১০. বৈদ্যবাটীর বাজার বর্ণন, বেচারামবাবুর আগমন, বাবুরামবাবুর সভায় মতিলালের বিবাহের ঘোঁট ও বিবাহ করণার্থে মণিরামপুরে যাত্রা এবং তথায় গোলযোগ।

শেওড়াপুলির নিস্তারিণীর আরতি ডেডাং ডেডাং করিয়া হইতেছে। বেচারামবাবু ঐ দেবীর আলয় দেখিয়া পদব্রজে চলিয়াছেন। রাস্তার দোধারি দোকান —কোনোখানে বন্দীপুর ও গোপাল পুরের আলু স্তূপাকার রহিয়াছে—কোনোখানে মুড়ি-মুড়কি ও চালডাল বিক্রয় হইতেছে —কোনোখানে কলু ভায়া ঘানিগাছের কাছে বসিয়া ভাষা রামায়ণ পড়িতেছেন —গোরু ঘুরিয়া যায় অমনি টিটকারি দেন, আবার আলে ফিরিয়া আইলে চিৎকার করিয়া উঠেন “ও রাম আমরা বানর, রাম আমরা বানর” —কোনোখানে জেলের মেয়ে মাছের ভাগা দিয়া নিকটে প্রদীপ রাখিয়া “মাছ নেবে গো, মাছ নেবে গো” বলিতেছে —কোনোখানে কাপুড়ে মহাজন বিরাট পর্ব লইয়া বেদব্যাসের শ্রাদ্ধ করিতেছে। এই সকল দেখিতে দেখিতে বেচারামবাবু যাইতেছেন। একাকী বেড়াতে গেলে সর্বদা যে সব কথা তোলাপড়া হয় সেই সকল কথাই মনে উপস্থিত হয়। তৎকালে বেচারামবাবু সদ্য সংকীর্তন লইয়া আমোদ করিতেন। বসতি ছাড়াইয়া নির্জন স্থান দিয়া যাইতে যাইতে মনোহরসাহী একটা তুক্ক তাঁহার স্মরণ হইল। রাত্রি অন্ধকার —পথে প্রায় লোকজনের গমনাগমন নাইে—কেবল দুই-একখানা গোরুর গাড়ী কেঁকোর কেঁকোর করিয়া ফিরিয়া যাইতেছে ও স্থানে স্থানে এক একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করিতেছে। বেচারামবাবু তুক্কর সুর দেদার রকমে ভাঁজিতে লাগিলেন —তাঁহার খোনা আওয়াজ আশপাশের দুই-একজন পাড়াগেঁয়ে মেয়েমানুষ শুনিবামাত্রে আঁও মাঁও করিয়া উঠিল —পল্লীগ্রামের স্ত্রীলোকদিগের আজন্মকালাবধি এই সংস্কার আছে যে খোনা কেবল ভূতেতেই করিয়া থাকে। ঐ গোলযোগ শুনিয়া বেচারামবাবু কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হইয়া দ্রুতগতি একেবারে বৈদ্যবাটীর বাটীতে উপস্থিত হইলেন।

বাবুরামবাবু ভারি মজলিস করিয়া বসিয়া আছেন। বালীর বেণীবাবু, বটতলার বক্রেশ্বরবাবু, বাহির সিমলার বাঞ্ছারামবাবু ও অন্যান্য অনেকে উপস্থিত। গদির নিকট ঠকচাচা একখানা চৌকির উপর বসিয়া আছেন। অনেকগুলি ব্রাহ্মণ পণ্ডিত শাস্ত্রালাপ করিতেছেন। কেহ কেহ ন্যায়শাস্ত্রের ফেঁক্‌ড়ি ধরিয়াছেন —কেহ কেহ তিথিতত্ত্ব, কেহ বা মলমাসতত্ত্বের কথা লইয়া তর্ক করিতে ব্যস্ত আছেন —কেহ কেহ দশম স্কন্ধের শ্লোক ব্যাখ্যা করিতেছেন —কেহ কেহ বহুব্রীহি ও দ্বন্দ্ব লইয়া মহা দ্বন্দ্ব করিতেছেন। কামাখ্যা-নিবাসী একজন ঢেঁকিয়াল ফুক্কন কর্তার নিকট বসিয়া হুকা টানিতে টানিতে বলিতেছেন —আপনি বড়ো বাগ্যমান পুরুষ —আপনার দুইটি লড়বড়ে ও দুইটি পেঁচা মুড়ি —এ বচ্চর একটু লেড়াং ভেড়াং আছে কিন্তু একটি যাগ করলে সব রাঙা ফুকনের মাচাং যাইতে পারবে ও তাহার বশীবুত অবে —ইতিমধ্যে বেচারামবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি আসিবামাত্র সকলেই উঠে দাড়াইয়া “আসতে আজ্ঞা হউক, আসতে আজ্ঞা হউক” বলিতে লাগিল। পুলিশের ব্যাপার অবধি বেচারামবাবু চটিয়া রহিয়াছিলেন কিন্তু শিষ্টাচারে ও মিষ্টকথায় কে না ভোলে ? ঘন ঘন “যে আজ্ঞা মহাশয়ে” তাহার মন একটু নরম হইল এবং তিনি সহাস্য বদনে বেণীবাবুর কাছে ঘেঁষে বসিলেন। বাবুরামবাবু বলিলেন —মহাশয়ের বসাটা ভালো হইল না —গদির উপর আসিয়া বসুন। মিল মাফিক লোক পাইলে মানিকজোড় হয়। বাবুরামবাবু অনেক অনুরোধ করিলেন বটে কিন্তু বেচারামবাবু বেণীবাবুর কাছছাড়া হইলেন না। কিয়ৎক্ষণ অন্যান্য কথাবার্তার পর বেচারামবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন মতিলালের বিবাহের সম্বন্ধ কোথায় হইল ?

বাবুরাম। সম্বন্ধ অনেক আসিয়াছিল। গুপ্তিপাড়ার হরিদাসবাবু, নাকাসী পাড়ার শ্যামাচরণবাবু, কাঁচড়াপাড়ার রামহরিবাবু ও অন্যান্য অনেক স্থানের অনেক ব্যক্তি সম্বন্ধের কথা উপস্থিত করিয়াছিল। সে সব ত্যাগ করিয়া এক্ষণে মণিরামপুরের মাধববাবুর কন্যার সহিত বিবাহ ধার্য করা গিয়াছে। মাধববাবু যোত্রাপন্ন লোক আর আমাদিগের দশ টাকা পাওয়া-থোয়া হইতে পারিবে।

বেচারাম। বেণী ভায়া ! এ বিষয়ে তোমার কি মত ? কথাগুলো খুলে বলো দেখি।
বেণী। বেচারাম দাদা। খুলে খেলে কথা বলা বড় দায় — বোবার শত্রু নাই আর কর্ম যখন ধার্য হইয়াছে তখন আন্দোলনে কি ফল ?
বেচারাম। আরে তোমাকে বলতেই হবে —আমি সব বিষয়ের নিগূড় তত্ত্ব জানিতে চাই।

বেণী। তবে শুনুন— মনিরামপুরের মাধববাবু দাঙ্গাবাজ লোক —ভদ্র চালচুলা নাই, কেবল গোরু কেটে জুতাদানি ধার্মিকতা আছে —বিবাহেতে জিনিসপত্র টাকাকড়ি দিতে পারেন কিন্তু বিবাহ দিতে গেলে কেবল কি টাকাকড়ির উপর দৃষ্টি করা কর্তব্য ? অগ্রে ভদ্রঘর খোঁজা উচিত, তারপর ভালো মেয়ে খোঁজা কর্তব্য, তারপর পাওনা-থোওনা হয় বড়ো ভালো — না হয় —নাই। কাঁচড়াপাড়ার রামহরিবাবু অতি সুমানুষ —তিনি পরিশ্রম দ্বারা যাহা উপায় করেন তাহাতেই সানন্দচিত্তে কাল যাপন করেন —পরের বিষয়ের উপর কখন চেয়েও দেখেন না —তাঁহার অবস্থা বড়ো ভালো নয় বটে কিন্তু তিনি আপন সন্তানাদির সদুপদেশে সর্বদা যত্নবান ও পরিবারেরা কি প্রকারে ভালো থাকিবে ও কি প্রকারে তাহাদিগের সুমতি হইবে সর্বদা কেবল এই চিন্তা করিয়া থাকেন। এমন লোকের সঙ্গে কুটুম্বিতা হইলে তো সর্বাংশে সুখজনক হইত।

বেচারাম। বাবুরামবাবু ! তুমি কাহার বুদ্ধিতে এ সম্বন্ধ করিয়াছ ? টাকার লোভেই গেলে যে ! তোমাকে কি বল্‌ব ? এ আমাদিগের জেতের দোষ। বিবাহের কথা উপস্থিত হইলে লোকে অমনি বলে বসে —কেমন গো রূপোর ঘড়া দেবে তো ? মুক্তোর মালা দেবে তো ? আরে আবাগের বেটা কুটুম্ব ভদ্র কি অভদ্র তা আগে দেখ্‌—মেয়ে ভালো কি মন্দ তার অন্বেষণ কর্‌ ? সে সব ছোট কথা —কেবল দশ টাকা লাভ হইলেই সব হইল —দূঁর দূঁর !

বাঞ্ছারাম। কুলও চাই —রূপও চাই —ধনও চাই ! টাকাটা একেবারে অগ্রাহ্য করলে সংসার কিরূপে চলবে ?

বক্রেশ্বর। তা বই কি —ধনের খাতির অবশ্য রাখতে হয়। নির্ধন লোকের সহিত আলাপে ফল কি ? সে আলাপে কি পেট ভরে ?

ঠকচাচা চৌকির উপর থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়িয়া বললেন, মোর উপর এতনা টিটকারি দিয়া বাত হচ্ছে কেন ? মুই তো এ শাদি করতে বলি —একটা নামজাদা লোকের বেটি না আন্‌লে আদমির কাছে বহুত শরমের বাত, মুই রাতদিন ঠেওরে ঠেওরে দেখেছি যে, মণিরামপুরের মাধববাবু আচ্ছা আদমি —তেনার নামে বাগে গোরুতে জল খায় —দাঙ্গা-হাঙ্গামের ওক্তে লেঠেল মেংলে লেঠেল মিল্‌বে —আদালতের বেলকুল আদমি তেনার দস্তের বিচ —আপদ পড়লে হাজারো সুরতে মদত্‌ মিলবে। কাঁচড়াপাড়ার রামহরিবাবু সেকস্ত আদ্‌মি —ঘেসাট-ঘোসাট করে প্যাট-টালে —তেনার সাথে খেসি কামে কি ফায়দা ?

বেচারাম। বাবুরাম! ভালো মন্ত্রী পাইয়াছ ! এমন মন্ত্রীর কথা শুনিলে তোমাকে সশরীর স্বর্গে যাইতে হইবে —আর কিবা ছে্লেই পেয়েছ ! —তাহার আবার বিয়ে ? বেণী ভায়া তোমার মত কি ?

বেণী। আমার মত এই যে —পিতা প্রথমে ছেলেকে ভালো রূপে শিক্ষা দিবেন ও ছেলে যাহাতে সর্বপ্রকারের সৎ হয় এমতো চেষ্টা সম্যক্‌রূপে পাইবেন —ছেলের যখন বিবাহ করিবার বয়েস হইবে তখন তিনি বিশেষরূপে সাহায্য করিবেন। অসময় বিবাহ দিলে ছেলের নানাপ্রকার হানি করা হয়।

এই সকল কথা শুনিয়া বাবুরামবাবু ধড়মরিয়া উঠিয়া তাড়াতাড়ি বাটীর ভিতর গেলেন। গৃহিণী পাড়ার স্ত্রীলোকদিগের সহিত বিবাহ সংক্রান্ত কথাবার্তা কহিতেছিলেন। কর্তা নিকটে গিয়া বাহির বাটীর সকল কথা শুনাইয়া থতমত খাইয়া দাঁড়াইলেন ও বলিলেন —তবে কি মতিলালের বিবাহ কিছু দিন স্থগিত থাকিবে ? গৃহিণী উত্তর করিলেন —তুমি কেমন কথা বলো —শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে ষেটের কোলে মতিলালের বয়েস ষোল বৎসর হইল —আর কি বিবাহ না দেওয়া ভালো দেখায়? এ কথা লইয়া এখন গোলমাল করিলে লগ্ন বয়ে যাবে, কি করছো—একজন ভালো মানুষের কি জাত যাবে? —বড় লয়ে শীঘ্র যাও। গৃহিণীর উপদেশে কর্তার মনের চাঞ্চল্য দূর হইল —বাটীর বাহিরে আসিয়া রোশনাই জ্বালিতে হুকুম দিলেন; অমনি ঢোল, রোশনচৌকি, ইংরাজী বাজনা বাজিয়া উঠিল ও বরকে তক্তনামার উপর উঠাইয়া বাবুরামবাবু ঠকচাচার হাত ধরিয়া আপন বন্ধু-বান্ধব কুটুম্ব-সজ্জন সঙ্গে লইয়া হেল্‌তে দুল্‌তে চলিলেন। ছাতের উপর থেকে গৃহিণী ছেলের মুখখানি দেখিতে লাগিলেন। অন্যান্য স্ত্রীলোকেরা বলিয়া উঠিল —ও মতির মা ! আহা বাছার কী রূপই বেরিয়েছে। বরের সব ইয়ার-বক্সি চলিয়াছে, পেছনে রংমশাল লইয়া কাহারো গা পোড়াইয়া দিতেছে, কাহারো ঘরের নিকট পটকা ছুঁড়িতেছে, কাহারো কাছে তুবরিতে আগুন দিতেছে। গরীব-দুঃখী লোকসকল দেক্‌সেক হইল কিন্তু কাহারো কিছু বলিতে সাহস হইল না।

কিয়ৎক্ষণ পরে বর মণীরামপুরে গিয়া উত্তীর্ণ হইল —বর দেখতে রাস্তার দোধারি লোক ভেঙে পড়িল —স্ত্রীলোকেরা পরস্পর বলাবলি করতে লাগিল —ছেলেটির শ্রী আছে বটে কিন্তু নাকটি একটু টেকালো হলে ভালো হইত —কেহ বলতে লাগিল রংটি কিছু ফিকে একটু মাজা হলে আরও খুলতো। বিবাহ ভারি লগ্নে হবে কিন্তু রাত্রি দশটা না বাজতে বাজতে মাধববাবু দরওয়ান ও লন্ঠন সঙ্গে করিয়া বরযাত্রীদিগের আগ্‌বাড়ান লইতে আইলেন —রাস্তায় বৈবাহিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়াতে প্রায় অর্ধঘন্টা শিষ্টাচারেতেই গেল —ইনি বলেন মহাশয় আগে চলুন, উনি বলেন মহাশয় আগে চলুন। বালীর বেণীবাবু এগিয়ে আসিয়া বলিলেন —আপনারা দু’জনের মধ্যে যিনি হউন একজন এগিয়ে পড়ুন আর রাস্তায় দাঁড়াইয়া হিম খাইতে পারি না। এইরূপ মীমাংসা হওয়াতে সকলে কন্যাকর্তার বাটীর নিকট আসিয়া ভিতরে প্রবেশ করিতে লাগিলেন ও বর যাইয়া মজলিসে বসিল। ভাট, রেও ও বারওয়ারীওয়ালা চারিদিকে ঘেরিয়া দাঁড়াইল —গ্রামভাটি ও নানা প্রকার ভাবের কথা উপস্থিত হইতে লাগিল —ঠকচাচা দাঁড়াইয়া রফা করিতেছেন —অনেক দম-সম দেন কিন্তু ফলের দফায় নামমাত্র —রেওদিগের মধ্যে একটা ষণ্ডা তেড়ে এসে বলিল, এ নেড়ে বেটা কেরে ? বেরো বেটা এখান থেকে —হিন্দুর কর্মে মুসলমান কেন ? ঠকচাচা অমনি রাগ উপস্থিত হইল। তিনি দাড়ি নেড়ে চোখ রাঙাইয়া গালি দিতে লাগিলেন। হলধর, গদাধর ও অন্যান্য নব বাবুরা একে চায় আরে পায়। তাহারা দেখিল যে প্রকার মেঘ করিয়া আসিতেছে —ঝড় হইতে পারে —অতএব ফরাস ছেড়ে, কেহ সেজ নেবায় —কেহ ঝাড়ে ঝাড়ে টক্কর লাগাইয়া দেয় —কেহ এর ওর মাথার উপর ফেলিয়া দেয়, কন্যাকর্তার তরফের দুইজন লোক এই সকল গোলযোগ দেখিয়া দুই-একটি শক্ত কথা বলাতে হাতাহাতি হইবার উপক্রম হইল —মতিলাল বিবাদ দেখিয়া মনে মনে ভাবে, বুঝি আমার কপালে বিয়ে নাই —হয় তো সুতা হাতে সার হইয়া বাটী ফিরিয়া যাইতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *