০৪. আঁধারে বাঘের ডাক

আঁধারে বাঘের ডাক

কী দেখেছেন?

ভূত! চন্দনবাবুর ভূত! সুব্রত একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললে। তারপর চন্দন সিংয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি বুঝি আমাদের শঙ্করবাবুর অ্যাসিটেন্ট?

চন্দন সিং সম্মতিসূচক ভাবে ঘাড় হেলাল।

এখানকার ঠিকাদার কে, চন্দনবাবু?

ছট্টু লাল।

তার সঙ্গে একটিবার আলাপ করতে চাই। কাল একটিবার দয়া করে যদি পাঠিয়ে দেন তাকে সন্ধ্যার দিকে!

দেব, নিশ্চয়ই দেব।

আচ্ছা চন্দনবাবু, আপনাকে কটা কথা যদি জিজ্ঞাসা করি, আপনি নিশ্চয়ই অসন্তুষ্ট হবেন না?

সে কি কথা! নিশ্চয়ই না। বলুন কি কথা?

আমি শঙ্করবাবুর বন্ধু। এখানে বেড়াতে এসেছি, জানেন তো?

জানি।

কিন্তু এখানে পৌঁছে ওঁর আগেকার ম্যানেজারের সম্পর্কে যে কথা শুনলাম, তাতে বেশ ভয়ই হয়েছে আমার।

নিশ্চয়ই, এ তো স্বাভাবিক। আমি ওঁকে বলছিলাম এখানকার কাজে ইস্তফা দিতে। আমার মনে হয় ওঁর পক্ষে এ জায়গাটা তেমন নিরাপদ নয়।

আমারও তাই মত। সুব্রত চিন্তিতভাবে বললে।

কি বলছেন সুব্রতবাবু?

হ্যাঁ—ঠিকই বলছি—

কিন্তু স্রেফ একটা গাঁজাখুরি কথার ওপরে ভিত্তি করে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার মধ্যে আমার মন কিন্তু মোটেই সায় দেয় না। বরং শেষ পর্যন্ত দেখে তবে এ জায়গা থেকে নড়ব–তাই আমার ইচ্ছে সুব্রতবাবু। শঙ্কর বললে।

বড় রকমের একটা বিপদ-আপদ যদি ঘটে এর মধ্যে শঙ্করবাবু?…অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপার, কখন কি হয় বলা তো যায় না।

যে বিপদ এখনও আসেনি, ভবিষ্যতে আসতে পারে, তার ভয়ে লেজ গুটিয়ে থাকব এই বা কোন দেশী যুক্তি আপনাদের? শঙ্কর বললে।

যুক্তি হয়ত নেই শঙ্করবাবু, কিন্তু অ-যুক্তিটাই বা কোথায় পাচ্ছেন এর মধ্যে! সুব্রত বলে!

কিন্তু, চন্দন সিং বলে, শুনুন, শুধু যে ঐ ভীষণ মূর্তি দেখেছি তাই নয় স্যার, মাঝে মাঝে গভীর রাতে কী অদ্ভুত শব্দ, কান্নার আওয়াজ মাঠের দিক থেকে শোনা যায়। এ ফিল্ডটা অভিশাপে ভরা।…কেউ বাঁচতে পারেনা। বাঁচা অসম্ভব। এর আগে তিনবার আক্রমণটা ম্যানেজারবাবুদের ওপর দিয়ে গেছে-কে বলতে পারে এর পরের বার অন্য সকলের ওপর দিয়ে যাবে না!

সে রাত্রে বহুক্ষণ তিনজনে নানা কথাবার্তা হল।

চন্দন সিং যখন বিদায় নিয়ে চলে গেল, রাত্রি তখন সাড়ে দশটা হবে।

শঙ্কর একই ঘরে দুপাশে দুটো খাট পেতে নিজের ও সুব্রতর শোবার বন্দোবস্ত করে নিয়েছে।

শঙ্করের ঘুমটা চিরদিনই একটু বেশী। শয্যায় শোবার সঙ্গে সঙ্গেই সে নাক ডাকতে শুরু করে দেয়।

আজও সে শয্যায় শোরার সঙ্গে সঙ্গেই নাক ডাকতে শুরু করে দিল। সুব্রত বেশ করে কম্বলটা মুড়ি দিয়ে মাথার কাছে একটা টুলের ওপরে টেবিলল্যাম্পটা বসিয়ে তার আলোয় কিরীটীকে চিঠি লিখতে বসল। কিরীটী

কাল তোকে এসে পৌঁছানোর সংবাদ দিয়েছি। আজ এখানকার আশপাশ অনেকটা ঘুরে এলাম। ধূ-ধূ মাঠ, যেদিকে তাকাও জনহীন নিস্তব্ধতা, যেন চারিদিকের প্রকৃতির কণ্ঠনালী চেপে ধরেছে।

বহুদূরে কালো কালো পাহাড়ের ইশারা, প্রকৃতির বুক ছুঁয়ে যেন মাটির ঠাণ্ডা পরশ নিচ্ছে। বর্তমানে যেখানে এদের কোল্‌ফিল্ড বসেছে, তারই মাইলখানেক দূরে বহুকাল আগে একসময়  একটা কোল্‌ফিল্ড ছিল। আকস্মিকভাবে এক রাত্রে সে খনিটা নাকি ধ্বসে মাটির বুকে বসে যায়। এখনও মাঝে মাঝে বড় বড় গর্তমত আছে। রাতের অন্ধকারে সেই গর্তের মুখ দিয়ে আগুনের হলকা বের হয়।

অভিশপ্ত খনির বুকে দুর্জয় আক্রোশ এখনও যেন লেলিহান অগ্নিশিখায় আত্মপ্রকাশ করে। আজ সন্ধ্যার দিকে বেড়িয়ে ফিরছি, অন্ধকার চারিদিকে বেশ ঘনিয়ে এসেছে, সহসা পিছনে দ্রুত পায়ের শব্দ শুনে চমকে পিছনপানে ফিরে তাকালাম। আশ্চর্য, কেউ যে এত লম্বা হতে পারে ইতিপূর্বে আমার ধারণা ছিল না!

লম্মায় প্রায় ছ হাত হবে। যেমন উঁচু লম্বা, তেমনি মনে হয় যেন বলিষ্ঠ গঠন। আগাগোড়া একটা ধূসর কাপড় মুড়ি দিয়ে হনহন করে যেন একটা ঝড়ো হাওয়ার মত আমার পাশ দিয়ে হেঁটে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে মাঠের অপর প্রান্তে মিলিয়ে গেল।

আমি নির্বাক হয়ে সেই অপস্রিয়মান মূর্তির দিকে তাকিয়ে আছি, এমন সময় একটা অদ্ভুত বাঘের ডাক কানে এসে বাজল।

এত কাছাকাছি মনে হল–যেন আশেপাশে কোথায় রাঘটা ওৎ পেতে শিকারের আশায় বসে আছে।

তুই হয়ত বলবি আমার শোনবার ভুল, কিন্তু পর পর তিনবার স্পষ্ট বাঘের ডাক আমি শুনেছি।

তাছাড়া তুই তো জানিস, সাহস আমার নেহাৎ কম নয়, কিন্তু সেই সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকার নিঝুম নিস্তব্ধ প্রান্তরের মাঝে গুরুগম্ভীর সেই শার্দুলের ডাকে আমার শরীরের মধ্যে কেমন যেন অকস্মাৎ সিরসির করে উঠল। দ্রুত পা চালিয়ে দিলাম বাসায় ফেরবার জন্য।

চিঠিটা এই পর্যন্ত লেখা হয়েছে, এমন সময় রাতের নিস্তব্ধ আঁধারের বুকখানা ছিন্নভিন্ন করে এক ক্ষুধিত শার্দুলের ডাক জেগে উঠল।

একবার, দুবার, তিনবার।

সুব্রত চমকে শয্যা থেকে লাফিয়ে নীচে নামল।

তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে ধাক্কা লেগে টেবিল-ল্যাম্পটা মাটিতে ছিটকে পড়ে চুরমার হয়ে ঘর অন্ধকার হয়ে গেল।

আলোর চিমনিটা ভাঙার ঝনঝন শব্দে ততক্ষণে শঙ্করের ঘুমটাও ভেঙে গেছে।

 ত্রস্তে শয্যার ওপরে বসে চকিত স্বরে প্রশ্ন করলে, কে?

শঙ্করবাবু, আমি সুব্রত।

সুব্রতবাবু!

হ্যাঁ। ধাক্কা লেগে আলোটা ছিটকে পড়ে ভেঙে নিভে গেল।

বাইরে একটা চাপা অস্পষ্ট গোলমালের শব্দ কানে এসে বাজে।

অনেকগুলো লোকের মিলিত এলোমেলো কণ্ঠস্বর রাতের নিস্তব্ধতায় যেন একটা শব্দের ঘূণাবর্ত তুলেছে।

বাইরে কিসের একটা গোলমাল শোনা যাচ্ছে না, সুব্রতবাবু?

হ্যাঁ।

কিসের গোলমাল?

বুঝতে পারছি না, তবে যতদূর মনে হয়, গোলমালটা কুলিবস্তির দিক থেকে আসছে। সুব্রত বললে, চলুন একবার খবর নেওয়া যাক।

বেশ চলুন।

দুজনে দুটো লং কোট গায়ে চাপিয়ে মাথায় উলের নাইট-ক্যাপ পরে দুটো টর্চ হাতে বেরুবার জন্য প্রস্তুত হল।

গোলমালটা ক্রমে যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ঘরের দরজা খুলে সুব্রত বেরুতে যাবে, এমন সময় আকাশ-পাতাল-ফাটানো একটা বাঘের কুদ্ধ গর্জন রাত্রির আঁধারকে যেন ফালি ফালি করে জেগে উঠল আবার অকস্মাৎ।

এবং এবারেও একবার, দুবার, তিনবার।

সুব্রতর সমস্ত শরীর লোহার মত শক্ত ও কঠিন, মনের সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রীগুলি সজাগ হয়ে উঠেছে।

শঙ্কর ঘরের মাঝখানে স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে গেছে। যেন সহসা একটা তীব্ৰ বৈদ্যুতিক তরঙ্গাঘাতে একেবারে অসাড় ও পঙ্গু হয়ে গিয়েছে। প্রথমটা কারও মুখে কোন কথাই নেই। কিন্তু সহসা সুব্রত যেন ভিতর থেকে প্রবল একটা ধাক্কা খেয়ে সজাগ হয়ে উঠে এক ঝটকায় ঘরের খিল খুলে ফেলে বাইরের অন্ধকার বারান্দায় টচটা জ্বেলে লাফিয়ে পড়ল।

আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটা বোধ হয় ঘটতে কুড়ি সেকেণ্ডও লাগেনি।

সুব্রতকে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখে প্রথমটা শঙ্কর বেশ একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য, পরক্ষণেই সেও সুব্রতকে অনুসরণ করলে।

বাইরের অন্ধকার বেশ ঘন ও জমাট। সুব্রতর হাতে টর্চের তীব্র বৈদ্যুতিক আলোর রশ্মি, অনুসন্ধানী দৃষ্টি ফেলে চারিদিকে ঘুরে এল, কিন্তু কোথাও কিছু নেই।

বাঘ তো দূরের কথা, একটা পাখি পর্যন্ত নেই।

ততক্ষণে শঙ্করও সুব্রতর পশ্চাতে এসে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু বাঘের ডাক তো স্পষ্ট শোনা গেছে!

তবে?

বুঝতে পারিছ না, সত্যি সত্যিই এ কি তবে ভৌতিক ব্যাপার!

বলতে বলতে শঙ্কর আবার হাতের টর্চের বোতামটা টেপে। মাঠের মাঝখানে কুলিবস্তি ও কলিয়ারীতে যাবার পথে কতকগুলি কাজঁই ও বাবলা গাছ পড়ে। সেইদিকে শঙ্করের হাতের অনুসন্ধানী বৈদ্যুতিক বাতির রশ্মি পড়তেই দুজনে চমকে উঠল, কে? কে ওখানে?

একটা কালো মৃর্তি। তার গায়ে সাদা সাদা ডোরা কাটা।

চকিতে সুব্রত কোমরবন্ধ থেকে আগ্নেয়াস্ত্রটা টেনে বের করলে এবং চাপা গলায় বললে, ওই দেখুন বাঘ! সরে যান, গুলি করি!

শেষের কথাগুলো উত্তেজনায় যেন বেশ তীক্ষ্ণ সজোরে সুব্রতর কণ্ঠে ফুটে বের হয়ে এল।

স্যার আমি! গুলি করবেন না স্যার! ইয়োর মোস্ট ফেথফুল অ্যাণ্ড ওবিডিয়েন্ট সারভেন্ট!

একটা চাপা ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর কানে এসে বাজল।

কে?

আমি বিমল দে। কলিয়ারীর সরকার।

বিমলবাবু! শঙ্করের বিস্মিত কণ্ঠ চিরে বের হয়ে এল।

দুজনে এগিয়ে গেল।

শঙ্কর বিমলবাবুর গায়ের ওপরে টর্চের আলো ফেলে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে বিমলবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, এত রাত্রে এখানে এই শীতে মাঠের মধ্যে কি করছিলেন?

আগাগোড়া একটা সাদা ডোরাকাটা ভারী কালো কম্বল মুড়ি দিয়ে বিমলবাবু সামনে দাঁড়িয়ে।

আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম, স্যার!

আমার কাছে যাচ্ছিলেন? শঙ্কর প্রশ্ন করলে।

হ্যাঁ। কুলি-ধাওড়ায় একটা লোক খুন হয়েছে।

খুন হয়েছে? …সুব্রত চমকে উঠল।

হ্যাঁ বাবু, খুন হয়েছে!

গোলমালটা তখন বেশ সুস্পষ্ট ভাবে কানে এসে বাজছে।

চলুন দেখে আসা যাক।

সুব্রতর দিকে তাকিয়ে শঙ্কর বললে।

আগে শঙ্কর, মাঝখানে বিমলবাবু ও সর্বশেষে সুব্রত টর্চের আলো ফেলে কুলিবস্তির দিকে এগিয়ে চলল।

মাথার উপরে তারায় ভরা রহস্যময়ী অন্ধকার রাতের আকাশ কী যেন এক ভৌতিক বিভীষিকার প্রতীক্ষ্ণয় উগ্রীব।

আজ রাতে কুয়াশার লেশমাত্র নেই।