০৬. মতিলালের মাতার চিন্তা, ভগিনীদ্বয়ের কথোপকথন, বেণী ও বেচারামবাবুর নীতি বিষয়ে কথোপকথন ও বরদাপ্রসাদবাবুর পরিচয়।

বৈদ্যবাটীর বাটিতে স্বস্ত্যয়নের ধুম লেগে গেল। সূর্য উদয় না হইতে হইতে শ্রীধর ভট্টাচার্য, রামগোপাল চূড়ামণি প্রভৃতি জপ করিতে বসিলেন। কেহ তুলসী দেন —কেহ বিল্বপত্র বাছেন —কেহ বববম্ বববম্ করিয়া গালবাদ্য করেন —কেহ বলেন যদি মঙ্গল না হয় তবে আমি বামুন নাহি —কেহ কহেন যদি মন্দ হয় তবে আমি পৈতে ওলাব। বাটীর সকলেই শশব্যস্ত —কাহারো মনে কিছু মাত্র সুখ নাই।

গৃহিণী জানালার নিকট বসিয়া কাতরে আপন ইষ্টদেবতাকে ডাকিতেছেন। কোলের ছেলেটি চুষি লইয়া চুষিতেছে —মধ্যে মধ্যে হাত পা নাড়িয়া খেলা করিতেছে। শিশুটির প্রতি এক একবার দৃষ্টিপাত করিয়া গৃহিণী মনে মনে বলিতেছেন —জাদু ! তুমি আবার কেমন হবে বলতে পারি না। ছেলে না হবার এক জ্বালা —হবার শতেক জ্বালা —যদি ছেলের একটু রোগ হল, তো মার প্রাণ অমনি উড়ে গেল। ছেলে কিসে ভালো হবে এজন্য মা শরীর একেবারে ঢেলে দেয় —তখন খাওয়া বলো —শোয়া বলো, সব ঘুরে যায়। দিনকে দিন জ্ঞান হয় না, রাতকে রাত জ্ঞান হয় না। এত দুঃখের ছেলে বড়ো হয়ে যদি সুসন্তান হয় তবেই সব সার্থক —তা না হলে মার জীয়ন্তে মৃত্যু —সংসারে কিছুই ভালো লাগে না —পাড়াপড়শীর কাছে মুখ দেখাতে ইচ্ছা হয় না —বড়ো মুখটি ছোট হয়ে যায় আর মনে হয় যে পৃথিবী দোফাঁক হও আমি তোমার ভিতরে সেঁদুই। মতিকে যে করে মানুষ করেছি তা গুরুদেবই জানেন —এখন বাছা উড়তে শিখে আমাকে ভালো সাজাই দিতেছেন। মতির কুকর্মের কথা শুনে অমি ভাজা ভাজা হয়েছি, দুঃখেতে ও ঘৃণাতে মরে রয়েছি। কর্তাকে সকল কথা বলি না, সকল কথা শুনিলে তিনি পাগল হতে পারেন। দূর হউক, আর ভাবতে পারি না। আমি মেয়েমানুষ, ভেবেই বা কি করিব—যা কপালে আছে তাই হবে।

দাসী আসিয়া খোকাকে লইয়া গেল। গৃহিণী আহ্নিক করিতে বসিলেন। মনের ধর্মই এই যখন এক বিষয়ে মগ্ন থাকে তখন সে বিষয়টি হঠাৎ ভুলিয়া আর একটি বিষয়ে প্রায় যায় না। এই কারণে গৃহিণী আহ্নিক করিতে বসিয়াও আহ্নিক করিতে পারিলেন না। এক একবার যত্ন করেন জপে মন দি, কিন্তু মন সেদিকে ধায় না। মতির কথা মনে উদয় হইতে লাগিল —সে যেন প্রবল স্রোত, কার সাধ্যি নিবারণ করে। কখন কখন বোধ হইতে লাগিল তাহার কয়েদ হুকুম হইয়াছে —তাহাকে বাঁধিয়া জেলে লইয়া যাইতেছে, তাহার পিতা নিকটে দাঁড়াইয়া আছেন, দুঃখেতে ঘার হেঁট করিয়া রোদন করিতেছেন। কখন বা জ্ঞান হইতেছে, পুত্র নিকটে আসিয়া বলিতেছেন, মা আমাকে ক্ষমা করো —আমি যা করিয়াছি তা করিয়াছি আর আমি কখন তোমার মনে বেদনা দিব না, আবার এক একবার বোধ হইতেছে যে মতির ঘোর বিপদ উপস্থিত, তাহাকে জন্মের মতো দেশান্তর যাইতে হইবেক। গৃহিণীর চটক ভাঙিয়া গেলে আপনাআপনি বলিতে লাগিলেন —এ দিনের বেলা আমি কি স্বপ্ন দেখিতেছি? না এ তো স্বপ্ন নয়, তবে কি খেয়াল দেখিলাম? কে জানে আমার মনটা আজ কেন এমন হচ্চে। এই বলিয়া চক্ষের জল ফেলতে ফেলতে ভূমিতে আস্তে আস্তে শয়ন করিলেন। দুই কন্যা মোক্ষদা ও প্রমদা ছাতের উপর বসিয়া মাথা শুকাইতেছিলেন।

মোক্ষদা। ওরে প্রমদা। চুলগুলো ভালো করে এলিয়ে দে না, তোর চুল গুলা যে বড়ো উষ্কখুষ্ক হয়েছে! না হবেই বা কেন? সাত জন্মের তো একটু তেল পড়ে না—মানুষের তেলে-জলেই শরীর, বারো মাস রুক্ষু নেয়ে নেয়ে কি একটা রোগনারা করবি? তুই এত ভাবিস্ কেন ? ভেবে ভেবে যে দড়ি বেটে গেলি।

প্রমদা। দিদি। আমি কি সাধ করে ভাবি? মনে বুঝে না, কি করি ? ছেলেবেলা বাপ একজন কুলীনের ছেলেকে ধরে এনে আমাকে বিবাহ দিয়েছিলেন —এ কথা বড়ো হয়ে শুনেছি। পতি কত শত স্থানে বিয়ে করেছেন, আর তাঁহার যেরূপ চরিত্র তাতে তাঁহার মুখ দেখতে ইচ্ছা হয় না। অমন স্বামী না থাকা ভালো।

মোক্ষদা। হাবি ! অমন কথা বলিস নে —স্বামী মন্দ হউক ছন্দ হউক, মেয়েমানুষের এয়ত্ থাকা ভালো।

প্রমদা। তবে শুনবে? আর বৎসর যখন আমি পালা জ্বরে ভুগতেছিনু —দিবারাত্রি বিছানায় পড়ে থাকতুম —উঠিয়া দাঁড়াইবার শক্তি ছিল না, সে সময় স্বামী আসিয়া উপস্থিত হলেন। স্বামী কেমন, জ্ঞান হওয়া অবধি দেখি নাই, মেয়ে মানুষের স্বামীর ন্যায় ধন নাই। মনে করিলাম দুই দণ্ড কাচে বসে কথা কহিলে রোগের যন্ত্রণা কম হবে। দিদি বললে প্রত্যয় যাবে না —তিনি আমার কাছে দাঁড়াইয়াই অমনি বল্লেন —ষোল বৎসর হইল তোমাকে বিবাহ করে গিয়াছি —তুমি আমার এক স্ত্রী —টাকার দরকারে তোমার নিকটে আসিতেছি —শীঘ্র যাব —তোমার বাপকে বললাম। তিনি তো ফাঁকি দিলেন —তোমার হাতের গহনা খুলিয়া দাও। আমি বললাম —মাকে জিজ্ঞাসা করি —মা যা বলবেন তাই করবো। এই কথা শুনিবা মাত্র আমার হাতের বালাগাছটা জোর করে খুলে নিলেন। আমি একটু হাত বাগড়া বাগড়ি করেছিনু, আমাকে একটা লাথি মারিয়া চলিয়া গেলেন —তাতে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিনু, তারপর মা আসিয়া আমাকে অনেকক্ষণ বাতাস করাতে আমার চেতনা হয়।

মোক্ষদা। প্রমদা। তোর দুঃখের কথা শুনিয়া আমার চক্ষে জল আইসে, দেখ তোর তবু এয়ত্ আছে, আমার তাও নাই।

প্রমদা। দিদি। স্বামীর এই রকম। ভাগ্যে কিছুদিন মামার বাড়ি ছিলাম তাই একটু লেখাপড়া ও হুনুরি কর্ম শিখিয়াছি। সমস্ত দিন কর্ম-কাজ ও মধ্যে মধ্যে লেখাপড়া ও হুনুরি কর্ম করিয়া মনের দুঃখ ঢেকে বেড়াই। একলা বসে যদি একটু ভাবি তো মনটা অমনি জ্বলে উঠে।

মোক্ষদা। কি করবে? আর জন্মে কত পাপ করা গিয়েছিল তাই আমাদের এত ভোগ হইতেছে। খাটা খাটুনি করলে শরীরটা ভালো থাকে মনও ভালো থাকে। চুপ করিয়া বসে থাকিলে দুর্ভাবনা বলো, দুর্মতি বলো, রোগ বলো, সকলি আসিয়া ধরে। আমাকে এ কথা মামা বলে দেন —আমি এই করে বিধবা হওয়ার যন্ত্রণাকে অনেক খাটো করেছি, আর সর্বদা ভাবি যে সকলই পরমেশ্বরের হাত, তাঁর প্রতি মন থাকাই আসল কর্ম। বোন্ ! ভাবতে গেলে ভাবনার সমুদ্রে পড়তে হয়। তার কূল-কিনারা নাই। ভেবে কি করবি? দশটা ধর্ম -কর্ম কর্ —বাপ -মার সেবা কর —ভাই দুটির প্রতি যত্ন কর, আবার তাদের ছেলেপুলে হলে লালন —পালন করিস্ —তারাই আমাদের ছেলেপুলে।

প্রমদা। দিদি। যা বলতেছ তা সত্য বটে কিন্তু বড়ো ভাইটি তো একেবারে অধঃপাতে গিয়েছে। কেবল কুকথা কুকর্ম ও কুলোক লইয়া আছে। তার যেমন স্বভাব তেমনি বাপ-মার প্রতি ভক্তি —তেমনি আমাদের প্রতিও স্নেহ। বোনের স্নেহ ভায়ের প্রতি যতটা হয় ভায়ের স্নেহ তার শত অংশের এক অংশও হয় না। বোন ভাই-ভাই করে সারা হন কিন্তু ভাই সর্বদা মনে করেন বোন বিদায় হলেই বাঁচি। আমরা বড়ো বোন —মতি যদি কখন কখন কাছে এসে দু-একটা ভালো কথা বলে তাতেও মনটা ঠাণ্ডা হয় কিন্তু তার যেমন ব্যবহার তা তো জানো ?

মোক্ষদা। সকল ভাই এরূপ করে না। এমন ভাইও আছে যে বড়ো বোনকে মার মতো দেখে, ছোট বোনকে মেয়ের মতো দেখে। সত্যি বল্‌চ এমন ভাই আছে যে ভাইকেও যেমন দেখে বোনকে তেমন দেখে। দু-দণ্ড বোনের সঙ্গে কথাবার্তা না কহিলে তৃপ্তি বোধ করে না ও বোনের আপদ্ পড়িলে প্রাণপণে সাহায্য করে।

প্রমদা। তা বটে কিন্তু আমাদিগের যেমন পোড়া কপাল তেমন ভাই পেয়েছি। হায় ! পৃথিবীতে কোনো প্রকার সুখ হয় না।

দাসী আসিয়া বলিল —মা ঠাকুরুন কাঁদছেন —এই কথা শুনিবামাত্র দুই বোনে তাড়াতাড়ি করিয়া নীচে নামিয়ে গেলেন।

চাঁদনীর রাত্রি। গঙ্গার উপর চন্দ্রের আভা পড়িয়াছে—মন্দ মন্দ বায়ু বহিতেছে—বনফুলের সৌগন্ধ মিশ্রিত হইয়া এক একবার যেন আমোদ করিতেছে—ঢেউগুলা নেচে উঠিতেছে। নিকটবর্তী ঝোপের পাখীসকল নানা রবে ডাকিতেছে। বালীর বেণীবাবু দেওনাগাজীর ঘাটে বসিয়া এদিক্ ওদিক্ দেখিতে দেখিতে কেদারা রাগিণীতে “শিখেহো” খেয়াল গাইতেছেন। গানেতে মগ্ন হইয়াছেন, মধ্যে মধ্যে তালও দিতেছেন। ইতিমধ্যে পেছন দিক্ থেকে “বেণী ভায়া, বেণী ভায়া, ও শিখেহো” বলিয়া একটা শব্দ হইতে লাগিল। বেণীবাবু ফিরিয়া দেখেন যে বৌবাজারের বেচারামবাবু আসিয়া উপস্থিত। অমনি আস্তেব্যস্তে উঠিয়া সম্মানপূর্বক তাঁহাকে নিকটে আনিয়া বসাইলেন।

বেচারাম। বেণী ভায়া। তুমি আজ বাবুরামকে খুব ওয়াজিব কথা বলিয়াছ। তোমাদের গ্রামে নিমন্ত্রণে আসিয়াছিলাম —তোমার উপর আমি বড়ো তুষ্ট হইয়াছি —এজন্য ইচ্ছা হইল তোমার সঙ্গে একবার দেখা করে যাই।

বেণী। বেচারাম দাদা। আমরা নিজে দুঃখী প্রাণী লোক, মজুরী করে এনে দিনপাত করি। যেসব স্থানে জ্ঞানের অথবা ধর্মকথার চর্চা হয় সেই সব স্থানে যাই। বড়োমানুষ কুটুম্ব ও আলাপী অনেক আছে বটে কিন্তু তাহাদিগের নিকট চক্ষুলজ্জা অথবা দায়ে পড়ে কিংবা নিজ প্রয়োজনেই কখন কখন যাই, সাধ করে বড়ো যাই না, আর গেলেও মনের প্রীতি হয় না কারণ বড়োমানুষ বড়োমানুষকেই খাতির করে, আমরা গেলে হদ্দ বল্‌বে—”আজো বড়ো গরমি—কেমন কাজকর্ম ভালো হচ্ছে—অরে এক ছিলিম তামাক দে।” যদি একবার হেসে কথা কহিলেন তবে বাপের সঙ্গে বত্তে গেলাম। এক্ষণে টাকার যত মান তত মান বিদ্যারও নাই ধর্মেরও নাই। আর বড়োমানুষের খোসামোদ করাও বড় দায়। কথাই আছে “বড়োর পিরীতি বালির বাঁধ, ক্ষণে হাতে দড়ি ক্ষণেকে চাঁদ” কিন্তু লোকে বুঝে না —টাকার এমন কুহক যে লোকে লাথিও খাচ্ছে এবং নিকট গিয়া যে আজ্ঞাও করছে। সে যাহা হউক, বড়োমানুষের সঙ্গে থাকলে পরকাল রাখা ভার, আজকের যে ব্যাপারটি হইয়াছিল তাতে পরকালটি নিয়ে বিলক্ষণ টানাটানি !

বেচারাম। বাবুরামের রকম সকম দেখিয়া বোধ হয় যে তাহার গতিক ভালো নয়। আহা। কি মন্ত্রী পাইয়াছেন। এক বেটা নেড়ে তাহার নাম ঠকচাচা। সে বেটা জোয়াচোরের পাদশা। তার হাড়ে ভেল্‌কি হয়। বাঞ্ছারাম উকিলের বাটীর লোক ! তিনি বর্ণচোরা আঁব —ভিজে বেড়ালের মতো আস্তে আস্তে সলিয়া কলিয়া লওয়ান্। তাঁহার জাদুতে যিনি পড়েন তাঁহার দফা একেবারে রফা হয়, আর বক্রেশ্বর মাস্টারগিরি করেন —নীতি শিখান অথচ জল উঁচু নীচু বলনের শিরোমণি। দূঁর দূঁর ! যাহা হউক, তোমার এ ধর্মজ্ঞান কি ইংরাজী পড়িয়া হইয়াছে ?

বেণী। আমার এমন কি ধর্মজ্ঞান আছে? এরূপ আমাকে বলা কেবল অনুগ্রহ প্রকাশ করা। যৎকিঞ্চিৎ যাহা হিতাহিত বোধ হইয়াছে তাহা বদরগঞ্জের বরদাবাবুর প্রসাদাৎ। সেই মহাশয়ের সহিত অনেক দিন সহবাস করিয়াছিলাম। তিনি দয়া করিয়া কিঞ্চিৎ উপদেশ দিয়াছেন।

বেচারাম। বরদাবাবু কে ? তাহার বৃত্তান্ত বিস্তারিত করিয়া বলো দেখি। এমন কথা সকল শুনতে বড়ো ইচ্ছা হয়।

বেণী। বরদাবাবুর বাটী বঙ্গদেশে—পরগনে এটেকাগমারি। পিতার বিয়োগ হইলে কলিকাতায় আইসেন—অন্নবস্ত্রের ক্লেশ আত্যন্তিক ছিল —আজ খান এমতে যোত্র ছিল না। বাল্যাবস্থাবধি পরমার্থ প্রসঙ্গে সর্বদা রত থাকিতেন, এজন্য ক্লেশ পাইলেও ক্লেশ বোধ হইত না। একখানি সামান্য খোলার ঘরে বাস করিতেন—খুড়ার নিকট মাস মাস যে দুটি টাকা পাইতেন তাহাই কেবল ভরসা ছিল। দুই-একজন সৎলোকের সঙ্গে আলাপ ছিল —তদ্ভিন্ন কাহারও নিকট যাইতেন না, কাহার উপর কিছু ভার দিতেন না। দাসদাসী রাখিবার সঙ্গতি ছিল না—আপনার বাজার আপনি করিতেন—আপনার রান্না আপনি রাঁধিতেন, রাঁধিবার সময় পড়াশুনা অভ্যাস করিতেন, আর কি প্রাতে কি মধ্যাহ্নে কি রাত্রে একচিত্তে পরমেশ্বরকে ধ্যান করিতেন। স্কুলে ছেঁড়া ও মলিন বস্ত্রেই যাইতেন, বড়োমানুষের ছেলেরা পরিহাস ও ব্যঙ্গ করিত। তিনি শুনিতেন না ও সকলকে ভাই দাদা ইত্যাদি মিষ্ট বাক্যের দ্বারা ক্ষান্ত করিতেন। ইংরাজী পড়িলে অনেকের মনে মাৎসর্য হয় —তাহারা পৃথিবীকে সরাখান্ দেখে। বরদাবাবুর মনে মাৎসর্য কোনো প্রকারে করিতে পারিত না। তাঁহার স্বভাব অতি শান্ত ও নম্র ছিল, বিদ্যা শিখিয়া স্কুল ত্যাগ করিলেন। স্কুল ত্যাগ করিবারমাত্র স্কুলে একটি ৩০ টাকার কর্ম হইল। তাহাতে আপনি ও মা ও স্ত্রী ও খুড়ার পুত্রকে বাসায় আনিয়া রাখিলেন এবং তাঁহারা কিরূপে ভালো থাকিবেন তাহাতেই অতিশয় যত্ন করিতে লাগিলেন। বাসার নিকট অনেক গরীব-দুঃখী লোক ছিল তাহাদিগেকে সর্বদা তত্ত্ব করিতেন —আপনার সাধ্যক্রমে দান করিতেন ও কাহারো পীড়া হইলে আপনি গিয়া দেখিতেন এবং ঔষধাদি আনিয়া দিতেন। ঐ সকল লোকের ছেলেরা অর্থাভাবে স্কুলে পড়িতে পারিত না এজন্য প্রাতে তিনি আপনি তাহাদিগকে পড়াইতেন। খুড়ার কাল হইলে খুড়াতুতো ভায়ের ঘোরতর ব্যামোহ হয়, তাহার নিকট দিনরাত বসিয়া সেবা-শুশ্রূষা করাতে তিনি আরাম হন। বরদাবাবুর খুড়ীর প্রতি অসাধারণ ভক্তি ছিল, তাঁহাকে মায়ের মতো দেখিতেন। অনেকের পরমার্থ বিষয়ে শ্মশান বৈরাগ্য দেখা যায়। বন্ধু অথবা পরিবারের মধ্যে কাহারো বিয়োগ হইলে অথবা কেহ কোনো বিপদে পড়িলে জগৎ অসার ও পরমেশ্বরই সারাৎসার এই বোধ হয়। বরদাবাবুর মনে ঐ ভাব নিরন্তর আছে, তাঁহার সহিত আলাপ অথবা তাঁহার কর্ম দ্বারা তাহা জানা যায় কিন্তু তিনি একথা লইয়া অন্যের কাছে কখনই ভড়ং করেন না। তিনি চটুকে মানুষ নহেন —জাঁক ও চটকের জন্য কোনো কর্ম করেন না। সৎকর্ম যাহা করেন তাহা অতি গোপনে করিয়া থাকেন। অনেক লোকের উপকার করেন বটে কিন্তু যাহার উপকার করেন কেবল সেই ব্যক্তিই জানে, অন্য লোকে টের পাইলে অতিশয় কুণ্ঠিত হয়েন। তিনি নানা প্রকার বিদ্যা জানেন কিন্তু তাঁহার অভিমান কিছুমাত্র নাই। লোকে একটু শিখিয়া পুঁটি মাছের মতো ফর্ ফর্ করিয়া বেড়ায় ও মনে করে আমি বড়ো বুঝি —আমি যেমন লিখি এমন লিখিতে কেহ পারে না —আমার বিদ্যা যেমন, এমন বিদ্যা কাহারো নাই —আমি যাহা বলিব সেই কথাই কতা। বরদাবাবু অন্য প্রকার ব্যক্তি, তাঁহার বিদ্যাবুদ্ধি প্রগাঢ় তথাচ সামান্য লোকের কথাও অগ্রাহ্য করেন না এবং মতান্তরের কোন কথা শুনিলে কিছু মাত্র বিরক্তও হয়েন না বরং আহলাদপূর্বক শুনিয়া আপন মতের দোষগুণ পুনর্বার বিবেচনা করেন। ঐ মহাশয়ের নানা গুণ, সকল খুঁটিয়া বর্ণনা করা ভার —মোট এই বলা যাইতে পারে যে তাঁহার মতো নম্র ও ধর্মভীতু লোক কেহ কখন দেখে নাই —প্রাণ বিয়োগ হইলেও কখন অধর্মে তাঁহার মতি হয় না। এমতো লোকের সহবাসে যত সৎ উপদেশ পাওয়া যায় বহি পড়িলে তত হয় না।

বেচারাম। এমতো লোকের কথা শুনে কান জুড়ায়। রাত অনেক হইল, পারাপারের পথ, বাটী যাই। কাল যেন পুলিশে একবার দেখা হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *