• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • লেখক
  • My Account
  • লেখক
  • My Account
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা PDF ডাউনলোড

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

৫৫. ট্রামে উঠেই মাথা গরম

লাইব্রেরি » সমরেশ মজুমদার » সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস সমগ্র » কালপুরুষ - সমরেশ মজুমদার » ৫৫. ট্রামে উঠেই মাথা গরম

ট্রামে উঠেই মাথা গরম হয়ে গেল অর্কর। চারজন লোক বসেছিল সামনে, কণ্ডাক্টর টিকিট চাইতেই তারা চোখ মটকে হাসল। কণ্ডাক্টর দ্বিতীয়বার চাইতেই একজন বলল, পরে দেব, বুঝতে পারছেন না?

কোথায় যাবেন?

এসপ্লানেড।

এক টাকা দিন। তবে চেকার উঠলে টিকিট কাটতে হবে।

এক টাকা কেন? ফিফটি ফিফটি করুন। আশি পয়সা। নামবার আগে দিয়ে যাব। লোকটা দাঁত বের করে হাসতে কণ্ডাক্টর সরে এল অর্কর সামনে, টিকিট!

অর্ক লোকটার দিকে তাকাল। বছর তিরিশের নিরীহ চেহারা। যে চারটে লোকের কাছ থেকে ও ফিরে এল তাদের বয়স চল্লিশের মধ্যে। কণ্ডাক্টর বিরক্ত গলায় বলল, কোথায় যাবেন?

অর্ক চোখে চোখ রাখল, ওদের কাছ থেকে টিকিট নিলেন না কেন? কেমন থতমত হয়ে গেল কণ্ডাক্টর। প্রশ্নটা বেশ জোরে হওয়ায় ট্রামের অন্য লোকগুলো এদিকে তাকিয়েছে। সেই চারজনও অনেকটা অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে অর্ককে দেখছে। শেষ পর্যন্ত কণ্ডাক্টর বলল, আপনার টিকিট করুন, ওসব নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই।

বেলগাছিয়া ব্রিজের ওপর দিয়ে হু হু করে ট্রাম ছুটছিল। এক্ষুনি আর জি কর এসে যাবে। অর্কর রাগ আরও বাড়ছিল, চমৎকার, আপনি প্রকাশ্যে পয়সা খাচ্ছেন, ট্রাম কোম্পানিকে ঠকাচ্ছেন আর কিছু বলা যাবে না?

এবার লোকটা প্রতিরোধ শক্তি হারিয়ে ফেলল। অর্ক অন্য যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বলল, এই লোকটিকে চিনে রাখুন। এ সমাজবিরোধী। ঘুষ নিয়ে ট্রামের লোকসান বাড়াচ্ছে। আর ওই চারজনও তাই। ভদ্রলোকের চেহারা নিয়ে হাফ টিকিটে বেড়াতে যাচ্ছে।

সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে রব উঠল, ঠিক বলেছে। এই জন্যে টিকিটের দাম বাড়ে। এদের ধরে পুলিসের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। আরে মশাই, কাকে বলবেন? সবখানেই তো দুনম্বরী ব্যাপার। মরালিটি শব্দটা এখন উঠে গেছে। পঁয়ত্রিশ পয়সা এগিয়ে দিতেই কণ্ডাক্টর টিকিট ছিঁড়ে দিল। ওর মুখ শুকিয়ে গেছে। আর জি কর আসতেই কণ্ডাক্টর ফিরে গেল চারজনের কাছে, টিকিট দিন। আপনাদের জন্যে বেইজ্জত হতে হল।

ট্রাম থেকে নেমে পড়ল অর্ক। পাঁচটা সমাজবিরোধীকে নিয়ে এক নম্বর ট্রামটা এসপ্লানেডের দিকে চলে গেল। অর্ক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সেই ট্রাফিক পুলিসটা আজ দাঁড়িয়ে নেই। আর একটা সমাজবিরোধী। তবে তার জায়গায় যে দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে অনেকটা আগের লোকটার মতনই।

এখনও বোধ হয় ভিজিটিং আওয়ার্স শুরু হয়নি। কিন্তু এর মধ্যে চত্বরে বেশ ভিড় জমেছে। পিচের পথটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অর্ক বুঝতে পারল তার শরীরটা যতটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল বলে মনে হয়েছিল ততটা হয়নি। মাথার ভেতরে দপদপানি শুরু হয়েছে, গা গোলাচ্ছে, জিভে তিকুটে স্বাদ।

খানিকটা এগোতেই মাথাটা এমন ঘুরে গেল যে অর্ক হাসপাতালের বারান্দায় বসে পড়ল পা ঝুলিয়ে। তার এখন জ্বর নেই কিন্তু শরীরে সামান্য শক্তি অবশিষ্ট নেই। অর্ক অলস চোখে হাসপাতাল বাড়িটার দিকে তাকাল। এটাও তো একটা দু’নম্বরের আড়ত। তোমার ন্যায্য পাওনা তুমি পাবে না। অথচ ধরার লোক আর পকেটে টাকা থাকলে সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। আর এই হাসপাতালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অর্কর মনে বিলাস সোমের মুখটা ভেসে উঠল। লোকটা এক নম্বর না দুনম্বর ছিল সেটা বোঝা বড় গোলমেলে।

মিনিট দশেক বসে থাকার পর একটু আরাম হল। অর্ক খানিকটা এগোতেই কোয়া এবং বিলুকে দেখতে পেল। ওদের চেহারা একদিনেই বেশ জীর্ণ হয়েছে। দুজনে একটা সিঁড়িতে বসে ছিল। ওকে দেখেই তড়াক করে উঠে এল।

বিলু জিজ্ঞাসা করল, তোমার নাকি জ্বর হয়েছে খুব?

কে বলল?

ওই ন্যাটা লোকটা। তোমাদের বোধ হয় আত্মীয় হয়।

পরমহংস কাকুর সঠিক পরিচয় পেয়ে হাসল অর্ক। তারপর মাথা নাড়ল, ওঁকে দেখেছিস তোরা?

বিলু বলল, না। এ বেলায় দেখিনি। বারোটা একটা অবধি ছিল।

কেন? অর্ক বুঝতে পারল না অত বেলা পর্যন্ত পরমহংসকাকু কেন থাকবে?

তোমার মায়ের কেসটা বোধ হয় ভাল নয়।

সঙ্গে সঙ্গে অর্কর বুকের ভেতরটা অসাড় হয়ে গেল। সে সাদা চোখে হাসপাতাল বাড়ির দিকে তাকাল। ভিজিটিং আওয়ার্স শুরু হয়েছে। লোকজন ভেতরে ঢুকছে। মাকে কি বিছানায় আনা হয়েছে? অর্ক আর দাঁড়াল না। কোয়াদের সেখানেই রেখে ও হাসপাতালের বারান্দায় উঠে এল। গেটে যে দারোয়ানটা থাকে সে এর মধ্যেই বোধ হয় অর্ককে চিনে গিয়েছে। কারণ কখনই কোন প্রতিরোধের সামনে দাঁড়াতে হয়নি অর্ককে ঢোকার সময়ে। ওষুধের বিটকেল গন্ধে ডুবে ডুবে অর্ক মাধবীলতার বিছানার সামনে এসে অবাক হয়ে গেল। একটি বিশাল চেহারার মহিলা বাবু হয়ে বসে ছানা খাচ্ছেন।

অর্ক অসহায় চোখে তাকাল চারপাশে। দেখতে আসা মানুষেরা যেন মেলা বসিয়েছে চারধারে। কিন্তু মাধবীলতা নেই। তার মানে অপারেশনের পর মাধবীলতাকে আর বিছানায় ফিরিয়ে আনা হয়নি।

অর্ক বাইরে বেরিয়ে এল। গেটের বাইরে তখন পরমহংস আর সৌদামিনী দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে পরমহংস এগিয়ে গেল, তোমার শরীর এখন কেমন আছে?

ভাল। মা–?

পরমহংস আড়চোখে সৌদামিনীর দিকে তাকাল। সৌদামিনীর মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই। অর্কর বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল। সে আবার প্রশ্ন করল, মায়ের কি কিছু হয়েছে?

 সৌদামিনী এবার কথা বললেন। ওঁর ঠোঁট সামান্য নড়লেও শব্দগুলো ঠিকঠাক বেরিয়ে এল, আমাদের এখন যে কোন পরিস্থিতির জন্যে তৈরি হতে হবে।

মানে?

এটা তো খুবই সরল। মেয়েটা সারাজীবনে তোমাদের জন্যে এত রক্ত দিয়েছে যে আজকে নিজের জন্যে লড়াই করার শক্তিটুকুও নেই।

হঠাৎ অর্কর মনে হল সৌদামিনী যেন আঙ্গুল তুলে বলছেন, তুমি এবং তোমরা মাধবীলতার মৃত্যুর জন্যে দায়ী হবে।

দুহাতে মুখ ঢাকল অর্ক। ওর সমস্ত শরীর কাঁপছিল। মা না থাকলে পৃথিবীটার চেহারা যে অন্যরকম হয়ে যাবে। কাঁধে হাত রাখল পরমহংস, ভেঙ্গে পড়ো না। ওকে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। বড় দুর্বল হয়ে পড়েছে। একবার সেন্স আসতেই অনিমেষের নাম ধরে ডেকেছিল। 

অর্ক ঠোঁট কামড়ালো। সে জিজ্ঞাসা করল, ডাক্তারবাবু কি হাসপাতালে আছেন?

হ্যাঁ। মিসেস সেনগুপ্তা ওঁকে বাড়ি থেকে তুলে এনেছেন। এখন ওঁর হাসপাতালে আসার কথা নয়।

আমি ওঁর সঙ্গে দেখা করব।

অর্ক আর দাঁড়াল না। পথে কয়েকটা বাধা পেলেও ও একরোখা ভাব দেখিয়ে ডাক্তারের মুখোমুখি হয়ে গেল। ডাক্তার তখন নিজের ছোট্ট ঘরটিতে চোখ বন্ধ করে বসে ছিলেন। ভদ্রলোককে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল।

অর্ক সামনে দাঁড়াতেই ডাক্তার চোখ খুললেন, কি চাই?

আপনার সঙ্গে একটু কথা বলব।

এখানে কে আসতে দিল?

কেউ দেয়নি, আমি এসেছি। ডাক্তারবাবু, আমার মা বাঁচবে না?

কে তোমার মা?

মাধবীলতা, যার অপারেশন আপনি করেছেন।

ও। হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। ডাক্তারবাবু অর্ককে আর একবার দেখলেন, আমার পক্ষে যা করা সম্ভব আমি সব করেছি। এখন ভগবানই ভরসা।

মায়ের কি হয়েছে?

অনেক কিছু, তুমি বুঝবে না। তবে মোটামুটি জানো, ওঁর পেটে অনেকটা ঘা হয়ে গিয়েছিল। ওপেন করে আমি হতভম্ব হয়ে গেছি। এটা অনেকদিনের ব্যাপার। জেনেশুনে আত্মহত্যা করা হচ্ছিল। এ কথাগুলো বলতে বলতে ডাক্তারবাবুর যেন খেয়াল হল, তোমাকে সৌদামিনী সেনগুপ্তা কিছু বলেননি?

না। ডাক্তারবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, তোমার বাবা এসেছেন?

বাবা?

হ্যাঁ, শুনলাম ওঁকে টেলিগ্রাম করা হয়েছে, এসেছেন?

অর্ক কথা বলল না কিন্তু শক্ত মুখে মাথা নাড়ল। ডাক্তার আবার জিজ্ঞাসা করলেন, হু ইজ অনি?

কেন?

যখনই সেন্স আসছে তখনই অনি শব্দটা ওর মুখে শোনা গেছে। তোমার নাম কি অনি?

অর্ক নিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আবার মাথা নাড়ল। খানিক আগে পরমহংসকাকু যখন ওই কথা বলেছিল ও বিশ্বাস করেনি। মা এখন বাবার কথা মনে করছে? পৃথিবীতে সবচেয়ে মায়ের কে আপন তা তো জানাই হয়ে গেল। তাহলে মা কেন চলে এল বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে? কেন তার পরিচয়ের ওপর কালি ছিটিয়ে দিল? যে মানুষটাকে খবর পাঠাতে নিষেধ করেছে বারংবার সেই মানুষের নাম ধরে ডাকছে চেতনা ফিরলেই?

মায়ের ওপর তীব্র অভিমান অর্কর মনে জন্ম নিল। মা তার কথা একবারও ভাবল না? এই সময় তো প্রিয়জনের মুখ মনে পড়ে, সে কি মায়ের প্রিয়জন নয়? অর্কর বুকের ভেতর যেন ভাঙ্গচুর চলছিল।

এই সময় আর একজন লোক ডাক্তারের সামনে দাঁড়াতেই তিনি নরম গলায় বললেন, মন শক্ত করো আর ভগবানকে ডাকো। তিনি আছেন বলেই পৃথিবীতে এখনও মির‍্যাকল ঘটে।

আমি একবার ওঁকে দেখতে পারি?

চোখ বড় হয়ে গেল ডাক্তারের, ইম্পসিবল।

একবার দেখব, একটুখানি। মাকে একবার দেখতে দিন।

ভেতরে যেতে দেব না আমি। বাইরে থেকে দেখতে পারো। একটা বেয়ারা গোছের লোককে ডেকে নির্দেশ দিতে সে অর্ককে নিয়ে গেল অনেকটা পথ হাঁটিয়ে বিশেষ ঘরের সামনে। তারপর বলল, ওই জানলা দিয়ে দেখুন।

জানলাটি কাঁচের। ভেতরটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ঘরের ভেতর গোটা চারেক খাটে অসুস্থ মানুষেরা শুয়ে আছে। তাদের মুখে নাকে হাতে নানারকমের নল আটকানো। কিন্তু কাউকেই আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না, প্রত্যেকটা শরীর সাদা চাঁদরের আড়ালে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। অসুস্থ মানুষদের চেহারা এক রকম হয়?

অর্ক চেষ্টা করেও মাধবীলতাকে খুঁজে বের করতে পারল না।

দুটো পা যেন ভীষণ ভারী, হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল অর্কর। ডাক্তার তো বলেই দিলেন তাঁর আর কিছুই করার নেই, এখন ভগবানই ভরসা। বিজ্ঞান কি কখনো ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে? তাহলে এ কেমন ডাক্তার? ডাক্তার বললেন, পেট ওপেন করে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। মায়ের পেটের মধ্যে কি ছিল? যদি কিছু খারাপ হয়ে থাকে সেটা কি পাল্টানো যায় না? যদি তার পেটের যন্ত্রপাতি খুলে মায়ের পেটে লাগিয়ে দেওয়া যায়? অর্ক কেঁদে ফেলল। সে বুঝতে পারছিল যখন একজন ডাক্তার ঈশ্বরের ওপর নির্ভর করতে বলেন তখন বিজ্ঞানের করার কিছু থাকে না।

এবং তখনই তার মনে দ্বিতীয় চিন্তার উদয় হল। মা এই সময়েও অর্ক বলে ডাকেনি। মায়ের মনের কোথাও সে নেই। যাকে মানুষ প্রচণ্ড ভালবাসে একমাত্র তার কথাই এই মুহূর্তে মনে পড়ে। মায়ের সঙ্গে বাবার ঝগড়া, সম্পর্ক ত্যাগ–এসবই তাহলে বানানো। আসলে মা যাকে ভালবাসতো তাকেই ভালবেসে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে তো মা অন্যরকম শিখিয়েছিল। না, মা তাকে বাবার বিরুদ্ধে কোনদিন কোন কথা বলেনি। তার মন বিষাক্ত করার কোন চেষ্টা করেনি। কিন্তু সে তো বাবাকে মানতে পারেনি। তার চেতনায় মা এবং বাবা সেই রাত্রে যে নোংরা জল ছুঁড়ে দিয়েছিল তা থেকে তো সারাজীবন মুক্তি নেই। এই সময় ভেবেছিল মা এবং সে পরস্পর পরস্পরের আশ্রয়। আজ বোঝা গেল সবই ভুল। আর এই প্রথম অর্ক অনিমেষকে হিংসে করতে লাগল। এবং অকস্মাৎ একটা নির্লিপ্তি তাকে গ্রাস করল। অর্ক চোখের জল মুছল কিন্তু সবকিছু সাদা হয়ে রইল তার চারপাশে।

বারান্দায় আসতেই নীপা মিত্র তাকে জিজ্ঞাসা করল, ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল তোমার?

মাথা নাড়ল অর্ক, হ্যাঁ।

আমি বিশ্বাস করি না তোমার মা চলে যাবে।

কে বলেছে চলে যাবে?

নীপা মিত্র যেন হোঁচট খেল। তারপর অন্য রকম গলায় জিজ্ঞাসা করল, কেন, ডাক্তারবাবু তোমায় কিছু বলেনি?

সেরকম কিছু বলেননি। শুধু ভগবানকে ডাকতে বললেন।

হ্যাঁ। ভগবানকে ডাকলে সব হয়। তুমি আমার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে যাবে?

কেন?

নীপা মিত্র হতাশ চোখে তাকাল অর্কর দিকে। অর্কর ঠোঁটে তখন হাসি, মা বলেছে ভগবানের কোন বাড়ি নেই। দক্ষিণেশ্বরে গেলেই ভগবানকে পাওয়া যাবে না। আর মা তো ঠাকুর দেবতা–।

ঠিক সেই সময় সৌদামিনী এগিয়ে এলেন, অর্ক, এখন তো ঈশ্বরকে ডাকা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই।

অর্ক বলল, হ্যাঁ, তাই উনি দক্ষিণেশ্বরের কথা বলছিলেন।

সৌদামিনী নীপা মিত্রকে দেখলেন, এ ব্যাপারে আমি কারো ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত করতে চাই না। আমি শুধু ঈশ্বরকে ডাকার কথাই বলতে পারি।

পরমহংস উঠে এসেছিল কাছে। বলল, একবার ডক্টর চক্রবর্তীর কাছে গেলে হতো না? শুনেছি উনি নাকি এ ব্যাপারে কিছু কিছু সাফল্য পেয়েছেন।

সৌদামিনী বললেন, অ্যালাপাথি থেকে হোমিওপাথিতে শিফট করতে গেলে, দাঁড়ান, আগে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলি।

দূরে একটা রিকশা আসছিল। রিকশাকে ঘিরে বেশ ভিড় এগিয়ে আসছে আউটডোরের দিকে। রিকশার ওপরে একটি এলিয়ে পড়া মানুষকে ধরে বসে আছে নিমু চাঅলা। অর্ককে দেখামাত্র ঈশ্বরপুকুরের কয়েকজন উত্তেজিত অবস্থায় ছুটে এল। তারা জানাল, কয়লার ছেলেরা চোরাগোপ্তা আক্রমণ করছে। একটু আগে শ্যামবাজারের মোড়ে হরেন ড্রাইভারের ছেলেকে ধরে কুপিয়েছে। নিমু চাঅলা একজনকে নিয়ে ওই সময় শ্যামবাজারে গিয়েছিল বলে ওরা প্রাণে মারতে পারেনি। আজকের কয়লার বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হবে বদলা হিসেবে। এরা সবাই আজ আদালতে গিয়েছিল। সেখানে কয়লাকে বিচারকের সামনে উপস্থিত করা হয়েছিল। কয়লাকে দেখতে বিরাট জনতা উপচে পড়েছিল সেখানে। সবাই কয়লাকে ছিঁড়ে ফেলতে চায়। আজ কয়লা জামিন পায়নি। কয়লার বড় বড় সঙ্গীরা হয় ধরা পড়ছে নয় ধরা দিচ্ছে। ফেরার পথে ওরা দেখতে পায় নিমু চাঅলা আহতকে নিয়ে রিকশায় আসছে।

শুনতে শুনতে অর্কর মনে পড়ল কোয়া এবং বিলু এতক্ষণ এখানেই ছিল। গতকাল মায়ের জন্যে ওরা রক্ত দিয়েছে। প্রয়োজন হলে ওরা আজও রক্ত দেবে। কিন্তু সেই সঙ্গে ওরা জানতে এসেছিল অর্ক তাদের জন্যে কিছু করতে পেরেছে কিনা। যে সমাজবিরোধী একটু আগে ছুরি মেরেছে, যে সমাজবিরোধী ট্রামে টিকিট কাটে না বা ঘুষ নেয়, যে সমাজবিরোধী সাদা পাশাক পরে চৌমাথায় দাঁড়িয়ে লরির ড্রাইভারের কাছে ঘুষ খায় বিলু এবং কোয়া সেই সমাজবিরোধীদের সঙ্গে এক শ্রেণীতে পড়ে না। তবু ওদের জানানো দরকার শুদ্ধির জন্যে একবার থানায় যেতে হবে। একবার থানা থেকে না ঘুরে এলে পাড়ার মানুষ ওদের গ্রহণ করতে পারবে না। আহতকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু কোয়া এবং বিলুকে আশেপাশে কোথাও দেখতে পেল না অর্ক। এই ভিড় দেখেই বোধ হয় ওরা আড়ালে চলে গিয়েছে।

কিন্তু এসব ব্যাপারে আর উৎসাহ পাচ্ছিল না অর্ক। ভিড় সরে গেলে সৌদামিনী বললেন, তোমাদের পাড়াটা খুব খারাপ, কাগজে পড়লাম।

কাগজে লিখেছে?

হ্যাঁ। একজন সমাজবিরোধী নাকি দলবল নিয়ে খুব অত্যাচার করত। পাড়ার লোকরা একজোট হয়ে তাকে পুলিসের কাছে তুলে দিয়েছে।

পরমহংস বলল, আমি পড়েছি খবরটা। এই ধরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে অর্ক একজন নায়ক। ওর পিঠে বোধ হয় এখনও ব্যাণ্ডেজ আছে, ছুরির।

সৌদামিনী বললেন, সে কি! তুমি এসব ঝামেলায় আছ নাকি?

অর্ক কথা বলল না। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে তার ভাল লাগছে না। সৌদামিনী আবার যোগ করলেন, তোমার মা এমন অসুস্থ আর তুমি ওসব করবে এটা ভাল নয়। উচিত নয়।

নোংরা জলে থাকব আর নোংরা গায়ে লাগলে পরিষ্কার করব না?

কথাটা শুনে তিনজনেই যেন চমকে উঠল। সৌদামিনী বললেন, আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না তোমরা অমন খারাপ পরিবেশে থাকতে কি করে? একটু বেশী ভাড়া দিলে ভদ্র পাড়ায় ঘর পাওয়া যায় নিশ্চয়ই।

ভদ্রপাড়ায় বুঝি সমাজবিরোধী থাকে না?

সৌদামিনীর মুখ কালো হয়ে গেল, মানে?

এই সময় পরমহংস নির্জীব হাসল, ঠিক বলেছ। নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়? তারপর রুমালে মুখ মুছল।

কথাটা অর্কর মনে বাজল। সত্যি তো! একটা শহরে আগুন লাগলে সব মন্দির পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। কেউ সেগুলো বাঁচাতে পারবে না। কলকাতার এক অঞ্চলে সমাজবিরোধীরা মাথা চাড়া দিলে অন্য পাড়ায় শান্তি থাকতে পারে না। নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়? সুন্দর কথা। এটা কি কোন কবিতার লাইন? হঠাৎ ঊর্মিমালার মুখ ভেসে এল মনে। এরকম লাইন বোধ হয় রবীন্দ্রনাথই লিখেছেন। অর্ক লাইনটা মনে করে রাখল।

এই সময় ডাক্তারবাবুকে দেখতে পেয়ে পরমহংস এবং সৌদামিনী তাঁকে ধরতে এগিয়ে গেলেন। অর্ক একবার সেদিকে তাকাল কিন্তু নড়ল না। নীপা মিত্র এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, জিজ্ঞাসা করল, ডাক্তারবাবু বেরিয়েছেন, কথা বলবে না?

আমি তো কথা বলেছি।

কি বললেন উনি? ক্যান্সার হয়নি তো?

ক্যান্সার? অর্কর সমস্ত শরীর শিথিল হয়ে গেল। মায়ের ক্যান্সার হলে সে কি করবে? ক্যান্সার হলে মানুষ বাঁচে না। শরীরের একটা জায়গায় ক্যান্সার হলে সেটি কেটে বাদ দিতে হয়। কিন্তু তার শেকড় অন্য জায়গায় মাথা তোলে। শেষ পর্যন্ত হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?

অর্ক সজোরে মাথা নাড়ল, না ক্যান্সারের কথা আমায় বলেনি! আপনাকে কে বলেছে মায়ের ক্যান্সার হয়েছে?

আমাকে কেউ বলেনি। খারাপ কথা প্রথমে মনে আসে বলে জিজ্ঞাসা করলাম।

এই সময় সৌদামিনীর উচ্ছ্বাস শোনা গেল। ছেলেমানুষের মত তিনি অতদূর থেকেই উত্তেজিত এবং আনন্দিত গলায় বলে উঠলেন, নীপা, ইটস নট দ্যাট, নট দ্যাট।

অর্ক দেখল ওঁরা ডাক্তারবাবুর সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছেন বারান্দা ধরে। নীপা মিত্র ছুটে গেল সেদিকে। কিন্তু অর্ক নেমে এল নিচে। না, মায়ের ক্যান্সার হয়নি। নট দ্যাট নট দ্যাট। আঃ। দুটো শব্দ একটা পাথরের পাহাড় গলিয়ে দিল। নগরে যদি আগুন না লাগে তাহলে দেবালয় কেন পুড়বে?

এবং তখনই তার দুই হাত মুঠো পাকাল। শরীর কাঁপতে লাগল। প্রাণপণে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে লাগল অর্ক। কারণ কাঁধে ঝোলা নিয়ে দুটো ক্রাচে ভর দিয়ে যে মানুষ দ্রুত এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে এই আলো অন্ধকারে তাকে চিনতে একটুও ভুল হয়নি।

Category: কালপুরুষ - সমরেশ মজুমদার
পূর্ববর্তী:
« ৫৪. সকালে একবার চোখ মেলেছিল অর্ক
পরবর্তী:
৫৬. অর্ক একটুও নড়ল না »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