১. বোম্বাই শহর বড়মানুষের শহর

অভিজাতক – উপন্যাস – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

বোম্বাই শহর বড়মানুষের শহর। সেখানে পথে পথে নয়তলা দশতলা বাড়ি উদ্ধতভাবে দাঁড়িয়ে আছে; মালাবার হিল-এর প্রাসাদগুলি উচ্চ আসনে বসে আপন আপন গৌরব-গরিমা ঘোষণা করছে; আবার তারই আশেপাশে চৌল আছে, যেখানে হীনজীবী মানুষ খোপের পায়রার মত একটি কুঠরি নিয়ে বাস করছে; অন্ধ গলির মধ্যে বস্তির অধিবাসীরা নিজেদের উলঙ্গ দীনতা লুকিয়ে রাখবার চেষ্টাও ছেড়ে দিয়েছে। প্রদীপের নীচেই অন্ধকার।

একটা স্যাঁতসেঁতে গলির মধ্যে ছোট একটি বাড়ি। দরজার দুপাশে সুরকি-খসা দেয়ালের জরাজীর্ণ নগ্নতা, রং-চটা দরজার কাঠের ওপর কাঁচা হাতে খড়ি দিয়ে লেখা লোকনাথ সিংহ।

এই বাড়ির একটি ঘরে কেঠো তক্তপোশ ছাড়া আসবাব বলতে আর কিছু নেই। বালিশে পিঠ রেখে লোকনাথ বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে খক খক করে কাশছে। তার স্ত্রী কুসুম পিছন দিক থেকে স্বামীর কাঁধে হাত দিয়ে এমনভাবে তাকে ধরে আছে যাতে সে কাশির বেগ সামলাতে পারে। লোকনাথের বয়স আন্দাজ ছত্রিশ, শরীর রোগ-জীর্ণ, সারা দেহে ক্লান্তির সুস্পষ্ট ছাপ।

কাশির বেগ একটু কমলে কুসুম স্বামীকে একগ্লাস জল এনে দিল, তার জল খাওয়া হলে আঁচল দিয়ে তার মুখ মুছিয়ে দিল। লোকনাথ শূন্য দৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে চেয়ে ক্ষীণস্বরে বলল–শুনেছি জলে ড়ুবে মরার আগে মানুষ অতীত জীবনের ঘটনা ছবির মত দেখতে পায়। আমিও যেন আজ ঠিক সেই রকম দেখতে পাচ্ছি

কুসুম ব্যাকুল স্বরে বলে উঠল–ওগো অমন করে বোল না, চুপ কর।

তার কথায় কান না দিয়ে লোকনাথ আপন মনেই বলে চলল—ওই ছবিটা দেখলেই একটি দিনের কথা মনে পড়ে, বাবার সঙ্গে সেদিন—

দেয়ালে একটি পুরানো ফটো— কম্পাউণ্ড-ঘেরা বড় বাড়ি, জমিদারের বাড়ি যেমন হয়, চারদিকে সুন্দর বাগান, বাগানের এক কোণে ফোয়ারা থেকে জল উৎসারিত হচ্ছে।

ফটোর দিকে চেয়ে লোকনাথ বলে চলেছে—ওই ফোয়ারা দেখছ, বাবার সঙ্গে সেদিন ওরই কাছে বসে দাবা খেলছিলাম। দাবা খেলায় বাবার কী ভীষণ নেশা ছিল—

স্মৃতির আলোয় দৃশ্যটি উজ্জীবিত হল। ফোয়ারার কাছে ছোট টেবিলের দুপাশে বসে পিতাপুত্রের দাবা-খেলা চলছে। দুজনেই খেলায় তন্ময়। বিশ বছরের যুবক লোকনাথ; একনাথের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, চুলে পাক ধরেছে, মুখ দেখেই বোঝা যায় গর্বিত কঠোর প্রকৃতির মানুষ, খেলার সময়েও তাঁর প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ব নরম হয় না। তিনি পরাজয়ে অভ্যস্ত নন।

কয়েকবার চাল দেবার পর লোকনাথ মুচকি হেসে দান দিল, সহজ সুরে বলল–কিস্তি। বাবা, আপনি মাৎ হয়ে গেলেন।

একনাথ ব্যগ্র বিস্ময়ে ছকের দিকে চেয়ে রইলেন। না, কোন সন্দেহ নেই, তিনি মাৎ হয়ে গেছেন। রাজার পালাবার রাস্তা নেই। তিনি বিড় বিড় করে বললেন—আরে তাই তো, এটা কি রকম হল। ছেলের দিকে ব্যর্থ চোখ তুলে তিনি হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলেন। ওহে ডাক্তার, এ কি কাণ্ড।

পারিবারিক চিকিৎসক ডাক্তার পাণ্ডে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন, একনাথের আহ্বানে কাছে এসে দাঁড়ালেন। ধীর শান্ত প্রকৃতির মানুষ, বুদ্ধিমান ও রসিক; বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ।

একনাথের গলায় গর্ব এবং নৈরাশ্য একসঙ্গে ফুটে উঠল–দ্যাখো ডাক্তার, কাণ্ডটা দ্যাখো। একটা কলেজের ছেলে কিনা আমায় মাৎ করে দিলে

লোকনাথ সসম্ভ্রমে উঠে নিজের চেয়ার ডাক্তারের দিকে এগিয়ে দিয়েছিল, তিনি হাসতে হাসতে লোকনাথের পিঠে চাপড় মেরে বললেন—বাবুজি, আমাদের যৌবন ফুরিয়ে এল, এখন আমাদের হারের পালা। বিজ্ঞান বলে—

আরে রেখে দাও তোমার বিজ্ঞান। এ হচ্ছে বংশের ধারা। ছাকড়া গাড়ির ঘোড়া কি রেসের বাজি জিততে পারে।

ডাক্তার পাণ্ডে চেয়ারে বসে তর্ক জুড়লেন— তা হয়তো পারে না, কিন্তু রেসের ঘোড়ার কুলুজি ঘাঁটলে দেখা যাবে গোড়ার কেউ না কেউ ছ্যাকড়া গাড়িই টানত।

একনাথ হুঙ্কার দিলেন—অসম্ভব। হতেই পারে না। রেসের ঘোড়ার বাচ্চাই রেসের ঘোড়া হয়। লোকনাথ, ঠিক কি না?

লোকনাথ ঘাড় হেঁট করে রইল। একনাথ তখন বললেন-তুমি আজ প্রমাণ করেছ বাঘের বাচ্চা বাঘ হয়। আমি খুশি হয়েছি। কি প্রাইজ চাই বল?

প্রাইজ! একটি প্রাইজের জন্যে তার মনে প্রবল লুব্ধতা ছিল, কিন্তু প্রবলপ্রতাপ বাপের সামনে সে কথা উচ্চারণ করার সাহস হয়নি। এখন প্রাইজের কথা শুনে তার মুখ অরুণাভ হয়ে উঠল, সে একবার বাপের দিকে একবার ডাক্তারের দিকে চাইতে চাইতে মনে সাহস সঞ্চয় করতে লাগল। শেষে দাবার ঘুঁটি নাড়াচাড়া করতে করতে জড়ানো গলায় বলল-প্রাইজ দেবেন? এঁ–

একনাথ সাহস দিয়ে বললেন–বল, লজ্জা কি। কী নেবে-আরবী ঘোড়া, না হাল ফ্যাশনের মোটরগাড়ি?

লোকনাথ আশান্বিত স্বরে বলল—যা চাইব তাই দেবেন?

একনাথ হাসলেন—যদি আমার সাধ্যে কুলোয়।

লোকনাথ তখন লজ্জা-গদগদ কণ্ঠে বলল—বাবা, একটি মেয়ে আছে, আমি তাকে বিয়ে করতে চাই।

নিমেষে একনাথের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল, তিনি ভ্রূকুটি করে লোকনাথের পানে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে কড়া সুরে বললেন-মেয়ে? কার মেয়ে?

এখন আর পিছনো যায় না, লোকনাথ যথাসম্ভব ধীরভাবে বলল–স্কুল-মাস্টারের মেয়ে, লখনৌতে বাড়ি। আমাদের বোডিংয়ের কাছে বাসা ছিল।

একনাথ অবিশ্বাসের সুরে বললেন-স্কুল-মাস্টারের মেয়েকে বিয়ে করতে চাও?

লোকনাথ বলল— তাতে দোষ কি? ভিন্ জাতের মেয়ে তো নয়, ওরাও রাজপুত।

ক্রুদ্ধ ব্যঙ্গের ভঙ্গিতে একনাথ বললেন–তাহলেই হল? দ্যাখো হে ডাক্তার, আজকালকার ছেলেরা দুপাতা ইংরিজি পড়ে কি শিখেছে।

একগুঁয়েমির বংশগত গরম লোকনাথের মাথায় চড়তে আরম্ভ করেছিল, ডাক্তারের দিকে চেয়ে সে বলল— ইংরিজি পড়ার সঙ্গে এর কি সম্বন্ধ দেখতে পাচ্ছি না।

একনাথের দৃষ্টি আরো কঠিন হয়ে উঠল–চোখ থাকলে তো দেখবে। শোনো, আগে বংশের প্রতি কর্তব্য, তারপর অন্য কথা। স্কুল-মাস্টারের মেয়েকে বিয়ে করা চলবে না, সমান ঘরে বিয়ে করতে হবে। আমার কাছে বংশমর্যাদাই প্রধান।

কিন্তু

একনাথ গর্জন করে উঠলেন–ব্যস্, অনেক শুনেছি, আর না। আমি এ বাড়ির মালিক, আমার কথা সবাইকে মেনে চলতে হবে। আমি যার সঙ্গে তোমার বিয়ে স্থির করব তাকেই বিয়ে করতে হবে। এই আমার শেষ কথা। হাতের এক ঝটকায় তিনি দাবার ঘুঁটিগুলো টেবিল থেকে নীচে ফেলে দিলেন, যেন এই ভাবেই উদ্যত বিদ্রোহকে ধূলিসাৎ করলেন।

লোকনাথ আর কোন কথা বলল না, কিন্তু তার মনের বিদ্রোহ মুখের ওপর প্রতিবিম্বিত হল। ডাক্তার পাণ্ডে এই পারিবারিক অগ্ন্যুদগারের সামনে পক্ষাহতের মত বসে রইলেন।

.

রোগপাণ্ডুর লোকনাথ ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে কুসুমকে কাছে টেনে নিল, আপন মনে বলে চলল— আমার মাথার তখন ঠিক ছিল না, শুধু জানতাম কুসুমকে না পেলে আমি বাঁচব না। কাউকে না জানিয়ে তাকে বিয়ে করে বাড়ি ফিরে এলাম—

.

বরবধু বেশে লোকনাথ ও কুসুম বাগানের রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে আসছে।

বাড়ির বারান্দায় একনাথ অগ্নিস্তম্ভের মত জ্বলছেন, মুহূর্তে একটা বিপর্যয় হতে পারে। চারিদিকে থমথমে ভাব। কিছু দূরে ডাক্তার পাণ্ডে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন।

বরবধু বারান্দার সিঁড়ির কাছে আসতেই একনাথ বজ্রের মত গর্জে উঠলেন— এত সাহস তোমার! ওই মেয়েকেই বিয়ে করেছ। তবে আমার কাছে এসেছ কেন? যাও, এ বাড়িতে তোমার ঠাঁই নেই, আমার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। আজ থেকে তুমি আমার ত্যাজ্যপুত্র।

পাণ্ডে ব্যাকুল হয়ে ছুটে এলেন– বাবুসাহেব, এ আপনি কি করলেন। আপনার একমাত্র সন্তান

আমার সন্তান নেই। যাও, দুর হয়ে যাও, তোমার মুখ দেখতে চাই না।

লোকনাথ স্থিরদৃষ্টিতে পিতার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল–তাই যাচ্ছি বাবা। আমিও প্রতিজ্ঞা করছি আপনি ডেকে না পাঠালে কোনদিন ফিরে আসব না।

জোড়হাতে নত হয়ে সে বাপকে প্রণাম করল, তারপর কুসুমের হাত ধরে ধীরে ধীরে গেট পার হয়ে চলে গেল।

বাড়ির ঝি-চাকরেরা এতক্ষণ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে চুপ করে শুনছিল, তাদের মধ্যে কেউ কেউ চোখের জল মুছতে লাগল। বাড়ির পুরোহিতমশাই বারান্দার এক কোণ থেকে সব দেখছিলেন, তিনি আর্দ্র চোখে গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। একনাথ পরিজনদের দিকে ফিরে উগ্ৰস্বরে বললেন— তোমাদের সাবধান করে দিচ্ছি, আমার ছেলের সঙ্গে যদি কেউ সম্পর্ক রাখো, তাকেও দূর করে দেব। ওর নাম এ বাড়িতে কেউ উচ্চারণ করবে না।

.

লোকনাথ বিছানায় বসে আছে, কুসুম তার পিছন থেকে কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে অতীতের দুঃস্বপ্ন দেখছে।

লোকনাথ বলছে …পনেরো বছর কেটে গেল, মনে হয় যেন সেদিনের কথা। এর মধ্যে কত ওলট-পালট হয়ে গেছে। সোমনাথ জন্মাল…বড় হয়ে উঠল…আর আমি দিনে দিনে তলিয়ে যাচ্ছি…অভাব…রোগ…আমার দিন ফুরিয়ে আসছে

ওগো চুপ কর।

তুমি যদি মনে কষ্ট পাও বলব না। কিন্তু মনকে তৈরি রাখাই ভাল। সোমনাথ কখন ফিরবে?

তার স্কুলের ছুটি হয় চারটেয়, আধঘণ্টার মধ্যে এসে পড়বে। তাকে কোন দরকার আছে?

তার সঙ্গে এক দান দাবা খেলতাম…হয়তো আর খেলা হবে না। দাবার ছক আর ঘুঁটি এনে রাখ তো। বলতে বলতে দমকা কাশির বেগে সে অভিভূত হয়ে পড়ল।

ঠিক এই সময় বাড়ির বাইরে নোংরা সরু গলি দিয়ে ডাক্তার পাণ্ডে চলেছিলেন। বয়সের ভারে তাঁর গতি মন্থর, হাতে একটি খোলা নোটবুক, বাড়ির নম্বর দেখতে দেখতে যাচ্ছেন।

ঘরের মধ্যে তখন লোকনাথ বিছানার ওপর ছক পেতে ঘুঁটি সাজাচ্ছে, কুসুম চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছে

…ডাক্তার পাণ্ডে বলতেন, দাবা আর অহঙ্কার—এই দুটো আমাদের, মানে পুরন্দরপুরের সিংহদের আসল রোগ। ডাক্তার পাণ্ডেকে তুমি চেনো না, অতি সজ্জন, আমাদের বাড়ির ডাক্তার, তাঁকে চাচা বলে ডাকতাম। জানি না তিনি আছেন কিনা—

বাইরে ডাক্তার পাণ্ডে দরজায় খড়ি দিয়ে লেখা নাম পড়ে থমকে দাঁড়িয়ে ছিলেন, নোটবুকে নম্বর মিলিয়ে দরজার কাছে এসে বিষাদভরা বিস্ময়ে চেয়ে রইলেন, যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না এমন একটা জীর্ণ নোংরা বাড়িতে লোকনাথ থাকতে পারে। তিনি দরজায় টোকা দিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন এমন সময় তাঁর পায়ের কাছে একটি ঘুরন্ত লাট্টু এসে ঘুরতে লাগল। ডাক্তার পাণ্ডে ফিরে। দেখলেন একটি ছেলে, বয়স আন্দাজ চোদ্দ, বুদ্ধিতে জ্বল জ্বল করছে মুখ, পরনে প্যান্ট ও হাফশার্ট, কাঁধে বইয়ের ব্যাগ, হাতে লাট্টুর লেত্তি। লাট্টুর মালিক লাট্টু কুড়িয়ে নিয়ে সসম্ভ্রমে ডাক্তার পাণ্ডেকে জিজ্ঞেস করল— আপনি কাকে খুঁজছেন?

ডাক্তার পাণ্ডে সোমনাথকে স্নেহদৃষ্টিতে দেখে বললেন— লোকনাথ সিংহ কি এই বাড়িতে থাকেন?

সোমনাথ বলল–আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু বাবার শরীর তো ভাল নেই।

ডাক্তার দুহাত বাড়িয়ে বললেন— তুমি লোকনাথের ছেলে! দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিল, কিন্তু বিশ্বাস করতে সাহস হচ্ছিল না।

তিনি সোমনাথকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ঠিক এই সময় কুসুম দরজা খুলে দেখল একজন অপরিচিত ভদ্রলোক সোমনাথকে প্রগাঢ় আলিঙ্গনে ঢেকে ফেলেছেন। সোমনাথ কোন মতে মুখ বার করে বলল–মা, ইনি বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

সোমনাথকে ছেড়ে দিয়ে ডাক্তার কুসুমের দিকে ফিরলেন। কুসুম তাঁকে এক নজরে দেখে চোখ নীচু করল, মৃদু স্বরে বলল— তাঁর শরীর খুব খারাপ, বাইরে আসতে পারবেন না।

ডাক্তার বললেন— শরীর খুব খারাপ! আচ্ছা, তাকে বলো ডাক্তার পাণ্ডে দেখা করতে চান। পনেরো বছর আগে সে আমাকে চাচাজি বলে ডাকত।

ঘরের ভেতর লোকনাথের কানে সব কথাই আসছিল, সে সানন্দে চিৎকার করে বলল—চাচাজি! আপনি এসেছেন! কুসুম, ওঁকে ঘরে নিয়ে এস।

কুসুম দোরের পাশে সরে দাঁড়াল, ডাক্তার পাণ্ডে ভেতরে প্রবেশ করলেন, তাঁর পেছনে সোমনাথ।

ঘরে প্রবেশ করে লোকনাথকে দেখেই ডাক্তার পাণ্ডে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। প্রবীণ ডাক্তার এক লহমায় বুঝতে পারলেন লোকনাথের কাছে মৃত্যুর পরোয়ানা এসে গেছে। তাঁর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।

বিছানার কিনারায় বসে ডাক্তার বাষ্পরুদ্ধ স্বরে বললেন— বাবা লোকনাথ, এ কি অবস্থা হয়েছে তোমার! মুখ দেখে চেনা যায় না। কি– কী রোগ?

লোকনাথ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল— চাচাজি, আপনি ডাক্তার, নিজেই পরীক্ষা করে দেখুন, আমার আর কত দিন।

ডাক্তারের চোখ জলে ভরে উঠল—এ কি–রাজরোগ?

লোকনাথ বলল–ঠিক ধরেছেন। একেবারে শেষ অবস্থা। দাবার ছকের দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাসে হেসে বলল—এবারে কালো ঘুঁটির চাল। তিন চালে কিস্তিমাৎ।

কুসুম ছেলের পানে তাকাল, তার কাঁধে হাত রেখে বলল— আয় তোকে খেতে দিই।

ওরা ঘর থেকে চলে গেলে ডাক্তার পাণ্ডে আস্তে আস্তে বলতে লাগলেন–গত পনেরো বছর ধরে কত জায়গায় না তোমাকে খুঁজেছি। কোথাও তোমার পাত্তা পেলাম না। হতাশ হয়ে খোঁজা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলাম, হঠাৎ সেদিন একজনের মুখে শুনলাম, বম্বে শহরের এই গলিতে তোমার নামে একজন থাকে। খবর পেয়েই ছুটে এসেছি। কিন্তু তোমার যে এই দশা দেখব তা কি ভেবেছিলাম।

লোকনাথ বলল–চাচাজি, দুঃখ করবেন না, মানুষ নিজের ভাগ্য নিজেই তৈরি করে। একটু থেমে বলল-বাবা কেমন আছেন?

ডাক্তার নিশ্বাস ফেলে বললেন–তাঁর কথা আর কি বলব। তুমি চলে আসার পর মানুষটা একেবারে পাগলের মত হয়ে গেছেন। মেজাজ সব সময় সপ্তমে চড়ে আছে। শরীরও আর আগের মত নেই, বাতের যন্ত্রণায় অধিকাংশ দিন বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। এই পনেরো বছরের মধ্যে তিনি পনেরো দিন নিজের ঘর থেকে বেরিয়েছেন কিনা সন্দেহ। এখন আমি বলি কি, তুমি বাবা বাড়ি ফিরে চল।

একটু চুপ করে থেকে লোকনাথ বলল-বাবার কি তাই ইচ্ছে?

ডাক্তার পাণ্ডে একটু বিব্রত হয়ে পড়লেন– না, মুখ ফুটে কিছু বলেননি, তবে তাঁর মনের কথা তো জানি, তোমাকে দেখবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। মনে মনে ছটফট করছেন। কিন্তু মুখে কিছু বলছেন না। জানো তো ওঁর স্বভাব, ভাঙবেন তবু মচকাবেন না

মলিন মুখে লোকনাথ খানিক চুপ করে রইল, তারপর শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে বলল–চাচাজি, আমার রক্তেও তো ওই একই অহংকার রয়েছে। অপরাধীর মত মাথা নীচু করে আমি ফিরে যাব না। আমি যা করেছি তার জন্যে আমার তিলমাত্র লজ্জা নেই। আমার স্ত্রীকে আপনি দেখেছেন, আমার ছেলে সোমনাথকেও দেখলেন। ওদের জন্যে আমি লজ্জা পাব ভেবেছেন! কখনো না।

পাশের ঘরে সোমনাথ মেঝেয় পিঁড়িতে বসে একমনে জলখাবার খাচ্ছে; কুসুম তার পাশে বসে আছে, কিন্তু তার কান পড়ে আছে ও-ঘরের দিকে। লোকনাথের গলা শোনা যাচ্ছে আপনি ঠাট্টা করে আমাদের বংশের দুটি দোষের কথা বলতেন। (দাবার ছকের দিকে আঙুল দেখিয়ে) একটি তো এই। নিজেই বুঝতে পারি, না মরা পর্যন্ত আমার এ নেশা ঘুচবে না।-সোমনাথ!

পাশের ঘর থেকে সোমনাথ উত্তর দিল— যাই বাবা। মুখ মুছতে মুছতে সে কাছে এসে দাঁড়াল। লোকনাথ হাসিমুখে বলল—খেলার জন্যে তৈরি?

সোমনাথ সাগ্রহে বলল–হ্যাঁ বাবা।

দেখা যাক, কে হারে কে জেতে। হারলে আমার দুঃখ নেই, ছেলেরা চিরদিনই বুড়োদের হারিয়ে দেয়। চাচাজি, সংসারের এই নিয়ম, না? আপনাকে কিন্তু আম্পায়ার হতে হবে।

পাণ্ডে বিষণ্ণভাবে ঘাড় নাড়লেন। খেলা শুরু হল। একাগ্র চোখে ছকের পানে তাকিয়ে দুজনে ঘুঁটি চালছে, পাণ্ডেও মন দিয়ে খেলা দেখছেন। পাশের ঘরে কুসুম মাঝে মাঝে দোরের কাছে এসে ওদের দেখছে, আবার সরে যাচ্ছে—

রাস্তা থেকে বৈরাগীর সুর শোনা গেল—

কাকো বন্দো কাকো নিন্দো
        দোনো পাল্লা ভারী।

.

পুরন্দরপুরের অর্ধ-নাগরিক পরিবেশের মধ্যে একনাথ সিংহের বাড়িটা যেন জরাহীন অমরত্বের জয়টীকা পরে দাঁড়িয়ে আছে। পনেরো বছরে তার তিলমাত্র ক্ষয়ব্যয় হয়নি।

সদর বারান্দার মাঝখান থেকে দোতলার সিঁড়ি উঠেছে; দুপাশে কাঠের রেলিং দেওয়া সেকেলে ধরনের সিঁড়ি। দোতলায় সিঁড়ির মুখ থেকে লম্বা বারান্দা, তার একপাশে সারি-সারি দরজা, অন্য পাশে খোলা আকাশ। বারান্দার শেষ প্রান্তে একটি বড় টেবিলের ওপর নানা রকমের ফল সাজানো রয়েছে, টেবিলের পিছনে একটি সেলফের ওপর কাচের বাটি গেলাস রাখা আছে। টেবিলের সামনের দিকে রুপোর প্লেটের ওপর এক গেলাস শরবত ঢাকা রয়েছে।

একনাথের খাস চাকর গোবর্ধন টেবিলের কাছে উবু হয়ে বসে আছে এবং সতর্কভাবে একটা দরজার পানে তাকিয়ে আছে। সকালবেলা একনাথের শয্যাত্যাগের সময় হয়েছে।

খাবারঘরের দরজা ঠেলে অল্পবয়সী একটি ঝি বারান্দায় বেরিয়ে এল, এক হাতে বালতি-ভর্তি এঁটো গেলাসবাটি, অন্য হাতে এঁটো থালা। গত রাত্রের উচ্ছিষ্ট বাসন সে মাজতে নিয়ে যাচ্ছে। বালতির মধ্যে বাসনগুলো দাসীর পা ফেলার তালে তালে ঝন ঝন্ শব্দ করছে।

গোবর্ধন তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল, আঙুল তুলে চাপা তর্জনের সুরে বলল— সসস। তোর কি হাঁটার কোন ছিরিছাঁদ নেই! পা ফেলছে দেখ না, যেন রাজসভায় নাচতে চলেছে! (একনাথের ভেজানো দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে) কর্তার কানে যদি যায়, তোর মুণ্ডু কেটে গেণ্ডুয়া খেলবেন।

ঝিয়ের নাম তারা, সে পা টিপে টিপে গোবর্ধনের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল— কর্তাবাবুর মেজাজ আজ কেমন?

গোবর্ধন বলল— গোল করিস না। মেজাজ খুব খারাপ, সকাল থেকে ক্ষেপে আছেন। যে সামনে পড়বে তার আর রক্ষে নেই। যা, নিঃসাড়ে সরে পড়।

যাচ্ছি দাদা। আজ যে কপালে কি আছে ঠাকুর জানেন। তারা-ঝি বালতি এবং থালা সামলাতে সামলাতে সিঁড়ির পাশে চলল। যেতে যেতে পিছন ফিরে চাইতে লাগল। সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে সে পড়ে গেল, বাসনগুলো বিপুল ঝনৎকার তুলে সিঁড়ি দিয়ে নীচে গড়াতে আরম্ভ করল। ভয় পেয়ে তারা-ঝি কঁকিয়ে কেঁদে উঠল। গোবর্ধন শিউরে উঠে দুহাতে নিজের কান চেপে ধরল।

.

একনাথ সিংহের শয়নঘরটি লম্বায়-চওড়ায় বেশ প্রশস্ত। পুরানো ফ্যাশনের ভারী ভারী আসবাব, ঘরের মাঝখানে চাঁদোয়া দেওয়া প্রকাণ্ড খাট-পালঙ্ক। একনাথ খাটের ওপর কোল পেতে বসে আছেন; তাঁর কোলে রামচরিত মানস। তিনি মাঝে মাঝে দু-একটি দোঁহা গুন গুন শব্দে উচ্চারণ করছেন। পনেরো বছরে তাঁর চেহারার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি, কেবল ঝাঁকড়া ভুরুতে পাক ধরেছে।

পড়তে পড়তে হঠাৎ তাঁর মেজাজ বিগড়ে গেল, তিনি ব্যঙ্গ-স্বরে বলে উঠলেন— পিতৃ-আজ্ঞা পালনের জন্যে রাম বনে গিয়েছিলেন। মিথ্যে কথা— বাজে কথা! রাম বনে গিয়েছিলেন দশরথকে জব্দ করবার জন্যে।

কোল থেকে রামচরিত মানস তুলে তাচ্ছিল্যভরে তিনি পাশে ফেললেন, ট্যাঁক থেকে ঘড়ি বার করে দেখেই উগ্রস্বরে হুঙ্কার ছাড়লেন—গোবরা।

রুপপার থালার ওপর শরবতের গেলাস নিয়ে গোবর্ধন ঘরে ঢুকল—এই যে শরবত।

একনাথ কটমট করে তার পানে তাকালেন— শরবত আনা হয়েছে? কটা বেজেছে তার হিসেব আছে?

আজ্ঞে সাতটা।

তাহলে আমি কখন দেওয়া হবে? তোমাকে রোজ মনে করিয়ে দেবার জন্যে কি আর একটা চাকর রাখতে হবে?

খাটের পাশে টিপাইয়ের ওপর শরবত রেখে গোবর্ধন ছুটে গেল ঘরের কোণে একটি দেরাজের দিকে। দেরাজ খুলে একটি চাঁদির আফিমের কৌটো নিয়ে ছুটে এসে একনাথের সামনে দাঁড়াল। কৌটো খুলে একনাথ আফিমের গুলি পাকাতে লাগলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বাক্যবাণ ছুটল। গোবর্ধন আবার শরবত হাতে নিয়ে কাঠের পুতুলের মত দাঁড়িয়ে রইল।

একনাথ আফিমের গুলি মুখে ফেললেন, শরবতের সাহায্যে সেটি গলাধঃকরণ করলেন, তারপর গেলাস ফেরত দিয়ে বললেন–ডাক্তার হতভাগা গেল কোথায়? কেউ তার খবর জানে?

গোবর্ধন আফিমের কৌটো যথাস্থানে রাখতে রাখতে বলল–আজ্ঞে তিনি তো পনেরো দিন ছুটি নিয়ে বাইরে গেছেন, আজ ফেরবার কথা।

একনাথ বললেন–আজ যদি না ফেরে ডাক্তারকে জবাব দেব। আমি বাতের যন্ত্রণায় মরছি, আর তিনি গায়ে ফুঁ দিয়ে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছেন। অমন ডাক্তারের দরকার নেই।

আজ্ঞে কর্তা।

যাও, তুমি বেরোও এখন।

গোবর্ধন ঝটিতে শরবতের গেলাস নিয়ে প্রস্থান করল।

বারান্দায় একজন চাকর ঝাঁট দিচ্ছিল, গোবর্ধন চোখ পাকিয়ে তাকে শাসন করল— কর্তাবাবু বাতের যন্ত্রণায় মরছেন, আর তুই ঝাঁট দিচ্ছিস? এত বড় আস্পর্ধা! যা তোকে জবাব দিলাম সে প্রভুত্বপূর্ণ ভঙ্গিতে সিঁড়ির দিকে আঙুল দেখাল। ঝাড়ুদার ভৃত্যটিও রসিক ব্যক্তি, সে কপট বিনয়ের ভঙ্গিতে সেলাম করে ঝাড় বগলে নিয়ে নীচে নেমে গেল।

গোবর্ধন তখন নিরিবিলি আর এক গেলাস শরবত তৈরি করে আত্মারামকে নিবেদন করবার উপক্রম করছে, নীচের দিকে নজর পড়ল, চারজন বেহারা একটি পালকি কাঁধে ফটক থেকে বাড়ির দিকে আসছে। ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে সে সেই দিকে চেয়ে রইল। তার মনে প্রশ্ন জাগল—পালকি করে কে আসে? এ বাড়িতে পালকির পাট তো অনেক দিন উঠে গেছে।

বারান্দার সামনে বেহারারা পালকি নামাল। পালকির দরজা খুলে বছর পাঁচেকের একটি মেয়ে লাফিয়ে বাইরে এল। তারপর আস্তে আস্তে পা বের করে বেরিয়ে এল একটি রোগা শুকনো চেহারার লোক; বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশ, শরীরের কাঠামো দেখে মনে হয় এককালে ভারী জোয়ান ছিল, কিন্তু এখন তার বুকে ও বাঁ হাতে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা, চোখ কোটরগত, গাল শুকিয়ে গেছে। লোকটি জমিদারবাবুর সর্দার লাঠিয়াল বসন্ত সিং, মেয়েটি তার কন্যা ললিতা।

বসন্ত সিংয়ের অবসন্ন শরীর নুয়ে পড়েছে, কোনমতে মেয়ের হাত ধরে সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল। সিঁড়ির মাথায় গোবর্ধন দাঁড়িয়ে ছিল, সে উৎকণ্ঠিতভাবে বলল—সর্দারজি, এই রোগা শরীর নিয়ে আপনি এলেন কেন? আপনার জখমের ঘা তো এখনো সারেনি।

বসন্ত সিং গম্ভীর মুখে বলল-মরার আগে এ ঘা আর সারবে না। মালিককে এত্তেলা দাও, তাঁর কাছে আর্জি আছে।

গোবর্ধন উদ্বিগ্ন হয়ে বলল–কিন্তু সর্দার, মালিকের মেজাজ আজ খুবই খারাপ, সকালবেলা উঠেই আমার মাথাটি চিবিয়েছেন। আপনি এসময় তাঁর কাছে গেলে বরং আজ বিকেলবেলা।

অধীর স্বরে সর্দার বলল— আমার দেরি করার সময় নেই। তুমি যদি এত্তেলা না দাও, আমি বিনা হুকুমে মালিকের কাছে যাব।

সর্দার একনাথের খাস কামরার পানে পা বাড়াল।

গোবর্ধন ভয় পেয়ে বলল—না না, আমি খবর দিচ্ছি। এত্তেলা না দিয়ে গেলে কর্তা আমাকে খুন করবেন। সে আগে আগে চলল, মেয়ের হাত ধরে সর্দার তার পিছনে রইল।

একনাথ আগের মতই বিছানায় বসে আছেন, কিন্তু তাঁর বসার ভঙ্গিটা আরো উগ্র, যেন তাঁর মনের কটাহে চিন্তাগুলো টবগ করে ফুটছে। গোবর্ধনকে দেখে তিনি জ্বলে উঠলেন— আবার কী! কে তোকে ডেকেছে?

গোবর্ধন হাত কচলাতে কচলাতে বলল আজ্ঞে সর্দার বসন্ত সিং

একনাথ বললেন— তার আবার কি হল? মরে গেছে নাকি? :

দোরের কাছ থেকে বসন্ত সিং বলল— আজ্ঞে না, মরিনি এখনও, তবে বেশি দেরি নেই মালিক। সে সামনে এসে জোড়হাতে মাথা নোয়াল, তারপর হাঁটু মুড়ে মেঝেয় বসে পড়ল। একনাথ কঠিন দৃষ্টিতে তাকে নিরীক্ষণ করে বললেন— তুই আবার কি মনে করে এসেছিস? ভাল লোককে সর্দার লেঠেলের পদ দিয়েছিলাম। কোথায় শত্তুরের হাড় গুঁড়ো করবে, তা নয়, নিজেই মার খেয়ে ফিরে এসেছে। অপদার্থ কোথাকার! যা, তোকে বরখাস্ত করলাম, তোর মত লেঠেল আমার দরকার নেই।

একনাথের রূঢ়বাক্যে তিলমাত্র বিচলিত না হয়ে বসন্ত সিং মেয়েকে কাছে টেনে নিল, বললমালিক, বিশ বছর আপনার গোলামী করছি, কাজে কখনো ফাঁকি দিইনি। খুন জখম যখন যা হুকুম করেছেন হুকুম তামিল করেছি, কখনও পিছপাও হইনি, বুকের রক্ত দিয়ে কাজ হাসিল করেছি। কিন্তু এবারের চোটটা আমায় শেষ করে দিয়েছে। আপনাকে আর বরখাস্ত করতে হবে না স্বয়ং যমরাজ নোটিশ দিয়েছেন। আমি শেষ পর্যন্ত মালিকের সেবা করতে পেরেছি, আমার কোন দুঃখ নেই

তবে হট্‌ করে আমার ঘরে ঢুকলি কেন? কি চাস তুই?

মালিক, আমার দিন ফুরিয়ে এসেছে। এই মেয়েটা ছাড়া (ললিতা চোখ তুলে নিরীহভাবে বাপের পানে চাইল) আমার নিজের বলতে কেউ নেই, তাই ওকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছি, আজ থেকে আপনি ওকে পালন করবেন।

একনাথ আকাশ থেকে পড়লেন অ্যাঁ, আমি তোর মেয়েকে মানুষ করব? তিনি আবার অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন–চালাকি পেয়েছিস! তোকে কুকুরে কামড়েছে রে হতভাগা। যা এই দণ্ডে আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যা।

বসন্ত সিং উঠে দোরের দিকে চলল— তাই যাচ্ছি মালিক, কিন্তু মেয়ে রইল। ওকে আপনার বাঁদী করে রাখবেন।

একনাথ চিৎকার করে উঠলেন— ওরে হতচ্ছাড়া, যাচ্ছিস কোথায়? মেয়েটাকে নিয়ে যা, ওকে আমি পুষতে পারব না। বাড়িতে একটা মেয়েছেলে নেই, কে ওকে দেখবে?

দোর পর্যন্ত গিয়ে সর্দার আস্তে আস্তে ফিরল, সে অব্যক্ত কণ্ঠে বলল–গোবর্ধন ভাই, একটু জল

গোবর্ধন এতক্ষণ ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল, চমকে উঠে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। একনাথ গর্জন ছাড়লেন— ঘরের কোণে জলের কুঁজো দেখতে পাচ্ছিস না, হতভাগা উল্লুক।

গোবর্ধন ছুটে গিয়ে সোরাই থেকে জল নিয়ে যখন সর্দারের কাছে এল, সর্দার ততক্ষণে এলিয়ে পড়েছে। গভীর নিশ্বাসের সঙ্গে তার গলা থেকে বেরিয়ে এল সেলাম মালিক।

গোবর্ধন তার মুখে জল ঢালবার চেষ্টা করল, কিন্তু জল মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ল। ললিতা হঠাৎ ভয় পেয়ে বাবা বাবা বলে কেঁদে উঠল। ঠিক এইসময় ডাক্তার পাণ্ডে ঘরে প্রবেশ করলেন।

ডাক্তার বসন্ত সিংকে মেঝেয় পড়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন, একনাথ বলে উঠলেন—দেখ তো ডাক্তার, মরে গেল নাকি!

ডাক্তার হাঁটু গেড়ে বসে বসন্ত সিংয়ের নাড়ী টিপলেন, বুকে হাত দিয়ে দেখলেন, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে একনাথের পানে চাইলেন— হাঁ, বুকের স্পন্দন থেমে গেছে ডাক্তারের মুখে তিক্ত কঠিনতা ফুটে উঠল, তিনি কেটে কেটে কথা বললেন–আর একটা দুঃসংবাদ আছে : আপনার একমাত্র ছেলে লোকনাথও মারা গেছে।

হঠাৎ ঘরের মধ্যে নিস্তরঙ্গ নীরবতা নেমে এল।

.

আধঘণ্টা কেটে গেছে। বসন্ত সিংয়ের শব সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, গোবর্ধন ললিতার হাত ধরে নিয়ে গেছে। এই আধঘণ্টার মধ্যে একনাথ ও ডাক্তার পাণ্ডে একটি কথারও বিনিময় করেননি, একনাথ নিশ্চল হয়ে চেয়ারের দিকে চেয়ে আছেন, ডাক্তারের অভিযোগ-ভরা দৃষ্টি একনাথের ওপর নিবদ্ধ।

হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে একনাথ ডাক্তারের পানে আরক্ত চক্ষু তুললেন, বিকৃতস্বরে বললেন–লোকনাথ যদি মরে গিয়ে থাকে তাতে আমার কি! আমার কিছুই আসে যায় না।

ডাক্তার নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললেন-দারুণ অভাবের মধ্যে অসহায় অবস্থায় সে মারা গেছে।

একনাথ ফেটে পড়বার উপক্রম করলেন এসব কথা তুমি আমাকে কেন শোনাচ্ছ? বলেছি তো লোকনাথ সম্বন্ধে আমার তিলমাত্র আগ্রহ নেই।

ডাক্তারের গলা আরো ভারী হয়ে এল— জানি। সে যে আমার কোলে মাথা রেখে শেষ নিশ্বাস ফেলল, একথা আমি ভুলতে পারছি না। তার বিধবা স্ত্রী আর ছেলে

একনাথ আর স্থির থাকতে পারলেন না, খাট থেকে লাফিয়ে নীচে নেমে চিৎকার করে উঠলেন—–শুনতে চাই না—ওরা আমার কেউ নয়—হঠাৎ উঠে দাঁড়াবার ফলে তাঁর পায়ে বাতের ব্যথা তীব্র হয়ে উঠেছিল, তিনি পড়ে যাচ্ছিলেন, ডাক্তার তাঁকে ধরে খাটের পাশে বসিয়ে দিলেন। একনাথ। দাঁতে দাঁত চেপে ডাক্তারের প্রতি বিষদৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন সবাই বজ্জাত, সবাই দাগাবাজ। শয়তান। আমি চিনি না। তোমাদের সবাইকে চিনি। তোমার ফন্দি আমি বুঝেছি। তার বিধবা স্ত্রী আর ছেলেকে আমার ঘাড়ে চাপাতে চাও।

ডাক্তার বিষণ্ণ মুখে মাথা নাড়লেন আমার কোন রকম ফন্দিফিকির নেই, থাকলেও কোন কাজে লাগত না। একটা কথা আপনি বোঝবার চেষ্টা করুন, আপনার নাতি বা আপনার পুত্রবধু আপনাকে ভালবাসে না, আপনি যদি তাদের এ বাড়িতে আনতে চান, মনে হয় না তারা আসতে রাজী হবে।

ক্ষণকালের জন্য গুম হয়ে গিয়ে একনাথ প্রচণ্ড অগ্নিকাণ্ডের মত ফেটে পড়লেন— কী, যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! আমার বাড়িতে আসতে রাজী হবে না! চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে। আসব–ডাক্তারের সংশয়পূর্ণ মাথানাড়া দেখে তিনি দ্বিগুণ জ্বলে উঠলেন–আমার কথার ওপর কথা বলে এমন সাধ্য কার! যাও তুমি, এখনি তাদের ধরে নিয়ে এস।

ডাক্তার দেখলেন ওষুধ ধরেছে, তিনি আরো দুঃখিতভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন— বাবুজি, বম্বে শহরটা ঠিক পুরন্দরপুর নয়। সেখানে পুলিশ আছে, আইন-আদালত আছে। তাছাড়া আপনার নাতি আর পুত্রবধু তো মাটির পুতুল নয় যে তুলে নিয়ে আসব। তারা জলজ্যান্ত মানুষ, তাদের স্বাধীন ইচ্ছা আছে

স্বাধীন ইচ্ছা! আমার ইচ্ছাই তাদের ইচ্ছা, আমি এখন ওদের গার্জেন। যাও, এখনি আমার উকিলকে ডেকে আনো!

যে আজ্ঞে, যাচ্ছি— মুখে উদ্বেগ ও মনে সন্তাষ নিয়ে ডাক্তার প্রস্থান করলেন। একনাথ আপন মনে গজরাতে লাগলেন— আমার কথা অগ্রাহ্য করবে। দেখে নেব। এবার এমন শিক্ষা দেব যা জন্মে ভুলবে না।…

.

কয়েকদিন পরে।

সদর বারান্দার নিম্নতম ধাপের এককোণে বসে ললিতা আপন মনে পুতুল নিয়ে খেলছে, একটি পুতুলকে ফ্রক পরিয়ে কোলে শুইয়ে সুর করে ঘুমপাড়ানি ছড়া বলছে

সাতসমুদ্র পার থেকে
        ময়ূরপঙ্খী নৌকা চড়ে
        আসবে খুকুর বর—

ললিতা পুতুলকে চাপড়ে চাপড়ে ঘুম পাড়াচ্ছে এমন সময় একটি ঘোড়ার গাড়ি এসে বারান্দার সামনে দাঁড়াল। ডাক্তার গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালেন, তারপর সোমনাথ নামল, সব শেষে নামল কুসুম। তার বিধবার বেশ, মুখে ঘোমটা। ললিতা পুতুলখেলা থামিয়ে অবাক হয়ে তাদের পানে চেয়ে রইল।

পাণ্ডে আগে আগে তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন, সকলের পিছনে সোমনাথ। সে ললিতার পাশ দিয়ে যাবার সময় ঘাড় বেঁকিয়ে তার পুতুল খেলার আয়োজন দেখল, একটু নাক উঁচু করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল। ললিতা বিক্ষুব্ধ চোখে চেয়ে রইল।

ওপরের বারান্দায় গোবর্ধন জোড়হাত মাথায় ঠেকিয়ে নীচু হয়ে কুসুমকে অভ্যর্থনা করল। তার মুখের ভাব গদ্গদ, সে ডাক্তারকে খাটো গলায় বলল–কর্তাবাবু ঘরেই আছেন, তাঁকে এত্তেলা দেব?

ডাক্তার বললেন— দরকার নেই, উনি জানেন।

গোবর্ধন কর্তার ঘরের পর্দা সরিয়ে একধারে দাঁড়াল, ডাক্তার কুসুমকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন।

পুরনো ধরনের আরামকেদারায় একনাথ বসে আছেন, পরনে জমকালো পোশাক। ভুরু কুঁচকে তিনি গড়গড়ার নলে টান দিচ্ছিলেন, ডাক্তারের গলা-খাঁকারি শুনে সেই দিকে তাকালেন। কুসুমের ওপর চোখ পড়তেই তাঁর মুখ কঠিন হয়ে উঠল। পাণ্ডে কুসুমকে ইঙ্গিত করে এগিয়ে যেতে বললেন। কুসুম চোখ নীচু করে একনাথের পায়ের কাছে গেল, হাঁটু মুড়ে মাথা ঠেকিয়ে শ্বশুরকে প্রণাম করল। একনাথ একবার তার দিকে চেয়েই মুখ ঘুরিয়ে নিলেন, কড়া সুরে বললেন–এই বাড়িতে তুমি থাকবে, আমার হুকুম। আমার সামনে কিন্তু কখনো আসবে না। যাও–অন্দরমহলে যাও। তিনি রাজকীয় ভঙ্গিতে অন্তঃপুরের দরজার দিকে আঙুল দেখালেন।

কুসুম মাথা নীচু করে সেই পথে চলে গেল। একনাথ তখন পাণ্ডের দিকে ফিরে বললেন—ছেলেটা কোথায়?

ডাক্তার চমকে উঠলেন—সোমনাথ? অ্যাঁ—কোথায় গেল! দেখছি। তিনি তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।

সোমনাথ নীচে ললিতার সঙ্গে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে বেশ মুরুব্বিয়ানা চালে কথা বলছে, ললিতা সম্ভ্রমের সঙ্গে শুনছে। সোমনাথ লাত্তুতে লেত্তি জড়াতে জড়াতে বলল–পুতুলখেলা আবার খেলা! ও তো সবাই পারে। তুমি লাট্টু ঘোরাতে পার?

ললিতা হতাশ স্বরে বলল—না তো। তুমি আমাকে শিখিয়ে দেবে?

সোমনাথ বলল—এ তুমি শিখতে পারবে না। ভারী শক্ত খেলা।

ললিতার মুখ দেখে মনে হল সে এখনি কেঁদে ফেলবে। সোমনাথ তাড়াতাড়ি বলল–আচ্ছা আচ্ছা, শেখাচ্ছি। এই নাও, লেত্তি আঙুলে জড়িয়ে এই এমনি করে ছুঁড়ে দাও।

ললিতা লাট্টু ছুঁড়ল, লাট্টু সোমনাথের কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। সে চোখ পাকিয়ে বলল— আর একটু হলেই আমার মাথাটা ফুটো করে দিয়েছিলে।

সে লাট্টু তুলে নিয়েছে এমন সময় ডাক্তার পাণ্ডে বললেন–তুমি এখানে কি করছ? চল চল, তোমার ডাক পড়েছে। তিনি ফিরে চললেন, সোমনাথ লাট্টু পকেটে রাখতে রাখতে তাঁর অনুগামী হল। ললিতা জলভরা চোখে চেয়ে রইল।

ওপরের ঘরে সোমনাথ বৃদ্ধের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়াল, ভাবভঙ্গি নির্ভীক কিন্তু সন্ত্রমপূর্ণ। একনাথ তার পানে ভ্রূকুটি করে চাইলেন, কিন্তু তাঁর চোখ বাষ্পচ্ছন্ন হল। নিজের দুর্বলতায় বিরক্ত হয়ে রুক্ষ স্বরে বললেন-তোমার নাম কি?

আমার নাম সোমনাথ, আমার বাবার নাম লোকনাথ সিংহ, আমার ঠাকুরদা পুরন্দরপুরের বাবুসাহেব একনাথ সিংহ।

একনাথ কিছুক্ষণ নীরবে আত্মসংবরণ করলেন, শেষে বললেন— তুমি লেখাপড়া শিখেছ?

সোমনাথ বলল— আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি ক্লাস এইট-এ পড়ি।

একনাথ হাত তুলে তাকে কাছে ডাকলেন, সোমনাথ তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তিনি মৃদুস্বরে প্রশ্ন করলেন–আমাকে চেন?

আজ্ঞে না। সে ডাক্তার পাণ্ডের দিকে তাকাতে তিনি ধীরস্বরে বললেন— ইনিই তোমার পিতামহ পুরন্দরপুরের বাবুসাহেব একনাথ সিংহ।

সোমনাথ অবাক হয়ে চাইল, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল— আপনি আমার দাদু? বাবার মুখে শুনেছি আপনি মস্ত বড়লোক, একজন রাজা। সত্যি আপনি রাজা?

একনাথ এবার ভেঙে পড়লেন, তাঁর চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়তে লাগল। বাষ্পরুদ্ধ স্বরে তিনি ডাক্তারকে বললেন—একে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাও ডাক্তার।

সোমনাথ চকিত হয়ে দুজনের মুখের পানে চাইল। ডাক্তার তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললেন–চল সোমনাথ, তোমাকে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাই।

.

অন্দরমহলে পূজার ঘর। গৃহদেবী শ্রীশ্রীচণ্ডীর বিগ্রহটি আকারে ছোট হলে কি হয়, প্রত্যহ খুব ঘটা করে তাঁর পূজা হয়।

পুরোহিতমশাই দেবীর সামনে স্তোত্রপাঠ করছেন, কুসুম জোড়হাতে তদগতভাবে দেবীর মুখের পানে তাকিয়ে বসে আছে। দেবীর পদপ্রান্তে কয়েকটি পাত্রে রক্তজবা ফুল।

স্তোত্রপাঠ শেষ হলে বৃদ্ধ পুরোহিত ও কুসুম মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন। তারপর পুরোহিত কুসুমের দিকে ফিরে হাসিমুখে বললেন–মা, তুমি নিজের বাড়িতে এসে সংসারের ভার বুঝে নিয়েছ এ বড় আনন্দের কথা। গিন্নীমার মৃত্যুর পর ত্রিশ বছর কেটে গেছে, বাড়িতে এমন একজন মেয়ে নেই যে পূজার যোগাড়যন্ত্র করে। এতদিন পরে তুমি এসে সব ব্যবস্থা করেছ, দেবী তোমার প্রতি প্রসন্ন হয়েছেন। এরপর দেখো, সব বিপদ-আপদ কেটে যাবে।

কপালে হাত ঠেকিয়ে কুসুম বলল— ঠাকুরের দয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *