১০. অদৃশ্য আততায়ী

অদৃশ্য আততায়ী

সেই আগেকার পথ ধরেই সুব্রত আবার ফিরে চলেছে। আকাশে কাস্তের মত সরু একফালি চাঁদ জেগেছে; তারই ক্ষীণ জোৎস্না শীতার্ত ধরণীর ওপরে যেন স্বপ্নের মতই একটা আলোর ওড়না বিছিয়ে দিয়েছে। পলাশ ও মহুয়াবনে গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে টুকরো টুকরো চাঁদের আলোর আলপনা। বনপথে যেন আলোর আলপনা ঢাকাই বুটি বুনে দিয়েছে। মাদল ও বাঁশির শব্দ তখনও শোনা যায়।

সুব্রত অন্যমনস্ক ভাবেই ধীরে ধীরে পথ চলছিল, সহসা সোঁ করে কানের পাশে একটা তীব্র শব্দ জেগে উঠেই মিলিয়ে গেল। পরক্ষণেই স্তব্ধ আলোছায়া-ঘেরা বনতল প্রকম্পিত করে বন্দুরে আওয়াজ জেগে উঠল: গুড়ুম! এবং সঙ্গে সঙ্গে কার যেন আর্ত চিৎকার কানে এল। সুব্রত থমকে হতচকিত হয়ে যেন থেমে গেল।

প্রথমটা সে এতখানি বিচলিত ও বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল যে ব্যাপারটা যেন ভাল করে কোনো কিছু বুঝে উঠতেই পারে না। পরক্ষণেই নিজেকে নিজে সামলে নিয়ে কোমরবন্ধে লোডেড রিভলবারটা ডান হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে যেদিক থেকে গুলির আওয়াজ শোনা গিয়েছিল সেই দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল। কিছু দেখা যায় না বটে তবে শুকনো পাতার ওপরে একটা ঝটাপটির শব্দ শোনা যাচ্ছে।

সুব্রত রিভলভারটা মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে টটা জ্বালল এবং টর্চের আলো ফেলে সন্তর্পণে এগিয়ে গেল, শব্দটা যে দিক থেকে আসছিল সেই দিকে।

অল্প খুঁজতেই সুব্রত দেখলে একটা পলাশ গাছের তলায় কে একটা লোক রক্তাক্ত অবস্থায় ছটফট করছে।

সুব্রত লোকটার গায়ে আলো ফেললে। লোকটা একজন সাঁওতাল যুবক। লোকটার ডানদিকের পাঁজরে গুলি লেগেছে। তাজা লাল টকটকে রক্তে বনতলের মাটির অনেকটা সিক্ত হয়ে উঠেছে। লোকটার পাশেই একটা সাঁওতালী ধনুক ও কতকগুলো তীর পড়ে আছে। সুব্রত লোকটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। কিন্তু সাঁওতালটাকে চিনতে পারল না। লোকটা ততক্ষণে নিস্তেজ হয়ে প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। দু-একবার ক্ষীণ অস্ফুট স্বরে কী যেন বিড়বিড় করে বলতে বলতে হতভাগ্য শেষ নিঃশ্বাস নিল।

সুব্রত নেড়েচেড়ে দেখল, শেষ হয়ে গেছে।

একটা দীর্ঘশ্বাস সুব্রতর বুকখানাকে কাঁপিয়ে বের হয়ে গেল।

সে উঠে দাঁড়াল। টর্চের আলো ফেলে ফেলে আশেপাশের বন ও ঝোপঝাড় দেখলে, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না।

হতভাগা সাঁওতালটা বন্দুকের গুলি খেয়ে মরেছে এবং স্বকর্ণেসে বন্দুকের গুলির আওয়াজও শুনতে পেয়েছে।

কিন্তু কে মারলে? কেনই বা মারলে?

নানাবিধ প্রশ্ন সুব্রতর মাথার মধ্যে জট পাকাতে লাগল। কিন্তু এটা ঠিক, যে-ই মেরে থাক সে সশস্ত্র।

অন্ধকার বনপথে সুব্রতর কাছেলোডেড রিভলবার থাকলেও সে একা। তার উপর এখানকার পথঘাট তার তেমন ভাল চেনা নয়। অলক্ষ্যে বিপদ আসতে কতক্ষণ? আর বিপদ যদি আচমকা অন্ধকারে আশপাশ থেকে এসেই পড়ে তবে তাকে ঠেকানো যাবে না। অথচ এত বড় একটা দায়িত্ব মাথায় নিয়ে এমনি করে বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকাটাও সমীচীন নয়। অতএব এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সরে পড়া যায় ততই মঙ্গল।

সুব্রত সজাগ হয়ে উঠল। টর্চের আলো জ্বেলে সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিকেদেখতে দেখতে সে এগিয়ে চলল। কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার!

কেবলই একজনের পর একজন খুনই হচ্ছে! কারা এমনি করে নৃশংসভাবে মানুষের প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে?

কিসের প্রয়োজনেই বা এমনি ভয়ঙ্কর খেলা? কিন্তু পথ চলতে একটু আগে যে সোঁ করে শব্দটাকে সে কানের পাশে শুনেছিল সেটাই বা কিসের শব্দ?

কিসের শব্দ হতে পারে? নানারকম ভাবতে ভাবতে সুব্রত অন্ধকার শালবনের পধ ধরে যেন বেশ একটু দ্রুতপদেই অগ্রসর হতে থাকে।

রাত্রি কটা বেজেছে কে জানে! আসবার সময় তাড়াতাড়িতে হাতঘড়িটা পর্যন্ত আনতে মনে নেই। খানিকটা দ্রুত হেঁটে শালবন পেরিয়ে সুব্রত পাহাড়ী নদীটার ধারে এসে দাঁড়াল। মাথার উপরে আকাশের বুকে ক্ষীণ চাঁদের আলোয় যেন একটা সূক্ষ্ম রূপালি পর্দা থিরথির করে কাঁপছে। কোথাও কুয়াশার লেশমাত্র নেই। দূরে সাঁওতাল ধাওড়া থেকে একটানা একটা কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে।

শীতের পাহাড়ী নদী, একেবারে জল নেই বললেই হয়। অনেকটা পর্যন্ত শুধু বালি আর বালি। নদীটা হেঁটেই সুব্রত পার হয়ে গেল।

সামনেই একটা প্রান্তর। প্রান্তর অতিক্রম করে সুব্রত চলতে লাগল।

আনমনে চিন্তা করতে করতে কতটা পথ সুব্রত এগিয়ে এসেছে তা টের পায়নি, সহসা অদূরে আবছা চাঁদের আলোয় প্রান্তরের মাঝখানে দৃষ্টি পড়তেই সুব্রত থমকে দাঁড়িয়ে গেল।

এখানে আসবার পরের দিন সন্ধ্যার দিকে প্রান্তরের মাঝে বেড়াতে বেড়াতে যে ভয়ঙ্কর মৃর্তিটা দেখেছিল অবিকল সেই মূর্তিটাই যেন লম্বা লম্বা পা ফেলে ফেলে জনহীন মৃদু চন্দ্রালোকে প্রান্তরের ভিতর দিয়ে হেঁটে চলেছে।

সুব্রত ক্ষণেক দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবল, তারপরই কোমরের লেদার কেস থেকে অটোমেটিক রিভলবারটা বের করে অদূরের সেই চলমান মৃর্তিটাকে লক্ষ্য করে রিভলবারের ট্রিগার টিপল।

নির্জন প্রান্তরের অন্ধকারে একঝলক আগুনের শিখা উদগিরণ করে চারিদিকে ছড়িয়ে একটা আওয়াজ ওঠে—গুড়ুম!

সঙ্গে সঙ্গে প্রান্তরকে ভয়চকিত করে ক্ষুধিত শার্দুলের ভয়ঙ্কর ডাক শোনা গেল। পর পর তিনবার।

চমকে উঠতেই সুব্রত চকিতের জন্য চোখের পাতা দুটো বুজিয়ে ফেলেছিল; কিন্তু পরক্ষণেই

যখন চোখের পাতা খুলল, দেখল, দ্রুত হাওয়ার মতই সেই মূর্তি ক্রমে দূর থেকে দূরান্তরে মিলিয়ে যাচ্ছে।

মূর্তিটিকে যে জায়গায় দেখা গিয়েছিল সেই দিকে লক্ষ্য করে সুব্রত রিভলবারটা হাতে নিয়ে দৌড়ল।

আন্দাজমত জায়গায় এসে পৌঁছে সুব্রত টচটা জ্বেলে চারিদিকের মাটি ভাল করে লক্ষ্য করে দেখতে লাগল।

সহসা ও লক্ষ্য করলে, প্রান্তরের শুকনো মাটির ওপরে তাজা রক্তের কয়েকটা ফোঁটা ইতস্তত দেখা যাচ্ছে।

রক্ত! তাজা রক্তের ফোঁটা!

তাহলে সত্যিই ভূত নয়, দৈত্য দানব বা পিশাচ নয়! সামান্য রক্তমাংসের দেহধারী মানুষ। কিন্তু জখম হয়নি। সামান্য আঘাত লেগেছে মাত্র। কিন্তু পালাবে কোথায়?

এই যে মাটির ওপরে রক্তের ফোঁটা ফেলে গেল এইটাই তার নিশানা দেবে যেখানে যতদূর পালাক না কেন, হাওয়ায় উবে যেতে পারবে না।

একদিন না একদিন ধরা দিতেই হবে। কেননা আঘাত যত সমান্য হোক না কেন, আহত হয়েছে এ অবধারিত এবং সেইজন্যই বেশী দূর পালানো সম্ভব হবে না।

কিন্তু শার্দুলের ডাক! ব্যাপারটা কী? অবিকল শার্দুলের ডাক! সহসা সোঁ-সোঁ করে একটা তীক্ষ্ণ শব্দ সুব্রতর কানের পাশ দিয়ে যেন বিদ্যুতের মত চকিতে মিলিয়ে গেল।

সুব্রত চমকে উঠে একলাফে সরে দাঁড়াল। এবং সরে দাঁড়াতে গিয়েই পাশে অদূরে মাটি দিকে নজর পড়ল। একটা ছোট তীরের ফলা অর্ধেক মাটির বুকে প্রোথিত হয়ে থিরথির করে কাঁপছে।

সুব্রত নীচু হয়ে হাত দিয়ে তীরটা ধরে এক টান দিয়ে মাটির বুক থেকে তুলে নিল।

তীরের তীক্ষ্ণ চেপ্টা অগ্রভাগে মাটি জড়িয়ে গেছে। এতক্ষণে সুব্রত বুঝতে পারলে, একটু আগে শালবনের মধ্যে অতর্কিতে যে শব্দ শুনেছিল সেও একটা তীর ছোটারই শব্দ এবংসেই তীরটাও তাকে মারবার জন্যই নিক্ষিপ্ত হয়েছিল বুঝতে আর কষ্ট হয় না।

শত্রুপক্ষ তাহলে সুব্রতর ওপরে বিশেষ নজর রেখেছে এবং তাকে মারবার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে! তীরটা হাতে নিয়ে সুব্রত সটান বাংলোর দিকে পা চালিয়ে দিল।

সুব্রত এসে বাংলোয় যখন প্রবেশ করল, শঙ্কর তখন ঘরে টেবিলের ওপরে একরাশ কাগজপত্র ছড়িয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কী যেন দেখছে।

শঙ্করবাবু! সুব্রত ঘরের মধ্যে পা দিয়ে ডাকল।

কে? ও, সুব্রতবাবু! এত রাত করে কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?

একটু বেড়াতে গিয়েছিলাম ঐ নদীর দিকটায়।

সামনেই একটা বেতের চেয়ারে বসে পড়ে সুব্রত পা দুটো টান করতে করতে বললে।

এতক্ষণ এই অন্ধকারে সেখানেই ছিলেন?

হ্যাঁ।

কথাটা বলে সুব্রত হাতের তীরটা টেবিল-ল্যাম্পের অত্যুজ্জ্বল আলোর সামনে উঁচু করে  তুলে তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে পরীক্ষা করতে লাগল।

সুব্রতর হাতে তীরটা দেখে শঙ্কর সবিস্ময়ে বললে, ওটা আবার কী? কোথায় পেলেন?

সুব্রত তীরটা গভীর মনোযোগের সঙ্গে পরীক্ষা করতে করতেই মৃদু স্বরে জবাব দিল, মাঠের মধ্যে কুড়িয়ে।

মাঠের মধ্যে কুড়িয়ে তীর পেলেন! তার মানে?

শঙ্কর বিস্মিত স্বরে প্রশ্ন করল।

মানে আবার কী? কেন, মাঠের মধ্যে একটা তীর কুড়িয়ে পেতে নেই নাকি?

শঙ্কর এবারে হেসে ফেললে, তা তো আমি বলছি না, আসল ব্যাপারটা কী তাই জিজ্ঞাসা করলাম।

আমার কী মনে হয় জানেন? সুব্রত বললে শঙ্করের মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ।

কী?

এই তীরের ফলায় নিশ্চয়ই কোনো তীব্র বিষ মাখানো আছে এবং সে বিষ সাধারণ কোনো সুস্থ মানুষের শরীরের রক্তে প্রবেশ করলে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মৃত্যু অবধারিত।

কি বলছেন সুব্রতবাবু?

শঙ্কর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সুব্রতর মুখের দিকে তাকাল।

মনে হওয়ার কারণ আছে শঙ্করবাবু। সুব্রত গম্ভীর স্বরে বললে।

বুঝতে পারছি না ঠিক আপনার কথা সুব্রতবাবু!

কোনো এক হতভাগ্যের উদ্দেশ্যে এই বিষাক্ত তীর নিক্ষেপ করে তার জীবনের ওপরে attempt করা হয়েছিল।

সর্বনাশ! বলেন কী?

হ্যাঁ। কিন্তু তার আগে, অর্থাৎ বিস্তারিত ভাবে আপনাকে সব কিছু বলবার আগে এক কাপ চা। দীর্ঘ পথ হেঁটে গলাটা শুকিয়ে গেছে।

O Surely! এখুনি। বলতে বলতে শঙ্কর সামনের টেবিলের ওপরে রক্ষিত কলিং বেল টিপল।

ভৃত্য এসে খোলা দরজার ওপরে দাঁড়াল।—সাহেব আমাকে ডাকছেন?

এই, শীগগির সুব্রতবাবুকে এক কাপ গরম চা এনে দে!

আনছি সাহেব। ভৃত্য চলে গেল।

ভৃত্যকে চায়ের আদেশ দিয়ে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে শঙ্কর দেখলে, চেয়ারের ওপরে হেলান দিয়ে চোখ বুজে সুব্রত গভীর চিন্তামগ্ন হয়ে পড়েছে।