১৫. হুগলীর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারি বর্ণন, বারদাবাবু, রামলাল ও বেণীবাবুর সহিত ঠকচাচার সাক্ষাৎ, সাহেবের আগমন ও তজবিজ আরম্ভ এবং বরদাবাবুর খালাস।

হুগলীর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারি বড়ো সরগরম। আসামী, ফৈরাদি, সাক্ষী, কয়েদী, উকল ও আমলা সকলেই উপস্থিত আছে, সাহেব কখন আসিবে —সাহেব কখন আসিবে বলিয়া অনেকে টো টো করিয়া ফিরিতেছে, কিন্তু সাহেবের দেখা নাই। বরদাবাবু বেণীবাবু ও রামলালকে লইয়া একটি গাছের নীচে কম্বল পাতিয়া বসিয়া আছেন। তাঁহার নিকট দুই একজন আমলা-ফয়লা আসিয়া ঠারে ঠোরে চুক্তির কথা কহিতেছে, কিন্তু বরদাবাবু তাহাতে ঘাড় পাতেন। তাঁহাকে ভয় দেখাইবার জন্য তাহারা বলিতেছে —সাহেবের হুকুম বড়ো কড়া —কর্মকাজ সকলই আমাদিগের হাতের ভিতর —আমরা যা মনে করি তাহাই করিতে পারি —জবানবন্দি করানো আমাদিগের কর্ম —কলমের মারপেঁচে সকলই উলটে দিতে পারি, কিন্তু রুধির চাই —তদ্‌বির করতে হয় তো এই সময় করা কর্তব্য, একটা হুকুম হইয়া গেলে আমাদিগের ভালো করা অসাধ্য হইবে। এই সকল কথা শুনিয়া রামলালের এক একবার ভয় হইতেছে কিন্তু বরদাবাবু অকুতোভয়ে বলিতেছেন—আপনাদিগের যাহা কর্তব্য তাহাই করিবেন, আমি কখনই ঘুষ দিব না, আমি নির্দোষ —আমার কিছুই ভয় নাই। আমলারা বিরক্ত হইয়া আপন আপন স্থানে চলিয়া গেল। দুই একজন উকিল বরদাবাবুর নিকটে আসিয়া বলিল —দেখিতেছি মহাশয় অতি ভদ্রলোক —অবশ্য কোনো দায়ে পড়িয়াছেন, কিন্তু মকদ্দমাটি যেন বেতদ্‌বিরে যায় না —যদি সাক্ষীর যোগাড় করিতে চাহেন এখান হইতে করিয়া দিতে পারি, কিঞ্চিৎ ব্যয় করিলেই সকল সুযোগ হইতে পারে। সাহেব এল এল হইয়াছে, যাহা করিতে হয় এই বেলা করুন। বরদাবাবু উত্তর করিলেন —আপনাদিগের বিস্তর অনুগ্রহ কিন্তু আমাকে বেড়ি পরিতে হয় তাহাও পরিব—তাহাতে আমার ক্লেশ হইবে না —অপমান হইবে বটে, সে অপমান স্বীকার করতে প্রস্তুত আছি —কিন্তু প্রাণ গেলেও মিথ্যা পথে যাইব না। ঈস্‌ ! মহাশয় যে সত্য যুগের মানুষ —বোধ হয় রাজা যুধিষ্ঠির মরিয়া জন্মিয়াছেন —না ? এইরূপ ব্যঙ্গ করিয়া ঈষৎ হাস্য করিতে করিতে তাহারা চলিয়া গেল।

এই প্রকারে দুটো বাজিয়া গেল —সাহেবের দেখা নাই, সকলেই তীর্থের কাকের ন্যায় চাহিয়া আছে। কেহ কেহ একজন আচার্য ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিতেছে—অহে ! গণে বলো দেখি সাহেব আসিবেন কি-না ? অমনি আচার্য বলিতেছেন —একটা ফুলের নাম করো দেখি ? কেহ বলে জবা —আচার্য আঙুলে গনিয়া বলিতেছেন —না, আজ সাহেব আসিবেন না —বাটীতে কর্ম আছে। আচার্যের কথায় বিশ্বাস করিয়া সকলে দপ্তর বাঁধিতে উদ্যত হইল ও বলিয়া উঠিল —রাম বাঁচলুম। বাসায় গিয়া চদ্দপ্যে হওয়া যাউক। ঠকচাচা ভিড়ের ভিতর বসিয়াছিল, জন চারেক লোক সঙ্গে —বগলে একটা কাগজের পোঁটলা —মুখে কাপড়, —চোখ দুটি মিট মিট করিতেছে। দাড়িটি ঝুলিয়া পরিয়াছে, ঘাড় হেঁট করিয়া চলিয়া যাইতেছে। এমতো সময় তাহার উপর রামলালের নজর পড়িল। রামলাল অমনি বরদা ও বেণীবাবুকে বলিল —দেখুন দেখুন ঠকচাচা এখানে আসিয়াছে —বোধ হয় ও এই মকদ্দমার জড় —না হলে আমাকে দেখিয়া মুখ ফেরায় কেন ? বরদাবাবু মুখ তুলিয়া দেখিয়া উত্তর করিলেন —এ কথাটি আমারও মনে লাগে —আমাদিগের দিকে আড়ে আড়ে চায় আবার চোখের উপর চোখ পরিলে ঘাড় ফিরিয়া অন্যের সহিত কথা কয় —বোধ হয় ঠকচাচাই সরষের ভিতর ভূত। বেণীবাবুর সদা হাস্য বদন —রহস্য দ্বারা অনেক অনুসন্ধান করেন। চুপ করিয়া না থাকিতে পারিয়া ঠকচাচা ঠকচাচা বলিয়া চিৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিলেন। পাঁচ-সাত ডাক তো ফাওয়ে গেল —ঠকচাচা বগল থেকে কাগজ খুলিয়া দেখিতেছে —বড়ো ব্যস্ত —শুনেও শুনে না —ঘাড়ও তোলে না। বেণীবাবু তাহার নিকটে আসিয়া হাত ঠেলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন —ব্যাপারটা কি? তুমি এখানে কেন? ঠকচাচা কথাই কন না, কাগজ উল্টে-পাল্টে দেখিতেছেন —এদিকে যমলজ্জা উপস্থিত —কিন্তু বেণীবাবুকেও টেলে দিতে হইবে, তাঁহার কথায় উত্তর না দিয়ে বলিল —বাবু ! দরিয়ার বড়ো মৌজ হইয়াছে —এজ তোমরা কি সুরতে যাবে? ভালো, তা যা হউক তুমি এখানে কেন? আরে ঐ বাতই মোকে বার বার পুচ করো কেন? মোর বহুত কাম, থোড়া ঘড়ি বাদ মুই তোমার সাতে বাত করব —আমি জেরা ফিরে এসি, এই বলিয়া ঠকচাচা ধাঁ করিয়া সরিয়া গিয়া একজন লোকের সঙ্গে ফাল্‌ত কথায় ব্যস্ত হইল।

তিনটা বাজিয়া গেল —সকল লোকে ঘুরে-ফিরে ত্যক্ত হইল, মফস্বলে কর্মের নিকাশ নাই —আদালতে হেঁটে হেঁটে লোকের প্রাণ যায়। কাছারি ভাঙো ভাঙো হইয়াছে এমতো সময়ে ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ীর গড় গড় শব্দ হইতে লাগিল, অমনি সকলে চিৎকার করিয়া উঠিল —সাহেব আস্‌ছেন আস্‌ছেন। আচার্যের মুখ শুকাইয়া গেল —দুই-একজন লোক বলিল —মহাশয়ের চমৎকার গণনা —আচার্য কহিলেন, আজ কিঞ্চিৎ রুক্ষ সামগ্রী খাইয়াছিলাম এই জন্য গণনায় ব্যতিক্রম হইয়াছে। আমলা-ফয়লারা স্ব স্ব স্থানে দাঁড়াইল। সাহেব কাছারি প্রবেশ করিবামাত্রেই সকলে জমি পর্যন্ত ঘাড় হেঁট করিয়া সেলাম বাজাইল। সাহেব শিস্‌ দিতে দিতে বেঞ্চের উপর বসিলেন —হুক্কাবরদার আলবলা আনিয়া দিল —তিনি মেজের উপর দুই পা তুলিয়া চৌকিতে শুইয়া পড়িয়া আলবলা টনিতেছেন ও লেবগুব ওয়াটার মাখানো হাতরুমাল বাহির করিয়া মুখ পুঁচিতেছেন। নাজিরদপ্তর লোকে ভারিয়া গেল —জবানবন্দিনবিস্‌ হন্‌ হন্‌ করিয়া জবানবন্দি লিখিতেছে কিন্তু যাহার কড়ি তাহার জয় —সেরেস্তাদার জোড়া গায়ে, খিরকিদার পাগড়ি মাথায়, রাশি রাশি মিছিল লইয়া সাহেবের নিকট গায়েনের সুরে পড়িতেছে, সাহেব খবরের কাগজ দেখিতেছেন ও আপনার দরকারি চিঠিও লিখিতেছেন, এক একটা মিছিল পড়া হলেই জিজ্ঞাসা করেন —ওয়েল কেয়া হোয়া ? সেরেস্তাদারের যেমন ইচ্ছা তেমনি করিয়া বুঝান ও সেরেস্তাদারের যে রায় সাহেবেরও সেই রায়।

বরদাবাবু বেণীবাবু ও রামলালকে লইয়া একপার্শ্বে দাঁড়াইয়া আছেন। যেরূপ বিচার হইতেছে তাহা দেখিয়া তাঁহার জ্ঞান হত হইল। জবানবন্দিনবিসের নিকট তাঁহার মকদ্দমার যেরূপ জবানবন্দি হইয়াছে তাহাতে তাঁহার কিছুমাত্র মঙ্গল হইবার সম্ভাবনা নাই —সেরেস্তাদার যে আনুকূল্য করে তাহাও অসম্ভব, এক্ষণে অনাথার দৈব সখা। এই সকল মনোমধ্যে ভাবিতেছেন ইতিমধ্যে তাঁহার মকদ্দমা ডাক হইল। ঠকচাচা অন্তরে বসিয়াছিল, অমনি বুক ফুলাইয়া সাক্ষীদিগকে সঙ্গে করিয়া সাহেবের সম্মুখে দাঁড়াইল। মিছিলের কাগজাত পড়া হইলে সেরেস্তাদার বলিল, খোদাওয়ান্দ ! গোমখুনি সাফ সাবুদ হুয়া —ঠকচাচা অমনি গোঁপে চাড়া দিয়া বরদাবাবুর প্রতি কট্‌মট্‌ করিয়া দেখিতে লাগিল, মনে করিতেছে এতক্ষণের পর কর্ম কেয়াল হইল। মিছিল পড়া হইলে অন্যান্য মকদ্দমায় আসামীদের কিছুই জিজ্ঞাসা হয় না —তাহাদিগের প্রায় ছাগল বলিদানের ব্যাপারই হইয়া থাকে, কিন্তু হুকুম দেখার অগ্রে দৈবাৎ বরদাবাবুর উপর সাহেবের দৃষ্টিপাত হওয়াতে তিনি সম্মানপূর্বক মকদ্দমার সমস্ত সরেওয়ার সাহেবকে ইংরেজীতে বুঝাইয়া দিলেন ও বলিলেন যে-ব্যক্তিকে গোমখুনি সাজান হইয়াছে তাহাকে আমি কখনই দেখি নাই ও যৎকালীন হুজুরি পেয়াদারা আমার বাটী তল্লাশ করে তখন তাহারা ঐ লোককে পায় নাই, সেই সময় বেণীবাবু ও রামলাল ছিলেন, যদ্যপি ইহাদিগের সাক্ষ্য অনুগ্রহ করিয়া লয়েন তবে আমি যাহা এজেহার করিতেছি তাহা প্রমাণ হইবে। বরদাবাবুর ভদ্র চেহারায় ও সৎ বিবেচনার কথাবার্তায় সাহেবের অনুসন্ধান করিতে ইচ্ছা হইল —ঠকচাচা সেরেস্তাদারের সহিত অনেক ইশারা করিতেছে কিন্তু সেরেস্তাদার ভজকট দেখিয়া ভাবিতেছে পাছে টাকা উগরিয়া দিতে হয়, অতএব সাহেবের নিকটে ভয় ত্যাগ করিয়া বলিল —হুজুর এ মকদ্দমা আয়ৌর শুন্নেকা জরুর নেহি। সাহেব সেরেস্তাদারের কথায় পেছিয়া পড়িয়া দাঁত দিয়া হাতের নখ কাটিতেছেন ও ভাবিতেছেন—এই অবসরে বরদাবাবু আপন মকদ্দমার আসল কথা আস্তে আস্তে একটি একটি করিয়া পুর্নবার বুঝাইয়া দিলেন, সাহেব তাহা শুনিবামাত্রেই বেণীবাবুর ও রামলালের সাক্ষ্য লইলেন ও তাহাদিগের জবানবন্দিতে নালিশ সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা প্রকাশ হইয়া ডিস্‌মিস্‌ হইল। হুকুম না হইতে হইতে ঠকচাচা চোঁ করিয়া এক দৌড় মারিল। বরদাবাবু ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে সেলাম করিয়া আদালতের বাহিরে আসিলেন। কাছারি বরখাস্ত হইলে যাবতীয় লোক তাঁহাকে প্রশাংসা করিতে লাগিল, তিনি সে সব কথায় কান না দিয়া ও মকদ্দমা জিতের দরুন পুলকিত না হইয়া বেণীবাবু ও রামলালের হাত ধরিয়া আস্তে আস্তে নৌকায় উঠিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *