৭. কয়েকদিন পরের ঘটনা

কয়েকদিন পরের ঘটনা।

চিন্তার পরপে সূর্যাস্ত হইতে বিলম্ব নাই। বারান্দার কিনারায় দাঁড়াইয়া চিন্তা একজন পথিকের অঞ্জলিবদ্ধ হস্তে জল ঢালিয়া দিতেছে। সন্ধ্যার পর পরপে আর কেহ আসে না, এই লোকটি বোধ হয় শেষ রাহী।

জল পান শেষ করিয়া পথিক যখন মুখ তুলিল তখন দেখা গেল, সে কান্তিলাল। কান্তিলাল আজ সুযোগ পাইয়া একাকী পরপে আসিয়াছে।

মুখ মুছিতে মুছিতে সে চিন্তার দিকে চোখ বাঁকাইয়া বেশ একটু ভঙ্গিমা সহকারে হাসিল, বলিল,–

কি পানিহারিন, পুরোনো রাহীকে চিনতেই পারছ না নাকি?

চিন্তা কান্তিলালকে বিলক্ষণ চিনিয়াছিল, সে গম্ভীর বিরক্তমুখে বলিল,–

জল খেলে, এবার নিজের কাজে যাও।

কান্তিলাল বারান্দার কিনারায় বসিল,–

সূয্যি ড়ুবতে চলল, এখন আর আমার কাজ কি? কথায় বলে, দিনের চাকর রাতের নাগর। এস দুদণ্ড বসে কথা কই

চিন্তা বলিল,-আমি সরকারের চাকর, যতক্ষণ সূর্য আকাশে থাকবে ততক্ষণ রাহীদের জল দিয়ে সেবা করা আমার কাজ। কিন্তু এখন আর আমি কারুর চাকর নই

কান্তিলাল বলিল,-আহা সেই কথাই তো বলছি পানিহারিন্! এখন তোমারও কাজ ফুরিয়েছে আমারও কাজ ফুরিয়েছে—একটু আমোদ করার এই তো সময়। নাও, বসো এসে—আজ আর এপথে কেউ আসছে না।

কান্তিলাল পদদ্বয় বারান্দার উপর তুলিয়া আরও জুত করিয়া বসিল।

চিন্তা কঠিন স্বরে বলিল,-যাও বলছি–নইলে—

কান্তিলাল এতক্ষণ নরম সুরে কথা বলিতেছিল, কিন্তু যখন দেখিল মিষ্টি কথায় চিড়া ভিজিবে না তখন সে মনের জঘন্যতা উদঘাটিত করিয়া হাসিল। বলিল,–

অত ছলকলায় দরকার কি পানিহারিন্! তুমিও জানো আমি কি চাই আর আমিও জানি তুমি কি চাও

চিন্তা বাহিরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল,-

যাও—ভাল চাও তো এখনই যাও

কান্তিলাল বলিল,-আর যদি না যাই? কি করবে? জোর করে তাড়িয়ে দিতে পারবে? বেশ—চলে এস—দেখি তোমার গায়ে কত জোর— বলিয়া কান্তিলাল কৌতুকভরে বাহ্বাস্ফোট করিয়া উচ্চহাস্য করিতে লাগিল। কিন্তু তাহার হাস্য দীর্ঘস্থায়ী হইল না; এই সময় একটি বলিষ্ঠ হস্ত আসিয়া তাহার কর্ণধারণপূর্বক এমন সজোরে নাড়া দিল যে কান্তিলালের হাসি মুদারাগ্রাম ছাড়িয়া কাতরোক্তির তারাগ্রামে গিয়া উঠিল।

কে রে তুই? ছাড় ছাড়

কর্ণধারণ করিয়াছিল নানাভাই। নানাভাইয়ের সাজ-পোষাক সাধারণ পথিকের মতই, উত্তরীয়ের একপ্রান্তে একটি মধ্যমাকৃতি পুঁটুলি পিঠের উপর ঝুলিতেছে। নানাভাই চিন্তার পানে চাহিয়া প্রশ্ন করিল,—

পানিহারিন, লোকটা কি তোমাকে বিরক্ত করছে?

চিন্তা নীরবে ঘাড় নাড়িল। কান্তিলালের কান তখনও নানার আঙুলের জাঁতিকলে ধরা ছিল, সে উঠিবার চেষ্টা করিতে করিতে তর্জন করিল,

কে তুই? এতবড় আস্পর্ধা

নানাভাই কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া কান্তিলালকে কান ধরিয়া টানিয়া দাঁড় করাইল। বলিল,–

আমিও তোর মত একজন রাহী কিন্তু তোর মত ছোটলোক নই। যা, আর এখানে দাঁড়ালে বেইজ্জত হয়ে যাবি।

বেইজ্জত!

হ্যাঁ, তোর নাক কান কেটে নেব। –যা

নানাভাই কান ছাড়িয়া দিল। কান্তিলাল দেখিল আততায়ীর চেহারা যেমন নিরেট, চোখের দৃষ্টিও তেমনি কড়া। সে আর বাগ-বিতণ্ডায় সময় নষ্ট করিল না, পদাহত কুকুরের মত পলায়ন করিল। যাইবার সময় চিন্তার পানে একটা বিষাক্ত অপাঙ্গ-দৃষ্টি হাসিয়া অস্ফুটকণ্ঠে বলিয়া গেল,

আচ্ছা

কান্তিলাল অদৃশ্য হইয়া গেলে নানাভাই পুঁটুলি নামাইয়া বারান্দার ধারে বসিল। বলিল,–

চিন্তাবেন, দেশে পাজি লোকের অভাব নেই, তুমি সাবধানে থাকো তো?

চিন্তা বলিল,-ভয় নেই, দরকার হলে আমার কাটারি আছে। কিন্তু তোমার পুঁটুলিতে ও কী নানাভাই?

নানাভাই বলিল,—আর বল কেন? তিলুবেনের কুড়মুড়া খাবার ইচ্ছে হয়েছিল তাই অনেক সন্ধান করে নিয়ে যাচ্ছি।

চিন্তা হাসিয়া বলিল,-আহা বেচারা! নানাভাই, তোমার সঙ্গে জরুরী কথা আছে। আজ সকালে ঝরনায় জল ভরতে গিয়ে–। কিন্তু আগে তোমায় জলপান দিই, তারপর বলব।

.

রাত্রিকাল। দস্যুদের গুহার অভ্যন্তর। কয়লার গগনে আগুনের সম্মুখে বসিয়া তিলু মোটা মোটা বাজরির রুটি সেঁকিতেছে। নানাভাই ছাড়া আর সকলে আগুন ঘিরিয়া বসিয়াছে; দিনের বেলা যতই গরম হোক, রাত্রে এই পাহাড়ের অধিত্যকায় বেশ ঠাণ্ডা পড়ে। হাতে কোন কাজ নাই, তাই সকলে মিলিয়া তিলুকে খেপাইতেছিল; এমন কি তেজ সিংও গম্ভীর মুখে এই কৌতুকে যোগ দিয়াছিলেন।

পুরন্দর উদ্বিগ্নমুখে বলিল,-নানাভাই এখনও ফিরল না—

প্রভু বলিল,— হুঁ–রাত কম হয়নি।

ভীমভাই একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস মোচন করিল। বলিল,–

বলতে নেই হয়তো ধরা পড়ে গেছে

তিলু দুই হাতে রুটি গড়িতে গড়িতে ক্রুদ্ধ চোখে তাহার পানে চাহিল। বলিল,-

যা তা বোলো না। নানাভাই এখনি ফিরে আসবেন। তিনি বলে গেছেন তাঁর ফিরতে একটু দেরি হতে পারে।

তেজ সিং বলিলেন,—কাজটা ভাল হয়নি তিলুবেন। নানাভাইয়ের মত একজন দুর্দান্ত ডাকাতকে মুড়ি আনতে পাঠানো— তিনি দুঃখিতভাবে মাথা নাড়িলেন।

প্রতাপ উদাসকণ্ঠে বলিল,-হয়তো সেই লজ্জাতেই নানাভাই দল ছেড়ে চলে গেছে। হাজার হোক বীরপুরুষ তো। তাকে মুড়ি আনতে বলা— প্রতাপও মাথা নাড়িল।

সকলে দুঃখিতভাবে মাথা নাড়িল। তিলুর মুখ কাঁদো কাঁদো হইয়া উঠিল, সে হাতের রুটি রাখিয়া কাতরকণ্ঠে বলিল,-

আমি বলিনি—আমি বলিনি নানাভাইকে মুড়ি আনতে। আমি খালি বলেছিলাম

পুরন্দর বলিল,—তুমি যা বলেছিলে সে তো আমরা সবাই শুনেছি। সেকথা শোনবার পর নানাভাইয়ের মত একজন কোমলপ্রাণ ডাকাত কি আর স্থির থাকতে পারে! সে না গেলে আমি যেতাম

ভীমভাই বলিল,-কেউ না গেলে শেষ পর্যন্ত আমাকেই যেতে হয়। বলতে নেই—

তিলু ব্যাকুলনেত্রে সকলের মুখের পানে চাহিতে চাহিতে তেজ সিংয়ের ঠোঁটের কোণে একটু হাসি লক্ষ্য করিয়া হঠাৎ বুঝিতে পারিল সকলে তাহাকে লইয়া তামাশা করিতেছে। তিলুর সমস্ত রাগ গিয়া পড়িল ভীমভাইয়ের উপর। একদলা বাজরির নেচি তুলিয়া লইয়া সে ভীমভাইকে ছুঁড়িয়া মারিল।

এই সময় গুহামুখে মানুষের গলার আওয়াজ হইল; আওয়াজ গুহার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হইয়া ভয়ঙ্কর শুনাইল

হুঁশিয়ার!

সকলে ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। কিন্তু ভয়ের কারণ ছিল না; পরক্ষণেই নানাভাই আলোকচক্রের মধ্যে আসিয়া দাঁড়াইল। সঙ্গে একটি স্ত্রীলোক, স্ত্রীলোকের চক্ষু কাপড় দিয়া বাঁধা।

নানাভাই বলিল,-প্রতাপ বারবটিয়া, একজন স্ত্রীলোক তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায় বলিয়া চোখের কাপড় খুলিয়া দিল। সকলে চমৎকৃত হইয়া দেখিল—চিন্তা।

প্রতাপ হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে বলিল,-চিন্তা!

তিলু একঝাঁক ছাতারে পাখির মত আনন্দকুজন করিতে করিতে ছুটিয়া গিয়া চিন্তাকে জড়াইয়া ধরিল।

অতঃপর চিন্তার প্রথম গুহায় আগমনের আনন্দ-সংবর্ধনা কথঞ্চিৎ শান্ত হইলে সকলে আবার আগুন ঘিরিয়া বসিয়াছে এবং পরম তৃপ্তির সহিত মুড়ি চিবাইতেছে। চিন্তার একপাশে প্রতাপ, অন্যপাশে তিলু তাহার একটা বাহু দৃঢ়ভাবে ধরিয়া আছে, যেন ছাড়িয়া দিলেই সে পায়রার মত উড়িয়া যাইতে পারে।

চিন্তা চারিদিকে চোখ ফিরাইয়া সকলকে দেখিতেছে; তাহার মুখে অসুয়া-বিদ্ধ হাসি

তোমাদের দেখলে আমার হিংসে হয়। আমিও যদি এখানে এসে থাকতে পারতাম!

সকলে অপ্রতিভভাবে নীরব রহিল; ভীমভাই এক খাবলা মুড়ি মুখে ফেলিয়া অর্ধমুদিত নেত্রে চিবাইতে চিবাইতে বলিল,-

আমাদেরই কি সাধ হয় না চিন্তাবেন। তুমি এলে, বলতে নেই, তিলুর রান্না থেকে মাঝে মাঝে কিঞ্চিৎ মুখবদল হত।

সকলের মুখে হাসি ফুটিয়া উঠিল; তিলুও হাসিল। চিন্তা নিশ্বাস ফেলিল। বলিল,-

যা হবার নয় তা ভেবে আর কি হবে? আমাকে কিন্তু রাত পোহাবার আগেই ফিরতে হবে। কে আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে?

পুরন্দর বলিল,—সে জন্য ভেবো না বেন। আমরা সবাই মিছিল করে তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসব।

প্রতাপ বলিল,-তার এখনও অনেক দেরি আছে। মিছিল করবার দরকার নেই, আমি আর মোতি চিন্তাকে খুব শিগগির পৌঁছে দিতে পারব। আকাশে চাঁদ আছে—

ভীম আস্তেব্যস্তে উঠিয়া দাঁড়াইল, বলিল,-

হুঁ হুঁ—আকাশে চাঁদ আছে। বলতে নেই কথাটা এতক্ষণ খেয়ালই হয়নি। দীর্ঘ বিরহের পর তরুণ তরুণীর যখন মিলন হয় তখন তারা কিঞ্চিৎ নিরিবিলি খোঁজে। চল, আমরা বাইরে গিয়ে বসি।

প্রতাপ বলিল,—ভীম, পাগলামি করো না–বসো। চিন্তা, কোনও খবর আছে নাকি?

চিন্তা বলিল,-খবর দিতেই তো এলাম। চিঠিতে অত কথা লেখা যায় না; নানাভাই বললেন মুখে সব কথা না বললে হবে না তাই

প্রতাপ বলিল—কি কথা?

চিন্তা একটু নীরব থাকিয়া বলিতে আরম্ভ করিল,—

আজ সকালে একটা ব্যাপার ঘটেছে। আমি রোজ যেমন জল ভরতে যাই তেমনি ঝরনায় গিয়ে দেখি—

.

ভোরের আলোয় ঝরনার সঞ্চিত জলাশয় ঝিলমিল করিতেছে। চিন্তা কলস কাঁখে জল ভরিতে আসিতেছে; প্রায় জলের কিনারা পর্যন্ত পৌঁছিয়া চিন্তা থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল।

তাহার দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া দেখা যায়, একটা অর্ধনিমজ্জিত পাথরের আড়ালে প্রায় এক কোমর জলে দুটি যুবক-যুবতী দাঁড়াইয়া আছে–যুবকের বাঁ হাত যুবতীর ডান হাতের সহিত শক্ত করিয়া দড়ি দিয়া বাঁধা। তাহারা চিন্তাকে দেখিতে পায় নাই, তীরের দিকে পিছন ফিরিয়া ধীরে ধীরে গভীর জলের দিকে অগ্রসর হইতেছে।

চিন্তার কটি হইতে কলস পড়িয়া গেল; সে অস্ফুট চিৎকার করিয়া ছুটিতে ছুটিতে জলের কিনারায় গিয়া দাঁড়াইল। ইহারা দুইজন যে মৃত্যুপণে আবদ্ধ হইয়া হাতে হাত বাঁধিয়া জলে নামিতেছে তাহা বুঝিতে তাহার বিলম্ব হইল না।

জলের মধ্যে দুইজন শব্দ শুনিতে পাইয়াছিল, তাহারা চমকিয়া ফিরিয়া চাহিল। চিন্তাকে দেখিয়া তাহাদের মুখের ভাব পরিবর্তিত হইল; তাহারা যেন মনের মধ্যে মৃত্যুর পরপারে চলিয়া গিয়াছিল, এখন বাধা পাইয়া আবার জীবন্ত-লোকে ফিরিয়া আসিল।

চিন্তা দুই হাত নাড়িয়া তাহাদের ডাকিল।

যুবক-যুবতী কাতরনেত্রে পরস্পরের পানে চাহিল। কি করিবে এখন তাহারা; এক ব্যক্তি দাঁড়াইয়া দেখিতেছে এ অবস্থায় আত্মহত্যা করা যায় না। তাহারা কিছুক্ষণ ইতস্তত করিয়া ধীরে ধীরে তীরের পানে ফিরিয়া আসিতে লাগিল।

যুবক-যুবতী তীরে আসিয়া একটি পাথরের উপর বসিল। যুবক লজ্জিতমুখে হাতের বন্ধন খুলিয়া ফেলিল। তাহাদের যুবক যুবতী না বলিয়া কিশোর-কিশোরী বলিলেই ভাল হয়; ছেলেটির বয়স কুড়ির বেশী নয়, মেয়েটির পনেরো-যোলো। দুজনেই সুশ্রী, মুখে বয়সোচিত সরলতা মাখানো।

চিন্তা দূরে আর একটি পাথরের উপর বসিয়া করলগ্নকপোলে দেখিতে দেখিতে বলিল,–

তোমাদের বাড়ি কোথায়?

ছেলেটি কুণ্ঠা-লাঞ্ছিত মুখ তুলিল, বলিল,-

দহিসার গ্রামে এখান থেকে প্রায় দু ক্রোশ দূরে—

চিন্তা বলিল,-তোমরা একাজ করতে যাচ্ছিলে কেন?

ছেলেটি কাতরস্বরে বলিল,-আমাদের আর উপায় ছিল না বেন। আমি প্রভাকে বিয়ে করতে চাই—প্রভাও আমাকে

প্রভা কুমারী-সুলভ গর্বে একটু ঘাড় বাঁকাইল।

চিন্তা বলিল,-তারপর?

ছেলেটি বলিল,-প্রভার বাপু পাশের গাঁয়ের মহাজনের কাছে অনেক টাকা ধার করেছেন, শোধ দেবার ক্ষমতা নেই। বুড়ো মহাজন বলেছে তার সঙ্গে প্রভার বিয়ে দিতে হবে, নইলে সে প্রভার বাপুর জমিজমা ঘরবাড়ি সব দখল করে নেবে।

চিন্তা বলিল,-প্রভার বাপু রাজী হয়েছেন?

হু–কাল বিয়ে।

তাই তোমরা আত্মহত্যা করতে এসেছ—

চিন্তা উঠিয়া গিয়া তাহাদের মাঝখানে বসিল, দুহাতে দুজনের স্কন্ধ জড়াইয়া লইয়া বলিল,-

শোনো, তোমরা আত্মহত্যা করো না—গ্রামে ফিরে যাও

দুজনে অবাক হইয়া চিন্তার মুখের পানে চাহিল।

চিন্তা বলিল,-যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। মহাজনের সঙ্গে বিয়ে আমি রদ করবার চেষ্টা করব। যদি না পারি, বিয়ের পর তোমরা যা ইচ্ছে করো—

.

গুহামধ্যে চিন্তা গল্প বলা শেষ করিয়া কহিল,

আমি তাদের আশ্বাস দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছি। এখন তাদের জীবন-মরণ তোমাদের হাতে।

প্রতাপ আগুনের পানে চাহিয়া থাকিয়া বলিল,-

কাল বিয়ে?

চিন্তা রলিল,-হ্যাঁ, আজ রাত পোহালে কাল বিয়ে।

প্রতাপ তেজ সিংয়ের দিকে ফিরিল।

সর্দারজী, আপনি কি বলেন? মহাজনের সঙ্গে বিয়ে হতে দেওয়া উচিত?

তেজ সিং অপ্রতিভভাবে ক্ষণেক ইতস্তত করিলেন। শেষে বলিলেন,-না।

প্রতাপ বলিল,-কিন্তু আইনে এর কোন দাবাই আছে কি?

তেজ সিং বলিলেন,-না।

প্রতাপ বলিল,-তাহলে জোর করে এ বিয়ে ভেঙে দিই?

তেজ সিং বললেন,—হ্যাঁ।

সকলের মুখে পরিতৃপ্তির হাসি ফুটিয়া উঠিল। ভীমভাই নানাভাইয়ের পেটে গোপনে কনুইয়ের একটি গুঁতা মারিয়া চোখ টিপিল।

.

পরদিন সন্ধ্যা। দহিসার গ্রামে প্রভার পিতৃ-ভবনে সানাই বাজিতেছে। প্রভার পিতা মধ্যবিত্ত ভদ্র গৃহস্থ। তাঁহার বাড়ির উন্মুক্ত অঙ্গনে বিবাহমণ্ডপ রচিত হইয়াছে—গ্রাম্যরীতিতে যতদূর সম্ভব। সুসজ্জিত হইয়াছে। গ্রামের নিমন্ত্রিত ব্যক্তিরা একে একে আসিয়া আসরে বসিতেছেন। বরের আসন এখনও শূন্য রহিয়াছে।

বাড়ির অন্দরে একটি ঘরে অনেকগুলি স্ত্রীলোক বধূ-বেশিনী প্রভাকে ঘিরিয়া বসিয়াছে। সকলে মাঙ্গলিক-গীতি গাহিতেছে, কেহ বা বধূকে সাজাইয়া দিতেছে, কিন্তু কাহারও মুখে হাসি নাই। প্রভা চুপটি করিয়া বসিয়া আছে, মাঝে মাঝে চকিত হরিণীর মত সশঙ্ক-চোখে সকলের মুখের পানে তাকাইতেছে। সে মনে মনে বড় ভয় পাইয়াছে তাহা তাহার মুখ দেখিলেই বোঝা যায়। কাল যখন ড়ুবিয়া মরিতে গিয়াছিল তখন তাহার মুখে এমন ভয়ের ছাপ পড়ে নাই।

বাড়ির সদরে বারান্দার এক কোণে একটি ঘরের মধ্যে বর ও বরযাত্রীদের স্থান নির্দিষ্ট হইয়াছে। বরের সহিত নাপিত পুরোহিত এবং গুটিকয়েক প্রৌঢ় বরযাত্রী আসিয়াছে। বর রূপচন্দ মহাজনের চেহারাটি পাকানো বংশ-যষ্টির মত, গোঁফ অধিকাংশ পাকিয়া গিয়াছে, গালের শুষ্ক চর্ম কুঞ্চিত হইয়া ভিতর দিকে চুপসাইয়া গিয়াছে, বেশ-ভূষা সমাপ্ত করিয়া এখন মুখের প্রসাধনে মন দিয়াছেন। কিন্তু মুখখানা কিছুতেই মনের মত হইতেছে না। নাপিত তাঁহার মুখের সম্মুখে একটি ছোট আয়না ধরিয়া রাখিয়াছে, তিনি তাহাতে মুখ দেখিতেছেন এবং নানা ভঙ্গি করিয়া, কী উপায়ে মুখখানাকে উন্নত করা যায়, তাহারই চেষ্টা করিতেছেন।

একটা থালার উপর অনেকগুলি পান রাখা ছিল, বর মহাশয় তাহাই এক থাবা তুলিয়া মুখের মধ্যে পুরিয়া দিলেন, তবু যদি গাল দুটি পরিপুষ্ট দেখায়! অতঃপর চুলের কি করা যায়? মাথায় না হয় পাগড়ি থাকিবে কিন্তু গোঁফের অম্লান পরিপক্কতা ঢাকা পড়িবে কি রূপে? বিভ্রান্তভাবে গোঁফের প্রান্ত ধরিয়া টানিতে টানিতে শেঠ নাপিতকে শুধাইলেন,

কি করি বল না রে! গোঁফজোড়া যে বড্ড সাদা দেখাচ্ছে। কামিয়ে দিবি?

হঠাৎ দ্বারের নিকট হইতে অট্টহাস্যে প্রশ্নের জবাব আসিল। শেঠ চমকিয়া দেখিলেন, একজন পাহাড়ী ঝোলা কাঁধে লইয়া দাঁড়াইয়া আছে। তাহার চোখে কাজল, চুলে ধনেশ পাখির পালক। পাহাড়ী হাসিতে হাসিতে বলিল,-

বল কি শেঠ? এ কি বাপের শ্রাদ্ধ করতে এসেছ যে গোঁফ কামিয়ে ফেলবে? আরে ছি ছি ছি। তোমার নতুন বৌ দেখলে বলবে কি?

শেঠ রূপচন্দ নবজাগ্রত কৌতূহলের সহিত আগন্তুককে নিরীক্ষণ করিলেন।–

পাহাড়ী মনে হচ্ছে! জড়িবুটি কিছু জানো নাকি?

পাহাড়ী ঘরে প্রবেশ করিল। বলিল,–

তা জানি বৈ কি। আমার এই ঝোলার মধ্যে এমন চীজ আছে, তোমাকে পঁচিশ বছরের ছোকরা বানিয়ে দিতে পারি শেঠ-পঁচিশ বছরের ছোকরা।

রূপচন্দ উৎফুল্ল হইলেন,—অ্যাঁ—তা বসো বসো। পণ্ডিতজী, লগনের এখনও দেরি আছে তো?

পুরোহিত বলিলেন,-এখনও দুঘড়ি দেরি আছে।

পাহাড়ী বলিল,-আমি এক ঘড়ির মধ্যে তোমার ভোল বদলে দেব শেঠ। কিন্তু তোমার সঙ্গীদের বাইরে যেতে বল, এসব যন্তর-মন্তর একটু আড়ালে করতে হয়

রূপচন্দ বলিলেন,—বেশ তো—বেশ তো। তোমরা সব আসরে গিয়ে বসো, পান তামাক খাও। লগন হলে আমাকে খবর দিও।

সঙ্গীরা সকলে বাহির হইয়া গেল। পাহাড়ী ভিতর হইতে দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া শেঠের সম্মুখে আসিয়া বসিল। শেঠের মুখের পানে চাহিয়া হাসিতে হাসিতে সে ঝোলার মধ্যে হাত পুরিয়া একটি ভীষণদর্শন ছোরা বাহির করিয়া সহসা শেঠের বুকের উপর ধরিল। বলিল,-

চুপটি করে থাকো শেঠ। নইলে তোমার চেহারা এমন বদলে যাবে যে কিছুতেই মেরামত হবে না।

পাহাড়ী স্বয়ং প্রতাপ।

.

রাত্রি হইয়াছে, বিবাহমণ্ডপে আলো জ্বলিতেছে। বরযাত্রী কন্যাযাত্রীর সমাগমে আসর ভরিয়া গিয়াছে। বরযাত্রী কয়জন একস্থানে সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া বসিয়াছেন এবং পান বিড়ি সেবন করিতেছেন।

কন্যার বাপ অবগুণ্ঠিতা কন্যাকে অন্দর হইতে আনিয়া আসরে পিঁড়ির উপর বসাইয়া দিলেন। পুরোহিত কিছু মন্ত্র পড়িলেন, তারপর হাঁকিলেন,-

এবার বরকে নিয়ে এস।

বরযাত্রীরা উঠি উঠি করিতেছেন এমন সময় বর নিজেই আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বরের পাগড়ি হইতে মুখের উপর শোলার ঝালর ঝুলিতেছে। সকলে সরিয়া গিয়া বরের পথ ছাড়িয়া দিল গিয়া কন্যার সম্মুখে পিঁড়ির উপর বসিলেন।

বরের মুখ যদিও কেহই দেখিতে পাইল না, তবু তাঁহার যুবজনোচিত অঙ্গসঞ্চালন দেখিয়া সকলেই একটু বিস্মিত হইল। একজন বরযাত্রী অন্য একটি বরযাত্রীর কানে কানে বলিল,-

পাহাড়ী ভেলকি দেখিয়ে দিয়েছে একেবারে ঠাট বদলে দিয়েছে–অ্যাঁ!

অতঃপর বিবাহবিধি আরম্ভ হইল, পুরোহিত আড়ম্বর সহকারে অতি দ্রুত মন্ত্র পড়িতে লাগিলেন। মণ্ডপের আনাচে-কানাচে পাঁচটি লোক উপস্থিত ছিল, কিন্তু কেহ তাহাদের ভাল করিয়া লক্ষ্য করে নাই। তাহারা গ্রামের লোক নয়, কিন্তু অপরিচিত লোক দেখিয়া কেহ কিছু সন্দেহ করে নাই; বরযাত্রীরা ভাবিয়াছিল, তাহারা কন্যাপক্ষীয় লোক এবং কন্যাপক্ষীয়েরা ভাবিয়াছিল, বরযাত্রী ছাড়া আর কে হইতে পারে। বিবাহবাসরে এরূপ ভ্রান্তি প্রায়ই ঘটিয়া থাকে।

নানাভাই, প্রভু, ভীমভাই, পুরন্দর ও তেজ সিং একটি একটি খুঁটি ধরিয়া দাঁড়াইয়া বিবাহক্রিয় দেখিতেছিলেন; প্রতাপ বরকন্যার আসনের কাছে ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। তাহার আর পাহাড়ী-বেশ নাই, ঝোলা অন্তর্হিত হইয়াছে; কেবল কোমর হইতে একটি মধ্যমাকৃতি থলি ঝুলিতেছে।

পুরোহিত বর বধুর হস্ত সংযুক্ত করিয়া দিয়া তাহার উপর একটি নারিকেল রাখিয়া প্রবল বেগে মন্ত্র পড়িতে লাগিলেন।

অধঘণ্টা মধ্যে বিবাহক্রিয়া সমাপ্ত হইল।

পুরোহিত ও কন্যার পিতা উঠিয়া দাঁড়াইলেন; পুরোহিত সভার দিকে ফিরিয়া বলিলেন,–

বিবাহবিধিঃ সমাপ্তা। সজ্জনগণ, নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করুন।

সভা হইতে মৃদু হর্ষধ্বনি উঠিল, কিন্তু পরক্ষণেই তাহা নীরব হইল। সকলে দেখিল, একজন অপরিচিত ব্যক্তি বরবধুর নিকটে গিয়া দাঁড়াইয়াছে; ঈষৎ হাসিয়া সে বর ও বধুর মুখ হইতে আবরণ সরাইয়া দিল।

অপরিচিত ব্যক্তির এই স্পর্ধায় সকলেই অসন্তুষ্ট হইত কিন্তু বরের মুখ দেখিয়া তাহা ভুলিয়া গেল। এ তো বৃদ্ধ মহাজন রূপচন্দ নয়; পাহাড়ীর ভেলকিবাজিও শুষ্ক মহাজনকে কুড়ি বছরের কমকান্তি যুবকে পরিণত করিতে পারে না। তাছাড়া যুবকটি গ্রামের সকলেরই পরিচিত। প্রথম বিমুঢ়তার চটকা ভাঙিলে সভা হইতে একজন বলিয়া উঠিল,

আরে এ যে চন্দু—আমাদের পাড়ার চন্দু।

প্রতাপ নত হইয়া প্রভার কানে প্রশ্ন করিল,-

বেন, চোখ তুলে দেখ। বর পছন্দ হয়েছে?

প্রভা একবার শঙ্কা-নিবিড় চোখ দুটি তুলিল, ক্ষণেকের জন্য বিস্ময়ানন্দে তাহার মুখ ভরিয়া উঠিল, তারপর সে চক্ষু নত করিল।

বরযাত্রিগণ এতক্ষণে সংবিৎ ফিরিয়া পাইয়াছিলেন এবং নিঃসংশয়ে বুঝিয়াছিলেন যে বরাসনে যে ব্যক্তি বসিয়া আছে সে আর যে হোক রূপচন্দ মহাজন নয়। তাঁহারা একজোটে উঠিয়া দাঁড়াইলেন, একজন সক্রোধে প্রশ্ন করিলেন,

এ কি—এ সব কী! আমাদের বর কোথায়?

প্রতাপের মুখে প্রশান্ত হাসি ফুটিয়া উঠিল, সে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া মণ্ডপের প্রবেশপথের দিকে দেখাইল।

ছিন্নবাস আলুথালু বেশে শেঠ প্রবেশ করিতেছেন। এখনও তাঁহার হাত হইতে দড়ি ঝুলিতেছে। প্রতাপ তাঁহার মুখ বাঁধিয়া হাত-পা বাঁধিয়া ঘরের মধ্যে রাখিয়া আসিয়াছিল, সেই অবস্থা হইতে তিনি বহুকষ্টে মুক্ত হইয়া ছুটিয়া বাহির হইয়াছেন। কোনও দিকে দৃকপাত না করিয়া তিনি বরাসনের অভিমুখে ধাবিত হইলেন। বর-বধুর দিকে জ্বলন্ত অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া তিনি শেষে কন্যার পিতার পানে ফিরিলেন—

দাগাবাজ জোচ্চোর! আমাকে এই অপমান! তোর সর্বনাশ করব আমি। তোর ভিটেমাটি চাটি করব—

প্রতাপ শান্ত কণ্ঠে কহিল,

রাগ করো না শেঠ, যা হয়েছে ভালই হয়েছে।

শীর্ণ দেহ ধনুকের মত বাঁকাইয়া শেঠ প্রতাপের পানে ফিরিলেন।

তুই কে রে—তুই কে? অ্যা পাহাড়ী।

প্রতাপের মুখ গম্ভীর হইল, সে গলা চড়াইয়া সকলকে শুনাইয়া বলিল,–

পাহাড়ী নই—আমি প্রতাপ বারবটিয়া।-শেঠ, আমি একলা আসিনি—আমার সঙ্গীরা এই সভাতেই আছে, সুতরাং কেউ গোলমাল করবার চেষ্টা করো না। এই ঘাটের মড়ার সঙ্গে প্রভাবেনের বিয়ে দিলে শুধু প্রভার বাপের নয়, গাঁসুদ্ধ লোকের অধর্ম হত। আমরা সেই অধর্ম থেকে তোমাদের রক্ষা করেছি। কিন্তু এমন কাজ ভবিষ্যতে আর করো না। —মহাজন, তোমার টাকা তুমি ফেরত পাবে, এখন বাড়ি ফিরে যাও। মনে থাকে যেন, প্রভার বাপের ওপর যদি কোনও জুলুম হয় আবার আমরা ফিরে আসব।—প্রভাবেন, এই নাও তোমার বিয়ের যৌতুক, এই দিয়ে তোমার বাপুর ঋণ শোধ করো।

প্রতাপ কোমর হইতে থলি লইয়া প্রভার কোলের উপর একরাশ মোহর ঢালিয়া দিল। সভাসুদ্ধ লোক হর্ষধ্বনি করিয়া উঠিল।

.

চাঁদনী রাত্রি। সুদূরপ্রসারী আবছায়া প্রান্তরের উপর দিয়া প্রতাপের দল ফিরিয়া চলিয়াছে, ছয়টি ঘোড়া পাশাপাশি ছুটিতেছে। তাহাদের সম্মুখে নবোদিত পূর্ণচন্দ্র পূর্বগগনে স্থির হইয়া আছে।

ছুটিতে ছুটিতে একটি ঘোড়া দল হইতে পৃথক হইয়া গেল—সে মোতি। প্রতাপ তাহার পৃষ্ঠ হইতে হাত নাড়িয়া বলিল,-

তোমরা ফিরে যাও—আমি কাল সকালে ফিরব।

প্রতাপ ক্রমে দল হইতে দূরে সরিয়া গেল। দলের পাঁচটি ঘোড়া পাশাপাশি চলিয়াছে—মাঝখানে তেজ সিং। নানাভাই তাঁহার পানে চাহিয়া একটু হাসিল। বলিল,

তৃষ্ণার্ত বিরহী জলের সন্ধানে চলল।

ভীমভাই বিমর্ষভাবে মাথা নাড়িল— বলতে নেই পরের বিয়ে দেখলে মনটা কিঞ্চিৎ খারাপ হয়ে যায়। আমারও তিলুর জন্যে

ভীমের ঘোড়া সকলকে ছাড়াইয়া আগে বাড়িল।

চন্দ্র আকাশে হাসিতেছে।

.

