০১. বাবুরামবাবুর পরিচয়—মতিলালের বাঙ্গালা, সংস্কৃত ও ফার্সী শিক্ষা।

বৈদ্যাবাটীর বাবুরাম বাবু বড়ো বৈষয়িক ছিলেন। তিনি মাল ও ফৌজদারী আদালতে অনেক কর্ম করিয়া বিখ্যাত হন। কর্মকাজ করিতে প্রবৃত্ত হইয়া উৎকোচাদি গ্রহণ না করিয়া যথার্থ পথে চলা বড়ো প্রাচীন প্রথা ছিল না – বাবুরাম সেই প্রথানুসারেই চলিতেন। একে কর্মে পটু – তাতে তোষামোদ ও কৃতাঞ্জলি দ্বারা সাহেব-সুবাদিগকে বশীভূত করিয়াছিলেন এজন্য অল্পদিনের মধ্যেই প্রচুর ধন উপার্জন করিলেন। এদেশে ধন অথবা পদ বাড়িলেই মান বাড়ে, বিদ্যা ও চরিত্রের তাদৃক্ গৌরব হয় না। বাবুরাম বাবুর অবস্থা পূর্বে বড়ো মন্দ ছিল, তৎকালে গ্রামে কেবল দুই এক ব্যক্তি তাঁহার তত্ত্ব করিত। পরে তাঁহার সুদৃশ্য অট্টালিকা, বাগ-বাগিচা, তালুক ও অন্যান্য ঐশ্বর্য-সম্পত্তি হওয়াতে অনুগত ও অমাত্য বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা অসংখ্য হইল। অবকাশ কালে বাটিতে আসিলে তাঁহার বৈঠকখানা লোকারণ্য হইত, যেমন মেঠাইওয়ালার দোকানে মিষ্ট থাকিলেই তাহা মক্ষিকায় পরিপূর্ণ হয় তেমন ধনের আমাদানি হইলেই লোকের আমদানি হয়। বাবুরামবাবুর বাটীতে যখন যাও তাঁহার নিকট লোক ছাড়া নাই—কি বড়ো, কি ছোট, সকলেই চারিদিকে বসিয়া তুষ্টিজনক নানা কথা কহিতেছে, বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা ভঙ্গিক্রমে তোষামদ করিত আর এলোমেলো লোকেরা একেবারেই জল উঁচু-নিচু বলিত। এইরূপে কিছু কাল যাপন করিয়া বাবুরাম বাবু পেন্‌সন লইলেন ও আপন বাটীতে বসিয়া জমিদারী ও সওদাগরী কর্ম করিতে আরম্ভ করিলেন।

লোকের সর্বপ্রকারে সুখ প্রায় হয় না ও সর্ববিষয়ে বুদ্ধিও প্রায় থাকে না। বাবুরাম বাবু কেবল ধন উপার্জনেই মনোযোগ করিতেন। কি প্রকারে বিষয়-বিভব বাড়িবে, কি প্রকারে দশজন লোক জানিবে, কি প্রকারে গ্রামস্থ লোক-সকল করজোড়ে থাকিবে— কি প্রকারে ক্রিয়াকাণ্ড সর্বোত্তম হইবে— এই সকল বিষয় সর্বদা চিন্তা করিতেন। তাঁহার এক পুত্র ও দুই কন্যা ছিল। বাবুরামবাবু বলরাম ঠাকুরের সন্তান, এজন্য জাতিরক্ষার্থ কন্যাদ্বয় জন্মিবামাত্র বিস্তর ব্যয় ভূষণ করিয়া তাহাদের বিবাহ দিয়াছিলেন, কিন্তু জামাতারা কুলীন, অনেক স্থানে দারপরিগ্রহ করিয়াছিল— বিশেষ পারিতোষিক না পাইলে বৈদ্যবাটীর শ্বশুরবাটীতে উঁকিও মারিত না। পুত্র মতিলাল বাল্যাবস্থা অবধি আদর পাইয়া সর্বদা বাইন করিত—কখন বলিত বাবা চাঁদ ধরিব—কখন বলিত বাবা তোপ খাব। যখন চিৎকার করিয়া কান্দিতে আরম্ভ করিত নিকটস্থ সকল লোক বলিত ঐ বান্‌কে ছেলেটার জ্বালায় ঘুমানো ভার। বালকটি পিতা-মাতার নিকট আস্কারা পাইয়া পাঠশালায় যাইবার নামও করিত না। যিনি বাটীর সরকার তাঁহার উপর শিক্ষা করাইবার ভার ছিল। প্রথম প্রথম গুরু মহাশয়ের নিকটে গেলে মতিলাল আঁ আঁ করিয়া কান্দিয়া তাঁহাকে আঁচড় ও কামড় দিত—গুরুমহাশয় কর্তার নিকট গিয়া বলিতেন, মহাশয়! আপনার পুত্রকে শিক্ষা করানো আমার কর্ম নয়। কর্তা প্রত্যুত্তর দিতেন—ও আমার সবেধন নীলমণি-ভুলাইয়া-টুলাইয়া গায় হাত বুলাইয়া শেখাও। পরে বিস্তর কৌশলে মতিলাল পাঠশালায় আসিতে আরম্ভ করিল। গুরুমহাশয় পায়ের উপর পা, বেত হাতে দেয়ালে ঠেসান দিয়া ঢুলছেন ও বলছেন “ল্যাখ রে ল্যাখ।” মতিলাল ঐ অবকাশে উঠিয়া তাঁহার মুখের নিকট কলা দেখাচ্ছে আর নাচ্ছে — গুরুমশায় নাক ডাকিতেছেন—শিষ্য কি করিতেছে তাহা কিছুই জানেন না। তাঁহার চক্ষু উন্মীলিত হইলেই মতিলাল আপন পাততাড়ির নিকট বসিয়া কাগের ছা বগের ছা লিখিত। সন্ধ্যাকালে ছাত্রদিগকে ঘোষাইতে আরম্ভ করিলে মতিলাল গোলে হরিবোল দিত—কেবল গণ্ডার এণ্ডা ও বুড়িকা ও পণিকার শেষ অক্ষর বলিয়া ফাঁকি সিদ্ধান্ত করিত,—মধ্যে মধ্যে গুরুমহাশয় নিদ্রিত হইলে তাঁহার নাকে কাটি দিয়া ও কোঁচার উপর জলন্ত অঙ্গার ফেলিয়া তীরের ন্যায় প্রস্থান করিত। আর আহারের সময় চুনের জল ঘোল বলিয়া অন্য লোকের হাত দিয়া পান করাইত। গুরুমহাশয় দেখিলেন বালকটি অতিশয় ত্রিপণ্ড, মা সরস্বতীকে একবারে জলপান করিয়া বসিল, অতএব মনে করিলেন যদি এত বেত্রাঘাতে সুযুত না হইল, কেবল গুরুমারা বিদ্যাই শিক্ষা করিল তবে এমতো শিষ্যের হাত হইতে ত্বরায় মুক্ত হওয়া কর্তব্য, কিন্তু কর্তা ছাড়েন না—অতএব কৌশল করিতে হইল। বোধ হয় গুরুমহাশয়গিরি অপেক্ষা সরকারি ভালো, ইহাতে বেতন দুই টাকা ও খোরাক-পোষাক—উপরি লাভের মধ্যে তালপাত কলাপাত ও কাগজ ধরিবার কালে এক একটা সিধে ও এক এক জোড়া কাপড় মাত্র, কিন্তু বাজার সরকারি কর্মে নিত্য কাঁচা কড়ি। এই বিবেচনা করিয়া কর্তার নিকট গিয়া কহিলেন—মতিবাবুর কলাপাত ও কাগজ লেখা শেষ হইয়াছে এবং এক প্রস্থ জমিদারী কাগজও লেখানো গিয়াছে। বাবুরামবাবু এই সংবাদ পাইয়া আহ্লাদে মগ্ন হইলেন, নিকটস্থ পারিষদেরা বলিল— না হবে কেন! সিংহের সন্তান কি কখন শৃগাল হইতে পারে ?

পরে বাবুরাম বাবু বিবেচনা করিলেন ব্যাকরণাদি ও কিঞ্চিত ফার্সী শিক্ষা করানো আবশ্যক। এই স্থির করিয়া বাটীর পূজারী ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিলেন—কেমন হে তোমার ব্যাকরণ-ট্যাকরণ পড়াশুনা আছে ? পূজারী ব্রাহ্মণ গণ্ডমুর্খ—মনে করিল যে চাউল-কলা পাই তাতে তো কিছুই আঁটে না—এত দিনের পর বুঝি কিছু প্রাপ্তির পন্থা হইল, এই ভাবিয়া প্রত্যুত্তর করিল— আজ্ঞে হাঁ, আমি কুইনমোড়ার ঈশ্বরচন্দ্র বেদান্তবাগীশের টোলে ব্যাকরণাদি একাদিক্রমে পাঁচ বৎসর অধ্যয়ন করি, কপাল মন্দ, পড়াশুনার দরুন কিছুই লাভবান হয় না, কেবল আদা জল খাইয়া মহাশয়ের নিকট পড়িয়া আছি। বাবুরাম বাবু বলিলেন—তুমি অদ্যাবধি আমার পুত্রকে ব্যাকারণ শিক্ষা করাও। পূজারী ব্রাহ্মণ আশা বায়ুতে মুগ্ধ হইয়া মুগ্ধবোধ ব্যাকরণের দুই-এক পাত শিক্ষা করিয়া পড়াইতে আরম্ভ করিলেন। মতিলাল মনে করিলেন গুরু-মহাশয়ের হাত হইতে তো মুক্ত হইয়াছি এখন এ বেটা চাউল-কলাখেকো বামুনকে কেমন করিয়া তাড়াই? আমি বাপ-মার আদরের ছেলে—লিখি বা না লিখি, তাঁহারা আমাকে কিছুই বলিবেন না—লেখাপড়া শেখা কেবল টাকার জন্য—আমার বাপের অতুল বিষয়—আমার লেখাপড়ায় কাজ কি? কেবল নাম সহি করিতে পারিলেই হইল। আর যদি লেখাপড়া শিখিব তবে আমার এয়ারবক্সিদিগের দশা কি হইবে? আমোদ করিবার এই সময়,—এখন কি লেখা-পড়ার যন্ত্রণা ভালো লাগে ?

মতিলাল এই স্থির করিয়া পূজারী ব্রাহ্মণকে বলিল—অরে বামুন, তুই যদি হ, য, ব, র, ল, শিখাইতে আমার নিকট আর আসিস ঠাকুর ফেলিয়া দিয়া তোর চাউল-কলা পাইবার উপায় সুদ্ধ ঘুচাইয়া দিব কিন্তু বাবার কাছে গিয়া একথা বললে ছাতের উপর হতে তোর মাথায় এমন এক এগারঞ্চি ঝাড়িব যে তোর ব্রাহ্মণীকে কালই হাতের নোয়া খুলিতে হইবে। পূজারী ব্রাহ্মণ হ, য, ব, র, ল প্রসাদ্যৎ ক্ষণেক কাল হ, য, ব, র, ল হইয়া থাকিলেন পরে আপনা আপনি বিচার করিলেন—ছয় মাস প্রাণপণে পরিশ্রম করিয়াছি এক পয়সাও হস্তগত হয় নাই, আবার “লাভঃ পরং গোবধঃ” —প্রাণ নিয়া টানাটানি—এক্ষণে ছেড়ে দিলে কেঁদে বাঁচি। পূজারী ব্রাহ্মণ যৎকালে এই সকল পর্যালোচনা করিতেছিলেন মতিলাল তাঁহার মুখাবলোকন করিয়া বলিল—বড়ো যে বসে বসে ভাবছিস্? টাকা চাই? এই নে—কিন্তু বাবার কাছে গিয়া বল্ গে আমি সব শিখেছি। পূজারী ব্রাহ্মণ কর্তার নিকট গিয়া বলিল—মহাশয় মতিলাল সামান্য বালক নহে—তাহার অসাধারণ মেধা, যাহা একবার শুনে তাহাই মনে করিয়া রখে। বাবুরামবাবুর নিকট একজন আচার্য ছিল—বলিল, মতিলালের পরিচয় দিবার আবশ্যক নাই। উটি ক্ষণজন্মা ছেলে, বেঁচে থাকিলে দিক্পাল হইবে।

অনন্তর পুত্রকে ফার্সী পড়াইবার জন্য বাবুরাম বাবু একজন মুন্‌শী অন্বেষণ করিতে লাগিলেন। অনেক অনুসন্ধানের পর আলাদি দরজির নানা হবিবল হোসেন তেল কাঠ ও ১।।০ টাকা মাহিনাতে নিযুক্ত হইল। মুন্‌শী সাহেবের দন্ত নাই, পাকা দাড়ি, শনের ন্যায় গোঁফ, শিখাইবার সময় চক্ষু রাঙা করেন ও বলেন, ‘আরে বে পড়’ ও কাফ গাফ আয়েন গায়েন উচ্চারণে তাঁহার বদন সর্বদা বিকট হয়। একে বিদ্যা শিক্ষাতে কিছু অনুরাগ নাই তাতে ঐরূপ শিক্ষক অতএব মতিলালের ফার্সী পড়াতে ঐরূপ ফল হইল। এক দিবস মুন্‌শী সাহেব হেঁট হইয়া কেতাব দেখিতেছেন ও হাত নেড়ে সুর করিয়া মস্‌নবির বয়েত পড়িতেছেন ইত্যবসরে মতিলাল পিছন দিগ্ দিয়া একখান জ্বলন্ত টিকে দাড়ির উপর ফেলিয়া দিল। তৎক্ষণাৎ দাউদাউ করিয়া দাড়ি জ্বলিয়া উঠিল। মতিলাল বলিল—কেমন রে বেটা নেড়ে আমাকে পড়াবি? মুন্শী সাহেব দাড়ি ঝাড়িতে ঝাড়িতে ও তোবা তোবা বলিতে বলিতে প্রস্থান করিলেন এবং জ্বালার চোটে চিৎকার করিয়া বলিলেন—এস্ মাফিক বেতমিজ আওর বদ্জাৎ লেড়কা কাভি দেখা নেই—এস্ কাম্‌সে মুল্কমে চাস কর্ণা আচ্ছি হ্যায়। এস্ জেগে আনা ভি হারাম হ্যায়-তোবা-তোবা-তোবা !!!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *