২৬. ঠকচাচার বেনিগারদে নিদ্রাবস্থায় আপন কথা আপনি ব্যক্তকরণ, পুলিসে বাঞ্ছারাম ও বটলরের সহিত সাক্ষাৎ, মকদ্দমা বড়ো আদালতে চালান, ঠকচাচার জেলে কয়েদ, জেলেতে তাহার সহিত অন্যান্য কয়েদীর কথাবার্তা ও তাহার খাবার অপহরণ।

মনের মধ্যে ভয় ও ভাবনা প্রবেশ করিলে নিদ্রার আগমন হয় না। ঠকচাচা বেনিগারদে অতিশয় অস্থির হইলেন,একখানা কম্বলের উপর পড়িয়া এপাশ ওপাশ করিতে লাগিলেন। উঠিয়া এক একবার দেখেন রাত্রি কত আছে। গাড়ির শব্দ অথবা মনুষ্যের স্বর শুনিলে বোধ করেন এইবার বুঝি প্রভাত হইল। এক একবার ধড়মড়িয়া উঠিয়া সিপাইদিগকে জিজ্ঞাসা করেন –”ভাই ! ভাই ! রাত কেত্‌না হুয়া? –তাহারা বিরক্ত হইয়া বলে, “আরে কামান দাগ্‌নেকো দো তিন ঘন্টা দের হেয় আব লৌট রহো, কাহে হর্ ঘড়ি দেক করতে হো?” ঠকচাচা ইহা শুনিয়া কম্বলের উপর গড়াগড়ি দেন। তাঁহার মনে নানা কথা –নানা ভাব –নানা উপায় উদয় হয়। কখন কখন ভাবেন –আমি চিরকালটা জুয়াচুরি ও ফেরেবি মতলবে কেন ফিরলাম –ইহাতে যে টাকাকড়ি রোজগার হইয়াছিল তাহা কোথায়? পাপের কড়ি হাতে থাকে না, লাভের মধ্যে এই দেখি যখন মন্দ কর্ম করিয়াছি তখন ধরা পড়িবার ভয়ে রাত্রে ঘুমাই নাই –সদাই আতঙ্কে থাকিতাম –গাছের পাতা নড়িলে বোধ হইত যেন কেহ ধরিতে আসিতেছে। আমার হামজোলফ খোদাবক্স আমাকে এ প্রকার ফেরেক্কায় চলিতে বার বার মানা করিতেন –তিনি বলিতেন, চাষবাস অথবা কোনো ব্যবসা বা চাকরি করিয়া গুজরান করা ভালো, সিদে পথে থাকিলে মার নাই –তাহাতে শরীর ও মন দুই ভালো থাকে। এইরূপ চলিয়াই খোদাবক্স সুখে আছেন। হায় ! আমি তাহার কথা কেন শুনিলাম না। কখন কখন ভাবেন উপস্থিত বিপদ্ হইতে কি প্রকারে উদ্ধার পাইব? উকিল কৌন‌সুলি না ধরিলে নয় –প্রমাণ না হইলে আমার সাজা হইতে পারে না –জাল কোন্‌খানে হয় ও কে করে তাহা কেমন করিয়া প্রকাশ হইবে? এইরূপ নানা প্রকার কথার তোলপাড় করিতে করিতে ভোর হয় হয় এমতো সময়ে শ্রান্তিবশত ঠকচাচার নিদ্রা হইল, তাহাতে আপন দায় সংক্রান্ত স্বপ্ন দেখিতে দেখিতে ঘুমের ঘোরে বকিতে লাগিলেন –”বাহুল্য! তুলি, কলম ও কল কেহ যেন দেখিতে পায় না –শিয়ালদার বাড়ির তালায়ের ভিতর আছে –বেশ আছে –খবর্‌দার তুলিও না –তুমি জল্‌দি ফরিদপুরে পেলিয়ে যাও –মুই খালাস হয়্যে তোমার সাত মোলাকাত করবো।”

প্রভাত হইয়াছে –সূর্যের আভা ঝিলিমিলি দিয়া ঠকচাচার দাড়ির উপর পড়িয়াছে। বেনিগারদের জমাদার তাহার নিকট দাঁড়াইয়া ঐ সকল কথা শুনিয়া চীৎকার করিয়া বলিল –”বদ্জাত ! আবতলক শোয়া হেয় –উঠো, তোম আপ্‌না বাত আপ্ জাহের কিয়া।” ঠকচাচা অমনি ধড়মড়িয়ে উঠিয়া চকে, নাকে ও দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে তস্‌বি পড়িতে লাগলেন। জমাদারের প্রতি এক একবার মিটমিট করিয়া দেখেন –এক একবার চক্ষু মুদিত করেন। জমাদার ভ্রূকুটি করিয়া বলিল –তোম্ তো ধরম্‌কা ছালা লে করকে বয়টা হেয় আর শেয়ালদাকো তালায়সে কল-ওল নেকালনেসে তেরি ধরম আওরভি জাহের হোগা। ঠকচাচা এই কথা শুনিবামাত্রে কদলীবৃক্ষের ন্যায় ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপিতে লাগিলেন ও বলিলেন “বাবা! মেরি বাইকো বহুত জোর হুয়া। এস সবসে হাম নিদ জানেসে জুট মুট বক্তা হুঁ !” “ভালা ও বাত পিছু বোঝা জাওঙ্গি –আব তৈয়ার হো” এই বলিয়া জমাদার চলিয়া গেল।

এদিকে দশটা ঢং ঢং করিয়া বাজিল, অমনি পুলিসের লোকেরা ঠকচাচা ও অন্যান্য আসামীদিগকে লইয়া হাজির করিল। নয়টা না বাজিতে বাজিতে বাঞ্ছারামবাবু বটলর সাহেবকে লইয়া পুলিসে ঘুরিয়া ফিরিয়া বেড়াইতেছিলেন ও মনে মনে ভাবিতেছিলেন –ঠকচাচাকে এ যাত্রা রক্ষা করিলে তাহার দ্বারা অনেক কর্ম পাওয়া যাইবে –লোকটা বলতে-কহিতে, লিখিতে-পড়তে, যেতে-আসতে, কাজে-কর্মে, মামলা-মকদ্দমায়, মতলব-মসলতে বড়ো উপযুক্ত। কিন্তু আমার হচ্ছে এ পেশা –টাকা না পাইলে কিছুই তদ্বির হইতে পারে না। ঘরের খেয়ে বনের মহিষ তাড়াইতে পারি না, আর নাচতে বসেছি ঘোমটাই বা কেন? ঠকচাচাও তো অনেকের মাথা খেয়েছেন তবে ওঁর মাথা খেতে দোষ কি ? কিন্তু কাকের মাংস খাইতে গেলে বড়ো কৌশল চাই। বটলর সাহেব বাঞ্ছারামকে অন্যমনস্ক দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল –বেন্‌সা ! তোম্ কিয়া ভাবতা ? বাঞ্ছারাম উত্তর করিলেন –বোসো সাহেব; হাম রূপেয়া যে সুরতনে ঘরমে ঢোকে ওই ভাবতা। বটলর সাহেব একটু অন্তরে গিয়া বলিলেন –”আস্‌সা আস্‌সা –বহুত আস্‌সা।”

ঠকচাচাকে দেখিবামাত্র বাঞ্ছারাম দৌড়ে গিয়া তাহার হাত ধরিয়া চোক দু-টো পান্‌সে করিয়া বলিলেন –একি একি! কাল কুসংবাদ শুনিয়া সমস্ত রাত্রিটা বসিয়া কাটাইয়াছি, একবারও চক্ষু বুজি নাই –ভোর হতে না হতে পূজা-আহ্ণিক অমনি ফুলতোলা রকমে সেরে সাহেবকে লইয়া আসিতেছি। ভয় কি ? এ কি ছেলের হাতের পিটে? পুরুষের দশ দশা, আর বড়ো গাছেই ঝড় লাগে। কিন্তু এক কিস্তি টাকা না হইলে তদ্বিরাদি কিছুই হইতে পারে না –সঙ্গে না থাকে তো ঠকচাচীর দুই-একখানা ভারি রকম গহনা আনাইলে কর্ম চলতে পারে। এক্ষণে তুমি তো বাঁচো তার পরে গহনা-টহনা সব হবে। বিপদে পড়িলে সুস্থির হইয়া বিবেচনা করা বড়ো কঠিন, ঠক-চাচা তৎক্ষণাৎ আপন পত্নীকে এক পত্র লিখিয়া দিলেন। ঐ পত্র লইয়া বাঞ্ছারাম বটলর সাহেবের প্রতি দৃষ্টিপাতপূর্বক চক্ষু টিপিয়া ঈষৎ হাস্য করিতে করিতে একজন সরকারের হাতে দিলেন এবং বলিলেন –তুমি ধাঁ করিয়া বৈদ্যবাটী যাইয়া ঠকচাচীর নিকট হইতে কিছু ভারি রকম গহনা আনিয়া এখানে অথবা আপিসে দেখতে দেখতে আইস, দেখিও গহনা খুব সাবধান করিয়া আনিও, বিলম্ব না হয়, যাবে আর আসবে –যেন এইখানে আছো। সরকার রুষ্ট হইয়া বলিল –মহাশয়। মুখের কথা, অমনি বললেই হইল ? কোথায় কলিকাতা –কোথায় বৈদ্যবাটী –আর ঠকচাচীই বা কোথা ? আমাকে অন্ধকারে ঢেলা মারিয়া বেড়াইতে হইবে, এক মুঠা খাওয়া দূরে থাকুক এখনও এক ঘটি জল মাথায় দিই নাই –আজ ফিরে কেমন করিয়া আসতে পারি ? বাঞ্ছারাম অমনি রেগেমেগে হুম্‌কে উঠিয়া বলিলেন,–ছোটলোক এক জাতই স্বতন্তর, এরা ভালো কথার কেউ নয়, নাতি-ঝেঁটা না হলে জব্দ হয় না। লোকে তল্লাশ করিয়া দিল্লী যাইতেছে, তুমি বৈদ্যবাটী গিয়া একটা কর্ম নিকেশ করিয়া আসতে পারো না ? সাকুব হইলে ইশারায় কর্ম-বুঝে –তোর চোকে আঙুল দিয়া বললুম তাতেও হোঁশ হইল না ? সরকার অধোমুখে না রাম না গঙ্গা কিছুই না বলিয়া বেটো ঘোড়ার ন্যায় ঢিকুতে ঢিকুতে চলিল ও আপনা আপনি বলিতে লাগিল –দুঃখী লোকের মানই বা কি আর অপমানই বা কি ? পেটের জন্য সকলই সহিতে হয়। কিন্তু হেন দিন কবে হবে যে ইনি ঠকচাচার মতো ফাঁদে পড়বেন। আমার দেক্তা উনি অনেক লোকের গলায় ছুরি দিয়াছেন –অনেক লোকের ভিটে মাটি চাটি করিয়াছেন –অনেক লোকের ভিটায় ঘু ঘু চরাইয়াছেন। বাবা ! অনেক উকিলের মুৎসুদ্দি দেখিয়াছি বটে কিন্তু ওর জুড়ি নাই। রকমটা –ভাজেন পটোল, বলেন ঝিঙ্গা, যেখানে ছুঁচ চলে না সেখানে বেটে চালান। এদিকে পূজা-আহ্ণিক, দোল-দুর্গোৎসব, ব্রাহ্মণভোজন ও ইষ্টনিষ্ঠাও আছে। এমন হিন্দুয়ানির মুখে ছাই –আগাগোড়া হারামজাদ্‌কি ও বদ্জাতি !

এখানে ঠকচাচা, বাঞ্ছারাম ও বটলর বসিয়া আছেন, মকদ্দমা আর ডাক হয় না। যত বিলম্ব হইতেছে তত ধরফড়ানি বৃদ্ধি হইতেছে। পাঁচটা বাজে বাজে এমন সময়ে ঠকচাচাকে ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে লইয়া খাড়া করিয়া দিল। ঠকচাচা গিয়া সেখানে দেখেন যে শিয়ালদার পুষ্করিণী হইতে জাল করিবার কল ও তথাকার দুই-একজন গাওয়া আনিত হইয়াছে। মকদ্দমার তদারক হওনান্তর ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম দিলেন যে, এ মামলা বড়ো আদালতে চালান হউক। আসামীর জামিন লওয়া যাইতে পারা যায় না সুতরাং তাহাকে বড়ো জেলে কয়েদ থাকিতে হইবে।

ম্যাজিস্ট্রেটের হুকুম হইবামাত্রে বাঞ্ছারাম তেড়ে আসিয়া হাত নাড়িয়া বলিলেন –ভয় কি ? একি ছেলের হাতের পিটে ? এ তো জানাই আছে যে,মকদ্দমা বড়ো আদালতে হবে –আমরাও তাই তো চাই। ঠকচাচা মুখখানি ভাবনায় একেবারে শুকিয়ে গেল। পেয়াদা হাত ধরিয়া হিড় হিড় করিয়া নীচে টানিয়া জেলে চালান করিয়া দিল। চাচা টংয়স্ টংয়স্ করিয়া চলিয়াছেন –মুখে বাক্য নাই –চক্ষু তুলিয়া দেখেন না, পাছে কাহারো সহিত দেখা হয় –পাছে কেহ পরিহাস করে। সন্ধ্যা হইয়াছে এমন সময় ঠকচাচা শ্রীঘরে পদার্পণ করিলেন। বড়ো জেলেতে যাহারা দেনার জন্য অথবা দেওয়ানি মকদ্দমা ঘটিত কয়েদ হয় তাহারা একদিকে ও যাহারা ফৌজদারী মামলা হেতু কয়েদ হয় তাহারা অন্য দিকে থাকে। ঐ সকল আসামির বিচার হইলে হয়তো তাহাদিগের ঐ স্থানে মিয়াদ খাটিতে নয়তো হরিং বাটীতে সুরকি কুটিতে হয় অথবা জিঞ্জির বা ফাঁসি হয়। ঠকচাচাকে ফৌজদারী জেলে থাকিতে হইল, তিনি ঐ স্থানে প্রবেশ করিলে যাবতীয় কয়েদী আসিয়া ঘেরিয়া বসিল। ঠকচাচা কটমট করিয়া সকলকে দেখিতে লাগিলেন –একজন আলাপীও দেখিতে পান না। কয়েদীরা বলিল, মুনশীজি !–দেখো কি ? তোমারও যে দশা আমাদেরও সেই দশা, এখন আইস মিলে-জুলে থাকা যাউক। ঠকচাচা বলিলেন –হাঁ বাবা ! মুই নাহক আপদে পড়েছি –মুই খাইনে, ছুঁইনে, মোর কেবল নসিবের ফের। দুই-একজন প্রাচীন কয়েদী বলিল –হাঁ তা বই কি ! অনেকেই মিথ্যা দায়ে মজে যায়। একজন মুখফোড় কয়েদী বলিয়া উঠিল –তোমার দায় মিথ্যা আমাদের বুঝি সত্য ? আঃ। বেটা কি সাওখোড় ও সরফরাজ ? ওহে ভাইসকল সাবধান –এ দেড়ে বেটা বড়ো বিট্কেলে লোক। ঠকচাচা অমনি নরম হইয়া আপনাকে খাটো করিলেন কিন্তু তাহারা ঐ কথা লইয়া অনেকে ক্ষণেক কাল তর্ক-বিতর্ক করিতে ব্যস্ত হইল। লোকের স্বভাবই এই, কোনো কর্ম না থাকিলে একটু সূত্র ধরিয়া ফাল্‌তো কথা লইয়া গোলমাল করে।

জেলের চারিদিক বন্ধ হইল –কয়েদীরা আহার করিয়া শুইবার উদ্যোগ করিতেছে, ইত্যবসরে ঠকচাচা এক প্রান্তভাগে বসিয়া কাপড় বাঁধা মিঠাই খুলিয়া মুখে ফেলিতে যান অমনি পেছন দিকে থেকে দুই দুই বেটা মিশ কালো কয়েদী –গোঁপ, চুল ও ভুরু সাদা, চোক লাল –হাহা হাহা শব্দে বিকট হাস্য করত মিঠায়ের ঠোঙাটি সট্ করিয়া কাড়িয়া লইল এবং দেখাইয়া দেখাইয়া টপ টপ করিয়া খাইয়া ফেলিল। মধ্যে মধ্যে চর্বণকালীন ঠকচাচার মুখের নিকট মুখ আনিয়া হিহি হিহি করিয়া হাসিতে লাগিল। ঠকচাচা একেবারে অবাক –আস্তে আস্তে মাদুরির উপর গিয়া সুড় সুড় করিয়া শুইয়া পড়িলেন, যেন কিল খেয়ে কিল চুরি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *