০৯. আঁধার রাতের পাগল

আঁধার রাতের পাগল

সুব্রত শঙ্করবাবুর সঙ্গে গোপন পরামর্শ করে অলক্ষ্যে চানকের ওপরে দুজন সাঁওতালকে সর্বক্ষণ পাহারা দেবার জন্য নিযুক্ত করল।

বিকেলের দিকে সুধাময়বাবুর সেক্রেটারী কলকাতা থেকে তার করে জবাব দিলেন: কর্তা বর্তমানে কলকাতায় নেই। তিনি যা ভাল বোঝেন তাই করুন। কর্তা কলকাতায় ফিরে এলেই তাঁকে সংবাদ দেওয়া হবে। তবে কতার হুকুম আছে, কোন কারণেই যেন, যত গুরুতরই হোক, খনির কাজ না বন্ধ রাখা হয়।

রাতে শঙ্কর সুব্রতকে জিজ্ঞাসা করল, কী করা যায় বলুন, সুব্রতবাবু? কাল থেকে তাহলে আবার খনির কাজ শুরু করে দিই?

হ্যাঁ, দিন। দু-চারদিনের মধ্যে আমার তো মনে হয় আর খুনটুন হবে না।

শঙ্কর হাসতে হাসতে বললে, আপনি শুনতে পারেন নাকি সুব্রতবাবু?

না, গুনতে-ফুনতে জানি না মশাই। তবে চারদিককার হাবভাব দেখে যা মনে হচ্ছে তাই বলছি মাত্র। বলতে পারেন স্রেফ অনুমান।

যাহোক, শঙ্কর খনির কাজ আবার পরদিন থেকে শুরু করাই ঠিক করলে এবং বিমলবাবুকে ডেকে যাতে আগামীকাল ঠিক সময় থেকেই নিত্যকার মত খনির কাজ শুরু হয় সেই আদেশ দিয়ে দিল।

বিমলবাবু কাঁচুমাচু ভাবে বললে, আবার ঐ ভূতপ্রেতগুলোকে চটাবেন স্যার! আমি আপনার most obedient servent, যা order দেবেন—with life তাই করব। তবে আমার মতে এ খনির কাজ চিরদিনের মত একেবারে বন্ধ করে দেওয়াই কিন্তু ভাল ছিল স্যার।

ভূতপ্রেতের ব্যাপার! কখন কি ঘটে যায়!

শঙ্কর হাসতে হাসতে উত্তর দিল, ভূতেরও ওঝা আছে বিমলবাবু। অতএব মা ভৈষী। এখন যান, সব ব্যবস্থা করুন গে, যাতে কাল থেকে আবার কাজ শুরু হতে পারে।

কিন্তু স্যার—

যান যান, রাত হয়েছে। সারারাত কাল ঘুমুতে পারিনি।

বেশ। তবে তাই হবে। আমার আর কি বলুন? আমি আপনাদের most obedient and humble servent বইতো নয়!

বিমলবাবু চলে গেলেন।

বাইরে শীতের সন্ধ্যা আসন্ন হয়ে এসেছে। সুব্রত কোমরে রিভালবারটা খুঁজে গায়ে একটা কালো রংয়ের ফারের ওভারকোট চাপিয়ে পকেটে একটা টর্চ নিয়ে বাংলোর বাইরে এসে দাঁড়াল।

পায়ে-চলা লাল সুরকির রাস্তাটা কয়লা-তঁড়োয় কালচে হয়ে ধাওড়ার দিক বরাবর চলে গেছে।

সুব্রত এগিয়ে চলে। পথের দুপাশে অন্ধকারের মধ্যে বড় বড় শাল ও মহুয়ার গাছগুলো প্রেতমূর্তির মত নিঝুম হয়ে যেন শিকারের আশায় দাঁড়িয়ে আছে। পাতায় পাতায় জোনাকির আলল, জ্বলে আর নেভে, নেভে আর জ্বলে। গাছের পাতা দুলিয়ে দূর প্রান্তর থেকে শীতের হিমেল হাওয়া হিলহিল করে বয়ে যায়।

সর্বাঙ্গ সিরসির করে ওঠে।

কোথায় একটা কুকুর শীতের রাত্রির স্তব্ধতা ছিন্নভিন্ন করে মাঝে মাঝে ডেকে ওঠে।

সুব্রত এগিয়ে চলে।

অদূরে পাঁচ নম্বর কুলি-ধাওড়ার সামনে সাঁওতাল পুরুষ ও রমণীরা একটা কয়লার অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে চারিদিকে গোলাকার হয়ে ঘিরে বসে কী সব শলা-পরামর্শ করছে। আগুনের লাল আভা সাঁওতাল পুরুষগুলোর খোদাই করা কালো পাথরের মত দেহের ওপর প্রতিফলিত হয়ে দানবীয় বিভীষিকায় যেন রূপায়িত হয়ে উঠেছে।

তারও ওদিকে একটা বহু পুরাতন নীলকুঠির ভগ্নাবশেষ শীতের ধূম্রাচ্ছন্ন অন্ধকারে কেমন ভৌতিক ছায়ার মতই অস্পষ্ট মনে হয়।

চারিদিকে বোয়ান গাছের জঙ্গল, তারই পাশ দিয়ে শীর্ণকায় একটি পাহাড়ী ক্ষুদ্র নদী, আর শুষ্কপ্রায় শুভ্র বালুরাশির উপর দিয়ে একটুখানি নির্মল জলপ্রবাহ শীতের অন্ধকার রাতে এঁকেবেঁকে আপন খেয়াল-খুশিতে অদূরবর্তী পলাশবনের ভিতর দিয়ে ঝিরঝির করে কোথায় বয়ে চলেছে কে জানে!

পলাশবনের উত্তর দিকে ছয় ও সাত নম্বর কুলি-ধাওড়া। সেখান থেকে মাদল ও বাঁশির আওয়াজ শোনা যায়।

সহসা অদূরবর্তী মহুয়া গাছগুলির তলায় ঝরাপাতার ওপরে একটা যেন সজাগ সতর্ক পায়ে চলার খস শব্দ পেয়ে সুব্রত থমকে দাঁড়িয়ে গেল।

বুকের ভিতরকার হৃৎপিণ্ডটা যেন সহসা প্রবল এক ধাক্কা খেয়ে থমকে থেমে গেল। পকেটে হাত দিয়ে সুব্রত টটা টেনে বের করল। যে দিক থেকে শব্দটা আসছিল ফস করে সেই দিকে আলোটা ধরেই বোম টিপে দিল।

অন্ধকারের বুকে টর্চের উজ্জ্বল আলোর রক্তিম আভা মুহূর্তে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে অট্টহাসি হেসে ওঠে।

কিন্তু ওকে? অন্ধকারেপলাশ গাছগুলোর তলায় বসে অন্ধকারে কী যেন গভীর মনেযোগের সঙ্গে খুঁজছে।

আশ্চর্য!

এই অন্ধকারে, পলাশবনের মধ্যে অমন করে লোকটা কি খুঁজছে?

সুব্রত এগিয়ে গেল।

লোকটা বোধ করি পাগল হবে।

একমাথা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া এলোমেলো বিশ্বস্ত জট-পাকানো চুল। মুখ ধুলোবালিতে ময়লা হয়ে গেছে এবং মুখে বিশ্রী দাড়ি। গায়ে একটা বহু পুরাতন ওভারকোট; শতছিন্ন ও শত জায়গায় তালি দেওয়া। পিঠে একটা নেকড়ার ঝুলি, পরনেও একটা মলিন লংস।

সুব্রত টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে লোকটার দিকে এগিয়ে যায়।

এই, তুই কে রে? সুব্রত জিজ্ঞাসা করে।

কিন্তু লোকটা কোন জবাবই দেয় না সুব্রতর কথায়, শুকনো ঝরে-পড়া শালপাতাগুলো একটা ছোট লাঠির সাহায্যে সরাতে সরাতে কী যেন আপন মনে খুঁজে বেড়ায়।

এই, তুই কে?

সুব্রত টর্চের আলোটা লোকটার মুখের উপর ফেলে। সহসা লোকটা চোখ দুটো বুজিয়ে চকে দুপাটি দাঁত বের করে হি হি করে হাসতে শুরু করল।

লোকটা কেবল হাসে।

হাসি আর যেন থামতেই চায় না। হাসছে তো হাসছেই। সুব্রতও সেই হাসিভরা মুখটার ওপরে আলো ফেলে দাঁড়িয়ে থাকে নিতান্ত বোকার মতই চুপ করে!

সুব্রত আলোটা নিভিয়ে দিল।

সহসা লোকটা ভাঙা গলায় বলে ওঠে, তু কি চাস বটে রে বাবু!

সুব্রত বোঝে লোকটা সাঁওতাল, বোধ হয় পাগল হয়ে গেছে।

তোর নাম কি? কোথায় থাকিস?

আমার নাম রাজা বটে!…থাকি উই—যেথা মারাংবরু রঁইছে।

এখানে এই অন্ধকারে কি করছিস?

তারে তুর দরকারটা কী? যা ভাগ!

সুব্রত দেখলে সরে পড়াই ভাল। পাগল। বলা তো যায় না! সুব্রত সেখান থেকে চলে এল।

পলাশবন ছাড়লেই ৬নং কুলির ধাওড়া।

রতন মাঝি সেখানেই থাকে। পলাশ ও শাল বনের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় কুলি-ধাওড়ার সামনে প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের লাল রক্ত আভাস।

মাদলের শব্দ কানে এসে বাজে, ধিতাং ধিতাং!

সঙ্গে সঙ্গে বাঁশিতে সাঁওতালী সুর।

সারাদিন খাদে ছুটি গেছে, সব আনন্দে উৎসবে মত্ত হয়ে উঠেছে।

ধাওড়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই একটা কালো কুকুর ঘেউ-উ-উ করে ডাকতে ডাকতে তেড়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি সাঁওতাল যুবক এগিয়ে এল, কে বটে রে? আঁধারে ঠাওর করতে পারছি। রা করিস না কেনে?

রতন মাঝি আছে? সুব্রত কথা বলে।

আরে, বাবু! ও পিন্টু, বাবুকে বসবার দে। বসেন আইজ্ঞা। রতন মাঝি সুব্রতর সামনে এগিয়ে আসে।

আধো আলো আধো আঁধারে মাঝির পেশল কালো দেহটা একটা যেন প্রেতের মতই মনে হয়।

কিছু সংবাদ আছে মাঝি?

না বাবু। সারাটি দিনমানই রইলাম বটে।

সুব্রত আরও কিছুক্ষণ রতন মাঝির সঙ্গে দু-চারটে আবশ্যকীয় কথা বলে ফিরল।