১. দুই বন্ধু—অজয় আর সমর

দুই বন্ধু—অজয় আর সমর। যারা দেখে, তারাই বলে, আহা, যেন এক বৃন্তে দুটি ফুল, উপমাটা নিতান্ত সাবেকী। অজয় আর সমর হাসে। কৃপার হাসি। বন্ধুত্বটা তাদের হাওয়ার দোলায় দুলে শুধু বাগানের শোভা বর্ধনই করে না; শেকড় তার মাটির অনেক গভীরে। ক্লাস ফাইভে একদিন তারা পড়ল: উৎসবে ব্যসনে চৈব দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্র বিপ্লবে। রাজদ্বারে শ্মশানে চ যঃ তিষ্ঠতি স বান্ধবঃ ॥

পেছনের বেঞ্চে বসে এখনই সমর পকেট থেকে পেন্সিল কাটা ছুরিখানা বার করল। পেন্সিল কাটা করেই কাটল বাঁ-হাতের তর্জনী। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। শিউরে উঠল অজয়। সমরের মুখে কিন্তু অমলিন হাসি। ধীর কণ্ঠে বলল, চাণক্য পণ্ডিত বাজেবাজেই লেখেননি রে। রক্ত ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর, উৎসবে, ব্যসনে, শ্মশানে, রাজদ্বারে—যেখানেই হোক, আমরা কেউ কাউকে ফেলে পালাব না। একজন আর একজনের পাশে এসে দাঁড়াব।

প্রতিজ্ঞা করল অজয়। মনে বিচিত্র এক উত্তেজনা, রক্তে উন্মাদনার ঢেউ। সেদিন অলক্ষ্যে বসে বিধাতা বোধ করি হাসলেন।

স্কুলের গণ্ডী একসঙ্গেই পেরোল তারা। ভর্তি হল একই কলেজে। অবশ্য অজয় নিল কমার্স। তার বাপ রমেন সেনের বিরাট সওদাগরী অফিস। ফলাও ব্যবসা। ভবিষ্যতে অজয়কে বাপের শূন্য সিংহাসনে বসতে হবে। আর সমর গিয়ে ভর্তি হল সায়েন্স ক্লাসে। ডাক্তার হতে হবে তাকে। আগ্রহ তার নিজের যতখানি, তার চেয়ে অনেক বেশি তার অভিভাবকদের।

যে ধারা এতকাল ছিল একমুখী, তাই হল দ্বিমুখী। চাণক্য পণ্ডিত বন্ধুর যাচাইয়ের যে কষ্টিপাথর রেখে গেছেন, তাতে যেন প্রথম চিড় দেখা দিল।

দিল উৎসবে, ব্যসনে। অজয় সান্ধ্য ক্লাসে পড়ে। সমরের ক্লাস সকালে। তাই ছুটিছাটা বা রবিবার ছাড়া দেখা-সাক্ষাৎ তাদের বিরল হয়ে উঠল। অজয়দের বাড়ির অত বড় বার্ষিক উৎসবে সমর যেতেই পারল না। সন্ধ্যায় নিত্য সাউথ ক্লাবে গিয়ে টেনিস খেলাও অজয়কে বন্ধ করে দিতে হল।

হোক, তবু এমনি ভাবে হোঁচট খেতে খেতে তার ছাত্রজীবন পার হল।

এর পর সংসার জীবনে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে পাথরের বুকে দেখা দেওয়া চিড়টা আরও অনেকখানি বেড়ে গেল।

পাস করার সঙ্গে সঙ্গেই অজয়ের বাপ ছেলেকে অফিসে নিয়ে গিয়ে বসালেন। একা বোধ করি সব দিক আর সামলাতে পারছিলেন না তিনি। মৃদু আপত্তি জানিয়েছিল অজয়, আর কটা দিন যাক বাবা। সমর ডাক্তারীটা পাস করে বেরুক…

থামিয়ে দিয়েছিলেন রমেন সেন। চোখের চশমাটা নামিয়ে রেখে কতক্ষণ ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছিলেন; বলেছিলেন, আজকের দিনে বন্ধুত্ব নিয়ে কেউ জাহির করে না। আসলে ওটা একজাতীয় আত্মসচেতনতা। দায়িত্ব এড়ানোর মনোবৃত্তিও বলতে পারো।

এর পর অজয় আর একটি কথাও বলেনি। পরদিন থেকেই গলায় টাই এঁটে, সাড়ে নটার সময় অফিসে হাজিরা দিতে শুরু করল।

তবু অবসর পেলেই সে ছুটে আসত সমরের হোস্টেলে। তার ঘরে ঢুকে খোলা বইপত্রগুলো গুটিয়ে দিত। হুকুম করত, চা আনা, খাবার আনা। আলোটি নিভিয়ে দে। তারপরই এখানে তক্তপোশটার ওপর সবসুদ্ধ গড়িয়ে পড়ে বলত, ডি.ই আর ডি.টি-তে কোন তফাৎ নেই রে। জীবনে দুটোই মারাত্মক ব্যাধি।

সমর কথা বরাবরই কম বলে। আত্মবিশ্বাসটা বেশি বলেই সব রকমের হৈচৈ এড়িয়ে চলে। খাবার সে সেদিনও আনাল, প্রচুর পরিমাণেই আনাল। নিজের হাতে চা তৈরি করে বন্ধুকে দিল; কিন্তু আলো নেভাল না। মৃদু কণ্ঠে বলল, ভুলে যাসনি, সামনে আমার এগজামিন।

ধড়মড় করে উঠে বসল অজয়। চা আর খাবারের সদগতি করতে করতে কৃত্রিম কোপ প্রকাশ করে বলল, নদীর একপাড় ভাঙে, আর একপাড় জাগে, জানিস তো। তোর জন্যেই হয়তো এর পর বিয়ে করে বসব।

সমরের ঠোঁটের কোণে শুধু একটু হাসি দেখা গেল। কোন কথা বলল না। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অজয় শাসনের সুরে বলল, তোর এই introvert স্বভাবটা ছাড়, সমর, নইলে রোগীর গায়ে যে ছুরি বসিয়ে হাত পাকাচ্ছিস, সেই ছুরিই একদিন নিজের বুকেই বসাবি।

মচমচ করে জুতোর শব্দ তুলে বেরিয়ে গেল সে।

হেসে সমর গুটানো বইটা আবার তুলে নিল। এমন অভিযোগ অজয় বহুবার করেছে, কিন্তু সে জানে, হাওয়ার মুখে পাল তুলে দিলে, জীবনতরী তার ঠিক ঘাটটিতে কোনদিনই ভিড়বে না। প্রতিটি মুহূর্তে তাকে শক্ত হাতে দাঁড় টানতে হবে। প্রতিকূল স্রোতের বিরুদ্ধে তিলে তিলে এগোতে হবে। অতি বড় প্রয়োজনের মুহূর্তেও কেউ গুণ টেনে কূলে ভেড়াবে না।

অবশেষে একদিন সে ডাক্তার হয়ে বেরোল। শল্য চিকিৎসক। অস্ত্রোপচার করত সে সাবলীল ভঙ্গিতে, অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে। যেটুকু সুনাম সে পেয়েছিল, সেইটুকু মূলধন নিয়েই শহরের প্রাণচঞ্চল পাড়ায় এক চেম্বার খুলে বসল। দরজার পাশেই নেমপ্লেট আটল, সমর রায়, সার্জেন।

মেধাবী ছাত্র ছিল সে। বছরের পর বছর পরীক্ষার ফল যত ভাল হয়েছে, আত্মবিশ্বাসও গেছে সেই অনুপাতে বেড়ে। রোগীর আশায় নিয়মমাফিক চেম্বারে বসে থাকতে থাকতে কোনদিন সে হতাশায় ভেঙে পড়েনি।

হাত ধরে পশারের তোরণদ্বারে পৌঁছে দেবে, এমন কোন শুভানুধ্যায়ী তার ছিল না। ভিড়ের মাঝে হারিয়েও গেল না সে।

না-যাবার সব কৃতিত্বটুকু তার নিজেরই। চিকিৎসাটাকে সে একান্ত পেশাদার বৃত্তি করে তোলেনি। রোগীর পকেটের দিকে না তাকিয়ে, রোগের জড় ধরেই টান দিত সে। কথা বলত কম, ব্যবহারে থাকত প্রশান্ত হাসির বরাভয়।

তাই একবার যে রোগী আসত, সে দ্বিতীয়বার আসতে দ্বিধা তো কতই না; বরং আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধবকে ডাক্তার রায়কে দিয়ে দেখাতে সুপারিশ করত।

নিন্দার মত প্রশংসাটাও বুঝি দাবানলের মতই ছড়িয়ে পড়ে। নইলে সকাল সন্ধ্যায় সমরের চেম্বারে রোগীর ভিড় বাড়তেই বা থাকবে কেন? নিয়মানুবর্তিতার বাঁধন শিথিল হয়ে গেল। বিশ্রামের অবকাশ গেল কমে। সব দিন সময়মত সমরের খাওয়াও হয় না। রাতের ঘুম বিঘ্নিত হয় টেলিফোনের ঝন্‌ঝন্‌ আওয়াজে।

অজয়ের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎটাও বিরল হয়ে উঠল। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় বন্ধুত্বের স্রোতে এবার ভাটার টান ধরেছে।

অফিস থেকে অজয় মাঝে মাঝে টেলিফোন তুলে অনুযোগ করে, নালিশ জানায়; তারপর হঠাৎই একদিন রাত্রে ধূমকেতুর মত এসে হাজির হয় সমরের চেম্বারের। অভিমানের বাঁকা সুরে বলে, পর্বত তো গেল না, তাই মহম্মদকেই ছুটে আসতে হল।

অভ্যর্থনায় সমরের অকারণ উচ্ছ্বাস থাকে না। কিন্তু সেই মুহূর্তে পেশার জোয়ালটাকে নামিয়ে ফেলতে দেরি হয় না তার। সামনাসামনি গদিমোড়া চেয়ারে বসে তারা শুরু করে দেয় খোসগল্প। পেয়ালার পর পেয়ালা কফি আনে ভৃত্য রামলগন। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলে। খোসগল্প একসময় এসে দাঁড়ায় স্মৃতিচারণে। তারপর রাজনীতি থেকে সমাজনীতি, অর্থনীতি থেকে চিকিত্সা বিজ্ঞান নিজেদের অগোচরেই পরিক্রমা করে চলে তারা। মাঝে মাঝে তর্ক তাদের উদ্দম হয়ে ওঠে। বাড়ি ফেরার কথা মনে থাকে না অজয়ের। অবশেষে ভোরের আলো জানলার শার্সি দিয়ে দেখা গেলে সমর অকস্মাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আর নয়, বাড়ি যা অজয়। চান করে এবার আমায় চেম্বারে বসতে হবে। নটায় একটা অপারেশন।

অজয়ের হুঁশ হয়। রাত জাগার ক্লান্তিটা এতক্ষণে যেন সর্বাঙ্গ ব্যেপে ছড়িয়ে পড়ে। অবসন্ন দেহটা টানতে টানতে সে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে, আর তখনই দেখা যায় শুভ্রবসনা মায়াকে ওপরে উঠতে। মায়া মানে কুমারী মায়া দে। নার্স। সমরের ক্লিনিকে কাজ করে। আগে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছিল। সমরের সঙ্গে পরিচয়টা সেইখান থেকেই।

ডিউটি দিতে যেতে হত সমরকে। আরও অনেক ছাত্রই যেত; কিন্তু রোগীদের ওপর তার দরদ, রোগনির্ণয়ের ক্ষমতা, মিষ্টি মধুর ব্যবহার চুম্বকের মতই টানত মায়াকে।

সহকর্মিণীদের কাছে সেটা বেশিদিন গোপন থাকেনি। সুযোগ পেলেই তারা ঠাট্টা করত, বিদ্রূপ করত, শ্লেষের চাবুক চালাত। শেফালি নাগই ও ব্যাপারে বোধ করি সবচেয়ে নির্মম ছিল। একটা দিনের কথা মায়া কখনও ভুলতে পারবে না। রাতের ডিউটি ছিল মায়ার আর সমরের। সারাক্ষণের মধ্যে একটিবারও তারা একান্ত হয়নি, অকারণে বাক্যবিনিময়ও করেনি; শুধু বারদুয়েক সমরের চোখে কৃতজ্ঞ দৃষ্টি ফুটে উঠেছিল।

অনাস্বাদিত এক পুলকে ভরে উঠেছিল মায়ার সারা অন্তর। সেইটুকু সঞ্চয় নিয়েই সে ফিরেছিল হোস্টেলে।

সামনের দালানটায় তখন চায়ের কাপ নিয়ে মজলিশ চলছিল। শেফালি নাগ তাকে দেখে টেনে টেনে বলে উঠেছিল, আহা। মায়ার আমাদের ধর্মে পাপ সয় না। আমরা ভাই পাপী-তাপী মানুষ। মনের মানুষ পেলেই লেপটে থাকি। প্লেটনিক লাভের কি বুঝব, বল।

সব কজনের কণ্ঠে হাসির জলতরঙ্গ বেজেছিল। লজ্জা অপমানের হাত থেকে রেহাই পেতে মায়া তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে ঢুকে আত্মগোপন করেছিল।

আর একদিন ধরেছিল দীপা চৌধুরী। ডাক্তারির শেষ পরীক্ষা আসন্ন। পাস যে সমর করবে, ভালভাবেই করবে, তাতে কারোই সন্দেহ ছিল না। সেইটে উপলক্ষ্য করেই দীপা নিরীহের ভঙ্গিতে মায়াকে প্রশ্ন করেছিল, এবার কি করবি? ঘুঘুর বাসা তো পুড়তে চলল!

মায়া কোন জবাব দেবার আগেই শেফালি উচ্চকণ্ঠে বলে উঠেছিল, না ভাই মায়া, শেষ কটা দিন তুই এমনভাবে সমর রায়ের বুকে জুড়ে থাক, যাতে ও ফেল করে। তবু তো ছটা মাস বিরহের কান্না কাঁদতে হবে না।

মায়ার বুকটা ভয়ে কেঁপে উঠেছিল। ছুটে নিজের ঘরে এসে সে আকুলভাবে প্রার্থনা জানিয়েছিল, ভগবান, সমরবাবু যেন পাস করেন। সারা জীবন যদি আমার সঙ্গে দেখা না হয় সেও সইবে, কিন্তু

সমর অবশ্য পাস করল। ভালভাবেই করল। শীর্ষস্থানে নাম তার।

তারপর ঘনিয়ে এল বিদায় নেবার দিন। চেষ্টা করেও মায়া চোখের জল গোপন করতে পারল না। সমরের একখানা হাত চেপে ধরে ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, কিন্তু আমি এখন কি করব, ডাক্তার রায়। আপনি যতদিন কাছাকাছি ছিলেন, নিজেকে যে কতখানি নিরাপদ ভাবতুম, এর পর-এর পর হয়তো—নেকড়ের পাল—। গলাটা তার বাষ্পভারে বুজে এল।

সেদিন সমর শুধু সান্ত্বনাই দিতে পেরেছিল, নির্ভয় করতে পারেনি।

তারপর সে নিজের চেম্বার খুলল। দাঁড়াবার মত পায়ের তলায় একটু মাটি পেতেই সোজা মায়ার কাছে গিয়ে প্রস্তাব করল, আমার ক্লিনিকের একজন নার্স তো লাগবেই। যদি ইচ্ছে করেন, চলে আসতে পারেন। অবশ্য মাইনে এখন বেশি দিতে পারব না। কোন রকমে থাকা-খাওয়াটা চলে যাবে, এই আর কি।

এতখানি সৌভাগ্যের কথা মায়া বোধ করি কল্পনাও করতে পারেনি। কাঁপা গলায় বলল, মাইনের কথা বলে কেন আমায় লজ্জা দিচ্ছেন, ডাক্তার রায়? আপনার যা খুশি দেবেন। মোটে না দিলেও আমার আপত্তি নেই। হাতে যা আছে, তাতে কিছুদিন স্বচ্ছন্দে চলে যাবে। শুধু এই নরককুণ্ড থেকে আমার উদ্ধার করে নিয়ে চলুন।

.

পরদিনই মায়া হাসপাতালের চাকরিতে ইস্তফা দিল। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও সমরের মতই চেম্বারের এক কোণে তার নীড় রচনা করতে পারল না। শুধু যে সঙ্কোচে বাধল, তাই নয়; সমাজের চোখেও সেটা বিসদৃশ।

তবু কতটুকুই বা হোস্টেলে থাকত সে? সকালে এসে যখন হাজিরা দিত, তখনও শহরে প্রাণের সাড়া জাগত না। ফিরত একেবারে গভীর রাতে। কর্মচঞ্চল শহর তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। হাতে সব সময়ই কিছু ক্লিনিকের কাজ থাকত না; তবু বসে থাকত না মায়া। সমরের প্রত্যেকটি বই ঝেড়ে-মুছে আলমারিতে সাজিয়ে রাখত, ঘরের কোন কোণে এতটুকুও ঝুল আছে কিনা ঘুরে ফিরে নিরীক্ষণ করত; ফাঁক পেলে সমরের চাকরটাকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই ভালমন্দ রাঁধতে বসত।

মাঝে মাঝে হঠাৎ অসময়ে ফিরে আসায় সমরের নজরে সেগুলো পড়েছে। মৃদু তিরস্কারও করেছে মায়াকে, অব্যাপারেষুতে লাভ নেই, মিস দে। হাতে কাজ না থাকে, পড়াশুনোও তো করতে পারেন।

কোন জবাব দিত না মায়া। ধীরে ধীরে সরে যেত তার সামনে থেকে। ছটা মাস এমনিভাবেই পার হয়ে গেল। এই ছমাসের চেম্বারে রোগীর ভিড় বেড়েছে, সমরের বিশ্রামের অবকাশ কমেছে, সেই সঙ্গে তার দুই চোখে দেখা গেছে নতুন এক আলো।

হ্যাঁ, সমর ভালবেসেছে। ভালবেসেছে লীলা দত্তকে। তাদেরই পাড়ার এক প্রসিদ্ধ ব্যবহারজীবীর মেয়ে। বছর বাইশ বয়েস। শিক্ষিত, সুন্দরী, আধুনিক সমাজের মক্ষিরানী।

প্রথম দেখাটা দত্তবাড়িতেই। কল পেয়ে রোগী দেখতে গিয়েছিল সমর। রোগীর সম্বন্ধে যে-সব প্রশ্ন সে করেছিল, লীলাকেই তার জবাব দিতে হয়েছিল। অপূর্ব ভঙ্গি তার কথা বলার, ব্যবহার নিরহঙ্কার, মিষ্টিমধুর; তাই পেশার ডাক যেদিন শেষ হয়ে গেল, সেদিন নেশার হাতছানি সে উপেক্ষা করতে পারল না।

তরুণ সার্জেনকে লীলারও ভাল লেগেছিল। ভাল লেগেছিল তার সহজ সরল ব্যবহার, নির্ভীক মতামত, বলিষ্ঠ জীবন দর্শন। তাই অকুণ্ঠভাবে এগিয়ে এসেছিল। প্রথম প্রথম চায়ের নিমন্ত্রণ; তারপর বাড়িরই লনে টেনিস খেলায় যোগদানের অনুরোধ।

সমর সাগ্রহেই সাড়া দিয়েছিল। দত্তবাড়ির আসরে সে এখন প্রায় নিত্য অতিথি। তার চোখে নতুন আলো দেখে মায়া যেটা অনুমান করেছিল, সেটাই স্থির বিশ্বাসে পরিণত হল সমরকে সেদিন র‍্যাকেট হাতে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে। বিস্মিত হয়েছিল বৈকি মায়া; কিন্তু তার ধাক্কাটা এমনই আচমকা যে সে একটি কথাও বলতে পারেনি।

সমর বোধ করি সেটা লক্ষ্য করেছিল। হালকা সুরেই বলেছিল, ডাক্তারদেরও সময় সময় নিজের চিকিৎসার দরকার। দেহের না হলেও, মনের, কি বলেন?

মায়া নীরবে শুধু ঘাড় নেড়েছিল।

শুনুন, যদি কেউ আসে, বা আমাকে আপনার দরকার হয়, হয়তো হবে না, তবু একটা ফোন নম্বর লিখে নিন। আমায় রিং করে দেবেন।

লীলাদের বাড়ির ফোন নম্বর দিয়েছিল সে। আর খাতার পাতায় সেটা টুকে নিয়েছিল মায়া।

যেতে গিয়েও আবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল সমর। কৌতুকের সুরে প্রশ্ন করেছিল, আচ্ছা, নার্সের জীবন ছাড়া কি আপনার আলাদা জীবন নেই, মিস দে? নার্সের পোশাক ছাড়া আটপৌরে শাড়ির কথা বলছি।

বুকের ভেতর দুরদুর করে উঠেছিল মায়ার। এক ঝলক রক্ত দেখা দিয়েছিল দুই গালে।

নতুনতর কৌতুকে সমরের দুই চোখ নেচে উঠেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, আচ্ছা, কোনদিন কাউকে ভালবাসেননি?

ভীরু চোখ তুলে মায়া তাকাতে গিয়েও পারেনি। মুখ ফিরিয়ে কাঁপা গলায় জবাব দিয়েছিল, না ডাক্তার রায়।

তাহলে আর দেরি করবেন না। কাউকে হৃদয় দান করে ফেলুন। বুঝবেন কি অপূর্ব সে অভিজ্ঞতা! আচ্ছা, চলি আমি।

ভরা মনে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল সে, আর দুহাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল মায়া। সে জানে সমর কোথায় যাচ্ছে। টেলিফোনটা যে দত্তবাড়ির সেটাও তার অজানা নয়। আর দত্ত সাহেবের মেয়ে লীলা। তাকেও দেখেছে মায়া। দেখেছে সমরেরই চেম্বারে, দত্ত সাহেবের গাড়িতে বারদুয়েক। সত্যই সুন্দরী, সে শিক্ষিতাও নিশ্চয়।

উদ্গত নিশ্বাসটা গোপন করল মায়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *