০৬. খাদে রহস্যময় মৃত্যু

খাদে রহস্যময় মৃত্যু

বাকি রাতটুকু সুব্রতর চোখে আর ঘুম এল না। সে আবার অর্ধসমাপ্ত চিঠিখানা নিয়ে বসল।

কিরীটী, চিঠিটা তো শেষ করেই রেখেছিলাম, কিন্তু সেই রাত্রেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। ঘটনাটা তোকে না লিখে পারলাম না। কুলী-ধাওড়ায় ঝন্টু নামে এক সাঁওতাল যুবক রাত্রে খুন হয়েছে। বিমলবাবু প্রমাণ করতে চান, ব্যাপারটা আগাগোড়াই ভৌতিক। অর্থাৎ ভূতের কাণ্ড। তবে মৃতের গলার পিছনদিকে আগের মতই চারটি ভয়ঙ্কর কালো ছিদ্র আছে দেখলাম। আমার কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা যেন খুবই সহজ। জলের মতই সহজ।…তোর চিঠির প্রত্যুত্তরের আশায় রইলাম। চিঠি পেলেই ভাবছি শ্রীমানকে পুলিসের হাতে তুলে দেব। কেননা ওই ধরনের শয়তান খুনীদের এমন সহজভাবে দশজনের সঙ্গে চলে-ফিরে বেড়াতে দেওয়া কি যুক্তিসঙ্গত? আমার যতদূর মনে হয়, আর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই ব্যাপারটার একটা সহজ মীমাংসা করে দিতে পারব। তোর উপস্থিতির বোধ হয় আর প্রয়োজন হবে না। আজ এই পর্যন্ত। ভালবাসা রইল। তোর সুব্রত।

চিঠিটা শেষ করে সুব্রত চেয়ার থেকে উঠে একটা আড়ামোড়া ভাঙল।

রাতের আকাশের বিদায়ী আঁধার দিগ্বলয়ের প্রান্তকে তখন ফিকে করে তুলেছে।

সুব্রত বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল।

শীতের হাওয়া ঝিরঝির করে সুব্রতর শ্রান্ত ও ক্লান্ত দেহমনকে যেন জুড়িয়ে দিয়ে গেল।

ঘুমোননি বুঝি সুব্রতবাবু!

শঙ্করের গলার স্বর শুনে সুব্রত ফিরে দাঁড়াল।

এই যে আপনিও উঠে পড়েছেন দেখছি। ঘুমোতে পারলেন না বুঝি?

না, ঘুম এল না। কিন্তু গতরাত্রের ব্যাপারটা সম্পর্কে আপনার কি মনে হয় সুব্রতবাবু?

দেখুন শঙ্করবাবু, ব্যাপারটা যে খুব কঠিন বা জটিল তা কিছু নয়, তবে এটা ঠিক যে, এর আগে যে-সব খুন এখানে হয়েছে তার সমস্ত রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত কোন স্থির সিদ্ধান্তে চট করে উপনীত হতে পারছি না। যতদূর মনে হয় এর পিছনে একটা দল আছে, অর্থাৎ একদল শয়তান এই ভয়ঙ্কর খুনখারাপি করে বেড়াচ্ছে।

বলেন কি?

হ্যাঁ, তাই। একজন লোকের ক্ষমতা নেই এত tactfully এতগুলো লোকের মধ্যে থেকে এমন পরিষ্কার ভাবে খুন করে গা-ঢাকা দিয়ে থাকে।

.

হাত-মুখ ধুয়ে চা পান করতে করতে শঙ্কর আর সুব্রত গতরাত্রের ঘটনারই আলোচনা করছিল, এমন সময় একটা কুলী ছুটতে ছুটতে এসে হাজির, বাবু গো, সর্বনাশ হয়েছে!

কি হয়েছে?

তের নম্বর কাঁথিতে পিলার ধসে গিয়ে কাল রাত্রে দশজন সাঁওতাল কুলী মারা গেছে।

শঙ্কর চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল।

সর্বনাশ! এক রাত্রে দশ-দশটা লোকের একসঙ্গে মৃত্যু! কিন্তু রাত্রে তো এ মাইনে কাজ চালাবার কথা নয়? তবে—তবে কেমন করে এ দুর্ঘটনা ঘটল?

রেজিৎবাবু কোথায় রে টুইলা? শঙ্কর কুলীটাকে প্রশ্ন করল।

রেজিংবাবু তো ওধারপানেই আসতেছে দেখলুম বাবু। দেখা গেল সামনের অপ্রশস্ত কাঁচা কয়লার গুঁড়ো ছড়ানো রাস্তাটা ধরে একপ্রকার দৌড়তে দৌড়তে রামলোচন পোদ্দার আসছে। রামলোচনবাবু এসে শঙ্করের সামনে দাঁড়িয়ে নমস্কার করল। মোটাসোটা চর্বিবহুল নাদুসনুদুস চেহারাখানি, পরনে খাকি হাফ প্যান্ট ও খাকি হাফ শার্ট। ঠোঁটের ওপরে বেশ একজোড়া পাকানো গোঁফ। মাথায় সুবিস্তীর্ণ টাক চক্ করে। বয়েস বোধ করি চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের মধ্যে।

এ কি শুনছি রামলোচনবাবু?

সর্বনাশ হয়ে গেছে, ঠিকই শুনেছেন স্যার–একেবারে সর্বনাশ হয়ে গেছে। এই খনি বুঝি আর চালানো গেল না!

সব খুলে বলুন।

কাল রাত্রে ১৩নং কাঁথিতে পিলার ধসে গিয়ে দশজন কুলী চাপা পড়ে মারা গেছে!

কাল রাত্রে মানে? অর্থাৎ আপনি বলতে চান রাত্রিতে কাল কয়লাখনিতে কাজ হচ্ছিল?

আজ্ঞে না।

আজ্ঞে না! তার মানে? এই তো বললেন কাল রাত্রে ১৩নং কাঁথিতে দশজন মারা গেছে!

আজ্ঞে তা তো গেছেই–

খনিতে কয়লা কাটার কাজ না থাকলে কেন তারা সেখানে গিয়েছিল? নিশ্চয়ই খনির মধ্যে লুকোচুরি খেলতে নয়? এ খনির নিয়ম কি? পাঁচটার মধ্যে খনির সমস্ত কাজ বন্ধ হয়ে যায় তো? রাত্রে কোন কাজ হয় না?

আজ্ঞে!

তবে তারা রাত্রে খনির মধ্যে কি করে গেল? চানক সন্ধ্যা পাঁচটার পর খাদে লোক নামায় না তো!

না, তা নামায় না। এবং রাত্রি সাতটা পর্যন্ত চানক ভোলা থাকে খাদের লোক শুধু ওঠাবার জন্য।

এমনও তো হতে পারে শঙ্করবাবু, সেই দশটি লোক গত রাত্রে খাদ থেকে মোটে ওঠেইনি, খাদেই ছিল? হঠাৎ সুব্রত বলে।

Impossible! খনির কুলিদের নামের একটা লিস্ট আছে। খাদে যারা নামে ও কাজশেষে খাদ থেকে উঠে আসে, নামের Registry-র সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া হয় তাদের নাম। এতে ভুলচুক হওয়া সম্ভব নয় সুব্রতবাবু!

কিন্তু আগে সব কিছুর খোঁজ নেওয়া দরকার শঙ্করবাবু। চলুন দেখা যাক খোঁজ নিয়ে আসলে ব্যাপারটা কি?

বেশ, চলুন।

তখনি দুজন রামলোচন ও টুইলাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

পথ চলতে চলতে সুব্রত শঙ্করকে জিজ্ঞাসা করল, নামের রেজিস্ট্রি খাতা কার কাছে থাকে শঙ্করবাবু?

সরকারবাবু—আমাদের বিমলবাবুর কাছে থাকে।

তিনি তো নাম মিলিয়ে নেন?

হ্যাঁ।

তবে আগে চলুন বিমলবাবুর খোঁজটা নেওয়া যাক, তিনি হয়তো এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে পারবেন।

চলুন।

শীতের সকাল। পথের দুপাশের কচি দূর্বাদলগুলির গায়ে রাতের শিশিরবিন্দুগুলি সূর্যের আলোয় ঝিলমিল করছে।

কিছুদূর এগিয়ে যেতেই খনির সীমানা পড়ে। ট্রাম-লাইনের পাশে একটা শূন্য কয়লা গাড়ির চারদিকে একদল সাঁওতাল জটলা পাকাচ্ছে, সকলেরই মুখে একটা ভয়চকিত ভাব।

শঙ্করকে আসতে দেখে দলের মধ্যে একটা মৃদু গুনগুন ধ্বনি জেগে উঠল।

কুলীদের সর্দার রতন মাঝি এগিয়ে এল।

কি খবর মাঝি? কিছু বলবি?

আমরা আর ইখানে কাম করতে পারব বাবু!

কেন রে?

ই খনিতে ভূত আছে, বাবু।

ভূত? ওসব বাজে কথা, তাছাড়া কার ছেড়ে দিলে খাবি কি?

কিন্তক তুরাই বল কেনে বাবু, প্রাণটি হাতে নিয়ে এমনি করে কেমনে কাজ করি—

চন্দন সিং ও বিমলবাবু এসে হাজির হলেন।

এই যে বিমলবাবু, কাল রেজিস্ট্রি খাতা আপনি মিলিয়েছেন তো? শঙ্কর প্রশ্ন করল।

আজ্ঞে হ্যাঁ।

সকলে খাদ থেকে উঠে এসেছিল working hours-এর পরে–মানে যারা কাল দিনের বেলায় কয়লা কাটতে খাদে নেমেছিল, তারা সকলে আবার খাদ থেকে ফিরে এসেছিল তো?

তা এসেছিল বৈকি।

তবে এই রকম দুর্ঘটনা ঘটল কি করে? সব শুনেছেন নিশ্চয়ই? চানক যে চালায় সে লোকটা কোথায়?

কে, আবদুল?

হ্যাঁ।

সে চানকের মেসিনের কাজেই আছে।

তাকে একবার ডেকে আনুন।

বিমলবাবু আবদুল ডাকতে চলে গেলেন।

রতন মাঝি আবার এগিয়ে এল, বাবু, আমরা কুলীকামিনরা আজ চলে যাবে রে!

তোদের কোন ভয় নেই। দুটো দিন সবুর কর, আমি সব ঠিক করে দেব। ভূতটুত ওসব যে একদম বাজে কথা, এ আমি ধরে দেব। যা তোরা যে যার কাজে যা!

কিন্তু দেখ গেল শঙ্করের আশ্বাসবাক্যেও কেউ কাজে যাবার কোন গরজই দেখাচ্ছে না।

তু কি বলছিস বাবু, আমি বোঙার নামে কিরা কেটে বলতে পারি এ খনিতে ভূত আছে!

এমন সময় বিমলবাবু আবদুল মিস্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলেন।

আবদুলকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, গত সন্ধ্যায় সে যথারীতি আটটার মধ্যেই চানক বন্ধ করে চলে গিয়েছিল এবং সে যতদূর জানে খাদে আর কেউ তখন ছিল না।

চানকের এঞ্জিনে চাবি দেওয়া থাকে না মিস্ত্রী?

জিজ্ঞাসা করল সুব্রত।

হ্যাঁ, সাবু।

চাবি কার কাছে থাকে?

আজ্ঞে আমার কাছেই তো।

আচ্ছা আজ সকালে চানকের এঞ্জিনের কাছে গিয়ে এঞ্জিনে চাবি দেওয়াই দেখতে পেয়েছিলে তো?

হ্যাঁ, সাব।

চলুন শঙ্করবাবু, খাদের যে কাঁথিতে পিলার ধসে গেছে সে জায়গাটা একবার ঘুরে দেখে আসি।

বেশ, চলুন। আসুন বিমলবাবু, চল চন্দন সিং।

তখন সকলে মিলে খাদের দিকে রওনা হল।