১৩. মৃতদেহ

মৃতদেহ

দারোগাবাবুরও যেন অতঃপর কেমন সব গোলমাল হয়ে যায়।

কিছুক্ষণ চিন্তা করে তিনি বললেন, চলুন না সুব্রতবাবুআমার সঙ্গে একটিবারসেইশালবনে; কোথায় আপনি মৃতদেহ দেখে এসেছিলেন, exact location-টা দেখাবেন।

নিশ্চয়ই, চলুন।

সকলে নদী পার হয়ে শালবনের দিকে এগিয়ে চলল।

.

প্রভাতের সোনালী রোদ শালবনের গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে ইতস্তত উঁকি দিচ্ছে।

শীতের প্রভাতের ঝিরঝিরে হাওয়া শালবনের গাছে সবুজ কচি পাতাগুলিকে মৃদু মৃদু শিহরণ দিয়ে বয়ে যায়।

সকলে এসে শালবনের মধ্যে প্রবেশ করল।

কোথায় দেখেছিলেন কাল রাত্রে সেই মৃতদেহ সুব্রতবাবু? দারোগাবাবু প্রশ্ন করলেন।

ওই শালবনের দক্ষিণদিকে।

গতরাত্রের সেই জায়গায় সকলে সুব্রতর নির্দেশমত এসে দাঁড়াল।

আশেপাশে কয়েকটা বড় বড় শালগাছ ছোট একটা জায়গাকে যেন আরও ছায়াচ্ছন্ন ও নির্জনতর করে ঘিরে রেখেছে।

এই সেই জায়গা দারোগাবাবু, সুব্রত বললে।

সেই জায়গার মাটিতে তখনও রক্তের দাগ জমাট বেঁধে শুকিয়ে আছে দেখা গেল।

সুব্রত সেই জমাটবাঁধা রক্তের দাগগুলোর দিকে আঙুল তুলে বলল, এই দেখুন দারোগা সাহেব, আমি যে গত রাত্রে স্বপ্ন দেখিনি বা আমার চোখের দৃষ্টিভ্রম ঘটেনি তার প্রমাণ। এই মাটির বুকে এখনও রক্তের দাগ রয়েছে।

সকলে তখন এক এক করে রক্তের দাগগুলো পরীক্ষা করে দেখল এবং সুব্রতর কথা যে মিথ্যা নয় এরপর সেটাই সকলে মেনে নিতে বাধ্য হল।

তাই তো স্যার, এ যে তাজ্জব ব্যাপার! দারোগাবাবু বলতে লাগলেন, কিন্তু মৃতদেহটা তবে কোথায় গেল?

সুব্রত তখন চারিদিকে ইতস্তত অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে চেয়ে কি যেন দেখছিল, দারোগাবাবুর কথার কোনো জবাবই দিল না।

এদিক ওদিক চেয়ে দেখতে দেখতে সহসা একসময় সুব্রতর চোখের দৃষ্টিটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং সহসা সে চিৎকার করে বলে উঠল, ইউরেকা! ইউরেকা! সম্ভবত আপনার লাশ পাওয়া গেছে দারোগা সাহেব। কিন্তু একটা শাবলের যে দরকার।

সুব্রতর উৎফুল্ল চিৎকারে সকলেই সুব্রতর দিকে ফিরে তাকাল।

ব্যাপার কী সুব্রতবাবু? শঙ্কর বললে।

লাশ পাওয়া গেছে শঙ্করবাবু। সুব্রত হাসতে হাসতে বললে।

লাশ পাওয়া গেছে? আপনার মাথা খারাপ হল নাকি সুব্রতবাবু? দারোগাবাবু বললেন।

দয়া করে একটা শাবল আনিয়ে দিন। আমি এখনই প্রমাণ করে দিচ্ছি।

তখনি বিমলবাবুকে খনিতে পাঠিয়ে দেওয়া হল একটা শাবল নিয়ে আসবার জন্য।

অল্পক্ষণের মধ্যেই বিমলবাবু ছোট একটা মাটি-খখাঁড়া শাবল নিয়ে ফিরে এলেন।

এই নিন স্যার শাবল।

সুব্রত বিমলবাবুর হাত থেকে শাবলটা নিয়ে একটা বড় শালগাছের গোড়া থেকে একটা ছোট শালগাছের চারা এক টান দিয়ে অনায়াসেই শিকড়সুদ্ধ তুলে ফেলে দিয়ে ক্ষিপ্রহস্তে মাটি খুঁড়তে লাগল। বেশী মাটি খুঁড়তে হল না, খানিকটা মাটি উঠে আসবার পরই একটা মানুষের হাত দেখা গেল।

এই দেখুন দারোগা সাহেব, আমার কথা ঠিক কিনা! এই দেখুন লাশ। সুব্রতর সমগ্র শরীর ও কণ্ঠস্বর প্রবল একটা উত্তেজনায় যেন কাঁপছে।

তারপর অল্প আয়াসেই মাটি থেকে মৃতদেহ খুঁড়ে বের করা হল। মৃতদেহ পরীক্ষা করে দেখা গেল যে, সুব্রত যা বলেছিল ঠিক তাই। মৃতদেহের পাঁজারায় গুলির ক্ষতও রয়েছে।

দারোগাবাবু এতক্ষণ একটি কথাও বলেননি, যেন বোকা বনে গেছেন। এমন ব্যাপার যে একটা ঘটতে পারে এ যেন ইতিপূর্বে তাঁর ধারণার অতীত ছিল। তিনি একজন দারোগা। এক-আধ বছর নয়, প্রায় দীর্ঘ এগার বছর এই লাইনে চুল পাকাচ্ছেন অথচ এই সামান্য সম্ভাবনাটা তাঁর মাথায় খেলেনি! খেলল কিনা সামান্য একজন শখের গোয়েন্দার সহচরের মাথায়!

দারোগাবাবু একটু গম্ভীরই হয়ে গেলেন।

আমার কথায় এবার বিশ্বাস হয়েছে তো স্যার পুরোপুরি? সুব্রত দারোগাবাবুর মুখের দিকে চেয়ে মৃদু হাসতে হাসতে প্রশ্ন করল।

এখনও আর না বিশ্বাস করে কেউ পারে নাকি সুব্রতবাবু? বললে শঙ্কর। কিন্তু আপনার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রশংসা না করে আমি পারছি না সুব্রতবাবু।

বুদ্ধির কিছু নয়—common sense,শঙ্করবাবু; বুদ্ধি যদি বলেন সে আমার বন্ধু ও শিক্ষাগুরু কিরীটী রায়ের আছে, সুব্রত বললে। শেষের দিকে তার কণ্ঠস্বর শ্রদ্ধায় যেন রুদ্ধ হয়ে এল।

কিন্তু কেমন করে বুঝলেন বলুন তো সুব্রতবাবু যে লাশ এখানে লুকনো আছে?

বললাম তো common sense! এই গাছটা লক্ষ্য করে দেখুন। গাছের পাতাগুলো যেন নেতিয়ে গেছে। এটাই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, বাকিটা আমার অনুমান-চারদিকে চেয়ে দেখুন, চারাগাছ আরও দেখতে পাবেন, কিন্তু কোনো গাছেরই পাতা এমন নেতানো নয়। প্রথমেই আমার মনে হল, ঐ গাছের পাতাগুলো অমন নেতিয়ে গেছে কেন? তখনি গাছটার পাশে ভাল করে চাইতেই মাটির দিকে নজর পড়ল। একটু ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলেই বোঝা যায় পাশের মাটিগুলো যেন কেমন আলগা। মনে হয় কে যেন চারপাশের মাটি খুঁড়ে আবার ঠিক করে রেখেছে। যেই এ কাজ করে থাকুক না কেন, লোকটার যথেষ্ট প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব আছে বলতেই হবে। মাটি খুঁড়ে মৃতদেহ পুঁতে এই গাছটি অন্য জায়গা থেকে উপড়ে এনে এখানে পুঁতে দিয়ে গেছে যাতে করে কারও নজরে না পড়ে এবং স্বাভাবিক বলে মনে হয়। কিন্তু গাছটি অন্য জায়গা থেকে উপড়ে আনার ফলে এক রাত্রেই নেতিয়ে উঠেছে। আরও ভেবে দেখুন এক রাত্রের মধ্যে যেখানে গাড়ি মোটর বা ট্রেনের তেমন কোনো ভাল বন্দোবস্ত নেই সেখানে একটা লাশকে সরিয়ে ফেলা কত কণ্ঠসাধ্য! তাছাড়া একটা মৃতদেহ অন্য জায়গায় সরানোও বিপদসঙ্কুল ব্যাপার। একে তো সকলের নজর এড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে, তার ওপর ধরা পড়বার খুবই সম্ভাবনা। অথচ মৃতদেহটা এভাবে ফেলে রাখাও চলে না—তাই সরানোই একমাত্র বুদ্ধিমানের কাজ এবং আশেপাশে কোথাও পুঁতে ফেলতে পারলে সব দিকই রক্ষা হয় এবং ব্যাপারটাও সহজ সাধ্যকর হয়ে যায়।

যা হোক, সকলেই তখন লাশের একটা বন্দোবস্ত করে বাংলোর দিকে ফিরল। কারও মুখেই কোনো কথা নেই। সকলে নির্বকভাবে পথ অতিক্রম করছে।

সকলে এসে বাংলোয় প্রবেশ করল।

বিমলবাবু বাংলো পর্যন্ত আসেননি, খনির দিকে চলে গেছেন মাঝপথ থেকে বিদায় নিয়ে।

বারান্দায় কয়েকটা বেতের চেয়ার পাতা ছিল। তিনজনে তিনটে চেয়ার টেনে বসল। দারোগাবাবুই প্রথমে কথা বললেন, সুব্রতবাবু, ময়নাতদন্তের রিপোর্টগুলো পড়েছেন নাকি?

হ্যাঁ, কাল রাত্রেই পড়ে ফেলেছি।

কি বুঝলেন?

সামান্যই। তার থেকে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া চলে না। আচ্ছা দারোগা সাহেব, এই case-গুলোর chemical examination-এর report-গুলো আপনার কাছে আছে নাকি?

না। তবে বলেন তো চেষ্টা করে আনিয়ে দিতে পারি কোয়ার্টার থেকে; দরকার আছে নাকি?

হ্যাঁ পেলে ভাল হত। একটা কাজ করতে পারবেন দারোগাসাহেব?

বলুন।

একটু অপেক্ষা করুন। সুব্রত ঘরের মধ্যে চলে গেল এবং পরক্ষণেইকাগজে মোড়া গতরাত্রের সেই তীরটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।

ব্যাপার কী? ওটা কি আপনার হাতে? দারোগাবাবু সুব্রতর হাতের কাগজে মোড়া তীরটার দিকে আঙুল নির্দেশ করে জিজ্ঞাসা করলেন।

কাগজের মোড়কটা খুলতে খুলতে সুব্রত বললে, এটা একটা তীর। এর ফলায় আমার মনে হয় কোনো মারাত্মক রকমের বিষ মাখানো আছে, দয়া করে এটা ধানবাদের কোনো কেমিস্টের কাছ থেকে একটু এগজামিন করে কী বিষ আছে জেনে আমায় জানাতে পারেন?

চেষ্টা করতে পারি, তবে কতদূর সফল হব, বলতে পারি না। তার চেয়ে কলকাতায় পাঠিয়ে দিই না কেন! এক হপ্তার মধ্যেই chemical examiner-এর report পেয়ে যাবেন।

দেখুন যদি ধানবাদে সুবিধা না হয়, তবে কলকাতায়ই পাঠাবেন।

তখনকার মত চা ও জলখাবার খেয়ে দারোগাবাবু বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

শঙ্কর খাদের দিকে রওনা হল।

সুব্রত চেয়ারটার উপরে গা এলিয়ে দিয়ে সমস্ত ঘটনাটা চিন্তা করতে লাগল।