চিন্তার পরপের সম্মুখ দিয়া পথের যে অংশ গিয়াছে, একজন অশ্বারোহী সেই চড়াইপথে পরপের দিকে অগ্রসর হইতেছে। চাঁদের আলোয় দুর হইতে দেখিলে মনে হয় বুঝি প্রতাপ, কিন্তু কাছে আসিলে দেখা যায় কান্তিলাল। খর্বাকৃতি ঘোড়ার পশ্চাদ্ভাগে খেজুরছড়ি দিয়া তাড়না করিতে করিতে কান্তিলাল অভিসারে চলিয়াছে।

পরপের দৃষ্টিসীমার মধ্যে পৌঁছিয়া সে ঘোড়া হইতে নামিল, ঘোড়ার রাস ধরিয়া রাস্তা হইতে কিছু দূরে একটি শুষ্ক বৃক্ষের শাখায় তাহাকে বাঁধিল; তারপর আপন মনে দন্ত বিকীর্ণ করিয়া হাসিতে হাসিতে লঘুপদে পরপের দিকে চলিল।

পরপের বারান্দার উপর জ্যোৎস্না পড়িয়াছে, ঘরের দ্বার রুদ্ধ। কান্তিলাল পা টিপিয়া টিপিয়া বারান্দায় উঠিতে যাইবে এমন সময় দ্রুত অশ্বক্ষুরধ্বনি শুনিয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। ক্ষুরধ্বনি পরপের দিকে আগাইয়া আসিতেছে। কান্তিলাল ক্ষণেক উৎকর্ণ হইয়া শুনিল, তারপর দ্রুত ফিরিয়া গিয়া একটি ঝোপের আড়ালে লুকাইল।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রতাপকে মোতির পৃষ্ঠে আসিতে দেখা গেল। কান্তিলাল ঝোপের ফাঁক দিয়া উঁকি মারিয়া প্রতাপকে দেখিল, কিন্তু আবছায়া-আলোতে ঠিক চিনিতে পারিল না। প্রতাপ মোতির পৃষ্ঠ হইতে বারান্দায় নামিয়া মোতিকে ছাড়িয়া দিল, তারপর দ্বারে গিয়া টোকা মারিল।

চিন্তা, দোর খোলো—আমি প্রতাপ।

ঝোপের আড়ালে কান্তিলালের চোখদুটা ধক করিয়া উঠিল। প্রতাপ! প্রতাপ বারবটিয়া! সে আবার ঝোপের ফাঁক দিয়া দেখিল, সম্মুখেই মোতি দাঁড়াইয়া আছে। হ্যাঁ, প্রতাপের ঘোড়াই তো বটে। কান্তিলালের সমস্ত শরীর প্রবল উত্তেজনায় শক্ত হইয়া উঠিল।

ওদিকে চিন্তা দ্বার খুলিয়াছিল; প্রতাপ ভিতরে প্রবেশ করিয়া আবার দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। কান্তিলাল উত্তেজনা-প্রজ্বলিত চোখে শুষ্ক অধর লেহন করিল।

ঘরের ভিতরটি প্রদীপের মৃদু-আলোকে স্নিগ্ধ হইয়া আছে। প্রতাপ ও চিন্তা বাহুতে বাহু জড়াইয়া মুখোমুখি দাঁড়াইয়া আছে। প্রতাপের মুখে একটু করুণ হাসি, চিন্তার সদ্য ঘুমভাঙা চোখে বিস্ময়ানন্দের কিরণ। প্রতাপ যে আজই আবার আসিবে তাহা সে আশা করিতে পারে নাই।

কী হল—প্রভার বিয়ে?

প্রতাপ বলিল,-হয়ে গেল (চিন্তার সপ্রশ্নদৃষ্টির উত্তরে) হাঁ, ঠিক লোকের সঙ্গেই। কিন্তু

চিন্তা বলিল,-কিন্তু কি?

প্রতাপ বলিল,-কিন্তু নয়, সবই ঠিক হয়েছে। কিন্তু ফিরে আসবার পথে মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল—তাই তোমার কাছে চলে এলাম চিন্তা। আজ আবার নতুন করে মনে হল-আমার জীবন কোন্ পথে চলেছে—কোথায় চলেছি আমরা।

প্রতাপের মন কোনও কারণে—কিংবা অকারণেই বিক্ষুব্ধ হইয়াছে বুঝিয়া চিন্তা নীরবে দাঁড়াইয়া শুনিতে লাগিল। যাহারা দুর্গম পথে একেলা চলে তাহাদের মনে এইরূপ সংশয় মাঝে মাঝে উদয় হয়, চিন্তা জানিত। তাহার নিজের মনেও কতবার কত বিক্ষোভ জাগিয়াছে, কিন্তু তাহা ক্ষণিক; প্রিয়জনের কাছে হৃদয়ভার লাঘব করিতে পারিলেই তাহা কাটিয়া যায়।

বাহিরে কান্তিলাল কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া যখন দেখিল, প্রতাপ বাহিরে আসিল না তখন সে পা টিপিয়া টিপিয়া ঝোপ হইতে বাহির হইল, সিধা বারান্দার দিকে না গিয়া একটু ঘুরিয়া পরপের পিছন দিকে চলিল।

ঘরের পিছনের দেয়ালে সমচতুষ্কোণ ক্ষুদ্র গবাক্ষ; নিম্নে চারিদিকে শুষ্কপত্র ছড়ানো রহিয়াছে; কান্তিলাল অতি সাবধানে গুড়ি মারিয়া জানালার নীচে উপস্থিত হইল। ভিতর হইতে কথাবার্তার আওয়াজ বেশ স্পষ্ট শোনা যায়। কান্তিলাল কান পাতিয়া শুনিতে লাগিল।

ঘরের ভিতর প্রতাপ ও চিন্তা ঝুলার উপর বসিয়াছে। প্রতাপ বলিয়া চলিয়াছে—

যেদিন প্রথম এ পথে যাত্রা শুরু করেছিলাম সেদিন জানতাম না কোথায় এ-পথ শেষ হবে—তারপর কতদিন কেটে গেল—আজও জানি না এ পথের শেষ কোথায়। তুমি জানো চিন্তা?

চিন্তা বলিল,-ঠিক জানি না! কিন্তু পথে চলাই কি একটা লক্ষ্য নয়?

প্রতাপ বলিল,—হয়তো তাই হয়তো জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পথেই চলতে হবে। নিজের জন্য ভাবি না, কিন্তু তোমার কথা ভেবে বড় দুঃখ হয় চিন্তা! তোমার জীবনটা আমি নষ্ট করে দিলাম। আমি যদি তোমার জীবনে না আসতাম, তুমি হয়তো কোন গৃহস্থকে বিয়ে করে স্বামী-সংসার নিয়ে সুখী হতে

চিন্তা শান্তস্বরে বলিল,-আমার জীবনকে তোমার জীবন থেকে আলাদা করে দেখছো কেন? তুমি কি আমাকে মনের মধ্যে নিজের করে নাওনি?

প্রতাপ বাহু ধরিয়া চিন্তাকে কাছে টানিয়া লইয়া অনুতপ্ত স্বরে বলিল,–আমায় মাপ কর চিন্তা। আমারই ভুল–আমারই ভুল।

জানালার নীচে কান্তিলাল পুর্ববৎ শুনিতেছিল। তাহার মুখ দেখিয়া মনে হয় এরূপ ধরনের কথাবার্তা সে মোটেই প্রত্যাশা করে নাই; দুইজন যুবক-যুবতীর মধ্যে নির্জন গভীররাত্রে যে এরূপ আলোচনা চলিতে পারে ইন্দ্রিয়সৰ্বৰ্ষ কান্তিলালের পক্ষে তাহা কল্পনা করাও দুরূহ।

ঘরের মধ্যে প্রতাপ আবার বলিতে আরম্ভ করিয়াছিল,

তোমার আমার কথা ছেড়ে দিলেও আর একটা কথা আছে চিন্তা। সারা পৃথিবী জুড়ে নির্ধনের ওপর ধনীর এই উৎপীড়ন চলছে, আমরা মুষ্টিমেয় কজন তার কতটুকু প্রতিকার করতে পারি? বুকের রক্ত দিতে পারি, জীবন আহুতি দিতে পারি কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার কতটুকু ফল হবে? মরুভূমিতে একবিন্দু জলের মত আমাদের এই প্রাণপণ চেষ্টা নিমেষে শুকিয়ে যাবে।

চিন্তা ক্ষণেক নীরব রহিল। শেষে বলিল,-

তবে কি এর কোনও উপায় নেই?

প্রতাপ বলিল,-আমি অনেক ভেবেছি, কোনও কুল-কিনারা পাইনি চিন্তা, আমাদের রোগ যেখানে ওষুধও সেখানে। মানুষের সমাজে যতদিন অবস্থার প্রভেদ আছে ততদিন ধনী দরিদ্রকে নির্যাতন করবে, শক্তিমান দুর্বলকে পীড়ন করবে।

তবে?

যদি কখনও এমন দিন আসে যখন মানুষে মানুষে অবস্থার ভেদ থাকবে না, সকলে আপন আপন শক্তি অনুযায়ী কাজ করবে আর সমান বৃত্তি পাবে—সেইদিন মানুষের দুঃখের যুগ শেষ হবে। সেদিন কবে আসবে জানি না—হয়তো কোনদিনই আসবে না।

আসবে। কিন্তু যতদিন না আসে?

প্রতাপ ঈষৎ হাসিয়া বলিল,-ততদিন আমরা লড়াই করে যাব। তুমি এই পরপ থেকে আমার কাছে পায়রার দূত পাঠাবে, আর আমি রাত্রে চোরের মত এসে তোমার সঙ্গে দেখা করে যাব।

ঘরের মধ্যে যখন এইরূপ কথাবার্তা চলিতেছিল কান্তিলাল ধীরে ধীরে উঠিয়া জানালার ভিতর দিয়া উঁকি মারিবার চেষ্টা করিতেছিল। অনবধানে একটি শুষ্কপত্রের উপর পা পড়িতেই মচ করিয়া শব্দ হইল। কান্তিলাল আর দাঁড়াইল না, ক্ষিপ্রপদে পলায়ন করিল।

ঘরের ভিতর প্রতাপ ও চিন্তা আওয়াজ শুনিতে পাইয়াছিল। প্রতাপ লাফাইয়া আসিয়া জানালার বাহিরে গলা বাড়াইল, কিন্তু কাহাকেও দেখিতে পাইল না। কান্তিলাল তখন দ্রুতগতিতে নিজের ঘোড়ার কাছে পৌঁছিয়াছে।

চিন্তা প্রতাপের পাশে গিয়া দাঁড়াইয়াছিল। প্রতাপ ফিরিয়া বলিল,

কেউ নেই। কিন্তু ঠিক মনে হল—

চিন্তা বলিল,-কোনও জন্তু-জানোয়ার হবে।

ওদিকে কান্তিলাল তখন নিজের ঘোড়ায় চড়িয়া ফিরিয়া চলিয়াছে। তাহার মুখে বিজয়ীর হাসি। খেজুর ছড়ি দিয়া ঘোড়াটাকে পিটাইতে পিটাইতে সে নিজমনেই বলিতেছে,

চল্ চল, ছুটে চল্। আর যাবে কোথায় বারবটিয়া—আর যাবে কোথায় পানিহারিন!

পরপের কক্ষে প্রতাপ চিন্তার কাছে বিদায় লইতেছিল—

এবার যাই চিন্তা। রাত শেষ হয়ে এল, তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও।

চিন্তা একটু হাসিল। প্রতাপ দ্বারের দিকে ফিরিতেছিল, চিন্তা বলিল,-একটা খবর দিতে ভুলে গেছি।

প্রতাপ ফিরিয়া প্রশ্ন করিল,-কী খবর?

চিন্তা বলিল,—সর্দার তেজ সিংয়ের স্ত্রী মর-মর। স্বামী নিরুদ্দেশ হবার পর থেকে তিনি অন্নজল ত্যাগ করেছিলেন, এখন একেবারে শয্যা নিয়েছেন। দুচার দিনের মধ্যে তিনি যদি স্বামীকে ফিরে না পান তাহলে তাঁকে আর বাঁচানো যাবে না।

প্রতাপ কিছুক্ষণ চিন্তা-তন্ময় চোখে চিন্তার পানে চাহিয়া রহিল। তারপর অস্ফুটস্বরে আপনমনেই বলিল,-

বাঁচানো যাবে না—

.

পরদিন প্রভাত।

দস্যুদের গুহামুখে প্রতাপ ও তেজ সিং মুখোমুখি দাঁড়াইয়া আছেন। প্রতাপ একহাতে তেজ সিংয়ের তরবারি, অন্য হাতে সে একটি সজ্জিত অশ্বের বলগা ধরিয়া আছে। কিছু দূরে তিলু ভীম প্রমুখ আর সকলে দাঁড়াইয়া দেখিতেছে।

প্রতাপ বলিল,—এই নিন আপনার তলোয়ার—এখান থেকে ঘোড়ায় চড়ে সটান বাড়ি যাবেন।

তেজ সিং বলিলেন, তুমি আমাকে বিনা শর্তে মুক্তি দিচ্ছ?

প্রতাপ বলিল,—একটি মাত্র শর্ত আছে আপনি পথে কোথাও দাঁড়াবেন না, সিধা বাড়ি যাবেন।

তেজ সিং তরবারি কোমরে বাঁধিলেন।

তেজ সিং বলিলেন,—কেন আমাকে হঠাৎ মুক্তি দিচ্ছ জানি না, কিন্তু এ অনুগ্রহ আমার চিরদিন মনে থাকবে।

প্রতাপ বলিল,-আশা করি আমাদের খুব মন্দ ভাববেন না।

তেজ সিং বলিলেন,—আমি যা চোখে দেখেছি তারপরও যদি তোমাদের মন্দ ভাবি তাহলে ভগবানের চোখে অপরাধী হব। চললাম তিলুবেন, চললাম ভাইসব—তোমাদের কোনওদিন ভুলব না।

তেজ সিং লাফাইয়া ঘোড়ার পিঠে উঠিলেন। তিলুর চোখ দুটি একটু ছলছল করিল।

তিলু বলিল,-আমার বাবা রতিলাল শেঠ মামুদপুরে থাকেন, তাঁর সঙ্গে যদি দেখা হয় বলবেন আমি ভাল আছি।

ভীমভাই বলিল,—আর বলতে নেই যদি সম্ভব হয় তিলুর জন্যে কিছু কুড়মুড়া পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন।

বিদায়ের বিষণ্ণতার উপর হাসির ঝিলিক খেলিয়া গেল।

তেজ সিং বলিলেন,—বেশ, চিন্তাবেনের কাছে পাঠিয়ে দেব। চললাম, আমাকে ভুলো না। যদি কখনও দরকার হয় স্মরণ করো।

তেজ সিং বিদায়-সম্ভাষণে দুই করতল যুক্ত করিলেন। তাঁহার ঘোড়া চলিতে আরম্ভ করিল।

.

দিবা তৃতীয় প্রহর।

চিন্তার পরপের সম্মুখে দুইটি ড়ুলি আসিয়া থামিল। একটিতে শেঠ গোকুলদাস বিরাজ করিতেছেন, অপরটি শুন্য। ড়ুলি ঘিরিয়া কান্তিলাল প্রমুখ ছয়জন বন্দুকধারী অশ্বারোহী তো আছেই, উপরন্তু আরও দশ বারো জন সশস্ত্র পদাতি।

গোকুলদাস কান্তিলালের দিকে চোখের ইশারা করিয়া বলিলেন,

দ্যাখ ঘরে আছে কি না।

কান্তিলাল ঘোড়া হইতে নামিয়া পরপের দিকে অগ্রসর হইল।

ঘরের মধ্যে চিন্তা পায়রা দুটিকে শস্য দিতেছিল, তাহারা খুঁটিয়া খাইতেছিল। বাহিরে বহু জনসমাগমের শব্দে সে গলা বাড়াইয়া দেখিল গোকুলদাসের দল, কান্তিলাল ঘরের দিকে আসিতেছে।

কান্তিলাল বারান্দার নিকট আসিয়া দাঁত বাহির করিয়া দাঁড়াইল। চিন্তার মুখ অপ্রসন্ন হইল, কিন্তু সে তাহার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করিয়া জলের ঘটি হস্তে ঘর হইতে বাহির হইয়া গোকুলদাসের অভিমুখে অগ্রসর হইল। কান্তিলাল তাহার অনুসরণ করিল না, ঐখানে দাঁড়াইয়া ঘরের মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারিতে লাগিল।

চিন্তা গোকুলদাসের সম্মুখে উপস্থিত হইলে তিনি জলপানের কোনও চেষ্টা না করিয়া নির্নিমেষ সর্প-চক্ষু দিয়া তাহার পানে চাহিয়া রহিলেন। চিন্তা নীরসস্বরে বলিল,-

জল নাও

গোকুলদাস পূর্ববৎ অজগরের সম্মোহন-চক্ষু মেলিয়া চাহিয়া রহিলেন, তারপর সহসা বন্দুকের গুলির মত প্রশ্ন করিলেন,

তুই প্রতাপ বারবটিয়ার গোয়েন্দা।

চিন্তার হাত হইতে ঘটি পড়িয়া গেল। সে সভয়ে চারিদিকে চাহিয়া দেখিল, পদাতি লোকগুলি তাহাকে চারিদিক হইতে ঘিরিয়া ধরিয়াছে; পলাইবার পথ নাই।

গোকুলদাস ড়ুলি হইতে উঠিয়া দাঁড়াইলেন, অনুচরদের হুকুম দিলেন,

এর হাত চেপে ধর।

দুইজন পদাতি চিন্তার দুই হাত চাপিয়া ধরিল; তখন গোকুলদাস তাহার মুখের কাছে মুখ লইয়া কর্কশস্বরে বলিলেন,-

শয়তান ছুঁড়ি, তোর সব কেচ্ছা জানি। প্রতাপ বারবটিয়া তোর নাগর রাত্রে লুকিয়ে তোর সঙ্গে দেখা করতে আসে। আর তুই পায়রা উড়িয়ে তাকে খবর পাঠাস্! অ্যাাঁ!

চিন্তা রুদ্ধস্বরে বলিল,-আমি কিছু জানি না।

গোকুলদাস বলিলেন,-জানি না?—দে তো ওর হাতে মোচড়, কেমন জানে না দেখি।

পদাতিদ্বয় চিন্তার হাতে মোচড় দিল, চিন্তা যন্ত্রণায় কাতরোক্তি করিয়া উঠিল।

গোকুলদাস বলিলেন,—এখনি হয়েছে কি, তোর অনেক দুর্গতি করব। তুই সরকারের নিমক খাস আর বারবটিয়ার গোয়েন্দাগিরি করিস! ভাল চা তো বল, প্রতাপ বারবটিয়া কোথায় থাকে তাহলে তোকে ছেড়ে দেব। বলবি?

চিন্তা বলিল,-আমি কিছু জানি না।

গোকুলদাস পদাতিদের ইশারা করিলেন,তাহারা আবার চিন্তার হাতে মোচড় দিল। এবার চিন্তা চিৎকার করিল না, অধর দংশন করিয়া নীরব রহিল।

গোকুলদাস বলিলেন,—বলবি?

চিন্তা পাংশু মুখে বলিল,—আমি কিছু জানি না।

গোকুলদাস হাসিলেন; তিনি ইহার জন্য প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছিলেন। বলিলেন,–

ওর মুখ বেঁধে ড়ুলিতে তো। পদাতিরা চিন্তার মুখ বাঁধিয়া দ্বিতীয় ড়ুলির মধ্যে ফেলিল।

গোকুলদাস বলিলেন,—তুই ভেবেছিস, তুই না বললে তোর নাগরকে ধরতে পারব না? তোকে যখন ধরেছি তখন সে যাবে কোথায়! কান্তিলাল, একটা পায়রা ধরে আন।

কান্তিলাল বলিল,-এই যে শেঠ, এনেছি।

সে ইতিমধ্যে চিন্তার ঘরে প্রবেশ করিয়া দুইটি পায়রার মধ্যে একটিকে ধরিয়াছিল, পোষা পায়রা ধরিতে বিশেষ কষ্ট হয় নাই।

গোকুলদাস কুর্তার পকেট হইতে এক চিলতা কাগজ বাহির করিলেন। কাগজে লেখা ছিল—

প্রতাপ বারবটিয়া,
        তোমার প্রণয়িনী পরপওয়ালীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছি। যদি তার প্রাণ ও ধর্ম রক্ষা করতে চাও,
তবে কাল সূর্যোদয়ের আগে আমার দেউড়িতে এসে ধরা দাও। যদি ধরা না দাও, সূর্যোদয়ের পর
তোমার প্রণয়িনীকে আমার ভৃত্য কান্তিলালের হাতে সমর্পণ করা হবে।
         —গোকুলদাস শেঠ

চিঠি কপোতের পায়ে বাঁধিয়া তাহাকে উড়াইয়া দেওয়া হইল। তারপর গোকুলদাস নিজ ড়ুলিতে প্রবেশ করিলেন। বলিলেন,

নে, জলদি ফিরে চল। দেখি এবার বারবটিয়া কোথায় যায়!

দুইটি ড়ুলি লইয়া দলবল আবার নিম্নাভিমুখে ফিরিয়া চলিল।

.

শৈলরেখাবন্ধুর পশ্চিম দিগন্তে অস্তরাগ লাগিয়াছে। গুহামুখে দাঁড়াইয়া প্রতাপ কপোতের পা হইতে চিঠি খুলিতেছে। আর সকলে তাহার চারিপাশে দাঁড়াইয়া আছে।

কপোতটিকে তিলুর হাতে দিয়া প্রতাপ সাগ্রহে চিঠি খুলিল। চিঠির সম্বোধন পড়িয়াই তাহার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। চিঠি পড়া যখন শেষ হইল তখন তাহার মুখের সমস্ত রক্ত নামিয়া গিয়া মুখ মৃতের মত পার হইয়া গিয়াছে।

সকলেই তাহার ভাবান্তর লক্ষ্য করিয়াছিল; নানাভাই বলিয়া উঠিল,

কী হল প্রতাপভাই?

প্রতাপের অবশ হস্ত হইতে চিঠিখানা মাটিতে খসিয়া পড়িল। সে উত্তর দিতে পারিল না, একটা প্রস্তরখণ্ডের উপর বসিয়া পড়িয়া দুহাতে মুখ ঢাকিল।

নানাভাই ভূপতিত চিঠিখানা তুলিয়া লইয়া পড়িতে আরম্ভ করিল, আর সকলে উদ্বিগ্নমুখে তাহাকে ঘিরিয়া ধরিল।

.

দিবালোক প্রায় নিভিয়া গিয়াছে। রাত্রি ঘনাইয়া আসিতেছে, কৃষ্ণা প্রতিপদের চাঁদ এখনও উঠে নাই।

গুহার সম্মুখে মোতির রাস ধরিয়া দাঁড়াইয়া প্রতাপ। তাহার কোমরে দুটি পিস্তল, আর কোনও অস্ত্র নাই। সে সঙ্গীদের সম্বোধন করিয়া ধীরকণ্ঠে বলিতেছে,

আমি ধরা দিতে চললাম। আর বোধহয় আমাদের দেখা হবে না। তোমাদের উপদেশ দেবার মত কোনও কথাই এখন খুঁজে পাচ্ছি না—তোমরা পরামর্শ করে যা ভাল বোঝ, করো। আর আমার শেষ অনুরোধ, আমাদের উদ্ধার করবার জন্যে বৃথা রক্তপাত করো না। বিদায়।

প্রতাপ একে একে সকলকে আলিঙ্গন করিল, তিলুর মাথায় হাত রাখিয়া আশীর্বাদ করিল, তারপর মোতির পৃষ্ঠে চড়িয়া অবলীয়মান আলোর মধ্যে অন্তর্হিত হইয়া গেল।

.

গোকুলদাসের প্রাসাদের নিম্নতলে একটি প্রকোষ্ঠে চিন্তা বন্দিনী রহিয়াছে। তাহার দুই হাত শৃঙ্খলিত, সে দেয়ালে ঠেস দিয়া বসিয়া শুষ্কচোখে শুন্যে চাহিয়া আছে। তাহার মাথার উপর প্রায় ছাদের কাছে একটি ক্ষুদ্র গরাদহীন গবাক্ষ; গবাক্ষপথে চাঁদের আলো ঘরে প্রবেশ করিয়াছে।

প্রকোষ্ঠের দৃঢ় লৌহদ্বারের বাহিরে কান্তিলাল ও আর একজন প্রহরী পাহারা দিতেছে। কান্তিলালের সর্বাঙ্গে জ্বরজনিত উত্তাপের অস্থিরতা। যেন খাঁচায় ইঁদুর ধরা পড়িয়াছে, আর ক্ষুধিত বিড়াল খাঁচার চারিপাশে পাক খাইতেছে।

.

উপলকঠিন প্রান্তরের উপর দিয়া প্রতাপ মোতির পৃষ্ঠে ছুটিয়া চলিয়াছে; পাথরের উপর মোতির ক্ষুরধ্বনি নাকাড়ার মত দ্রুতচ্ছন্দে বাজিতেছে। চাঁদের কিরণে দৃশ্যটি স্বপ্নময়। মোতির পিছনে দীর্ঘ ছায়া পড়িয়াছে।

.

গুহার মধ্যে চারিটি পুরুষ ও একটি নারী অগ্নি ঘিরিয়া নীরবে বসিয়া আছে। আজ রন্ধনের আয়োজন নাই, চটুল হাস্য পরিহাস নাই। তিলু একপ্রান্তে বসিয়া আছে, তাহার গণ্ড বহিয়া নিঃশব্দে অশ্রু ঝরিয়া পড়িতেছে।

পুরুষদের মধ্যে ভীমভাইয়ের অবস্থা সর্বাপেক্ষা লক্ষণীয়। অন্য সকলে হতাশ গম্ভীর মুখে বসিয়া আছে কিন্তু ভীম যেন এই প্রচণ্ড আঘাতে একেবারে ভূমিসাৎ হইয়াছে। সে দুই জানু বাহুবদ্ধ করিয়া আগুনের দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকাইয়া আছে; তাহার মুখ দেখিয়া মনে হয় চিন্তা করিবার শক্তিও তাহার অবশ হইয়া গিয়াছে।

সহসা পুরন্দর মুখ তুলিল,–

এখানে থেকে আর লাভ কি?

প্রভু মাথা নাড়িল।

কোনও লাভ নেইই। তার চেয়ে

নানাভাই বলিল,-তার চেয়ে প্রতাপ যেখানে ধরা দিতে গেছে সেই শহরে—

পুরন্দর বলিল,-কিন্তু প্রতাপভাই মানা করে গেছেন।

প্রভু বলিল,-রক্তপাত আমরা করব না। কিন্তু রক্তপাত না করেও ওদের উদ্ধারের চেষ্টা করা যেতে পারে।

নানা ও পুরন্দর সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়িল। প্রভু ভীমের দিকে ফিরিয়া দেখিল তাহাদের কথা ভীমের কানে যায় নাই। প্রভু বলিল,-

ভীম, তুমি কি বল?

ভীম চমকিয়া উঠিল,

অ্যা। কী?

প্রভু বলিল,-আমরা শহরে যেতে চাই; প্রতাপের কাছাকাছি থাকলেও হয়তো তাকে সাহায্য করতে পারব। তিলুবেন, তুমি কি বল?

তিলু কথা বলিল না, কেবল ঘাড় নাড়িয়া সায় দিল। ভীমের মুখভাব কিন্তু সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিল।

শহরে! কিন্তু যদি কেউ আমাদের চিনতে পারে?

তিলু ও আর সকলে একটু অবাক হইয়া ভীমের পানে তাকাইল। প্রভু বলিল,-

প্রতাপের শহরে আমাদের কে চিনবে? আমরা কেউ ও শহরের লোক নই। তা ছাড়া আমরা গা-ঢাকা দিয়ে থাকব; সেখানে লছমন আছে, সে আমাদের লুকিয়ে রাখবার ব্যবস্থা করবে।

ভীম যেন এখনও নিঃসংশয় হইতে পারে নাই, এমনিভাবে স্খলিতস্বরে বলিল,–

তা—তা—এখানেও তো আর নিরাপদ নয়—শহরে যদি—

.

সম্মুখদিকে ঈষৎ ঝুঁকিয়া প্রতাপ মোতির পৃষ্ঠে বসিয়া আছে; মোতি গিরিকান্তার পার হইয়া ছুটিয়া চলিয়াছে। তাহার মুখে ফেনা, সর্বাঙ্গে ঘাম ঝরিতেছে।

চন্দ্র মধ্যাকাশে। মোতির ছায়া তাহার পেটের নীচে পড়িয়াছে। প্রতাপ মোতির গ্রীবার উপর হাত রাখিয়া মাঝে মাঝে অস্ফুটস্বরে বলিতেছে,

মোতি, আরও জোরে চল্ বেটা—এখনও অর্ধেক পথ বাকি।

.

চিন্তার কারাকক্ষের দ্বারমুখে কান্তিলাল পায়চারি করিতে করিতে পাহারা দিতেছে, অন্য প্রহরীটা দাঁড়াইয়া ঝিমাইতেছে। দূরে কোতোয়ালীর ঘড়িতে মধ্যরাত্রির ঘন্টা বাজিল।

গোকুলদাসের চোখে নিদ্রা ছিল না, তিনি আসিয়া দেখা দিলেন। কান্তিলালকে জিজ্ঞাসা করিলেন,

কি রে, আছে তো ছুঁড়ি?

কান্তিলাল নৃশংসহাস্যে দন্ত বাহির করিল।

যাবে কোথায় শেঠ? চাবি দাও, খুলে দেখিয়ে দিচ্ছি।

গোকুলদাস কোমর হইতে চাবি দিলেন, কান্তিলাল তালা খুলিয়া দ্বার ঈষৎ উন্মুক্ত করিল। ফাঁক দিয়া উভয়ে দেখিলেন, চিন্তা দেয়ালে ঠেস দিয়া পূর্ববৎ বসিয়া আছে, একটু নড়েও নাই।

দ্বারে তালা লাগাইয়া গোকুলদাস আবার চাবি কোমরে ঝুলাইলেন।

বারবটিয়া যদি সূর্যোদয়ের আগে ধরা না দেয়—

কান্তিলালের চক্ষু লোভে জ্বলিয়া উঠিল, সে সৃক্কণী লেহন করিল।

.

মোতি চলিয়াছে। ফেনায় ঘর্মে তাহার সর্বাঙ্গ আপ্লুত। সম্মুখে পাহাড়ের একটা চড়াই। মোতি একটা নালা লাফাইয়া পার হইয়া গেল, তারপর চড়াই উঠিতে আরম্ভ করিল। ছায়া এখন তাহার সম্মুখে; সে যেন নিজের ছায়াকে ধরিবার জন্য ছুটিয়াছে।

প্রতাপ অস্ফুটস্বরে বলিল,–

আর একটু, আর একটু মোতি! এই পাহাড়টা পার হলেই—

.

পূর্বাকাশে একটুখানি আলোর ঝিলিক দেখা দিয়াছে, কিন্তু পৃথিবীপৃষ্ঠে এখনও তাহার প্রতিবিম্ব পড়ে নাই। পশ্চিম গগনে চন্দ্র প্রভাহীন।

মোতি এখন সমতল বালুময় ভূমি দিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে; শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছিতে আর দেরি নাই।

কিন্তু সমস্ত রাত্রি অবিশ্রাম ছুটিবার পর মোতির বিপুল প্রাণশক্তিও নিঃশেষ হইয়া আসিয়াছে। এতক্ষণ সে যন্ত্রবৎ ছুটিয়াছে, উচ্চনীচ উদ্ঘাত কিছুই তাহার গতিকে ব্যাহত করিতে পারে নাই। কিন্তু এখন সহসা তাহার গতিবেগ প্রশমিত হইল, তাহার তীরের ন্যায় ঋজু-গতি এলোমেলো হইয়া গেল। তারপর ক্লান্ত পাগুলি দুমড়াইয়া মোতি মাটির উপর পড়িয়া গেল।

প্রতাপ ছিটাইয়া দূরে পড়িল। বালুর উপর তাহার আঘাত লাগিল না, সে দ্রুত উঠিয়া মোতির কাছে আসিয়া বুকভাঙা স্বরে ডাকিল,

মোতি!

মোতি আর উঠিল না। তাহার হৃৎস্পন্দন থামিয়া আসিতেছিল, সে বিকৃত নাসারন্ধ্র হইতে কয়েকটি অতি দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিল। তারপর তাহার দেহ স্থির হইল।

প্রতাপ মোতির গ্রীবার উপর লুটাইয়া পড়িল,

মোতি—বেটা!

.

পূর্বাকাশ সিন্দুরবর্ণে রঞ্জিত হইয়াছে, সূর্যোদয়ের আর বিলম্ব নাই। পাখি ডাকিতেছে। গোকুলদাসের প্রাসাদভূমিতে বহু সেপাই সান্ত্রী; প্রতাপ বারবটিয়াকে ধরিবে বলিয়া সকলের সশস্ত্র ও সতর্কভাবে রাত কাটিয়াছে। ইহারা সকলেই গোকুলদাসের বেতনভুক। হয়তো ইহাদের মধ্যে প্রতাপের দলভুক্ত দুই চারিটি লোক গুপ্তভাবে আছে, কিন্তু কাহারও আচরণ দেখিয়া তাহা সন্দেহ হয় না। তাহারা অন্য সকলের সহিত পাহারা দিয়াছে, হয়তো চিন্তাকে উদ্ধার করিবার উপায় খুঁজিয়াছে, কিন্তু আদেশদাতা নেতার অভাবে কিছুই করিতে পারে নাই।

চিন্তার অবরোধ কক্ষের সম্মুখের অলিন্দে দাঁড়াইয়া গোকুলদাস বাহিরের দিকে তাকাইয়া আছেন। তাঁহার ললাটে নিষ্ফল ক্রোধের ভ্রূকুটি।

চক্রবাল-রেখায় ধীরে ধীরে সূর্যোদয় হইল।

গোকুলদাস মনে মনে গর্জন করিলেন বারবটিয়া আসিল না। শয়তান ধরা দিল না। আচ্ছা, তবে রাজপুতনীটাই তাহার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করিবে।

কান্তিলাল ও অন্য প্রহরীটা গোকুলদাসের পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল, তিনি ফিরিয়া বলিলেন,-

কাহ্না, তুই কোতোয়ালীতে যা—কোতোয়ালকে ডেকে নিয়ে আয়! ববি যে আমি প্রতাপ বারবটিয়ার দলের একটা মেয়েকে ধরেছি শিগগির এসে তাকে গ্রেপ্তার করুক।

যো হুকুম।

কাহ্না চলিয়া গেলে কান্তিলাল ব্যগ্রকণ্ঠে বলিল,–

শেঠ, আমার বকশিশ।

গোকুলদাস বিকৃতমুখে হাসিয়া চাবি তাহার হাতে দিলেন,

এই নে তোর বকশিশ।

অধৈর্য-স্খলিতহস্তে কান্তিলাল দ্বারের তালা খুলিল। দুহাতে দ্বার ঠেলিয়া যেই সে প্রবেশ করিতে যাইবে অমনি ভিতর হইতে পিস্তলের আওয়াজ হইল। কান্তিলালকে প্রবেশ করিতে হইল না, সে চৌকাঠের উপর মুখ খুঁজিয়া পড়িয়া গেল। গোকুলদাস চিৎকার করিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিলেন।

আওয়াজ শুনিয়া চারিদিক হইতে লোক ছুটিয়া আসিল, কিন্তু তাহারাও দরজার সম্মুখে আসিয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। কারাকক্ষের মধ্যে প্রতাপ ও চিন্তা পাশাপাশি দাঁড়াইয়া আছে; প্রতাপের দুই হাতে দুটি পিস্তল।

প্রতাপ বলিল,-আমরা তোমাদের হাতে ধরা দেব না। কোতোয়ালের হাতে আমরা ধরা দেব। তফাত থাকো—এগিয়েছ কি মরেছ।

সমবেত সান্ত্রীরা প্রতাপের উগ্রমূর্তি দেখিল, তাহার হাতের পিস্তল দেখিল, কান্তিলালের মৃতদেহ দেখিল, তারপর পিছু হটিল।

এই সময় সদলবলে কোতোয়াল আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সকলে তাঁহাকে পথ ছাড়িয়া দিল। তিনি দ্বারের সম্মুখস্থ হইতেই প্রতাপ পিস্তল দুটি তাঁহার হস্তে সমৰ্পণ করিয়া শান্তকণ্ঠে কহিল,

আমি প্রতাপ বারবটিয়া, ইনি আমার স্ত্রী চিন্তাবাঈ। আমাদের বন্দী করুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *