৮. ময়না তদন্তের রিপোর্ট পাওয়া গেল

পরের দিন সকালেই ময়না তদন্তের রিপোর্ট পাওয়া গেল।

কোন তীব্র বৈদ্যুতিক কারেন্টের আঘাতেই অতুলের মৃত্যু ঘটেছে। সন্ধ্যার দিকে ঐ দিনই শিউশরণের বাড়ির বাইরের ঘরে বসে কিরীটী, সুব্রত ও শিউশরণের মধ্যে ঐ সম্পর্কেই আলোচনা চলছিল।

Electrocution-য়ে মৃত্যু! অভিনব উপায় অবলম্বন করা হয়েছে হত্যা করবার জন্য।

কিরীটী বলছিল, অতুলবাবুর শরীরের মধ্যে হাই ভোল্টের কোন ইলেকট্রিক কারেন্ট প্রবেশ করিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে সেটুকু বোঝা গেল। কিন্তু কথা হচ্ছে আলোর সুইচটা অন্ করেছিল কে? অতুলবাবু নিজেই, না হত্যাকারী?

শিউশরণ প্রশ্ন করে, কি তুমি বলতে চাও কিরীটী? সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় শিউশরণ কিরীটীর মুখের দিকে।

বলছি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে নিজেই অতুলবাবু আলোটা জ্বেলে নিজের ঘরের মধ্যে যে মৃত্যুফাঁদ পাতা ছিল তাতে নিজেই অজ্ঞাতে পা দিয়েছিলেন, না অতুলবাবু সে রাত্রে তাসের আড্ডা হতে ফিরে শয়নকক্ষে প্রবেশ করে বরাবর গিয়ে শয্যা নিয়েছিলেন, তারপর কোন একসময় সেই ঘরে হত্যাকারী প্রবেশ করে।

তাহলে তোমার ধারণা হত্যাকারী অতুলবাবুর বিশেষ পরিচিতই ছিল? প্রশ্নটা করে শিউশরণ।

নিশ্চয়ই। সে রকমই যদি হয়ে থাকেও কোন সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু এখন কথা হচ্ছে শেষের ব্যাপারটাই যদি ঘটে থাকে তাহলে বুঝতে হবে একান্ত আকস্মিক ভাবেই মৃত্যু এসেছিল সে রাত্রে বিশেষ তাঁর একজন পরিচিত জনের হাত দিয়েই–

আর একটু খোলসা করে বল, রায়।

দেখ শিউশরণ, আমার অনুমান প্রথমোক্ত ভাবেই অতুলবাবুকে আকস্মিক ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তাসের আড্ডা হতে ফিরে খুব সম্ভবত অতুলবাবু আলো জ্বেলে শয্যায় আশ্রয় গ্রহণ করতে যাবেন এমন সময় হয়ত হত্যাকারী ঘরে প্রবেশ করে। এবং খুব সম্ভবত হয়ত হত্যাকারী গিয়ে অতুলবাবুর শয্যার ওপরে উপবেশন করে ও তাই দেখে অতুলবাবু চেয়ারে বসতে যান—এই পর্যন্ত কথাটা বলতে বলতেই হঠাৎ কিরীটী কি ভেবে যেন থেমে যায় এবং চাপা অনুত্তেজিত কণ্ঠে বলে, নিশ্চয়ই! নিশ্চয়ই তাই!

বিস্মিত সুব্রত ও শিউশরণ দুজনেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, কি? কি নিশ্চয়ই, কিরীটী?

হ্যাঁ নিশ্চয়ই! কিন্তু–কিন্তু কেন! আর তাই যদি হয়ে থাকে মণিকা দেবীর জানা উচিত ছিল। মণিকা দেবীর নিশ্চয়ই জানা উচিত ছিল। কিরীটী স্বগতোক্তির মতই যেন আপন মনে কথাগুলো বলে চলে।

সুব্রত ও শিউশরণ কিরীটীর মৃদুচ্চারিত কথাগুলো শুনে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

কিরীটী চেয়ার থেকে উঠে ঘরের মধ্যে তখন পায়চারি শুরু করেছে।

কোন একটা বিশেষ চিন্তা তার মাথার মধ্যে এসে প্রবেশ করেছে এবং সেই চিন্তার আবর্তেই কিরীটী সহসা ব্যাকুল ও চঞ্চল হয়ে উঠেছে।

অথচ এও সুব্রত জানে নিজে থেকে স্বেচ্ছায় যতক্ষণ নিজেকে কিরীটী ব্যক্ত না করে ততক্ষণ কোনমতেই কোন সাড়া তার কাছ হতে পাওয়া যাবে না।

হঠাৎ আবার একসময় পায়চারি থামিয়ে কিরীটী শিউশরণের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদুকণ্ঠে বললে, চল শিউশরণ, বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসা যাক।

বাইরে! কোথায় যাবে?

চলই না। আগে হতেই মেয়েলী কৌতূহল কেন? সুব্রত চল। ওঠ।

অগত্যা উঠতেই হল ওদের দুজনকে।

.

রাস্তায় বের হয়ে কিরীটী গোধূলিয়ার দিকেই চলতে শুরু করে।

মন্থর অলস পদক্ষেপে হেঁটে চলেছে কিরীটী আগে আগে আর ওরা দুজনে নির্বাক তাকে অনুসরণ করে চলেছে।

কোথায় চলেছে কিরীটী!

চলতে চলতে ক্রমে ওরা জঙ্গমবাড়িতে মণিকা দেবীদের বাড়ির কাছাকাছিই এসে দাঁড়াল।

অপ্রশস্ত সরু গলিপথটায় আলোর ব্যবস্থা এত কম যে সমগ্র গলিপথটা একটা আলো-আঁধারিতে যেন কেমন থমথম করছে।

হঠাৎ কিরীটী শিউশরণকে চাপা কণ্ঠে প্রশ্ন করে, মণিকাদের ঠিক উল্টো দিকে ঐ দোতলা বাড়িটায় কে থাকে শিউশরণ?

কেমন করে বলব না খোঁজ নিয়ে? শিউশরণ নিরাসক্ত কণ্ঠে জবাব দেয়।

তাহলে চল একবারটি না হয় খোঁজ নিয়েই দেখা যাক।

ব্যাপার কি?

বুঝতে পারছ না? উপরের দিকে ভাল করে চেয়ে দেখ। ঐ বাড়ির দোতলা থেকে মণিকা দেবীদের বাড়ির দোতলার বিশেষ একটা ঘরের জানালাটা খোলা থাকলে এবাড়ির কোন কোন লোকের চোখে ঘটনাচক্রে বা দৈবাৎ যাই বল মণিকা দেবীদের বাড়ির ঐ ঘরের কোন কিছু হয়ত দৃষ্টিগোচরও হতে পারে। এবং মণিকা দেবীদের বাড়ির প্ল্যানটা একটু ভেবে দেখলেই মনে পড়বে ঐ যে বন্ধ জানালাটা দেখছ মণিকা দেবীদের বাড়ির ওটাই সেই ঘর—অকুস্থান, যেখানে অতুলবাবুকে হত্যা করা হয়েছে। অতএব–

কিরীটীর কথায় দুজনে তাকিয়ে দেখতেই মনে হল, সত্যি তাই তো।

শেষোক্ত কথার জের টেনে কিরীটী তখন বলছে, অতএব চলই না একবার ঐ বাড়িটায় চুঁ মেরে দেখা যাক।

চল।

সকলে এগিয়ে গেল।

কিন্তু দরজার কড়া নাড়তে হল না। দরজার কাছাকাছি যেতেই হঠাৎ বন্ধ দরজা খুলে গেল এবং খোলা দ্বারপথে একজন লংস ও হাফসার্ট পরিহিত পুরুষ একটা সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে বের হয়ে আসছেন দেখা গেল।

অ মশাই, শুনছেন? কিরীটীই আহ্বান জানায়।

সাইকেল-হাতে ব্যক্তি থামলেন, আমাকে বলছেন?

হ্যাঁ। আপনি এই বাড়িতেই থাকেন বুঝি?

হ্যাঁ। কেন বলুন তো? কি চাই? রুক্ষ ভারী কণ্ঠস্বর।

আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।

আপনাকে তো আমি চিনতে পারছি না! তাছাড়া এখন আমার সময় নেই। পূর্ববং রুক্ষ কণ্ঠস্বর।

এবারে শিউশরণ এগিয়ে এসে হিন্দীতে বললে, আপনার সঙ্গে কথা আছে। আমি খোদাইচৌকির থানা-অফিসার, থানা থেকেই আসছি।

থানা-অফিসার! এবারে ভদ্রলোক তাকালেন।

হ্যাঁ। একটু ভেতরে চলুন, কয়েকটা কথা আছে।

সকলে এসে ভদ্রলোকের বাড়ির নীচের তলাকার একটা ঘরে প্রবেশ করল। ভদ্রলোক ঘরে সর্বাগ্রে প্রবেশ করেই সুইচ টিপে ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন।

মাঝারি আকারের ঘর। নীচু ছাত।

ঘরের মধ্যে আসবাবপত্রের তেমন কোন বাহুল্য না থাকলেও একটা ছিমছাম পরিচ্ছন্ন ভাব আছে।

ঘরের মধ্যস্থলে একটা তক্তপোশ পাতা। তার উপরে একটা শতরঞ্চ বিছানো। এবং খান-দুই চেয়ার।

দেওয়ালে একটি বাংলা-ইংরাজী দেওয়ালপঞ্জী ভিন্ন অন্য কোন ছবি নেই।

বসুন—ভদ্রলোকই আহ্বান জানালেন।

তক্তপোশের ওপরেই সকলে উপবেশন করে।

ঘরের আলোয় ভদ্রলোকের চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বলিষ্ঠ গঠন। চওড়া কপাল। পরিপাটি করে চুল আঁচড়ানো। মধ্যখানে সিঁথি, ঠোঁটের উপরে একজোড়া ভারী গোঁফ।

আপনার নামটা জিজ্ঞাসা করতে পারি কি? কিরীটীই প্রশ্ন করে।

রণলাল চৌধুরী।

দেখুন মিঃ চৌধুরী, এই সময় হঠাৎ এসে আপনার কাজের ব্যাঘাত ঘটিয়ে বিরক্ত করছি বলে আমরা বিশেষ দুঃখিত। অবশ্য বেশী সময় আপনার আমরা নষ্ট করব না। যে জন্যে এসেছি সেই কথাই বলি। আপনি শুনেছেন হয়ত আপনার বাড়ির সামনের বাড়িতেই পরশু এক ভদ্রলোক মারা গিয়েছেন।

শুনেছি।

আচ্ছা আপনাদের এই বাড়িতে উপরে নীচে কখানা ঘর মিঃ চৌধুরী?

ওপরে দুখানা-নীচে দুখানা।

আপনাদের family member কজন?

Family member বলতে আমরা দুজন। আমি আর আমার বুড়ো বাবা।

বাড়ির কাজকর্ম করার লোক নেই?

ঠিকে রাঁধুনী ও ঝি আছে। আর আমার দোকানের একটা বাচ্চা চাকর রাত্রে এখানে এই ঘরে থাকে।

ও। আপনার বুঝি দোকান আছে?

হ্যাঁ। চকে Electric goods-এর একটা দোকান আছে।

হুঁ। ওপরে আপনি কোন ঘরে থাকেন জানতে পারি কি?

রাস্তার ওপরের ঘরটাতেই থাকি।

আচ্ছা সাধারণত কত রাতে আপনি শুতে যান?

রাত বারোটা-একটার আগে বড় একটা আমি ঘুমোই না।

অত রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন?

হ্যাঁ। বইটই পড়ি আর কি।

পরশু রাত্রে?

তা সাড়ে বারোটা পর্যন্ত প্রায় জেগে বই পড়েছি।

আপনার ঘরের জানলা খোলা ছিল- mean রাস্তার দিকের জানলাটা?

হ্যাঁ। জানলা-দরজা আমার ঘরের সব সময় ভোলাই থাকে।

মিঃ চৌধুরী, আপনি বলতে পারেন পরশু রাত্রে সাড়ে এগারোটা থেকে রাত বারোটার মধ্যে সামনের বাড়ির দোতলার ঠিক আপনার ঘর থেকে সামনের ঘরে কোন কিছু দেখেছেন বা শুনেছেন?

ভদ্রলোক একটু ইতস্তত করছেন বলে যেন মনে হয়।

কিরীটীর চোখের দৃষ্টি কিন্তু রণলাল চৌধুরীর ওপরেই নিবদ্ধ থাকে।

মিঃ চৌধুরী, যদি কিছু দেখে থাকেন বা শুনে থাকেন তো বলুন। কারণ আপনি হয়ত নিশ্চয়ই শুনেছেন মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়—কিরীটী বলে।

তার মানে! কি আপনি বলতে চান? মার্ডার? সুস্পষ্ট একটা আতঙ্ক রণলাল চৌধুরীর কণ্ঠস্বরে প্রকাশ পায়।

সত্যিই তাই।

হত্যা! খুন!

হ্যাঁ।

অতঃপর রণলাল চৌধুরী কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকে।

ঘরের মধ্যে একটা স্তব্ধতার পীড়ন যেন চলেছে।

তাহলে আমি যতটুকু জানি বলাই উচিত। সে রাত্রে দোকান থেকে ফিরতে আমার অন্যান্য দিনের চাইতে একটু রাতই হয়েছিল। খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘরে ঢুকতে রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গিয়েছিল। ঘরে ঢুকে আলোটা জ্বালতে যাব হঠাৎ একটা তীব্র নীল আলোর ঝাপটায় যেন চোখ দুটো আমার ঝলসে গেল। হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম কিছুক্ষণের জন্য। খেয়াল যখন হল আমার ঘরের খোলা জানালাপথে সামনের বাড়ির ঘরটা দেখলাম অন্ধকার। ব্যাপারটা যে কি ঘটল কিছুই বুঝতে পারলাম না।

শুধু একটা নীল আলোর ঝাপ্টা? আর কিছু দেখেননি বা শোনেননি?

না।

কিছুক্ষণ আবার স্তব্ধতা।

স্তব্ধতা ভঙ্গ করলে কিরীটীই, ঐ বাড়ির সঙ্গে আপনার জানাশোনা নেই?

হ্যাঁ। মণিকা দেবীর দিদিমার সঙ্গে পরিচয় আছে। আমিও তাঁকে দিদিমা বলেই ডাকি। এবং উনিও আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন।

ও! কতদিন এ বাড়িতে আপনারা আছেন?

তা বছর দশেক তো হবেই।

সুবালা দেবীর সঙ্গে আপনার পরিচয় নেই?

কে? ঐ রাঁধুনী মেয়েটা? রণলালের কণ্ঠে একটা সুস্পষ্ট অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য।

হ্যাঁ।

না মশাই। মেয়ে তো নয় একেবারে পুরুষের বাবা। বিশ্রী ক্যাটকেটে কথাবার্তা!

আচ্ছা রণলালবাবু, অবসর সময় আপনার কেমন করে কাটে?

এই বইটই পড়ে, না হয় ক্লাবে তাস খেলে কাটাই।

তাহলে বই পড়া আপনার অভ্যাস আছে?

অভ্যাস কি বলছেন! চার-চারটে লাইব্রেরীর মেম্বার আমি!

শরৎ চাটুয্যের বই আপনার কেমন লাগে?

কেমন লাগে বলছেন? শরৎবাবুর লেখার আমি একজন গোঁড়া ভক্ত।

চরিত্রহীন বইটা পড়েছেন?

নিশ্চয়ই। বার চার-পাঁচ পড়েছি। সোৎসাহে জবাব দেয় রণলাল।

চরিত্রহীন উপন্যাসে কিরণময়ী সত্যি কাকে ভালবাসত বলে আপনার মনে হয় রণলালবাবু? দিবাকরকে না উপীন্দ্রকে?

কিরণময়ী ভালবাসত উপীন্দ্রকেই। দিবাকরের মত একটা গর্দভকে কোন মেয়েমানুষ ভালবাসতে পারে নাকি?

সুব্রত নিবাক হয়েই রণলালের সঙ্গে কিরীটীর কথাবার্তা শুনছিল। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না সুব্রত, হঠাৎ কিরীটী রণলালের মত একজন সদ্যপরিচিত লোকের সঙ্গে শরৎ-সাহিত্য প্রসঙ্গ নিয়ে মেতে উঠল কেন! অথচ এও তো সে জানে এ ধরনের ঘরোয়া আললাচনা কখনও কিরীটী নিজের মনোমত ব্যক্তিবিশেষের সঙ্গে ছাড়া করে না। তার স্বভাববিরুদ্ধ।

আর শিউশরণ তো স্পষ্টই মনে মনে বিরক্ত হয়ে উঠছিল। এই জন্যই কি হঠাৎ কিরীটী এ সময় বাড়ি হতে বের হয়ে এল।

রণলাল চৌধুরীর সঙ্গেই যদি তার পরিচয় করবার প্রয়োজন ছিল তবে বললেই তো হত তাকে। থানা থেকেই লোক পাঠিয়ে কিরীটী এই লোকটাকে ডেকে নিয়ে যেতে পারত। সেজন্য এ সময়ে এতদূর ছুটে আসবার কি প্রয়োজন ছিল!

আচ্ছা আমরা তাহলে চলি রণলাল। আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে ভারী আনন্দ হল। আর এভাবে হঠাৎ এসে অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করে গেলাম বলে মনে কিছু করবেন না। কিরীটী বিনয়ে যেন বিগলিত হয়ে যায়।

না না বরং আপনাদের সঙ্গেও তো আমার আলাপ হল। অবশ্য আপনারা না এলে আমিই হয়ত যেতাম। কিন্তু জানেন তো, ঠিক সাহস পাইনি। হাজার হোক কেউ স্বেচ্ছায় কি পুলিসের সামনে যায়! বলে রণলাল নিজেই হেসে ওঠে।

রণলালের ওখান হতে বিদায় নিয়ে তিনজনে আবার খোদাইচৌকির দিকেই ফিরছিল।

হঠাৎ একসময় শিউশরণ প্রশ্ন করে, রণলালবাবু যে নীল আলোর কথা বললেন, ব্যাপারটা তোমার কি মনে হচ্ছে কিরীটী? Something electrical ব্যাপার নয় তো? তুমি তো বলছিলে এবং ময়না তদন্তেও প্রকাশ অতুল বোসকে electrocution করে হত্যা করা হয়েছে!

কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বলে, হ্যাঁ। তাই কি?

একবার কাল সকালে মণিকা দেবীদের বাড়িতে অতুল বোস যে ঘরে থাকত সেই ঘরের ইলেকট্রিক কানেকশনটা দেখে এলে হত না?

শিউশরণের কথায় কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে মৃদু একটা হাসির বঙ্কিম রেখা জেগে ওঠে।

অতুল বোসের মৃত্যু-তদন্তের ব্যাপারে যদিও সুব্রত প্রথম হতেই উপস্থিত এবং তৎসংক্রান্ত সকল প্রকার আলোচনাই সে শুনেছে, সে কিন্তু একটি কথাও বলেনি।এবারের হত্যা-তদন্তে সে যেন এক নীরব দ্রষ্টা ও শ্রোতা মাত্র। তবে মুখে কোনরূপ প্রশ্ন বা মন্তব্য না করলেও মনে মনে সে সমগ্র ব্যাপারটাই নিজের বুদ্ধি ও বিবেচনায় বিচার বিশ্লেষণে একটা মীমাংসায় পৌঁছবার চেষ্টা শুরু হতেই করে আসছিল।

হঠাৎ একটা কথা সুব্রতর মনে পড়ে। পরশু সকালে মণিকা দেবীদের গৃহ হতে ফেরবার পথে কথাপ্রসঙ্গে কিরীটী বলেছিল: হাই ভোলটের কারেন্টে বেচারার মৃত্যু হয়েছে। প্রমাণের খানিকটা অংশ সরিয়ে ফেললেও হত্যাকারী আমার চোখে ধুলো দিতে পারেনি। কারণ ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনার কিছুটা মালমসলা তখনও ঐ ঘরে অবশিষ্ট ছিল। কিন্তু কি সে প্রমাণ! এখন সহসা একটা সম্ভবনা বিদ্যুৎ-চমকের মতই সুব্রতর মনে ভেসে ওঠে: অতুল বোসের মৃতদেহটা চেয়ারের উপরে উপবিষ্ট ছিল। চেয়ারটি স্টীলের পাত ও রডে তৈরী। ইলেকট্রিক কারেন্টে মৃত্যু। তবে কি ঐ স্টীলের চেয়ারটাই!

কিরীটীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল। না শিউশরণ, তার আর প্রয়োজন নেই। বললাম তো, হত্যাকারী তার নিদর্শন স্বরূপ যে প্রমাণটুকু হয় ইচ্ছা করে অপসারণের প্রয়োজন মনে করেনি অথবা নিয়তিরই নিষ্ঠুর ইঙ্গিতে তাকে আকর্ষণ করেনি বলেই ফেলে রেখে গিয়েছে, সেইখানেই সে ধরা পড়ে গিয়েছে।

কি সে প্রমাণ? কথাটা শিউশরণ না জিজ্ঞাসা করে থাকতে পারে না।

একটা তামার পাতের রিং মত যেটা অতুল বোসের মৃতদেহ যে চেয়ারের ওপরে উপবিষ্ট ছিল তার পায়ার সঙ্গে লাগানো ছিল। মৃদু কণ্ঠে কথাটা উচ্চারণ করে কিরীটী সহসা যেন প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল। কিন্তু যাক সে কথা। আমি ভাবছি হত্যাকারীর দুঃসাহসিক বুকের পাটার কথা। এত বড় দুঃসাহস হল কি করে! একপক্ষে অবিশ্যি ভালই হয়েছে, একটা জায়গায় এসে আমি হোঁচট খাচ্ছিলাম বার বার। ঠিক রাত কটায় অতুলকে হত্যা করা হয়েছে! এখন বুঝতে পারছি রাত সাড়ে এগারোটা থেকে রাত পৌনে বারোটার মধ্যেই।

বলতে বলতে সহসা শিউশরণের মুখের দিকে তাকিয়ে কিরীটী বলে, বুঝলে শিউশরণ, এ হত্যার পরিকল্পনা একদিনের বা হঠাৎ কোন এক বিশেষ মুহূর্তের আকস্মিক নয়। অত্যন্ত ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে স্থিরীকৃত। কিন্তু তার পশ্চাতে আছে হয়ত কোন বিচিত্র অনুভূতির গোপন পীড়ন যেটা দীর্ঘদিন ধরে তিলে তিলে হত্যাকারীর মনের অবগহনে তার হত্যার মতই একটা পাশবিক জিঘাংসা বা লিন্সাকে জাগিয়ে তুলেছে। সঙ্কল্প হয়েই ছিল শুধু মাত্র সুযোগের ও স্থানের অপেক্ষা, সেই সুযোগ ও স্থান মিলে গেল এবারে পূজাবকাশের ছুটিতে কাশীতে। হত্যাকারীর মনের মধ্যে যে বিচিত্র সঙ্কল্পটা বিষের ধোঁয়ার মতই ধোঁয়াচ্ছিল, যেটা ছিল কিছুটা স্পষ্ট, কিছুটা অস্পষ্ট, বিচিত্র অনুকূল পরিবেশে সেটা অকস্মাৎ হয়তো কোন কারণে নখদন্ত বিস্তার করে আত্মবিকাশ করেছে। এবং আমার অনুমান যদি সত্য হয় তাহলে বোধ হয় হত্যা করবার জন্য যে পরিকল্পনাটুকু হত্যাকারী করেছে সেটা পূর্বপরিকল্পিত নয়, হঠাৎই হয়ত তার মনে সম্ভাবনাটুকু উদয় হওয়ায় কাজে লাগাবার চেষ্টা করেছে পরিকল্পনাটা। And it became successful! হতভাগ্য অতুল বোসের মৃত্যু ছিল ঐরূপ এক দুর্ঘটনাতেই, ঘটে গেল সেই দুর্ঘটনা। কথাগুলো একটানা বলে কিছুক্ষণ কিরীটী স্তন্ধ থাকে। তারপর আবার মৃদু কণ্ঠে বলে, একটি ছোট্ট এক্সপেরিমেন্ট করব। এবং আশা করি তারপরই এ রহস্যের ওপরে যবনিকা ভোলা যাবে।

.

দিন দুই পরে। অহল্যাবাঈ ঘাট, রাত্রি বোধ করি এগারোটা হবে। স্থানটি ঐ সময় একপ্রকার নির্জন বললেও হয়। চাঁদ উঠতে দেরি আছে। শুক্লপক্ষের মেঘমুক্ত আকাশে একরাশ তারা ঝিকমিক করে জ্বলছে। গঙ্গার জলে পড়েছে সেই আকাশের তারার স্তিমিত আলোর ক্ষীণ দীপ্তি।

ঘাটের কাছে পর পর দুটি নৌকো বাঁধা। অস্পষ্ট আলোছায়ায় সেই নৌকোর সামনে একটি নারীমূর্তি উপবিষ্ট দেখা যাচ্ছে।

পশ্চাতে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। দীর্ঘকায় কে একজন সিঁড়ি ভেঙে ঘাটের কাছে নেমে আসছে। একজন পুরুষ। পুরুষ নারীর পশ্চাতে এসে দাঁড়াল। অস্পষ্ট আলোছায়ায় তাকেও ভাল করে চেনা যায় না। নারীমূর্তি ফিরে তাকাল, কে?

আমি।

ও, তুমি! এস, বস। নারী আহ্বান জানাল।

কিন্তু কি ব্যাপার বল তো! এভাবে এই জায়গায় চিঠি দিয়ে দেখা করবার জন্য ডেকে আনবার মানে কি? যা বলবার আমার ঘরে রাত্রে এসেও তো বলতে পারতে। পুরুষ বলে।

না। বলতে পারতাম না তার কারণ কারও না কারও নজরে পড়ে গেলে পরের দিন সকালে তুমি বা আমি কেউই কি আর মুখ দেখাতে পারতাম! আর যাই করি এত বড় নির্লজ্জ অন্তত দিদিমার সামনে হতে পারতাম না।

কিন্তু এখনও আমি বুঝতে পারছি না, মণি, এভাবে এত রাত্রে এ জায়গায় কেন তুমি ডেকে এনেছ আমাকে!

কেন ডেকে এনেছি জান? অতুলের মৃত্যুর ব্যাপারটা একবার ভোলাখুলি তোমার সঙ্গে আলোচনা করতে চাই।

আশ্চর্য! সে আলোচনার জন্য এইভাবে এত রাত্রে চিঠি লিখে গঙ্গার ঘাটে ডেকে আনবার কোন প্রয়োজনই তো ছিল না মণি।

ছিল।

কেন?

কারণ লোক-নিন্দা ও লোকেদের কথা ছেড়ে দিলেও একটা কথা আমাদের তিনজনের একজনও কি অস্বীকার করতে পারব যে, আমাদের তিনজনের মধ্যেই একজন অতুলের এই নিষ্ঠুর হত্যার জন্য দায়ী?

সত্যিই কি তুমি তাই মনে কর মণি?

কিরীটীবাবু মনে করেন। গতকাল তাই তিনি আমাকে থানায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

মিঃ কিরীটী রায় আর কি মনে করেন? নিশ্চয়ই আমাদের তিনজনের মধ্যে যে হত্যাকারী তাকেও তিনি তাঁর অপূর্ব বুদ্ধির প্যাঁচে ফেলে সনাক্ত করে ফেলেছেন! বলেই ফেল না! সে কথাটাই বা লুকোচ্ছ কেন? আমাদের তিনজনের মধ্যে কে? তুমি, আমি, না রণেন?

পুরুষ আর কেউ নয়, সুকান্ত। এবং নারী মণিকা।

সুস্পষ্ট ব্যঙ্গে সুকান্তর কণ্ঠস্বর এবারে আরও কঠিন মনে হয়, কিন্তু সেই কারণে এমনি করে এই রাত্রে গঙ্গার ঘাটে টেনে এনে এ নাটক সৃষ্টি না করলেও পারতে মণি। এবারে তোমাকে আমি সত্যিই বলছি, এই তেলাপোকা আর কাঁচপোকার নাটক এখানেই আমি শেষ করতে চাই। আমার কি ইচ্ছে হচ্ছে জান? একজন তো গেছেই, বাকি দুজনকেও শেষ করে অবশেষে নিজেকে হত্যা করে এই নবৎসরের নাটকের ওপর যবনিকা টেনে দিই। আসলে তুমি কি জান মণিকা! একটি harlot!

সুকান্ত!

চেঁচিয়ে কোন লাভ নেই মণিকা। এখন দেখতে পাচ্ছি চিঠি দিয়ে আজ রাত্রে এখানে তুমি আমাকে ডেকে এনে একপক্ষে ভালই করেছ। আমাদের চারজনের এই নাটকের শেষ দৃশ্যটুকু তোমাকে ভাল করেই বুঝিয়ে দিয়ে যেতে পারব। অপূর্ব এক ভালবাসার অভিনয় তুমি এই দীর্ঘ নবৎসর ধরে করছ। সত্যিই তুমি অনন্যা!

সুকান্ত! আর্ত করুণ কণ্ঠে যেন চিৎকার করে ওঠে মণিকা।

থাম। শোন, মনে পড়ে তোমার দার্জিলিংয়ের সে রাত্রের কথা! সে রাত্রের ঘটনার জন্য পরে আমি অনুতপ্ত হয়েছিলাম এই ভেবে যে, হয়ত আমাদের তিনজনের মধ্যে আমাকে বাদ দিয়ে অতুল বা রণেনকে তুমি মনে মনে ভালবাস, কিন্তু তুমি অগ্রসর হতে পারছ না আমাদের তিনজনের বন্ধুত্বের কথা ভেবেই। পাছে আমাদের দুজনের মনে আঘাত লাগে একজনকে তুমি বরণ করলে। পরে বুঝেছিলাম ভুল আমারই। ভালবাসা তোমার চরিত্রে নেই। ভালবাসতে তুমি কাউকেই কোনোদিন পারবে না। ভালবাসতে হলে যে মনের দরকার, যে কোমল অনুভূতির প্রয়োজন সেইখানেই ঝুলি তোমার শূন্য। সেইখানেই তোমার চরিত্রের পরম দৈন্য। যে নারীর মনে ভালবাসার অনুভূতি নেই অথচ রূপ ও যৌবন আছে, সে বিকৃত মনেরই সমগোত্রীয়। তাই তোমার সংসর্গে যা অবশ্যম্ভাবী তাই ঘটেছে, অতুল নিহত হয়েছে। এবার হয়ত আমাদের পালা কিন্তু অতদূর আমি গড়াতে দেব না।

সুকান্তর কণ্ঠস্বর উত্তেজনায় যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে।

সভয়ে আবার চিৎকার করে ওঠে মণিকা ভয়ার্ত ব্যাকুল কণ্ঠে, সুকান্ত! সু—

হাঃ হাঃ করে বজ্রকণ্ঠে হেসে ওঠে সুকান্ত। হাসির শব্দটা একটা প্রতিধ্বনি তুলে নির্জন অহল্যাবাঈ ঘাট হতে নিশীথের গঙ্গাবক্ষের উপর দিয়ে রাতের অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়ে।

হ্যাঁ, নির্জন এই অহল্যাবাঈ ঘাটে গঙ্গার উপকূলে কেউ নেই। তোমাকে গলা টিপে হত্যা করে অন্ধকারে ঐ গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়ে যাব। হাঃ হাঃ! আবার পাগলের মত অট্টহাসি হেসে ওঠে সুকান্ত। এগিয়ে গিয়ে সুকান্ত মণিকার ডান হাতের সুকুমার মণিবন্ধটা চেপে ধরে লৌহ-কঠিন মুষ্ঠিতে।

সুকান্ত! সুকান্ত—আমি-মণিকা ব্যাকুল কণ্ঠে কি যেন বলবার চেষ্টা করে।

কেই শুনতে পাবে না। কেই জানতে পারবে না—দুহাতে মণিকার গলাটা টিপে ধরে সুকান্ত।

ঠিক এমনি সময় ঘাটের কাছে অন্ধকারে যে নৌকো দুটো বাঁধা ছিল তার একটার মধ্যে একটা ঝটাপটির শব্দ শোনা যায় এবং পরক্ষণেই কে একজন ব্যাঘ্রের মত ঘাটের ওপরে নৌকো থেকে লাফিয়ে পড়ে সুকান্তকে আক্রমণ করে।

সুকান্ত, ছাড়। ছাড়—খুনী শয়তান–

সঙ্গে সঙ্গে প্রায় নৌকোর ভেতর থেকে কিরীটী, শিউশরণ ও সুব্রত ঘাটের সিঁড়ির উপর লাফিয়ে পড়ল। রণেনের আক্রমণ থেকে সুকান্তকে মুক্ত করে দেয় কিরীটী।

সুকান্ত ও রণেন দুজনেই তখন হাঁফাচ্ছে।

রণেন কিন্তু চেঁচিয়ে বলে, না না ওকে ছাড়বেন না মিঃ রায়। সুকান্ত–সুকান্তই অতুলকে হত্যা করেছে।

.

আরও আধ ঘণ্টা পরে রণেন, সুকান্ত ও মণিকাকে নিয়ে কিরীটী ও শিউশরণ থানায় গিয়ে হাজির হল। থানার অফিসঘরে সকলে প্রবেশ করে এবং কিরীটী সকলকে বসতে অনুরোধ করে।

আরও কিছুক্ষণ পরে কিরীটী বলতে শুরু করে, আজ রাত্রে কিছুক্ষণ আগে অহল্যাবাঈ ঘাটে যে ঘটনাটা ঘটে গেল সে জন্যে আমি বিশেষ দুঃখিত এবং আপনাদের তিনজনের কাছেই সেজন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। অতুলবাবুর মৃত্যুরহস্যের উদঘাটনে পৌঁছবার জন্য আমি ছোট্ট একটা একত্সপেরিমেন্ট করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে একত্সপেরিমেন্টের সমাপ্তিটা যে এমন বিশ্রী তিক্ত ব্যাপারে গিয়ে দাঁড়াবে সত্যি আমি তা ভাবিনি। আপনারা তিনজনেই বিশ্বাস করুন আজকের ক্ষণপূর্বে অহল্যাবাঈ ঘাটে যে একসপেরিমেন্টের পরিকল্পনা আমি করে মণিকা দেবীকে দিয়ে সুকান্তবাবুকে রাত্রে গঙ্গার ঘাটে দেখা করবার জন্য চিঠি দিইয়ে এবং নৌকো ভাড়া করে সেই নৌকার মধ্যে অন্ধকারে রণেনবাবুকে নিয়ে আত্মগোপন করেছিলাম, সবটাই এই সৎ উদ্দেশ্যেই করেছিলাম যে আজকের এই ছোট্ট একসপেরিমেন্টের ভেতর দিয়েই আমরা অতুলবাবুর হত্যারহস্যের একটা মীমাংসায় পৌছাব এবং হত্যাকারীকে সনাক্ত করতে পারব। যদিও হত্যাকারী কে আমরা বুঝতে পেরেছি তাহলেও কিছুক্ষণ পূর্বে গঙ্গার ঘাটে আপনাদের তিনজনকে কেন্দ্র করে যে অপ্রীতিকর ঘটনাটা ঘটে গেল সেটা এখন বুঝতে পারছি অবশ্যম্ভাবীই হয়ে উঠেছিল। এবং ঐ অপ্রীতিকর ব্যাপারটা আজ রাত্রে গঙ্গার ঘাটে না ঘটলেও দু-এক দিনের মধ্যেই যে ঘটত সে বিষয়ে এখন আমি সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ।

কিরীটীর কথাগুলো যেন রণেন, সুকান্ত ও মণির কর্ণকুহরে গলিত সীসের মতই প্রবেশ করল।

তিনজনেই ওরা পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে নির্বাক। কিরীটী কিন্তু ওদের কারোর দিকেই তাকাচ্ছে না। ওদের যেন সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগে ব্যস্ত।

সমস্ত ঘরটার মধ্যে যেন একটা শ্বাসরোধকারী আবহাওয়া জমাট বেঁধে উঠেছে। সিগারেটটায় অগ্নিসংযোগ করে তাতে গোটা দুই টান দিয়ে হঠাৎ কিরীটীই নিজের রচিত শ্বাসরোধকারী ঘরের মৃত্যুশীতল স্তব্ধতাটা ভেঙে দিল, অতুলবাবুর হত্যার পশ্চাতে আছে একটা দীর্ঘদিন ধরে লালিত হিংসা। দিনের পর দিন দীর্ঘ কয়েক বৎসর ধরে তিনটি পুরুষের মনের অবগহনে একটি নারীকে কেন্দ্র করে চলেছিল এক হিংসার কুটিল ভয়ঙ্কর বিষমন্থন। শুনে আশ্চর্য হবেন না আপনারা কেউ, অতুলবাবু নিহত না হয়ে রণেনবাবু ও সুকান্তবাবু আপনাদের দুজনের একজন নিহত হতে পারতেন। এবং অতুলবাবু নিহত না হয়ে আপনাদের মধ্যে একজন কেউ নিহত হলে, অতুলবাবু ও অন্য একজনকে হয়ত আজকের এই কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হত। আজকের এই পরিস্থিতি অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। হ্যাঁ, প্রত্যেকেই আপনারা তিন বন্ধু আপনাদের ঐ বান্ধবীর জন্য পরস্পরের প্রতি দিনের পর দিন দীর্ঘকাল ধরে নিরতিশয় ঘৃণা ও হিংসা পোষণ করেছেন। হয়ত বা মনে মনে কত সময় পরস্পর পরস্পরকে হত্যা করবার সঙ্কল্পও করেছেন। কিন্তু হত্যার সঙ্কল্প করলেই কিছু হত্যা করা যায় না। তার জন্য চাই ক্ষণিক একটা বিকৃত উন্মাদনা, ভয়ঙ্কর একটা প্রতিজ্ঞা। এ তো হঠাৎ হত্যা করা নয়। এ যে স্থির মস্তিষ্কে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে হত্যায় লিপ্ত হওয়া। ভাবুন তো একবার বাইরে বন্ধুত্বের মুখোশ এঁটে মনের মধ্যে সন্তর্পণে হত্যার জন্য ছুরি শানিয়েছেন। দিনের পর দিন মনের মধ্যে পরস্পর পরস্পরের প্রতি প্রচণ্ড হিংসা ও ঘৃণা পোষণ করে বাইরে ভালবাসা ও প্রেমের চটকদার অভিনয় করেছেন। এবং আজ রাত্রে অহল্যাবাঈ ঘাটে যে ঘটনাটা ঘটে গেল সেটা দীর্ঘদিনের ঐ গোপনে মনের মধ্যে লালিত পরস্পরের প্রতি পরস্পরের প্রচণ্ড হিংসা ও ঘৃণা ঐ মণিকা দেবীকে কেন্দ্র করে।

কিরীটী কথাগুলো বলে ক্ষণকালের জন্য চুপ করে থাকে।

হঠাৎ রণেনবাবুর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, উঃ,ঘরের মধ্যে বিশ্রী গরম! জানলাগুলো একটু খুলে দিতে বলুন না। দম বন্ধ হয়ে আসছে।

ঘরের তিনটে জানলার মধ্যে দুটো জানলার কবাটগুলো খোলাই ছিল, বাকি জানলার পাল্লা দুটোও এগিয়ে গিয়ে কিরীটী হাত দিয়ে ঠেলে খুলে দিল।

ঘরের দেওয়ালে টাঙানো কটায় ঢং ঢং করে রাত তিনটে ঘোষণা করল। ইতি মধ্যেই রাত্রিশেষের প্রহরগুলিতে শিশিরের একটা সিক্ততা দেখা দিয়েছে। একটা আর্দ্র ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ভাব।

নিস্তব্ধ সকলে একে অন্য হতে অল্প অল্প ব্যবধানে বসে আছে ঘরের মধ্যে। তিনটি ফাঁসির আসামী যেন রাত পোহালে ফাঁসি হবে তারই অধীর ব্যাকুল প্রতীক্ষ্ণয় প্রহর গুনছে। মুখের দিকে তাকালে মনে হয় তিনটি প্রাণহীন পুতুল যেন।

কিরীটীর কঠিন নিষ্ঠুর কণ্ঠস্বর আবার শোনা গেল, শুধু আপনারাই ঐ দোষে দোষী নন রণেনবাবু, সুকান্তবাবু। সর্বত্র চলেছে আজ ঐ হিংসার কুটিল আবর্ত। যুগ যুগ ধরে মানুষের শুভবুদ্ধির ও ভালবাসার দুশ্চর তপস্যা ব্যর্থ হয়েছে। হিংসা! হিংসা: হিংসা সর্বত্র! বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু যাক সে কথা। এবারে অতুলবাবুর হত্যার ব্যাপারে ফিরে আসি।

শিউশরণ এখানে বাধা দেয়, কিন্তু–

কিরীটী মৃদু হেসে বলে, বুঝেছি তোমার খটকা কোথায় লাগছে শিউশরণ! ইলেকট্রিক মিস্ত্রী আর কেউ নয় হত্যাকারীই স্বয়ং সকলের চোখে ধুলো দেবার জন্য ঐ বেশ নিয়েছিল।

তারপর একটু থেমে যেন দম নিয়ে তার অসমাপ্ত বক্তব্যে ফিরে আসে, আমার মনেও ঐখানেই খা লেগেছিল। এবং সেইজন্যই আসলে ছোট একটা একসপেরিমেন্টের আয়োজন করেছিলাম আজ রাত্রে আমি গঙ্গার ঘাটে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাতে করে অতুলবাবুর নৃশংস হত্যারহস্যের জটিল অংশের দুইয়ের তিন অংশ পরিস্কার হয়ে গেলেও বাকি ও শেষ অংশটুকু এখনও অস্পষ্টই আছে। এবং সেইজন্যই গঙ্গারঘাট হতে সকলকে নিয়ে আমি এখানে এসে মিলিত হয়েছি। তারপর হঠাৎ শিউশরণের মুখের দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, বাইরে এইমাত্র পদশব্দ পেলাম। দেখ উনিও বোধ হয় এসে গেলেন। তাঁকেও এই ঘরে নিয়ে এস, যাও।

বিস্মিত নির্বাক সকলের সামনে দিয়েই শিউশরণ ঘর হতে বের হয়ে গেল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সুবালা দেবীকে নিয়ে ঐ ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।

যুগপৎ ঘরের মধ্যে ঐ সময় উপস্থিত সকলেই নির্বাক বিস্ময়ে সুবালা দেবীর দিকে তাকাল নীরব দৃষ্টি তুলে। শিউশরণ তার চেয়ারটাই এগিয়ে দিল সুবালাদেবীর দিকে, বসুন।

কেবল মণিকার কঠ হতে উচ্চারিত হল একটিমাত্র শব্দ, সুবালাদি!

বসুন সুবালা দেবী। কিরীটী বললে।

নিঃশব্দে সুবালা দেবী শিউশরণের খালি চেয়ারটায় উপবেশন করে।

মণিকা দেবী, সুবালা দেবী, রণেনবাবু, সুকান্তবাবু আপনারা সকলেই উপস্থিত এখানে সে রাত্রে যাঁরা ঘটনাস্থলের আশেপাশে ছিলেন। একটা কথা না বলে পারছি না, সকলেই আপনারা সেদিনকার আপনাদের প্রদত্ত জবানবন্দিতে কিছু কিছু গোপন করেছেন। একান্ত পৈশাচিক ভাবেই সে রাত্রে আপনাদেরই চারজনের মধ্যে একজন অতুলবাবুকে হত্যা করেছেন। এবং এও আমি জানি আপনাদেরই মধ্যে কে তাঁকে হত্যা করেছেন। তাই আবার আজ এখন শেষ অনুরোধ আপনাদের জানাচ্ছি, এখনও আপনারা যে যা গোপন করেছেন খুলে বলুন। অকাট্য প্রমাণ দিয়ে আমায় সাহায্য করুন হত্যাকারীকে ধরিয়ে দেবার।

কিরীটীর শেষের কথাগুলো যেন ঝমঝম্ করে ঘরের মধ্যে একটা বজ্রের হুঙ্কার ছড়িয়ে গেল।

সকলেই স্তব্ধ। নির্বাক। কারও মুখে একটি শব্দ পর্যন্ত নেই।

সহসা সুকান্ত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় এবং ঘরের খোলা দরজার দিকে পা বাড়ায়। কিরীটীর কঠিন কণ্ঠ শোনা গেল, ঘর ছেড়ে যাবেন না সুকান্তবাবু! বসুন!

তীক্ষ্ণ ঝাঁঝালো কণ্ঠে সুকান্ত চেঁচিয়ে ওঠে, No, No! This is simply inhuman torture!I cant stand it any more!I cant!

না, আপনার এখন যাওয়া হতে পারে না। এগিয়ে আসে এবারে শিউশরণ।

শিউশরণকে দুহাতে পাগলের মতই ঠেলে ঘর হতে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানায় সুকান্ত, Let me go! Let me go! যেতে দিন, আমাকে যেতে দিন!

এবারে এগিয়ে এল রণেন, না, না। দাঁড়াও সুকান্ত। যদি আমাদের তিনজনের মধ্যেই একজন সত্যিই অতুলের হত্যাকারী হই—let that be decided once for all!

খিঁচিয়ে ওঠে সুকান্ত, decide করবে? কি decide করবে শুনি যে আমরাই একজন অতুলকে বন্ধু হয়ে হত্যা করেছি? ছিঃ ছিঃ! এর চেয়ে গলায় দড়ি দাও তোমরা।

এবারে মণিকা বলে, সুকান্ত, রণেন,তোমরা কি পাগল হলে?

সহসা রণেন ঘুরে দাঁড়ায় মণিকার কথায় তার দিকে এবং তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গভরা কণ্ঠে বলে, খেপবার আরও কি কিছু বাকি আছে মণিকা! তবু যদি সে রাত্রে তোমাকে আমি সকলে শুতে যাবার পর অতুলের ঘর থেকে আমার ও তার ঘরের মধ্যবর্তী দরজা দিয়ে দ্রুতপদে বের হয়ে তোমার শোবার ঘরে যেতে না দেখতাম!

কি বলছো তুমি রণেন! বিস্ময়ে যেন চেঁচিয়ে ওঠে মণিকা।

হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। অন্ধকার ঘর দেখে ভেবেছিলে তখনও বুঝি আমি ঘরে ঢুকিনি! তখনও বুঝি আমি বাথরুম থেকে ফিরিনি। কিন্তু সব—সব আমি দেখেছি। তুমি আমার চোখের সামনে দিয়ে ঘরের এক মাঝের দরজা দিয়ে অতুলের ঘর থেকে বের হয়ে অন্য মাঝের দরজা দিয়ে নিজের ঘরে চলে গিয়েছিলে। দেখেছি, আমি সব দেখেছি।

রণেন! রণেন,এসব তুমি কি বলছ! আমি তোমরা—তুমি ও অতুল ঘর ছেড়ে চলে আসবার পর প্রায় আধঘণ্টা সুকান্তর ঘরে দাঁড়িয়েই গল্প করেছি।

হ্যাঁ, she is right! সমর্থন করে সুকান্ত।

শাক দিয়ে মাছ ঢাকবার চেষ্টা করা আর বৃথা সুকান্ত। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে ওঠে রণেন।

না, মিথ্যে নয়। যা বলেছি তা সত্যি। মণিকা আবার বলে।

থাক থাক, যথেষ্ট হয়েছে। ঘৃণাভরে মুখ ফেরায় রণেন।

এতক্ষণে কিরীটী কথা বলল, না রণেনবাবু, মণিকা দেবী, সুকান্তবাবু ও আপনি কেউই আপনারা মিথ্যে কথা বলেননি। কিন্তু এ কথাগুলো সে দিন জবানবন্দির সময় প্রত্যেকে আপনারা যদি গোপন না করতেন তবে এত কষ্ট করতে হত না আমাকে হত্যাকারীকে ধরতে। কথাটা বলে কিরীটী এবং শিউশরণের মুখের দিকে তাকাল এবং নিঃশব্দে চোখে চোখে কি যেন ইঙ্গিত জানাল এবং শিউশরণ নিঃশব্দে ঘর হতে বের হয়ে গেল।

এবারে সুবালা দেবী, এঁরা সকলেই যেটুকু যা গোপন করেছিলেন বললেন। আপনিও যা গোপন রেখেছেন বলুন! কিরীটী কথাগুলো বললে সুবালা দেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে।

আমি যা জানতাম সব বলেছি। শান্ত ধীর কণ্ঠস্বর।

না, বলেননি। আপনি এখনও বলেন নি কেন আপনি সে রাত্রে অতুলবাবুর ঘরে গিয়ে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন!

মিথ্যে কথা। তার ঘরে আদৌ আমি যাই নি সে রাত্রে।

কিন্তু সাক্ষী যে আছে সুবালা দেবী!

ঠিক এই সময় শিউশরণের সঙ্গে রণলাল চৌধুরী এসে সেই ঘরে প্রবেশ করল, এসবের মানে কি দারোগাবাবু! সেই সন্ধ্যা থেকে থানায় এনে আমাকে আটকে রেখেছেন! ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললে রণলাল। তার কণ্ঠে রীতিমত বিরক্তি।

কি করি বলুন রণলালবাবু! সে রাত্রে যদি সত্যি কথাটা বলতেন তবে মিথ্যে কষ্ট দিতে হত না আপনাকে। জবাব দেয় কিরীটী।

তার মানে? এসব কি আপনি বলছেন?

ঠিকই বলছি। সুবালা দেবী স্বীকার যাচ্ছেন না যে সে রাত্রে সুবালা দেবী অতুলবাবুর ঘরে বসে অন্ধকারে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু আপনি তো সব দেখেছেন। Eye witness! আপনিই বলুন না?

কিরীটীর কথায় রণলাল ও সুবালা পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। তাকিয়ে থাকে তারা কিছুক্ষণ পরস্পর পরস্পরের প্রতি নিষ্পলক স্থির দৃষ্টিতে।

ঘরের মধ্যে উপস্থিত অন্যান্য সকলে যেন পাথরে পরিণত হয়েছে। সকলেই নির্বাক। বিমূঢ়।

এসবের মানে কি কিরীটীবাবু? শান্ত দৃঢ় কণ্ঠে প্রশ্ন করে সুবালা।

এখনও বুঝতে পারছেন না? আশ্চর্য! সুবালা দেবী, আপনি একজন পাকা অভিনেত্রী সন্দেহ নেই, কিন্তু দুর্ভাগ্য আপনার, ধর্মের কল বাতাসেই নড়েছে। এত করেও আপনি সব দিক বজায় রাখতে পারেননি।

কিরীটীবাবু? তীক্ষ্ণ চিৎকার করে ওঠে মণিকা।

হ্যাঁ মণিকা দেবী, অতুলের হত্যাকারিণী উনিই। সুবালা দেবী। অবশ্য পরিকল্পনাটি ওঁর নয়, ওনার। রণলালবাবুর। এই দুই প্রেমিক-প্রেমিকারই যুগ্ম প্রচেষ্টায় অতুলবাবু নিহত হয়েছেন।

বলেন কি! প্রশ্নটা সকলেই প্রায় একসঙ্গে করে।

মৃতু-ফাঁদ পেতেছিলেন রণলাল তাঁরইপ্রেমিকা সুবালার অনুরোধে। তারপর সেই মৃত্যুফাঁদকে সক্রিয় করে তোলেন উনি শ্রীমতী সুবালা দেবী। কিরীটী জবাব দেয়।

হঠাৎ ঐ সময় পাগলের মত চীৎকার করে ওঠে রণলাল সুবলার দিকে তাকিয়ে, হারামজাদী! তবে তুই সব বলেছিস? তোকে আমি খুন করব!

বলতে বলতে অতর্কিতে রণলাল ঝাঁপিয়ে পড়ে সুবালার ওপরে এবং তার কণ্ঠ টিপে ধরে দুহাতে। কিন্তু কিরীটী সতর্ক ছিল, নিমেষে সে এগিয়ে দুজনের মধ্যখানে এসে পড়ে এবং বলপ্রয়োগে রণলালকে ছাড়িয়ে দেয়। রণলালকে পুলিসের প্রহরায় অতঃপর একটা চেয়ারের উপর বসিয়ে কিরীটী বলে, বসুন রণলালবাবু। প্রেমের গতিটা বড় কুটিল! চরিত্রহীনের দিবাকরকে বুঝেও যে কেন আপনি বুঝতে পারলেন না, সত্যিই লজ্জার কথা। কিরণময়ী দিবাকরকে ভালবাসেনি কোনদিনও, ভালবেসেছিল সে উপেনকেই অর্থাৎ অতুলবাবুকেই।

সুবালাদি! মণিকার কণ্ঠ হতে কথাটা আর্ত চিৎকারের মতই শোনাল।

হ্যাঁ, মণিকা দেবী। বিধবা কিরণময়ীর উপেনকে সেই ভালবাসাই হল কাল। হতভাগিনী কিরণময়ী যেমন জানত না যে উপনের সমস্ত মন জুড়ে ছিল পশু বৌঠান, তেমনি সুবালাও জানতেন না যে অতুলের সমস্ত মন জুড়ে ছিল মণিকা দেবী। তাছাড়া আরও একটা মারাত্মক ভুল সুবালা করেছিলেন, স্বৈরিণীর মত উপচিকা হয়ে নিজেকে এক শিক্ষিত মার্জিত অন্যের প্রেমে অন্ধ পুরুষের সামনে দাঁড় করিয়ে।

আবার রণলাল চেঁচিয়ে ওঠে, স্বৈরিণী! মনে মনে তবে তুই অতুলকেই চেয়েছিস! আমাকে নিয়ে কেবল খেলাই করেছিস! উঃ! কি বোকা আমি! কি বোকা!

হ্যাঁ, বড় মারাত্মক খেলা! মৃদু হেসে কিরীটী বলে।

কিন্তু তবে—তবে সুবালাদি অতুলকে খুন করলে কেন? আবার মণিকাই প্রশ্ন করে।

সেটা সুবালা দেবী বলতে পারবেন না হয়ত। কিন্তু আমি জানি। কিন্তু আজ আর নয়। রাত পোহাল। এবারে আপনারা বাড়ি যান সকলে।

সমস্ত দৃশ্যটার উপরে কিরীটী তখনকার মত একটা পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিতে চাইল।

কিন্তু শেষটুকু না শুনে কেউ যেতে রাজী নয়।

কিরীটী তখন অদূরে পাষাণপ্রতিমার মত নিশ্চল উপবিষ্ট সুবলার দিকে আর একবার তাকাল।

হতাশা অপমান ও দুর্নিবার লজ্জায় উপবিষ্ট সুবালার মাথাটা বুকের উপরে ঝুলে পড়েছে।

নিষ্ফলা এক নারীর পক্ষে এ যে কত বড় মর্মঘাতী কিরীটী তা বুঝতে পারে। মৃদুকণ্ঠে তাইসে শিউশরণকে লক্ষ্য করে বললে, এদের দুজনকেই তাহলে অন্যঘরে রেখে এস শিউশরণ।

শিউশরণের নির্দেশে তখন রণলাল ও সুবালা স্থানান্তরিত হল।

তাহলে এবারে আপনাদের বলি সব কথা। কিরীটী বলতে শুরু করে ব্যর্থ প্রেমের এক মর্মন্তুদ কাহিনী। হতভাগিনী সুবালা! I pity her! জ্বলন্ত আগুনের মত রূপ নিয়ে এসেও সে হল নিষ্ফলা। কিন্তু যৌবন তার সহজাত কামনার স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে দিল তার দেহ ও মনে। সেই অতৃপ্ত কামনার আগুন বুকে নিয়ে সুবালা এসে মণিকা দেবীর দিদিমার কাছে আশ্রয় নিল। দিন কেটে যাচ্ছিল একরকম করে, এমন সময়ে পাশের বাড়ির রণলাল চৌধুরী সুবালার সামনে এসে দাঁড়াল। সুবালার আগুনের মত রূপে রণলাল মুগ্ধ পতঙ্গের মতই পুড়ে ঝলসে গেল কিন্তু অর্ধশিক্ষিত মিস্ত্রী রণলাল সুবালার মনকে পুরোপুরি আকর্ষণ করতে পারল না। বোধ হয় রুচির সংঘাত।

সুবালার মনের মধ্যে ছিল একটা পরিচ্ছন্ন রুচিবোধ, তাই সে তার অতৃপ্ত যৌনকামনায় জ্বলতে থাকলেও রণলালকে গ্রহণ করতে পারলে না মন থেকে। কিন্তু একেবারে হাতছাড়াও করলে না সম্ভবত রণলালকে। মুগ্ধ পতঙ্গকে আকর্ষণ করবার যে এক ধরনের তৃপ্তি—পুরুষকে আকর্ষণ করবার যে সহজাত নারীতৃপ্তি মনে মনে সেটাই সুবালা উপভোগ করতে লাগল রণলালকে দিয়ে। কিন্তু হতভাগ্য প্রেমমুগ্ধ রণলাল সুবালার মনের আসল সংবাদ না পেয়ে মনে মনে ভাবতে লাগল, সুবালা তার করায়ত্ত!

এমনি যখন অবস্থা, মণিকা দেবীর আমন্ত্রণে অতুলবাবু, রণেনবাবু ও সুকান্তবাবু এলেন সেবারে কাশীতে। এবং বলাই বাহুল্য সুবালা সত্যি সত্যিই এবারে অতুলবাবুর প্রতি আকৃষ্ট হল। এবং সে আকর্ষণ ক্রমে বর্ধিত হয়ে চলল মণিকা দেবী অসুস্থ হয়ে পড়ায় ও তার সেবার মধ্য দিয়ে অতুলবাবুর কাছে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে এসে। সৌভাগ্যক্রমে এ সংবাদ আমার গোচরীভূত হয় তদন্তের দিন অতুলবাবুর সুটকেস হাতড়াতে গিয়ে, তাঁর সুটকেসের মধ্যে তাঁর স্বহস্তলিখিত রোজনামচাখানি পেয়ে ও পড়ে। অতুলবাবুও যে সুবালার রূপে প্রথম দিকে কিছুটা আকর্ষিত হননি তা নয়, কিন্তু তাঁর মণিকা দেবীর প্রতি একনিষ্ঠ প্রেম শিক্ষা ও রুচি তাঁর মনের ওপরে করাঘাত হেনে তাঁকে সজাগ করে দিল। তিনি সজাগ হয়ে সরে গেলেন।

রুদ্ধ নিশ্বাসে সকলে কিরীটীর কথা শুনছে। বোবা বিস্ময়ে সকলেই নির্বাক।

কিরীটী পকেট হতে সিগার-কেসটা বের করে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করলে। জ্বলন্ত সিগারটায় গোটাকয়েক টান দিয়ে আবার তার বক্তব্য শুরু করল।

যা বলছিলাম, অতুলবাবুও সাবধান হলেন কিন্তু সুবালা তখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। তার আর ফেরবার পথ ছিল না। এবং সোজাসুজি ভালবাসা বিকারে একদিন সুবালা অতুলবাবুর হাত চেপে ধরলে। অতুলবাবু জানালেন প্রত্যাখ্যান। প্রত্যাখ্যানের লজ্জা ও অপমান নিয়ে সুবালা ফিরে এল আর সেই লজ্জা ও অপমানের ভিতর হতে জন্ম নিল এক ভয়ঙ্কর কুটিল প্রতিহিংসা, পদাহতা নারী সর্পিণীর মত ছোবল তুলল। এই প্রতিহিংসা-অনলে ইন্ধন যোগায় দুটি বস্তু—এক অতুলের প্রত্যাখ্যান আর দুই মণিকা দেবীর চাইতে ঢের বেশী রূপবতী হয়েও অতুলকে আকর্ষণ না করতে পারায় মণিকা দেবীর কাছে তার পরাজয়।

প্রতিহিংসার ঐ আগুন তিন বৎসর ধরে সুবালা বুকের মধ্যে পুষে রেখেছে সুযোগের প্রতীক্ষ্ণয়। সেই সুযোগ এল এবারে যখন আবার আপনারা সকলে কাশীতে এলেন। এবং খুব সম্ভবত হয়ত অতুলবাবুর প্রতি প্রতিহিংসা নেবার জন্য সুবালা রণলালের শরণাপন্ন হয়। কারণ যেভাবে অতুলবাবুকে হত্যা করা হয়েছে সে পরিকল্পনা কোন নারীর মস্তিষ্ক-উদ্ভুত যে নয় এ ধারণা আমার প্রথম দিনই হয়েছিল। তাই প্রথম দিনই সন্দেহের তালিকা থেকে মণিকাদেবীকে আমি বাদ দিয়েছিলাম। যাহোক তারপর রণলালের আবির্ভাব ঘটল রঙ্গভূমে। এবং রণলালেরই পরামর্শমত, অবশ্য সবই আমার অনুমান, সুবালা কোন কিছুর সাহায্যে অতুলবাবুর ঘরের আলোটা নষ্ট করে মিস্ত্রীবেশী রণলালের প্রবেশের সুযোগ করে দেয় ওদের বাড়িতে। সুযোগমত মিস্ত্রীরূপী রণলাল রঙ্গভূমে প্রবেশ করে সবার অলক্ষ্যে মৃত্যু-ফাঁদ পেতে রেখে গেল।

পূর্বেই বলেছি অতুলবাবুকে হত্যা করা হয় বৈদ্যুতিক কারেন্ট প্রয়োগে। ইলেকট্রিক মিস্ত্রী রণলালের পক্ষে হাইভোল্টের পরিকল্পনাটি কার্যকরী করা সহজই ছিল এবং সম্ভবতপরিকল্পনাটি তার মাথায় আসে যত রাজ্যের ট্র্যাশ ইংরাজী পেনী সিরিজের গোয়েন্দা কাহিনীর বাংলা অনুবাদ পড়ে পড়ে। কিন্তু যাক সে কথা। এবারে হত্যার ব্যাপারে ফিরে আসি।

অতুলবাবুর ঘরে বসবার লোহার চেয়ারটার পায়ার সঙ্গে ও ঘরের অলোর সুইচবোর্ডের সঙ্গে একটা তামার পাত ও তারের সাহায্যে যোগাযোগ করে রাখা হয়েছিল এমন ভাবে যে, বেচারী অতুলবাবু ঘরে ঢুকে আলো জ্বেলে ইলেকট্রিক কারেন্টে তরঙ্গায়িত সেই চেয়ারটায় একটিবার গিয়ে বসলেই আর তাঁর পরিত্রাণ থাকবে না। Direct 220 Volt. A.C. current—অপূর্ব, নিষ্ঠুর, অব্যর্থ মৃত্যুফাঁদ। এইখানে হত্যাকারী একটু risk নিয়েছে। যদি অতুলবাবু চেয়ারে একেবারেই না সে রাত্রে বসতেন! সেই ভেবেই হত্যাকারী পূর্ব হতেই বোধ হয় অতুলবাবুর ঘরে ঢুকে অন্ধকারে তাঁর শয্যার উপরে নিঃশব্দে বসেছিল অতুলবাবুর অপেক্ষায়।

অতুলবাবু ঘরে ঢুকে আলো জ্বেলেই ঘরের মধ্যে হত্যাকারীকে দেখতে পেয়ে বোধ হয় চমকে যান। এবং খুব সম্ভবত তখন হত্যাকারী সুবালা অতুলবাবুকে চেয়ারটায় উপবেশন করতে বলে। কোনরূপ সন্দেহ না করে অতুলবাবু হয়ত চেয়ারে গিয়ে বসেন আর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাড়াতাড়ি তখন সুইচ অফ করে সুবালা রণলালের নির্দেশমত মৃত্যুফাঁদের সাজসরঞ্জাম সরিয়ে নিয়ে ঘরের মাঝের দরজা দিয়ে অর্থাৎ রণেনবাবুর ঘরের ভেতর দিয়ে পালায়।

মানসিক চাঞ্চল্যে এইখানে হত্যাকারী মারাত্মক তিনটি ভুল করে। এক নম্বর অতুলবাবুকে যে রাত্রে শয়নের পূর্বে চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ পড়াশুনা করেন সেই তথ্যটি পূর্ব হতে জানা থাকায় এবং লোকের মনে সেই ধারণা জন্মাবার জন্য চেয়ারের পাশে একখানা বই ফেলে রেখে যায় যেটা হয়ত নিজেই সে রাত্রে সে পড়েছিল ও তার হাতে ছিল। ভুল করেছিল অতুলবাবুর সুটকেস থেকে সাধারণত যে ধরনের বই তাঁর প্রিয় যেমন সাইকোলজি ও সেকলেজির কোন একখানা বই সেখানে না রেখে তারই অর্থাৎ হত্যাকারীরই বহু-পঠিত প্রিয় চরিত্রহীন উপন্যাসখানা সেখানে ফেলে রেখে গিয়ে। দু নম্বর ভুল করে সে চেয়ারের পায়া থেকে তামার পাতের রিংটা না খুলে নিয়ে গিয়ে ও সুইচবোর্ডের সঙ্গে যুক্ত তারের সবটুকু খুলে নিতে না পারায়, তাড়াতাড়ি টানাটানিতে বোধ হয় তারের একটা অংশ সুইচ-বোর্ডে লেগেছিল ছিঁড়ে গিয়ে। তিন নম্বর ও সর্বাপেক্ষা মারাত্মক ভুল করে সে মানসিক চাঞ্চল্যে সাধারণ দ্বারপথটা না ব্যবহার করে ঘরের মধ্যবর্তী দ্বারপথটা যাবার সময় ব্যবহার করে। সে হয়ত কল্পনাও করেনি ঘরের মধ্যে ঐ সময় ঠিক অন্ধকারে রণেনবাবু এসে প্রবেশ করেছেন। সোজা পথে ঘর হতে বের হলে ঐ সময় বারান্দায় তাকে কেউ দেখলেও হয়ত অতটা সন্দেহ জাগত না।

এমন সময় রণেনবাবুই প্রশ্ন করেন, কিন্তু মিঃ রায়, আপনি জানলে কি করে যে সুবালা দেবীই হত্যাকারী?

কিরীটী জবাব দিল, দুটি কারণে। প্রথমত অতুলবাবুর ডায়েরী পড়ে এবং দ্বিতীয়ত মৃত অতুলবাবুর চেয়ারের সামনে চরিত্রহীন উপন্যাসখানা পেয়ে। প্রথমটায় চরিত্রহীন উপন্যাসটা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। কিন্তু অতুলবাবুর সুটকেস ঘাঁটতে গিয়ে তার মধ্যে কয়েকখানা সেকসোলজি ও সাইকোলজির বই দেখে চেয়ারের কাছে মাটির ওপরে পড়ে থাকা বইখানা আবার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এবারে গিয়ে বইখানা তুলে নিয়ে দেখি শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীন। পূর্বেই শুনেছিলাম অতুলবাবু সাইকোলজির প্রফেসর। সাইকোলজির প্রফেসর অতুলবাবু রাত জেগে চরিত্রহীন উপন্যাস পড়বেন কেমন যেন মনে খটকা লাগল।

এই সময় হঠাৎ রণেনবাবু বলে ওঠেন, বাংলা উপন্যাস বা বই বড় একটা ও পড়তই না। বিশেষ করে নভেল বা উপন্যাস ছিল তার দুচক্ষের বিষ।

আমারও সেই রকমই মন বলেছিল, যাহোক কৌতূহলভরেই বইখানার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা পাতার মার্জিনে দেখলাম রিমার্ক পাস করা হয়েছে—কিরণময়ী, দুঃখ করো না , উপীন্দ্র নপুংসক। হাতের লেখা দেখে বুঝলাম কোন স্ত্রীলোকের রিমার্ক। এই ধরনের টিপ্পনী করা অভ্যাস বই পড়ে নারীদেরই সাধারণত থাকে বা ঐজাতীয় মনোবৃত্তিসম্পন্ন পুরুষদের থাকে। তাছাড়া বইয়ের প্রথমেই টাইটেল পেজে ছোট্ট করে এক জায়গায় লেখা ছিল সুবালা। বুঝলাম সেটা তারই বই। সমস্ত ব্যাপারটা যোগ করে ভাবতে গিয়ে মনে হল যেভাবেই হোক ঐ হত্যারহস্যের মধ্যে সুবালার অন্তত কিছুটা যোগাযোগ আছেই। কিন্তু সকলের জবানবন্দি থেকে কোন কিনারা হল না।

সন্দেহ পড়েছিল আমার রণেন ও সুবালার ওপরেই বেশী। অথচ এও বুঝেছিলাম একাকিনী সুবালার পক্ষে এ হত্যা ঘটানো সম্ভবপর নয়। সুবালা সুন্দরী যুবতী। পুরুষ মাত্রেই তার প্রতি আকৃষ্ট হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু কার সাহায্য নিল সুবালা। স্বভাবতই মনে হল সুবালা যদি কারও সাহায্য নিয়ে থাকে তো সে আশেপাশেরই কোন যুবক হবে। তাই হানা দিলাম সর্বপ্রথমেই পাশের বাড়িতে। রণলালের সাক্ষাৎ মিলল এবং তার সঙ্গে কথায়বাতায় বুঝলাম, সুবালার প্রতি রণলাল যে বিরাগ দেখাচ্ছে সেটা আসল সত্য নয়। অভিনয় মাত্র। যাতে তাদের ওপরে কারও সন্দেহ না পড়ে। কিন্তু তা যেন হল, সুবলাই যদি হত্যা করে থাকে, তার movemets ধোঁয়াটে জবানবন্দিতে পরিষ্কার হয়নি। তাই গঙ্গার ঘাটে আজ রাত্রের অভিনয়ের আয়োজন। কিন্তু তাতে একটা ব্যাপার প্রমাণিত হলেও সুবালার ব্যাপারটা হল না। কারণ মণিকা দেবীকে shield করবার জন্য রণেন ও সুকান্তবাবু তখনও সত্যি কথা সবটুকু বললেন না।

কিন্তু কি প্রমাণিত হল বলছিলেন? প্রশ্ন করে সুকান্ত।

প্রমাণিত হল এই যে, সত্যিই আপনারা দুজনেই মণিকা দেবীকে অন্তর দিয়ে ভালবাসেন। এবং আপনাদের দুজনের একজনও অতুলবাবুর হত্যার সঙ্গে জড়িত নন।

তারপর বলুন? রণেন বলে।

তারপর আর কি, পূর্বাহ্নেই আমি শিউশরণের সাহায্যে সুবালা ও রণলালকে পৃথক পৃথক ভাবে থানায় ডাকিয়ে এনে দুটি পৃথক ঘরে আটকে রেখেছিলাম। তার পরের ব্যাপারটা তো সর্বসমক্ষেই ঘটল। নূতন করে বিবৃতির প্রয়োজন রাখে না। কিন্তু শেষ কথা আবার আপনাদের বলছি—আপনি মণিকা দেবী, রণেনবাবু ও সুকান্তবাবু, আপনাদের মধ্যে এবারে যত শীঘ্র সম্ভব একটা শেষ মীমাংসা করে নিন। কারণ আগুন নিয়ে এ বড় বিষম খেলা। দেখলেন তো চোখের সামনেই।

তিনজনেই মাথা নীচু করে।

কারও মুখ দিয়েই কোন কথা বের হয় না।

কিরীটী শিউশরণের দিকে তাকিয়ে বললে, শিউশরণ, এঁরা আজ তোমার অতিথি, মিষ্টিমুখ করাও অন্তত এক কাপ করে চা—

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! শিউশরণ লজ্জিত ভাবে ঘর হতে প্রস্থান করলে বোধ হয় চায়ের যোগাড় দেখতেই।