০২. যদুনাথের হলঘর

যদুনাথের হলঘর। ঘড়িতে সওয়া এগারোটা বাজিয়াছে।

সেবক পুর্ববৎ দরজায় ঠেস দিয়া বসিয়া আছে, তাহার মাথাটি হাঁটুর উপর নত হইয়া পড়িয়াছে।

উপরের ঘরে নন্দা পড়িতেছে। তাহার চক্ষু ঘুমে জড়াইয়া আসিতেছে। সে একটা হাই তুলিল; তারপর ঈষৎ সজাগ হইয়া আবার পড়িতে আরম্ভ করিল

অমূং পুরঃ পশ্যসি দেবদারুম–

বাড়ির ফটকের সম্মুখে গুর্খা দারোয়ান এখন আর পায়চারি করিতেছে না, ফটকের পাশে একটি টুলের উপর খাড়া বসিয়া আছে, দুই হাঁটুর মধ্যে বন্দুক। কিন্তু তাহার চক্ষুদুটি মুদ্রিত।

বাগানের অভ্যন্তর অপরিস্ফুট জ্যোৎস্নায় ঈষদালোকিত।

একটি মানুষ বাহিরের দিক হইতে পাঁচিলের উপর উঠিয়া বসিল, সতর্কভাবে এদিক ওদিক তাকাইয়া বাগানের মধ্যে লাফাইয়া পড়িল। লোকটির চেহারা শীর্ণ, মুখে কয়েক দিনের গোঁফ-দাড়ি, গায়ে ছিন্ন-মলিন কামিজ। চেহারা ও ভাবভঙ্গি দেখিয়া তাহাকে ছিচকে চোর বলিয়া মনে হয়।

লঘু ক্ষিপ্রপদে চোর বাড়ির দিকে চলিল; আঁকাবাঁকাভাবে এক ঝোপ হইতে অন্য ঝোপে গিয়া ছায়ামূর্তির মতো সদর দরজার দিকে অগ্রসর হইল। শেষে বাড়ির গাড়ি বারান্দার পাশে একটা উঁই ফুলের ঝাড়ের পিছনে গিয়া লুকাইল।

হল-ঘরের ভিতরে সেবক দরজায় ঠেস দিয়া ঘুমাইতেছে।

ঘড়িটা ঠং করিয়া বাজিয়া উঠিতেই সেবক চমকিয়া মাথা তুলিল। সাড়ে এগারোটা। সে উদ্বিগ্ন মুখে উঠিয়া দাঁড়াইল।

দ্বারের বাহিরে চোর উঁই ঝোপের আড়াল হইতে উঁকি মারিতেছিল, দ্বার খোলার শব্দে সে আবার লুকাইয়া পড়িল।

অর্ধ-উন্মুক্ত দ্বারপথে সেবকের মুণ্ড দেখা গেল। সে ফটকের দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল, তারপর মুণ্ড টানিয়া লইয়া আবার দ্বার ভেজাইয়া দিল।

সঙ্গে সঙ্গে চোর ঝোপের আড়াল হইতে বাহির হইয়া আসিল; নিঃশব্দে দ্বারের কাছে গিয়া কবাটে কান লাগাইয়া শুনিতে লাগিল।

দ্বারের অপর পারে সেবক চিন্তিতমুখে দাঁড়াইয়া ভাবিতেছে—এখনও বাবুর ইয়ার্কি দেওয়া শেষ হইল না! গলার মধ্যে একটা শব্দ করিয়া সে দ্বারের হুড়কা লাগাইবার উদ্যোগ করিল, তারপর কি ভাবিয়া হুড়কা না লাগাইয়াই পা টানিয়া টানিয়া আবার সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিতে লাগিল।

সেবকের পদশব্দ উপরে মিলাইয়া গেলে, সদর দরজা বাহিরের চাপে একটু খুলিয়া গেল। চোরের মাথা সেই ফাঁক দিয়া ভিতরে প্রবেশ করিয়া ক্ষিপ্র চকিত দৃষ্টিতে একবার চারিদিক দেখিয়া লইল, তারপর চোরের শরীরও ভিতরে প্রবেশ করিল।

পিছনে দরজা ভেজাইয়া দিয়া চোর ক্ষণকাল সমস্ত শরীর শক্ত করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল; তারপর বিড়াল-পদক্ষেপে যদুনাথের শয়নকক্ষের দিকে অগ্রসর হইল।

যদুনাথের দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া চোর উৎকর্ণভাবে শুনিল; ভিতর হইতে যদুনাথের মন্দ্রগভীর নাসিকাধ্বনি আসিতেছে। চোর তখন আরও কয়েক পা আগাইয়া গিয়া ঠাকুরঘরের সম্মুখে দাঁড়াইল; ঝুঁকিয়া দেখিল দ্বারে ভারী তালা ঝুলিতেছে।

উপরে নন্দার দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া সেবক নন্দাকে বলিতেছে—তুমি আর কতক্ষণ জেগে থাকবে? খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়।

নন্দা বলিল—এত দেরি তো দাদা কোনও দিন করে না! কী হল আজ? না, আমি জেগে থাকব। আজ ফিরুক না, খুব বকবো।

সেবক ক্ষুব্ধস্বরে বলিল-বকে আর কি হবে দিদিমণি, চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী। ও জানে আমরা তো আর ওকে কর্তার কাছে ধরিয়ে দিতে পারব না, তাই ওর অত বুকের পাটা।

সেবক আবার নীচে নামিয়া আসিল।

নীচে চোর ঠাকুরঘরের তালাটি নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখিতেছিল, সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনিয়া চমকিয়া খাড়া হইল। সদর দরজা পর্যন্ত পৌঁছিবার আর সময় নাই, চোর ভোজনকক্ষের দ্বার খুলিয়া সুট করিয়া ভিতরে ঢুকিয়া পড়িল।

সেবক নীচে নামিয়া আসিয়া চোরকে দেখিতে পাইল না, কেবল দেখিল ভোজনকক্ষের দরজা একটু ফাঁক হইয়া আছে। সে ভাবিল, হয়তো বিড়াল ঢুকিয়াছে, কিংবা মন্মথ, তাহার অবর্তমানে ফিরিয়া আসিয়া আহারে বসিয়াছে। সে গিয়া দ্বারের নিকট হইতে ভিতরে উঁকি মারিল কিন্তু বিড়াল কিংবা মন্মথকে দেখিতে পাইল না; মন্মথর খাবার যেমন ঢাকা ছিল তেমনি ঢাকা আছে। সেবক তখন দরজা বন্ধ করিয়া বাহির হইতে শিকল লাগাইয়া দিল, তারপর আবার সদর দরজার সম্মুখে গিয়া বসিল।

.

ভোজনকক্ষে চোর একটা আলমারির পাশে লুকাইয়াছিল। শিকল লাগানোর শব্দ তাহার কানে গিয়াছিল, সে সশঙ্ক মুখে বাহির হইয়া আসিল; সন্তর্পণে দ্বার টানিয়া দেখিল নির্গমনের পথ বন্ধ, খাঁচার মধ্যে ইদুরের মতো সে ধরা পড়িয়াছে। চোরের চক্ষু ভয়ে বিস্ফারিত হইল; সে ছুটিয়া গিয়া জানালা খুলিল। কিন্তু জানালায় মোটা মোটা লোহার গরাদ বসানো; উপরন্তু ঘরের উজ্জ্বল আলো জানালা পথে বাহিরে যাইতেছে, কাহারও দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারে। চোর তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করিয়া দিল; তারপর হতাশভাবে দেয়ালে ঠেস দিয়া ঝাঁকড়া চুলের মধ্যে আঙুল চালাইতে লাগিল।

আপন শয়নকক্ষে নন্দা পড়িতে পড়িতে বইয়ের উপর ঢুলিয়া পড়িতেছিল। একবার বইয়ের উপর মাথা ঠুকিয়া যাইতে তাহার ঘুমের ঘোর কাটিয়া গেল। সে উঠিয়া দ্বারের কাছে গেল, দ্বার খুলিয়া কিছুক্ষণ কান পাতিয়া শুনিল। নীচে সাড়াশব্দ নাই। নন্দা তখন বইখানা তুলিয়া লইয়া পায়চারি করিতে করিতে পড়া মুখস্থ করিতে লাগিল—

একাতপত্ৰং জগতঃ প্রভুত্বম—

ভোজনকক্ষে চোর পুর্ববৎ দেয়ালে ঠেস দিয়া দাঁড়াইয়াছিল। তাহার হতাশ বিভ্রান্ত চক্ষু ইতস্তত ঘুরিতে ঘুরিতে মন্মথর খাবারের উপর গিয়া স্থির হইল। সে কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল, তারপর গিয়া ঢাকা খুলিয়া দেখিল।

খাবার দেখিয়া চোরের মুখে ক্লিষ্ট হাসির মতো একটা ভঙ্গিমা ফুটিয়া উঠিল। সে আসনে বসিল, গেলাস চকাইয়া হাত ধুইল, তারপর থালার দিকে হাত বাড়াইল। তাহার মনের ভাব, যদি ধর পড়িতেই হয় শূন্য উদরে ধরা পড়িয়া লাভ কি?

ফটকের সম্মুখে গুর্খা দারোয়ান টুলের উপর খাড়া বসিয়া ঘুমাইতেছে। মন্মথ রাস্তার দিক হইতে আসিয়া তাহার কাঁধে টোকা মারিল। গুর্খা সটান উঠিয়া স্যালুট করিল, তারপর চাবি বাহির করিয় ফটক খুলিতে প্রবৃত্ত হইল। প্রশ্ন করিল—

ক ঘড়ি ব্যজা হ্যায় সরকার?

মন্মথ হাতের ঘড়ি দেখিবার ভান করিল।

পৌনে দশটা। গুর্খা বলিল—জী সরকার।

মন্মথ ভিতরে প্রবেশ করিল : গুর্খা আবার ফটকে তালা লাগাইল।

হল-ঘরে সেবক হাঁটুতে মাথা রাখিয়া বসিয়া আছে। সদর দরজার মৃদু টোকা পড়িতেই সে উঠিয়া দ্বার অল্প খুলিল। মন্মথ পাশ কাটাইয়া প্রবেশ করিল।

সেবক কটমট করিয়া চাহিয়া মন্মথর একটা হাত চাপিয়া ধরিল, চাপা গলায় বলিল—

চল কর্তার কাছে। তিনি জেগে বসে আছেন। মন্মথ সভয়ে পিছু হটিল।

অ্যাঁ—দাদু জেগে!

সেবকের মুখে একটু হাসির আভাস দেখিয়া সে থামিয়া গেল; বুঝিতে পারিল সেবক মিথ্যা ভয় দেখাইতেছে। সে বিরক্ত হইয়া বলিল—দ্যাখ সেবক, এত রাত্রে ইয়ার্কি ভাল লাগে না। —নে জুতো খোল—

সেবক নত হইয়া তাহার জুতার ফিতা খুলিতে লাগিল : মন্মথ ইতিমধ্যে কোট ও গলার টাই খুলিয়া ফেলিল।

সেবক বলিল—এবারটা ছেড়ে দিলাম। কিন্তু ফের যদি দেরি করেছ—

সেবক উঠিয়া কোট ও টাই মন্মথর হাত হইতে লইল—

যাও, খেয়ে নাও গে। শুধু ইয়ার্কিতে পেট ভরে না।

ঘরের এককোণে একটা আলনা ছিল, সেবক জুতা কোট প্রভৃতি লইয়া সেই দিকে রাখিতে গেল। মন্মথ পা টিপিয়া ভোজনকক্ষের দিকে চলিল।

ভোজনকক্ষে চোর আসনে বসিয়া আহার আরম্ভ করিয়াছে এমন সময় হঠাৎ দ্বার খুলিয়া গেল। চোর চমকিয়া দেখিল এক ব্যক্তি দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইয়া!

মন্মথও একজন অপরিচিত ব্যক্তিকে তাহার খাদ্য আত্মসাৎ করিতে দেখিয়া ক্ষণেক স্তম্ভিত হইয়া রহিল, তারপর চিৎকার করিয়া উঠিল—

অ্যাঁ–কে। চোর—চোর!

চোর তড়াক করিয়া লাফাইয়া উঠিয়া একদিকে ছুটিল; মন্মথ চোর চোর বলিয়া চেঁচাইতে চেঁচাইতে তাহার পশ্চাদ্বাধন করিল। ঘরের মধ্যে এক পাক ঘুরিয়া চোর সাঁ করিয়া দ্বার দিয়া বাহির হইল; মন্মথও তাহার পিছনে বাহির হইল।

হল-ঘরে সেবক মন্মথর চিৎকার শুনিয়া তাড়াতাড়ি ভোজনকক্ষের দিকে আসিতেছিল, চোর বিদ্যুদ্বেগে তাহাকে পাশ কাটাইয়া ঘরের অন্য দিকে পলায়ন করিল। কিন্তু মন্মথ সেবককে এড়াইতে পারিল না; সবেগে ঠোকাঠুকি হইয়া দুজনেই ভূমিসাৎ হইল এবং তারস্বরে চোর চোর বলিয়া চেঁচাইতে লাগিল।

যদুনাথের ঘুম ভাঙিয়া গিয়াছিল। তিনি ধড়মড় করিয়া উঠিয়া প্রথমেই চাবির গোছাটা মুঠিতে চাপিয়া ধরিলেন, তারপর খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে হল-ঘরে বাহির হইয়া আসিলেন।

ওদিকে নন্দাও অপ্রত্যাশিত সোরগোল শুনিয়া দ্রুতপদে নীচে নামিয়া আসিল।

চোর এতক্ষণ ড্রয়িংরুমের দ্বারের কাছে পর্দার আড়ালে লুকাইয়া ছিল; নন্দা নামিয়া আসিবার পর সে সরীসৃপের মতো নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়া উপরে অদৃশ্য হইয়া গেল।

যদুনাথ ও নন্দা যখন ভূপতিত মন্মথ ও সেবকের কাছে উপস্থিত হইলেন তখন তাহারা পরস্পর ধরাধরি করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইবার চেষ্টা করিতেছে।

যদুনাথ কড়া স্বরে বলিলেন-কি হয়েছে, এত চেঁচামেচি কিসের?

মন্মথ ও সেবক একসঙ্গে বলিল—চোর চোর—

নন্দা বলিয়া উঠিল—কই কোথায় চোর?

সে চারিদিকে তাকাইল। যদুনাথ আর্তনাদ করিয়া উঠিলেন—

অ্যাঁ—চোর! আমার সূর্যমণি—

তিনি হাঁপাইতে হাঁপাইতে গিয়া ঠাকুরঘরের দ্বার খুলিলেন। দেখিলেন সূর্যমণি যথাস্থানে আছে, চুরি যায় নাই।

যদুনাথ দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন-যাক, আছে—

তিনি আবার ঠাকুরঘরে তালা লাগাইলেন। ইতিমধ্যে বাড়ির ভিতর হইতে আরও তিন-চারজন ভৃত্য উপস্থিত হইয়াছিল।

মন্মথ তাহাদের বলিল—বাড়িতে চোর ঢুকেছে। খোঁজো তোমরা—ওপরে নীচে চারিদিকে খুঁজে দ্যাখো-যাও—

চাকরেরা ইতি-উতি চাহিতে লাগিল, তারপর ভয়ে ভয়ে এদিকে ওদিকে প্রস্থান করিল।

যদুনাথ মন্মথকে প্রশ্ন করিলেন—কোথায় ছিল চোর? কে দেখলে তাকে?

মন্মথ থতমত খাইয়া বলিল—আমি খাবার জন্যে নীচে নেমে এসে দেখি—

যদুনাথ সন্দিগ্ধভাবে বলিলেন—খাবার জন্যে? এত রাত্রে?

মন্মথ বলিল—আমি—পৌনে দশটার সময় বাড়ি ফিরেছি কিন্তু খিদে ছিল না তাই নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলাম। তারপর এই মিনিট পাঁচেক আগে নেমে এসে খাবার ঘরে ঢুকে দেখি–

ও—কি দেখলে?

দেখি একটা লোক আমার আসনে বসে বসে খাচ্ছে—

খাচ্ছে!

হ্যাঁ, টপাটপ খাচ্ছে।

নন্দা সহানুভূতির স্বরে বলিল—আহা বেচারা! হয়তো পেটের জ্বালাতেই চুরি করতে ঢুকেছিল—হয়তো কতদিন খেতে পায়নি?

মন্মথ বলিল–তা জানি না। কিন্তু এদিকে আমার নাড়ী জ্বলে যাচ্ছে।

নন্দা বলিল—এস তোমাকে খেতে দিই। আলমারিতে খাবার আছে।

তাহারা ভোজনকক্ষে গেল; যদুনাথ ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। চাকরেরা বিভিন্ন দিক হইতে ফিরিয়া আসিল।

জনৈক ভৃত্য বলিল—বাড়িতে চোর নেই বাবু, ওপর নীচে আঁতিপাতি করে খুঁজেছি।

যদুনাথ বলিলেন—নেই তো গেল কোথায়? এই ছিল এই নেই—একি ভেলকিবাজি নাকি!-সদর দরজা খোলা রয়েছে, সেবক কই?

এই সময় একজোড়া ছেঁড়া জুতা দুই হাতে আস্ফালন করিতে করিতে সেবক দরজা দিয়া প্রবেশ করিল।

পেয়েছি! পেয়েছি!—এই দ্যাখো

সেবক দুর্গন্ধ জুতাজোড়া যদুনাথের নাকের সম্মুখে ধরিল। যদুনাথ দ্রুত নাক সরাইয়া লইয়া বিরক্ত স্বরে বলিলেন—

আ গেল যা। কি পেয়েছিস?

সেবক বলিল—জুতো গো বাবু-জুতো। উঁই ঝাড়ের পেছনে জুতো খুলে রেখে বাড়িতে ঢুকেছিল

যদুনাথ জুতার ছিন্ন গলিত অবস্থা নিরীক্ষণ করিলেন।

হুঁ, সত্যিই ছিচকে চোর, খাবার লোভে বাড়িতে ঢুকেছিল। যা রাস্তায় ফেলে দিগে যা।

সেবক লাফাইয়া উঠিল—ঐঃ। ফেলে দেব! পুলিসকে দিতে হবে না?

যদুনাথ অস্ফুটস্বরে বলিলেন-পুলিস! হ্যাঁ, পুলিশকে খবর দেওয়া দরকার। কিছু বলা যায় না।

ওদিকে ভোজনকক্ষে মন্মথ ও নন্দা মুখোমুখি দাঁড়াইয়া ছিল; মন্মথ একটা রেকাবি হাতে লইয়া আহার করিতেছিল। নন্দা ভর্ৎসনাপূর্ণ চক্ষে তাহার পানে চাহিয়া ছিল।

মন্মথ চিবাইতে চিবাইতে বলিল—চোরে খাবার খেয়ে গেল—হুঁ!

নন্দা বলিল—যেমন কর্ম তেমনি ফল। খাবেই তো চোর। আরও দেরি করে এস!

মন্মথ বলিল-হুঁ।

ওদিকে হল-ঘরে যদুনাথ চাকরদের বলিতেছেন—

চোরটা পালিয়েছে যখন তখন আর কি হবে। তোরা যা, সাবধানে ঘুমোবি। আর সেবক, তুই ঠাকুরঘরের সামনে শুয়ে থাক। আজ অনেক রাত হয়েছে, কাল সকালে পুলিস ডাকব।

অন্য ভৃত্যরা চলিয়া গেল। সেবক চোরের জুতাজোড়া বগলে করিয়া বলিল—ঠাকুরঘরের সামনেই শোব। কিন্তু জুতো ছাড়ছি না। কাল সকালে পুলিস এলেই বলব, এই ন্যাও জুতো!

ইতিমধ্যে মন্মথ ও নন্দা ফিরিয়া আসিয়াছে। নন্দা বলিল—জুতো! কি হবে জুতো?

সেবক বলিল—কী আর হবে? চোরের জুতো পেয়েছি, আজ রাত্তিরে মাথায় দিয়ে শুয়ে থাকব। তারপর কাল সকালে দেখো।

মন্মথ বলিল—মাথা খারাপ।

যদুনাথ নন্দা ও মন্মথকে বলিলেন—তোমরা শুয়ে পড় গিয়ে। রাত হয়েছে।

যদুনাথ নিজ কক্ষে ফিরিয়া গেলেন। নন্দা ও মন্মথ সিঁড়ি দিয়া উপরে চলিল। সেবক জুতাজোড়া বালিশের মতো মাথায় দিয়া ঠাকুরঘরের সম্মুখে শয়নের উদ্যোগ করিল।

নন্দা ও মন্মথ উপরে আসিয়া নিজেদের ঘরের দরজার সম্মুখে দাঁড়াইল। নন্দার দরজা খোলা রহিয়াছে, ভিতরে আলো জ্বলিতেছে। মন্মথ নিজের ঘরের দরজা ঠেলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিতে যাইবে এমন সময় নন্দা মিনতির সুরে বলিয়া উঠিল—

দাদা, কেন রোজ রোজ এত দেরি কর বল দেখি? আজ তো আর একটু হলেই ধরা পড়ে গিয়েছিলে।

আমি কি ছেলেমানুষ? কচি খোকা?

নন্দা বলিল—না। কিন্তু সে কথা দাদুকে বললেই পারো। আমরা কেন রোজ রোজ তোমার জন্যে দাদুর কাছে মিছে কথা বলব? জানো একটা মিছে কথা বলার জন্যে দাদু আজ ভুবনবাবুকে বিদেয় করে দিয়েছেন?

মন্মথ রুষ্ট কণ্ঠে বলিল—যথেষ্ট হয়েছে, আমাকে আর লেকচার দিও না। আমি তোমার দাদা, তুমি আমার দিদি নও।

মন্মথ নিজের ঘরে ঢুকিয়া দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। নন্দা কিয়ৎকাল দাঁড়াইয়া নীরবে অধর দংশন করিল, তারপর ফিরিয়া নিজ কক্ষে প্রবেশ করিল এবং বেশ একটু জোরের সঙ্গে দ্বারের ছিটকিনি লাগাইয়া দিল। তারপর বিরক্ত আহত মুখে ওয়ার্ডরোবের সম্মুখে দাঁড়াইয়া চুলের বিননি খুলিতে লাগিল।

ওদিকে মন্মথ নিজের ঘরে গিয়া আলো জ্বালিয়াছিল। ঘরটি নন্দার ঘরের জোড়া; ওয়ার্ডরোবের স্থানে একটি ড্রেসিং টেবিল আছে। মন্মথ ইতিমধ্যে পায়জামার উপর ড্রেসিং গাউন পরিয়াছে, সিগারেট ধরাইয়াছে। এখন সে টেবিলের সম্মুখে বসিয়া একটি দেরাজ খুলিল; দেরাজ হইতে লিলির একটি ছোট ফটোগ্রাফ বাহির করিয়া একদৃষ্টে তাহার পানে চাহিয়া রহিল এবং ঘন ঘন সিগারেট টানিতে লাগিল।

নন্দা নিজের ঘরে চুল আঁচড়ানো শেষ করিয়া আলনা হইতে কোঁচানো আটপৌরে শাড়ি লইয়া রাত্রির জন্য বেশ পরিবর্তন করিতে আরম্ভ করিয়াছে এমন সময় এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটিল। নন্দা সত্ৰাসে দেখিল, ওয়ার্ডরোবের দ্বার ধীরে ধীরে খুলিয়া যাইতেছে, যেন, ভিতর হইতে কেহ দ্বার ঠেলিয়া খুলিতেছে।

নন্দার অবস্থা শোচনীয় হইয়া উঠিল। তাহার বস্ত্র পরিবর্তন ক্রিয়া তখন মধ্যপথে। সে ভয় ও লজ্জায় জড়সড় হইয়া চাপা গলায় বলিয়া উঠিল—

কে?

অমনি ওয়ার্ডরোবের ঈষন্মুক্ত দ্বারপথে একজোড়া যুক্তকর বাহির হইয়া আসিল, সেই সঙ্গে কাতর, কণ্ঠস্বর শুনা গেল—

আমাকে মাফ করুন

কণ্ঠস্বর পুরুষের, কিন্তু অতিশয় করুণ। তার উপর জোড় করা হাত দুটি বিনীতভাবে বাহির হইয়া আছে। নন্দা প্রথমে ত্রাসের ধাক্কা সামলাইয়া লইয়া ক্ষিপ্র হস্তে বস্ত্র পরিবর্তন করিতে লাগিল।

তুমি কে?

আমি—আমি চোর।

চোর!

ভয় পাবেন না। আমি আপনার কোনও অনিষ্ট করব না। যদি অনুমতি করেন, বেরিয়ে আসব কি?

না না, এখন বেরিও না।

আচ্ছা। দেখুন, আমার কোনও কু-মতলব নেই, আমি ধরা পড়বার ভয়ে লুকিয়ে আছি। আমাকে ক্ষমা করুন।

নন্দা এতক্ষণে বস্ত্র পরিবর্তন সম্পন্ন করিয়াছে। চোরের দীনতা দেখিয়া সে অনেকখানি সাহস ফিরিয়া পাইল। সঙ্গে সঙ্গে এই অদ্ভুত পরিস্থিতির নূতনত্ব তাহাকে উত্তেজিত করিয়া তুলিল। চেঁচামেচি করিয়া লোক ডাকিলে চোরকে সহজেই ধরা যায়। কিন্তু না তাহা করিল না। সে স্বভাবতই সাহসিনী। কোমরে আঁচল জড়াইয়া সে নিজের পড়ার টেবিলের কাছে গেল; টেবিলের উপর একটি রুল ছিল, দৃঢ় মুষ্টিতে সেটি ধরিয়া সে চোরের দিকে ফিরিল। বলিল—

এবার বেরিয়ে এস।

চোর যুক্তকরে ওয়ার্ডরোব হইতে বাহির হইয়া আসিল।

নন্দা রুল তুলিয়া বলিল—দাঁড়াও—আর এগিয়ো না।

চোর অমনি দাঁড়াইয়া পড়িল। নন্দা ইতিপূর্বে কখনও চোর দেখে নাই, চোর সম্বন্ধে একটা প্রেত-পিশাচ জাতীয় ধারণা তাহার মনে ছিল। কিন্তু এই চোরের মূর্তি দেখিয়া তাহার সমস্ত ভয় দুর হইল। চোর নিতান্ত নির্জীব প্রাণী। সে সতেজে প্রশ্ন করিল—

তুমি আমার ঘরে ঢুকলে কি করে?

চোর কাতর কণ্ঠে বলিল—আমাকে তাড়া করেছিল, তাই পালাবার রাস্তা না পেয়ে ওপরে পালিয়ে এসেছিলাম-দোহাই আপনার, আমাকে পুলিসে দেবেন না।

চোর দীন নেত্রে নন্দার মুখের পানে চাহিল।

নন্দা বলিল—তুমি চুরি করবার জন্যে এ বাড়িতে ঢুকেছিলে?

চোর উত্তর দিল না, লজ্জাহত চক্ষু নত করিল। নন্দার মনে দয়া হইল; কিন্তু তাহার ভাবভঙ্গি নরম হইল না। রুলের দ্বারা চেয়ার দেখাইয়া সে কড়া সুরে বলিল—

বোস ঐ চেয়ারে।

চোর সঙ্কুচিতভাবে চেয়ারের কানায় বসিল।

নন্দা বলিল—তোমার নাম কি?

দিবাকর-দিবাকর রায়।

নন্দা সবিস্ময়ে প্রতিধ্বনি করিল—দিবাকর রায়। ভদ্রলোকের ছেলে হয়ে তুমি চুরি কর।

দিবাকর কাতরভাবে বলিল—আমি বড় গরীব কাজকর্ম পাইনি

নন্দা প্রশ্ন করিল—কাজকর্ম পাওনি কেন? লেখাপড়া করেছ?

চোর ছাড়া-ছাড়া ভাবে উত্তর দিল—ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়েছিলাম—পাস করতে পারিনি। আবার বাবা ভদ্রলোক ছিলেন, কিন্তু তিনি হঠাৎ মারা গেলেন—কিছু রেখে যেতে পারেননি। মা অনাহারে মারা গেলেন–তারপর—তারপর কাজ যোগাড় করবার অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু কেউ কাজ দিলে না। তাই শেষ পর্যন্ত পেটের জ্বালায়

নন্দার মুখ এবার করুণায় কোমল হইল।

পেটের জ্বালায়! তাই বুঝি তুমি খাবারঘরে ঢুকে খেতে বসেছিলে?

দিবাকর বলিল—হ্যাঁ। সবে একটি গ্রাস মুখে তুলেছি এমন সময়

আহা বেচারা! এখনও বোধ হয় তোমার পেট জ্বলছে?

ও কিছু নয়। আমার অভ্যেস আছে।

নন্দা টেবিলের উপর রুল রাখিয়া দিল, সদয় কণ্ঠে বলিল—

তুমি খাবে? আমার ঘরে খাবার আছে।

দিবাকর চেয়ার হইতে উঠিয়া উচ্চকিতভাবে চাহিল।

খাবার!!

হ্যাঁ—এই যে। এস।

নন্দার অনুবর্তী হইয়া দিবাকর চরকি আলমারির কাছে গিয়া দাঁড়াইল, সাগ্রহে খাদ্যদ্রব্যগুলি দেখিয়া নন্দার পানে চোখ তুলিল।

আমাকে এই সব খেতে বলছেন?

হ্যাঁ-খাও না।

আপনার দয়া জীবনে ভুলতে পারব না

এক টুকরা খাদ্য তুলিয়া মুখে দিতে গিয়া দিবাকর সহসা থামিয়া গেল।

কিন্তু—এ তো আপনার খাবার!

নন্দা বলিল—তাতে কি! তুমি খাও।

দুঃখিতভাবে মাথা নাড়িয়া দিবাকর খাদ্য থালায় রাখিয়া দিল।

না, আপনার মুখের খাবার খেতে পারব না। আপনার নিশ্চয় খিদে পেয়েছে।

নন্দা বলিল—না, আমার খিদে নেই। তুমি খাও না

দিবাকর বলিল—মাফ করবেন, আমি পারব না। আপনার কষ্ট হবে।

নন্দা এবার হাসিয়া বলিল—আচ্ছা, আমিও খাচ্ছি। এবার খাবে তো?

নন্দা থালা হইতে চিংড়ি মাছের কাটলেট তুলিয়া লইয়া তাহাতে একটু কামড় দিল। দিবাকরের মুখে এতক্ষণে হাসি দেখা দিল। সে একটা লুচি লইয়া মুখে পুরিল। চরকি আলমারির দুই পাশে দাঁড়াইয়া চোর ও গৃহকন্যার যৌথ ভোজন আরম্ভ হইল।

মন্মথ এখনও শয়ন করে নাই, সিগারেট টানিতে টানিতে নিজের ঘরে পায়চারি করিতেছিল। বন্ধ। দরজার সম্মুখ দিয়া যাতায়াত করিবার সময় বাহির হইতে অস্পষ্ট বাক্যালাপ তাহার কানে আসিতেছিল; কিন্তু এতক্ষণ সেদিকে সে মন দেয় নাই। এখন সে হেঁট মুখে দাঁড়াইয়া শুনিবার চেষ্টা করিল, তারপর ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া দ্বারের দিকে চলিল।

নন্দার ঘরে দুজনের আহার তখন প্রায় শেষ হইয়াছে, দ্বারে ঠকঠক শব্দ শুনিয়া উভয়ে চমকিয়া উঠিল। নন্দা চকিতে নিজের ঠোঁটের উপর আঙুল রাখিয়া দিবাকরকে নীরব থাকিতে ইঙ্গিত করিল, তারপর দ্বারের দিকে ফিরিয়া উচ্চ কণ্ঠে বলিল

কে?

দ্বারের অপর পার হইতে মন্মথর কণ্ঠস্বর আসিল—

আমি। দোর খোলো।

দাদা! কি দরকার?

দোর খোলো–কার সঙ্গে কথা কইছ?

নন্দা নীরবে দিবাকরকে ইশারা করিল, দিবাকর আলমারির পিছনে বসিয়া পড়িল। তখন নন্দা রঘুবংশ বইখানা তুলিয়া লইয়া দ্বারের ছিটকিনি খুলিয়া দাঁড়াইল, ঈষৎ বিরক্তির স্বরে বলিল—এত রাত্রে তোমার আবার কি হল!

মন্মথ সন্দিগ্ধভাবে ঘরের এদিক ওদিক উঁকি মারিল, বলিল—

তুমি এখনও ঘুমোওনি?

না। কিছু দরকার আছে?

মনে হল তুমি কার সঙ্গে কথা কইছ।

কথা কইছি! সে কি? ও-

নন্দা হাসিয়া উঠিল। হাতে খোলা বই দেখাইয়া বলিল—

পড়া মুখস্থ করছিলাম।

এত রাত্রে পড়া মুখস্থ।

হ্যাঁ। শুনবে? শোনো

অমূং পুরঃ পশ্যসি দেবদারুম্
        পুত্ৰীকৃতহসৌ বৃষভধ্বজেন।

মন্মথ উত্যক্তভাবে বলিল-থাক, দুপুর রাত্রে শ্লোক আওড়াতে হবে না।

সে নিজের ঘরে চলিয়া গেল। নন্দা আবার দ্বার বন্ধ করিল। যেন মস্ত একটা ফাঁড়া কাটিয়াছে এমনিভাবে সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া সে বইখানা টেবিলের উপর ফেলিল। দিবাকরের মুণ্ড চরকি আলমারির পিছন হইতে ধীরে ধীরে জাগিয়া উঠিল। চোখে চোখে বাক্য বিনিময় হইল।

অতঃপর তাহাদের কথাবার্তা অনুচ্চ ফিসফিস্ স্বরে হইতে লাগিল।

দিবাকর বলিল—আপনি দুবার আমাকে রক্ষা করলেন। এবার আমি যাই।

নন্দা বলিল—হাঁ, এবার তোমাকে যেতে হবে! কিন্তু যাবে কোন্ দিক দিয়ে?

দিবাকর খোলা জানালার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিল—

বাগানে কেউ আছে কিনা দয়া করে একবার দেখবেন কি?

একটু বিস্মিত হইয়া নন্দা জানালার কাছে গিয়া নীচে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল। চাঁদ অস্ত গিয়াছে, নীচে বড় কিছু দেখা যায় না।

নন্দা বলিল—না, কেউ নেই।

দিবাকর বলিল—তাহলে আমি জানালা দিয়েই

নন্দা সরিয়া আসিল; দিবাকর গিয়া জানালা দিয়া উঁকি মারিল।

নন্দা বলিল—কিন্তু যদি পড়ে যাও, হাত-পা ভাঙবে

দিবাকর বলিল—না, পড়ব না, একটা জলের পাইপ আছে।—হাত জোড় করিয়া বলিল—আমাকে আপনি অনেক দয়া করেছেন, এবার বিদায় দিন।

নন্দা আঙুল তুলিয়া বলিল—কিন্তু মনে রেখো, আর কখনও চুরি করবে না। তুমি পুরুষ, ভদ্রসন্তান; কাজ করবে।

দিবাকর বলিল—কাজ পাব কোথায়? যখন কুলি-কাবাড়ীর কাজ পাই তখন করি; আর যখন পাই না-পেটের দায় বড় দায়।

আচমকা একটা কথা নন্দার মনে পড়িয়া গেল; সে বিস্ফারিত নেত্রে কিছুক্ষণ শুন্যে তাকাইয়া রহিল। বড় দুঃসাহসের কথা, কিন্তু একটা হতভাগাকে যদি সৎ পথে আনা যায়। নন্দা দিবাকরের কাছে এক-পা সরিয়া আসিয়া চাপা উত্তেজনার কণ্ঠে বলিল

আমি যদি তোমাকে কাজ দিই, তুমি কাজ করবে?

দিবাকর চমকিয়া উঠিল—কাজ! আপনি আমাকে কাজ দেবেন।

নন্দা বলিল—দিতে পারি। আমার দাদুর একজন সেক্রেটারি চাই। তুমি হিসেব-নিকেশের কাজ জানো?

দিবাকর দ্বিধাভরে বলিল—তা—একটু একটু জানি।

তা হলেই হবে। কিন্তু মনে থাকে যেন, যদি এক পয়সা চুরি হয় তাহলে পুলিশে ধরিয়ে দেব।

বিশ্বাস করুন, কাজ পেলে আমি চুরি করব না। চুরি করা আমার স্বভাব নয়; অভাবে পড়েই

আচ্ছা। বেশ।

নন্দা ওয়ার্ডরোব হইতে একটা দশটাকার নোট লইয়া দিবাকরের হাতে দিল। দিবাকরের মুখ কৃতজ্ঞতায় ব্যাকুল হইয়া উঠিল।

নন্দা বলিল—এই নাও দশটাকা। এখন যা বলি শোন। কাল সকালে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে ভাল কাপড়-চোপড় পরে দাদুর সঙ্গে দেখা করতে আসবে।

দিবাকর বলিল—আপনি যা বলবেন তাই করব। আর কি করব বলুন। চাকরির কথা আপনার দাদুকে বলব কি?

নন্দা গালে আঙুল ঠেকাইয়া ক্ষণেক চিন্তা করিল। শেষে বলিল—না, তাতে গণ্ডগোল হতে পারে। শোন, আমার দাদু জ্যোতিষ চর্চা করেন। তুমি বলবে, তাঁর নাম শুনে এসেছ; তোমার। কাজকর্ম নেই কবে কাজকর্ম হবে তাই জানতে এসেছ। বুঝলে?

আজ্ঞে বুঝেছি। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। কাল সকালে আমি আসব।

আবার জোড়হস্তে নন্দাকে নমস্কার করিয়া দিবাকর জানালা পার হইল; তারপর তাহার মস্তক জানালার নীচে অন্তর্হিত হইয়া গেল।

নন্দা আসিয়া কিছুক্ষণ জানালার নীচে চাহিয়া রহিল; পরে জানালা বন্ধ করিয়া দিল। তাহার মুখে ভয় সংশয় এবং উত্তেজনা মিশিয়া এক অপূর্ব ভাবব্যঞ্জনা ফুটিয়া উঠিল। গত একঘন্টা ধরিয়া এই ঘরে যে ব্যাপার ঘটিয়াছে তাহা স্বপ্ন না সত্য? নিজের দুঃসাহসের কথা ভাবিয়া সে নিজেই স্তম্ভিত হইয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *