১২. তাতারীর বাগিচা

তাতারীর বাগিচা।

কার্পেট-শোভিত কক্ষ। বিশেষভাবে আজ আলোকসজ্জার পরিপাটী দেখা যায়। চার কোণে চারটি সামাদান জ্বলছে। উপরে ঝাড়বাতি। তাকিয়া, গেদা চারিদিকে সাজানো। কক্ষের দক্ষিণ দিকে সংলগ্ন একটি বারান্দা।

তাতারী কক্ষের ভেতরের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার পরিধানে পাজামা পিরহান।

বাগান থেকে ফুলের পোশর এই কামরা পর্যন্ত ধাওয়া করে। তবু মাঝে মাঝে দ্রাক্ষারস সৌরভের কাছে পেছিয়ে যেতে হয়। তিন-চারজন সাকী জাম ও পেয়ালা হাতে প্রতীক্ষমান।

হারুন : তাতারী!

তাতারী : আলম্পানা।

হারুন : ওখানে কেন? আজ আমরা তোমার মেহমান। এই দ্যাখো, কত শরীফ মানুষ এসেছে তোমার বাগিচায়। আবু নওয়াস, আবুল আলাহিয়া, আবু ইস্‌হাক। এদের যেমন দরবারে তেমনি নিজের মাকানে পাওয়া নসীবের কথা। তুমি ভুলে যাও না কেন তুমি আর গোলাম নও। এসো, এসো।

তাতারী : জাঁহাপনা…

হারুন : খানাপিনা যথেষ্ট হয়েছে। আবু নওয়াস আর মাটিতে পা ফেল্‌বে না। কি বলো, আতাহিয়া?

আতাহিয়া : জাঁহাপনা, আবু নওয়াস সব সময় মাথায় হাঁটে। ও আর কখনই বা পা ব্যবহার করে?

হারুন : কিন্তু আজ কদম টলটলমান।

আতাহিয়া : জাঁহাপনা, ওর খোয়ারী এসে গেছে। এই নওয়াস!

নওয়াস : জী।

আতাহিয়া : ঘুমোচ্ছ কেন? হাসি শুনবে না?

নওয়াস : আতাহিয়া, তুমি আমার লেজ ছাড়া আর কিছু নও। কিন্তু দুম্বার লেজ বেজায় ভারী।

আতাহিয়া : আমিরুল মুমেনীন, আপনি সাক্ষী থাকুন। নিজের মুখে স্বীকার করেছে, আবু নওয়াস একটা দুম্বা।

নওয়াস : আতাহিয়া, হুজুরের সামনে বেয়াদবি করো না। তুমি তা হলে মেনে নিচ্ছো, তুমি একটা লেজ।

আতাহিয়া : তুমি দুম্বা হলে, আমার লেজ হতে আপত্তি নেই।

নওয়াস : দু……বা… লেজ। দুম্বা লেজ।

আতাহিয়া : আবু নওয়াস, তোমার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।

হারুন : থামো দুই জনে। তোমাদের কবিদের সঙ্গ মাঝে মাঝে আমাকে ভয়ানক বিরক্ত করে তোলে। খালি কথা আর কথা। তাতারী, এরা এসেছে তোমার হাসি শুনতে। একবার সেই হাসি–বিশ্বজয়ী হাসি–শুনিয়ে দাও ত। এই নওয়াস…

নওয়াস : জাঁহাপনা।

হারুন : চোখ খোলো।

নওয়াস : আস্‌সামোয়া তায়তান।

হারুন : হ্যাঁ, তাতারী, তোমার হাসি শুনিয়ে দাও। কী…? এখানে লজ্জা পাচ্ছো। ঐ বারান্দায় গিয়েই হাসি শুনিয়ে দাও।

তাতারী : জাঁহাপনা।

হারুন : কী বলো।

তাতারী : হাসতে পারছি না, আমিরুল মুমেনীন।

হারুন : তুমি কি আবু নওয়াসের মত পানিতে ডুবে আছো?

তাতারী : না, জাঁহাপনা। আপনি দেখেছেন, ও পানি আমি স্পর্শ করি না।

হারুন : তবে হাসবে না যে।

তাতারী : আলম্পানা, হাসি আসছে না।

হারুন : আবু ইস্‌হাক, একে হাসির দাওয়াই দাও।

ইস্‌হাক : জাঁহাপনা, ও এখনি হাসবে। এ-ই হাসো ত হে।

তাতারী : হাসতে পারছি না, জনাব আবু ইস্‌হাক।

হারুন : আমি খোদ আমিরুল মুমেনীন হুকুম দিচ্ছি, তুমি হাসো। তোমার হাসি আমরা শুনতে চাই। হাসি শোনার জন্যে এদের ডেকে এনেছি। বেইজ্জৎ হব?

সময়ের ভারের কাছে হিমালয় পরাজয় স্বীকার করে। এখানে মহাজাল স্বয়ং অনড়। সকলের নিঃশ্বাস ভারী। কামরায় সকলে নিস্তব্ধ। সকলের দৃষ্টি একজনের দুই ঠোঁটের উপর নিবদ্ধ। কাল হয়তো এখানেই থেমে থাকত, যদি না হারুনর রশীদ হঠাৎ গর্জে উঠতেন।

হারুন : হাসোর… কি এখনও হাসছো না?

তাতারী : জাঁহাপনা।

হারুন : আমাকে বহু মানুষ জাঁহাপনা বলে, তোমার কাছ থেকে ও ডাক শুনতে চাই না। আমি শুনতে চাই হাসি।

তাতারী : জাঁহাপনা…

হারুন : বুঝেছি। তুমি হাসবে না। তুমি আমাকে বন্ধুদের সামনে বেইজ্জৎ করতে চাও। মশ্‌রুর…

মশ্‌রুর : জাঁহাপনা, এই নাফরমান বান্দার গর্দান এখনই দু-টুকরা করি।

আতাহিয়া : জাঁহাপনা…

হারুন : কি আবুল আতাহিয়া, তুমি আবার কি বলতে চাও।

আতাহিয়া : জিল্লুল্লাহ্ এখনই ওর সাজা দেবেন না?

হারুন : কেন?

আতাহিয়া : আলম্পানা, কারণ এত খানাপিনা আর গান-বাজনা আর হাসির পর, একদা-গোলামের হাসি না শুন্‌লেও চলবে।

হারুন : আতাহিয়া, তুমি চুপ করো। মশ্‌রুর—

মশ্‌রুর : জাঁহাপনা—

হারুন : তল্‌ওয়ার খোলো। দেরী করছ কেন?

নওয়াস : আলম্পানা, আলম্পানা… আমি কবি আপনি জানেন। নাফরমানের গর্দান নেওয়া উচিত। কিন্তু এর অপরাধ কতটুকু বিচার করে দেখা হোক। ও হাসছে না। কিন্তু হাসির জন্য ওয়াক্ত লাগে, যেমন নামাজের জন্য প্রয়োজন হয়।

হারুন : আবু নওয়াস, তোমার কবিত্বের খোমা এখন গাছে ঝুলিয়ে রাখো। ওয়াক্ত লাগে? সময় লাগে?

আতাহিয়া : হাঁ, জাঁহাপনা। সব সময় হাসি আসে না।

নওয়াস : আমি ত আপনাকে, নুরুল্লাহ্ আগেই বলেছি, উপাদান লাগে।

হারুন : আবু নওয়াস, তুমি হুঁশে আছে তা হলে।

নওয়াস : আলম্পানা, হুঁশে থাকার জন্যই আমি বেহুঁশ হই। আল্ খামারো লী কামারান্‌। সুরা আমার কাছে আকাশের চাঁদ।

হারুন : কি বলতে চাও তুমি, আবু নওয়াস? সাফ্‌-সাফ্‌ বলো।

নওয়াস : আস্‌সামায়ো তায়তান। হুজুর দুনিয়ায় কত দাঙ্গাহাঙ্গামা, খুন-খারাবি, ঝগড়া-কোন্দল, লোভ মোহ মাৎসর্য। এ সব কি দেখা যায় চোখে? বেহুঁশ থাকাই লাভ। আমার ওই হুঁশ আছে বলেই আমি বেহুঁশ থাকতে চাই। আর যাদের সে হুঁশ নেই অর্থাৎ যারা বেহুঁশ–তারা হুঁশে থাকে, আর যারা ইশে থাকে তারা বেহুঁশ। দুনিয়ার তাবৎ লড়াইবাজ দাঙ্গাবাজ ফেরেব্বাজ আওরতবাজ ঘোড়াবাজ মরদ্‌বাজ নিজেদের ভয়ানক হুশিয়ার মনে করে।

হারুন : নওয়াস, তুমি যে কী বলছ, আমার ও বোঝার সাধ্য নেই। মরদবাজ আবার কি? আরগুলো থোড়াবহুৎ বুঝি।

নওয়াস : আলম্পানা, সেই লুৎ-আলয়হেস্ সালামের জমানায়–

[সকলে : হা-হ্ হা-হ্ হা। হা হ্ হাহ্ হা হ্‌]

হারুন : আবুল আলাহিয়া, তোমাদের মত কবি এবং বাদক সঙ্গে থাকলে আর খেলাফৎ চলবে না। মশ্‌রুর, তোমার তলওয়ার নামাও। কিন্তু মনে রেখো, তাতারী তোমাকে যা দিয়েছি, তা আর কেউ পেলে আবার আমার গোলাম হতে চাইত। এত বাগবাগিচা বান্দী গোলাম ধনদৌলত। খবরদার আর নেমকহারামির অপবাদ নিজের মাথায় ঢালবে না। আজ তোমাকে মাফ করলাম। কয়েকদিন পর আবার আসছি, তোমার হাসি আমরা শুনব। মনে রেখো…।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *