স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই দাদা এখানে আমাকে নিয়ে এসে রেখেছেন—বলতে বলতে গান্ধারীদেবীর চোখের পাতা দুটো যেন অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে আসে।

আপনারা কয় বোন?

আমি আর কুম্ভী।

কুন্তী দেবীও কি এখানে আছেন?

না, সে বহুদিন আগে মারা গেছে, তার একমাত্র ছেলে ঐ শকুনি।

শকুনি! ঠিক তো, শকুনিবাবুকে দেখছি না! তা তিনি কোথায়? সঙ্গে সঙ্গে দালাল সাহেব বলে ওঠেন।

ডাঃ সমর সেনেরও শকুনির কথা সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় তার সেই কথা, আজ্ঞে মাতুল দুযযাধনের ভাগিনেয় শকুনি।

দুঃশাসন চৌধুরী হঠাৎ বলে ওঠেন, ডেকে আনব সে হতভাগাটাকে দালাল সাহেব?

না, আপনি বসুন। ডাকা যাবেখন। কিরীটী শান্ত স্বরে জবাব দিল এবং গান্ধারী দেবীর দিকে অতঃপর আবার তাকিয়ে বললে, আচ্ছা গান্ধারী দেবী, আপনার মেয়ে রুচিরার বিয়ের কোন চেষ্টাচরিত্র করছেন না?

রুচির বিয়ের সব কিছু তো একপ্রকার ঠিকই হয়ে আছে।

ঠিক হয়ে গেছে তাহলে?

হ্যাঁ।

কোথায়? কার সঙ্গে?

সমীরের সঙ্গে, আর সমীর তো এখন এই বাড়িতেই আছে।

সমীর! বিস্মিত কিরীটী যেন গান্ধারী দেবীকে পাল্টা প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ–সমীর বোস। ওদের কয়লার ব্যবসা আছে, অবস্থা খুব ভাল। দাদাই এ বিয়ের সব ঠিকঠাক করেছিলেন নিজে পছন্দ করে।

কিরীটী এবারে দুঃশাসন চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে, কাউকে পাঠিয়ে দুঃশাসনবাবু সমীরবাবুকে একবার ডেকে আনুন না দয়া করে এখানে।

নিশ্চয়ই। বলে দুঃশাসন চৌধুরী একজন ভৃত্যকে তখুনি সমীরকে ডেকে দিতে বললেন।

কিরীটী আবার গান্ধারী দেবীর দিকে ফিরে প্রশ্ন শুরু করে, আচ্ছা গান্ধারী দেবী, আপনি আর রুচিরা দেবী কি একই ঘরে শোন?

না। পাশাপাশি দুটো ঘরে দুজনে শুই, তবে দুঘরের মধ্যে যাতায়াতের জন্য মাঝখানে একটা দরজা আছে।

রুচিরা দেবী যখন আপনাকে গিয়ে রায়বাহাদুরের মৃত্যু সংবাদ দেন তখন আপনি জানেন কিছু? আপনি কি ঐ সময় জেগে ছিলেন?

না। ঘুমিয়ে ছিলাম। তাছাড়া ঘুম আমার চিরদিনই একটু বেশী গাঢ়। ডাকাডাকি না করলে বড় আমার একটা ঘুম ভাঙে না।

তাহলে রুচিরা দেবীই—মানে আপনার মেয়েই আপনাকে ডেকে তুলেছেন ঘুম থেকে?

হ্যাঁ।

আপনাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে আপনাকে তিনি ঠিক কি কথা বলেছিলেন আপনার মনে আছে?

হ্যাঁ, রুচি বললে দাদাকে নাকি কে ছোরা মেরে খুন করেছে।

তা নয়, আমি জানতে চাই, ঠিক রুচিরা দেবী আপনাকে কি কথা বলেছিলেন? মনে করে বলুন।

রুচি বলেছিল—

হ্যাঁ বলুন—ঠিক তিনি কি কথাগুলো আপনাকে বলেছিলেন?

ও বলেছিল, মা, শীগগির এস। বড় মামাবাবু নাকি খুন—

আর কিছু তিনি বলেননি?

না।

আচ্ছা আর একটা কথা, ইদানীং কিছুদিন ধরে যে রায়বাহাদুরের ধারণা হয়েছিল আজ রাত চারটের সময় কেউ তাঁকে হত্যা করবে, এ কথাটা কি আপনি জানতেন? মানে আপনি কি শুনেছেন তাঁর মুখ থেকে কখনও?

হ্যাঁ, শুনেছি বৈকি।

হুঁ, আচ্ছা আর দুটি প্রশ্ন কেবল আপনাকে আমি করতে চাই গান্ধারী দেবী। তারপর একটু থেমে বলে, বলতে পারেন রায়বাহাদুরের কেন ইদানীং ধারণা হয়ে গিয়েছিল ঐ রকমের একটা যে তাঁকে সকলে হত্যা করবার ষড়যন্ত্র করছে?

না, বলতে পারি না। আমার তো মনে হয় এমন কোন কারণই থাকতে পারে না। তাছাড়া তাঁকে এ বাড়ির মধ্যে তাঁর আত্মীয়স্বজনরা কেউ কেনই বা হত্যা করতে যাবে! দাদাও যেমন সকলকে ভালবাসতেন, সকলেও তেমনি দাদাকে ভালবাসত।

হুঁ। আচ্ছা আপনার দাদা রায়বাহাদুরের কোন উইল ছিল বলে জানেন বা কিছু কখনও শুনেছেন?

হ্যাঁ, যতদূর জানি দাদার বোধ হয় একটা উইল আছে।

সে উইল সম্পর্কে অর্থাৎ সে উইলের মধ্যে কি লেখা আছে বা না আছে, সে সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?

না।

আচ্ছা আপনি এখন যেতে পারেন।

গান্ধারী দেবী নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

অতঃপর কিরীটী পুলিস-সুপার দালাল সাহেবের সঙ্গে অন্যের অশ্রুতভাবে কিছুক্ষণ যেন কি মৃদুকণ্ঠে আলোচনা করে।

এবং মধ্যে মধ্যে দালাল সাহেব মাথা নেড়ে সম্মতি জানান।

.

বাইরে আবার পদশব্দ শোনা গেল।

এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আটাশ-ঊনত্রিশ বৎসরের একজন সুশ্রী যুবক ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল। যুবকের পরিধানে স্লিপিং পায়জামা ও গায়ে জড়ানো একটা পাতলা কমলালেবু রংয়ের কাশ্মীরী শাল।

মাথায় বিস্রস্ত কেশে ও চোখে-মুখে সুস্পষ্ট একটা নিদ্রাভঙ্গের ছাপ যেন তখনও লেগে আছে।

দুঃশাসন চৌধুরীই তাকে সবাগ্রে আহ্বান জানালেন, এস সমীর। তুমি কি ঘুমোচ্ছিলে নাকি?

হ্যাঁ। কিন্তু ব্যাপার কি? হঠাৎ? উদ্বিগ্ন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে বারেকের জন্য দুঃশাসন চৌধুরীর মুখের দিকে চেয়ে সমীর ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলের মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করল।

শোননি কিছু?

না তো! খুবই দুঃসংবাদ, দাদা খুন হয়েছেন।

খুন! যেন একটা আর্ত চিৎকারের মতই শব্দটা সমীরের কণ্ঠ হতে নির্গত হয়।

হ্যাঁ। দাদাকে কে যেন খুন করেছে।

আপনারই নাম সমীর বোস? ঐ সময় কিরীটী বাধা দেয়।

কিরীটীর প্রশ্নে সমীর মুখ তুলে তাকায়।

হ্যাঁ। আপনি?

আমার নাম কিরীটী রায়। এ কদিন আমি এখানে আছি, কিন্তু কই আপনাকে তত আমি দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না।

আমি তো আজই রাত আটটার গাড়িতে কলকাতা থেকে এসেছি।

ওঃ!

ডাঃ সমর সেন সমীর বোসকে চিনতে পেরেছিলেন।

এই ঘরের মধ্যে ঢুকে দুঃশাসন চৌধুরী ও ডাঃ সানিয়েলের সঙ্গে সমীর বোসকেই তিনি দেখেছিলেন।

কিরীটী আবার বলে, বসুন সমীরবাবু, কতক্ষণ এ ঘরে ছিলেন আপনি আজ রাত্রে?

সমীর চেয়ারের ওপরে উপবেশন করল। এবং মৃদুকণ্ঠে বলে, রাত তিনটে পর্যন্ত তো আমি এই ঘরেই ছিলাম। ডাঃ সেন আসবার পর আমি শুতে যাই।

আপনারও তো শুনেছি কয়লার খনি আছে, তাই না মিঃ বোস?

হ্যাঁ।

কোথায়?

ঝরিয়াতে ও সিঁজুয়াতে।

রায়বাহাদুরের ভাগ্নী রুচিরা দেবীর সঙ্গে তো আপনার বিয়ের সব কথাবার্তা হয়ে গেছে, তাই না?

কথাবার্তা হয়েছে বটে একটা, তবে এখনও final কিছুই স্থির হয়নি।

রুচিরা দেবীর সঙ্গে আপনার পরিচয় নিশ্চয়ই আছে?

হ্যাঁ।

কত দিনের পরিচয়?

তা অনেক দিনের হবে। কলেজের একটা ফাংশনে বছরখানেক আগে রুচির সঙ্গে আমার আলাপ হয়।

একটা কথা মিঃ বোস, ঐ বিয়ে সম্পর্কে কথাবাতার জন্যই কি আপনি এখানে এসেছেন। কাল?

না। রায়বাহাদুরের একটা মাইন আমি কিনব, কয়েক মাস যাবৎ কথাবার্তা চলছিল। সেই সম্পর্কেই একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা করবার জন্য বিশেষ করে এবারে আমার এখানে আসা।

কথাবাতা কিছু হয়েছিল সে সম্পর্কে?

হ্যাঁ। রাত্রেই সব ফাইনাল হয়ে গিয়েছে। সইও হয়ে গিয়েছে, এখন কেবল রেজিস্ট্রী করা বাকি।

আপনি এখান থেকে একেবারে সোজা আপনার ঘরেই গিয়েছিলেন, তাই না মিঃ বোস?

হ্যাঁ। বড্ড ঘুম পাচ্ছিল তাই সোজা গিয়ে বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

আপনার সঙ্গে রায়বাহাদুরের ব্যবসা ছাড়া আর অন্য কোন কথা হয়েছিল কি মিঃ বোস?

না। রায়বাহাদুর যে গত রাত্রে ভোর চারটের সময় নিহত হবেন, সে ধরণের কোন কথাও আপনাকে তিনি বলেননি?

না।

চাকর কে আপনাকে ডাকতে গিয়েছিল?

কৈরালাপ্রসাদ।

আচ্ছা এবারে আপনি যেতে পারেন মিঃ বোস। তবে একটা অনুরোধ, আমাকে না জিজ্ঞাসা করে কিন্তু আপনি এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেন না।

বেশ।

সমীর বোস অতঃপর ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

কিরীটী এবারে দালাল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললে, মৃতদেহটা তাহলে ময়না তদন্তের জন্য সিভিল সার্জেনের কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন।

হ্যাঁ, সেটা করতে হবে বৈকি। দালাল সাহেব বলেন, নীচে গাড়িতে আমার এ.এস.আই আছে মিঃ মিত্র, তাকেই ইনস্ট্রাকশনটা দিয়ে আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

দালাল সাহেব ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।