তারাবাঈ ২০ পরিচ্ছেদ

আজ বৈশাখী পূর্ণিমা। জ্যোৎস্না-জালে জগন্মঙ্গল যেরূপ মনোহারিণী শোভা ধারণ করিয়াছে, রায়গড়ের রাজবাটীও আজ তেমনি আলোক ও পুস্প পতাকা সজ্জায় পূর্বদিন অপোও যেন অধিকতর শোভায় প্রদীপ্ত এবং পুলকিত হইয়া উঠিয়াছে! সমস্ত দিন ভোজের বিপুল উৎসব অন্তে মগরেবের নামাজের পরে যথারীতি ইসলামী প্রথানুযায়ী উদ্বাহ-ক্রিয়া সম্পন্ন হইল।

অতঃপর জামাতা আফজাল খাঁকে অন্তঃপুরে আনয়নের ব্যবস্থা হইল। অন্তঃপুরের একটি নির্দিষ্ট অট্রালিকায় বাসরের জন্য পূর্ণ হইতেই আরাস্তা করা হইয়াছিল। আফজাল খাঁকে সেই অট্রালিকায় লইয়া বসাইবার কিছু পরেই অন্তঃপুরে ভীষণ আর্তনাদ উত্থিত হইল। সে আর্তনাদ অন্তঃপুরের যে যেখানে ছিল সকলেই চকিত হইয়া শিহরিয়া উঠিল!

“খুন! খুন! তারা খুন হয়েছে!” এই ভীষণ অশনিপাততুল্য শব্দ পুনঃ পুনঃ দ্রুত হইতে লাগিল! শিবাজী এবং আফজাল খাঁ উঠিতে পড়িতে প্রাঙ্গণে ছুটিয়া গেলেন! স্ত্রীলোকদিগের ভিড় ঠেলিয়া সত্যই দেখিতে পাইলেন যে, সালঙ্কারা সুসজ্জিতা তারা বুকে শাণিত-ছুরিকা-বিদ্ধ-অবস্থায় ভূতলে পতিত রহিয়াছে! রক্তে মেদিনী ভাসিয়া যাইতেছে! ছুরিকা তন্মুহুর্তেই বক্ষ হইতে তুলিয়া লওয়া হইল। চিকিৎসার যথারীতি বন্দোবস্ত হইল! কিন্তু হায়! সকলি বৃথা। তীক্ষ্ণধার ছুরিকায় হৃদপিন্ড বিদীর্ণ হইয়া গিয়াছিল। সুতরাং অল্পক্ষণের মধ্যেই তারা প্রাণত্যাগ করিল। এই লোমহর্ষনকার নিদারুণ সাংঘাতিক ঘটনার বৃত্তান্ত এই যে, তারাকে যখন নববধূ বেশে সাজাইয়া বাসর ঘরের দিকে লইয়া যাওয়া হইতেছিল, তখন প্রাঙ্গণে অবস্থিত একখানি পালঙ্কির ভিতর হইতে সহসা মালোজী নির্গত হইয়া শাণিত-ছুরিকা তারার বক্ষেবিদ্ধ করিয়া দেন। ছুরি বিদ্ধ করিয়াই মালোজী উর্দ্ধশ্বাসে দরজার দিকে ছুটিয়া যান। দারবান বাধা দিতেই দারবানকেও ছুরি মারিয়া নিজের পথ মুক্ত করেন। কিন্তু অন্তপুরের দ্বার হইতে ছুট পাইলেও বাহিরের দ্বারে সৈনিক-প্রহরী কর্তৃক গ্রেপ্তার হন।

মহা আনন্দের মধ্যে মহাবিষাদের তরঙ্গ উত্থিত হইয়া! পূর্ণিমার শোভা আমাবস্যার অন্ধাকারে ডুবিয়া গেল। আশার কমল নিরাশার পঙ্কে মগ্ন হইল। রায়গড়ে মহা হাহাকার পড়িয়া গেল! তারা শোকে সকলেই আত্মহারা হইল! সেই বিবাহোৎসব দিনের এই নৃশংস হত্যাকান্ডের শোকের বিষয় পাঠক-পাঠিকা অনুমানে বুঝিয়া লউন। আর যদি সহানুভূতি থাকে, তবে এক বিন্দু অশ্রুপাত করুন।

পরদিন প্রত্যুষে মালোজীকে শূলে চড়ান হইল। মুহুর্ত মধ্যে নৈরাশ্য-দিগ্ধ হিংসাপরায়ন আত্মা শূন্যে মিশিয়া গেল। রায়গড়ের বিষাদ ভার আরও বাড়িয়া গেল। কারণ সকলেই বুঝিল যে, মালোজী তারার প্রতি একান্তই আসক্ত এবং অনুরক্ত ছিলেন। কিন্তু তারা তাহাকে একেবারেই চাহিত না। সে আফজাল খাঁর রূপসরোবরেই প্রেমের কমল তুলিতে সাঁতার দিয়াছিল। কিন্তু হায়! হতভাগিনীর আশা পূরণ হইল না। দগ্ধজীবনের অতৃপ্ত আকাঙ্খা এবং প্রেমের আগ্নেয়-পিপাসা লইয়াই জীবন ত্যাগ করিল! প্রেম-সরোবরে ডুবিয়াও এক বিন্দু প্রেমসুধা পানের পূর্বেই তাহার জীবনলীলা শেষ হইল। কি তীব্র বিষাদপূর্ণ ভয়াবহ ঘটনা! শিবাজী কন্যার শোকে নিতান্ত বিমনায়মান এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িলেন। আফজাল খাঁর নিকটে গভীর দুঃখ ও করুণ বিলাপ প্রকাশ করিলেন। আফজাল খাঁর চক্ষু হইতে অশ্রুধারা নির্গত হইল।

অনন্তর আফজাল খাঁর সহিত আত্মীয়তা এবং কুটুম্বিতা বজায় রাখিবার জন্য শিবাজী তাঁহার ভগ্নী কামিনীবাঈকে আফজাল খাঁর করে সমর্পণ করিবার প্রস্তাব করিলেন। কিন্তু আফজাল খাঁ কিছুতেই স্বীকৃত হইলেন না। আফজাল খাঁ তৎপর দিবস প্রাতঃকালে বিজাপুরে কুচ করিবার জন্য প্রস্তুত হইলেন। শিবাজীও অগত্যা তাহাতে সম্মত হইলেন। পরদিন প্রত্যুষে সেনাপতি সাহেব রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করিবার জন্য প্রস্তুত হইলে, শিবাজী, রামদাস স্বামী প্রভৃতি সকলেই বিদায় দিতে আসিলেন। শিবাজী দুঃখ প্রকাশ করিয়া বলিলেন, “মহাবীর সেনাপতে! আমার আসা পূর্ণ হ’ল না। নৌকা কূলে লেগেও ডুবে গেল। আপনি আমার প্রবল শক্র ছিলেন। আপনি অসাধারণ বীরপুরুষ! আপনি আমার দক্ষিণ হস্ত হলে, দিল্লীর সিংহাসন দখন করাও অসম্ভব ছিল না। আমার আশা পূর্ণ হ’ল না। আপনার সহিত যুদ্ধে কখনও পারব না! আমার রাজ্যলিপ্সা কখনও দমিত হবে না; সে পথের আপনি কণ্টক। যে উপায়ে সে কণ্টক দূর করার জন্য আশা করেছিলাম, তা’ ব্যর্থ হ’ল! সুতরাং এক্ষণে দস্যুবৃত্তি ব্যতীত আর উপায় নাই।”

শিবাজীর কথা শেষ হইতে না হইতেই আফজাল খাঁ ভীষণ চীৎকার করিয়া উঠিলেন। বিস্ময়-বিস্ফারিতনেত্রে সকলে চমকিত এবং ব্যস্ত ভাবে দেখিল-শিবাজী ভীষণ ব্যাঘ্র-নখাকৃতি তীক্ষ্ণধার ছুরিকা আফজাল খাঁর বুকে আমূল বসাইয়া দিয়াছেন। সকলে ভয়ে আর্তনাদ করিয়া উঠিল! আফজাল খাঁর লোকজন প্রস্তুত হইবার পূর্বেই শিবাজী এবং মাওয়ালী সৈন্যগণ মুসলমানগণকে আক্রমণ করিয়া বিপর্যন্ত এবং বিচ্ছিন্ন করিয়া ফেলিল। বহু সম্ভ্রান্ত সৈন্যগণ নিহত হইলেন। হস্তী, অশ্ব, আসাসোটা এবং অন্যান্য সমস্ত মূল্যবান পদার্থই লুণ্ঠিত হইল। বাদ্যকরগণ বাদ্যযন্ত্রাদিসহ ধৃত হইল।

অল্প সংখ্যক লোকই প্রাণ লইয়া বিজাপুরে প্রত্যাবর্তন করিত সমর্থ হইল। শিবাজী অনতিবিলম্বেই আবার নানাস্থানে লুণ্ঠন করিতে লাগিলেন। আফজাল খাঁ এবং তাঁহার সহকারী যুদ্ধবিশারদ তেজস্বী বীরপুরুষদিগের নিধনে শিবাজী অতিমাত্রায় স্পর্ধিত এবং সাহসী হইয়া উঠিলেন। শিবাজীর ভীষণ ও ভয়াবহ বিশ্বাসঘাতকতা এবং মহাবীর আফজাল খাঁর শোকে মুহ্যমান এবং ক্রোধ ও প্রতিসিংসায় উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিলেন। শিবাজীর এই অমানুষিক হত্যাকান্ড এবং বিশ্বাসঘাতকতায় সমগ্র দক্ষিণ-ভারত চঞ্চল হইয়া উঠিল। যেখানে-সেখানে এই লোমহর্ষক এবং পৈশাচিক হত্যার নিদারুণ কাহিনী একমাত্র আলোচ্য বিষয় হইয়া উঠিল।

শিবাজীর এই নৃশংস হত্যাকান্ড এবং জুগুপ্সিত বিশ্বাসঘাতকতায় দাক্ষিণাত্যের সমস্ত রাজরাজড়াই শিহরিয়া উঠিলেন। সকলেই বুঝিল, শিবাজীর অসাধ্য পাপকর্ম কিছু নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *