ফিরোজা বেগম ০১ পরিচ্ছেদ

শারদীয় পৌর্ণমাসী শশধরের ন্যায় নির্মল কৌমুদীজাল বিতরণ করিয়া মোসলেম-প্রতিভা-শশী কালের অলঙ্ঘনীয় নিয়মে রাহুগ্রস্ত হইয়া পড়িয়েছে। অতুলীয় কীর্তি কিরীটিনী নগরীকুল শিরোমণি দিল্লীর প্রতাপ ও গৌরব খর্ব হইয়া পড়িয়াছে। ভুবনবিখ্যাত তৈমুরবংশে বীরচূড়মণি বাবর, বিচিত্রকর্মা হুমায়ুন, প্রতিভাশালী আকবর, তীক্ষ্ণবুদ্ধি জাহাঁঙ্গীর, কীর্তিমান শাহ্‌জাহান এবং তাপসসম্রাট আওরঙ্গজেবের পরে ক্রমশঃ হীনবীর্য অদূরদর্শী বাদশাহগণ দিল্লীর তখ্‌তে বসিতে লাগিলেন। তাঁহাদের ব্যসন-বিলাস, অবিমৃষ্যকারিতা এবং উজির ও সেনাপতিগণের বিশ্বাসঘাতকতার ভুবনবিখ্যাত দিল্লী সাম্রাজ্য ক্রমশঃ খণ্ড বিখণ্ড হইয়া হীনবল এবং হীনপ্রভ হইতে লাগিল।

অযোধ্যা, রোহিলাখণ্ড, সিন্ধু, কাশ্মীর, বাঙ্গাল, হায়দ্রাবাদ, কর্নাট, মালব প্রভৃতি বহু স্বাধীন রাজ্যের পত্তন হইল। এই সমস্ত রাজ্যের মধ্যে সর্বদাই যুদ্ধবিগ্রহ সংঘটিত হওযায় সমগ্র ভারতবর্ষ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িল। এই সুবণৃ সুযোগে মারাঠীয়রা দলবদ্ধ হইয়া শিরোত্তোলন করিল। তরবারি এবং অগ্নিমুখে তাহারা হিন্দুস্থানে এক মহাপ্রলয়কাণ্ডের সূচনা করিয়া দিল। শান্তিময় ভারত সাম্রাজৌ মারাঠীয়রা বিধাতার অভিসম্পাত স্বরূপ আবির্ভূত হইয়াছিল। হত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ, বৃক্ষচ্ছেদন, শস্যদাহ, সতীত্বনাশ প্রভৃতি যত প্রকারের অত্যাচার এবং অবিচার শয়তানের মস্তিষ্কে থাকিতে পারে, তাহা সম্পূণৃভাবেই মারাঠীদিগকে আশ্রয় করিয়াছিল। মারাঠীদিগরে অত্যাচারে ভারতের সর্বত্রই ‘ত্রাহি’ আর্তনাদ উত্থিত হইয়াছিল। মারাঠী দস্যুদিগের নিকট ধনী-দরিদ্র, স্ত্রী-পুরুষ, বালক-বৃদ্ধ, হিন্দ-মুসলমান কোন প্রভেদ ছিল না।

সর্বত্রই তাহারা ভূমি-রাজস্বের চতুর্থাংশ (চৌথ) পাইবার জন্য ভীষণ জুলুম এবং অত্যাচার করিতে লাগিল। জগদ্বিখ্যাত দিগ্বিজয়ী চেঙ্গিজ খাঁর নৃশংস আক্রমণে এবং নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে যেমন একদিন পশ্চিম-এশিয়ার মুসলমানগণ উৎপীড়িত, নিহত, লুণ্ঠিত এবং ছিন্নভিন্ন হইয়া পড়িয়াছিলে, আরব ও ইরান-তুরানের বিপুল বিশাল সভ্যতার আলোক-ভাণ্ডার যেমন নির্বাপিত হইয়া গিয়াছিল, ধূর্তচূড়ামণি নির্মমপ্রকৃতি মারাঠী দস্যুদলের অত্যাচার, উৎপীড়ন এবং হত্যা ও লুণ্ঠনে ভারতের বক্ষে তেমনি ঘরে ঘরে দারুণ হাহাকার উঠিয়া গগন-পবন আলোড়িত করিতে লাগির। এই অত্যাচার, হত্যা এবং লুণ্ঠনের মুখে হিন্দু ও মুসলামানের কোন পার্থক্য ছিল না। লুণ্ঠন করিতে করিতে মারাঠীরা তাহাদের গুরু শিবাজীর সময় হতেই সাহসী, কৌশলী, ধূর্ত এবং নিষ্ঠুর হইয়া পড়িয়াছিল।

এইরূপ যখন মারাঠীদিগের অত্যাচারে মন্দির ও মসজিদ চূর্ণীকৃত এবং হিন্দু ও মসুলমান উভয়ই লুণ্ঠিত এবং নিহত হইতেছিল, সেই সমযে দিল্লী লুণ্ঠনকারী মারাঠীদিগের বিক্রান্ত এবং রণনিপুন সেনাপতি সদাশিব রাও এবং তাহার অধিনস্থ নায়ক, ভাস্কর পণ্ডিতের মধ্য দিল্লীর প্রান্তবর্তী একটি শিবিরে নিম্নলিখিত কথোপকথন হইতেছিল।

সদশিবঃ কি অপরিসীম রূপ! ছবিতে যা’ দেখলাম, তাতেই অবাক্‌ হয়েছি। রূপের সহিত এখন তেজের প্রভা দৃঢ়তার গাম্ভীর্য কখনও দেখা যায় না!

ভাস্করঃ তা’ আর বলতে কি? বিধাতা নির্জনে বসে একটু একটু করে বোধ হয় যুগযুগান্তর ধরে সৃষ্টি করেছেন। বিশ্বের যে পদার্থে যতুটুক সৌন্দর্যের বিশেষত্ব এবং মাধুরী ছিল, তা’ তিল তিল করে কুড়িয়ে ললনাকুল-ললামভূতা এই ত্রিলোকমোহিনী বীরাঙ্গনাকে সৃষ্টি করেছেন। বিদ্যুতের সহিত চাঁদের হাসি, গোলাপের সহিত কমর, কোমলতার সহিত কঠোরতা, শান্তির সহিত তেজঃ, শুভ্রতার সহিত বর্ণের, লাবণ্যের সহিত রূপের, মধুর সহিত সৌরভের, গাম্ভীর্যের সঙ্গে সারল্যের, প্রেমের সহিত প্রভুত্বের একত্র সম্মিলন করে অপরূপ প্রেমপ্রতিমা এই বিশ্বমোহীনি নারীসত্তাকে সৃষ্টি করেছেন। যে দেশে এমন নারীরত্ন জন্মগ্রহণ করে, সে দেশ ধন্য! যে জাতিতে প্রতিভা ও সৌন্দর্যের এমন অপরূপ জীবন্ত নিরুপম প্রতিমা জন্মগ্রহণ করে, সে জাতিও ধন্য! এমন নারীর পিতা, ভ্রাতা, আত্মীয় হতে পারলেও গৌরব!

সদাঃ আর স্বামী হতে পারলে?

ভাস্করঃ হায়! স্বর্গপ্রাপ্তি কোন্‌ ছার!

সদাঃ স্বর্গ! ছি! তার চরণ-তলেই শত স্বর্গ। এই স্বর্গপ্রাপ্তির জন্যই ত এত সাধ্যসাধনা। এই পরম স্বর্গকে লুণ্ঠন করতে না পারলে, আমাদের “বর্গী” বা “লুঠেরা” নামটাই বৃথা।

ভাস্করঃ এ যে পরম রত্ন! কত নির্জীব রত্ন লুণ্ঠন করেছি, আর এই সজীব রত্নকে কি লুণ্ঠন করতে পারবনা?

সদাঃ কই, কোথায় পারলে? এত দিন হয়ে গেল, তবুও ত কিছু কূল-কিনারা করতে পারলে না। তার বিবাহের কথাও ত হচ্ছে। বিবাহের পরেই উচ্ছিষ্ট হলে কি আমার ভোগে লাগবে?

ভাস্করঃ আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। উচ্ছিষ্ট হবার পূর্বেই ভোগে লাগাব। আমার দেবতাকে কখনও উচ্ছিষ্ট ভোগ দিব না।

সদাঃ রোহিলাখণ্ডের পরাক্রান্ত সিংহ নজীব-উদ্দৌলার সঙ্গেই নাকি বিবাহ নির্ধারিত হয়েছে?

ভাস্করঃ তাই বটে! তা’ হলে সিংহের সহিতই সিংহিনীর সংযোগ! নজীব-উদ্দৌলাও পরম সুশ্রী এবং তেজীয়ান পুরুষ।

সদাঃ তার সঙ্গে ত আমাদের সন্ধি আছে। সুতারং ফিরোজা বানুকে হরণ করলে বা ছিনিয়ে নিলে, তার সহিত যুদ্ধ অনিবার্য।

ভাস্করঃ আমরাও ত চাই চাই। সন্ধিতে আমাদের ক্ষতি। সন্ধি আছে আছে বলেই ত রোহিলাদিগের ধনসম্পত্তিও লুণ্ঠন করতে পাচ্ছি না।

সদাঃ কিন্তু রোহিলাদিগকে ঘাঁটান আর ভীমরুরের চাকে আঘাত করা সমান কথা। রোহিলাদিগকে ঘাঁটালে আমাদিগকে বিষম বেগ পেতে হয়।

ভাস্করঃ তেমন কিছু নয়, মহারাজ। রোহিলারা মহাতেজী এবং বীরপুরুষ বটে; সম্মুখযুদ্ধে তারা চির জয়শীল। কিন্তু আমরা ত আর যুদ্ধ করব না। গভীর অন্ধকারে হঠাৎ তাদের উপর আপতিত হয়ে তাদিগকে বিপর্যস্ত করে ফেলব। আর আসল কথা হচ্ছে, আমরা রোহিলাখণ্ডে না গেলে, তারাই বা কেমন করে এখানে এসে আক্রমণ করেব?

সদাঃ রমণী হরণ করলে, মুসলমান তার প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়বে না। সে প্রতিশোধে যতই প্রাণ বলি দিতে হোক না কেন, মুসলমান কখনই তা’তে কুণ্ঠিত হবে না। এমন কি, সমস্ত ভারতেও এই অগ্নি প্রোজ্জ্বলিত হতে পারে। রমনীর ইজ্জতকে ওরা নিজের প্রাণ হতেও সহস্র গুণে শ্রেয়ঃ বোধ করে।

ভাস্করঃ এত আশঙ্কা করলে এ ভোগে লালসা না করাই সঙ্গত। কি প্রয়োজন? মারাঠীদিগের মধ্যে না হয়, হিন্দুস্থানী ব্রহ্মণদিগের মধ্য হতে শত শত সুন্দরী বিনা কেশে বিনা ঝঞ্ঝাটে সংগৃহীত হতে পারে।

সদাঃ অমৃতের পিপসা কি জলে মিটে? ফিরোজাকে না পেলে ত জীবনই বৃথা। ফিরোজার ন্যায় সুন্দীর গুণবতী আর কে?

ভাস্করঃ মহারাজ! গুড়, মধু, চিনি, মিশ্রী সবই মিষ্টি।

সদাঃ মিষ্ট ত সবই বটে! কিন্তু তাই বলে গুড় ও মধুর মিষ্টতা ত এক নয়।

ভাস্করঃ এক ত নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, মধু খেতে গেলেই মৌমাছির হুলও খেতে হবে।

সদাঃ সেইটা যা’তে খেতে না হয়, অথচ মধুর চাক ভাঙ্গা যায়, এইরূপ বন্দোবস্ত করাই হচ্ছে বুদ্ধিমানের কার্য।

ভাস্করঃ সেই বুদ্ধি খাটাবার জনইত এত মাথাব্যথা।

সদাঃ মাথাব্যথা ত বটে, কিন্তু জিজ্ঞেস করি, মাথামুণ্ডু করলে কি?

ভাস্করঃ নিশ্চিন্ত হউন। সে ফন্দি এঁটেই বসে আছি।

সদাঃ ফন্দিটা একবার শুনিই না কেন?

ভাস্করঃ ফন্টিা হচ্ছে এই যে, আপনি সেদিন নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্য নজীব-উদ্দৌলার বরযাত্রীর এবং বন্ধু ও হিতৈষীরূপে বিবাহে উপস্থিত থেকে আপনার হিতৈষণা এবং সৌজন্য প্রদর্শন করবেন। আমরা জাঠদিগের ছদ্মবেশে ফিরোজাকে হরণ করে নিব। এ জন্য আমি একদল জাঠ দস্যুরও বন্দোবস্ত করেছি। আপনি বরং আপনার মারাঠী দেহরক্ষী সেনা নিয়ে আমাদিগকে বাধা দিবেন। দুই একটা জাঠকে কৌশলে গ্রেফ্‌তারও করে নিব। তাদিগকে পূর্ব হ’তেই মন্ত্র পড়ায় কারসাজী বলে ব্যক্ত করবে।

সদাঃ বাহবা ভাস্কর! বাহবা তোমার বুদ্ধি! তুমি যে শুধু সেনাপতি নও, পণ্ডিতও, তা’যথার্থই বটে! এক ঢিলে দুই পাখী শিকার!

ভাস্করঃ মহারাজ! রথ দেখা এবং কলা বেচা দুটোই হবে। এই ব্যাপারে ভরতপুরের মহারাজের সঙ্গে সফদরজঙ্গের এবং তৎসঙ্গে নজীব-উদ্দৌলার স্বয়ং বাদশাহের পর্যন্ত বিরোধ লেগে যাবে। ভরতপুরের আমাদের যেরূপ বিরুদ্ধে আচরণ করছে, তাতে এই রূপ উপয়েই তাকে জব্দ করতে হয়। রোহিলার খড়গেই তার বলি হবে।

সদাঃ কেন? আমরাও ত সফদরজঙ্গ এবং নজীব-উদ্দৌলার সঙ্গে যোগ দিয়েই ভরতপুর লুন্ঠন করবো। তাতে রোহিলাদের সঙ্গে আমাদের আরও সদ্‌ভাব বেড়ে যাবে।

ভাস্করঃ তা’কি আর বলতে হবে? ধন্য তোমার উদ্‌ভাবনী শক্তি। যাও, এখন কাজে যাও। কার্যসিদ্ধির পরে আশাতীত খেলাত!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *