৮. ভুনুকেও একটা অবসন্নতা ঘিরে ধরেছে

ভুনুকেও একটা অবসন্নতা ঘিরে ধরেছে। স্বদেশীর উন্মাদনায় সে পাগল হয়েছিল। তার কী রকম একটা বিশ্বাস হয়েছিল, সমস্ত দেশ জুড়ে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। যদি সেটা স্বরাজ হয়, তবে কী হবে, সেসব সে বোঝে না। কিন্তু এত লেখাপড়া জানা ইমানদার আদমি যখন খেপে গিয়েছে, তখনই নিশ্চয়ই কিছু একটা চাই। যা চাই তা অজানা হলেও তার একটা উত্তেজনা আছে, একটা আকাঙক্ষা আছে। কিন্তু কিছু হয়েছে বলে তার মনে হচ্ছে না।

মন অবসন্ন, তবু লাটবাবুর কথা সে ভুলতে পারে না। পারে না বুঝতে। কিন্তু লাটবাবুর জন্য তার মনে একটা বিস্মৃতি-বেদন লুকিয়ে আছে। শিক্ষিত, ভদ্রলোক আবার মাতাল, অথচ এখানকার আর দশটা মাতালবাবুদের মতো বেশ্যাসক্ত নয়। ভুনুর গাড়িতে চেপে ফোলোবাবুর মতো যায় না, ভাড়াটে বাগানবাড়িতে। এরকম কোন্ লোকটা আছে যে ভুনুর গলা জড়িয়ে ধরে। সে একমাত্র ভজুলাট। কোন্ বাবু তার সঙ্গে দোস্তি করে। লাটঠাকুর। দুটো পয়সার দরকার হলে কে দেয়। শরীফ মেজাজ লাটবাবু। সেই জন্যই তার ভাবনা হয়।

ভাবে, তার নিজের কানা ভাঙা তলা ফুটো সংসারে না হয় অহরহ জ্বালা আছে। তারই না হয়। একটা চাকা ভঙে গেলে, গদি একটা ফেটে গেলে, মাথায় হাত দিয়ে বসতে হয়। তার রাজা-রানী মরে গিয়ে তাকেই না হয় ভিখিরি করে দিয়েছিল। হাঁ, লাটবাবু তাকে টাকা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু টাকা সে নেয়নি। কেন নেবে। লারাইন ঠাকুরের সোনা ছেড়ে এসেছি কি লাটবাবুর টাকা নেব বলে! গাড়োয়ান হতে পারি, তা বলে কি ইমানদারের তেজ নেই! সে ধার করেছে, মনিয়ার গায়ের সব রুপোর গয়না বিক্রি করেছে, বিক্রি করেছে ঘরের যাবতীয় বস্তু। সে রাগ মনিয়ার আজও আছে।

কিন্তু লাটঠাকুরের তখলিফ সে বোঝে না। যেমন বোঝে না সে তার বউ মনিয়ার সবখানি। তার এই ছ্যাকরা গাড়ির গাড়োয়ানের প্রাণে তার রূপসী বউ মনিয়া, (লাটঠাকুর আবার তাকে মিনিবোসা কি বলে) কেবলি কী রকম একটা সংশয়ের আগুন জ্বালিয়ে রাখে। মনিয়ার পেটের খিদেটা সে বোঝে, কিন্তু মনের দুরন্ত খিদেটা এত কেন সে বুঝতে পারে না। হয় তো মনের নয়, সেটা দেহেরই। মনিয়া সব সময়ই পেটে খেতে যেমন ভালোবাসে, দেহের খিদেটাও তার প্রায় সেই রকম! মায়ের কোলে শিশু যেমন কেবলি খায়, খায় আর ঘুমোয়, মানিয়া যেন তেমনি। চলতে ফিরতে হাঁসের মতো তার জৈবিক তাড়না। হয় তো এটা তার শুধুমাত্র স্বভাব। চরিত্র নয়।

তাহলে স্বভাববশেই সে বাঁকা হেসে বলে থাকে, ভুনু কোচোয়ানের বহুড়ি হওয়াটা তার পক্ষে খুবই অপ্রীতিকর। কি তার প্রীতিকর সেটার আন্দাজ নেই বলেই বোধ হয় রঙ্গ করে বলে ভুনুকে, কোনদিন দেখবে কার সঙ্গে ভেগে গেছি। রাগ করলেও সে একথা বলে। বলার পরে তার খিলখিল্ হাসির রন্ শব্দ ভুনুর বুকের আগুন গনগনিয়ে তোলে।

ভুনু তখন ঠাণ্ডা হয়ে থাকলে কী হয়, বলা যায় না। কারণ ভুনু একথা শুনলে ঠাণ্ডা হয় না। এ যদি ঠাট্টা হয়, তবে তা ভুনুর সহোর বাইরে। সে রাগে কিন্তু খেই পায় না।

তা ছাড়া মনিয়ার একটু হল গলা ভাব সকলের সঙ্গে। পড়শি ছোকরারা অনেকে তার রূপমুগ্ধ অনুরাগী। মনিয়ার ভাবটা এমনি যেন, রূপ দেখে যদি কেউ মুগ্ধ হয়, হোক। বলি কোন মেয়েটা তার রূপমুগ্ধকে প্রশ্রয় না দেয়।

তা হলে তার হকার নেই। ভেতরটা তার ভরাট। সেই জন্যই বুঝি খর চোখের তারা দুটো তার সব সময় বিচিত্র অর্থে বেঁকে থাকে। এ-দিক থেকে ভেবে দেখলে, বাইরের জীবনে ভুনুর নায়কত্ব আছে, ঘরের জীবনে আর শুধু নায়িকা।

ভুনুকে পেলে সব ভোলে। যাকে পেয়ে সব ভোলে, আবার তারই প্রাণে কেন এমনি ধারা হুল ফোটানো, সে সৃষ্টিছাড়া মনের কথা জানে মনিয়ার অন্তর্যামী।

তবু ভুনুর জীবন বিস্তৃত। গাড়োয়ান হিসাবে তার চিন্তার ক্ষেত্র খানিকটা প্রশস্ত। তার কাজের মাঝে ও অকাজে ভাবনা যখন বড় হয়ে ওঠে, তখন সে আর মেজাজ রাখতে পারে না। আর মনিয়া যদি খারাপ হয়, তা হলেও এ জীবনে মনিয়াকে ছাড়া তার চলবে না।

বেশ, তার নয় সবটাই শ্রীহীন। কিন্তু লাটঠাকুরের প্রাণে এত বিরাগ কেন? বড় রাস্তার উপরে অমন বাড়ি, স্টেশনের ধারে অমন চা-খানা একটা যার রয়েছে তার ভাবনা কি? চা-খানা নয়, লোকে এটাকে ছিমতি কাফে না কী একটা বলে। যে যা খুশি বলুক সিদানি সাউ যে তার ছোলা ছাতুর দোকানটার নাম দিয়েছে রাম-লছমন ভাণ্ডার। তাতে কী যায় আসে। দোকানটা ভোলা ছাতুরই, জরুর রাম-লছমন পাওয়া যায় না সেখানে। তবে হ্যাঁ, লাটঠাকুরের দোকানে মাংসের রকমারি মজাদার খাবার তৈরি হয়। তার দামও অনেক। ভুনু সে সব প্রায়ই খেয়ে থাকে। ভজুলাট তাকে ডেকে নিয়ে খাওয়ায়। ছিমতি টিমতি একটা কিছু হতে পারে এ দোকানটা।

আর সমস্ত দোকানটার দিকে তাকালে হঠাৎ চোখ ফেরানো যায় না। কিন্তু গণেশ ঠাকুরের মূর্তিটা তার দোকানে আছে কিনা সেটা নজরে পড়েনি কোনওদিন।

আর লাটঠাকুরের ঘরের খবর অবশ্য সে জানে না। জানে না তার বউ ছেলেমেয়ের কথা। তার বাবাকে দেখেছে বাড়ির বাইরের বারান্দায় একটা চেয়ারে সারাদিন গা এলিয়ে দিয়ে বুড়ো মানুষ বসে থাকেন। সামনের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে। দৃষ্টিটা যেন একটু ঘোলাটে মনে হয়। শরীরটা এখনও শক্তই দেখায় কিন্তু সেটা যেন পাতাহীন ঝড়ো রুক্ষ মহীরূহ।

সংসারটা ভরাটই মনে হয়। তবু তার মনে হয় লাটঠাকুরের বুকের মধ্যে যেন কীসের আগুন লুকিয়ে আছে। সে আগুন কীসের তা সে ঠিক ঠাহর পায় না। কিন্তু লাটঠাকুরের সব সময়ের চলাও জ্বালাও, ছাড়া কথা নেই। প্রতি মুহূর্তে তার মধ্যে রয়েছে একটা ছটফটানি মনটার ঝড়ো বেগ, অসহ্য তিক্ততা। এত কথাও হয় তো সে বোঝেনি বুঝেছে তার প্রাণের জ্বালাটা। কাজে কথাতেও লোকটা দ্রুত, বেগবান।

সে ভেবেছিল, লাটঠাকুর হয়তো তার রূপসী বউয়ের প্রেমে পড়েছে। সে প্রায়ই মিনিলোসার কথা বলতো, এখনও বলে। আর লাটঠাকুরদের মতো লোকেরা যখন গাড়োয়ানের বউয়ের কথা এত বেশি বলাবলি করে, তখন বুঝতে হবে, বাবুর মনে রং লেগেছে। ব্যাপারটা ভুনুর ঠেকে শেখা। ছোট ঘরে রূপ থাকে সত্যি। বড় ঘরের রূপের সঙ্গে যেন তা আলাদা। ছোট ঘরের রূপকে ধুলোমাটি ও দারিদ্র্যের মধ্যে থাকতে হয়। বড় ঘরের রূপের উপরে আবার ঘষা মাজা পালিশ আছে। তা ছাড়া, গাড়োয়ানের ঘরের রূপ তো আর ধোয়া সাজির ফুলগুচ্ছ নয়। তাই স্টেশনের হেড টিকেট কলেক্টর থেকে প্রতিবেশী ভদ্রঘরের পড়ুয়া অপড়য়া নোংরা যুবকদের দল ও ভুনুদের বস্তির বাড়িওয়ালা, জমিদার প্রসন্ন চাটুজ্যে নাকি নাম সেই লাল ড্যাবা চোখো টেকো মাথা পর্যন্ত বেশ খানিকটা মনিয়া মনিয়া বাই আছে।

আস্তাবলের কাছে নাড় পুরোতের গলি। নাড় পুরোতের গলি বলতে সবাই বোঝে ওটা বেশ্যা-পল্লী। ওই গলিটাতে যখন ওই সব ব্যক্তিরা ও ছোকরারা যায় তখন বোধ হয় ওর কাছাকাছি বলেই মনিয়াকে আর আলাদা করে চিন্তা করতে পারে না।

পণ্ডিতজনেরা বলেন, নাচওয়ালী ও বেশ্যা স্বর্গেও আছে। দেবতাদেরও ও-সব দরকার আছে সেই জন্যই উর্বশী, মেনকার জন্ম। এত রূপ তাদের যে, একজনের হৃদয় ভরানো তার দ্বারা সম্ভব নয়, শোভাও পায় না।

তাই ভুনু যখন অতিরিক্ত মাতাল হয় আর মনিয়ার দুর্জয় হাসিভরা মুখটা মনে পড়ে বুকের মধ্যে টন টন করে ওঠে, মনে হয় এ সংসারে সমস্তটাই মিথ্যে। তখন সে ভাবে, বুঝছি আশমানের চিড়িয়াকে সে তার ময়লা খাঁচাটায় বন্দি করে রেখেছে। হয় তো মনিয়া রানী হওয়ার মতো আওরত, যাকে নিয়ে রাজ্যে রাজ্যে লড়াই ও অনেকের অনেক কথা হতে পারে। হয় তো সে অনেকের জন্য, একলার নয়। ভুনু শুধু তাদের মতো একজন কৃপাপ্রার্থী হয়ে কাছে দাঁড়াতে পারে।

কিন্তু লাটঠাকুরের ব্যাপারটা তাকে আবার কথঞ্চিৎ আরাম এনে দেয়। এ লোকটা মিনিবোসার কথা বটে, সেটা অন্যান্যদের থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকম। যেমন আর দশজনের কথা বলে, যেমন বলে ঘোড়ার কথা, চা-খানার কথা বা খদ্দেরের কথা, ঠিক যেমনি, আর কিছু নয়।

তবুও মনে হয় লাটঠাকুরকে বাইরে থেকে যা দেখা যায়, সে তা-ই নয়। তার একটা ভেতর আছে, যার প্রকাশ শুধু উচ্ছঙ্খল ভাবনার মধ্যে। কিন্তু ভুনু তার সবটুকু বোঝে না।

গাড়িটা আস্তাবলের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে। গেট বন্ধ আস্তাবলের। ভুনু নামতে যাবে এমন সময় দরজা খুলে গেল। ঘোড়া দুটো আপনি ঢুকে পড়ল ভিতরে। ভুনু গাড়ি থেকে নেমেই দেখল পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে মনিয়া। খরচোখের বাঁকা চাউনি। বলল, কেয়া, স্বরাজী কা লড়াই হোতা টিশান মে?

বলতে বলতে দরজা বন্ধ করে দিল সে। ভুনু বলল, কাঁহে?

এতনা জলদি চলা আয়া? ক্যায়া, কামায়া বহুত?

ভুনুর মেজাজ খারাপ হয়ে উঠল, তুহার ক্যায়া জরুরত?

সে কথার কোনও জবাব না দিয়ে মনিয়া নির্বিবাদে ভুনুর ট্যাঁক হাতড়াতে লাগল। ভুনু খানিকটা সরে গিয়ে বলল, কাঁহে, বাতা পলে।

হমারি খুশি। বলে সে ভুনুর ট্যাঁক থেকে বার করলে পাঁচ আনা। পয়সা হাতে নিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল সে, এতনা কামায়া? হ্যাঁ মেরি মরদ?

ভুনুর রাগ চড়তে থাকে। সে বলে উঠে, লে, শালা টিশান্ মে হ্যায় লাটবাবু, ঘর মে হ্যায় অ্যায়সা না বুজ আওরত।

কিন্তু মনিয়া তবু হাসে। বলে, হ্যাঁ, লাটবাবু তুমকো ভাগা দিয়া? উসসে পয়সা কাঁহে না মাকে লে আয়া?

এমনি কাটা কাটা বেঁধানো কথা মনিয়ার। কিন্তু কটাক্ষে তার দুর্জয় হাসি চাপা পড়ে আছে।

এর পরে ভুনু বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই মনিয়া তাকে ধরে ফেলে। চলে খানিকটা টানাটানি হ্যাঁচড়া-হেঁচড়ি।

আশ্চর্য, মনিয়া যেন ছেলেমানুষ। যেমনি তার কথা, তেমনি তার কাজ। হঠাৎ কাঁদতে আরম্ভ করে দিয়ে বলল, অ্যায়সা করেগা, তো হম জান দে দেগা।

ভুনুও বলে, যা আভি যা।

মনিয়া বলে, তুম ভি চল।

এবার হাসতে হয় ভুনুকে। সে অবাক হয়ে মনিয়ার দিকে তাকিয়ে। এ রূপ ও কথার ধার সে বোঝে না।

এমনি বোঝে না লাটবাবুকে। চারটে কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মনিয়া চারটে রুটি খেয়ে রঙ্গ করতে পারে। তবু সে তাকে বোঝে না। এমনও হয়েছে, উপোস থেকেও সে তেমনি হেসেছে ভুনুকে নিয়ে। ওরা কিছু একটা চাই, জরুর। তা নইলে এরকম হতে পারে না। যেমন চাই কিছু লাটবাবুর, বাঙালির। যেমন চাই আমার, দুটো আরও তেজী ঘোড়া, আর দিন ভর খালি সোয়ারি।

ভুনু বলল, ক্যায়া, ফিন রোতা কাঁহে?

হম রোয়েগা। খুশি হামারি!

কাঁহে?

তুমি হমকো মরণে বোল্‌তা।

ও তো দিল্লাগি হ্যায়।

চোখের জল প্রায় শুকিয়ে আসে মনিয়ার। বলে, দিন ভর তুমকো ঘরমে রহনে হোগা।

কাঁহে?

একেলি হম্‌কো ডর লাগতা।

 কিস্‌কা ডর।

আদমি কা।

বলতে বলতে এবার সে সত্যি কেঁদে ফেলে আবার। বলে তুম কুছ নেহি সমঝতা। তার এ কান্না মিথ্যে নয়। সে একলা থাকতে পারে না। আদমির ডর নয়, কিছু চাই। তার কিছু করতে হবে। ভেতরে ভেতরে একটা অবুঝ বাসনা নিয়ত আবর্তিত হচ্ছে। এক এক সময় তার মনে হয়, ভুনুকে ঘরে রেখে সে নিজেই গাড়ি চালিয়ে আসে। কিন্তু একলা জীবনে তার বড় হাঁফ লাগে।

ভুনু একটু চুপ থেকে বলল, আচ্ছা চল ইটাগড় বড়া ভাইকে পাশ!

বাইরে বেড়াতে যাওয়ার কথা শুনে আনন্দে লাফিয়ে উঠল মনিয়া, সচ্‌?

হাঁ।

এত্‌না টাইম কাহে নাহি বোলা? বলেই মনিয়া ছুটল ঘরের ভিতরে।

ভুনু বোকাটে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রইল। এ আজব দুনিয়ার কোনও কিছুর মানে বোঝে না সে। কই এক মিনিট আগেও তো সে একথা ভাবেনি।

নিজের উপরেই তার রাগ হতে লাগল। নিজের মনকেও সে চেনে না। চেনে না বলেই বোধ হয় আবার চুপচাপ সে আস্তাবল থেকে বেরিয়ে গেল। গেল রাস্তায়। তার পর হাঁটতে আরম্ভ করল।

তিনটে বাজে। ভজু তখনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাগলের মতো বকছে।

এ সময়েই এল ভজুলাটের দুই ছেলে, হাত ধরাধরি করে। দূর থেকে মাতাল বাপকে দেখেই তাদের টানা টানা চোখে শঙ্কার ছায়া পড়েছে। বড় ছেলেটির ভয় একটু বেশি। সে নামে গৌর, দেখতে গৌরাঙ্গ। ভজহরির নিখুঁত ছাপ তার মুখে। ভাবটা নেই। চিন্তায় ও জীবনধারণে যেন যুঁইয়ের আধিপত্যটাই তার উপরে বেশি। তেরো বছরের ছেলে নয় যেন শঙ্কিত কিশোরী। মামার বাড়ির দিক থেকে টানে গৌরকে, গৌরও মামার বাড়ির ভক্ত। বাপকে সে ভয় পায়, পারলে আর সামনে নড়তে চায় না।

পরেরটি এগারো বছরের নিতাই। সে শ্যামবর্ণ, তার মায়ের মতো। কিন্তু নিতাই সবল, স্বাস্থ্যবান। তার টানা চোখে যেটা শঙ্কা বলে মনে হয়, সেটা আসলে কৌতূহল। তার আবেগ হাসিতে, রাগে, হাতে পায়ে। মাথায় ঘন কালো কোঁকড়ানো চুল, তার মায়ের মতো। ঘরে তাকে সবাই নিষ্ঠুর ছেলে বলে জানে। গৌর থেকে শুরু করে ছোট ছোট আরও তিনটি ভাই বোন, কেউ তার মারের হাত থেকেই রেহাই পায় না। তার জেদ, তার রাগ, হাসি কান্না সবই বেশি। সে অশান্ত কিন্তু অকপট গাম্ভীর্য তারই বেশি। সে উদ্দাম, কিন্তু গান পাগল। সে যেন সুর লহরী, গানের অন্তরের অদৃশ্য মৃৰ্ছনা। গানের মধ্যে নিজের অস্তিত্বকে মিশিয়ে দিয়ে স্বপ্ন দেখে আর দোলে। তার ভাবনা আছে, ভাবুকতা নেই বুড়ো মানুষের মতো। গৌরের মতো নিস্পৃহ নয় সে। সরস্বতীকে তার ভূগোল বিজ্ঞানের চেহারায় বড় ভয় কিন্তু হাস্যময়ী নারীমূর্তিটির পরম ভক্ত। সে গৌরের ছোট, কিন্তু বড়। সব মিলিয়ে সে দুবার কিন্তু এ পোড়া সংসারের দুর্নীতি তার মান দেয় না। যুঁই তাকে সারাদিন চেঁচিয়ে বকুনি দেয়, রাতে তার ঘুমন্ত মুখে চুমু খায়! আর ঘুমের মধ্যে নিতাইয়ের বুক উজাড় করে যে দীর্ঘ নিশ্বাস পড়ে, তা যেন সারাদিনের জমানো সব বেদনাটুকু নিঃশেষ হয়ে যায়। সে নিশ্বাসটুকু হৃদয়ে ভরে যুঁই শুয়ে থাকে। পরদিন নিতাইয়ের ঘুম ভাঙে বেদনাহীন ক্ষোভহীন পরিচ্ছন্ন মন নিয়ে। গতদিনের কথা সে ভুলে যায়, হৃদয় যেন নিত্য কুঁড়ি ফোটা ফুলের মতো সতেজ ও নতুন। কেমন করে, তা সে নিজেই জানে না। তার পরে আবার মায়ের বকুনি, দাদুর কানমলা, ভাইবোনের সঙ্গে ঝগড়া, পাড়ার নেড়িকুকুরটার অসহ্য বেঁচে থাকা, বাবার মাতলামো, প্রতিবেশীদের হীনতা ইস্তক, একবার মাত্র খেয়ে সারাদিন কাজ করা মানুষগুলোর জন্য আর বিচিত্র টানটনানি। আর সব মিলিয়ে তার বুকের মধ্যে যেন একটা বিরাট ফানুস ফুলে ওঠে।

সে যেমন মামার বাড়ির ভক্ত নয়, তেমনি মামার বাড়িও তাকে টানে না। যদিও চেহারাটা তার নরাণাং মাতুলক্রম। তাকে টানে খানিকটা ভজু, সেজন্য সেও বাপকেই রেয়াত করে বেশি।

বাপের কাছ থেকে খানিকটা দূরেই তারা দুভাই দাঁড়িয়ে পড়ে। গৌরই দাঁড়িয়ে নিতাইকে আগে ঠেলে দিল। নিতাইও শক্ত করে গৌরের হাত টানে। ঠেলাঠেলি করতে থাকে পরস্পরে।

ব্যাপারটা ভজুর নজরে পড়তেই সে জড়ানো গলায় চিৎকার করে উঠল, জরণ! চরণ তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল, বাবু!

চোখ বুজে বলল, ভজু, লাটের পোয়েরা দাঁড়িয়ে আছে, হারামজাদা, হাত ধরে নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি।

চড় চাপড় পড়ার আগেই চরণ ছুটে গেল। শুধু অবশ্য চড় চাপড়ই নয়, ছেলে দুটোকে, বিশেষ গৌরকে ভালবাসে চরণ।

ভজু দুহাত বাড়িয়ে ডাকে, এসো…আমার চোখের জোড়া মণি এসো।তার পর হঠাৎ গান জুড়ে দেয় বেসুরো গলায়।

এস দুটি ভাই,
গৌর নিতাই,
দ্বিজমণি দ্বিজরাজ হে।

ততক্ষণে ছেলে দুটোকে নিয়ে এসে পড়ল চরণ আর রাস্তায় ও স্টেশনের রকে আস্তে আস্তে মাতলামির মজা দেখবার লোভে ভিড় করেছে অকাজের লোকেরা।

ছেলে দুটি কাছে আসতেই ভজু তাদের কাছে জানু পেতে অভিনয়ের ভঙ্গিতে বলে উঠল,

একি, একি হেরি বনমধ্যে,
দুটি নিরালার পুষ্পসম
জ্যোতির্ময় দুই বালকে? কেন বক্ষে
 হাহাকার উঠিছে আপনি!
ওরে, তোরা কারা? কি বা পরিচয়?
কে সে ভাগ্যবান পিতা, কে বা মাতা–
যার কোল ভরে আলো করে–
বন মধ্যে ফুটেছিস্ বিশ্বের হাসির মতন?

ইতিমধ্যে লজ্জায় রাগে ও ভয়ে গৌরের মুখ লাল হয়ে চোখ ফেটে জল এসে পড়েছে ও নিতাই অশ্রুহীন চোখে শক্ত শরীরে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে।

চরণের রাগ হচ্ছে যেন স্বামী সোহগিনীর রাগ। তবু কাণ্ড দেখে সে খুক খুক করে হাসছিল মুখে কাপড় চাপা দিয়ে। সে হাসি ভজুলাটের চোখে পড়লে আর রক্ষে ছিল না কিন্তু ছেলে দুটোর জন্য তার মায়া হচ্ছিল। কর্তা নিজে মাতলামো করে, সেকথা আলাদা, এদের নিয়ে কেন?

কিন্তু ভজু কোনওদিন তার ছেলেমেয়ের গায়ে হাত তোলেনি। এদিক থেকে তার অদ্ভুত সংযম। যুঁই যদি কোনওদিন বিরক্ত হয়ে তার সামনে গায়ে হাত তোলে, তবে সে রাগের চেয়ে অসহ্য বিদ্রূপে যুঁইয়ের হৃদয় ছিন্নভিন্ন করে দেয়। সেটাই অবশ্য যুঁইয়ের পক্ষে যথেষ্ট। সে কেঁদে বলে, রাগ করলে মা বুঝি ছেলের গায়ের হাত তোলে না? তা বলে কি সেটা মার?

তা বটে। ভজু স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে এটা আসলে মার নয়। তবু সে বলে, দেখ নিতায়ের মা, গন্ধ ছড়ালে যেমন ফুলের দোষ নেই আর ঝরে পড়লে দোষ নেই গাছের, তেমনি এই বাচ্চাগুলো। মেরে যদি তুমি ওদের ছেলেমানুষি বন্ধ করতে পারতে, আপত্তি ছিল না কিন্তু উলটে যে তুমিই পরে জব্দ হবে।

তা ঠিক, তবু যুঁই না বলে পারে না, সে জব্দ হওয়া আমার ঢের ভাল তবু স্বস্তি তো পাব। এ জীবনে তো কেবলি জব্দ হয়েছি। স্বস্তিটুকু না থাকলে পারব না।

সেই ভাল। সুখের চেয়ে স্বস্তি, এই তো সংসারের বেদ। চলতে গিয়ে যে পাটি প্রথম ফেলছি কোথায়, খালি সেটুকু দেখে নেওয়া। তার পর সামনেটা কেবলি ধূধু পেছনটা ধাঁধা।

কিন্তু ভজুর বুকের মধ্যে যেন একটা মস্ত পশু হাঁক পেরে গর্জে ওঠে। ইচ্ছে করে সমস্ত জগৎটাকে দুহাতের মুঠোয় ধরে দুমড়ে ফেলে। সে স্বস্তি চায় না, চায় সুখ।

তবুও সামনে পিছনের সবটা ভুলে সে আকণ্ঠ পান করে। অ্যালকোহলের তীব্র ঝাঁজ গলা বুক জ্বলিয়ে, লিভার কোষ্ঠ পুড়িয়ে খাক করে তার সমস্ত চেতনাকে গ্রাস করে ফেলে। সে শুধুমাত্র ভজুলাট শ্ৰীমতী কাফের মালিক। না, সে কোনও কিছুরই মালিক নয়। একদিন সে শ্মশান থেকে তার জীবনের পথ বেছে নিয়ে ফিরেছিল। যেখান থেকে এসেছিল, আজ যেন সে আবার সেখানেই ফিরে চলেছে। আজ নিজেকে তার ভারবাহী পশু মনে হচ্ছে। জীবনের ভারবাহী। সেটাকে সে ছুড়ে ফেলতে চায়। এর অর্থ কী! আত্মহত্যা?

গৌরকে কাছে টানতেই সে এল, কিন্তু নিতাই শক্ত করে রাখল তার শরীরটাকে। ঘাড় বাঁকিয়ে রইল অন্যদিকে।

ভজু আদর করে বলল, কী হয়েছে বাবা। রাগ হয়েছে?

এবার নিতাইয়ের চোখে জল এসে পড়েছে। সে চেঁচিয়ে উঠল, হ্যাঁ।

ভজু গলা আরও নামিয়ে বলল, বেশ তবে আর কথা নয়।

এক মুহূর্ত পরে নিতাই বলল, মা তোমাকে ডেকেছে। তাড়াতাড়ি চলল।

আচমকা যুঁইয়ের উপবাসী শুকনো মুখটা মনে করে বুকটা দুমড়ে উঠে উঠে নেশাটা টাল খেয়ে গেল তার। তার চোখে ভেসে উঠল, পেটে ক্ষুধা নিয়ে, সমস্ত কাজকর্ম সেরে, ভাত নিয়ে তার জন্য অন্ধকার গলিটার মুখে অপেক্ষা করছে। হয় তো বা কুঁচকে নজর করছে, তাকে আসতে দেখা যায় কি না। কিন্তু সেখানে, রাস্তার বাঁকে শুধু চৈত্র দুপুরের রোদ কাঁপছে ঝিলিমিলি।

বুঝি জীবনের পথের ওই দূর বাঁকটাতে সবটাই মরীচিকার মতো মিথ্যের ঝিলিমিলি। এ জীবনে যার জন্য প্রতীক্ষা করা গেছে, সে কি এসেছ? না কি এ প্রতীক্ষা শুধু এ সংসারের আর দশটা নিয়মের মতো!

চরণ! পরিষ্কার গলায় বলল ভজু, এদের কিছু খাইয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিস্।

চরণ খালি বলল, আজ্ঞে।

তারপর ফিরে ভজু বারান্দা থেকে নামতে গিয়েই দেখল মাতলামির মজা দেখার দর্শকের ভিড়। সবাই দাঁত বার করে হাসছে তার দিকে চেয়ে। অমনি সে চিৎকার করে উঠল, চরণ!

আজ্ঞে। চরণ ছুটে এল।

লোকগুলোকে দেখিয়ে বলল, এ সব শালার কাছ থেকে চার আনা করে প্যালা নে মজা দেখার।

বলে সে জনতার দিকে এগুতেই সব এধারে ওধারে ছুটে পালাতে লাগল। ছুটতে গিয়ে আছাড় খেল কেউ কেউ। যেন একটা সাংঘাতিক জীব এগিয়ে আসছে তাদের দিকে।

ভজু আপন মনে হেসে উঠে বলল,

মাগো, জন্ম দে জগৎ হাসালি,
ছেলে বলে পুতুল দিলি।

শালাদের গায়ে একটু মদের ছিটা দিয়ে দে। বলে সে এগুতে গিয়ে আবার থামল। দেখল, সবাই পালাল, একটি ছেলে পালায়নি। ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে বুক টান করে, ঠোঁটে ঠোঁট টিপে, অপলক চোখে ভজুর দিকে তাকিয়ে।

ভজু জিজ্ঞেস করল, তোর নাম কী?

জবাব এল, কানু।

কানু? তা বেশ! তুই কেন পালালি না?

ছেলেটি বলল, কেন?

কেন? তা ঠিক। ভজু বলল আপন মনে, কানু আর কেন? বেশ! তোদের বাড়ি কোথায়?

ঠাকুরপাড়া।

বাপের নাম?

শ্রী শ্রীধর–

ভজু বলে উঠল, চাটুজ্যে। তুই যে অসুরের ঘরে দেবসুত রে! তুই মাংস খাস?

এইবার ছেলেটি কিঞ্চিৎ বিব্রত হয়ে বলল, খাই।

আমি খাওয়ালে খাবি?

ছেলেটি নিশূপ। ভজু ডাকল, চরণ।

চরণ রুষ্ট মুখে বলল, আঁজ্ঞে।

এক চপ কাটলেট আর মাংস খাইয়ে দে।

বলে সে এগুবার উদ্যোগ করতেই চরণ বলে উঠল, কিন্তু আজকে যে মাল একেবারে—

চোপরাও হারামজাদা। যা বলছি তাই কর। বলে সে চলে গেল।

ছেলেটি লজ্জায় তাকাতে পারল না চরণের দিকে। বোধ হয় পালিয়ে যাবার কথা ভাবছিল। কিন্তু চরণ তার আগেই তাকে টেনে নিয়ে গেল দোকানের মধ্যে।

গৌর নীরবে কিছুটা গোমড়া মুখে অভ্যর্থনা করল ছেলেটিকে। নিতাই ইতমধ্যে সোজা গিয়ে বসেছিল বাপের চেয়ারটিতে। সে বলল, নাম কী?

কানু বোধ হয় একবার ভেবে দেখল তার সম্মান ক্ষুন্ন হচ্ছে কি না। পরে বলল, কানু।

তুই স্কুলে পড়িস?

পড়ি।

কোন ক্লাশে?

ক্লাশ সেভেন।

একটু দমে গেল নিতাই। সে পড়ে ক্লাশ ফাইভে। কিন্তু কানুকে তার ভাল লেগে গিয়েছে। বলল বোস্ এখানে।

তার পর শুরু হয় তার নিজের আধিপত্য। সে ভেতরের অন্ধকার ঘরটায় গিয়ে সব খুঁটে খুঁটে দেখে। কৈফিয়ত তলব করে চরণের কাছে কোন জিনিসটা মনঃপূত না হলে। মাংসের ঢাকনাটা খুলে দেখে সেটা ঠিক আছে কি না, কিংবা চেখে দেখে। উনুনের কাছে গিয়ে বায়না ধরে রান্না করবে বলে। কিছু না করতে দিলেই যুদ্ধ শুরু হয় চরণের উপর। হয় তো কয়লা ভাঙতে শুরু করে পেঁয়াজ, শসা কুঁচোয়, খায়, ছড়িয়ে ফেলে খানিকটা মাস্টার্ড।

তার পর খিলখিল করে হেসে উঠে বলে, সামনের ঘরটা সাদা, ওটা আমাদের দোকান। এ ঘরটা কালো, এটা আমাদের নয়। টিনের চালা থেকে বেয়ে পড়া মাকড়শার ঝুলগুলো দেখে হাসতে গিয়ে শিউরে ওঠে। যেন কোন ক্লেদাক্ত সরীসৃপ ঝুলছে তার সামনে। হয় তো মনে হয়, এ অন্ধকার ঘরটাতে লুকোচুরি খেলা ভাল জমতে পারে। সেজন্য মাঝে মাঝে হামলে পড়ে গেীরের উপর। কিন্তু ইঁদুর ও আরশোলার লুকোচুরি হুটোপুটি এমন শুরু হয় যে, তার লুকোচুরি জমে না। তখন সে একটা লাঠি নিয়ে বন্য ব্যাধের মতো ইঁদুর ও আরশোলার পেছনে তাড়া করে। বাড়ির সবাইকে ফাঁকি দিয়ে যে গালাগালগুলো শিখেছে, সেই সব শালা বানচোত খই-এর মতো ফুটতে থাকে তার মুখের মধ্যে।

চরণ সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে কখন বুঝি বা এসে হুমড়ি খেয়ে পড়বে জ্বলন্ত উনুনে, ফেলে দেবে জলের জালাটা, ভাঙবে কাপ প্লেট, আছাড় খেয়ে চূর্ণ করবে নিজেরই হাত পা।

তার পর হন্তদন্ত হয়ে বাইরের আলোকিত ঘরটায় ছুটে গিয়ে আবার সন্তর্পণে উঁকি মারে এ অন্ধকার ঘরটার দিকে। যেন বিভীষিকাময় রাজ্যটার সীমা পেরিয়ে গিয়ে সে দূর থেকে এ জায়গাটাকে দেখছে। তার পর চোখ বড় বড় করে হাতছানি দিয়ে ফিসফিস করে চরণকে ডাকে, চলে এসো, ও ঘরে ভূত আছে।

কিন্তু ওই পর্যন্তই। তার পরেই সে লাফ দিয়ে উঠে যায় প্রোপ্রাইটারের চেয়ারে। ক্যাশের ড্রয়ারটা খোলে আর বন্ধ করে। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, চরণ, এখানে কত হয়েছে?

অন্যমনা চরণ ভাবে বুঝি সত্যিই বাইরে কোনও খদ্দেরকে খেতে দিয়ে এসেছে। সে ছুটে আসে তাড়াতাড়ি হিসেব দিতে।

নিতাই তখন প্রাণভরে হাসে।

গৌর অত্যন্ত রুষ্টমুখে এ-সব চুপ করে দেখে, একটি কথাও বলে না। কিন্তু বাড়ি গিয়ে প্রত্যেকটি ভূতের মতো শুরু করা মুক্তি চাই। নারায়ণ জন্য একজনকে সে ভালর কেউই

কথা সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার মায়ের কাছে অভিযোগ করে এবং তার শান্ত চোখ বড় করে আগ্রহভরে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে, এ ব্যাপারের কোনও প্রতিকার বা শাস্তির আশা আছে কি না।

ভজু নিতাইয়ের এ-সব দেখেশুনে বলে, যাক, জীবনে যদি কিছুই তোর না হয়, শ্রীমতী কাফের প্রোপ্রাইটারিটা তোর জন্য রইল।

আর নিতাইয়ের এ খেলা দেখে চরণ যেন সত্যি পেছনের এ ধোঁয়াচ্ছন্ন, ঝুলপড়া এবড়ো-খেবড়ো উনুন ঘরটায় ভূতের মতো শুন্য চোখে তাকিয়ে থাকে। এই শ্রীমতী কাফেতে একটি কথা সে বার বার শুনেছে, আমরা সর্বস্ব পণ করা মুক্তি চাই। নারায়ণ যাবার সময় বলেছিলেন, চরণ, মুক্তির সাধনা কর। সে মুক্তি কী? তার বদ্ধ প্রাণের মুক্তির জন্য একজনকে সে ভালবেসেছিল। বারবণিতাকে। কিন্তু দুজনেই তারা আজ নতুন করে বাঁধা পড়েছে। মুক্তি তো তারা কেউই পায়নি। তবে কি মুক্তির সাধনা তার বিফলে চলে গিয়েছে। কিন্তু তাকে ছাড়া চরণ সে মুক্তি চায় না। তবে কি মুক্তি পাওয়া যাবে না? যে মুক্তির কথা শুনেছে এখানে সে মুক্তির অর্থ কী?

সে মুক্তির অর্থ জানে না চরণ।…এ অন্ধকার ঘরে হুস করে একটু হাওয়া এসে মাকড়শার ঝুল দুলে ওঠে। নিঝুম পেয়ে ইঁদুর আরশোলার হুটোপাটি শুরু হয়। কাঁচা মাটির ভেজা মেঝে, কয়লা ঘঁটে জল, জালা, টিন, উনুনের গৰ্গনে আঁচে চরণের মূর্তিটা জ্বলজ্বল করে।

প্রাণটা তার কিশোর নিতাইয়ের মতো খেলা করতে চায়।…মানুষের যে আত্মা স্বর্গগামী না হয়ে মতে ফেরে, তাকে সবাই বলে ভূত। চরণ যেন তাই। সে মুক্তি চায়। এ ভুতুড়ে জীবন, নিতাইয়ের এ শঙ্কা ভরা ভুতুড়ে ঘরটা ছেড়ে মুক্তি চায় সে।

কিন্তু ঘরের বাইরে মুক্তি কোথায়। মুক্তি দাও চরণকে, সর্বস্ব পণ করা সেই মুক্তি।

মুক্তি! কে জানে, কোথায় আছে চরণের সেই সব পণ করা মুক্তি! যদি বলল, স্বরাজ হল সেই মুক্তির প্রতীক, তবে বলতে হয় উনিশশো চৌত্রিশ, অর্থাৎ গত বছরের পর থেকে সেই মুক্তির স্বাদ নোতা হয়ে গেছে। বাইশ সালের মতো আবার একটা বিশ্রী অবসাদ এসেছে।

মুক্তির মারের দাগ শ্রীমতী কাফের সর্বাঙ্গে। তার দরজায়, জানলায়, আসবাবে, তার মালিক ও চাকরের হৃৎপিণ্ডে। তার দাগ ঘরে ঘরে, পথে পথে, দেয়ালে দেয়ালে। দাগ তার ঠোঁটের কশে রক্তে, বুকের ছিন্ন পাঁজরে, মায়ের কান্নায় ও প্রেয়সীর ভাঙা বুকে।

আবার সেই একই ব্যাপারের পুনরাবৃত্তি। গান্ধীজি বলেছেন, দেশবাসী তাঁর সত্যাগ্রহের মর্ম অনুধাবন করতে পারেনি, আমরা পারিনি ইংরেজ শাসকদের হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটাতে। এর পরে আইন অমান্যের দায়িত্ব তিনি একলা গ্রহণ করবেন।

বাংলা অ্যাসেম্বলিতে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা কংগ্রেসকে যেন পরবাসী করে তুলল। তাদের মন বেঁকে গেল বাংলার প্রতি। সমস্যা শুধু বামপন্থী সুভাষবাবুকে নিয়ে। সারা ভারতের, এমন কী গান্ধীজিরও সমস্যা।

ফলে বাংলার বুকে অবসাদ। অবসাদ শ্রীমতী কাফেতে।

এখানকার সকলেই জেল থেকে ফিরে এসেছে। আবার তাদের আড্ডা জমেছে শ্রীমতী কাফেতে। কিন্তু অন্তস্রোতে কিছু একটা ঘটে গিয়েছে, একটা অদ্ভুত পরিবর্তনও চোখে পড়ে।

আসেননি শুধু নারায়ণ। তাকে আর তাঁর বন্ধুদের ইংরেজ সরকার দেশের মাটিতে রাখতেও অরাজি। তাদের নিয়ে গেছে সমুদ্রের নির্জন দ্বীপে, আন্দামানে। যেখানে মাতৃভূমির কোনও কলকাকলি পৌঁছয় না।… মাঝে মাঝে ভজুর কাছে নারায়ণের চিঠি আসে। রানাঘাটের এক অখ্যাত গ্রাম থেকে একটি সম্পন্ন ঘরের বউ প্রায়ই ছুটে ছুটে আসে এই চিঠিগুলি দেখতে। সে প্রমীলা। কিন্তু চিঠিগুলিতে, দ্বীপ-নির্বাসিত চারধারের বেড়া মহাসমুদ্রের মতো উদাত্ত জিজ্ঞাসা এখানে যেন দূরাগত গুগুনানির মতো বাজে। অসহ্য প্রতীক্ষার আবদ্ধ প্রাণ সে গুনগুনানিতে মুক্তি পায় না। মাতে না। ভয়ঙ্কর একটা ঝড় না হলে সে যে ভাঙবে না। অন্ধকারে আর কতদিন এ মুখ লুকিয়ে রাখা চলে। তার চেয়ে সে তার জীবনের সব অভিশাপ নিয়ে ঘুচে মুছে যাক।

নারায়ণের পথ-বিশ্বাসী সুনির্মল আর রথীনও মুক্ত হয়ে এসেছে জেল থেকে। প্রিয়নাথের উপর থেকে পরোয়ানা তুলে নিয়েছে সরকার। সে এখন কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠক।

কমিউনিস্ট পার্টি। রাজনৈতিক মহলে এ দলটির নাম প্রায়ই শোনা যায়। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে অ্যালান হিউম সাহেবের প্রতিষ্ঠিত কংগ্রেস নামটা বিদেশি ও দুর্বোধ্য ঠেকেছিল। নামের মাঝে কোথায় যেন একটা বিদেশের গন্ধ ছিল। অথচ আজ কংগ্রেস নামটা একটা দেশীয় শব্দ হয়ে উঠেছে। ভাবা দায়, এর আবার কোন দেশীয় অর্থ আছে।

আজকে কমিউনিস্ট নামটা তখনকার কংগ্রেসের মতো। হয় তো বা আরও কিছু নতুন নাম, নতুনতর তার কাজ। যেন সভ্য আর্য ঋষির আশ্র কুঞ্জে, অসভ্য অনার্য উলঙ্গ শিবের আবির্ভাব। সেই শিবের মোহন মূর্তি দেখে ঋষিবধুর অঙ্গবাস খুলে যায়। কে জানে, একদিন গণমনের সমস্ত বাঁধ ভেঙে দেবে কিনা কমিউনিস্ট পার্টি।

প্রিয়নাথ যে পথ নিয়ে একদিন নারায়ণের বিশ্বাস হারিয়েছিল, সেই পথেই সে তার সিদ্ধির অন্বেষণে ছুটে চলেছে। উপকণ্ঠের মজুরবস্তি তার কর্মক্ষেত্র। যে রথীন একদিন তার বিরুদ্ধে ছিল, সেই রথীন আজ তার সর্বক্ষণের সঙ্গী।

সর্বস্ব পণ করা মুক্তির সন্ধানে ছুটেছে তারা। কিন্তু সারা দেশে আবার একটা দারুণ অবসাদ এসে পড়েছে। পরাজয়ের অবসাদ।

পথ বিচ্যুত হয়ে সুনির্মল। সে দূরে সরে গেছে। রুক্ষ শীতের কাঁটাভরা পথ থেকে সে উষ্ণ নরম কোটরে আশ্রয় নিয়েছে।

অবসাদই এসেছে। নইলে, কৃপাল দলাদলি ভালবাসত সত্যি, কিন্তু গোপনে মদ খাওয়া ধরেনি। আজকাল ধরেছে। সে লুকিয়ে সিগারেট খায়, বিলাতি মদ খায়। শঙ্করদাও খান। তিনিই কৃপালের গুরু। তাদের চিন্তার মধ্যে একটা ভয়াবহ ফাটল ধরেছে।

অবসাদে ভেঙে পড়েছে হীরেন। রাজনীতি থেকে অনেকখানিই দূরে সরে গেছে। আজও সে তেমনি সুতো কাটে, ধর্মগ্রন্থ পড়ে। মাঝে মাঝে বেদ-বেদান্ত ও ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে প্রবন্ধও লেখে।…কিন্তু সে যে মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল, তা যেন আজ ভোজবাজির ছায়ার মতো কোথায় উধাও হয়ে গেছে।

জেল থেকে এসে রামাকে দেখে সে চিনতে পারেনি। অসহ্য যন্ত্রণায় ও ঘৃণায় বুকের মধ্যে রি রি করে উঠেছিল তার।…জট পাকানো, উকুনের সাদা নিকি ভরা এক মাথা চুল, ধুলো মলিন কাপড়, তাও হেঁড়া। গায়ে জামা নেই। ফুক ফুক করে বিড়ি ফোঁকে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে খ্যাল খ্যাল করে হাসে। কাছে পিঠে থাকে এক গাদা বাচ্চা। তার ঝাড় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে বাচ্চাগুলি! এতগুলি বাচ্চা কী করে হল রামার! শুধু তাই নয়। ওর সেই আগের বরটা মরে গেছে। আবার একটা লোকের ঘরে চলে গেছে রামা। …গায়ের মধ্যে কাঁটা দিয়ে ওঠে হীরেনের। এই সেই রামা! এখন মিউনিসিপ্যালিটির ধাঙড় মেথরদের একটা ইউনিয়ন হয়েছে প্রিয়নাথের চেষ্টায়। রামা সেখানেই যায়।

তবু বুকের মধ্যে সহস্র কীটের দংশন অনুভব করে হীরেন। মনে পড়ে বস্তি থেকে ফিরে আসার দিন রামার সেই আলিঙ্গন। যদি সেদিন নিয়ে আসত সে তাকে, তা হলে কি হত! জানে না সে। সে তো মনে করেছিল, ওটা মহামৃত্যুর আলিঙ্গন। কিন্তু সেই আলিঙ্গনেই তো সে বাঁধা পড়েছে। সে তার বউদির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। আলিঙ্গনটা রামার নয়, বউদির। হীরেনের তাতে সুখ নেই, দুঃখেরও কোনও অনুভূতি নেই তার। এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে সে মুক্তি চায়। কতবার ভেবেছে সে, আত্মহত্যা করবে। কিন্তু ভবিষ্যতের একটা বিচিত্র কৌতূহল তাকে বার বার বাধা দিয়েছে!..আর বিচিত্র তার মতি, রামাকে দেখলে আজও তার হৃদয় অপ্রকৃতিস্থ হয়ে ওঠে।

এই বিরাট ঘুরপথ। আর প্রতিটি মোড়ে মোড়ে ঠেকে যাওয়া অসহ্য অবসাদ।

সকলেই চলছে, ঠেকছে, নিজের মতো করে মুক্তি চাইছে। চরণের সেই সব পণ করা মুক্তি।

বোধহয় লিগ মিনিস্ট্রির দরুনই ললিত মুখুজ্যেরা একটা আন্দোলনের পথ পেয়েছে। শ্রীমতী কাফেতে তার বজ্রকণ্ঠ আজকাল ঘর ঘর ধ্বনিত হয়ে ওঠে।

ধ্বনিত হয়ে ওঠে, কংগ্রেস, গান্ধী, আইনসভা, ইকনমিস্টের সম্পাদকীয়, শ্রমিক তদন্ত রিপোর্ট, ফজলুল হকের বিবৃতি, নবীন শ্যামাপ্রসাদের সিংহনাদ, সুভাষচন্দ্রের কংগ্রেস বিরোধিতা, কমিউনিস্ট পার্টি, ট্রেড ইউনিয়ন, বাটলিওয়ালা, ডাঙ্গে আর মুজঃফর আহমদ, অর্থাৎ এ-দেশীয় রাজনীতির আদি ও শেষ। তার পর হিটলার, হিমলার-হেস-গোয়েরিং তোজো-মুসোলিনী-চেম্বারলেন-ট্রটস্কি তার উপরে রাশিয়া ও স্ট্যালিন।

তার পরে পরস্পরের দলাদলি ও বিবাদ।

সেই পুলিশ অফিসারটি বদলী হয়ে গেছে একত্রিশ সালের মাঝখানেই। শ্রীমতী কাফের উপর ততখানি কড়া নজর হয় তো এখন নেই।

নজর এখন শুধু প্রিয়নাথের উপর। এই শিল্পাঞ্চলের গোলযোগের সৃষ্টি এখন ওরাই করতে পারে।

এদের কাছ ঘেঁষেই রোজ বসে থাকে— সুনির্মল। সে বেশির ভাগ সময়েই কোনও কথা বলে না। কোনও কোনও সময় হঠাৎ গান্ধী বিরোধী উক্তি করে বসে, নয় তো ফ্রান্সে আগামী নির্বাচনে পপুলার ফ্রন্টের অবশ্যম্ভাবী জগের আশা দীপ্ত গলায় বলে।

যখন সবাই অসম্ভব চেঁচামেচি শুরু করে, সে তখন জনবহুল রাস্তাটার দিকে স্বপ্নালু চোখে তাকিয়ে বোধ হয় এ গণ্ডগোলের জন্যই প্রথমে গায়,

তোর মলিন বসন ছাড়তে হবে,
হবে রে এইবার,
ও তোর মলিন অহঙ্কার।

তাতে কেউই কর্ণপাত করে না, যে যার নিজেকে নিয়ে মশগুল। তখন সে তার গলার মধ্যে সমস্ত সুর মাধুর্যটুকু ঢেলে গেয়ে ওঠে,

যৌবন সরসী নীরে
মিলন শতদল,
কোন চঞ্চল বন্যায় টলমল, টলমল।

কিংবা,

তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে
কত আর সেতু বাঁধি সুরে সুরে তালে তালে।

জীবনে তার যদি কোনও উদ্দেশ্য এখন থেকে থাকে, তবে তা প্রেম। প্রেমে সে সত্যি পড়েছে এবং সেটাই তার মানসিক সংগ্রামের আকার ধারণ করেছে। সে ভালবেসেছে সেই সরসী রায়কে।

সে শাড়ি পরে, গয়না পরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল সোনার তারকা তার প্রশস্ত কপালে জ্বলজ্বল করে। তার ঘন কালো ঢেউ দেওয়া চুল, বিশাল চোখে ব্যথিত হাসি, বলিষ্ঠ শরীরে তার নম্রতার ছাপ। তার ভরা জীবনের শুন্য বুকে সে গ্রহণ করেছে সুনির্মলের নিবেদিত প্রেম। জীবনের দিকপাশে তার ভুল ছিল না, ছিল না চিন্তার দুর্বলতা। তারই সমবয়সী ছন্নছাড়া, দিকপাশ ভোলা সুনির্মলকে সে আশ্রয় দিয়েছে। সে জড়ায়নি সুনির্মলকে।

ত্রিশোধেঁর এ ছেলেগুলো যেন ঝড়ো পাখি। ওদের মাতামাতির অন্ত নেই, অন্ত নেই উন্মাদনার। বুকে ওদের বারুদ ঠাসা, দিকে তাই কেবলি বিস্ফোরণ! প্রেমে অন্ধ এ সুনির্মল আবার কালকে মাতবে। তখন ফিরে আসবে এই কুলায়, সরসীর বুকে। ওদের ভালবেসে স্বস্তি নেই, না ভালোবাসলে সুখ নেই। ওরা এমনি।

তাই সরসী তার বৈধব্যের বুকের বাসা খুলে দিয়েছে। ওদেরই একজন ক্লান্ত হয়ে ছুটে আসবে

তার কাছে, ক্ষত বিক্ষিত করবে বাসা, জরাকে সরিয়ে করবে নবীনের প্রতিষ্ঠা।

ক্লান্তি যখন গ্রাস করবে তখন উত্তাপের অগ্নিশিখা নিয়ে রণডঙ্কায় ঘা দেবে সরসীরা। কটাক্ষে আগুন হেনে রক্তশাড়ি উড়িয়ে ওরা নির্দেশ দেবে পথের।

সুনির্মল হেসে ওঠে। থাক, ও-সব থাক। জনারণ্যে শুধুই সে সরসী, বিধবা, বিদূষী। থাক রাজনীতি, অপরে করুক ছাত্র আন্দোলন, না থাক উত্তাপ, সংবাদ বন্ধ থাক পপুলার ফ্রন্টের, ফ্রাঙ্কো-স্পেনের, থাক কিশোর ছাত্রের জ্বলন্ত অভিনন্দন। সে কবিতা বাঁধে,

এমন করে ঘুম ভাঙ্গায়য়া না মোর
প্রেমের তৃষ্ণাতে আমি মাতাল ঘোর,
কেন এ বিশ্বের কমামেলা?
এবার শুরু হোক প্রেমের পালা।

বিধবা বিয়ে কি বিদ্রোহ নয়? সেই বিদ্রোহই করবে সুনির্মল। সে বাজ হানবে এই পয়সা পিশাচ চাঁদির জুতোখোর সমাজের বুকে। সে তার পিতৃপিতামহের সঞ্চিত অর্থ উইল করে দেবে সরসীকে, তার সন্তানকে।

তেমনি আসেন বৃদ্ধ গোলক চাটুজ্যে। কাহিনীর থলি ঝাড়তে আরম্ভ করেন। তিনি বলেন সবই সত্যি। কেবল শ্রোতারা হা হা করে হাসে।

আম খাওয়ার কথা বলছ? তিনি শুরু করেন। সেবারে আশু বাবু বললেন, আশু বাবু হে। চেনো না তোমাদের কলকেতার আশু মুখুজ্যেকে, রয়েল বেঙ্গল টাইগার? বললেন, এসো গোলক, দুটো আম খাওয়া যাক। বসলাম দুজনে আম খেতে দুপাশে, মাঝখানে বসে আম কেটে কেটে দিতে লাগলেন আশুবাবুর মা।… তার পরে জানো মশাই, আমি তো খাচ্ছিই খাচ্ছি। খাওয়া যখন শেষ হল তখন আর আশুবাবুকে খুঁজে পাই না, তিনিও আমাকে খুঁজে পান না। পাবেন কী করে? মাঝখানে যে আমের আঁটি আর খোসার পাহাড় উঠে গেছে মানুষ সমান। দেখা কি যায়?

এরকম অদ্ভুত রকমের বহু গল্পের ঝুড়ি তিনি রোজ খালি করেন। এর পরে কারও কার্পণ্য আর টেকে না চায়ের ব্যাপারে।

আর একজন আসেন ভবনাথ বাঁড়জ্যে। তাঁর কথা না বললে শ্রীমতী কাফের কথা শেষ করা যাবে না। তিনি বসেন ভজুর একেবারে পাশে এবং যতক্ষণ ভিড় থাকে, ততক্ষণই কচকে টেকো মাথাটা নিয়ে মহা বিরক্তিতে ভ্রূ কুঁচকে চুপ করে থাকেন। মাঝে মাঝে দু চারটা কথা বলেন ভজুর সঙ্গে। বয়স প্রায় ছাপ্পান্ন। ছিলের রেলওয়ে পার্শেল ক্লার্ক, সম্প্রতি রিটায়ার করেছেন। বিপত্নীক। ঘরে তাঁর নতুন দম্পতি, ছেলে আর ছেলের বউ। আরও দুটি ছেলে, স্কুলে পড়ে। বিবাহিত ছেলে বড়টির বয়স প্রায় তিরিশ।

ভজু তার চেয়ে অনেক ছোট হলেও উভয়ের বন্ধুত্বটা গভীর। চেহারায় চরিত্রে প্রায় পুরোপুরি ফারাক থাকলেও তাদের দুজনে জমে অদ্ভুত। ভজু বলে তাকে তুমি আর বাঁড়ুজ্যে দা। ইনি বলেন শুধু ভজু। এক কালে তার ঘর ছিল বরিশাল জেলায়, এখন রেল কলোনিই তাঁর ঘর।

ভবনাথের ইদানীং জীবনটা একটু অদ্ভুত। তিনি আসে সন্ধ্যাবেলা, এক কাপ চা খান তার পর খালি ভজুকে বলতে থাকেন, চলো না, একটু পেছনের ঘর থেকে ঘুরে আসি। অর্থাৎ তিনি মদ পান করবেন, কিন্তু লুকিয়ে ভজুলাটের সঙ্গে, ঠিক যেমন নতুন লোকে মদ খাওয়া ধরে। চিরটা জীবনভরে এমন কী বিড়ি সিগারেট, পান কিছুই খাননি। নিয়মিত চাকরি করেছেন, সংসার করেছেন, পালন করেছেন স্ত্রী পুত্র পরিবার, উপরি রোজগার করে পয়সাও কিছু জমিয়েছেন এবং জীবনকে শেষ করে যেন তিনি আবার শুরু করেছেন। চিরকাল নিয়মের মধ্যে থেকে স্বাস্থ্যটা অটুটই রেখেছেন বলা চলে। কিন্তু জীবনের একটা নতুন কৌতূহল ফুটে উঠেছে তার চোখে। গত ত্রিশ বছরের এ বিশ্বের কোনও কথা জিজ্ঞেস করলে বলেন, কই কিছুই তো জানি না। এতদিনের ভাবলেশহীন চোখজোড়াতে তাঁর নতুন ভাবের সঞ্চার হয়েছে। ক্লান্তি আছে, গোলমাল সইতে পারেন না, কিন্তু জীবনটাকে চেখে দেখার ভারী সাধ।

তিনি যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন, ততক্ষণই আড়চোখে লুকিয়ে লক্ষ করেন ঘরের নতুন দম্পতি তার ছেলেবউকে। তাদের কথা হাসি ঝগড়া খুনসুটি। দেখে তার কৌতূহল ও বিস্ময়ের সীমা থাকে না। এ জীবনটার যেন কিছুই তার জানা নেই, কিছুই দেখা নেই। যেন একটি নতুন জগৎ। তিনি যেন এ খেলার মাঝে শিশু দর্শক।

এসব কথা তিনি এসে আবার গল্প করেন ভজুর কাছে। এ সাধারণ কথাগুলো ভবনাথের মুখ থেকে শুনে ভজুর কাছেও যেন অসাধারণ ঠেকে। তিনি বলেন, জানো ভজু আমার ভারী অবাক লাগে। আমি এর কিছু ভেবে পাই না।

তারপর সব ঝামেলা কেটে গেল তিনি দোকানের পেছনে গিয়ে কয়েক পাত্র পান করেন। এমন কী তখন চরণও কাছে থাকতে পারে না। যদি দেখে ফেলে। কিন্তু পরে তিনি আরম্ভ করেন বকবক। তার মধ্যে তিনি কতই না অভিনব দর্শনের বিচিত্র তথ্য উঠে পড়ে। এমন কী রাজনীতি নিয়েও আলোচনা করেন, চেঁচিয়ে ফেলেন।

তারপর টলতে টলতে বাড়ি ফিরে যান। ভজুকে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসতে হয় কোনও কোনও দিন।

ভজু বলে, আচ্ছা বাঁড়জ্যেদা, এ তোমার কেমন ধারা লুকিয়ে নেশা করা? সবাই তো জেনেই যায়। তবে সামনে বসে খাও না কেন?

ভবনাথ বলেন, তা যদি বললে, অবশ্য বলতে নেই এমন কথা কিন্তু সৃষ্টিটা গোপনেই হয়। প্রকাশ তার বাইরে। ভজু ভাবে, ভবনাথদাও মুক্তি চান। কীসের মুক্তি, কার মুক্তি।

বাঙালি আর আসে না। যদিও আসে, খুব কম। তার মাতলামি অনেক ঘুচে গেছে। সেও দিবারাত্র ওই প্রিয়নাথ, তার পাননাথদাদার সঙ্গেই ঘোষে। সে মুক্তি-উন্মাদ নয়, বিদ্রোহী। এই কয়েক বছরের মধ্যে বউ ছেলে মরে, ঘর বিকিয়ে পথে এসে আশ্রয় নিয়েছে সে। দিবানিশি তার কাজ। বলে, লাটবাবু, জীবনে হার জিত আছে। আজ হারছি কাল কিন্তু ঠিক জিতে নোব!

ভজু বলে কার কাছ থেকে কী জিতবি?

অন্যমনস্ক হয়ে যেন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে বাঙালি। একটু পরে চাপা গলায় ফিসফিস করে বলে, কেন, বউ ছেলে আর ভিটে।

জিতে নেবে! শুনে ভজু হাসে না কাঁদে বোঝা যায় না। কেবল পানের মাত্রাটা বাড়িয়ে দেয়। মাতলামির ঘোরেও অবাক হয় ভজু যখন দেখে, শ্ৰীমতী কাফের পিছনে বসে দলের সভা বসায় প্রিয়নাথ ওই বাঙালিকে নিয়ে। এই সভায় আসে সেই চটকলের শ্রমিক ভাগন আর মনোহর। এখনও ভজুর প্রতি ওদের অবিশ্বাসটা যায়নি। কিন্তু লাটবাবুকে একটি সেলাম জানিয়ে দিব্যি ভেতরে গিয়ে বসে। সেই কানপুরের সুরজ সিং আজকাল এ অঞ্চলেই বাসিন্দা হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক সে। সেও আসে। কিন্তু তাদের তর্কের অবসর নেই। তারা কেউই শ্ৰীমতী কাফের সামনের ঘরের লোক নয়। তাদের এই বৈঠকে আসে আরও কয়েকটি ছেলে, স্কুলের উঁচু ক্লাশের ছেলেরা। এ বিশ্বে ওরা আর কোথাও ঠাঁই পায়নি, পেয়েছে ভজুলাটের শ্রীমতী কাফেতে।

কোনও কোনওদিন ভজু জিজ্ঞেস করে প্রিয়নাথকে, কী চাস্ তোরা? কী চায়। প্রিয়নাথ বলে অনেক কথা, শ্রমিক বিপ্লব, সাম্যবাদ, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো, অক্টোবর বিপ্লব…

ভজু তাড়াতাড়ি বলে, থাম। তার পর যেন খুবই কৌতূহল ভরে একটি কথা জিজ্ঞেস করে বোঝে একটা প্রস্তুতি চলছে। যাত্রার প্রস্তুতি, লক্ষ্যের প্রস্তুতি। কিন্তু ওদের মুক্তির অর্থ সে বোঝে না।

মুক্তি! অ্যালকোহলের তীব্র ঝাঁজে পোড়া পেটটা চেপে ভজু বিড়বিড় করে,

এ মহানিদ্রা ঘুচিবে জানি
আকাশে ধ্বনিবে অভয় বাণী
মন্ত্রের মতো ছড়াবে মর্তে
মহাদেশ দেশ ঘরে পল্লীতে।

হ্যাঁ আজকাল নেশার ঝোঁকে ভজন এমনি কবিতা আওড়ায়। মাঝে মাঝে হীরেনের বড় ভাল লাগে এই কবিতা। বিস্মিত প্রশংসাভরে সে ভজনের দিকে তাকিয়ে থাকে।

তার দিকে তাকিয়ে ভজন বলে ওঠে,

(সেদিন) বাউলের সুরে বেহালার তারে
জ্বলিবে আগুন গ্রামে প্রান্তরে।
দেখবি তোর সোনার কানন নাই,
ধরিত্রী মুখ রহিবে ফিরায়ে
না দিবে তোরে ঠাঁই।

হীরেন একটা দুর্বোধ্য অস্বস্তিতে কবিতাটা নিজের নামে আওড়ায়। তাকে এ কবিতা শোনাবার অর্থ কী।…ঠিক এই কবিতার মতো তার মনে পড়ে যায় বউদির কথা। একদিন ছোকরা ঝাড়দারের প্রেমে পড়ে যেমন রামা বিচিত্র হাসিতে ঘুমন্ত শিশুর দেয়ালা করত, তেমনি হাসে বউদি। সে হাসিতে যেন একটা ভয়াবহ সর্বনাশের ইঙ্গিত রয়েছে। বউদিকেও তার বড় ভয়। বউদির ইচ্ছা, ওই রামার মতো। একখানি ছোটমোটো বাসা, সেখানে হীরেন আর বউদি। বউদি নয় বউ। ছি ছি ছি, ততখানি নীচে কেমন করে সে নামবে।

এমনি ভয় ধিক্কার তার প্রিয়নাথের প্রতি। সন্ত্রাসবাদ ছেড়ে ওরা আবার একটা নতুন পথে এসেছে। একদিন এ পথও ওদের ছেড়ে দিতে হবে। দিতে হবে, কেন না, এ পথে ভারতের সেই অতীত আত্মাকে ফিরিয়ে আনা যাবে।

কোনও কোনও সময়ে, ভজনকে একলা পেয়ে একঘেয়ে কান্নার মতো নানান কথা বলে যায়। বলে, দেখো ভজু, যেদিন রাজনীতি করতে এসেছিলুম, সেদিন কিন্তু অন্যরকম ভেবেছিলুম। ভাবি, এত যে ছুটে চলেছি, জেল খাটছি কী পেয়েছি। এ তো সবই দলীয় রাজনীতির চুড়ান্ত হচ্ছে। কিন্তু ভারতের সেই মহাতীর্থ রূপটি কোথায় তাঁকে তো দেখতে পাইনে।…জানো, এক সময়ে ভাবতুম ভারতের সব নারীই বুঝি মহাশ্বেতা। নাঃ, আমি চলে যাব ভাবছি। সরে যাব এ-সব থেকে।

ভজন অমনি তীব্র গলায় চিৎকার করে ওঠে পেঁয়াজি পেয়েছিস হীরেন, অ্যাঁ? কাবুলে দেখেছি, পাওনাদার মরে গেলে কবরে লাঠি পেটা করে। কোথায় পালাবি?

হীরেন যেন সত্যি যমদূতের শমনের মুখে পড়েছে, এমনি আতঙ্ক ফুটে ওঠে তার চোখে। বলে, কেন বলছ এ কথা। কোনও পাপ তো করিনি।

করোনি? কীসের একটা চাপা ঝাঁজে যেন জ্বলে ওঠে ভজন। বলে, তবে কি পাপ করেছে আন্দামানের বন্দিরা? তাদের জন্য একটি কথা তোমরা বলেছ? বলি ফাইল বগলদাবা করে ইংরেজের অফিসে গিয়ে কোন্ স্বরাজের জন্য তোরা লড়ছি? বন্দিদের এই তিলে তিলে মরণ, তোমাদের এ শত্রুর সঙ্গে হাত মেলানো আর পরস্পরের সাহায্যের রাজনীতির জন্যে? তোমাদের এ খাতাবদলির দাবি আর সমাজ সংস্কারের ধাপ্পা দিয়ে ভেবেছ এ রেল আর চটকল মজুরদের তোমরা। ঠাণ্ডা করে রাখবে? ভজুলাটকে বাজে কথা বুঝিয়ো না নিয়োগী। আগামী দুচার বছরে তোমরা আরও ক্ষমতা পেতে পারো, এমনকী তুমি, কৃপাল, তোমরা সবাই কর্তা হতে পারো, কিন্তু জেনো সেটাই শেষ নয়। তোমরা ভেক নিতে পারো, সাধু হতে পারো না।

সে চুপ করে, কিন্তু শান্ত হতে পারে না। বারবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে দাদা নারায়ণ হালদারের মুখ। তিনি আছেন এখন আন্দামানে। মাঝে মাঝে চিঠি আসে ভজুর নামে। সে চিঠির সামনে পেছনে সবটাই কালি দিয়ে লেপা, খালি কয়েকটি কথা, যে কথা দিয়ে মানুষটাকে মনে করা গেলেও স্পর্শ করা যায় না।

তারপর চিৎকার করে ওঠে, চরণ, হীরেনকে চা দে।

বলে আবার বলে নিয়োগীকে, না কি, এক পেগ হবে। তোমরা তো আবার নিরামিষাশী। নিয়োগী যেন একেবারে ভেঙে পড়ে। বলে, দাও।

তার পর আপনমনে আওড়াতে থাকে ভজু।

লন্ডনের রাজার ভারতবর্ষ
মোরা যোগাই সুধীজনে হর্ষ।

আর একজন আসে শ্রীমতী কাফেতে প্রায় প্রত্যহ, কিন্তু কোনও দিন বসে না। লোকে তাকে বলে তিলক ঠাকুর, ভজু বলে ঠাকুরকাকা। সবাই জানে লোকটা সাংঘাতিক চশমখোর। কারবার তার তেজারতি।

তার পয়সা লুকোনো থাকে নাকি মাটির তলায়। যাকে বলে যখের ধন। পাড়ার আইবুড়ো আর অল্প বয়সী মেয়ে দেখে বেড়ায় বড় মানুষ প্রসন্ন চাটুজ্যে, যার নিজের ঘরে সুন্দরী বউ তবু ভুনুর মনিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে যেমন দাঁতহীন বুড়ো মাংসের দিকে তাকায় উগ্র লোভানিতে, সেই তার সঙ্গে তিলকঠাকুরের একমাত্র ভাব। প্রসন্ন চাটুজ্যে পেয়েছে গুপ্তধন, সেই ধনে সে বড়লোক। লোক বলে তারও নাকি যখের ধন। এরা মরলে আর জন্মাবে না। প্রসন্ন চাটুজ্জে আর তিলকঠাকুর জমে ভারী ভাল। শোনা যায়, তিলকঠাকুরের আসল নজরটা নাকি প্রসন্নর স্ত্রীর উপর। প্রসন্নর স্ত্রী, সত্যিই বলা চলে অপূর্ব সুন্দরী। কথাটা হয় তো প্রসন্নও জানে তবে উভয়েরই যখের ধনের যে মিলটা আছে, সেটা তাদের অবিচ্ছেদ্য করেছে।

কিন্তু তিলকের সাহস আছে বলতে হবে। সে রোজ শ্রীমতী কাফের বারান্দায় উঠে টিকিটি নেড়ে এক গাল হেসে বলে, ভাইপো, মাইরি বলছি, এ রাস্তাটা আর পার হতে পারি না তোমার এ শ্রীমা কেউফের মাংসের খোসবাইতে। সৎ বামুনকে একদিন খাইয়ে একটু পুণ্য করো। শত হলেও বিলিতি রান্না তো।

অর্থাৎ মরে গেলেও সে পয়সা খরচ করে খাবে না। ভজু জানে এখানে রাগ বৃথা। কিন্তু পিত্তি জ্বলে যায় তার। তবু বলে নিস্পৃহ গলায়, ঠাকুরকাকা, ভাইপোর আপনার মতি খারাপ, পয়সা ছাড়া যে আমি কেষ্ট বলতে পারিনে।

তিলকের নাসারন্ধ্র সত্যি ফুলে ওঠে মাংসের গন্ধে, সমস্ত মুখটা লালায় ভরে যায়। তবু পয়সা ব্যয় করে রেস্টুরেন্টে মাংস খাওয়া? আরে বাপরে। ছেলে বউ দূরের কথা, নিজে সে আধ পয়সার ঘুগনিও কোনওদিন কিনে খায় না ইচ্ছে হলে। কে জানে বাবা, কোন ফাঁকে গণেশ বিগড়ে বসে থাকবে।

ভজু ভাবে, এই তিলকঠাকুর কি মুক্তি চায় না! চাইবে কী করে। ও যে টাকা ধনরত্ন যখ দিয়ে রেখেছে।

তবে কে মুক্তি চায়। যুঁই চায়। যুঁই।

কই, তার চোখে তো আর সেই বিদ্রোহের ঝিলিক দেখা যায় না। ঠোঁটের সেই বাঁকা রেখাটি তো আর তেমন করে নীরব বিদ্রূপে জ্বালিয়ে দেয় না ভজুর হৃদয়। যেন ভাবের ঘোরে ভাবলেশহীন তার মুখ। অথচ যেন একটি কিশোরী বালিকা। বালিকা চুল বাঁধে না, আলতা পরে না, সাজগোজ করে না। সে বৈরাগিনী হয়েছে।

নিতাইয়ের মায়ের সে রূপ দেখে বুক জ্বলে না ভজুর, বুকের মধ্যে কে পুরুষ নিঃশব্দে অশ্রুহীন চোখে যেন লুকিয়ে কাঁদে!..না, যুঁই পারল না তাকে ছেড়ে যেতে। মৃন্ময়ী কি নবকুমারকে ছেড়ে যেতে পেরেছিল? যাবে তো, অমন করে গঙ্গায় তলিয়ে যাবে কেন!

বকুলমা ছুটে এলেন কেন বৃন্দাবন থেকে? মুক্তি পেলেন না সেখানে? কোথায় তাঁর ঠাকুর। এখন তো দিবানিশি মালা হাতে বসে থাকেন হালদারমশাইয়ের আরাম কেদারার পায়ার কাছে। দুজনেই নিঝুম। দেহ রয়েছে, তাঁরা দুজন নেই। কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছেন।

মুক্তির সন্ধানে গেছেন বুঝি।…

কথা বল হে মৌন রাত
চোখ চাও হে অন্ধ রাত
মুক্তি দাও হে অনন্ত রাত!…

ভজু এসে ঢুকল শ্ৰীমতী কাফেতে।

সন্ধ্যা হয়েছে, বাতি জ্বলছে এখানে সেখানে। স্টেশনে গাড়িতে যাত্রীর ভিড়। কলকাতার চাকুরেরা ফিরছে সব কাজের শেষে। ভিড় রাস্তার উপরে।

ঘোড়ার গাড়ি একটাও নেই স্ট্যান্ডে। জলদানিটার তলার মুখ থেকে জল উঠছে টগবগ করে। মোটর বাস পুষ্পময়ী স্টার্ট দিয়েও চিকার করছে, চলে এসো, খালি গাড়ি।

সন্ধ্যাকালীন ভিড় জমে উঠেছে শ্রীমতী কাফেতে। মেতে উঠেছে সকলে। এই মাতামাতিতে মাতেননি ভবনাথ। বরং অত্যন্ত বিরক্ত ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে রয়েছেন সকলের দিকে।

অদ্ভুত আসর জমিয়েছেন চাটুজ্যে মশাই। তিনি আজ ভূতের গল্প আরম্ভ করেছেন। কোন এক বাদশার ছেলে ঘুটে কুড়োনীর মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে জান ফতে করেছিল, তারই কাহিনী। একালে প্রেমটাই তো তারই ভৌতিক ব্যাপার।

শুধু ঘন ঘন হাতের সোনার ঘড়ি দেখে সুনির্মল। সরসী তাকে ডাকতে আসবে।

রাত্রি নটার পর শ্রীমতী কাফে প্রায় নিরালা হয়ে আসে, চরণ যখন তার ভারতের হাঁড়িটি উনুনে বসিয়ে দেয়, তখন শহরের বড় রাস্তাটায় লোজন কমে আসে, স্টেশনে লোকাল ট্রেনের ভিড় কমে গিয়ে মেইল ট্রেনের যাত্রীরা ঘুমোয়, ঘোড়ার গাড়িগুলো প্রায় আশাহীন হয়ে পড়ে থাকে, অবশ হয়ে আসে ঘোড়াগুলির রুগ্ন শরীর, দক্ষিণ থেকে ছুটে আসে চৈত্রের ঝড়ো হাওয়া তখন ভবনাথ আর ভজু যার পেছনের ঘরটায়।

এতক্ষণ প্রতীক্ষা করা ভবনাথের অসহ্য। ছেলেমানুষের মতো কান্না পায় তাঁর। ইচ্ছে হয় ভজুকে কামড়ে খামচে দেন। রোজই এ অস্থিরতাকে চেপে ঠাণ্ডা গলায় বলেন, কাল থেকে আর আসব না হে ভজু। কিন্তু যখন পানীয় পড়ে, তখন আবার নিজেকে ফিরে পান। আবার ঠিক সন্ধ্যাবেলাটিতে হাজির হন এসে।

তাদের এ আসরে ভজু কোনও কোনও দিন ডেকে নিয়ে আসে তার ভুনু সারথিকে। প্রথমে এ ব্যাপারটা দেখে তো ভবনাথ প্রায় আঁতকে উঠেছিলেন। একটা গাড়োয়ানের সঙ্গে বসে মদ্যপান। কিন্তু ভজুর পাল্লায় পড়ে এ আত্মসম্মানটা তাকে খোয়াতে হয়েছে। এখন আর ভুনুকে তার তত বাধে না। কিন্তু মদ না খেয়ে চরণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে, সেটা তার পক্ষে অসম্ভব।

আজ মদ খেয়ে ভবনাথ বাইরে এসে রোজকার মতো সেই একই কথা প্রথমে বলেন, দেখো ভজু, শুনেছিলুম বুড়োদের নাকি জীবনে কোনও সাধ থাকে না। কিন্তু আমি তোমাকে জোর করে বলতে পারি, আমার বড় ছেলের চেয়েও আমার শক্তি যথেষ্ট।

ভজু বলে, তোমাকে দেখে তাই মনে হয়। বিয়ে টিয়ে করতে ইচ্ছে যায়?

তোমার খালি ঠাট্টা। এ বয়সে আবার বিয়ে। ভয়ানক গম্ভীর হয়ে গিয়ে ভবনাথ চোখ বুজে মোটা গলায় বলেন, তবে দেখো ভজুলাট, ছেলেটার বে দিয়ে আমি ভুল করেছি।

এরকম বকবকানি প্রত্যহের ফলে ভজু এ সময়ে নির্বিকার শ্রোতা মাত্র। বলল, এ যে নতুন কথা শোনালে বাঁড়ুজ্যে দা?

হ্যাঁ হে, তাই শোনাচ্ছি। ভবনাথ কিছুটা উত্তেজনা বোধ করেন। বলেন, চাকরি, বিয়ে, সংসার এ-সবের মধ্যে না ঢুকিয়ে ছেলেটিকে যদি অমানুষ করে ফেলতাম, একবার দেখতাম তা হলে কী পরিণতিটা হয়। অর্থাৎ ও নিজে ওর জীবনটাকে কী ভাবে গড়ে, সেটা একবার দেখতাম।

এবার কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে ভজু ভাল করে ভবনাথের মুখটা দেখে বলে, বলল কি বাঁড়জ্যে দা, একেবারে ছেলের বিনিময়ে এমন কড়া একত্সপেরিমেন্ট কীসের জন্য?

শ্ৰীমতী কাফের উজ্জ্বল আলোর উপরেও দরজার কাচের একটা ধারালো শেড ভবনাথের অ্যালকোহল উজ্জ্বল মুখে পড়েছে। মনে হচ্ছে, লোকটা ভবনাথ বাঁড়জ্যে নয়, আর কেউ।

বলেন, দেখো ভজু, নিজের জীবনটার দিকে যতই ফিরে তাকাই, কেবলি দেখি কতগুলো ফাইল, কাগজ আর বাংলাদেশের কতগুলো স্টেশনের অন্ধকার ঘর। এমন কী স্ত্রীর মুখটা পর্যন্ত মনে করতে পারি না, সত্যি বলছি।…এখন আমার এ ছেলেটার জীবন দেখে মনে হচ্ছে আমিও হয়তো এমনিই ছিলাম, সেই একই ব্যাপারের এপাশ ওপাশ। এর কি দরকার ছিল?

ভজু বলল, সেই তো ভাল বাঁড়জ্যে দা, তোমার নিজেকেই আর একবার ঝালিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

ভবনাথ যেন অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে উঠলেন, ছি ছি ছি, আমার ঘেন্না ধরে গেছে ভজুলাট, ও জীবনটা আমি আর দেখতে চাইনে। আমার মতো বয়সে ওরও হয়তো এই পরিণতিই হবে।তা ছাড়া আর কী-ই বা হতে পারে। ও তো অলরেডি খাঁচায় আটকা পড়ে গেছে।

ভজু দেখল, ভবনাথের এটা মাতলামি নয়, হৃদয়েরই কথা। বলল, তোমার ছেলে কী হলে তুমি খুশি হতে?

তা জানিনে ভজু কিন্তু আমারই মতো চাইনে। তারপর জনহীন রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ও যদি চোর হত, ডাকাত হত, ও যদি পরের মেয়েকে ছিনিয়ে এনে বিয়েও করত তাতেও আমার আপত্তি ছিল না। ও পান বিড়ি কিছুই খায় না, বউ বলে ওকে যে মেয়েটাকে এনে বিয়েছি, তার দিকে ছাড়া কোনওদিকে ফিরেও তাকায় না। পরের ছেলে দুটোও যেন তাই হচ্ছে। এই আদর্শে আমার ঘেন্না ধরে গেছে ভাই। আমি একটু হাওয়া চাই আমার গুমোট ঘরে। আমি যেন আমাকে আর না দেখি।

ভবনাথের বেদনা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল ভজুকে। সে বুঝেছে, এ বেদনা হল গর্ভবতীর বেদনা, অন্ধ প্রকোষ্ঠের শিশু যত সংশয়াম্বিত হোক, এ সংসারের আলো দেখতে চায় সে। ভবনাথের বেদনা নতুনের জন্য। সে তাকিয়ে দেখল, ভবনাথের গলার শিরাগুলো ফুলে উঠেছে, মুখটা লাল হয়ে উঠেছে আরও। একটা অদ্ভুত হাসির আভাস তাঁর মুখে।

ভজুর একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে তিনি ফিসফিস করে বললেন, ক্ষুদিরাম বলে এক বাঙালির নাম শুনেছি, তাকে সরকার ফাঁসি দিয়ে খুন করেছে। তোমার দাদা নারান হালদারের কত কথা বলেছে। ভাবি, এ মহাজীবনের এই মহামরণের পথেও যদি আমার ছেলেরা যেত

ভবনাথের রক্তচোখ ফেটে অকস্মাৎ জলের ধারা গড়িয়ে এল। ধরে আসা গলায় বলে চললেন, আমি যদি কাপুরুষের মতো বাধাও দিতাম—তবু…তবু…

একে একে শহরের বাতি নিভে আসতে থাকে, নেমে আসে অন্ধকার। স্টেশনের কুলিরা ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমিয়ে পড়েছে রাস্তাটা। চরণ ঝিমুতে থাকে পেছনের অন্ধকার ঘরটায়।

রাতের নিঝুমতায় চৈত্র হাওয়া উদাস হয়ে যায়, আনমনে ধাক্কা দিয়ে যায় শ্রীমতী কাফের ঘরে।

ভজু বলল, বাঁড়জ্যেদা, চলো বাইরে যাই।

দুজনেই তারা বাইরে এসে দাঁড়ায় অস্থির পদক্ষেপে।

নির্মেঘ আকাশে ঝকমক করছে তারা। সুস্পষ্ট ছায়াপথের শুভ্রতা যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

রেলওয়ে ইয়ার্ড থেকে ভেসে আসছে লুজ সান্টিং-এর গুমগুম শব্দ।

ভজু বলল রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে, বাঁড়ুজ্যেদা নেশাটা আজ মাটি করে দিলে তুমি।

তারপর গম্ভীর গলায় বলে উঠল,

নীলে নীল বিষ শিরে শিরে রয়,
লক্ষ জীবনের মিছে অপচয়,
আজ কিসের উচ্ছাসে ওঠে বুদবুদ।
এ কোন্ রক্ত চাহিতেছে সুদ?
কড়ায় গণ্ডায় হিসেব যে চায়
নীল বন্যার একি ঠেকা দায়,
কে এ শিশু রক্ত-পত্র হাতে
হেসে হেসে আসে খুলি রাঙা পথে।

তারা দুজনে রাস্তার মাঝখানে। পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে একটা মোটর গাড়ি। তার পথ রুদ্ধ। কেবলি হর্ন দিচ্ছে।

ভজু চিৎকার করে উঠল, চুপ করে পাশ দিয়ে চলে যা।

ভেতরের যাত্রী এদেশীয় স্বামী-স্ত্রী। ভয়ে বিবর্ণ হয়ে তাঁরা যেন সিটের গায়ে মিশে গেলেন।

ড্রাইভার একবার ভীত চোখে ভজুলাটকে দেখে, প্রায় নিঃশব্দে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। আবার ঠাণ্ডা হয়ে আসে ভজু। একটু আরাম অনুভব করে হাওয়ার স্পর্শে। বলে, বাঁড়জ্যেদা, তোমার কথা আমি খানিক আন্দাজ করতে পারি। তোমার চাপা পড়া প্রাণে আগুন লেগেছে। তেমনি এ বিশ্ব সংসারের সকলের প্রাণেই আজ আগুন। কিন্তু আমরা বোবা, কেউ কথা বলতে পারিনে।

বলে সে একটু চুপ করে থেকে বলল, আমি ভজু, ভজুলাট মাতাল। আমাকে সকলে হিসেবের বাইরে রেখে দিয়েছে! দিক, দোষ দেব না…দেখো, ছোটকালে বাবাকে দেখেছি মাতাল, প্রতিবেশিকে দেখেছি স্বার্থপর। পয়সার জন্য ব্লেড় দিয়ে মাসির গলা কাটতে দেখেছি পাড়ায়। মা বাবা কাউকে আমার বিশ্বাস ছিল না। মায়া ছিল না নিজের প্রতি। মদ যেদিন প্রথম খেয়েছি, নির্ভয়ে খেয়েছি, বাবার সামনে দিয়ে হেঁটে গেছি! এ ছাড়া আর কী উপায় ছিল জানতুম না। কার তোয়াক্কা, কীসের তোয়াক্কা, আর কীসের আশায়? জীবনটাকে কোনওরকমে ক্ষয় করে ফেলা, এই তো জীবন!…শালা ঘরে একটা ফোঁটা মদ রাখতে পারি না, বাবা খেয়ে ফেলে। সংসারের আগে পেছনে সমস্তটা শুন্য। এ শ্রীমতী কাফে চোরাবালুর উপর দাঁড়িয়ে আছে, আমি দেনায় তল হয়ে আছি। তোমরা বলবে এ শুধু আমার দোষ, কিন্তু পারি না। সকলের মুখে আমাকে অন্ন তুলে দিতে হয়, শ্ৰীমতীর রোজগার আমাকে সবটুকু পোষাতে পারে না আর বাবা…।

থেমে যায় সে। ভবনাথ চেয়ে থাকেন তার মুখের দিকে। সে আবার বলে, যুঁই। ভাবি কেন মরতে এনেছিলুম। ওর বাবা কাঁড়িখানেক টাকা দিয়েছিল, কবে তা খেয়ে বসে আছি। আজকে আমার নিতাই গৌর, ওদের আমি কোথায় রেখে যাব, কার কাছে, কোন্ আশ্রয়ে? এ জীবনের বেড়াজালকে ভাঙতে পারলুম না। যিনি পেরেছেন, তিনি চলে গেছেন। আমি? আমি কী করব আমার এ অবিশ্বাস, সংশয়, সংন্দেহ দিয়ে, কোথায় কুট মাথা?

তার কানে বেজে উঠল সেই ঝড়জলের রাতে ভুনুর গাড়ির ঘরঘর শব্দ। ভবনাথের স্পর্শে যেন মনে হল, নারাণ হালদার তার হাত ধরেছেন। সে শুনতে পেল সেই কথা, তুমি তাকে পথে দেখাও, ছিঁড়ে ফেলো এ অন্ধকার, ভাঙো এ পথের বাধা।….

কার কাছে, কার কাছে সে প্রার্থনা, কোন্ সে মহাশক্তি? বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠল নিতাই, গৌর, চরণ, যুঁই, ভবনাথ…।

সামনে তাকিয়ে দেখল ভুনু দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেই রাত্রে যে ভুনু সোনা নেয়নি। সে দু-হাতে ভুনুর হাত জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, জীবনের ভাঙা পথে আমি যেন তোর মতো গাড়োয়ান হতে পারি। আমি যেন মুটে হতে পারি। আমাকে যেন কোনওদিন থামতে না হয়, কোনওদিন না।

রাত নিঝুম, নক্ষত্র নির্বাক, ঝিঝির গোঙানি, উতলা হওয়ার বারো বাসর জাগার পালা নাড় পুরোতের গলিতে।

আচমকা সমস্ত কিছুকে চমকে তীব্র কণ্ঠের মিনতি ভেসে এল গঙ্গার ধার থেকে বউ কথা কও,–কথা কও!

.

চরণের ঘরের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সেই মেয়েটি। আসে এখন প্রত্যহ। বোধহয় অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে এমনি আসাটা। অনুরোধ না করলেও স্ব-ইচ্ছায় বহুক্ষণ থেকে যায়। তাড়া নেই, নেই তীব্র বিদ্রূপের কশাঘাত।

চরণের সে উচ্ছাস মৃত, আবেগ উধাও। তবুও অষ্টপ্রহর উনুনের আঁচে জ্বলা পোড়া মুখটা ঠাণ্ডা হয়ে আসে, বন্ধুকে অভিনন্দনের হাসি ফোটে মুখে। বলে, এলো। ঘরে লোক ছিল না?

মেয়ে নয়, বারো বিলাসিনী। বাঁকিয়ে হাসে, অকারণ ছায়াঘন চোখে আলো জ্বালাতে চায়। বলে, তুমি কি তোক নও?

লোক বইকী। আমি যে চরণ।

কার চরণ?

তোমার চরণ।

ছি। মেয়েটি হেসে ফেলে। তারপর জিজ্ঞেস করে, কী খেলে, আর কী খবর। বলে তাদের পাড়ার খবর। তারপর বলে চরণকে, তোমাকে ভালবাসি।

চরণ জানে হয়তো ও ভালবাসে না, এ কথা বলাটা বুঝি ওর অভ্যাস! তবু চরণ তার মাসের পুঁজি একটু একটু করে দিয়ে নিঃশেষ করে ফেলে সব। খাওয়ায় ওকে উদ্ধৃত্ত চপ কাটলেট। না চাইতে এমন ভাবে দেয় যে, মেয়েটা নিজেই এক একদিন লজ্জায় বলে ফেলে, আজ থাক, কাল নেব।

তারপর খুব ধীরে ধীরে চরণের আবেগ আসে, মনটাকে তলায় ফেলে জয় হয় শরীরের। তখন সে দুহাতে মেয়েটিকে নিয়ে যেন গুটিয়ে ফেলে তুলোর দলার মতো।

মেয়েটি স্বাভাবিকভাবে বলে, রাতে রোজই তোমার কাছে চলে আসতে ইচ্ছে করে, কিন্তু ওদের হিসেব না মেটালে তো চলে না…তুমি ঝাল বড়ি খেতে ভালবাস বলছিলে, আচ্ছা কাল নিয়ে আসব।

চরণ বিড়ির পর বিড়ি ফোঁকে। কথা বলার জন্য প্রাণটার মধ্যে ছটফট করে, কিন্তু তার জিভটা যেন অসাড় হয়ে যায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই অসীম সমুদ্র, অনন্ত আকাশ। তারপর বলে, ঝাল বড়ি এনো, আমার এখানে তোমারও নেমন্তন্ন রইল মাছ ভাতের।

আ-মৃত্যু যার কপালে সিন্দুর থাকবে, সেই চিরসধবার এই-ই তো প্রকৃত নিমন্ত্রণ।

নোয়া সিন্দুর মাছ ভাত সোনার বরণ পতি।
রেখে ড্যাং ড্যাং করে সগ্‌গে গেল চির আয়ুষ্মতী ॥

.

যুঁই। ভজু ডাকল।

রাতের নিরালা পথের দিকে তাকিয়ে যুঁই দাঁড়িয়েছিল জানালার কাছে। বলল, যাই। যুঁই দরজা খুলে দিল।

দরজা খুলে দিয়ে যুঁই রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল। ভজু তাকে ধরে ফেলল। বলল, আজ আর খাব না যুঁই।

এটা নতুন নয়। প্রায় প্রত্যহ রাতেই তার খাওয়া হয় না। যন্ত্রণা বাড়ে যুঁইয়ের। বলে, আর কতদিন এ ভাবে চালাবে? শরীরটা যে যাবে?

কিন্তু, খিদে যে আমার সত্যি নেই, নিতাইয়ের মা।

এমন ভাবে বলে যে যুঁই আর জোর করতে পারে না। সে ভজুর উত্তপ্ত গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সংসারের কথা বলে, রোগের কথা বলে।

ভজু হঠাৎ বলে ওঠে, যেন আচমকা যযুঁইয়ের সারা অন্তরটাকে চোখের সামনে তুলে এনে বলে, আচ্ছা যুঁই, এই কী চেয়েছিলে? তোমার জীবনের ভবিষ্যতের স্বপ্নে, একদিনও কী এ রাতের কথা ভাবতে পেরেছিলে?

যুঁই নিচুপ। তার চোখ ফেটে জল এসে পড়ে। সত্যি যে সে স্বপ্নের অগোচরেও তার জীবনের এমন রাতকে কল্পনা করতে পারেনি। তার শৈশবে সারা দেহ ভরে কোনও উল্লাস জাগেনি এই রাত্রির জন্য। এই ভজুর বুকে আজ সে আলিঙ্গনাবদ্ধ হওয়ার জন্য আকুল হয়। কিন্তু তার কুমারী প্রাণে কোনওদিন এ শিবের মূর্তি গড়েনি। কিন্তু কী হবে সে কথা ভেবে!

ভজু বলে, পারোনি, আমি জানি। কেউ পারে না। এ সংসার তাই। কিন্তু একলা আমাকে দোষ দিয়ো না যুঁই। দোষ যদি দাও, অভিশাপ যদি দাও, তবে এ পুরুষশাষিত সমাজকে দিয়ো। তুমি এ অন্ধঘরের কোণে পড়ে থাকো, তবু জানি কী আগুন লুকানো আছে তোমার বুকে। যদি কোনওদিন আগুন জ্বালো, তা হলে সারা বিশ্বকে জ্বালিয়ে।

যুঁই বলে ওঠে, থাক, তোমার এত কথা তো আমি বুঝিনে। শুধু এইটুকু বুঝেছি, তোমাকে আমি পারিনি বাঁধতে, তোমাকে আমি পাইনি, পাইনি।

রুদ্ধ কান্নায় গলার স্বর বন্ধ হয়ে গেল তার।

ভজুর ইচ্ছা হল চিৎকার করে বলে, সত্যি বাঁধতে পারোনি, তোমার নারীর সমস্ত ক্ষমতাকে তুমি টিপে চেপে রেখেছ, তোমার পরাজয়ের অপমান নিয়ে তুমি পড়ে আছ। আমরা কেউই কাউকে পাইনি, কেউ না।

নিতাই স্বপ্ন-ঘোরে ডেকে উঠল, মা।

এই যে বাবা বলে ওঠে যুঁই। তারপর ঘুমন্ত নিতাইয়ের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ভজুকে বলে একেবারে পরিষ্কার গলায়, ভুতুড়ে ভাবনা রাখো, শুয়ে পড়ো বাপু। রাত হয়েছে।

রাত হয়েছে। একটা নিশ্বাস ফেলে ভজু তবু যুঁইয়ের কাছে গিয়ে মুখ গুজে পড়ে। মনে মনে বলে, কথা কও, হে মৌন রাত, কথা কও!

নিশুতি রাত চিৎকার করছে, বউ কথা কও।

.

সন্ধ্যাবেলা শ্রীমতী কাফের জমজমাটির মাঝে আবিভাব হল তিলকঠাকুরের। বোধহয় অভ্যাসের বশেই, পেছনের ঘরটার দিকে তাকিয়ে নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে, ভাইপো, একদিন খাওয়াও বাবা বিলিতি রান্না, একটা দিন।

আজ সন্ধ্যার ঝোঁকেই ভজুর মাথা এলিয়ে পড়েছে টেবিলের উপর। বলল, খাবে? বেশ, বসো। আজ খাওয়াব তোমাকে।

তিলকঠাকুর কিছুতেই যেন বিশ্বাস করতে পারে না। খুশিতে ঢোক গিলে বলে সত্যি বলছ ভাইপো।

সত্যি নয় তো কী মিছে! চরণ? হাঁকল ভজু।

চরণ এল মুখ বেজার করে। ভজু হুকুম দিল, দে, ঠাকুরকাকা যা খেতে চায় তাই দে। কোমা পিস্ দে, কারি দে, চপ, কাটলেট, যা আছে সব দে।

তিলকঠাকুর সকলের দিকে হেসে হেসে তাকায়। হাতে হাত ঘষে বসে পড়ে ভবনাথের পাশে। আবার ভবনাথকেই বলে গলা নামিয়ে, মাতালই বা কী আর ভগবানই বা কি। দুটোই সমান। ভজু আমার ভাইপো!–-

তিলকঠাকুর লোভী রাক্ষসের মতো খায় তারিফ করে। বলে, এ যদি বিলিতি রান্না হয়, সত্যি বলছি, এ দেশটাও যেন বিলেত হয়ে যায়। বেঁচে থাকো ভাইপো শ্রী মা কেইফের দিন দিন ছিবিদ্ধি হোক।

খাওয়া শেষ হলে ভজু বলল, আর খাবে না?

ভাইপো, খুব খেয়েছি আর একদিন হবে।

ভজু ডাকল, চরণ!

আঁজ্ঞে!

ঠাকুরকাকা কী কী খেয়েছে?

চরণ বলল, চার পিস্ কোর্মা, এক ডিস্ কারি, দুটো চপ, দুটো কাটলেট।

ভজু বলল, মানে, তিন টাকা দশ আনা?

তিলকঠাকুর একটু বিমর্ষ হয়ে বলল, সত্যি ভাইপো, তোমার অনেক পয়সা খেয়ে ফেললুম।

আমার কেন খাবে, তোমারই খেয়েছ। ভজু বলল, রক্তচক্ষু তুলে, সুদ আদায় করে ফিরছ, ট্যাঁকেও টাকা আছে, দিয়ে যাও।

জোর করে হাসে তিলকঠাকুর। হেঁ হেঁ কী যে বলল ভাইপো।ভজু প্রায় দাঁড়িয়ে ওঠে, হেঁ হেঁ কী যে, নয়। তিন টাকা দশ আনা দিয়ে তবে যাও। চরণ কাছে দাঁড়া।

তিলকঠাকুরের মুখ একেবারে অন্ধকার। ককিয়ে উঠল, তুমি যে আমাকে খাওয়ালে?

সবাইকে খাওয়াই, তা বলে কী পয়সা নিইনে?

তিলকঠাকুর কেঁদে ফেলে প্রায়। সারা ঘরে আরম্ভ হয়ে যায় গুলতানি। ঠাকুরের সাক্ষী মানা কেউ-ই শোনে না।

একে বলে আক্কেল সেলামি। দেবে তো দাও, নইলে বে-ইজ্জত হবে কিন্তু। ধমকে ওঠে ভজু।

সত্যি চোখের জল মুছেই তিলকঠাকুর ট্যাঁক থেকে টাকা বার করে দিয়ে চিৎকার করে ওঠে, আমি যদি খাঁটি বামুন হই, তবে তোকে অভিসম্পাত দিচ্ছি—

ভগবানকে দাও ঠাকুরকাকা, আমাকে যে তিনি গড়েছেন।

তিলকঠাকুর ততক্ষণে চিৎকার করতে করতে পথে নেমে গিয়েছে।

ভজু চিৎকার করে ডাকল, ঠাকুরকাকা শোনো।

তখন তিলকঠাকুরের আশা হল, তবে বোধ হয় পয়সা দিয়ে দেবে। সে ফিরে এল।

ভজু বললে, আমি কে বলল তো?

ভজু।

উঁ, হুঁ, ভজুলাট। মনটা তোমার খারাপ হয়েছে, গানু পুরোতের ছেলের বিধবা বউয়ের কাছে যাও, ভাল লাগবে।

তিকঠাকুর পৈতে ধরে চিৎকার করে উঠল, সে ভগবান, হে ঈশ্বর, হে চন্দ্র সূর্য, এ শয়তানকে ধ্বংস করো। ধ্বংস করো। বলতে বলতে চলে গেল।

ভজু বলল ভগবানকে, আমার কাছে রমজা নি। জানো, শুনেছি, সি, আর, দাশকে একজন প্রফুল্ল ঘোষ সম্পর্কে বলেছিলেন, ঘোষ মশাই খুবই সরল। তিনি বলেছিলেন, হ্যাঁ, একটা লোহার শিক গরম করে ঘোষের মাথায় ঢুকিয়ে দিলে সেটা স্কু-থ্রেডের মতো পাকিয়ে বেরিয়ে আসবে। এ ব্যাটারা তাই।

হাসিতে গোলমালের মত্ত হয়ে উঠল সব কেবল হীরেন ছাড়া।

আর একজনের চোখে কিছুই ছিল না। সুনির্মল তার দুটি চোখ দিয়ে তাকিয়েছিল বাইরে, ওই এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে, দুনম্বর প্লাটফর্মের ওভারব্রিজের সিঁড়ির ভিতর দিয়ে এক টুকরো তারা মিটমিট করা আকাশের দিকে! সেখানে শুধু সরসী রায়, ওই ঝিকিমিকি তারা তারই হাসি, তারই চোখ।

গণ্ডগোলের মধ্যে সে গান গাইতে লাগল,

কেন পান্থ এ চঞ্চলতা?}
কোন শূন্য হতে এল তার বারতা?

কিন্তু তিলকঠাকুর ছাড়বার পাত্র নয়। সেখান থেকে বেরিয়েই ছুটে গেল ভজুর বাবার কাছে। গিয়ে একেবারে কেঁদে পড়ল সে।

ভজুর বাবা মহাদেব হালদার বসে আছেন বাইরের বারান্দায় চেয়ারে হেলান দিয়ে। চেহারাটাতে ভাঙনের লক্ষণ সুস্পষ্ট, একটা বিরাগ ও উদাসীনতায় কেমন গম্ভীর ও বিষণ্ণ দেখায় তাঁকে। ভজুর তীক্ষ্ণতা তাঁর মুখে চোখেও স্পষ্ট কিন্তু তা যেন কয়েকটা বিরক্তির তির্যক রেখায় বেঁকে রয়েছে। যেন মনে হয়, এ সংসারকে একদিন তিনি ভালবেসেছিলেন এবং প্রতিদানে ঠকেছেন। সেইজন্য আজ আর বিস্বাদের অন্ত নেই। তাঁর বিরাট খাঁড়ার মতো নাকটা এখন অনেকখানি ঝুলে পড়েছে।

যেমন বসে থাকেন তৈমনি বসে রইলেন হালদার মশাই। অপলক চোখে তাঁর সেই বিরক্তব্যঞ্জক দৃষ্টি দিয়ে তিলকের দিকে চেয়ে দেখলেন একবার।

তিলক সমানে বলে চলল ভজুর কথা, কেবল বাদ দিল গনু পুরোতের ছেলেদের বউয়ের উল্লেখটা। বলল, সেই তোমার মনে আছে দাদা, কালি কায়েতের সঙ্গে তোমার শেষ মামলার দিন তুমি আমার কাছে দশটা টাকা চেয়েছিলে। আমার কাছে সাতশো টাকা ছিল আমি তোমাকে তবু দিইনি। টাকা আমার আদরের। তুমি তো তাতে আমার উপর রাগোনি। আর তোমার ছেলে খাওয়ার নাম করে আজ কী দাগাটাই দিলে। খাঁটি বামুন হও তো, এর বিচার করতেই হবে।

মহাদেব হালদারের কোনও ভাবান্তর হল না এত কথা শুনে। যেমন শুনলেন তেমনি নির্বিকার ভাবে বললেন, তুমি এক কাজ করো তিলক। পাঁচ টাকা খরচ করে দশ টাকা নিতে চাও?

তিলকের চোখ জ্বলে উঠল, কে না চায় দাদা।

তবে দশটা পয়সা খরচ করে তোমাকে সদরে যেতে হবে। গিয়ে আমাদের উকিল মিত্তির মশায়ের সঙ্গে দেখা করতে হবে। এক নম্বর ম্যাজিস্ট্রেটের ঘরে যাতে পড়ে সেরকম মুসাবিদা করে ভজুর নামে একটা মামলা ঠুকে দিয়ে আসতে হবে। মানহানি ও মারধোর। পারবে?

মহাদেব একইরকম চোখে তাকালের তিলকের দিকে।

তিলকের চোখ জোড়া যাকে বলে একেবারে ছানাবড়া হয়ে গিয়েছে। সে কথা বলবে কি, তার খালি মনে হতে লাগল, কোথায় এসেছে সে। তার মুখ দিয়ে খালি বেরিয়ে এল, তুমি বলছ, তোমার ছেলের নামে।

মহাদেব হালদার বললেন, আর মিত্তির মশাইকে বলবে, যে,–

তিলক ততক্ষণে নেমে পড়েছে বারান্দা থেকে। বলল, আর বলল না দাদা, তোমাকে নমস্কার। তিন টাকা দশ আনা আমার আক্কেল সেলামি গেছে।

বলে সে পোঁ পোঁ করে পালাল।

তাতেও, কোনও ভাবান্তর হল না হালদারমশায়ের। তিনি পুবের অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দেখলেন, অন্ধকারের মধ্যে আরও অন্ধকার যেন ধোঁয়ার মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে। কেবলি উঠছে আর শ্বাসরোধ করে ফেলছে।

তিনি বললেন, হে নারায়ণ।

তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা অন্ধকার ছোট্ট ঘর এবং তার লোহার বেড়া। তার ভেতরে গালে হাত দিয়ে কে একজন বই পড়ছে। ফিস ফিস গলায় কয়েকটি শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে থেকে থেকে সেই অন্ধকারে, মুক্তি—স্বাধীনতা–মৈত্রী!–

কে এসে একজন দাঁড়াল হালদার মশায়ের সামনে। তিনি চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করলেন, কে? নারান? অর্থাৎ তাঁর বড় ছেলে। জবাব এল, আমি নি।

নি কে?

আমি তা।

তা?

আমি হস্সই…। বলে নিতাই খিলখিল করে হেসে উঠল।

হালদারমশাই বললেন, হারামজাদা।

তাতে নিতাইয়ের হাসি আরও দুবার হয়ে একেবারে বাড়ি মাথায় করে তুলল। যুঁই সচকিত হয়ে রান্নাঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। হতভাগাটা পড়াশোনা ছেড়ে পালিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *