১১. মতিলালের বিবাহ উপলক্ষে কবিতা ও আগরপাড়ার অধ্যাপকদিগের বাদানুবাদ।

আগরপাড়ার অধ্যাপকেরা বৈকালে গাছের তলায় বিছানা করিয়া বসিয়া আছেন। কেহ কেহ নস্য লইতেছেন —কেহ বা তামাক খাইতেছেন —কেহ বা খক্‌ খক্‌ করিয়া কাশিতেছেন —কেহ বা দুই-একটি খোশ-গল্প ও হাসি-মস্‌করার কথা কহিতেছেন। তাঁহাদিগর মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করিলেন —বিদ্যারত্ন কেমন আছেন? ব্রাহ্মণ পেটের জ্বালায় মণিরামপুরে নিমন্ত্রণে গিয়া পা ভাঙিয়া বসিয়াছে —আহা কাল যে করে লাঠি ধরিয়া স্নান করিতে যাইতেছিলেন তাহাকে দেখিয়া আমার দুঃখ হইল।

বিদ্যাভূষণ। বিদ্যারত্ন ভালো আছেন, চুন হলুদ ও সেঁকতাপ দেওয়াতে বেদনা অনেক কমিয়া গিয়াছে। মণিরামপুরের নিমন্ত্রণ উপলক্ষে কবিকঙ্কণ দাদা যে কবিতা রচনা করিয়াছেন, তাহাতে রং আছে —বলি শুনুন :

ডিমিকি ডিমিকি, তাথিয়ে থিয়ে বোলে নহবত বাজে।
মাধব ভবন। দেবেন্দ্রসদন। জিনি ভুবন বিরাজে।
অদ্‌ভুত সভা। আলোকের আভা। ঝাড়ের প্রভা মাজে মাজে।
চারিদিকে নানা ফুল। ছড়াছড়ি দুই কুল। বাদ্যের কুল কুল ঝাঁজে।
খোপে খোপে গাঁদা মালা। রাঙা কাপড় রুপার বালা। এতক্ষণে বিয়ের শালা সাজে।
সামেয়ানা ফর্‌ ফর্‌। তালি তাতে বহুতর। জল পড়ে ঝর্‌ ঝর্‌ হাজে।
লেঠিয়াল মজবুত। দরওয়ান রজপুত। নিনাদ অদ্ভুত গাজে।
লুচি চিনি মনোহরা। ভাঁড়ারেতে খুব ভরা। আল্পনার ডোরা ডোরা সাজে।
ভাট বন্দী কত কত। শ্লোক পড়ে শত শত। ছন্দ নানামতো ভাঁজে।
আগরপাড়া কবিবর। বিরচয়ে ওঁহিপর। ঝুপ করে এল বর সমাজে।

হলধর গদাধর উসু খুসু করে।
ছট্‌ ফট্‌ ছট্‌ ফট্‌ করে তারা মরে।
ঠকচাচা হন কাঁচা শুনে বাজে কথা।
হলধর গদাধর খাইতেছে মাথা।
পড়াপড়্‌ পড়াপড়্‌ ফাঁড়িবার শব্দ।
গুপাগুপ্‌ গুপাগুপ্‌ কিলে করে জব্দ।
ঠনাঠন্‌ ঠনাঠন্‌ ঝাড়ে ঝাড়ে লাগে।
সট্‌ সট্‌ সট্‌ সট্‌ করে সবে ভাগে।
মতিলাল দেখে কাল বসে বসে দোলে।
সুতাসার কি আমার আছয়ে কপালে।
বক্রেশ্বর বোকেশ্বর খোশামদে পাক্কা।
চলে যান কিল খান খান গলা ধাক্কা।
‌ বাঞ্ছারাম অবিরাম ফিকিরেতে টন্‌ক।
চড় খেয়ে আচাড় খেয়ে হইলেন বঙ্ক।
বেচারাম সব বাম দেখে যান টেরে।
দূঁর দূঁর দূঁর দূঁর বলে অনিবারে।
বেণীবাবু খান খাবু নাই গতি গঙ্গা।
হুপ্‌ হাপ্‌ গুপ্‌ গাপ্‌ বেড়ে উঠে দাঙ্গা।
বাবুরাম ধরে থাম থাম থাম করে।
ঠক ঠক ঠক ঠক কেঁপে মরে ডরে।
ঠকচাচা মোরে বাঁচা বলে তাড়াতাড়ি।
মুসলমান বেঈমান আছে মুড়ি ঝুড়ি।
যায় সরে ধীরে ধীরে মুখে কাপড় মোড়া।
সবে বলে এই বেটা যত কুয়ের গোড়া।
রেওভাট করে সাট ধরে তাকে পড়ে।
চড়্‌ চড়্‌ চড়্‌ চড়্‌ দাড়ি তার ছেঁড়ে।

সেখের পো ওহো ওহো বলে তোবা তোবা।
জান যায় হায় হায় মাফ করো বাবা।
খুব করি হাত ধরি মোরে দাও ছেড়ে।
ভালা বুরা নেহি জান্তা জেতে মুই নেড়ে।
এ মোকামে কোই কামে আনা ঝকমারি।
হয়রান পেরেসান বেইজ্জতে মরি।
না বুজিয়া না সুজিয়া হেন্দুদের সাতে।
এসেছি বসিয়া আছি সেরফ্‌ দোস্‌তিতে।
এ সাদিতে না থাকিতে বার বার নানা।
চাচি মোর ফুপা মোর সবে করে মানা।
না শুনিয়া না রাখিয়া তেনাদের কথা।
জান যায় দাড়ি যায় যায় মোর মাথা।

মহা ঘোর ঝাপে লাঠিয়াল সাজিছে।
কড়্‌ মড়্‌ হড়্‌ মড়্‌ করে তারা আসিছে।
সপাসপ্‌ লপালপ্‌ বেত পিঠে পড়িছে।
গেলুম্‌রে মলুম্‌রে বলে সবে ডাকিছে।
বরযাত্রী কন্যাযাত্রী কে কোথা ভাগিছে।
মার মার ধর ধর এই শব্দ বাড়িছে।
বর লয়্যে মাধববাবু অন্তঃপুরে যাইছে।
সভা ভেঙে ছারখার একেবারে হইছে।
সবে বলে ঠক মুখে খুলে কাপড় বেড়।
দাড়ি ছেঁড় দাড়ি ছেঁড় দাড়ি ছেঁড় দাড়ি ছেঁড়।
বাবুরাম নির্‌ নাম হইয়ে চলিল।
রেসালা দোশালা সব কোথায় রহিল।
কাপড় চোপড় ছিঁড়ে পড়ে খুলে।
বাতাসে অবশে ওড়ে দুলে দুলে।
চাদর ফাদর নাহি কিছু গায়ে।
হোঁচট মোচট খান সুদু পায়ে।
চলিছে ধলিছে বড়ো অধোমুখে।
পড়েছি ডুবেছি আমি ঘোর দুঃখে।
ক্ষুধাতে তৃষ্ণাতে মোর ছাতি ফাটে।
মিঠাই না পাই নাহি মুড়কি জোটে।
রজনী অমনি হইতেছে ঘোর
বাতাস নিশ্বাস মধ্যে হল জোর।
বহে ঝড় হড়্‌ মড়্‌ চারিদিগে।
পবন শমন যেন এল বেগে।
কি করি একাকী না লোক না জন।
নিকট বিকট হইবে মরণ।
চলিতে বলিতে মন নাহি লাগে।
বিধাতা শত্রুতা করিলে কি হবে।
না জানি গৃহিণী মোর মৃত্যু শুনে।
দুঃখেতে খেদেতে মরিবেন প্রাণে।
বিবাহ নির্বাহ হল কি না হল।
ঠ্যাঙাতে লাঠিতে কিন্তু প্রাণ গেল।
সম্বন্ধ নির্বন্ধ কেন করিলাম।
মানেতে প্রাণেতে আমি মজিলাম।
আসিতে আসিতে দোকান দেখিল।
অবাধা তাগাদা যাইয়া ঢুকিল।
পার্শ্বেতে দর্মাতে শুয়ে আছে পড়ে।
অস্থির দুস্থির বুরো ঠক নেড়ে।
কেমনে এখানে বাবুরাম বলে।
একালা আমাকে ফেলিয়া আইলে।
এ কর্ম কি কর্ম সখার উচিত।
বিপদে আপদে প্রকাশে পিরিত।
ঠক কয় মহাশয় চুপ করো।
দোকানী না জানি তেনাদের চর।
পেলিয়ে যাইলে সব বাত হবে।
বাঁচিলে জানেতে মহবত রবে।
প্রভাতে দোঁহাতে করিল গমন
রচিয়ে তোটকে শ্রীকবিকঙ্কণ।

তর্কবাগীশ বাবুরামবাবুর বড়ো গোঁড়া কবিতা শুনিবামাত্র জ্বলিয়া উঠে বলিলেন —আ মরি ! কিবা কবিতা —সাক্ষাৎ সরস্বতী মূর্তিমান —কিংবা কালিদাস মরিয়া জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন —কবিকঙ্কণের ভারি বিদ্যা —এমন ছেলে বাঁচা ভার। পয়ারও চমৎকার ! মেজের মাটি —পাথর বাটি —শীতল পাটি —নারকেল কাটি ! ব্রাহ্মণ পণ্ডিত হইয়া বড়োমানুষের সর্বদা প্রশংসা করিবে গ্লানি করা তো ভদ্র কর্ম নয় —এই বলিয়া তিনি রাগ করিয়া সে স্থান হইতে উঠিয়া চলিয়া যান। সকলে হাঁ —হাঁ —দাঁড়ান গো বলিয়া তাঁহাকে জোর করিয়া বসাইলেন।

অন্য আর একজন অধ্যাপকও কথা চাপা দিয়া অন্যান্য কথা ফেলিয়া সলিয়ে-কলিয়ে বাবুরামবাবু ও মাধববাবুর তারিফ করিতে আরম্ভ করিলেন। বামুনে বুলি প্রায় বড়ো মোটা —সকল সময় সবকথা তলিয়ে বুঝিতে পারে না —ন্যায়শাস্ত্রে ফেঁকড়ি পড়িয়া কেবল ন্যায়শাস্ত্রীয় বুদ্ধি হয় সাংসারিক বুদ্ধির চালনা হয় না। তর্কবাগীশ অমনি গলিয়া গিয়া উপস্থিত কথায় আমোদ করিতে লাগিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *