৩. রণেন আর সুকান্ত পরস্পর

রণেন আর সুকান্ত পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। এ ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে। পরস্পরের দৃষ্টিতে পরস্পরের প্রতি যেন একই প্রশ্ন চোখের তারায় ফুটে উঠলেও মুখে প্রকাশ পাচ্ছে না। সুকান্তই প্ৰথুমে কথা বললে দুজনের মধ্যকার বিশ্রী স্তব্ধতাটা ভেঙে, ভাবতেই পারছি না আমি রুণু-সত্যিসত্যিই অতুল আমাদের মারা গিয়েছে!

কিন্তু কি করে মরল তাই ভাবছি।

সেটা পরের কথা। এখন আমাদের কি করা কর্তব্য বল?

মৃত্যুটা অস্বাভাবিক বলেই মনে হচ্ছে। এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে আমাদের এখুনি নিকটবর্তী থানায় একটা সংবাদ দেওয়া প্রয়োজন। মৃদু কণ্ঠে রণেন বলে।

থানায়! মানে পুলিসে! কথাটা উচ্চারণ করতে গিয়ে সুকান্ত যেন কেমন নিজেই চমকে ওঠে। কণ্ঠস্বরে একটা সুস্পষ্ট ভীতির আভাস পাওয়া যায়।

হ্যাঁ, থানায় সংবাদ দেওয়া প্রয়োজন।

কিন্তু তার আগে একজন বাইরের ডাক্তারকে ডাকলে হত না? রণেন যেন নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করার ছলে কথাটা বলে।

ডাক্তার! ডাক্তার এসে এখন কি করবে? তাছাড়া তুমিই যখন উপস্থিত আছ! সুকান্ত জবাবে বলে।

বাইরের একজন ডাক্তারেরও প্রয়োজন বইকি। একটা death certificate-ও তো চাই মৃতদেহ সৎকার করতে হলে!

কেন, তুমি?

না, আমার পক্ষে death certificate দেওয়া ভাল হবে না।

তবে!

ডাঃ মজুমদারকেই না হয় তাহলে ডাকা যাক।

বেশ, তাই হোক।

ডাঃ বিলাসবিহারী মজুমদার পাড়াতেই থাকেন। তাঁকেই ডেকে আনতে গেল রণেন।

এদিকে মণিকার বুড়ী দিদিমার কাছে কিন্তু আর চাপা রইল না দুঃসংবাদটা। সুকান্তই জানাল। বুড়ী অতুলকে মৃত দেখে একেবারে কেঁদে ফেললেন। দীর্ঘদিনের পরিচিত এই ছেলে তিনটি বুড়ীর। এবং এই দীর্ঘদিনের পরিচয়ে একটা স্নেহের সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল এদের সঙ্গে। বুড়ী দিদিমা অতুল, রণেন ও সুকান্তকে নিজের জনের মতই দেখতেন।

সুবালাদিও সব শুনে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে যায়। একটু পরেই ডাঃ মজুমদার এলেন। ডাক্তার এ বাড়িতে বিশেষ পরিচিত। হাসিখুশি ও রসিক মানুষ। রণেন ডাক্তারকে ডাকতে গিয়ে আসল সত্যিকারের সংবাদটি দেয়নি। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে উচ্চকণ্ঠে ডাক্তার দিদিমাকে ডাকতে লাগলেন, সক্কালবেলাতেই আবার চৌধুরীগিন্নীর বাড়িতে কার অসুখ হল? কোথায় চৌধুরী গিন্নী?

দোতলার বারান্দায় মণিকা দাঁড়িয়ে ছিল, তার সঙ্গেই ডাঃ মজুমদারের প্রথমে চোখাচোখি হল, এই যে মণি মা! কার অসুখ হল আবার বাড়িতে? রণেনবাবু জরুরী তলব দিয়ে একেবারে টেনে নিয়ে এলেন!

 মণিকার কণ্ঠে সাড়া নেই এবং মণিকার ভীতিবিহ্বল ফ্যাকাশে মুখখানার দিকে হঠাৎ তাকিয়েই ডাক্তারের মনে কেমন যেন খটকা লাগে। দাঁড়িয়ে যান ডাঃ মজুমদার এবং ব্যগ্র উৎকণ্ঠার সঙ্গেই এবারে প্রশ্ন করেন, কি ব্যাপার মণি মা? এখানে এমন করে দাঁড়িয়ে যে?

ডাঃ মজুমদার মণিকাকে মণি মা বলে ডাকতেন এবং মণিকা ডাক্তারকে ডাক্তার জ্যাঠা বলে ডাকত।

ঐ ঘরে যান ডাক্তার জ্যাঠা। নিম্ন কণ্ঠে কোনোমতে কথাগুলো বলে মণিকা।

কি হয়েছে?

ঐ ঘরে—

বিস্মিত হতভম্ব ডাঃ মজুমদার অগত্যা নির্দিষ্ট ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলেন। ঘরে ঢুকেও প্রথমটায় তিনি ব্যাপারটা বুঝতে পারেন না। তারপর অতুলের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। বাক্যস্ফুর্তি হয় না। He is dead! অর্ধস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন ডাক্তার মজুমদার। সকলের মুখের দিকেই অতঃপর একবার তাঁর দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিলেন।

রণেন, সুকান্ত, মণিকা, দিদিমা ও সুবালাদি সকলেই স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে। কারও মুখে কথা নেই। এগিয়ে গিয়ে মৃতদেহ পরীক্ষা করলেন ডাক্তার। মৃতের মুখের দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মৃদু কণ্ঠে বললেন, অস্বাভাবিক মৃত্যু বলেই মনে হচ্ছে মণি মা! থানায় শিউশরণকে একটা সংবাদ দাও। আমি তো death certificate দিতে পারব না। বলতে বলতে রণেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি আমার ডিসপেনসারিতে গিয়ে কম্পাউণ্ডার হরিকে বলুন সে যেন এখুনি সাইকেলে করে থানায় গিয়ে আমার নাম করে শিউশরণকে একটা খবর দিয়ে আসে—এখুনি এ বাড়ির ঠিকানায় আসতে বলেছি আমি। যান—আর দেরি করবেন না। তাই তো! তাই তো!

ডাক্তার নীরবে মাথা দোলাতে লাগলেন আপন মনেই।