৩. বিবাহ চুকে যাবার পর

বিবাহ চুকে যাবার পর অজয় আর লীলা মধুচন্দ্রিমা যাপন করতে কলকাতার বাইরে চলে গেল।

এসব তথ্য কাগজের পাতা থেকে ঘুঁটিয়ে ঘুঁটিয়ে সংগ্রহ করল মায়া। লোভীর মতই মনে মনে রোমন্থন করত সেগুলো। বিজাতীয় এক আনন্দ পেত যেন।

সেদিনও এমনি এক সংবাদের ওপর বসে বসে চোখ বুলাচ্ছিল, এই সময় ডাক এল সমরের ঘর থেকে।

দুহাতে মুখ চেপে বসেছিল সমর। মায়া কাছে এসে দাঁড়াতেই ক্লান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, এখনও কজন রোগী ক্লিনিকে আছেন, মিস দে?

আর একজন।

তাঁকে কোনরকমে বিদায় করতে পারেন?

রীতিমত বিস্মিত হল মায়া। তবে সেটা যথাসাধ্য গোপন করে জবাব দিল, তা হয়তো পারি। বাড়ি যাবার জন্যে তিনি অধীর হয়ে পড়েছেন

খাসা। তাহলে তাঁকে জেলখানা থেকে খালাস করে দিন। তিনিও হাসতে হাসতে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যান।

কিন্তু কিন্তু আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না!

সমর নিস্পৃহ গলায় জবাব দিল, দিন কয়েকের জন্যে ক্লিনিক বন্ধ রেখে একটু বেড়িয়ে আসব ভাবছি।

মায়া চমকে উঠল। অব্যক্ত কণ্ঠে বলল, বেড়িয়ে আসবেন? কোথায়? কতদিনের জন্যে?

কে বলতে পারে? হয়তো বিশ তিরিশ বছরের জন্যে। অবশ্য ততদিন যদি বেঁচে থাকি।

মায়া শিথিল দেহে বসে পড়ল অনতিদূরে।

সেটা লক্ষ্য করে সমর স্নানভাবে হাসল। বলল, আপনার সাময়িক একটু অসুবিধে হবে তা বুঝেছি। অবশ্য আমি তিন মাসের মাইনে আপনাকে দিয়ে যাব।

ঢোক গিলল মায়া। প্রায় অবরুদ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কবে যেতে চান?

কবে কি? আজই—ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই।

মায়া আঁৎকে উঠল, ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই! কিন্তু কোথায় যাবেন?

সে-প্রশ্নটা নিয়ে এখনও মাথা ঘামাইনি। আর তাতে লাভটাই বা কি? পকেট থেকে খানদুয়েক দশ টাকার নোট বার করে সমর টেবিলের উপর ছুঁড়ে দিল। বলল, এতে যদূর যাওয়া চলে।

মায়া বিস্ফারিত নয়নে শুধু তাকিয়ে রইল।

হঠাৎ যেন একটা কিছু মনে পড়েছে, এমনই ভঙ্গিতে সমর জিজ্ঞেস করল, আমাদের টাইম টেবল আছে না? দয়া করে যদি একবার এনে দেন।

মায়া নিঃশব্দে উঠে পাশের ঘরে চলে গেল এবং একটু পরেই ফিরে এল একখানা ব্র্যাডশ হাতে।

মায়া ভারী বইখানা তার সামনে ধরে দিতে যেতেই সমর তাকে ইঙ্গিত করল খুলে দেখতে। বলল, শুধু দেখবেন কুড়ি টাকার মধ্যেই যেন ভাড়াটা হয়। আর—আর কোন অখ্যাত অজ্ঞাত স্টেশন হলে তো কথাই নেই—সোনায় সোহাগা

মায়া পাতার পর পাতা উল্টে চলল। একসময় মুখ তুলে বলল, একটা পেয়েছি, মনে হচ্ছে-গিরমহল—ভাড়া উনিশ টাকা সত্তর পয়সা

খাসা। সমর রীতিমতো উৎসাহিত হয়ে উঠল, গিরমহল নামটা কখনো শুনিনি। আপনি শুনেছেন নাকি?

না।

রীতিমত রোমাঞ্চ হচ্ছে। অজ্ঞাতবাসের উপযুক্ত জায়গা।

সে উত্তেজিতভাবে উঠে দাঁড়াল। পায়চারি করতে করতে কতকটা আত্মগতভাবেই বলে চলল, হয়তো সেখানে বড়জোর দশ-বিশটা কুঁড়ে ঘর…পোস্ট অফিস থাকতেও পারে, না-ও পারে…হপ্তায় একদিন হাট…মাইল দুতিন দূরে হলেই বা ক্ষতি কি?…খালি পায়ে শক্ত সমর্থ গ্রামের মেয়েরা শাকসজী মাথায় নিয়ে বেচতে আসে। তাদেরই একজনকে এনে বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করব…সন্তান সন্ততিতে ঘর ভরে উঠবে…তারা ভালবাসবে আমায়, শ্রদ্ধা করবে আমায়…তা যদি না করে ঠেঙিয়ে পাট করব সবাইকে

হঠাৎ মায়ার ওপর দৃষ্টিটা পড়তেই সে থেমে গেল। সঙ্কোচের হাসি হেসে বলল, আমার ভাবী জীবনের ছবি আঁকিনি, মিস দে; লেখক হবার উপক্রমণিকা। আমি একটু বেরোচ্ছি। বাড়িওলার সঙ্গে রাফসাফ করে আসি। বড়জোর ঘণ্টাখানেক লাগবে। আপনি ইত্যবসরে দুটো ব্যাগে আমার জিনিসপত্রগুলো ভরে রাখুন দয়া করে। শল্য-চিকিৎসার হাতিয়ারগুলো দিতে ভুলবেন না।

কথাশেষে ঝড়ের মতই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মায়ার মুখে কোন ভাবান্তর ঘটল না।

সত্যিই ঘণ্টাখানেক বাদে সমর ফিরে এল এবং ভেতরে পা দিয়েই একেবারে আঁৎকে উঠল। সারা মেঝে জুড়ে অসংখ্য ট্রাঙ্ক, হোন্ড-অল, ব্যাগ ইত্যাদি ছড়ানো; আর ভারী একটা সুটকেসের ওপর মায়া পা ছড়িয়ে বসে। মুখ তার তেমনি ভাবলেশহীন।

এসব কি?

মায়া উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে মৃদুকণ্ঠে জবাব দিল, আমিও যাচ্ছি তো।

যাচ্ছেন? কোথায়?

গিরমহলে।

মুহূর্তের জন্যে সমর হতবাক হয়ে গেল। কথাটা সে বিশ্বাসই করতে পারছিল না। পরক্ষণে সে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, কি বলছেন পাগলের মত? যেখানে যাব, আপনাকে ছায়ার মতই সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে হবে নাকি?

একা থাকার বিভীষিকা বোধ করি মায়ার মন থেকে সব সঙ্কোচ শঙ্কা দূর করে দিয়েছিল। মৃদু অথচ সুদৃঢ় কণ্ঠেই সে বলল, আমি যাবই।

না। আমি একা যেতে চাই।

আপনি একাই থাকবেন। আমি কোন সময়ে কোন কারণে আপনার সামনে এসে বিরক্ত করব।

কেন বুঝছেন না? আমি কোথা থেকে আপনাকে মাইনে দেব?

মাইনে তো আমি চাইছি না।

দেরি হয়ে যাচ্ছে। একটু পরেই রওনা হতে হয়। সমর মরীয়া হয়ে তাকে বোঝাবার চেষ্টা করল, কেন বুঝছেন না, মিস দে, আমি কোথায় থাকব, কি করব জানি না। অপরিচিত জায়গা-চোর-ডাকাত, বাঘ-ভাল্লুক থাকাও বিচিত্র নয়। তাছাড়া—তাছাড়া আমি যে যুধিষ্ঠির সেজেই থাকব

মায়ার চোখে ততক্ষণে জল ঘনিয়ে এসেছে। বাধা দিয়ে সে বলল, কেন মিথ্যে আমায় বারণ করছেন? আমি যাবই। আমি বোকা-সোকা মেয়ে, কার ভরসায় এখানে একলা থাকব। সবাই advantage নেবে।

চেষ্টা যে মিথ্যা সেটা মর্মে মর্মে বুঝল সমর। হতাশার ভঙ্গিতে বলল, ঠিক আছে। মেয়েরা জেদ ধরলে কে কবে তাদের নিরস্ত করতে পেরেছে?

মায়া খুশি হয়ে উঠল। চট করে চোখের জল মুছে বলল, আর আধঘণ্টা মাত্তর সময়। আমি ফোনে দুখানা ট্যাক্সি বলে দিয়েছি। খাওয়ার কোন হাঙ্গামা করে কাজ নেই। ট্রেনেই ডাইনিংকার আছে। আর ভোরের দিকে তো আমরা পৌঁছেই যাচ্ছি।

সুনিপুণ ব্যবস্থা! সমর হাসবে না কাঁদবে, ভেবে না পেয়ে ভারী ভারী ব্যাগ দুটো তুলে নিল। মনে মনে বলল তুমি বোকা-সোকা মেয়ে। হুঁ।

.

ভোরের দিকে ট্রেন গিরমহলে গিয়ে থামল।

পাহাড়ের সানুদেশে ছোট্ট স্টেশন। কুলির বালাই নেই। না বা আছে যাত্রীর। শুধু একজন শীর্ণকায় প্রৌঢ়কে পোস্টাল ভ্যান থেকে গোটা দুয়েক ব্যাগ নামাতে দেখা গেল। কে জানে, লোকটি হয়তো একাধারে পিয়ন এবং পোস্টমাস্টার দুই-ই।

বড় জোর মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে ট্রেনখানা আবার গন্তব্যস্থানের উদ্দেশে পাড়ি জমাল। শুন্য প্ল্যাটফর্মে মালপত্রের মাঝখানে বসে রইল সমর আর মায়া।

লোকালয় বলতে স্টেশনের কয়েকশ গজ পেছনে গোটাদুয়েক কুটিরকে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। সেখান থেকে আধমাইল-টাক দূরে ত্রিভুজাকৃতি একটা পাহাড়ের চুড়োয় যে বড় বাড়িখানা রোদের মুকুট মাথায় পরে দাঁড়িয়ে আছে, প্রথম দর্শনে সেটাকে দুর্গ বলেই মনে হয়।

ব্যাগ হাতে পোস্টমাস্টারকে এদিকেই আসতে দেখে সমর উঠে দাঁড়াল। নমস্কার করে সে জিজ্ঞেস করল, এখানে কোন কুলি পাওয়া যাবে না?

কুলি! ভদ্রলোক হা-হা করে হেসে উঠলেন। চোখ মিটিমিট করতে করতে বললেন, কুলি বলতে আমিই।

আপনি কি এখানেই থাকেন?

হ্যাঁ, না থেকে আর যাব কোথায়? অধীনের নাম পাণ্ডে–রামস্বরূপ পাণ্ডে। পোস্টারমাস্টার অ্যান্ড মার্চেন্ট। ছোটখাট একটা বিশ্বকর্মা ভাণ্ডার আছে।

ভদ্রলোক একটু বেশি কথা বলেন। তা বলুন, সমরের তাতে সুবিধেই হল। সাগ্রহে সে জিজ্ঞেস করল, আমরা এখানে কিছুদিন থাকব ভাবছি। সুবিধেমত কোন বাড়ি-টাড়ি পাওয়া যাবে কি?

এমন একটা বিচিত্র প্রস্তাব নিয়ে কেউ কোনদিন আসেনি। চোখ দুটো যতটুকু সম্ভব বিস্ফারিত করে তিনি জবাব দিলেন, অজ্ঞাতবাসে এসেছেন? তা কতদিনের জন্যে?

সমর একটু নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে উঠল, চিরকাল। যতদিন না মৃত্যু তার হিমশীতল বাহুবন্ধনে বেঁধে নিয়ে যায়।

কিছুক্ষণ নির্বোধের মতই পাণ্ডে তার মুখের তাকিয়ে রইলেন। বারকয়েক ঢোক গিললেন, তারপর মায়াকে চোখের ইশারায় দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মহাশয়ের গৃহিণী?

মায়ার মুখখানা রাঙা হয়ে উঠল; সমর কিন্তু স্নিগ্ধ হাসি হেসে বলল, না, আমার সেবিকা, মানে নার্স। আমি ডাক্তার।

পাণ্ডের চোখ দুটোয় একটা আলো চকচক করে উঠল।

আচ্ছা, আপনাদের এখানে কোন ডাক্তার আছেন?

জী হাঁ! সাতমাইল দূরের এক গাঁয়ে। কালব্যাধি ধরলে তাঁকে ডাকতেই হয়।

হাসি চেপে সমর বলে, কালব্যাধি যদি ধরে, তখন আর ডাকা-না-ডাকা তো সমানই।

মায়া ইত্যবসরে একটা স্যুটকেসের ওপর বসে পড়েছিল শিথিল দেহে। নেই, এ পোড়া দেশে আশা করার মত কিছুই নেই। তার অবস্থা দেখে সমর হেসে উঠল। পাণ্ডেকে বলল, দেখেছেন তো, সাধে আর বলে পথি নারী বিবর্জিতা! ওই বাড়িটার তাহলে কি হবে? পাওয়া যাবে?

পাণ্ডে মাথা চুলকোলেন, বহুক্ষণ ধরে কি যেন ভাবলেন, তারপর জবাব দিলেন, গিরমহলের কথা বলছেন? ওই পাহাড়ের চূড়ায় যেটা? আজ্ঞে এক বুড়ো সরকার ছাড়া আর তো কেউ ওখানে থাকে না।

ভাড়া পাওয়া যাবে না বোধ হয়?

জানি না স্যার। কোনদিন তো কাউকে এসে থাকতে দেখিনি! আর এসে কে-ই বা থাকবে বলুন? আশপাশে গাঁও নেই, তা ছাড়া বাড়িতে যাবার ওই পাথুরে পাকদণ্ডী পথ।

এবার সমর যেন সত্যিই খানিকটা হতাশ হয়ে পড়ল। এখানে এসেছে এক অন্ধ আবেগে, যুক্তি দিয়ে যার কোন ব্যাখ্যা করা চলে না। শেষ পর্যন্ত সত্যিই কি হার মেনে ফিরে যেতে হবে? একরকম মরীয়া হয়েই জিজ্ঞেস করল সে, আর কোন বাড়ি যেখানে আমরা গিয়ে কোন রকমে মাথা গুঁজতে পারি?

পাণ্ডেও চিন্তাকুল হয়ে উঠলেন। কতক্ষণ গুম হয়ে থেকে বিড়বিড় করে বললেন, কই, সেরকম তো কিছু—দাঁড়ান, দাঁড়ান—হপ্তা দুই আগে বুড়ো মিশির মারা গেছে—তার বাড়িটা হয়তো খালি হলেও হতে পারে।

চমকে উঠল মায়া। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কিসে মারা গেছেন ভদ্রলোক?

বয়েসের মৃত্যু মা! একশো তিন বছর সাত মাস যার উমার হল, তার কি কোন বেমারীর দরকার হয় মা?

সমর হেসে ফেলে বলল, সর্বনাশ! এই আজব দেশে লোকের গড়পড়তা পরমায়ু যদি একশো বছর হয়, তাহলেই তো আমায় ডেরা-ডেন্ডা তুলে পালাতে হবে। পরক্ষণে গম্ভীর হয়ে বলল, দয়া করে একটু খবর নেবেন, আপনার মিশির ঠাকুরের বাড়িটা পাওয়া যাবে কি না?

তা হয়তো যাবে স্যার। তবে এক বাত বলছি কি, আমার মত আপনাদের দুজনেরও দেখছি বহুত ভুখ লেগেছে। দয়া করে আমার গরীবখানায় চলুন। কিছু খানাপিনা করে নিন দুজনে।

অতি উত্তম প্রস্তাব! মিস দের কোন আপত্তি নেই তো?

মায়া উঠে দাঁড়াল। কোন কথা না বলে ইঙ্গিতে জানাল, তার কোন আপত্তি নেই।

খুশি হলেন পাণ্ডে। একগাল হেসে বললেন, আপনাদের সামান সব এখানেই পড়ে থাক। কিছু ভাবনা করবেন না। গিরমহলে চোর-ডাকু নেই। পরে ছোকরাদের পাঠিয়ে দেব নিয়ে যেতে।

অতঃপর সমর আর মায়া মৃত মিশিরের বাড়িতেই অধিষ্ঠিত হল। যেটা তারা আশঙ্কা করেছিল, বাড়িখানা তার চেয়ে কিন্তু অনেক ভাল। চারখানা মাঝারি আকারের ঘর, আলো-হাওয়া প্রচুর; চারদিকে কামিনী গাছের বেড়া দিয়ে ঘেরা।

মায়া ব্যবস্থার ভারটা নিজের হাতেই তুলে নিল। সামনে বড় ঘরখানা ডাক্তারের রোগী দেখার। দুপাশেই দুখানা ছোট ঘর—দুজনের শোবার। আর পেছনের খানা যৌথ খাবার এবং বসবার ঘর। সুবিধার মধ্যে দুপাশের শোবার ঘর থেকেই মাঝখানের দুখানা ঘরে যাতায়াত করা যায়।

সমর তাকিয়ে মায়ার গৃহকর্ম দেখছিল। একসময় গভীর স্বরে বলল, মিস দে, যদি কিছু মনে না করেন, একটা ব্যবসাদারী কথা বলি। বাড়ি ভাড়া, খাওয়া-দাওয়ার খরচ সব আমার। কিন্তু নিজের জীবিকা আপনাকে নিজেই অর্জন করতে হবে। সেটা রান্নাবান্না এবং পরিবেশন করে। রোজগারের বেলায় কোন প্রতিযোগিতা চলবে না কিন্তু। কোন প্রসব করানোর কেস এলে আপনি আপনার পারিশ্রমিক পাবেন, অন্য রোগের বেলায় কিন্তু ভিজিট যা কিছু—তা চালকলাই হোক, আর নগদ দক্ষিণাই হোক, আমার নিজস্ব। রাজী?

হাতের ঝাঁটাটা আবার তুলে নিয়ে রেখাহীন মুখে মায়া জবাব দিল, রাজী, ডাক্তার রায়।

.

কে জানত নাম লেখা বোর্ডখানা বাড়ির সামনে টাঙানো রীতিমত একটা অনুষ্ঠানে পরিণত হবে! গিরমহল থেকে তো বটেই, আশপাশের আরো পাঁচ-সাতখানা গ্রাম থেকে সমস্ত লোক ঝেটিয়ে এল দেখতে। পোস্টমাস্টার পাণ্ডে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর নিজস্ব ভাষায় এক দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন : ভাইলোগ! আর মরবার ভয় নেই। সবকোই এখন থেকে মিশির ঠাকুরের মত একশো বরষ জিন্দা থাকবে। কেঁউ কি কোলকাত্তা থেকে ভারি ডাংদার সাব আমাদের মধ্যে আসিয়ে গেলেন। যো কুছ বেমারী হবে, ডাংদার সাবকে দেখলেই ভাগবে

ঘন ঘন হাততালি পড়তেও ত্রুটি হল না।

দিন কেটে চলল। ডাক প্রায় নেই বললেই চলে। তবে ভাগ্যবলে জিনিসপত্রের দাম অবিশ্বাস্য রকমের সস্তা। শুন্য ঘরে বসে সমর মনে মনে হিসেব করে, এই হারে চললে, পুঁজি যা সঙ্গে এনেছে, তাতে পুরো বছর চলে যাবে। তার ওপর গাঁয়ের লোকের স্নেহের দান তো আছেই। সে-দান মহার্ঘ কিছু নয়, শাকসজী, কিছু ফল বা ডিম। প্রথম প্রথম সমর দাম দিতে চেয়েছিল, তাতে মনক্ষুণ্ণই হয়েছিল তারা। ডাক্তারবাবুদের তারা মনে করে এ-গাঁয়ের মান্য অতিথি। অতিথি সৎকারের কতটুকু কি-ই বা তারা করতে পেরেছে!

কৃতজ্ঞতায় সমরের মন ভরে ওঠে। ভরা মন আবার উপচে পড়তে চায় যখন সে বোঝে তার বেকারত্ব ঘুচোতে লোকগুলো মিথ্যে রোগের ছলনায় নিজেদের বা তাদের ছেলেমেয়েদের তার সামনে এনে হাজির করে। গিরমহল থেকে চার মাইল দূরে প্রতি সোমবার যে হাট বসে, সেখানে তারা তাদের ডাংদার সাবের এমন উচ্ছ্বসিত ভাষায় প্রচারকার্য চালায়, যার দুচারটে কথা কানে এলেও লজ্জায় সমরকে ছুটে পালাতে হত।

মায়া কিন্তু এখানে এসে সত্যিকার সুখী হয়েছে। সমরের কাছে যেটুকু সঙ্কোচ তার ছিল, ধীরে ধীরে তা যেন কেটে যাচ্ছিল। এখন সে তার সামনে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে হাসে, সময় বিশেষে পরিহাস করতেও ছাড়ে না। নতুন বান্ধবী জুটিয়েছে সে পাণ্ডের স্ত্রীকে। প্রায়ই তার বাড়িতে যায়, গল্প-গুজব করে, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ছুটোছুটি করে বেড়ায়।

সমর কিছু দেখে, কিছু বা শোনে। মনে মনে মায়াকে ঈর্ষাও হয়তো করে। তবু সে তার মত সহজ স্বাভাবিক কোন রকমেই হয়ে উঠতে পারে না। অধিকাংশ সময় আত্মমগ্ন হয়েই থাকে সে। বেড়াতে বেরোয়ও একা। মাইলের পর মাইল পাহাড়ী পথে যখন হাঁটে, তার মুখে দেখে মনে হয়, বিষণ্ণতার শিকারী পাখিটা প্রশস্ত দুই ডানা মেলে তার অন্তরের আকাশ ঢেকে রেখেছে। মায়ার সঙ্গে কোথাও তার কোন বিরোধ নেই, তবু ঘনিষ্ঠও সে হতে পারেনি। অবশ্য সে চেষ্টাও করেনি। কেন, সে-জবাব হয়তো সে নিজেও দিতে পারত না। প্রথম দিকে অস্বস্তি ছিল, তাদের দুজনকে এক বাড়িতে থাকতে দেখে গাঁয়ের লোক হয়তো অনেক কিছু ভেবে নিতে পারে। কিন্তু না, সাদাসিধে লোকগুলো মিথ্যা কুৎসা রটানোর অনেক ঊর্ধ্বে। তবু

পেছন দিকের খাবার ঘর থেকে পাহাড়ের চুড়োয় গিরমহল বাড়িখানা বেশ পরিষ্কারই দেখা যায়। হাতে কাজ না থাকলে সমর অনেক সময় সেদিকে তাকিয়ে থাকে। রাতের অন্ধকারে বাড়িখানাকে মনে হয় যেন অতিকায় দৈত্য। অভ্রংলেহি তার লিপ্সা। চিৎ কখনও সে অন্ধকার স্কুপে আলোক বিন্দু ফুটে ওঠে, ইতস্তত ঘুরে বেড়াতেও দেখা যায়। হয়তো বাড়ির তদারককারী সরকার আলো হাতে ঘোরাফেরা করে। কিন্তু সমরের বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয় না।

পাশে থাকলে মায়া আঁৎকে উঠে বলে, বাড়িটার দিকে চোখ পড়লেই আমার গা ছমছম করে। কত যুগের কত রহস্য যেন জমা আছে ওখানে। কে জানে, হয়তো বীভৎস ইতিহাসও একটা আছে!

সমরের নিজেরও সেটা মনে হয়। তবু মায়াকে আরো খানিকটা ভয় পাইয়ে দেবার জন্যে গড়গড় করে বলে যায় গিরমহলের এক কাল্পনিক ইতিহাস। বলে, একবার সে একা ওই বাড়িখানায় ওঠবার। চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পাকদণ্ডী পথ বেয়ে ওঠবার মুখে কে যেন বার বার তাকে নির্মমভাবে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দিয়েছিল। দয়া করে প্রাণে যে মারেনি, এইটুকুই ভাগ্য।

দীর্ঘ ন মাস এইভাবে কেটে গেল। তাদের নিস্তরঙ্গ জীবনস্রোতে না দেখা দিল কোন অশান্তির আবর্ত, না বা প্রেমের উত্তাল তরঙ্গ। উত্তরমুখী ভাগীরথীর মত একটানা শুধু বয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *