০১. নতুন ম্যানেজার

রাত্রি যখন গভীর হয় – কিরীটী অমনিবাস – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

০১. নতুন ম্যানেজার

ডিসেম্বরের শেষের শীতের রাত্রি।

কুয়াশার ধূসর ওড়নার আড়ালে আকাশে যেটুকু চাঁদের আলো ছিল তাও যেন চাপা পড়ে গেছে।

মিনিট কয়েক হল মাত্র এক্সপ্রেস ট্রেনটা ছেড়ে চলে গেল।

গাড়ির পিছনকার লাল আলোটা এতক্ষণ যা দেখাচ্ছিল, একটা রক্তের গোলার মত, এখন সেটাও কুয়াশার অস্বচ্ছতায় হারিয়ে গেছে।

স্টেশনের ইলেকট্রিক বাতিগুলো কুয়াশার আবরণ যেন ভেদ করে উঠতে পারছে না। ধানবাদ স্টেশনের লাল কাঁকর-ঢালা চওড়া প্ল্যাটফর্মটা জনশূন্য।

একটু আগে ট্রেনটা থামার জন্য যে সামান্য চঞ্চলতা জেগেছিল, এখন তার লেশমাত্রও নেই।

একটা থমথম করা স্তব্ধতা চারিদিকে যেন। জুতোর মচমচশব্দ জাগিয়ে দুজন ভদ্রলোক প্ল্যাটফর্মের উপর দিয়ে পাশাপাশি হেঁটে বেড়াচ্ছে। একজন বেশ লম্বা বলিষ্ঠ চেহারার, পরিধানে কালো রংয়ের দামী সার্জের সুট। তার উপর একটা লং কোট চাপানো। মাথায় পশমের নাইট ক্যাপ, কান পর্যন্ত ঢাকা।

অন্যজন অনেকটা খাটো। পরনে ধুতি, গায়ে-মাথায় একটা শাল জড়ানো। মুখে একটা জ্বলন্ত বিড়ি।

চা-ভেণ্ডার তার চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে এগিয়ে এল, বাবু, গরম চা? গরম চা? …

না, প্রথম ব্যক্তি বললে।

গলার স্বরটা বেশ ভারী ও মোটা।

চা-ভেণ্ডার চলে গেল।

দ্বিতীয় ব্যক্তির দিকে ফিরে প্রথম ব্যক্তি প্রশ্ন করলে, সুশান্তবাবু যেন খুন হলেন কবে?

গত ২৮শে জুন রাত্রে।

আজ পর্যন্ত তাহলে তাঁর মৃত্যুর কোন কারণই খুঁজে পাননি?

না, খুনীকে খুঁজতেও তো কসুর করলাম না। আমাদের কুলী-গ্যাং, কর্মচারীরা, মায় পুলিস অফিসাররা পর্যন্ত খুঁজে খুঁজে সবাই হয়রান হয়ে গেছেন।

আশ্চর্য!

তা আশ্চর্য বৈকি! পর পর তিনজন ম্যানেজার এমনি করে কোয়াটারের মধ্যে খুন হলেন। আমরা তো ভেবেছিলাম, এরপর কেউ আর এখানে কাজ নিয়ে আসতেই চাইবেন না। হাজার হোক একটা প্যানিক (ভীতি) তোবলে লোকটি ঘন ঘন প্রায় শেষ বিড়িটায় টান দিতে লাগল।

শঙ্কর সেন মৃদু হেসে বললেন, আমি লয়াবাদে একটা কলিয়ারীতে মোটা মাইনের চাকরি। করছিলাম। তাহলে কথাটা আপনাকে খুলেই বলি—ঐ যে ভয়ের কথা কি বললেন—আমাদের বড়বাবুর মুখে এখানকার ঐ ভয়ের ব্যাপারটা শুনে চার মাসের ছুটি নিয়ে এই চাকরিতে এসে জয়েন করেছি।

কিন্তু–

ভয় নেই, পছন্দ হলে থেকে যাব।

আপনার খুব সাহস আছে দেখছি, শঙ্করবাবু!

শুধু আমিই নয়—শঙ্কর সেন বলতে লাগলেন, আমার এক কলেজ-ফ্রেণ্ডকেও লিখেছি আসতে। বর্তমানে সে শখের গোয়েন্দাগিরি করে। যেমন দুর্দান্ত সাহস, তেমন চুলচেরা বুদ্ধি। কেননা আমার ধারণা, এইভাবে পর পর আপনাদের ম্যানেজার নিহত হওয়ার পিছনে ভৌতিক কিছু নেই, আছে কোন শয়তানের কারসাজী।

বলেন কি স্যার? আমার কিন্তু ধারণা এটা অন্য কিছু!

অন্য কিছু মানে? শঙ্কর সেন বিমলবাবুর মুখের দিকে তাকাল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে।

যে জমিটায় ওঁরা অর্থাৎ আমাদের কর্তারা কলিয়ারী শুরু করতে ইচ্ছা করেছেন, ওটা একটা অভিশপ্ত জায়গা। ওখানকার আশপাশের গ্রামের সাঁওতালদের কাছে শুনেছি, ওই জায়গাটা নাকি বহুকাল আগে একটা ডাকাতদের আড্ডাখানা ছিল, সেই সময় বহু লোক এখানে খুন হয়েছে। সেই সব হতভাগ্যদের অদেহী অভিশপ্ত আত্মা আজও ওখানে দিবারাত্রি নাকি ঘুরে বেড়ায়।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ। কতদিন রাত্রে বিশ্রী কান্না ও গোলমালের শব্দে আমারও ঘুম ভেঙে গেছে। আবছা চাঁদের আলোয় মনে হয়েছে যেন হালকা আবছা কারা মাঠের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

অল বোগাস! দাঁতে দাঁত চেপে শঙ্কর সেন বললে।

আমি জানি স্যার, ইংরাজী শিক্ষা পেয়ে আপনারা আজ এসব হয়ত বিশ্বাস করতে চাইবেন না, কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি। মরণই আমাদের শেষ নয়। মরণের ওপারে একটা জগৎ আছে এবং সে জগতের যারা বাসিন্দা তাদেরও প্রাণে এই মাটির পৃথিবীর লোকদের মতই দয়া, মায়া, ভালবাসা, আকাঙক্ষা, হিংসা প্রভৃতি অনুভূতিগুলো আছে এবং মাটির পৃথিবী ছেড়ে গেলেও এখানকার মায়া সহজে তারা কাটিয়ে উঠতে পারে না।

একটানা কথাগুলো বলে বিমলবাবু একটা বিড়ি ধরিয়ে প্রাণভরে টানতে লাগলেন।

কই, আপনার বাসের আর কত দেরি?

এই তো, আর মিনিট কুড়ি বাকি।

চলুন, রেস্টুরেন্ট থেকে একটু চা খেয়ে নেওয়া যাক।

আজ্ঞে চায়ে আমার নেশা নেই।

তাই নাকি? বেশ, বেশ। কিন্তু এই শীতে চা-বিনে থাকেন কি করে?

আজ্ঞে গরীব মানুষ।

দুজনে এসে কেলনারের রেস্টুরেন্টে ঢুকল এবং চায়ের অর্ডার দিয়ে দুজনে দুখানা চেয়ার দখল করে বসল।

আপনি আপনার যে বন্ধুটির কথা বলছিলেন, তাঁর বুঝি গোয়েন্দাগিরিতে খুব হুজুগ আছে? হ্যাঁ, হজুগই বটে। শঙ্করবাবু হাসতে লাগল।

হুঁ। ওই এক-একজনের স্বভাব। নেই কাজ তো খই ভাঁজ! তা বড়লোক বুঝি? টাকাকড়ির অভাব নেই, বসে বসে আজগুবী সব খেয়াল মেটান!

বেয়ারা চায়ের সরঞ্জাম রেখে গেল।

আসুন না বিমলবাবু, কেতলি থেকে কাপে দুধ চিনি মিশিয়ে র-চা ঢালতে ঢালতে বিমলবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে শঙ্কর বললে, বড্ড ঠাণ্ডা, গরম গরম এক কাপ চা মন্দ লাগবে না!

আচ্ছা দিন, বিমলবাবু বলে, আপনার request, মানে অনুরোধ–

শঙ্কর বিমলবাবুকে এক কাপ চা ঢেলে দিল। চায়ের কাপে বেশ আরাম করে চুমুক দিতে দিতে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে বিমলবাবু শঙ্করের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, তা আপনার সে বন্ধুটির নাম কী?

নাম কিরীটী রায়।

কিরীটী রায়! কোন্ কিরীটী রায়? বর্মার বিখ্যাত দস্যু কালো ভ্রমর প্রভৃতির যিনি রহস্য ভেদ করেছিলেন?

হ্যাঁ।

ভদ্রলোকের নাম হয়েছে বটে! কবে আসবেন তিনি?

আজই তো আসবার কথা ছিল, কিন্তু এল না তো দেখছি। কাল হয়ত আসবে।

এমন সময় বাইরে ঘণ্টা বেজে উঠল।

বাস এসে গেছে।

বাস মানে একটা কম্পার্টমেন্ট এঞ্জিন টেনে নিয়ে যায়।

চা-পান শেষ করে দাম চুকিয়ে দিয়ে দুজনে বাসে এসে উঠে বসল।

অল্পক্ষণ বাদেই বাস ছেড়ে দিল।

শীতের অন্ধকার রাত্রি কুয়াশার আবরণের নীচে যেন কুঁকড়ে জমাট বেঁধে আছে।

খোলা জানলাপথে শীতের হিমশীতল হাওয়া হু-হু করে এসে যেন সর্বাঙ্গ অসাড় করে দিয়ে যায়। এতগুলো গরম জামাতেও যেন মানতে চায় না। দুজনে পাশাপাশি বসে চুপচাপ।

কাতরাসগড় ও তেঁতুলিয়া হল্টের মাঝামাঝি ওদের গন্তব্য স্থান। কাতরাসগড় স্টেশনে নেমে সেখান থেকে হেঁটে যেতে হয় বেশ খানিকটা পথ। রাত্রি প্রায় তিনটের সময় গাড়ি এসে কাতরাসগড় স্টেশনে থামল। অদূরে স্টেশন-ঘর থেকে একটা ক্ষীণ আলোর রেখা উঁকি দিচ্ছে। একটা সাঁওতাল কুলি এদের অপেক্ষায় বসে ছিল।

তার মাথায় সুটকেস ও বিছানা চাপিয়ে একটা বেবী পেট্রোমাক্স জ্বালিয়ে ওরা রওনা হয়ে পড়ল।

নিঝুম নিস্তব্ধ কনকনে শীতের রাত্রি।

আগে বিমলবাবু এগিয়ে চলেছে, হাতে তার আলো, চলার তালে তালে দুলছে।

আলোর একঘেয়ে সোঁ সোঁ আওয়াজ রাত্রির নিস্তব্ধ প্রান্তরের মৌনতা ভঙ্গ করছে। মাঝে মাঝে এক-একটা দমকা হাওয়া হু-হু করে বয়ে যায়।

মাঝখানে শঙ্কর। সবার পিছনে মোটঘাট মাথায় নিয়ে সাঁওতালটা।

একপ্রকার ঝোঁকের মাথায়ই শঙ্কর এই কাজে এগিয়ে এসেছে। চিরদিন বেপরোয়া জীবনের পথে এগিয়ে চলেছে। এ দুনিয়ায় ভয়ডর বলে কোন কিছু, কোন প্রকারে বিপদ-আপদ তাকে পিছনটান দিয়ে ধরে রাখতে পারে নি। সংসারে একমাত্র বুড়ী পিসীমা। আপনার বলতে আর কেউ নেই। কেই বা বাধা দেবে?

বিমলবাবুর মুখ থেকেই শোনে কলিয়ারীর ইতিহাসটা শঙ্কর। বছর-দুই আগে কাতরাসগড় ও তেঁতুলিয়ার মাঝামাঝি একটা জায়গার সন্ধান পেয়ে পূর্ববঙ্গের এক ধনীপুত্র কলিয়ারী করবার ইচ্ছায় কাজ শুরু করেন। কিন্তু একমাস যেতে না যেতেই ম্যানেজার রামহরিবাবু একান্ত আশ্চর্যভাবে তাঁর কোয়ার্টারে এক রাত্রে নিহত হন। দ্বিতীয় ম্যানেজার বিনয়বাবু কিছুদিন বাদে কাজে বহাল হন। দিন পনের যেতে না যেতে তিনিও নিহত হন। তারপর এলেন সুশান্তবাবু, তাঁরও ঐ একই ভাবে মৃত্যু ঘটল। পুলিস ও অন্যান্য সবাই শত চেষ্টাতেও কে বা কারা। যে এঁদের এমন করে খুন করে গেছে তার সন্ধান করতে পারলে না। তিন-তিনবারই একটি কুলি বা কর্মচারী নিহত হয়নি, তিনবারই ম্যানেজার নিহত হল। মৃত্যুও ভয়ঙ্কর। কে যেন ভীষণভাবে গলা টিপে হতভাগ্য ম্যানেজারদের মৃত্যু ঘটিয়েছে, গলার দুপাশে দুটি মোটা দাগ এবং গলার পিছনের দিকে চারটি কালো গোল ছিদ্র।

শঙ্কর যেখানে কাজ করছিল সেখানকার বড়বাবুর কাছে ব্যাপারটা শুনে একান্তকৌতূহলবশেই নিজে অ্যাপ্লিকেশন করে কাজটা সে নিয়েছে চারমাসের ছুটি মঞ্জুর করিয়ে।

এখানে রওনা হবার আগের দিন কিরীটীকে একটা চিঠিতে আগাগোড়া সকল ব্যাপার জানিয়ে আসবার জন্য লিখে দিয়ে এসেছে।

কিন্তু এই নিষুতি রাতে নির্জন প্রান্তরের মাঝ দিয়ে চলতে চলতে মনটা কেমন উন্মনা হয়ে যায়, কে জানে এমনি করে নিশ্চিত মরণের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভাল করল কি মন্দ করল!

অদূরে একটা কুকুর নৈশ স্তব্ধতাকে সজাগ করে ডেকে উঠল।

ওরা এগিয়ে চলে।