সারদামঙ্গল – ২য় সর্গ

                           গীতি
             [রাগিণী কালাংড়া,–তাল যৎ]
 
হারায়েছি-হারায়েছি রে, সাধের স্বপনের ললনা
   মানস-মরালী আমার কোথা গেল বল না!
        কমল-কাননে বালা,
        করে কত ফুলখেলা,
আহা, তার মালা গাঁথা হ’ল না!
        প্রিয় ফুলতরুগণ,
        সুধাকর, সমীরণ,
বল বল ফিরে কি আর পাব না!
        কেন এল চেতনা!


                ১
      আহা সে পুরুষবর
      না জানি কেমনতর
দাঁড়ায়ে রজতগিরি অটল সুধীর!
      উদার ললাট ঘটা,
      লোচনে বিজলীছটা,
নিটোল বুকের পাটা, নধর শরীর।


               ২
      সৌম্য মূর্ত্তি স্ফুর্ত্তি-ভরা,
      পিঙ্গল বল্কল পরা,
নীরদ-তরঙ্গ-লীলা জটা মনোহর;
      শুভ্র অভ্র উপবীত
      উরস্থলে বিলম্বিত,
যোগপাটা ইন্দ্রধনু রাজিছে সুন্দর।
 
               ৩
      কুসুমিতা লতা ভালে,
      শ্মশ্রুরেখা শোভে গালে,
করেতে অপূর্ব্ব এক কুসুম রতন;
      চাহিয়ে ভুবন পানে
      কি যেন উদয় প্রাণে,
অধরে ধরে না হাসি–শশীর কিরণ।

              ৪
      কি এক বিভ্রম ঘটা,
      কি এক বদন ছটা,
কি এক উছলে অঙ্গে লাবণ্য-লহরী;
      মন্দাকিনী আসি কাছে
      থমকে দাঁড়ায়ে আছে,
থমকে দাঁড়ায়ে দেখে অমর অমরী।

            ৫
      নধর মন্দাররাজি
      নবীন পল্লবে সাজি
দূরে দূরে ধীরে ধীরে ঘেরিয়ে দাঁড়ায়।
      গরজি গম্ভীর স্বরে
      জলধর শির’পরে
করি করি জয়ধ্বনি চলে দুলে দুলে।
      তড়িত ললিত বালা,
      করে লুকাচুরি খেলা,
সহসা সমুখে দেখে চমকে পালায়।
      অপ্সরী বাঁশরী করে
      দাঁড়ায়ে শিখরী পরে
আনন্দে বিজয়গান গায় প্রাণ খুলে।

             ৬
      দিগঙ্গনা কুতূহলে
      সমীর-হিল্লোল ছলে
বরষে মন্দার ধারা আবরি গগন।
      আমোদে আমোদময়,
      অমৃত উথুলে বয়,
ত্রিদশ-আলয় আজি আনন্দে মগন।
      জ্যোতির্ম্ময় সপ্ত ঋষি
      প্রভাত উজলি দিশি,
সম্ভ্রমে কুসুমাঞ্জলি অর্পিছেন পদতলে॥

           ৭
      সে মহাপুরুষ-মেলা,
      সে নন্দনবন-খেলা,
সে চিরবসন্ত-বিকশিত ফুলহার,
      কিছুই হেথায় নাই;
      মনে মনে ভাবি তাই,
কি দেখে আসিতে মন সরিবে তোমার!

              ৮
      কেমনে বা তোমা বিনে
      দীর্ঘ দীর্ঘ রাত্র দিনে
সুদীর্ঘ জীবন-জ্বালা সব অকাতরে,
      কার আর মুখ চেয়ে
      অবিশ্রাম যাব বেয়ে
ভাসায়ে তনুর তরী অকূল সাগরে!

              ৯
      কেন গো ধরণী রাণী
      বিরস বদনখানি,
কেন গো বিষণ্ণ তুমি উদার আকাশ,
      কেন প্রিয় তরু লতা
      ডেকে নাহি কহ কথা,
কেন রে হৃদয় কেন শ্মশান উদাস

               ১০
      কোন সুখ নাই মনে,
      সব গেছে তার সনে;
খোলো হে অমরগণ স্বরগের দ্বার।
      বল কোন্ পদ্মবনে,
      লুকায়েছ সংগোপনে
দেখিব কোথায় আছে সারদা আমার!

             ১১
      অয়ি, এ কি, কেন কেন,
      বিষণ্ণ হইলে হেন।
আনত আনন-শশী আয়ত নয়ন,
      অধরে মন্থরে আসি
      কপোলে মিলায় হাসি
থর থর ওষ্ঠাধর, স্ফোরে না বচন।

            ১২
      তেমন অরুণ-রেখা
      কেন কুহোলিকা-ঢাকা,
প্রভাত-প্রতিমা আজি কেন গো মলিন।
      বল বল চন্দ্রাননে,
      কে ব্যথা দিয়েছে মনে,
কে এমন–কে এমন হৃদয়-বিহীন!

              ১৩
      বুঝিলাম অনুমানে,
      করুণা-কটাক্ষ দানে
চাবে না আমার পানে, কবে না ও কথা;
      কেন যে কবে না হায়
      হৃদয় জানিতে চায়,
সরমে কি বাধে বাণী, মরমে বা বাজে ব্যথা!

            ১৪
      যদি মর্ম্মব্যথা নয়,
      কেন অশ্রুধারা বয়!
দেববালা ছলাকলা জানে না কখন;
      সরল মধুর প্রাণ,
      সতত মুখেতে গান,
আপন বীণার তানে আপনি মগন!

             ১৫
      অয়ি,হা সরলা সতী
      সত্যরূপা সরস্বতী!
চির-অনুরক্ত ভক্ত হয়ে কৃতাঞ্জলি
      পদ্ম-পদ্মাসন কাছে
      নীরবে দাঁড়ায়ে আছে,
কি করিবে, কোথা যাবে, দাও অনুমতি!
      স্বরগ-কুসুম-মালা
      নরক-জ্বলন-জ্বালা,
ধরিবে প্রফুল্ল মুখে মস্তকে সকলি।
      তব আজ্ঞা সুমঙ্গল,
      যাই যাব রসাতল,
চাইনে এ বরমালা, এ অমরাবতী!

            ১৬
      নরকে নারকি-দলে
      মিশি গে মনের বলে,
পরাণ কাতর হ’লে ডাকিব তোমায়;
      যেন দেবী সেই ক্ষণে
      অভাগারে পড়ে মনে,
ঠেল না চরণে, দেখো, ভুল না আমায়!

           ১৭
      অহহ! কিসের তরে
      অভাগা নরকে জরে
মরু-মরু-মরুময়-জীবন-লহরী;
      এ বিরস মরুভূমে
      সকলি আচ্ছন্ন ধূমে,
কোথাও একটিও আর নাহি ফোটে ফুল;
      কভু মরীচিকা মাজে
      বিচিত্র কুসুম রাজে,
উঃ! কি বিষম বাজে সেই ভাঙে ভুল!
      এত যে যন্ত্রণা জ্বালা,
      অবমান অবহেলা,
তবু কেন প্রাণ টানে! কি করি, কি করি!

            ১৮
      তেমন আকৃতি, আহা,
      ভাবিয়ে ভাবিয়ে যাহা
আনন্দে উন্মত্ত মন, পাগল পরাণ,
      সে কি গো এমন হবে,
      মোর দুখে সুখে রবে
কাঁদিয়ে ধরিলে কর ফিরাবে বয়ান!

           ১৯
      ভাবিতে পারিনে আর!
      অন্ধকার–অন্ধকার–
ঝটিকার ঘূর্ণী ঘোরে মাথার ভিতর;
      তরঙ্গিয়া রক্তরাশি
      নাকে মুখে চোকে আসি
বেগে যেন ভেঙে ফেলে; ধর ধর ধর;–

           ২০
      ধর, আত্মা, ধৈর্য্য ধর,
      ছি ছি এ কি কর কর,
মর যদি, মরা চাই মানুষের মত;
      থাকি বা প্রিয়ার বুকে
      যাই বা মরণ-মুখে,
এ আমি, আমিই রব; দেখুক্ জগত।

           ২১
      মহান্ মনেরি তরে
      জ্বালা জ্বলে চরাচরে,
পুড়ে মরে ক্ষুদ্রেরাই পতঙ্গের প্রায়;
      জলুক্ যতই জ্বলে,
      পর জ্বালা-মালা গলে,
নীলকণ্ঠ-কণ্ঠে জ্বলে হলাহল-দ্যুতি;
      হিমাদ্রিই বক্ষ’পরে
      সহে বজ্র অকাতরে,
জঙ্গল জ্বলিয়া যায় লতায় পাতায়;
      অস্তাচলে চলে রবি,
      কেমন প্রশান্ত ছবি!
তখনো কেমন আহা উদার বিভূতি!

           ২২
      হা ধিক্ অধীর হেন!
      দেখেও দেখ না কেন
দুখে দুখী অশ্রুমুখী প্রাণপ্রতিমায়!
      প্রণয় পবিত্র ধনে
      সন্দেহ করো না মনে,
নাগরদোলায় দোলা শিশুরি মানায়!
      সারদা সরলা বালা,
      সবে না সন্দেহ জ্বালা,
ব্যথা পাবে সুকোমল হৃদয়কমলে॥
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *