০৩. মতিলালের বালীতে আগমন ও তথায় লীলাখেলা, পরে ইংরাজী শিক্ষার্থে বহুবাজারে অবস্থিতি।

রবিবারে কুঠিওয়ালারা বড়ো ঢিলে দেন—হচ্ছে হবে—খাচ্ছি খাব—বলিয়া অনেক বেলায় স্নান-আহার করেন—তাহার পরে কেহ বা বড়ে টেপেন—কেহ বা তাস পেটেন—কেহ বা মাছ ধরেন—কেহ বা তবলায় চাঁটি দেন— কেহ বা সেতার লইয়া পিড়িং পিড়িং করেন— কেহ বা শয়নে পদ্মনাভ ভালো বুঝেন—কেহ বা বেড়াতে যান—কেহ বা বহি পড়েন। কিন্তু পড়াশুনা অথবা সৎ কথার আলোচনা অতি অল্প হইয়া থাকে। হয় তো মিথ্যা গালগল্প কিংবা দলাদলির ঘোঁট, কি শম্ভু তিনটা কাঁঠাল খাইয়াছে এই প্রকার কথাতেই কাল ক্ষেপণ হয়। বালীর বেণীবাবুর অন্য প্রকার বিবেচনা ছিল। এদেশের লোকদিগের সংস্কার এই যে স্কুলে পড়া শেষ হইলে লেখাপড়ার শেষ হইল। কিন্তু এ বড়ো ভ্রম, আজন্ম মরণ পর্যন্ত সাধনা করিলেও বিদ্যার কুল পাওয়া যায় না, বিদ্যার চর্চা যত হয় ততই জ্ঞান বৃদ্ধি হইতে পারে। বেণীবাবু এ বিষয় ভালো বুঝিতেন এবং তদনুসারে চলিতেন। তিনি প্রাতঃকালে উঠিয়া আপনার গৃহকর্ম সকল দেখিয়া পুস্তক লইয়া বিদ্যানুশীলন করিতেছিলেন। ইতিমধ্যে চৌদ্দ বৎসরের একটি বালক—গলায় মাদুলি—কানে কামড়ি, হাতে বালা ও বাজু, সম্মুখে আসিয়া টিপ করিয়া একটি গড় করিল। বেণীবাবু এক মনে পুস্তক দেখিতেছিলেন বালকের জুতার শব্দে চম্‌কিয়া উঠিয়া দেখিয়া বলিলেন, ‘এসো বাবা মতিলাল এসো—বাটীর সব ভালো তো? মতিলাল বসিয়া সকল কুশল সমাচার করিল। বাণীবাবু কহিলেন—অদ্য রাত্রে এখানে থাকো কল্য প্রাতে তোমাকে কলিকাতায় লইয়া স্কুলে ভর্তি করিয়া দিব। ক্ষণেক কাল পরে মতিলাল জলযোগ করিয়া দেখিল অনেক বেলা আছে। চঞ্চল স্বভাব—এক স্থানে কিছু কাল বসিতে দারুন ক্লেশ বোধ হয়—এজন্য আস্তে আস্তে উঠিয়া বাটীর চতুর্দিকে দাঁদুড়ে বেড়াইতে লাগিল— কখন ঢেঁস্কেলের ঢেঁকিতে পা দিতেছে—কখন বা ছাতের উপর গিয়া দুপদুপ করিতেছে—কখন বা পথিকদিগকে ইট- পাটকেল মারিয়া পিট্রান দিতেছে; এইরূপে দুপ-দুপ করিয়া বালী প্রদক্ষিণ করিতে লাগিল—কাহারো বাগানে ফুল ছেঁড়ে—কাহারো গাছের ফল পাড়ে—কাহারো মট্‌কার উপর উঠিয়া লাফয়—কাহারো জলের কলসী ভাঙিয়া দেয়।
বালীর সকল লোকেই ত্যক্ত হইয়া বলাবলি করিতে লাগিল—এ ছোঁড়া কে রে? যেমন ঘরপোড়া দ্বারা লস্কা ছারখার হইয়াছিল আমাদিগের গ্রামটা সেইরূপ তচ্‌নচ্‌ হবে না –কি? কেহ কেহ ঐ বালকের পিতার নাম শুনিয়া বলিল—আহা বাবুরামবাবুর এ পুত্র—না হবে কেন? “পুত্রে যশসি তোয়েচ নরাণাং পুণ্যক্ষণম্‌।”
সন্ধ্যা হইল—শৃগালদিগের হোয়া হোয়া ও ঝিঁ ঝিঁ পোকার ঝিঁ ঝিঁ শব্দে গ্রাম শব্দায়মান হইতে লাগিল। বলীতে অনেক ভদ্রলোকের বসতি—প্রায় অনেকের বাটীতে শালগ্রাম আছেন এজন্য শঙ্খ-ঘণ্টা ধ্বনির ন্যূনতা ছিল না। বেণীবাবু অধ্যয়নান্তর গামোড়া দিয়া তামাক খাইতেছেন ইত্যবসরে একটা গোল উপস্থিত হইল। পাঁচ-সাতজন লোক নিকটে আসিয়া বলিল—মশাই গো! বৈদ্যবাটীর জমিদারের ছেলে আমাদের উপর ইঁটঁ মারিয়াছে—কেহ বলিল—আমার ঝাঁকা ফেলিয়া দিয়াছে—কেহ বলিল—আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়াছে—কেহ বলিল—আমার মুখে থুতু দিয়াছে—কেহ বলিল—আমার ঘিয়ের হাঁড়ি ভাঙিয়াছে। বাণীবাবু পরদুঃখে কাতর—সকলকে তুষেতেষে ও কিছু কিছু দিয়া বিদায় করিয়া দিলেন, পরে ভাবিলেন এ ছেলের তো বিদ্যা নগদ হইবে—এক বেলাতেই গ্রাম কাঁপিয়া দিয়াছে—এক্ষণে এখন হইতে প্রস্থান করিলে আমার হাড় জুড়ায়।
গ্রামের প্রাণকৃঞ্চ খুড়ে, ভগবতী ঠাকুরদাদা ও ফচ্‌কে রাজকৃষ্ণ আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—বাণীবাবু এ ছেলে কে? —আমরা আহার করিয়া নিদ্রা যাইতেছিলাম—গোলের দাপটে উঠে পড়েছিলাম—কাঁচা ঘুম ভাঙাতে শরীরটা মাটি মাটি করিতেছে। বেণীবাবু কহিলেন—আর ও কথা কেনে বলো? একটা ভারি কর্মভোগে পড়িয়াছি—আমার একটি জমিদার ষণ্ডা কুটুম্ব আছে—তাহার হ্রস্ব দীর্ঘ কিছুই জ্ঞান নাই—কেবল কতকগুলো টাকা আছে। ছেলেটিকে স্কুলে ভর্তি করাইবার জন্য আমার নিকট পাঠাইয়াছেন—কিন্তু এর মধ্যেই হাড় কালি হইল—এমন ছেলেকে তিনদিন রাখিলেই বাটীতে ঘুঘু চরিবে। এইরূপ কথোপকথন হইতেছে—জন কয়েক চেংড়া পশ্চাতে মতিলাল ‘ভজ নর শম্ভুসুতেরে’ বলিয়া চিৎকার করিতে করিতে আসিল। বেণীবাবু বলিলেন—ঐ আসছে রে বাবু—চুপ কর—আবার দুই-এক ঘা বসিয়ে দেবে না-কি? পাপকে বিদায় পারিলে বাঁচি। মতিলাল বেণীবাবুকে দেখিয়া দাঁত বাহির করিয়া ঈষদ্ধাস্য করত কিঞ্চিৎ সস্কুচিত হইল। বেণীবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন—বাবু কোথায় গিয়েছিলে? মতিলাল বলিল—মহাশয়দের গ্রামটা কত বড়ো তাই দেখে এলেম।
পরে বাটীর ভিতর যাইয়া মতিলাল রাম চাকরকে তামাক আনিতে বলিল। অম্বুরি অথবা ভেলসায় সানে না—কড়া তামাকের উপর কড়া তামাক খাইতে লাগিল। রাম তামাক যোগাইয়া উঠিতে পারে না—এই আনে—এই নাই । এইরূপ মুহুর্মুহু তামাক দেওয়াতে রাম অন্য কোনো কর্ম করিতে পারিল না। বাণীবাবু রোয়াকে বসিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিলেন ও এক-এক বার পিছন ফিরিয়া মিট মিট করিয়া উঁকি মারিয়া দেখিতে লাগিলেন।
আহারের সময় উপস্থিত হইল। বেণীবাবু অন্তঃপুরে মতিলালকে লইয়া উত্তম অন্ন-ব্যঞ্জন ও নানা প্রকার চর্চা-চোষ্য-লেহ্য-পেয় দ্বারা পরিতোষ করাইয়া তাম্বুলগ্রহণান্তর আপনি শয়ন করিতে গেলেন। মতিলাল শয়নগারে গিয়া পান-তামাক খাইয় বিছেনার ভিতর ঢুকিল। কিছু কাল এপাশ ওপাশ করিয়া ধড়মড়িয়া উঠিয়া এক-এক বার পায়চারি করিতে লাগিল ও এক-এক বার নীলু ঠাকুরের সখীসংবাদ অথবা রাম বসুর বিরহ গাইতে লাগিল। গানের চোটে বাটীর সকলের নিদ্রা ছুটে পালাইল।
চণ্ডীমণ্ডপে রাম ও কাশীজোড়া নিবাসী পেলারাম মালী শয়ন করিয়াছিল। দিবসে পরিশ্রম করিলে নিদ্রাটি বড়ো আরামে হয়, কিন্তু ব্যঘাত হইলে অত্যন্ত বিরক্তি জন্মে। গানের চিৎকারে চাকরের ও মালীর নিদ্রা ভাঙিয়া গেল ।
পেলারাম। অহে বাপা রাম ! এ সড়ার চিড়কারে মোর লিদ্রা হতেছে না—উঠে বাগানে বীজ গুঁড়া কি পেড়াইব?
রাম। (গা মোড় দিয়া) আরে রাত ঝিঁ ঝিঁ কচ্চে—এখন কেন উঠ্‌বি ? বাবু ভালো নালা কেটে জল এনেছে—এ ছোঁড়া কান ঝালা-পালা কল্লে—গেলে বাঁচি।
পরদিন প্রভাতে বেণীবাবু মতিলালকে লইয়া বৌবাজারের বেচারাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাটীতে উপস্থিত হইলেন। বেচারামবাবু কেনারামবাবুর পুত্র—বুনিয়াদী বড়ো মানুষ—সন্তানাদি কিছুই নাই—সাদাসিধে লোক কিন্তু জন্মাবধি গঁর্ণখাঁদা—অল্প অল্প পিট্‌পিটে ও চিড়চিড়ে। বেণীবাবুকে দেখিয়া স্বাভাবিক নাকিস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন—’আরে কও কি মনে করে?’
বাণীবাবু। মতিলাল মহাশয়ের বাটীতে থাকিয়া স্কুলে পড়বে—শনিবার শনিবার ছুটি পাইলে বৈদ্যবাটী যাইবে। বাবুরামবাবুর কলিকাতায় আপনার মতো আত্নীয় আর নাই এজন্য এই অনুরোধ করিতে আসিয়াছি।
বেচারাম। তার আটক কি? —এও ঘর সেও ঘর। আমার ছেলেপুলে নাই— কেবল দুই ভাগিনেয় আছে—মতীলাল স্বচ্ছন্দে থাকুক।
বেচারামবাবুর নাকিস্বরের কথা শুনিয়া মতিলাল খিল খিল করিয়া হাসিতে লাগিল। অমনি বাণীবাবু উহুঁ উহুঁ করত চোখ টিপ্‌তে লাগিলেন ও মনে করিলেন এমন ছেলে সঙ্গে থাকিলে কোথাও সুখ নাই। বেচারামবাবু মতিলালের হাসি শুনিয়া বলিলেন—বেণী ভায়া ! ছেলেটি কিছু বেদ্‌ড়া দেখতে পাই যে? বোধ হয় বালককালাবধি বিশেষ নাই পাইয়া থাকিবে। বাণীবাবু অতি অনুসন্ধনী—পূর্বকথা সকলি জানেন, আপনিও ভুগেছেন—কিন্তু নিজ গুণে সকল ঢেকে ঢুকে লইলেন—গুপ্ত কথা ব্যক্ত করিলে মতিলাল মারা যায়—তাহার কলিকাতায় থাকাও হয় না ও স্কুলে পড়াও হয় না। বেণীবাবু নিতান্ত বাসনা সে কিছু লেখাপড়া শিখিয়া কোনো প্রকার মানুষ হয়।
অনন্তর অন্যান্য প্রকার অনেক আলাপ করিয়া বেচারামবাবুর নিকট হইতে বিদায় হইয়া বেণীবাবু মতিলালকে সঙ্গে করিয়া শরবোরণ সাহেবের স্কুলে আসিলেন। হিন্দু কলেজ হওয়াতে শরবোরণ সাহেবের স্কুল কিঞ্চিৎ মেড়ে পড়িয়াছিল এজন্য সাহেব দিন রাত্রি উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছিলেন—তাঁহার শরীর মোটা—ভুরুতে রোঁ ভরা—গালে সর্বদা পান—বেত হাতে—এক একবার ক্লাসে ক্লাসে বেড়াইতেন ও এক একবার চৌকিতে বসিয়া গুড়গুড়ি টানিতেন। বেণীবাবু তাঁহার স্কুলে মতিলালকে ভর্তি করিয়া দিয়া বলীতে প্রত্যাগমন করিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *