৯. জালিয়ানবাগ দিবসের ডাক নয়

জালিয়ানবাগ দিবসের ডাক নয়। স্মৃতি পালনের নির্দেশ দিয়েছে কংগ্রেস সারা ভারতময়, আহ্বান জানিয়েছে, বি পি সি সি। সুভাষ বসুর সঙ্গে মতান্তরকে কেন্দ্র করেই, বাংলা কংগ্রেসে একটা বামপস্থার ঝোঁক দেখা দিয়েছে যেন। তবে খুবই সামলে। যত সামলেই হোক, তবু ওয়ার্কিং কমিটি সুভাষ বসুর উপর সভ্যপদ বাতিলের শাস্তি চাপাবেন, শোনা যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে বি পি সি সির উপর অ্যাডহক কমিটি চাপানো হবে গান্ধীবাদী কংগ্রেসীদের নিয়ে। আর সুভাষবাবুর একটা নতুন দল খাড়া করতে পারেন, এটাও কানাঘুষা।

এই কোঁদলের মধ্যে হীরেন আর কৃপালও ছিল। বিপিসিসির উপর তুষ্ট নয় সে। কিন্তু ওয়ার্কিং কমিটির উপরেও নয়। গত কয়েক বছরে প্রদেশগুলিতে কংগ্রেসের অ্যাসেম্বলীর কার্যাবলী তার পছন্দ হয়নি। সে দেখেছে নিজেদের মধ্যেই দলাদলি, ক্ষমতার অপব্যবহার। সে যা চেয়েছিল, গান্ধীজি যা চেয়েছিলেন, সে বস্তু সুদূর পরাহত। নিশীথ রাত্রির ঘুমন্ত ভারত, উষার মঙ্গলগান ও স্তোত্রে, ঘণ্টা ও কাঁসি-ধ্বনিতে মুখরিত মন্দিরের ভারতকে পাশ্চাত্তের ডামাডোলের বাজারের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চাইছে সবাই। তাই সে আজ রাজনীতি থেকে অনেক দূরেই থাকে।…দূরে না থাকলে উপায় কি। যে মন্দিরের সে স্বপ্ন রচনা করেছিল সেই মন্দিরের রক্ষাকর্ত্তী রামা ঝাড়দারনী। ফল পাকুড় ও স্বপাকের মিষ্টি দিয়ে দেবতার পুজো দেবে। সেই প্রসাদে তারা ধন্য হবে। কিন্তু কুৎসিত জগৎ তার বিষাক্ত কীটে পরিণত করেছে রামাকে। আর বউদি। তার চোখে শুধু আগুন আর একটা ভয়াবহ হাসি। ওই হাসি দেখে নাকি পুরুষে আবার মাতালও হয়। না, হীরেন পালিয়ে যাবে কোথাও।

কৃপালও বি পি সি সি-র ব্যাপারে খুশি নয়। কিন্তু দু-নৌকায় পা দিয়েছে। ক্ষমতা পেতে চায় সে। তার সবচেয়ে বেশি রাগ ছিল প্রিয়নাথদের উপর। ওদের সেন্ট্রাল কমিটি কায়দা করে উদারতার সঙ্গে জানিয়েছে, কংগ্রেসের মধ্যে থাকা না থাকা নিয়ে বিবাদ করব না। ভেদপস্থার চেয়েও কাজের দিকেই আমাদের ঝোঁক বেশি থাকবে। অথচ, কাজ তো ছাই। সমাজতন্ত্রবাদের বাজে ধোঁকা দিয়ে খালি মজুর খেপানোই তাদের কাজ। শেষ পর্যন্ত তো সবাই সুনির্মলের মতো মাস্টারনির পেছনে ছুটবে আর যক্ষ্মা রোগে ভুগবে।

সেই জন্য এই জালিয়ানবাগ দিবস ডাকের ব্যাপারে রথীন ও প্রিয়নাথের উপরে তার বিশ্বাস ছিল। অথচ কংগ্রেস বলেছে, শান্তিপূর্ণ সভা ও শোভাযাত্রা হবে। সাধারণ নাগরিক ও ছাত্ররা তাদের দৈনন্দিন জীবনের মধ্যেই শহিদদের স্মরণ করবেন। কংগ্রেস কর্মীরা অফিসে বৈঠক করবেন। শোক প্রকাশ করবেন, প্রার্থনা করবেন ও শহিদের মৃত আত্মার প্রতি সম্মান প্রদর্শণ করবেন।

কিন্তু বেলা বাড়তে দেখা গেল, সুলের ছাত্ররা সব গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সমস্ত আকাশটাকে চমকে তুলল বহু তরুণ গলার ঘোষণা, জালিয়ানবাগ, জিজনদাবাদ।

কৃপাল হীরেন এরা সব শ্রীমতী কাফেতে এসে থেমে পড়েছে। একী হল, এ সব কার কারসাজি? ধর্মঘট বা বিক্ষোভ প্রদর্শনের তো কোনও কথা ছিল না। কংগ্রেস এরকম ডাক তো দেয়নি।

হীরেন বলল, রথীন ওখানে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

কৃপাল বলল, কারণ?

তা কী জানি। হীরেন হাত উলটে বলল।

রথীন কংগ্রেসরই সভ্য। সে কী করে ছাত্রদের ধর্মঘটের মাঝখানে চলে গেল। তার পার্টির কাজ করবার কোনও কথাই তাকে বলা হয়নি।

সুনির্মলও আছে বোধহয়? কৃপাল খেঁকিয়ে উঠল।

হীরেন বিরক্ত হয়ে জবাব দিল, আমাকে ধমকাচ্ছ কেন?

সে গীতাখানি বার করল পকেট থেকে।

একটা গলার স্বর ভেসে এল স্কুলের গেটের কাছ থেকে, বন্ধুগণ, ছাত্রবন্ধুরা, এ সেই ইংরেজের মিথ্যে ইতিহাস অন্ধকূপ হত্যার কাহিনী নয়, আজকের এই দিনেই দিনের বেলা ইংরেজ হত্যা করেছিল ভারতীয়দের, পাঞ্জাবের ঘেরা বাগানের চারদিক থেকে বন্দুকের গুলিতে।… গোলমাল বেড়ে উঠেছে।

মনে হয়েছিল ভজু ঘুমোচ্ছে টেবিলে মাথা পেতে। সে চিৎকর করে উঠল, ঠিক ঠিক বলেছিস।

কৃপাল সেদিকে কান না দিয়ে বলল, রথীন অদ্ভুত ছেলেগুলোকে বাড়ি ফিরে যেতে বলবে তো! হীরেন ড়ুবে গিয়েছে শ্রীকৃষ্ণার্জুনের প্রশ্নোত্তরে।

ভজু তার মোটা গলায় ঘোষণা করল, ওরা আর কোনও দিন বাড়ি ফিরে যাবে না।

.

হেড মিস্ট্রেস সরসীর বুকের মধ্যে থরথর করে কাঁপছে, হাওয়ায় কেঁপে ওঠা বুনো ঘাসের ডগার মতো। তার সারা চোখে মুখে ঝড়ের প্রতীক্ষা। এখুনি এসে ঝড় আছড়ে পড়বে তার স্কুলের গেটে। বিদীর্ণ করে দেবে তার কপট বাঁধ, ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সেই বন্যা তার এই ছোট্ট সরোবরের মতো স্কুলটাকে, মেয়েরা বেরিয়ে পড়বে পথে পথে ছেলেদের সঙ্গে। সেই ঝড়কে চালিয়ে নিয়ে আসবে উদ্ধত পবনের মতো সুনির্মল। বুঝি লণ্ডভণ্ড করে দেবে তারও এ ঘরখানি, বুঝি তাকেও বেসামাল করে দেবে সেই ঝড়, তার হৃদয়কে, তার সমস্ত কিছুকে।

কিন্তু পারছে কোথায় তা সুনির্মল। মধ্যপথে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে, ছুড়ে ফেলে দিয়েছে মুখ থেকে সিগারেটটা। অসহ্য বেদনায় বুকের মধ্যে যেন স্কু বিঁধছে। আন্দোলন নয়, জালিয়ানবাগ দিবস নয়। শুধুই গিয়ে একবার ছাত্রদের সামনে দাঁড়ানো। তার হাজারো আলস্য ও ক্লান্তির মাঝে সে যে শুধুমাত্র নেশা। সরসীর ইংরেজি আদ্য অক্ষর এস রুমালের কোণে যেন রাজহংসীর মতো গ্রীবা বাঁকিয়ে রয়েছে। লাল রেশমের সে অক্ষর রক্তাক্ত।

অভূতপূর্ব ক্লান্তি। সে পৃথিবী থামো! ওই একটু দূরেই ছাত্রেরা ভিড় করেছে স্কুল গেটের সামনে, শ্লোগান ভেসে আসছে তাদের। ওই শ্রীমতী কাফের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে কৃপাল দত্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে। সুনির্মল না এসে পারেনি শুধুমাত্র দর্শক হিসেবে।

অকস্মাৎ একটা কান্নার বেগ ঠেলে আসছে তার বুকে। এ কী জীবন তার। কী চেয়েছিল সে জীবনে। গোলামাল হয়ে গিয়েছে সব। বারবার বলতে থাকে, সরসী, সরসী আমাকে নিয়ে চলো, অন্য কোথা, অনেক দূরে। শুধু আমি আর তুমি।… সে হাঁটতে আরম্ভ করে। হরিজন সেবা, পপুলার ফ্রন্ট, বম্বের কাপড়ের কলে ধর্মঘট আর মাদ্রিদ…।

পুলিশ! কে চিৎকার করে উঠল। ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল ছাত্ররা। জালিয়ানবাগ আর আব্বাস উদ্দিনের কাশের বন—ভজু চিৎকার করে উঠল, ভুনু সারথি, গাড়ি মাঝপথে রাখ।

হুকুম মাত্র গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল রাস্তায় আড়াআড়ি ভাবে। উৎকণ্ঠিতা সন্ত্রস্তা মনিয়া ছুটে আসছে। মিনিলোসা…। পুলিশের পথের সামনে বাধা।

ভবনাথ আফসোসে ভেঙে পড়ল, ভজু…ভজু, আমার ছোট ছেলেটা ভয়ে বাড়ি পালিয়ে গেল হে। স্কুল থেকে।

সুনির্মল আসছে। দ্রাবিড় ও আর্য সভ্যতা। রাইখস্টাইগ ও লক্ষ গ্রাম বাংলা, সুভাষ-সীতারামাইয়া..

চলা আও কসম মেরি…। মনিয়া দুহাত বাড়িয়ে দিয়েছে কোচোয়ানের উঁচু টঙের দিকে। কিছু না বুঝলেও একটা স্বরাজীর নেশা আছে ভুনুর। এই স্বরাজীর জন্য সে সব করতে পারে সেকথা জানে মনিয়া। তাই সে ছুটে এসেছে। ভুনুর জানটা যদি যায়। মিনিলোসার চোখে জল। চলা আও, আও।

ভবনাথের সমস্ত কিছু গণ্ডগোল হয়ে গেল, দিশা হারিয়ে গেল মনিয়ার দিকে তাকিয়ে। জীবনে এই প্রথম চোখ আটকে গেল, পুরুষের চোখ যেন এই প্রথম নারী। বুকের মধ্যে ধ্বক ধ্বক করে উঠল ভবনাথের।

মনিয়ার, ঘোর দুপুর গায়ের রং, চোখে ব্যাকুলতা, উত্তোলিত সুঠাম হাত কাপড়ের আড়ালে উঁকি দেওয়া শক্ত পুষ্ট বুক, ভোলা নাভিস্থল, তার নীচে শাড়ির বাঁধন। মোনালিসা নয়, মিনিলোসা! হ্যাঁ, ওই নামই তো অনেকবার শুনেছেন ভজুর মুখে। শুনেছেন ভুনুর মুখে। কিন্তু ভাবতেও পারেননি এমন করে ওই কোচোয়ানি মিনিলোসা ঝড় তুলবে তাঁর বুকে। একী হল বুকের মধ্যে। কী হল তার চোখের। ছি ছি ভবনাথ।… কে তুমি ভবনাথ?

কেউ নয়, এক চরিত্রবান ভদ্রলোক, নাম ভবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

গাড়ি হটাও। দারোগা চিৎকার করে উঠল।

দাঁড়া ভুনু, গাড়ি চেপে বাড়ি যাব। চেঁচিয়ে উঠল ভজুলাট।

বাঁ দিকের রাস্তায় বেঁকে যাচ্ছে মিছিল।

সুনির্মল ভেসে গিয়েছে জনারণ্যে। কালিদাস আর ভারতচন্দ্র, মাইকেল ও রবীন্দ্রনাথ। মন চমকে উঠল সুনির্মলের।

হ্যাঁ, সরসীর সঙ্গে যে সে শান্তিনিকেতনে যাবে। লাঠির আঘাত পড়ল ঘোড়ার মাথায়। পেছিয়ে গেল গাড়ি।

পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ল স্কুলের গেটে, বাঁ দিকের রাস্তায়। একটা ছেলে এসে ছিটকে পড়ল গাড়ির কাছে। মনিয়া তাকে তুলে দিল গাড়ির মধ্যে, দিয়ে নিজে উঠে দরজা বন্ধ করে দিল।

কৃপাল হীরেনের হাত থেকে ছুড়ে ফেলে দিল গীতাখানি। দিয়ে বেরিয়ে গেল পেছনের দরজা দিয়ে।

পুলিশ মার্চ করে গেল গীতার উপর দিয়ে, থেঁতলে দলে।

এ কি একুশ সাল না তিরিশ সাল?

ভুনু নামিয়ে নিয়ে ঢুকিয়ে দিল ছেলেটাকে শ্রীমতী কাফেতে।

ভজু চেঁচিয়ে উঠল, শ্রী শ্রীধরের ছেলে, তুই কানু না?

কানু বলল, হ্যাঁ! ওরা কোথায় গেল?

চোখ আর কপাল ফুলে উঠেছে কানুর! ভজু তাকে দুহাতে টেনে নিল বুকের কাছে। বলল, ওদের সন্ধান পরে হবে। কিন্তু, তুই যে সত্যি দেব-সুত রে। চরণ, এক গেলাস দুধ দে।

ভুনু বলল, লাটঠাকুর, বউ নিয়ে ঘরে যাচ্ছি।

যা। ভজু বলল। সামনের রাস্তাটা ফাঁকা হয়ে আসছে। পুলিশ চলে গেছে মিছিলের সঙ্গে। স্কুলবাড়িটা ফাঁকা পোড়োবাড়ির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে।

মনিয়া গাড়ির ভেতর থেকে উল্কণ্ঠিত চোখে তাকিয়ে আছে কানুর দিকে। যেন ভুনুর সোয়ারি বসে আছে গাড়িতে।

ভবনাথের চোখের পলক পড়ে না। এক সন্ত্রতা মেয়ে আলুথালু বেশ, অযত্নের এলো চুল, কী বিচিত্র তার গায়ের রং, অপূর্ব গঠন। এ যে দুর্গা প্রতিমার আর এক রূপ! চোখ গেল। চোখ গেল! একী হল।

নিয়োগী হতভম্বের মতো তাকিয়ে রয়েছে ছেড়া গীতাটার দিকে। ছিন্নভিন্ন পাতাগুলি উড়ে যাচ্ছে হাওয়ায়।…প্রসাদে সর্ব দুঃখানাং হানিরস্যোপজয়তে…কায়েন মনস্যা বিদ্যা কেবলৈরিন্দ্রিয়েরপি.যেন সমগ্র ভারত ছিন্নভিন্ন হচ্ছে।

কানু সসঙ্কোচে দুধের গেলাসে চুমুক দিল। ভজু বলল, ওরে, তোকে বেঁধে রাখার জন্য দুধ দিইনি, দিয়েছি তোর প্রাণটার জন্য। তোকে সেদিন মাংস খাইয়েছিলুম বলে তোর বাপ আমাকে গালাগালি দিয়ে গেছে। গেলই বা, তোর জন্য শ্রীমতী কাফের দরজা চিরদিন ভোলা রইল।

ভজুর মনে পড়ে গেল, তার ছেলেমেয়েরা ঠিকমতো দুধ পায় না। না-ই বা পেল। কিন্তু কানু–!

ভজু বলল, নারান হালদারের নাম শুনেছিস?

কানু তার লাঠির আঘাতে ফোলা চোখটা তুলে বলল, জানি, আপনার দাদা।

আর তোর?

কানু জবাব দিল, রথীনদা বলেছেন, তিনি আমাদের গুরুদেব।

গুরুদেব! ভজু তার ড্রায়ারে ভেতর থেকে একখানা বই বের করে, তার ভেতরে একটা ছবি খুলে ধরল কানুর সামনে। বলল, চিনিস এ লোকটাকে?

ছবিটার নীচে লেখা রয়েছে ঋষি কার্ল মার্কস।

কানু বলল, ইনি কোথাকার ঋষি?

ভজু বলল, বিশ্বের!–বইটা তোদের গুরুদেবের ঝোলায় ছিল, পড়েছে আমার হাতে। আমি তোকে দিলুম, তুই পড়বি। খবরদার, কেউ যেন না দেখে।

বলে দুধ খাইয়ে কানুকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল সে। দিয়ে এসে দাঁড়াল তার সেই র‍্যাফেলের মা, সিরাজদ্দৌলা আর রবীন্দ্রনাথের মুর্তিটার সামনে।

এমন সময় বিনা বাধায় পুলিশ ঢুকে তল্লাসি চালাতে আরম্ভ করল শ্রীমতী কাফের ঘরে।

দারোগা বলল, আপনার এখানে কেউ লুকিয়ে আছে?

ভজু ধীর গলায় বলল, আছে।

দারোগা উৎসুক গলায় জিজ্ঞেস করল, কে? প্রিয়নাথবাবু?

ভজু বলল, কাছে আসা হোক। তারপর কৌতূহলিত দারোগাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, সি আর দাশ, রবীন্দ্রনাথ, র‍্যাফেলের মা-ছেলে আর সিরাজদ্দৌলার ছবিটা। পরে নিজেকে দেখিয়ে বলল, এই এঁরা, আমিও লুকিয়েই আছি, খুঁজে পাওয়া যাবে না।

দারোগা হঠাৎ রাগে এক মুহূর্ত গম্ভীর থেকে বলল, সকালবেলাই বোধহয়।

না না, পেটে মাল পড়েনি, মাইরি বলছি। তাড়াতাড়ি বলে উঠল ভজু, সেই জন্যই তো ভাল করে কথা বলতে পারছি না। যাবার আগে আমার ওই সুদর্শনচক্রধারীর ছবিখানিও দেখে যাবেন, উনি নরনারায়ণ।

দারোগা বেরিয়ে যাওয়ার মুখে হীরেনকে বলল, আপনি চলুন থানায় একটা স্টেটমেন্ট দেবেন।

কিন্তু ভজুর মুখে একটুও বিদ্রূপের আভাস নেই। তার সারা চোখ মুখ আগুনের মতো ধ্বক ধ্বক করে জ্বলছে। নিজের পেটটা চেপে ধরে ফিসফিস করছে, সত্যি আমি লুকিয়ে আছি। আমি পলাতক, পালিয়ে আছি সকলের কাছ থেকে। যুঁই আর সন্তানদের কাছ থেকেও। কেন, কেন এমন হল।

গার্লস স্কুলে ধর্মঘট করে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছে অলিগলিতে, গঙ্গার ধারে, মাঠে, গ্রামে। যেন ঝড় এসেছিল কালবৈশাখীর, আবার সব শান্ত হয়ে গিয়েছে। কেবল কারখানাগুলোর গেটে পুলিশ এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে যেন আবার ঝড়ের আশঙ্কায়।

জ্বরতপ্ত সুনির্মলকে নিয়ে সরসী ফিরে গিয়েছে তার কোটরে।

.

আস্তাবলে গাড়ি ঢুকতেই মনিয়া একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল ভুনুর উপর।কেন, কেন গোঁয়ার কাঁহিকা।

বলে আর ভুনুর গায়ে পিঠে ছোট্ট দস্যি মেয়েটার মতো হাত চালাতে থাকে। ভুনু সে সব গ্রাহ্য করে হা হা করে হেসে উঠে আস্তাবলের দরজাটা বন্ধ করে দিল। জোর করে মনিয়ার হাত দুটো ধরে বলল, বুজদিল আওরত! আমি তোর মরদ ভুনু নয়? অতগুলো ছোকরাকে পুলিশ মারবে, আমাকে আটকাতে হবে না?

কাঁহে? রুদ্ধ কান্নায় ভেঙে পড়ে মনিয়া।

কাঁহে? রাগ হয় না, মায়া হয় ভুনুর। ফিসফিস করে বলে, এটা আজাদির লড়াই জানিস না? তারপর নিজের মাথা থেকে বানিয়ে বলতে থাকে, মহাতমা গাঁধী আছে না? উনকে জেলে নিয়ে গেছে তাই। লারাইনঠাকুর ফের আসবে কিনা,ছোকরারা সে দেওতাকে ফিরিয়ে আনতে চায়।

মনিয়া কিছুক্ষণের জন্য সত্যি সব ভুলে বড় বড় চোখে তাকিয়ে ভুনুর কথা শুনতে থাকে। ভুনু আপন মনে তার যা খুশি তাই বলতে থাকে। গান্ধী, মতিলাল, আর ইংরেজ। কোনও বিষয়েই তার পরিষ্কার ধারণা নেই, স্বাধীনতা কেন এবং কীসের তারও কোনও খেই পায় না সে ভেবে ভেবে। কিছুক্ষণ পর মনিয়া তার পেখম খুলে ধরে। হাসি গোপন করে বলে ওঠে, হরবখত তুম অ্যায়াসা করেগা তো হম ভাগ যায়েগা কিসিকো সাথ।

ফের সেই কথা। মুহূর্তে ভুনুর মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে, গম্ভীর হয়ে ওঠে। উগ্র রক্তচোখে তাকায় মনিয়ার দিকে। মনিয়া ওর হৃদয়ের তলাটুকু চিনে ফেলেছে যেন। কিন্তু ঠাট্টা হলেও একথা শুনতে পারে না সে। মনিয়া ঘাড় বাঁকিয়ে হাসে আড়ে আড়ে চায় আর বলে, হাঁ সচ।

ভুনু এমনভাবে দাঁড়ায় যেন এখুনি ঝাঁপিয়ে পড়বে মনিয়ার উপর। কিন্তু সে হঠাৎ পেছন ফিরে বাইরের দিকে পা বাড়ায়। অমনি মনিয়া হাসিতে ফেটে পড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে দুহাতে। খেলাটা যেন তার রোগে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ভুনু টানা হাঁচড়া করতে থাকে, বেসামাল মনিয়ার গায়ের কাপড় খসে পড়ে। তবুও ছাড়ে না, হাসে আর প্রতিজ্ঞা করতে থাকে আর কোনওদিন বলবে না।

তাতেও হয় না। তারপর হাসি ছেড়ে কান্নার পালা আসে। কঠিন গালাগালিতে ভুনু ভাঁটা দেয়, হয় তো কষে থাপ্পড়ও কষায়। তারপর হয় এর পরিসমাপ্তি।

বাঁকা অওরত বাঁকা তার কথা। তার আকাঙ্ক্ষাও বাঁকা। কী চায় মনিয়া। সত্যি কী মোনালিসা হতে চায় সে! কী করে হওয়া যায় তা তো জানা না ভুনু।

মনিয়া মুক্ত হতে চায়। কীসের মুক্তি? তার শরীরের মাঝে বন্ধ মহাসমুদ্রের মুক্তি। সে কি, মৃত্যু? না, না, এ দুনিয়াতে কেউ তোমরা অওরতের দুঃখ বোঝে না। নিজের মধ্যে একটা প্রচণ্ড শক্তি আর উল্লাস, তাকে সে আর ধরে রাখতে পারে না। তাকেই সে মুক্তি দিতে চায়।

কে বুঝবে? ভুনু নিজেকে বোঝে না। ভাবে সে নিজে কী চায়। এক এক সময় মনে হয়, জিন বাঁধা লাগামের বন্ধন ছিঁড়ে সে শুধু উন্মুক্ত মাঠে ছেড়ে দিতে চায় তার রাজারানিকে।

.

ভজু বলে, বাঁড়ুজ্যেদা, রোজ ঘুম থেকে উঠে দেখি একটা করে বছর চলে যায়। চুল যে আমার সব পেকে যাচ্ছে।

ভবনাথ চুপ করে থাকেন। দেড় বছর হয়ে গিয়েছে, প্রথম প্রেমের গোপন বেদনা তার বৃদ্ধ হৃদয়টিকে দুমড়ে ফেলেছে। ভজুকেও পারেন না সে কথা বলতে। একী হল? ঘরবার যে সমান হয়ে গেল। একে কি ভীমরতি বলে? হবে বা, কিন্তু বুকে যে ঝড়, রক্ত যে তোলপাড়। যুবকদের কী প্রেমে পড়লে এমনি হয়? নিদ্রাহীন রাতে কেবলি সেই নারীর মুখ। নারী নয়, হায়, সে যে গাড়োয়ানের বউ!

ভজু হাঁফায়। গায়ে সব সময়েই যেন জ্বর। পেটে যেন কী হয়েছে। মনে হয় যেন অনেকগুলো বিষফোঁড়া হয়েছে। তবু বিলিতি আরসিতে মুখ দেখে, আর বলে,

সাদা চুল দেখেছ বটে, মনটি কিন্তু রাঙ্গা,
সাকী তুমি যতই না, এ দিলে যাবে না ভাঙ্গা।

আর আজকাল সে যখন তখন ভবনাথের কাছে কেবলি শ্রীমতী কাফে, গৌর, নিতাই, যুঁই, এদের প্রসঙ্গে পেড়ে বসে। একটা দারুণ অস্থিরতা ও দুশ্চিন্তা যেন তাকে ধীরে ধীরে ময়ালের মতো গ্রাস করছে।

মাঝে মাঝে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কানুর দিকে। সে এখন রীতিমতো রথীনদের দলের সঙ্গে কাফের পেছনে বৈঠক করে। তাকে এসে প্রণাম করে আর বলে, জানেন, সেই বইটা আমি পড়েছি, অনেককে দিয়েছি পড়তে। আমাদের পথ কেউ রোধ করতে পারবে না।

এ-অঞ্চলে ঝড় এনে দিয়েছে সরসীর সিঁথির সিন্দুর। সে বিয়ে করেছে সুনির্মলকে, আচমকা স্টার্ট দেওয়া মোটর ঝাঁকানির মতো অন্তঃপুরের বিধবারা যেন ঝাঁকানি খেয়েছে। শ্রাবণে যেন চৈত্র এসেছে। এতবড় পুরুষ কে?

সুনির্মল। কিন্তু সরসীর সিঁথির ঔজ্জ্বল নেই তার চোখে। তাদের পুরনো আমলের নোনা ধরা বাড়িটার অন্ধকারের মতো ছায়া চেপেছে তার চোখে। সন্ধ্যা-আহ্নিকে স্তব্ধ তার মায়ের মতো হৃদয় স্পন্দন যেন নিঃশব্দ। দেরি হয়েছে, বড় দেরি হয়ে গিয়েছে। সরসীর সমস্ত উষ্ণতাও আর যেন টিকিয়ে রাখতে পারে না।…

এখানকার একটি স্কুল কমিটি চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে সরসীকে। সরসী চলে যাবে সুনির্মলকে নিয়ে, সমুদ্রের তীরে, কোনও স্বাস্থ্য নবািসে। এত সহজে হাল সে ছাড়বে না। আবার যে সে সিদুর পরেছে এখনি মুছে ফেলার জন্য? না, তার জীবন-তারার মতো ওই সিন্দুর বিন্দু কিছুতেই হারাতে দেবে না সে।

.

ভুনু। ডাকতে ডাকতে ভুনুর আস্তাবলের ভেতরে বাড়ির ভেতরের গলি মুখটার কাছে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন ভবনাথ। এ কী করছেন তিনি, একী? চরিত্রবান ভবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রিটায়ায় রেলওয়ে কর্মচারী, ঘর ভরা তিন ছেলে, এক বউ।… কিন্তু বুক যে পুড়ে গেল গোপন প্রেম যে আর সহ্য হয় না। আজ মুত্যুকে ধ্রুব করে এসেছেন। এর শেষ চাই।

মনিয়া বেরিয়ে এসে থমকে দাঁড়াল। দেখল, শান্তশিষ্ট এক বুড়ো ভদ্রলোক, হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। পলকহীন চোখে তার একটু বিস্ময়, একটু বা আর কিছু। কিন্তু প্রসন্ন চাটুজ্যের মতো খারাপ মনে হল না।

মনিয়ার ঘোমটা নেই। কাজের ফাঁকে সামান্য আঁচল টেনে দেওয়া বুকে। তার শরম হল না। বলল চোখ তুলে, উ তো ঘর মো নহি হ্যায় বাবু।

ভবনাথের গোঁফ কেঁপে উঠল, হাত পা কাঁপছে থরথর করে। ভাঙা গলায় বলে উঠলেন, তোমার কাছে এসেছি।

মনিয়া হতবাক। লোকটা কীরকম বোকা হয়ে গেছে যেন, একটা ভাল মানুষ কীসের শোক পাওয়ার মতো। দুপা এগিয়ে আবার দাঁড়াল। মনিয়া তাজ্জব। লোকটা কেঁদে ফেলবে নাকি? কোনও দুঃসংবাদ এসেছে, তার মরদের গাড়িতে যাবে বুঝি? কিন্তু মনিয়াকে চায় কেন? সেও এগিয়ে এল, জিজ্ঞেস করল, আপনি কে আছ বাবু।

ভবনাথ একেবারে হতভম্ব শিশুর মতো বলে ফেললেন, আমি? আমি ভবনাথ, ভবনাথ বাঁড়জ্যে। চাকরি থেকে রিটেয়ার করেছি। আমি–আমার বড় ছেলের বিয়ে হয়েছে, আমার–

হঠাৎ ভবনাথের গলা বন্ধ হয়ে গেল, সব ঝাপসা হয়ে গেল চোখের সামনে। তার বুকটার মধ্যে যেন গলানো উত্তপ্ত সীসা ঢেলে দিয়েছে কে। মুহূর্তে সব জমে তাকে একেবারে পাথর করে দিল। তাঁর মনে হল, নিজের মুখটা যেন একটা কালো জানোয়ারের মতো দেখাচ্ছে। তিনি ফিসফিস করে বললেন, মিনিলোসা, আমি ভবনাথ।

বলে তিনি দু হাতে মুখ ঢেকে সেখান থেকে কাঁপতে কাঁপতে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। মনিয়া অবাক হয়ে পেছন পেছন এসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে খালি বলল, মিনিলোসা…ভওনাথ।

সন্ধ্যাবেলা এলেন ভবনাথ শ্রীমতী কাফেতে। এক হাতে সুটকেশ, আর এক হাতে ছোট বিছানা। বললেন, ভজুলাট ভায়া, আজকে রাত্রেই রওনা হলুম হরিদ্বারের দিকে।

ভজুলাট মাথা এলিয়ে পড়ে আছে। শুধু মদের নেশায় নয়, অসহ্য পেটের যন্ত্রণায়। ব্যথায় প্রায় সংজ্ঞা নেই তার। খালি বলল জড়িয়ে জড়িয়ে, চলো, যাচ্ছি।

ভবনাথ তার মাথায় হাত রেখে বললেন, সেই ভাল, ভাই। বলে হেসে চোখের জল মুছে চলে গেলেন।

.

পিওন চিঠিটা দিয়ে গেল শ্রীমতী কাফেতে। আন্দামানের চিঠি। অসীম সমুদ্রের দূর দ্বীপ থেকে আসা এক ঝলক রোদ।

খুলতে গিয়ে ভজু মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে। পেটের নাড়িতে নাড়িতে সহস্র বিস্ফোটকের যন্ত্রণা। সমস্ত লিভারটা যেন বিষাক্ত পুঁজ রক্তে ফুলে উঠেছে। চিঠিটা দুমড়ে যেতে লাগল হাতের মুঠোয়। মেঝেতে হেঁচড়ে যেতে লাগল মুখ। পথের নিশানা এসেছে, মুক্তির সন্ধান এসেছে, খুলে পড়তে চায় ভজু।

ভুনু দেখে তাড়াতাড়ি নেমে এল গাড়ির উপর থেকে! দুহাতে ভজুকে তুলে ডাকল, ঠাকুর, লাটবাবু? ব্যথায় নীল মুখ ভজুর শব্দহীন।

চরণ ভুনুর গলার স্বরে বেরিয়ে এসে ব্যাপারটা বুঝল। বলল, ব্যথা উঠেছে, বাড়ি নিয়ে যেতে হবে।

ভুনু বলল, আমি নিয়ে যাচ্ছি।

হাতে চিঠিটা মুঠো করা অবস্থায় ভুনু ভজুকে পাঁকাকোলা করে গাড়ির গদিতে শুইয়ে, চালিয়ে নিয়ে গেল।

বাড়ির সামনে গিয়ে নামতেই বারান্দা থেকে নিতাই চেঁচিয়ে উঠল, মা বাবা মাতাল হয়েছে, ভুনু কোচোয়ান নিয়ে এসেছে।

যুঁই ছুটে বেরিয়ে এল। ভুনু নিয়ে তাকে শুইয়ে দিতেই যুঁই আর্তনাদ করে উঠল, এ কী, এ কী মুখ হয়েছে, হাত পা এত ঠাণ্ডা কেন?

সব ছেলেমেয়েরা ছুটে এল। নিতাই বলল, মদ তো ঠাণ্ডাই।

হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে যুঁই দেখল, খোলাই হয়নি, দুঃসংবাদের কারণ তো নয়। তবে এমন হল কেন? সে ডাকল ভজুর বুকে হাত দিয়ে, ওগো, ওগো সব শুনছ? কী হয়েছে তোমার? পেটে ব্যথা? ভজু কোনওরকমে ঘাড় নাড়ল, আর কী সব বিড়বিড় করতে লাগল। যুঁই বলল, ভুনু, একবার ডাক্তারকে ডেকে দাও।

ভুনু ছুটল। যুঁই রান্নাঘরে গিয়ে গরম জল বসিয়ে দিল। তারপিন তেল ফেলে দিল দু ফোঁটা। ফ্লানেল বের করে আবার ভজুর কাছে ছুটে গিয়ে বসল সে।

এমন অবস্থা তো কোনওদিন দেখেনি। হাত পা যে ক্রমাগত ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। সে বলল, ওগো, কতদিন যে তোমাকে বলেছি, কতদিন। আজ একী করছ, একী করছ, তুমি?

ছেলেমেয়েরা সবাই বুক টনটনানি নিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কেবল নিতাই যেন রাগ করে বসেছিল বাপের কাছে। কেন এত মদ খাওয়া?

ভজু বলল স্তিমিত গলায়, চিঠি–

যুঁই বলল, পড়ব?

ভজু ঘাড় নাড়ল। যুঁই চেঁচিয়ে পড়তে লাগল,–

কল্যাণীয় ভজু,

তোর চিঠি পেয়েছি। জানিস তো চিঠি আসতে কত দেরি হয়। তুই মনটা অত উতলা করিস কেন। তোরাই আমাকে দেখতে চাস আমার বুঝি তোদের দেখতে ইচ্ছে করে না? অত ভাবিসনে। দ্যাখ, মানুষ চিরদিন একরকম থাকে না। আমিও নেই। তোর সেই ছোটকালের কথা মনে আছে, আমি সাধু হয়ে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলুম? সেটা কতবড় পাগলামি। বৃথাই ভগবান বলে চেঁচিয়েছি। বারবার যে হাত তুলে নমস্কার করেছি আকাশের দিকে তাকিয়ে, সে যে তাদেরই, তোরাই সে যে। প্রমীলাকে বলিস, বাইরে গেলেই দেখা করব…

তারপর কালি লেপে দিয়েছে চিঠিটাতে। যেন দ্বীপের পরে অথৈ সমুদ্র।

ভজু তা বুঝল। তার দুই চোখের পাতা ভিজে উঠেছে। সে বলল ভাঙা গলায়, যুঁই। গৌর, নিতাই, শামু, মিনি–

আবার চুপ হয়ে গেল। যুঁই বলল, বলল কী বলছ, বলো।

ডাক্তার এলেন। এসেই তাঁর চোখ মুখের ভাব একেবারে বদলে গেল। ভজুর হাত নিয়ে নাড়ি। দেখলেন।

যুঁই ডাকল, ডাক্তারবাবু।

ডাক্তার বললেন আচমকা নিশ্বাস ফেলে, উনি যা চান, ওঁকে তাই দিন।

কী বললেন, কী বললেন। যুঁই ড়ুকরে কেঁদে উঠল।

ভজু হঠাৎ পরিষ্কার গলায় ডাকল, যুঁই মণি, কাঁদিসনে। এদিকে আয়, আমার ছেলেমেয়েকে আমার কাছে দে। যুঁই তাড়াতাড়ি সব ছেলেমেয়েকে তার কাছে এনে দিল। বলল, ওগো তুমি কী চাও একবার বলো?

ভজু দুহাতে ছেলেমেয়েদের জড়িয়ে এনে বলল, আমাকে একটু মদ দাও।

ডাক্তার বললেন, মদ?

যুঁই তাকাল ডাক্তারের দিকে। তীব্র ব্যাকুল দৃষ্টি তার।

ডাক্তার আবার একবার ভজুর হাত তুলে নাড়ি দেখলেন। কিন্তু মুখ আরও কালো করে চুপ করে রইলেন তিনি।

যুঁই বলল, বাধা দেবেন না ডাক্তারবাবু, আমাকে দিতে দিন। আর কোনওদিন যে চাইবে না।

বলে সে পাগলিনীর মতো পাশের ঘরে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখল তার শ্বশুর, তার স্বামীর মদটুকু সব খেয়ে, বোতলটি নিয়ে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এই মাত্র যেন ঝড়-ভাঙা গাছটা পাতাডালপালাহীন অবস্থায় দুমড়ে হা করে রয়েছেন। বুঝি পড়ে যাবেন এখুনি।

যুঁই চিৎকার করে উঠল পিচাশ..রাক্ষস!..

ভজুর গলার স্বর বন্ধ হয়ে আসছে। তবু বলছে, ভেবেছিলুম কত ভয় করবে, কত ভয়। না, ভয় নেই যুঁইবাবাকে ডাক।–

তারপর ফিসফিস করে বলল,

কথা বল হে মৌন রাত,
চোখ চাও…
মুক্তি দাও।…

ভুনু দশ বছর আগের মতো আচমকা ঘোড়া দুটোকে ছুটিয়ে বেরিয়ে গেল। হট যাও-মত রোখো রাজা-রানি চল। কিন্তু কোথায় যাবে সে। মনে হল তারও জীবনে, যৌবনের অধ্যায় আজ শেষ হয়ে গেল।

শ্রীমতী কাফের দরজা কয়েকদিন বন্ধ রইল। কাচের দরজায়, শ্রীমতী কাফে, ভিতরে আসুন কথাটাতে সামান্য ধুলো পড়ল। চরণও ভজুর বাড়িতে রাত্রে শোয়। বারান্দায় শুয়ে রইল কয়েকদিন একটা কুকুর তার সঙ্গে কুটে পাগলা। শুধু প্রিয়নাথেরা যেন ঘরছাড়ার মতো কিছুদিন এ-দিক ওদিক ঘুরে বেড়াল।

তারপর আবার ভোলা হল একদিন। গৌরকে বসিয়ে দিয়ে গেল তার বাপের চেয়ারটাতে তার মামা।

ভুনু হাঁ করে তাকিয়ে রইল ছেলেটার দিকে। শ্রীমতী কাফের আর এক পর্ব শুরু। কেবল ভুনুর মনে হল, ছিমতি যেন আজ বেওয়া বাউরী হয়ে গিয়েছে। হাঁ, এ তত লাটবাবুর অওরতের মতোই। লাটবাবুর প্রাণের ছিমতি কাফে।

.

তারপর উনিশশো আটচল্লিশ সালের শেষ দিকে একটি দিন। দীর্ঘ দিন চলে গিয়েছে। দীর্ঘ কতকগুলি বছর। তার মাঝে গেছে সর্বগ্রাসী যুদ্ধ আর মন্বন্তর। মানুষ মরেছে লক্ষ লক্ষ। শহিদ হয়েছে শত শত বিয়াল্লিশ সালের সংগ্রামে, ছেচল্লিশের আজাদ হিন্দ দিবসে।

কিন্তু আজকের এই সকালে শ্রীমতী কাফে দাঁড়িয়ে আছে তেমনি। না, তেমনি নয়, একটু অন্যরকম।

সাইন বোর্ড আছে তেমনি। তবে একদিকে কাত হয়ে পড়েছে। বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে। অস্পষ্ট হয়েছে লেখাগুলি। দরজাগুলি পুরনো হয়ে গিয়েছে। চেয়ারগুলি হাল আমলের রূপ ধরেছে। ভেতরে ছবিগুলির অধিকাংশ নেই। নেই ভজনের সেই প্রিয় ছবি রবীন্দ্রনাথ, মেরি, সিরাজদ্দৌলা, আর র‍্যাফেলের মা। নেই নারায়ণের ছবি। ঘড়িটার লেখাগুলি ক্ষয়ে গেছে। ঘড়িটার নীচে একটা কাগজে লেখা হয়েছে, লিকার স্ট্রিকটলি প্রোহিবিটেড।

প্রোপ্রাইটরের চেয়ারে বসে আছে একটি নির্জীব মতো লোক। চেহারায় নির্জীব, চোখে মুখে বুদ্ধির চাপ লক্ষ করা যায়। লোকটা একমনে কাগজ পড়ছে। ” তার পাশে ঝুঁকে আছে একটা ছেলে। ছেলে নয়, যুবক। এক মাথা কালো কোঁকড়ানো চুল, লম্বা শক্ত গড়ন। টানা টানা চোখ, কিন্তু বিবর্ণ। বয়সের চেয়েও মুখটা পাকা। একটা কঠিন নিষ্ঠুরতার ছাপ।

ঝুঁকে আছে দুই বগলে দুটি ক্রাচ চেপে। হাঁটুর খানিকটা উপর থেকে তার একটা পা নেই। হাফ প্যান্টের তলা দিয়ে একটা পা নেমে এসেছে আর একটার তলায় গোল একটা মাংসের ডালা থলথল করছে। তার ওই নরম মাংসের ড্যালাটা প্রায় একটা কাবুলি এসে টেপে আর খিস্তি করে হাসে। ছেলেটাও হাসে তার পায়ের দিকে তাকিয়ে। বলে, কেটে দেব মাংসটুকু।

সে শ্রীমতী কাফের বাবুর্চি। বয়। নাম তার নিতাই, ভজুর ছেলে।

 ভজনের মৃত্যুর পর গৌর বছরখানেক দোকানে বসেছিল। কিন্তু আশ্চর্য, স্বল্পভাষী সুন্দর গৌর একবছরের মধ্যে একেবারে অন্য ধরনের হয়ে গিয়েছিল। নানান কুসংসর্গে পড়ে তার চরিত্র সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ ধারণ করেছিল। তার পক্ষে শ্রীমতী কাফের হুইল ধরা সম্ভব হয়নি। কিছুদিন সেটা এখানকার নিচু শ্রেণীর বদমাইশদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল।

প্রতিবাদ করার ছিল একমাত্র চরণ। প্রতিবাদ প্রিয়নাথও করেছে। কিন্তু গৌর তাদের সোজা পথ দেখিয়ে দিয়েছে।

কংগ্রেসের সবাই এমনিতেই তখন সরে গিয়েছে। হীরেন এখন কলকাতাবাসী। কৃপাল কংগ্রেসী এম এল এ। সে যখন এখান দিয়ে মোটরে করে যায় তখন একবারও তার স্মৃতিপথে এই শ্ৰীমতী কাফের কথা মনে হয় না।

প্রিয়নাথ একদিন গিয়ে যুঁইকে বলেছিল গৌরের কথা। যুঁই শুধু বলেছিল, ওটা ওরা বাপের সম্পত্তি ঠাকুরপো। আর গৌর যে এমনি হয়েছে, তাতে আমি একটুও অবাক হইনি। না হলেই ভাবনায় পড়তুম। তা, ও যদি শ্রীমতী কাফেটাকে একেবারে শেষ করে দিতে চায়, দিক। একবার ঘুচে গেলে আর শুনতে হবে না কিছু।

প্রিয়নাথ যুঁইয়ের মুখের দিকে আর তাকাতে পারেনি। প্রিয়নাথ হয় তো আরও কিছু করত, কিন্তু ঠিক সেই সময় কমিউনিসট পার্টিকে সরকার বেআইনি করে দিল। আত্মগোপন করল প্রিয়নাথ।

একবার শেষবারের মতো মাথা চাড়া দিয়ে উঠলেন হালদার। এই বয়সে, পাড়ায় ঘুরে ঘুরে শ্ৰীমতী কাফেটা তিনি একজনকে লিজ দিলেন।

ততদিন গৌর ঘোষ উচ্ছঙ্খল হয়ে উঠেছে। বিড়ি সিগারেট ছাড়িয়ে নেশার দৌড় তার অন্যদিকেও গেল। চরিত্রেও দোষ দেখা দিল।

যুঁই একটা প্রাণহীন পুতুলের মতো সব তাকিয়ে দেখেছে। সে দুঃখিত না বিস্মিত, কিছুই তার চোখ দেখে বোঝা যায়নি। রাত্রে ঘুমন্ত গৌরকে দেখত সে। মনে হত, তার স্বামী শুয়ে আছে যেন। পরমুহূর্তেই তার গায়ের মধ্যে ঘৃণায় কাঁটা দিয়ে উঠত। ভজন আর গৌর, এ যেন স্বর্গ মর্তের তফাত।

কিন্তু কী আশ্চর্য। শ্রীমতী কাফে বছরে বছরে কেবলি হাত বদলি হয়ে চলল। সবাই নাকি খালি লোকসানই দেয়। শ্রীমতী কাফের প্রোপ্রাইটারের চেয়ারটা যেন অভিশপ্ত, অভিশপ্ত দোকান। এখানে কেউ-ই বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। কেউ কেউ বলে, ভজুলাটের ভূত চেপে আছে দোকানটায়। এ আর কেউ চালাতে পারবে না।

সত্যি, চলে না। যারা লিজ নেয়, তাদের একটা মাসিক টাকা যুঁইকে দেওয়ার চুক্তিতে আবদ্ধ হতে হয়। কিন্তু বেশিদিন সেই চুক্তি পালন করা চলে না। অথচ এই শ্ৰীমতী কাফে একমাত্র ভরসা। যুঁই যা-ই বলুক, শ্রীমতী কাফে না থাকলে তারা খাবে কী।

এতদিন বাদে দেখা যাচ্ছে, এই শেষ মুহূর্তে হালদার বিচলিত হয়ে উঠছেন। যেন এইজন্যই তিনি বেঁচে রয়েছেন। বৃদ্ধা বকুলমা বিরক্ত হন যুঁইয়ের উপর। বলেন, এ মানুষটাকে তোমরা শান্তিতে মরতেও দেবে না। যুঁই ভাবে, সত্যি, যাকে বাঁচিয়ে রাখা উচিত ছিল তাকে রাখতে পারিনি। কাকে বলব, কাকে জানাব সে কথা। যাকে না বললেও সব বুঝতে, যাকে না দিলেও ঠিক নিয়ে নিত, সে তো আজ আর নেই। সেদিন যে ব্যথার মাঝে আগুন ছিল। আজ সে ব্যথা ও আগুন, কিছুই নেই।

নিতাইকে একটা মোটর কারখানায় ভরতি করার কথা হয়েছিল। কিন্তু তার একটা পা কেটে ফেলতে হয়েছে। ও যে দস্যি ছেলে। গাছ থেকে পড়ে পা কেটে সামান্য ঘা হল। সেই ঘা পচে উঠে পাটাকে বাদ দিতে হল। যেন সময় বুঝে, ঘর বুঝে ও পঙ্গু হয়ে বসে রইল। কোথায় গেল তার দস্যিপনা, কথায় কথায় আসি ও রাগ। কাচটি বগলে দিয়ে সে প্রথম দিকে রোজই চলে যেত নিরালা গঙ্গার ধারে। কেবলি বাবাকে মনে পড়তে। তারপর মনে মনে কী একটা ভেবে সে যুঁইয়ের কাছে ছুটে আসত। কিন্তু মুখ দিয়ে কিছু বলতে পারত না। শুধু ক্ৰাচটি বগলে চেপে দাঁড়িয়ে থাকত। যুঁই বলত, অমনি করে দাঁড়াসনি নিতু, একটু বসে থাক।

তারপর বিয়াল্লিশ সাল গিয়েছে। নিতাই বসে থাকতে পারেনি। ক্ৰাচটি বগলে দিয়ে সে রোজ বসে থেকেছে শ্রীমতী কাফের বারান্দায় গিয়ে। মালিক বদল হয়েছে কাফের। কোনও রাজনৈতিক দলের সভা বৈঠক সেখানে কিছুই হত না। তবু পুলিশ শ্রীমতী কাফে তখন তন্ন তন্ন করে তল্লাশি করেছে। তীক্ষ্ম সন্দেহান্বিত চোখে তাকিয়ে দেখেছে এক পা ওয়ালা নিতাইকে।

মানুষ না থাক, শ্রীমতী কাফের ইটের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ইন্ধন। শ্রীমতী কাফে যতদিন থাকবে, ততদিন এ অঞ্চল নিশ্চিন্ত হতে পারবে না।

কিন্তু নিতাই সেজন্য আসে না। সে আসে শ্রীমতী কাফের উপর নজর রাখবার জন্য। কাফের কোনও ক্ষতি না হয়। তার কোনও অধিকারই নেই, তবু সে নিজে, প্রত্যেকটি জিনিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে যায়।

পেছনের অন্ধকার ঘরটা উঁকি মেরে দেখে। দরকার হলে নিজেও ঝাটা বুলিয়ে দিয়ে যায়। তখনও সে ভাবতে পারেনি এ ঘরে একদিন তাকে আসতে হবে কাজের জন্য। এই ঝুল পড়া অন্ধকার ঘরটা একদিন তার রোমান্সের লীলাভূমি ছিল। এ ঘরটাকে সে নিজের বলে ভাবতে পারেনি। কেন না, এখানে ভূত আছে। এটা কালো ঘর।

তারপর কমিউনিসট পার্টির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে গিয়েছে। আবার বাইরে বেরিয়ে এসেছে প্রিয়নাথেরা। জাপান-বিরোধী আন্দোলন তখন কমিউনিস্টদের মুখ্য কাজ। কিন্তু ফ্যাসি-বিরোধী যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি তারা বোঝাতে পারেনি দেশকে, ফলে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ার মাঝখানে অপমানে ও বিদ্রূপে ছিন্নভিন্ন হতে হয়েছে তাদের। কিন্তু হার মানেনি।

আস্তে আস্তে দেখা গেল, শ্রীমতী কাফের দায়িত্ব যারা এর পর নিয়েছে তারা সকলেই কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের লোক। ফলে, সেখানে রাজনৈতিক কোলাহল, এমন কী হাতাহাতি, মারামারিও হয়েছে।

আন্দামান থেকে মুক্ত হয়ে এসেছেন নারায়ণ। যুঁইয়ের মনের মধ্যে হয় তো এমনি একটা আশা ছিল, নারায়ণ এবার সংসারে দায়িত্ব নেবেন। বোধহয় উচিত-বিবেচনায় নারায়ণও কিছুদিন চেষ্টা করেছেন।

সে চেষ্টা দেখে, ঘোমটার আড়ালে হাসতে গিয়ে যুঁই কেঁদে ফেলেছে। সে অনেকদিন কাঁদেনি। কাঁদতে হল নারায়ণের অবস্থা দেখে। সমুদ্রের এক অন্ধকার দ্বীপ থেকে মুক্ত হয়ে, আর এক জায়গায় এসে তিনি বন্দি হয়েছেন। যুঁইয়ের বন্দিশালায় আটক পড়েছেন তিনি। তার কাছে দৈনিক অনেক লোক আসে, তাঁর অনেক কাজ বাইরে। তাঁর জন্য অনেকে প্রতীক্ষা করে আছে। কিন্তু কেমন করে যান।… ভজন যে ভাসিয়ে রেখে গেছে সব। এসে দেখলেন, এ সংসারের দিন চলে না। গৌরকে সারাদিন খুঁজে পাওয়া যায়। নিতাই পঙ্গু। আর একটি ছেলে আছে, মন্টু। সে সারাদিন একটা সাইকেল মেরামতের দোকানেই পড়ে থাকে। কাজ শেখে। লেখাপড়া করাবার মতো পয়সাও নেই। তাকে নারায়ণ আর বেরুতে দেন না কোথাও।

কিন্তু তিনি কী করবেন। আজ তাঁকে কী নতুন করে আবার সংসারের পথে যাত্রা করতে হবে। তাতে তিনি নিজে বা সংসার, কোনওটাই যে টিকবে না।

তাঁর এ অবস্থা দেখে যুঁই আর চুপ করে থাকতে পারল না। জীবনে প্রথম সে ঘোমটার সমস্ত সঙ্কোচ খুলে ফেলে নারায়ণের সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, আপনি এ ভাবে বসে থাকলে কী করে চলবে?

নারায়ণ লজ্জায়, সঙ্কোচে এতটুকু হয়ে উঠলেন। তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, না বউমা, আমি চেষ্টায় আছি। মানে, সংসারের সব ব্যাপার তো সব সময় বুঝে উঠতে পারিনে, তাই একটু—

সংসারের কথা বলিনি। আপনার সংসার তো শুধু এটাই নয়, আরও অনেক আছে।

নারায়ণ বুঝতেই পারেনি, যুঁই তাঁকে বিদ্রূপ করেছে কিনা। যুঁই বলল, এ ভাবে সব ছেড়ে দিয়ে আপনাকে আমি ঘরে বসে থাকতে দেব না। আপনার জন্য এত মানুষ বসে আছে–

না না বউমা, সংসারে কেউ কারও জন্য বসে থাকে না।

যুঁই জোর করে বলল, থাকে। নিজের চোখে তো দেখতে পাচ্ছি। আপনাকে দেশের মানুষ নির্বাসন থেকে মুক্ত করে নিয়ে এসেছে। আমি তো তার থেকে বাদ নই। আপনি চলে যান তাড়াতাড়ি, আপনার কাজে হাত দিনগে। আমাকে আর অপরাধী করবেন না।

নারায়ণের বুকের মধ্যে ফানুসের মতো ফুলে উঠল। চোখ দুটো তার কিছুতেই শুকনো থাকতে চাইছে না। বললেন, কিন্তু সংসার

যুঁই বলল, চলবে। বরং আপনি জানাশোনা একজন ভাল লোকের হাতে দোকানটা দিয়ে যান।

নারায়ণ ভাবছিলেন, ভজন ভাসিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার শ্রীমতী কাফেই আজ সব ভরসা।

একদিন শেষ মামলায় হেরে হালদারমশাইও ভজনের চায়ের দোকানটিকেই ড়ুবন্ত মানুষের তৃণকুটোর মতো জ্ঞান করেছিলেন।

কিন্তু আরও কিছু বলার ছিল যুঁইয়ের। বলল, প্রমীলা ঠাকুরঝি মারা গেছেন।

সংসারটা জানতেন না নারায়ণ। কয়েকমুহূর্ত তিনি অবুঝ পাগলের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপরে বললেন, ও! মারা গেছে? কবে?

বছরখানেক। আপনাকে একবার দেখবার…

বউমা। নারায়ণ থামিয়ে দিলেন যুঁইকে। তিনি আর শুনতে চান না। পারছেন না শুনতে। কানের মধ্যে বাজছে খালি একটি কথা, একবার যদি তুমি না আসো, তা হলে জীবনের সবটাই বাকি থেকে যাবে।

যুঁই বলল, যদি কখনও রানাঘাট যান, তবে একবার প্রমীলা ঠাকুরঝির বরের সঙ্গে দেখা করবেন। ঠাকুরঝি বলে গেছেন।

গিয়েছিলেন নারায়ণ, দেখা করেছিলেন প্রমীলার বরের সঙ্গে। অত্যন্ত সাধারণ মানুষ। অবস্থাপন্ন লোক। বয়স হয়েছে যথেষ্ট। আর বিয়ে-থা করেননি। নারায়ণকে বলেছিলেন, অনেক চেষ্টা করেছিলাম মশাই ধরে রাখবার, আপনি বড় দেরি করে ফেললেন। বিয়ে হওয়ার পর থেকে শুধু তাকে ধরে রাখাই আমার কাজ ছিল। তা আপনি যে এত দেরি করবেন, মানে, তারও তো একটা মানুষের জান ছিল। কাহাঁতক সে আর….

নারায়ণ তাঁকে নিরস্ত করবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ভদ্রলোক বলেছিলেন, না না, মশাই বলতে দিন। এই সামান্য কথা কয়টি না বললে আমারও যে ছুটি নেই। আপনার কি, দিব্যি কোনওদিন পুলিশের গুলি খেয়ে ফট করে মরে যাবেন, ব্যস হয়ে গেল। আর আমি? আমি কী করব?

হাসতে গিয়ে ভদ্রলোকের চোখের জল দেখা দিয়েছিল। বলেছিলেন, মশাই, আমি আর চুপ করে থাকতে পারছি না, বুঝলেন। এই যে নবীন, একেও সে আপনাকেই দিয়ে গেছে। আর আমি। আমাকে যদি নেন, মাইরি বলছি…আমি আর কিছুতেই একলা থাকতে পারছি না।….

নারায়ণ জোর করে প্রমীলার স্বামীর হাতটি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে খালি বলেছিলেন, আপনি একটু চুপ করুন। তারপর নীরবে তারা দুজনেই অসীম শূন্যে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। অনেকক্ষণ।

তারপর আবার শ্রীমতী কাফে। নারায়ণ যতীশ বলে একটি ভদ্রলোকের হাতে শ্রীমতী কাফে তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন। ভদ্রলোককে অনেকে কমিউনিসট ভাবাপন্ন বলে জানতেন।

প্রিয়নাথদের অহোরাত্র আড্ডাস্থল ওইটাই। লোকে বলে, রেস্টুরেন্ট নয়, কমিউনিস্ট পার্টির অফিস। সত্যি, তাদের দলের প্রাদেশিক নেতারাও এ অঞ্চলে এলে একবার শ্রীমতী কাফেতে আসেন। তা ছাড়া দিবারাত্রি কমিউনিস্টরা তো আছেই। চা কত কাপ খায়, তার কোনও হিসেব নেই। আসলে জায়গাটি তাদের বড় সুবিধার হয়েছে।

মাঝে মাঝে যতীশবাবু গম্ভীর হয়ে চুপ করে থাকেন। কিন্তু ভদ্রলোক মুখ ফুটে বিশেষ কিছু বলতে পারেন না। কেন না, সময়ে সময়ে উনি নিজেও মেতে যান। মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে তিনি কটু কথাও বলেন। কিন্তু রোধ করতে পারেন না।

নবীন গাঙ্গুলীও এ অঞ্চলের কংগ্রেসি এম এল এ। তিনি একদিন মোটর থেকে নেমে এক কাপ চা খেয়েছিলেন। খেয়ে যতীশকে বলেছিলেন, চায়ের স্বাদটাও দেখছি লাল হয়ে গিয়েছে। আপনি বুঝি প্রিয়নাথদের দলের লোক।

যতীশ তাড়াতাড়ি বলেছিলেন, আজ্ঞে না মশাই। নবীন ভেংচে বলেছিলেন, না মোশাই কেন, হাঁ মোশাই বলুন না। ছি ছি, অ্যাদ্দিনের দোকানটা একেবারে মাটি করে দিলে। নারানটার জন্যই এরকম হল। তুলে দেওয়া দরকার দোকানটা।

কৃপালও বলেছে এরকম কথা। শঙ্করদা কলকাতা কংগ্রেস কমিটির লোক, তিনি সেখানেই থাকেন। হীরেনও কলকাতাতেই থাকে। শোনা যায়, সে আজকাল ভারতের তীর্থক্ষেত্রগুলি ঘুরে বেড়াচ্ছে, প্রাচীন তথ্য সংগ্রহ করছে। বউদি তার সঙ্গে কলকাতাবাসিনী হয়েছেন। বউদিও এখন একজন কংগ্রেসের নেত্রী। এ অঞ্চলে তার নামে সবাই বড় কলঙ্ক দিয়েছে। অর্থাৎ বউদির চরিত্র সম্পর্কে।

তেমনি আছে শুধু কুটে পাগলা। তবে একেবারে বুড়ো হয়ে গেছে। একমাথা পাকাচুল, একমুখ দাড়ি।

কিন্তু চরণ নেই। গৌরের দৌরাত্ম্যের যুগেই শ্রীমতী কাফে ছেড়ে সে চলে গিয়েছে নাড় পুরোতের গলিতে। সে জীবনের পথে ভাসতে চেয়েছিল। কিন্তু একলা সে কোথায় ভেসে যাবে। তার সর্ব পড়ে থাকবে ওই গলিটাতে। পণাঙ্গনা সেই মেয়েটি তাকে আশা দিয়েছে, সময় এলে একদিন দুজনেই তারা বেরিয়ে পড়বে। তারা মুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু সেই মুক্তি আসেনি। তাদের দুজনেরই চুলে পাক ধরতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু সেদিন আসেনি। আজকাল তাকে লোকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে, খিস্তি-খেউড় করে। তার গায়ে খারাপ রোগের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। সে কানা হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। আধকানা চোখ নিয়ে সে মাঝে মাঝে শ্ৰীমতী কাফের সামনে এসে দাঁড়ায়। তাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে যায় নিতাই।

এখানে এসে চরণের মনে পড়ে সেই শিয়ালদহ স্টেশনের কথা। যেদিন তাকে ধুলো থেকে তুলে নিয়ে এসেছিল ভজন, তার মনিব ভজুলাট। অর মনে পড়ে জাহাজের সেই বাবু, নারায়ণ, আর ইরাবতী কুলে সেই গ্রাম, তার জন্মভূমি।

যতীশের আমল থেকেই নিতাই এসেছে শ্রীমতী কাফেতে। সে নিজেই একদিন যুঁইকে বলেছিল, মা, আমি ভাল রাঁধতে পারি। একটা লোক শুধু শুধু মাইনে নিয়ে যায়। দোকানে আমিই রাঁধব। যতীশবাবুকে বলেছি।

ক্রাচ বগলে নিতাইয়ের দিকে খানিকক্ষণ অর্থহীন চোখে তাকিয়ে থেকে বলেছিল যুঁই, বেশ। তোর যদি তাই ইচ্ছে হয়।

যুঁই বুঝেছিল নিতাইকে সে তার বাপের দোকানে আজ চাকর খাটতে পাঠাচ্ছে। মা আর ছেলে কয়েক মুহূর্ত শুধু সামনাসামনি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। আর কিছুই বলার দরকার হয়নি। নিতাই মাটির বুকে ক্রাচের একটা অদ্ভুত খট খট শব্দ করে চলে গিয়েছিল। ক্রাচের সেই খোঁচা এসে লাগছিল যুঁইয়ের বুকে। সে ছুটে গিয়েছিল ছাদের উপর। ফিসফিস করে বলেছিল, কী অদ্ভুত কারখানা-ই না খুলেছিল।

হালদার মরবেন না। বোধ হয় বকুলমা মরতে দিতে চান না। তিনি আছেন সেখানে দিবারাত্র।

হালদারের একটা ইচ্ছা ছিল। ইচ্ছাটা, জমি সংক্রান্ত ওই বেনামা কাগজপত্রগুলি যদি গৌরকে দিয়ে কাজে লাগানো যায়। অর্থাৎ মামলা করানো যায়। সে আশা অনেকদিন নির্বাপিত হয়েছে। আশা ছিল নিতাই। সেও গেল। কিন্তু প্রধান রায় মন্ত্রী হয়েছেন শুনে তিনি আবার আশান্বিত হলেন। মুমূর্ষ শয্যাতেই সেই আশাতে আবার বুক বাঁধলেন তিনি। একদিন এই প্রধান রায়কে এ সমস্ত অঞ্চলের ভোট পাইয়ে দিয়েছিলেন কাউন্সিলের ইলেকশনে। সুরথনাথ বাঁড়জ্যেকে পরাজিত করেছিলেন।

গৌরের একটা সুযোগে সুবিধার জন্য প্রধান রায়কে একটা চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিলেন গৌরের হাত দিয়ে। কয়েকদিন ঘুরে চিঠিটা দিয়েছিল গৌর তাঁকে। জবাবটা এসেছিল কৃপালের মারফত।

জবাব ছিল এখন কিছু করা সম্ভব নয়। আর নারায়ণের ভাইপোর কোনও কাজ সরকারি ব্যবস্থায় নেই।

হালদারমশাই খালি কৃপালকে বলেছিলেন, শিগগির বেরিয়ে যা এখান থেকে। যা।

কৃপাল অসহ্য ক্রোধে বেরিয়ে এসেছিল। এতবড় অপমানের একটা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য খেপে গিয়েছিল সে।

আজ আটচল্লিশ সালের শেষ দিক। কমিউনিসট পার্টি আবার বেআইনি হয়ে গিয়েছে। প্রিয়নাথ আত্মগোপন করেছে। কানু, বাঙালি, মনোহর, ভাগন, তারা সকলেই জেলে!

নারায়ণ অনেকদিন থেকেই বিভিন্ন জেলায় ঘুরছিলেন। তিনি গ্রেফতার হয়েছেন। জেলে আছেন।

.

শ্ৰীমতী কাফে ফাঁকা। আজকাল এখানে কয়েকশো সাইকেল রিকশা সব সময় প্যাঁক প্যাঁক করে ঘোরে। পুষ্পময়ী নেই। এ অঞ্চলে এখন নতুন বাস রুট খুলেছে। ঘোড়ার গাড়িতে কেউই চাপে না। তবু ভুনু আছে। একেবারে বুড়িয়ে গেছে। না, সে কোনওদিন এই ছিমতি কাফেকে বুঝল না, কোথা দিয়ে কী হয়ে গেল। লাটবাবুর ছেলেকে বাবুর্চির কাজ করতে দেখে সে ভগবানের প্রতিও বিমুখ হয়ে উঠেছে। কিন্তু ছিমতির সঙ্গে আর তার সে ভাব নেই। ভাবের লোক নেই, তাই ভাব নেই। মাঝে মাঝে সে চমকে দোকানটার দিকে তাকায়। মনে হয় কেউ যেন তাকে ভুনু সারথি বলে ডাকছে। কিন্তু কেউ ডাকে না। আজকে সে সারথি নয়, শুধু এক বুড়ো গাড়োয়ান।

নেই মনিয়া। মিনিলোসা। সে মারা গেছে। শুন্য কোল নিয়ে, মহাসমুদ্রের মতো অসীম উল্লাস বুকে চেপেই সে মারা গেছে।

ভবনাথের আর কোনও সন্ধান কেউ পায়নি।

শ্ৰীমতী কাফে টিমটাম চলে। চপ কাটলেট খাওয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ কী ভিড় হয়েছে এ অঞ্চলে। পূর্ববঙ্গের বাস্তুবিতাড়িত মানুষের ভিড়। যেন দাবা খেলার ছড়ানো খুঁটির মতো ছড়িয়ে পড়েছে।

তবু শ্ৰীমতী কাফের উপর কড়া নজর। অন্ধকার রাত্রে অদৃশ্য প্রেতের জোড়া জোড়া চোখ পাহারা দিচ্ছে শ্রীমতী কাফে। এর প্রতিটি ইটে ইটে বিস্ফোরণের সম্ভাবনা।

দেওয়ালে দেওয়ালে লাল রংএর পোস্টার পড়ে রাত্রে, এই সরকারকে বিতাড়নের আহ্বান তাতে। খাওয়া পরার দাবি, বাঁচার দাবিতে ক্ষুব্ধ ঘোষণা লেখা থাকে কাগজগুলিতে।

দেওয়ালে, গাছে, পাড়ায় টিকটিকির মতো অনুসন্ধানী চোখ ঘুরছে। কে, কারা দিচ্ছে ওই পোস্টারগুলি। নজরটা সোজা গিয়ে পড়ে শ্রীমতী কাফের দিকে।

তখন হয়তো অন্ধকার শ্রীমতী কাফের ঘরে ঘুম ভেঙে যায় নিতাইয়ের। আজকাল সে এখানেই শোয়। আর তার ঘুম আসে না। ক্রাচ ছাড়া এক ঠ্যাং নিয়ে দাঁড়ায়। ঘুম আসে না, বিচিত্র খেয়ালে লাফিয়ে লাফিয়ে পেছনের ঘরে যায়। যেন একটা এক ঠ্যাংওয়ালা প্রেতের মতো। ঝাঁপটা আটকানো আছে কিনা দেখে। তারপর হঠাৎ লাইটটা জ্বেলে দেয়। অমনি তার কিম্ভুতকিমাকার ছায়াটা ভেসে ওঠে বেড়ার গায়ে।

আচমকা আলোর আঘাতে ছুটে পালায় ইঁদুর আর ছুঁচো। তার গা বেয়ে ওঠে আরশোলা। সে ঝাড়া দেয়, বলে, শালা!

আর তার দিকে তাকিয়ে প্রাণের ভয়ে কুড়কুড় করে খাঁচাবন্দি মুরগিটা। ভাবে, ওই এক ঠ্যাং যম বুঝি এখুনি ক্যাঁচ করে তার গলায় বসিয়ে দেবে ধারালো ছুরিটা। ওই কাটা ঠ্যাং দিয়ে চেপে গলায় ছুরি দেয় সে।

আবার বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে সামনের ঘরে এসে তার বাবার চেয়ারটা দেখে। ওইখানে আর কোনওদিন সে বসে না। বসবার অধিকার নেই তার।

সত্যি, হঠাৎ ভীষণ নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে তার মুখটা। কিন্তু খুব আলতোভাবে কাটা ঠ্যাংটায় হাত বুলোয় সে।

.

যতীশ কাগজ পড়ছেন। ক্র্যাচ বগলে দিয়ে ঝুঁকে দেখছে নিতাই। সকালবেলা। সবে শ্রীমতী কাফে খোলা হয়েছে। রিকশওয়ালারা এখনও সবাই আসেনি। ভুনু আসেনি। যাত্রীর ভিড় হয়নি।

এমন সময় একগাড়ি সশস্ত্র পুলিশ এল। পাশ থেকে নেমে এলেন একজন পদস্থ অফিসার। হাতে তাঁর তল্লাসির পরোয়ানা এবং আরও কিছু। ভদ্রলোক প্রৌঢ়। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল। মোটাসোটা মানুষ। চোখে তার সপ্রশ্ন কৌতূহলিত দৃষ্টি। যেন অবাক হয়েছেন শ্রীমতী কাফে দেখে।

যতীশকে বললেন, আপনি মালিক যতীশ বন্দ্যোপাধ্যায়?

হ্যাঁ।

এ ঘরে কী কমিউনিসট পার্টির গুপ্ত অফিস আছে?

না।

আমরা দেখব।

তল্লাসি খুব সামান্য হল। পাওয়া গেল না কিছুই। রাস্তায় জনতার ভিড় হয়েছে। পুলিশ ভিড় হটিয়ে দিচ্ছে। অফিসারটি সব ঘুরে ঘুরে দেখে হঠাৎ বললেন, আগের ছবিগুলি দেখছি নেই। ভজুবাবুর আমলের সেই সব ছবি।

এই সেই ছোকরা অফিসার। একদিন যে মাথা উঁচু করে এখানে ঢুকতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি। আজ ঢুকেছেন। একদিন যাদের তিনি এখানে ধরতে এসেছেন, তাদের অনেকের হুকুমে আজ তিনি এখানে এসেছেন। যতীশকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কমিউনিসট পার্টির মেম্বর?

যতীশ বললেন, আজ্ঞে না।

আপনাকে একবার থানায় যেতে হবে।

যতীশের মুখে হঠাৎ ছায়া ঘনিয়ে এল। তারপরে বলল, বেশ।

অফিসারটি আবার বললেন, এই নিন সরকারি হুকুমপত্র। এই শ্ৰীমতী কাফেটি আমি তালাবন্ধ করে দিয়ে যাব। গভর্নমেন্ট এটা খুলে রাখতে চান না।

বলে তিনি নিতাইয়ের দিকে ফিরে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন, কী রে ছোকরা, তোর নাম কী?

প্রশ্ন গুনে নিতাইয়ের গায়ের মধ্যে জ্বলে উঠল। তবু বলল, নিতাই হালদার।

বাপের নাম?

ভজনানন্দ হালদার।

অফিসারটি যেন বিশ্বাস করতে পারলেন না। হঠাৎ থতমত খেয়ে গেলেন। আমতা আমতা করে বললেন, ও, মানের ভজুবাবু, ভজুবাবুর ছেলে তুমি?

নিতাই কোনও জবাব দিল না সে কথার। তিনি আবার বললেন, তোমার পাটা কী করে…

নিতাই পেছনের ঘরে ক্রাচের খটখট শব্দে চলে গেল। জল ঢেলে দিল সদ্য জ্বলা উনুনে। খাঁচায় একটা মুরগি ছিল ছেড়ে দিল সেটাকে বাজারের পেছন দিকে। মুরগিটা কয়েক মুহূর্ত এ অভাবিত মুক্তিতে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে ঘাড় নাড়তে লাগল। তারপর বাজারের পেছন দিকটায় ছুটে গিয়ে খুঁটে খুঁটে পোকা খেতে লাগল। সবই নজর করে দেখল একটি সেপাই।

তারপর বাইরের ঘরে এসে যতীশকে বলল, আপনি যান, আমি মাকে গিয়ে বলি সব কথা।

অফিসারটি হঠাৎ ডাকলেন তাকে আবার। অফিসারটি কিছু করতে চান এদের জন্য। ভজু তাকে অনেক অপমান করেছে, তার শোধ দেবেন তিনি এদের উপকার করে। তিনি আবার মাথা উঁচু করে ঢুকতে চান শ্ৰীমতী কাফেতে।

নিতাইকে বললেন, তুমি একদিন কলকাতায় আমার সঙ্গে দেখা করো। বুঝতে পারছি, এটাই তোমাদের শেষ সম্বল। আমি চাই না এটা বন্ধ থাকুক। তুমি এসো, আমি তোমার নামে দোকানটাকে ওপন করে দেব, কেমন? আমিই সব ব্যবস্থা করে দেব। একটু সমঝে চললে, কিছুই হবে না। সত্যি, ভদ্রলোকের ছেলে! আমি গভর্নমেন্টকে রাজি করাব। কেমন?

নিতাই চকিতে একবার তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে অফিসারের মুখের দিকে দেখে দক্ষিণ দিকে ফিরে তাকাল।…অনেক লোক ভিড় করেছে। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। বোধহয় সকলের করুণা হচ্ছে তার জন্য।

কোনও কথা না বলে, খুব জোরে পিচের রাস্তায় ক্রাচের শব্দ তুলে চলে গেল সে। খট খট খট…

অফিসারটি চাপা অস্ফুট গলায় খালি বললেন, সাপের বাচ্চা, শলুই! ননসেন্স। বোধ হয় মাথাটা আজ আবার নতুন করে নিচু হয়ে গেল তাই রাগ হচ্ছে।

.

তারপর দোকানটা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল।

শীতের রুক্ষতা। চারিদিকে ন্যাড়া গাছ। ধুলো আর ধোঁয়া। সব যেন কুঁকড়ে আছে। ওই আকাশ, ধুলো, মাটি সবই।

তবু একটা দক্ষিণের সামুদ্রিক হাওয়ার বেগ থেকে থেকে হুসহুস করে আসছে। শীতের আড়মোড়া ভেঙে আসছে বসন্তের হাওয়া।

নিতাই এসে সব বলল, যুঁইকে। যুঁই শুনল। অবাক হল না। হালদারমশাই শুনলেন, কিন্তু কিছু বুঝতে পারলেন না বোধ হয়। কেননা শুনতে পান না।

নিতাই যুঁইকে বলল অফিসারটির কথা। যুঁই তাতেও বিস্মিত হল না। বরং নিতাইয়ের কঠিন মুখটার দিকে বড় বড় চোখে তাকাল।

তারপর নিতাইয়ের একটি হাত নিজের ঘাড়ে নিয়ে ক্রাচ দুটি সরিয়ে দিয়ে বলল, ও দুটো থাক, আমার উপর ভর দিয়ে একটু দাঁড়া বাবা। ওই দুটো আমি দেখতে পারিনে রে।

নিতাই বলল, তোমার উপর আর কতদিন ভর করব?

যুঁই বলল, ভর করবি কেন? তা বলে আমার বুকে একটু আসতে নেই?

হাওয়া আসছে। উত্তরের চাপ ঠেলে আসছে দক্ষিণ হাওয়া। আর নিতাইয়ের উত্তপ্ত জিভে একটা নোনতা স্বাদ ঠেকছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *