০৮. বুড়োশিবতলার ঘাটে

বুড়োশিবতলার ঘাটে অশ্বতলায়, যতীন অন্যমনস্ক হয়ে বসে ছিল।

পুষ্প মাঝে মাঝে কোথায় যায়, আজও বেরিয়েছে। তার নানা কাজ, কোথায় কখন ঘোরে। পুষ্পকে যতীন খানিকটা বোঝে, খানিকটা বোঝে না। পুষ্পের ভালবাসায় সেবাযত্নে তার বহুদিনের বুভুক্ষু প্রাণ তৃপ্ত হয়েছে বটে কিন্তু সঙ্গিনী হিসাবে যতীনের মনে হয় পুষ্প অনেক অনেক উঁচু। সে পুষ্পকে ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে, এমন কি কিছু কিছু ভয়ও করে। তার সঙ্গে কিন্তু মন খুলে কথা বলা যায় না, বলতে চাইলেও মুখে অনেকটা আটকে যায়। এমন সুখ, শান্তি, আনন্দের মধ্যেও যতীন নিজেকে খানিকটা একা মনে না করে পারে না।

আশা, আজ যদি আশা…

এই সব সুন্দর দিনে, সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যে বসে আশার কথাই মনে হয়। আরও মনে হয় সে বড় হতভাগিনী, তার এত ভালবাসা আশা বোঝেনি; আশা যদি বুঝতো, তার মূল্য দিত, হতভাগিনী নিজেই কত তৃপ্তি পেতো।

তার ইচ্ছা হয় যখন তখন আশার কাছে যায়। কিন্তু পুষ্প তাকে যেতে দেয় না। এর কারণ যতীন জানতো না। আশার জীবনের অনেক ব্যাপার পুষ্প যা জানে যতীন তা জানে না। পাছে সে সব দেখলে যতীনের মানসিক যন্ত্রণা বেড়ে যায়, সেজন্যে পুষ্প প্রাণপণে সে সব। জিনিস ওর দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে রাখতে চায়। যার কোনো প্রতিকার করবার ক্ষমতা নেই, তা ওকে জানতে দিয়ে কোনো লাভ নেই।

যতীন জানতো আশা খেয়ালের বশে অভিমান করে বাপের বাড়ী গিয়ে উঠেছিল এবং অভিমানের দরুনই তার সঙ্গে দেখা করেনি। তার নিষ্ঠুরতা, সেও অভিমানপ্রসূত। আশার চরিত্রের আসল দিক পুষ্প কত কৌশলে ঢেকে রেখেচে যতীনের কাছে তা একমাত্র জানতেন যতীনের মা। পাছে ওর চোখেও সে সব ধরা পড়ে যায়, এই ভয়ে নিজে সঙ্গে না নিয়ে যতীনকে একা আশার কাছে যেতে দিত না। যতীনের একা যাবার প্রবল ইচ্ছা সত্ত্বেও একা পৃথিবীতে যেতে সে তেমন সাহস পায় না–একদিন যাবার চেষ্টা করে খানিকটা গিয়েছিল, হঠাৎ মধ্যপথে কে যেন ওকে চৌকো কাঠের বাক্সের আকারের ঘর তৈরী করে তার মধ্যে বন্দী করবার চেষ্টা করতে লাগলো। ও এগিয়ে যায়, একটা ঘর ছুঁড়ে বার হয়, আবার সামনে ঐ রকম কিউব দিয়ে সাজানো ঘর আর একটি তৈরী হয়–সেটা অতি কষ্টে পার হয়, তো আর একটা। দ্বিতীয় স্তরের অপেক্ষাকৃত স্কুল অথচ অত্যন্ত নমনীয় বস্তুপুঞ্জের ওপর ওর নিজের চিন্তাশক্তি কাৰ্য্য করে আপনা-আপনিই এই রকম কিউব-সাজানো দেওয়ালের বেড়াজাল সৃষ্টি হচ্ছিল–চিন্তার সংযম বা পবিত্রতা অভ্যাস না করলে এই সব নিম্নস্তরে যে ও রকম হয় তা যতীনের জানা ছিল না–যতীন যত ভয় পায়, ততই তার মনের বল কমে যায়–ততই সে নিজের সৃষ্টি কিউবরাশির মধ্যে নিজেই বন্দী হয়। জনৈক উচ্চস্তরের পথিক-আত্মা তাকে সে বিপদ থেকে সেদিন উদ্ধার করেন। সেই থেকে একা পৃথিবীতে আসতে ওর ভরসা হয় না।

আজও বসে ভাবতে ভাবতে আশার জন্যে সহানুভূতি ও দুঃখে ওর মন পূর্ণ হয়ে গেল। কিন্তু কি করবার আছে তার, অশরীরী অবস্থায় আশার কোনো উপায়ই সে করতে পারে না–অন্তত করবার উপায় তার জানা নেই।

হঠাৎ তার প্রবল আগ্রহ হোল আর একবার সে আশার কাছে যাবার চেষ্টা করবে। এলোমেলো চিন্তা মন থেকে সে দূর করবে– ভেবে ভেবে চন্ডীর একটা শ্লোক তার মনে পড়লো…

যা দেবী সৰ্ব্বভূতেষু দয়ারূপেণ সংস্থিতা
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমোনমঃ।।

এই শ্লোকটা একমনে আবৃত্তি করতে করতে সে ইচ্ছা করলে যে পৃথিবীতে যাবে–আশাদের বাড়ীতে–আশার কাছে। পরক্ষণেই সে অনুভব করলে সে মহাশূন্যে মহাবেগে কোথায় নীত হচ্চে, গতির বেগে তার শরীরে শিহরণ এনে দিলে, মন মাঝে মাঝে অন্যদিকে যায়, আবার ফিরিয়ে এনে জোর করে চন্ডীর শ্লোকের প্রতি নিবদ্ধ করে।

এই তো তার শ্বশুরবাড়ীর পুকুর। ঐ তো সামনেই বাড়ী। বড় মজার ব্যাপার। এটা এখনও যতীন বুঝতে পারে না, কি করে সে। চিন্তা করা-মাত্রেই ঠিক জায়গায় এসে পৌঁছে গেল। এরোপ্লেন যারা চালায়, তাদের তো দিভুল হয়, কত বিপাকে বেঘোরে কষ্ট পায়– কিন্তু কি নিয়ম আছে এ জগতে যে, জনৈক অজ্ঞ আত্মা শুধু মাত্র চিন্তা দ্বারা গন্তব্য স্থানে এসে পৌঁছয়।

রাত্রি…আশা দোতলার ঘরে ঘুমুচ্চে, ও গিয়ে তার শিয়রে বসলো। খানিকটা পরে দেখলে আশার দেহের মধ্যে দিয়ে ঠিক আশার মত আর একটি মূর্তি বার হচ্চে। যতীন শুনেছিল গভীর নিদ্রার সময় মানুষের সূক্ষ্মদেহ তার স্থূলদেহ থেকে সাময়িক ভাবে বার হয়ে ভুবর্লোকে বিচরণ করে। কিন্তু আশার এই সূক্ষ্মদেহ দেখে যতীন বিস্মিত ও ব্যথিত হয়ে গেল। কি জ্যোতি-হীন, শ্রীহীন, অপ্রীতিকর মেটে সিঁদুরের মত লাল রঙের দেহটা! চোখ অর্ধনিমীলিত, ভাবলেশহীন, বুদ্ধিলেশহীন…একটু পরে সে দেহের চক্ষুদুটির দৃষ্টি যতীনের দিকে স্থাপিত হোল–কিন্তু সে দৃষ্টিতে এমন কোনো লক্ষণ নেই, যাতে যতীন বুঝতে পারে যে আশা ওকে চিনেচে বা ওর অস্তিত্ব সম্বন্ধে ও সচেতন হয়েছে। যেন মুমূর্ষ লোকের চোখের চাউনি–যা কিছু বোঝে কিছু বোঝে না, চেয়ে থাকে অথচ দেখে না। যতীন ভুবর্লোকের অল্পদিন-সঞ্জাত সামান্য অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারলে, আশার সূক্ষ্মদেহ অত্যন্ত অপরিণত এবং আদৌ উচ্চতর স্তরের উপযুক্ত নয়। সে জিজ্ঞেস করলে–আশা, কেমন আছ? আমায় চিনতে পারো?

আশার চোখে-মুখে এতটুকু চৈতন্য জাগলো না, সে যেন ঘুমুচ্চে। যতীন চতুর্থ স্তরে যেমন অবস্থায় পড়েছিল, আশার ভুবর্লোকে অতি নিম্নস্তরেই সেই অবস্থা। এখন ও যদি পৃথিবীর স্থূল দেহটা হারায়, এ লোকে এসে মহাকষ্ট পাবে, কারণ যে দেহটা নিয়ে এ লোকের সঙ্গে কারবার সে দেহটাই ওর তৈরী হয়নি। সদ্যঃপ্রসূত অন্ধ বিড়াল ইঁদুর ধরবে কেমন করে?

অর্থাৎ আশা অতি নিম্নশ্রেণীর আত্মা! যতীন আরও কয়েকবার নিজের অস্তিত্ব সম্বন্ধে আশাকে সচেতন করবার বৃথা চেষ্টা করে ব্যথিত মনে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলে।

সেদিনই বুড়োশিবতলার ঘাটে গঙ্গার ধারে এক ব্যাপার ঘটলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *