০৩. ঘরের মধ্যে ঐ সময়

ঘরের মধ্যে ঐ সময় ওরা তিনজন ছাড়াও দুঃশাসন ও বৃহন্নলা চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। উভয়ের চোখেমুখেই একটা অসহায় ভীতিবিহ্বল ভাব। নির্বাক এবং কেমন যেন বিস্ময়াবিভূত সকলে।

ওয়াল-ব্লকের গম্ভীর সঙ্কেতধ্বনিটা যেন নিষ্ঠুর হত্যার কথাটাই জানিয়ে দিয়ে গেল।  মৃত্যু আছেই। কে কবে মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেয়েছে—এবং আসে যখন অমোঘ পরোয়ানা হাতেই এসে হাজির হয়। তবু রায়বাহাদুরের মৃত্যুটা যেন অকস্মাৎ একটা ধাক্কা দিয়েছে সবার মনেই। কোন কথা না বলে কিরীটী অতঃপর ঘরের মধ্যের পদটিা তুলে রায়বাহাদুর যেখানে শায়িত সেখানে এসে দাঁড়াল। অন্যান্য সকলেও তাকে অনুসরণ করে ওর আশেপাশে এসে দাঁড়ায়।

অদূরে সর্বপ্রথম সকলেরই দৃষ্টি পড়ে রোগীর শিয়রের কাছে, চেয়ারের উপরে উপবিষ্ট নার্সের মাথাটা চেয়ারের উপরে একপাশে হেলে রয়েছে।

।আর—আর শায়িত মুদ্রিতচক্ষু রায়বাহাদুরের বুকের ঠিক মাঝখানে সুদৃশ্য কালো বাঁটওয়ালা একটা ছোরা সমূলে বিদ্ধ হয়ে আছে—যেন নিষ্ঠুর মৃত্যুর ভয়াবহ প্রত্যক্ষ সাক্ষী দিচ্ছে।

রায়বাহাদুরের গায়ের উপরে যে সাদা চাদরটি ছিল সেই চাদর সমেতই ছোরাটা ভেদ করে গিয়েছে। কিন্তু ছোরাটার কালো বাঁটের চার পাশে লাল রক্তচিহ্ন শুভ্র চাদরের উপরে যেন ভয়াবহ একটা বিভীষিকার মত মনে হয়।

কোন প্রয়োজন ছিল না, তথাপি ডাঃ সানিয়াল প্রথমেই রায়বাহাদুরের পালস্টা দেখলেন, সব শেষ! অনেকক্ষণ মারা গেছেন।

কিরীটী প্রথমে নার্সের নাম ধরে ডাকে, কিন্তু সাড়া না পেয়ে এগিয়ে উপবিষ্ট ও নিদ্রিত নার্সকে ঠেলে জাগাতে গিয়ে দেখে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন নার্স।

কিরীটীর বুঝতে কষ্ট হয় না যে স্বাভাবিক ঘুম নয়। কোন তীব্র ঘুমের ওষুধের সাহায্যেই নার্সকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করা হয়েছে, সম্ভবতঃ ইচ্ছে করেই।

ডাক্তার দুজনও ইতিমধ্যে নার্সের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ডাঃ সানিয়াল ঘুমন্ত নার্সকে পরীক্ষা করতে উদ্যত হন, কিরীটী সরে দাঁড়ায়।

অপলক দৃষ্টিতে কিরীটী নিহত, মুদ্রিতচক্ষু রায়বাহাদুরের মুখের দিকে চেয়ে ছিল। সমস্ত মুখখানা জুড়ে যেন ফুটে উঠেছে একটা নিষ্ঠুর অবজ্ঞার চিহ্ন।

অদূরে টেবিলের উপরিস্থিত নীলাভ দ্যুতিতে মুখখানার মধ্যে যেন কেমন এক নিদারুণ বিভীষিকা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

ঘরের মধ্যে সকলেই নিস্তব্ধ, কারও মুখে টু শব্দটি পর্যন্ত নেই।

কেবল পর্দার ওপাশের ওয়াল-ক্লকটা একঘেয়ে শব্দ করে চলেছে। মন্থর বিশ্রী টক্ টক টক্ শব্দ সেই নিশ্চলতার মধ্যে।

উঃ, কি ভয়ানক!

সকলেই যুগপৎ ঐ কথাগুলি সহসা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে তাকাল। কথাটা বলেছিলেন দুঃশাসন চৌধুরী। কথাটা বলেই তিনি দুহাতে নিজের মুখখানা ঢাকেন।

ডাঃ সানিয়াল যেন কি একটা কথা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বলা হল না, ঠিক ঐসময় একটা ভারী জুতোর মচমচ শব্দ সকলের কানে প্রবেশ করে।

মচমচ শব্দে জুতো পায়ে কে যেন এই কক্ষের দিকেই এগিয়ে আসছে। মচমচমচ। জুতোর শব্দ এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। কিরীটীই সর্বাগ্রে পর্দার ওদিকে পা বাড়িয়েছিল এবং পর্দার এদিকে আসতেই দেখতে পেল পুলিসের ইউনিফর্ম পরিধানে হৃষ্টপুষ্ট ভারিক্কী চেহারার এক অফিসার ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে। বারেক কিরীটী ও পুলিস অফিসারটি দুজনে দুজনের দিকে অনুসন্ধানী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। কিরীটী প্রথমে কথা বলে, আপনিই বোধ হয় এখানকার এস.পি. মিঃ দালাল?

হ্যাঁ। আপনি?

আমি! আমার নাম কিরীটী রায়। আসুন, এইমাত্র আমরা জানতে পেরেছি রায়বাহাদুর নিহত হয়েছেন।

কি বললেন! রায়বাহাদুর–উৎকণ্ঠা মিশ্রিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন পুলিশ সুপার মিঃ দালাল।

হ্যাঁ। চলুন, এই ঘরের পর্দার ওপাশে মৃতদেহ।

স্তম্ভিত নির্বাক এস.পি.দালাল যন্ত্রচালিতের ন্যায় কিরীটীকে অনুসরণ করলেন।

পর্দার এপাশে এসে পা দিতেই এবং মৃতের বক্ষে ছুরিকাবিদ্ধ রায়বাহাদুরের প্রতি নজর পড়তেই অস্ফুট কণ্ঠে আবার দালাল সাহেব বলে ওঠেন, উঃ, What a horrible sight! কি ভয়ানক! Then really he has been killed!

সত্যিই ভয়ানক! যেন পূর্বাপর সমস্ত ব্যাপারটাই একটা চরমতম বিস্ময়। একটা ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। মাত্র ঘণ্টাখানেক আগেও যে লোকটি জীবিত ছিলেন, প্রাণস্পন্দনের মধ্যে দিয়ে নিজের সত্তাটাকে ঘোষণা করছিলেন, এই মুহূর্তে অসহায় মৃত্যুর মধ্যে যেন নিঃশেষে লোপ পেয়েছেন। নিশ্চিহ্ন হয়ে মুছে গিয়েছেন জীবনসমুদ্রের বুক থেকে। এবং এই ঘটনার মধ্যে সর্বাপেক্ষা ঘনীভূত রহস্য হচ্ছে এই যে, ঐ ছুরিকাবিদ্ধ মৃত লোকটি কেমন করে না-জানি অবধারিত অবশ্যম্ভাবী তাঁর মৃত্যুর সংবাদটি পূর্বাহ্নেই জানতে পেরেছিলেন কোন এক আশ্চর্য উপায়ে। কিন্তু সত্যিই কি জানতে পেরেছিলেন, না সেটা ডাক্তারের ভাষায় একটা সত্যিই ইলিউশন মাত্র! না, ব্যাপারটা তাঁর অসুস্থ মস্তিষ্কের উত্তেজনাপ্রসূত একটা কল্পনা মাত্র!

নার্স সুলতা করের জ্ঞান আরও আধ ঘণ্টা পরে ফিরে আসে একটু একটু করে।

ওষুধের প্রভাব হতে মুক্ত হয়ে সে ঘুম থেকে জেগে উঠল। প্রথমটায় সে কিছুই বুঝতে পারে না। চোখের ঘুম ও মনের নিষ্ক্রিয়তাটুকু যেন কেটেও কাটতে চায় না। একটা নেশার ঘোরের মত সমস্ত চেতনাকে তার এখনও আচ্ছন্ন করে আছে যেন। কিরীটীর পরামর্শে এক কাফ স্ট্রং কফি পান করার পর সুলতা যেন কতকটা ধাতস্থ হয়।

কিন্তু তাকে নানাভাবে প্রশ্ন করেও তার বক্তব্য হতে এমন কিছুই পাওয়া গেল না যা রায়বাহাদুরের মৃত্যু-রহস্যের উপরে আলোকসম্পাত করতে পারে।

সুলতা কর বললে, রাত্রি দুটো নাগাদ ডাক্তার সানিয়ালের কফি তৈরী হয়েছিল। সেই কফি পান করবার পর হতেই তার বিশ্রীরকম ঘুম পায় এবং সে ঘুমিয়ে পড়ে।

কিরীটী তখন প্রশ্ন করে, রায়বাহাদুর কি তখন জেগে ছিলেন?

না—সুলতা বলে। রায়বাহাদুরকে ডাঃ সেন ঘুমের ওষুধ খাইয়ে আসবার পর কিছুক্ষণের মধ্যে রায়বাহাদুর ঘুমিয়ে পড়েন।

সাধারণতঃ দীর্ঘকাল ধরে, বলতে গেলে প্রায় নিয়মিতই ঘুমের ওষুধ সেবন করবার ফলে ইদানীং কোন ঘুমের ওষুধেই সহজে রায়বাহাদুরের নিদ্রাকর্ষণ হচ্ছিল না।

অথচ আশ্চর্য, আজ ঘুমের ওষুধ পান করবার কিছুক্ষণের মধ্যেই রায়বাহাদুরের নিদ্রাকর্ষণ হয় এবং শীঘ্রই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন।

রায়বাহাদুরকে নিদ্রিত দেখে সুলতা করেরও দু চোখের পাতায় ঢুলুনি নেমে আসতে চায়। এবং কখন একসময় সে নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছে কিছুই তার মনে নেই।

সুলতা কর কথা বলছিল কিন্তু কিরীটীর মনে হয় তার কথাবার্তায় একটা ভীতির ভাব যেন সুস্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে।

প্রথমতঃ ডিউটি দিতে দিতে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল, দ্বিতীয়ত সেই ঘুমন্ত অবস্থার মধ্যেই নিষ্ঠুর আততায়ীর হস্তে রায়বাহাদুর নিহত হয়েছেন—নিঃসন্দেহে ব্যাপারটা তার গাফিলতি, তাই কি তার ঐ ভীতি?

কিন্তু কিরীটী নার্স সুলতা করের ঐ ভীতির ব্যাপারটা যেন বুঝেও ইচ্ছে করেই বিশেষ আমল দেয় না।

দালাল সাহেব যখন বারংবার নানাবিধ প্রশ্নবাণে ভীত সুলতা করকে নানা ভাবে জেরার পর জেরা করে চলেছেন, কিরীটীর মনের মধ্যে তখন সম্পূর্ণ অন্য একটি চিন্তা আবর্ত রচনা করে ফিরছিল যেন।

সত্যি কথা বলতে কি, রায়বাহাদুরের বিশেষ অনুরোধে তাঁর গৃহে এলেও ব্যাপারটার মধ্যে আদৌ কোন গুরুত্ব দেয়নি এতক্ষণ পর্যন্ত। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে,রায়বাহাদুর যেমন করেই হোক ব্যাপারটা বুঝতে পেরে থাকুন না কেন ব্যাপারটা একটা নিষ্ঠুর পূর্বপরিকল্পিত প্ল্যান অনুযায়ী সংঘটিত হয়েছে, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না এখন আর।

বেচারী সুলতা করের কোন দোষ বা অপরাধ নেই বুঝতে পারে কিরীটী। এবং হত্যাকারী যে ধূর্ত ও অত্যন্ত ক্ষিপ্র সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ মাত্রও নেই।

কারণ প্রথমতঃ সে পূর্বাহ্নেই ঘোষণা করে ও প্ল্যান এঁটে রায়বাহাদুরকে হত্যা করেছে।

দ্বিতীয়তঃ ঠিক হত্যার সময়টিতে বা পূর্বে এ বাড়ির সকলের মধ্যে যার রোগীর সবাপেক্ষা নিকট উপস্থিত থাকবার সম্ভাবনা ছিল, সেই সুলতা করকে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই কৌশলে কফির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে, যাতে করে তার দিক থেকে কোন বাধা না আসে।

তৃতীয়তঃ যাকে হত্যা করবে বলে হত্যাকারী স্থির করেছিল তাকে পর্যন্ত তীব্র ঘুমের ওষুধ পান করিয়ে আগেই ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল।

এই তো গেল হত্যাকারীর দিকটা।

নিহত রায়বাহাদুরের দিকটাও রীতিমত যাকে বলে জটিল। পূর্বাহ্নে তিনি তো নিজের হত্যার কথা জানতে পেরেছিলেনই, তা সে যেমন করেই হোক এবং যেজন্য তিনি কলকাতা থেকে কিরীটীকে নিজের কাছে এনে রেখেছিলেন ও এস.পি. দালাল সাহেবকেও কথাটা আগে থাকতেই জানিয়ে রেখেছিলেন। সেদিক দিয়ে হত্যাকারীকে বিচার করলে নিঃসন্দেহে হত্যাকারী প্রচুর রিস্ক নিয়েছে, যেহেতু আগে থাকতে আটঘাট বেঁধে কাজ করে থাকলেও সে শুধু চতুর নয়, দুঃসাহসীও বটে। কিন্তু কথা হচ্ছে সে কেমন করে এতগুলো লোকের উপস্থিতির মধ্যে ধোঁকা দিয়ে সকলকে বোকা বানিয়ে দিল!

কিরীটী আরও ভাবছিল, ছোরার সাহায্যে যখন রায়বাহাদুরকে হত্যা করা হয়েছে তখন এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে হত্যাকারী এই কক্ষে সশরীরে প্রবেশ করেছিলই।

কিন্তু কথা হচ্ছে, ঠিক ঐ সময়টিতে এই কক্ষের মধ্যে নিদ্রিতা নার্স সুলতা কর ও ঘুমন্ত রায়বাহাদুর ব্যতীত তৃতীয় কোন ব্যক্তি বা প্রাণী উপস্থিত ছিল কিনা। এবং উপস্থিত থাকলে কে উপস্থিত ছিল—এই বাড়ির মধ্যে আর কারই বা উপস্থিত থাকা সম্ভব!

মনে মনে অত্যন্ত দ্রুত কিরীটী চিন্তা করে নেয় এই বাড়ির সমস্ত লোকগুলিকে।

মৃত রায়বাহাদুর ছাড়া ঐ সময় বাড়ির মধ্যে উপস্থিত ছিল তাঁর সহোদর ভাই দুঃশাসন চৌধুরী, রায়বাহাদুরের খুল্লতাত অবিনাশ চৌধুরী, ভাগ্নে শকুনি ঘোষ, রায়বাহাদুরের একমাত্র পুত্র বৃহন্নলা চৌধুরী, বৃহন্নলার স্ত্রী নমিতা চৌধুরী, বৃহন্নলার একমাত্র একাদশ বর্ষীয় বালকপুত্র বিকর্ণ ও রায়বাহাদুরের বোনের মেয়ে রুচিরা দেবী, রায়বাহাদুরের বিধবা বোন ও রুচিরার মা গান্ধারী দেবী। এই আটজন বাড়ির ভেতরের লোক।

বাইরের কর্মচারীদের মধ্যে অন্দরে যাদের অবাধ যাতায়াত ছিল, ম্যানেজার নিত্যধন সাহা, তশীলদার বৃদ্ধ কুন্ডলেশ্বর শমা ও পুরাতন নেপালী ভৃত্য কৈরালাপ্রসাদ ও ডাক্তার সানিয়াল এবং কিছুক্ষণ আগে এসেছেন ডাঃ সমর সেন, বৃন্দাবন, ঝি সৈরভী ও ননীর মা। এবং যাদের ছিল না তারা হচ্ছে ড্রাইভার রামনরেশ ও ভৈরব, নাইটকিপার হুম্ সিং, দারোয়ান বলদেব ও দুধনাথ। এদের মধ্যে অর্থাৎ যাদের অন্দরে যাতায়াত ছিল না তাদের বাদ দিয়ে ঐ বারোজনের মধ্যে কেউ যদি হত্যাকারীকে সাহায্য করে থাকে তাহলে হয়ত তাকে খুঁজে বের করতে পারলে রহস্যের ব্যাপারে কিছুটা কিনারা হতে পারে! এখন কাকে কাকে ঐ বারোজনের মধ্যে বিশেষভাবে সন্দেহ করা যেতে পারে! সেদিক দিয়ে একমাত্র আত্মীয়-পরিজনদের মধ্যে রায়বাহাদুরের পুত্র বৃহন্নলা চৌধুরীর একাদশ-বর্ষীয় বালকপুত্রকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারে।

বাকি সকলকে সন্দেহের তালিকার মধ্যে ধরা যেতে পারে, কারণ বাকি সকলের প্রত্যেকেরই মৃত রায়বাহাদুরের মৃত্যুতে লাভবান হবার সম্ভাবনা।

কাজেই প্রত্যেকের পক্ষেই রায়বাহাদুরকে হত্যা করা এমন কিছুই অসম্ভব নয় বা ছিল না।

কিরীটীর চিন্তাজাল হঠাৎ ছিন্ন হয়ে গেল।

ঐ সময় সুপার দালাল সাহেব সুলতা করের জবানবন্দি শেষ করে দুঃশাসন চৌধুরীকে জেরা শুরু করেছেন।

আপনি বলেছেন দীর্ঘ পাঁচ বছর আপনি বাড়িছাড়া থাকবার পর মাত্র দিন দশেক আগে এখানে ফিরে এসেছেন, কেমন কিনা?

হ্যাঁ। দালাল সাহেবের প্রশ্নের জবাবে জানান দুঃশাসন চৌধুরী।

এই পাঁচ বছর আপনি কোথায় ছিলেন?

বর্মামুলুকে মৌচিতে—

মৌচি–কেন?

মৌচিতে আমার মাইকার বিজনেস ছিল—

মাঝখান থেকে কিরীটী এবারে প্রশ্ন করে, কয়েকটা কথা আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই মিঃ দালাল মিঃ চৌধুরীকে, যদি অবশ্য আপনি অনুমতি দেন।

একটু যেন বিরক্তি ও অনিচ্ছার সঙ্গেই দালাল সাহেব বলেন, বেশ তো, করুন।

মিঃ চৌধুরীর কি মাইকার সেই বিজনেস এখনও আছে? কিরীটী এবারে প্রশ্ন করে দুঃশাসন চৌধুরীকে।

না। দাদার অনুরোধে সমস্ত বিজনেস তুলে দিয়েই একেবারে চলে এসেছি।

বিজনেস কেমন চলছিল আপনার?

খুব ভালই চলছিল। তাই আমারও বিজনেস তুলে দেবার কোন ইচ্ছাই ছিল না। গত বছর দেড়েক ধরে দাদা অনবরত আমাকে ওখানকার বিজনেস তুলে দিয়ে দেশে ফিরে আসবার জন্য অনুরোধ করছিলেন চিঠির পর চিঠি দিয়ে। তাছাড়া এখানকার এত বড় কলিয়ারী বিজনেস বৃহন্নলা একা একা ম্যানেজ করে উঠতে পারছিল না–

কেন, আমি তো যতদূর জানি ইদানীং অসুস্থ অবস্থাতেও দুমাস আগে পর্যন্ত বিছানায় শোয়া অবস্থাতেই রায়বাহাদুর নিজে বিজনেস দেখাশুনা করতেন। তাছাড়া আপনার ছোটকাকা অবিনাশবাবুও তো বিজনেস দেখাশুনা করতেন বলেই শুনেছি—কিরীটী এবারে বলে।

কিরীটীর কথায় দুঃশাসন চৌধুরী বিশেষ অর্থপূর্ণ একটু হাসি হেসে বলেন, কে দেখাশুনা করতেন বললেন, আমাদের কাকা সাহেব?

হ্যাঁ।

হুঁ, তা দেখতেন বটে। তবে এতই যখন আপনার জানা আছে—এও নিশ্চয়ই আপনি জানেন, কাকা সাহেবের আসল বিজনেসের চাইতে গানবাজনার ব্যাপারেই বরাবর বেশী ঝোঁক এবং সেই কারণেই বরাবর দাদাকে না হোক মাসে হাজার দেড় হাজার করে অর্থ আত্মীয়তার আক্কেলসেলামী বাবদ জলে ফেলতে হত। বলতে বলতে কণ্ঠের মধ্যে আরও তাচ্ছিল্য ও অবহেলার ভাব এনে বললেন, হুঁ, তিনি দেখবেন বিজনেস! এই যে বাড়ির মধ্যে এত বড় একটা ব্যাপার ঘটে গেছে, দেখুন গিয়ে কাকা সাহেব দিব্যি খোসমেজাজে বাঈজীর গান শুনছেন এখনও তাঁর ঘরে আসর জমিয়ে।

কিরীটী দুঃশাসন চৌধুরীর কথায় কোনরকম গুরুত্ব না দিয়ে অত্যন্ত ধীর শান্ত কণ্ঠে জবাব দেয়, দেখুন দুঃশাসনবাবু, আজ গত সাত বছর ধরে রায়বাহাদুরের সঙ্গে এবং আপনাদের এই ফ্যামিলির সঙ্গে আমার একান্ত ঘনিষ্ঠ ভাবেই পরিচয়। আপনাদের কাকা সাহেব অবিনাশধাবুর সমস্ত কিছুই আমার জানা, তিনি আমার আদৌ অপরিচিত নন। একটা কথা আপনি হয়ত ভুলে যাচ্ছেন দুঃশাসনবাবু, রায়বাহাদুরের বর্তমান সুবিপুল সম্পত্তি অর্জনের মূলে আপনাদের কাকা সাহেবের দীর্ঘ বারো বৎসরের পরিশ্রম ও অধ্যবসায় আছে। সেদিক দিয়ে আমি যতদূর জানি, রায়বাহাদুরই ইদানীং বৎসর তিনেক হল আপনাদের কাকা সাহেবের জন্য মাসিক দেড় হাজার টাকা মাসোহারার পাকাপাকি একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ইচ্ছে করেই

শ্লেষাত্মক কণ্ঠে এবারে দুঃশাসন চৌধুরী জবাব দিলেন, আপনি দেখছি অনেক কিছুই জানেন মিঃ রায়, তাই একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করার লোভটা দমন করতে পারছি না। এতই যখন আপনি জানেন, এও আপনার নিশ্চয়ই অজানা নয় যে কোথাও কোন কাগজপত্রে এ সম্পকে কোন নির্দেশ আছে, না এটা একটা উভয়ের মধ্যে তাদের মৌখিক ব্যবস্থাই হয়েছিল!

বৎসর দুই আগে রায়বাহাদুরের সঙ্গে যখন একবার আমার কলকাতায় দেখা হয়, কথায় কথায় সেই সময়েই রায়বাহাদুর আমাকে বলেছিলেন—লিখিত ভাবে তাঁর উইলের মধ্যেও–

উইল! দাদার উইল! পরম বিস্ময়ের সঙ্গেই যেন দুঃশাসন চৌধুরী কথা কটা উচ্চারণ করেন কিরীটীকে বাধা দিয়ে।

হ্যাঁ। উইলেই সে রকম লিখে দিয়েছেন তিনি, তাই আমাকে বলেছিলেন—

এবারে সত্যিই আমাকে হাসালেন মিঃ রায়। দাদার উইল! যতদূর আমার জানা আছে। তাঁর তো কোন উইলই নেই।

পাকাপোক্ত রেজিস্টার্ড উইল একটা না থাকলেও—উইল তাঁর একটা ছিল আমি জানি—বেশ জোরের সঙ্গেই জবাব দিল এবার কিরীটী।

ভুল শুনেছেন। কাঁচা পাকা কোন উইলই তাঁর নেই।

ইতিমধ্যে একসময় রায়বাহাদুরের পুত্র বৃহন্নলা চৌধুরীকেও দালাল সাহেব ঐ কক্ষের মধ্যে ডেকে এনেছিলেন।

পিতার আকস্মিক নিষ্ঠুর মৃত্যুতে বৃহন্নলা চৌধুরী যেন শোকে মুহ্যমান হয়ে পাথরের মতই একপাশে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল।

তার দিকে তাকিয়ে কিরীটী বলে, বৃহন্নলাবাবু, আপনার বাবার কোন উইল বা ঐজাতীয় কোন কিছু লেখা কি নেই?

না। আমি যতদূর জানি বাবার কোন উইল ছিল বলে আমি শুনিনি অন্ততঃ—

আছে। কে বললে নেই! আছে, আলবৎ হ্যায়।

অকস্মাৎ অন্য একটি পুরুষের সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরে ঘরের মধ্যে উপস্থিত সব কটি প্রাণীই যুগপৎ বিস্মিত দৃষ্টিতে ফিরে তাকায় বক্তার দিকে।

কোন পুরুষের কণ্ঠস্বর এমন মধুস্রাবী হতে পারে এ যেন ধারণাও করা যায় না—ডাঃ সেনের মনে হল।

সত্যি অপূর্ব মিষ্টি কণ্ঠস্বর বক্তার।

এ তো কণ্ঠস্বর নয়, সঙ্গীতের সুর বুঝি।

সঙ্গীতের জন্যই যেন ভগবান ঐ কণ্ঠস্বরটি সৃষ্টি করেছেন।