০৫. আবার ভয়ঙ্কর চারিটি ছিদ্র

আবার ভয়ঙ্কর চারিটি ছিদ্র

সকলেই নির্বাক। কারও মুখে কোন কথা নেই। শুধু রাতের স্তব্ধ মৌনতার বুকে জেগে উঠেছে কতকগুলো ভয়ার্ত লোকের একটানা গোলমালের এলোমেলো একটা ক্রমবর্ধমান শব্দের রেশ।

সহসা সুব্রত কথা বললে, আপনার কোয়াটারটা কোথায় বিমলবাবু?

কেন, এখানেই তো থাকি!

এখানেই মানে? কোথায়? মানে লোকেশানটা চাচ্ছি!

কুলিদের ধাওড়ার লাগোয়া। আমি আর রেজিংবাবু একই ঘরে থাকি।

আপনার রেজিংবাবুর নাম কি?

রামলোচন পোদ্দার।

তিনি কোথায়?

তিনি ধাওড়ার দিকে গেছেন।

গোলমাল শোনবার আগে ঘুমোচ্ছিলেন বুঝি?

না। রামলোচনবাবু ঘুমোচ্ছিলেন, আমি জেগে বসে হিসাবপত্র দেখছিলাম।

কথা বলতে বলতে ততক্ষণ তারা কোফিল্ডের কাছাকাছি এসে পড়েছে। অদূরে অন্ধকারে অস্পষ্টভাবে চানকের উপরের চাকাটা দেখা যাচ্ছে।

চারিদিকে একটা থমথমে ভাব এবং সেই থমথমে প্রকৃতির বুকে একটা অস্পষ্ট গোলমালের সুর, কেমন যেন ভৌতিক বলে মনে হয়।

ধাওড়ায় তখন সাঁওতাল পুরুষ ও কামিন সকলেই প্রায় একজায়গায় ভিড় করে মৃদু গুঞ্জনে জটলা পাকাচ্ছে। শঙ্করকে দেখে সকলে ভিড় ছেড়ে সরে দাঁড়াতে লাগল।

একটা ঘরের দরজার সামনে সকলে এসে দাঁড়াল।

একটি বলিষ্ঠ চব্বিশ-পঁচিশ বছরের সাঁওতাল যুবক চিৎ হয়ে পড়ে আছে।

সামনেই একটা কেরোসিনের ল্যাম্প দপদপ করে জ্বলছে প্রচুর ধূম উদগিরণ করে।

প্রদীপের লাল আলোর মলিন আভা মৃত সাঁওতাল যুবকের মুখের উপরে প্রতিফলিত হয়ে মৃতের মুখখানাকে যেন আরও বিভীস, আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে।

মাথাভর্তি ঝাঁকড়া কালো চুলগুলো এলোমেলো। গোল গোল বড় বড় চোখের মণি দুটো যেন চক্ষুকোটর থেকে ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। জিভটা খানিকটা বের হয়ে এসেছে মুখ-বিবর থেকে। সমগ্র মুখখানি ব্যেপে একটা ভয়াবহ বিভীষিকা ফুটে উঠেছে।

সুব্রত মৃতের মুখের ওপরে শক্তিশালী টর্চের উজ্জ্বল আলো ফেলল।

অত্যুজ্জ্বল আলোয় মৃত ব্যক্তির গলার দিকে নজর পড়তেই সুব্রত চমকে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি প্রখর করে দেখতে লাগল।

গলার দুপাশে আঙুলের দাগ যেন চেপে বসে গেছে।

নাকের নীচে হাত দিয়ে দেখলে, কোথাও আর শ্বাসপ্রশ্বাসের লেশমাত্র নেই।

অনেকক্ষণ মারা গেছে। হিমকঠিন অসাড়।

টর্চের আলোয় মৃতদেহটাকে সুব্রত ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে দেখল। মৃতদেহটিকে উপুড় করে দিতেই ও লক্ষ্য করল রক্তে কালো কালো চারটি ছিদ্র ঘাড়ের দিকে যেন কি এক বিভীষিকায় ফুটে উঠেছে। মনে হয় যেন কোন তীক্ষ্ণ ধারাল অস্ত্রের অগ্রভাগ দিয়ে পাশাপাশি পর পর চারটি ছিদ্র করা হয়েছে।

শঙ্কর প্রশ্ন করলে, কী দেখছেন সুব্রতবাবু? উঠে আসুন!

সুব্রত টর্চটা নিভিয়ে দিল, হ্যাঁ, চলুন। কী ভয়ঙ্কর যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু!

সকলে বাইরে এসে দাঁড়াল।

শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশে ক্ষীণ চাঁদের এক টুকরো জেগে উঠেছে, যেন বাঁকানো ছোরা একখানি। সহসা কে এক নারী আলুলায়িতা কুন্তলা, পাগলিনীর মতই শঙ্করবাবুর পায়ের উপরে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল, বাবু রে, হামার কি হল রে–

সকলে চমকে উঠল।

একজন বৃদ্ধগোছের সাঁওতাল এগিয়ে এল, ও সোহাগী। কী করবি বল্—

কে এই মেয়েটি বিমলবাবু? শঙ্করবাবু প্রশ্ন করলেন।

ঝন্টুর স্ত্রী, বাবু। সোহাগী।

কে ঝন্টু?

যে লোকটা মারা গেছে।

তুই এখন যা সোহাগী। তোর একটা ব্যবস্থা করে দিব রে। শঙ্কর বলে। সান্তনা দেয়।

ঝন্টুকে ছেড়ে আমি থাকতে লারব বাবু গো। ঝন্টুকে তুই আমায় ফিরায়ে দে বাবু।

কেঁদে আর কি করবি বল্! যা ঘরে হ্যাঁ।

না, না। ঘরকে আমি যাব না রে। ঘর আমার আঁধার হয়ে গেল। ঝন্টু আমার নাই রে। ওরে ঝন্টু রে!

চুপ কর, সোহাগী, চুপ ক।

সহসা বিমলবাবু প্রচণ্ড বেগে ধমক দিয়ে উঠলেন, এই মাগী, থাম! ভূতে তোর স্বামীকে খুন করেছে, তার ম্যানেজারবাবু কি করবে? যা ওঠ ওঠ! যত সব নচ্ছার বদমায়েস এসে জুটেছে। যা ভাগ যা! অন্ধকার রাতে আনমনে পথ চলতে চলতে সহসা একটা তীব্র আলোর ঝাপটা মুখে এসে পড়লে পথিক যেমন ক্ষণেকের জন্য বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, সোহাগীও তেমনি সহসা যেন তার সকল শোক ভুলে মুহূর্তের জন্য মৌন বাক্যহারা হয়ে ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে বিমলবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল এবং পায়ে পায়ে পিছন হেঁটে সরে যেতে লাগল।

চলুন ম্যানেজারবাবু, ওদিকে রাত প্রায় শেষ হয়ে এল। পুলিসে খবর দিতে হবে, লাশ ময়নাতদন্তে যাবে। যত সব হাঙ্গামা! পোষাবে না বাপু এখানে আর আমার চাকরি করা। ভূতের আড্ডা! কে জানে কবে হয়ত আবার আমার ওপরেই চড়াও হবে! বাপ মা ছেলেপিলে ছেড়ে এই বিদেশ-বিভুঁয়ে প্রাণটা শেষে কি খোয়াব?

চলুন শঙ্করবাবু, কোয়াটারে ফেরা যাক। সুব্রত বলে।

সকলে কুলী-ধাওড়া ছেড়ে কোয়ার্টারের দিকে পা বাড়াল। সকলেই নীরবে পথ অতিবাহিত করে চলেছে, কারও মুখে কোন কথা নেই।

পথ চলতে চলতে একসময় বিমলবাবু বলল, বলছিলাম না, এই কোলফিল্ডটা একটা পরিপূর্ণ অভিশাপ! এখানে কারও মঙ্গল নেই। কিন্তু এবারে দেখছি আপনি স্যার বেঁচে গেলেন। এর আগের বারের আক্রোশগুলো ম্যানেজারবাবুদের ওপর দিয়েই গেছে এবং আগেকার ঘটনা অনুযায়ী বিপদটা আপনার ঘাড়েই আসা উচিত ছিল। তা যাক, ভলই হল এক দিক দিয়ে।

তার মানে? সহসা সুব্রত প্রশ্ন করে বসল।

বিমলবাবু যেন সুব্রতর প্রশ্নে একটু থতমত খেয়ে যায়, কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, মানে—মানে আর কি! ওই কুলীগুলোর জীবনের আর কী দাম আছে বলুন? ওদের দু-দশটা মরলে কী এসে গেল!

সহসা স্তব্ধ রাতের মৌনতাকে ছিন্নভিন্ন করে সোহাগীর করুণ কান্নার আকুল রেশ কানে এসে বাজল সবার। ঝন্টু রে—তু ফিরে আয় রে! ওরে আমার ঝন্টু রে!

সুব্রতর পায়ের গতিটুকু যেন সহসা লোহার মত ভারী হয়ে অনড় হয়ে গেল। বিমলবাবুর দিকে ফিরে শ্লেষমাখা সুরে সে বলল, তা যা বলেছেন বিমলবাবু! দুনিয়ার আবর্জনা ওই গরীবগুলো। যাদের মরণ ছাড়া আর গতি নেই, এ সংসারে তারা মরবে বৈকি!

নিশ্চয়ই। আপনিই বলুন না, ওই জংলীগুলোর প্রাণের দাম কি-ই বা আছে? বিমল বলে ওঠে।