০৭. গোলাম-বস্তী

পরদিন রাত্রি।

গোলাম-বস্তী নিঝঝুম।

তারা দু’জনে ঘুমিয়ে ছিল, মৃত্যু-রূপা ঘুম–একে অপরের অঙ্গের পাকে পাকে একাকার।

হঠাৎ দরজায় করাঘাতের শব্দ হলো। প্রথমে ধীরে, মৃদু শব্দ। তারপর জোরে, দ্রুত।

–তাতারী, শুনছো?

–কে… কি …

মেহেরজান : শুনছো?

তাতারী : কি মেহেরজান?

মেহেরজান : দুয়ারে কে ঘা দিচ্ছে।

তাতারী : আমার ঘোড়াটা হয়ত দড়ি ছিঁড়ে আমার খোঁজে এসেছে।

মেহেরজান : না, না–এ তোমার পেয়ারা ঘোড়া নয়। মানুষ।

তাতারী : শুয়ে থাকো, কোন সাড়া দিও না।

মেহেরজান : আরো জোরে ঘা দিচ্ছে, দরজা ভেঙে পড়বে। আমি হলফ করে বলতে পারি ঘোড়া নয়। তুমি সাড়া দাও।

তাতারী : কে?

নেপথ্যে : দরজা খোল।

তাতারী : কেন?

নেপথ্যে : দরকার আছে।

তাতারী : কে?

নেপথ্যে : এই গোলাম, দরজা খোল। নচেৎ লাথি দিয়ে ভেঙে ফেলব।

তাতারী : কে আপনি, জনাব?

নেপথ্যে : আমি মশ্‌রুর।

তাতারী : জাঁহাপনা, এখনই খুলছি। (ফিসফিস্ কণ্ঠে) মেহেরজান, সর্বনাশ! তুমি তাড়াতাড়ি বোরখা পরে নাও।

মেহেরজান : (ফিসফিস্ শব্দে) তাতারী, আল্লা যেন সহায়, নেঘাবান হন। কোথাও লুকানোর জায়গা নেই?

তাতারী : এই ছোট খুপরী, লুকাবে কোথায়?

মেহেরজান : তবে আল্লা যা নসীবে রেখেছেন, আমি বোরখা পরে নিই, তুমি দরজা খুলে দাও।

নেপথ্যে : এই জলদি কর, দরজা খোল্‌।

তাতারী : দিচ্ছি জনাব। বোরখা পরেছ?

মেহেরজান : পরেছি।

তাতারী : আসুন, জনাব। (নতজানু) আহ্লান ওয়া সাহলা ইয়া মওলানা। এ কি! স্বয়ং আমিরুল মুমেনীন। লা-হাওলা ওলা কুয়াতা, আলম্পানা, বান্দার গোস্তাখি মাফ করবেন। এই শির কালাম। গোস্তাখির জন্য আমার কঠোর সাজা দিন, জাঁহাপনা।

হারুন : তুই ঘরের প্রদীপ জ্বালিয়েছিস, আরো আলো–আরো রোশনাই চাই।

তাতারী : জাঁহাপনা গরীবের আর তো কিছু নেই। তবে পাশের প্রতিবেশীর কাছ থেকে চেয়ে আনি।

হারুন : মশ্‌রুর, কোতোয়ালদের একটা আলো আনতে বলো, শিগগির।

মশ্‌রুর : যে হুকুম, জাঁহাপনা।

তাতারী : আলম্পানা, গোস্তাখি মাফ করবেন বান্দার সওয়ালে। এই সুসাম রাত্রে আপনার পয়জার এই গোলামদের বস্তীতে জিল্লুল্লাহর আবির্ভাব? কিছু বুঝতে পারছি নে।

হারুন : আবু ইস্‌হাক।

ইস্‌হাক : জাঁহাপনা।

হারুন : আমার বদলে তুমি জবাব দাও।

ইস্‌হাক : এই গোলাম, জাঁহাপনা তোর হাসি শুনে খুব সন্তুষ্ট হয়েছেন। তাই তোর জন্যে ইনাম নিয়ে এসেছেন।

 তাতারী : ইনাম?

ইস্‌হাক : হ্যাঁ, ইনাম।

তাতারী : কিন্তু জাঁহাপনা, বান্দার কোন গুণ নেই, আর বান্দা এমন কোন কাজ করে নি, যার জন্যে সে ইনাম প্রত্যাশী হতে পারে।

ইস্‌হাক : গোলাম, তোর হাসি বড় মধুর। তাই আমিরুল মুমেনীন সেই হাসির রেশ ধরে এখানে এসে পৌঁছেছেন।

তাতারী : জনাব, বান্দাকে আর গোনাগার করবেন না। গোলাম, তার আবার হাসি!

হারুন : না, সত্যি। ইস্‌হাক আমার কথাই বলছে। আমি সেই জন্যেই এসেছি।

তাতারী : আমিরুল মুমেনীন, আল্লা আপনার শান শওকত আরো বৃদ্ধি করুন, আপনার দবদবা দিকেদিকে ছড়িয়ে পড়ুক। আপনি দুনিয়ার আমীর হন। গরীবের এই জুপড়িতে কি করে যে আপনারে জায়গা দিই।

মশ্‌রুর : চুপ কর, গোলাম।

হারুন : এই যে কোতোয়ালের আলো এনেছে। এখন চারিদিক বেশ চোখে পড়ে। এই গোলাম, ওটা কী?

তাতারী : কি জাঁহাপনা?

হারুন : ওই যে দেওয়ালের সাথে কালো বোরখা লেগে রয়েছে।

তাতারী : জাঁহাপনা–

হারুন : কি?

তাতারী : জাঁহাপনা–

মশ্‌রুর : জবাব দে, নফর।

তাতারী : জাঁহাপনা, বান্দাকে কতl করুন। বান্দা এই জবাব দিতে অক্ষম।

হারুন : জবাব দে, নচেৎ–

তাতারী : জাঁহাপনা।

হারুন : মশ্‌রুর, এই বান্দরের জিভ ছিঁড়ে নাও, এখনও জবাব দিচ্ছে না।

মশ্‌রুর : আবু ইস্‌হাক, দ্যাখো দ্যাখো, গোলামটা ধুলোয় লুটিয়ে কাঁদছে, তবু জবাব দিচ্ছে না।

ইস্‌হাক : আমি দেখি, মশ্‌রুর। এই, আমিরুল মুমেনীনের সওয়ালের জবাব দে।

হারুন : মশ্‌রুর, যা ভেবেছিলাম তা নয়, না-ফরমান গোলাম। একে কতল করো এক্ষনি।

মেহেরজান : (বোরখা খুলিতে খুলিতে) না, না আমিরুল মুমেনীন। দেওয়ালের গায়ে শুধু বোরখা নেই, আমি আছি তার ভেতরে। ওকে মাফ করুন।

হারুন : আবু ইস্‌হাক, মশ্‌রুর দ্যাখো। বোরখার অন্ধকার ছিঁড়ে এই মাহতাব (চাঁদ) কোথা থেকে উদয় হোলো? থামো মশ্‌রুর। জবাব পাওয়া গেছে। এই, তুই কে?

মেহেরজান : (নতজানু) জাঁহাপনা, মজ্‌কুর জানানা আপনার বাঁদী।

হারুন : বাঁদী।

মেহেরজান : হা, জাঁহাপনা।

হারুন : কোন্ দেশী বাঁদী এমন?

মেহেরজান : আরমেনী বাঁদী, আমিরুল মুমেনীন।

হারুন : এই গোলাম, উঠে দাঁড়া। একটা জবাব দিবি, তবু এত ভয়। এ তোর কে?

তাতারী : আমার বিবি আলম্পানা।

হারুন : তোর বিবি?

তাতারী : হ্যাঁ, জাঁহাপনা।

হারুন: তুই শাদী করেছিস্‌, অথচ খবর দিস্ নি? গোলামের আস্পর্ধা বড় বেড়ে গেছে। আলেপ্পো শহরে কতকগুলো গোলামের তাই মাথা থেঁৎলে দিতে হোলো।

তাতারী : জাঁহাপনা, গোস্তাখি মাফ করবেন। আপনার পায়ের খাক্‌ এই গোলাম। তার আবার শাদী। তার আবার দাওয়াৎ।

হারুন : তোর কি জানা নেই, আপন মাওলার (প্রভু) হুকুম ছাড়া কোন গোলাম শাদী করতে পারে না বা নিজের বেটির শাদী দিতে পারে না?

তাতারী : জানি, জাঁহাপনা।

হারুন : তবে—

তাতারী : তার সাজা নিতে আমি প্রস্তুত আছি। অবাধ্য, নাফরমান বান্দার যা’ শাস্তি হয়, তাই আমার প্রাপ্য।

হারুন : হ্যাঁ, তোর গর্দান যাওয়াই উচিৎ। এই বাঁদী, তুই কোথা থাকিস্?

মেহেরজান : আপনার মহলের বাঁদী, জাঁহাপনা।

হারুন : আমার মহলের বাঁদী শাদী করেছে গোলাম, অথচ আমাকে কেউ জানায় নি। তাজ্জব ব্যাপার। তোকে কোনদিন দেখি নি?

মেহেরজান : না, আলম্পানা।

হারুন : অমন নতজানু করজোড়ে তোর থাকার দরকার নেই। উঠে দাঁড়া।

মেহেরজান : জাঁহাপনা। বান্দীকে আর গোনাগার করবেন না।

হারুন : আমি যা বলি, তা শোন্। এখানে মশ্‌রুর খাড়া আছে তা ভুলে যাস্ নি। উঠে দাঁড়া।

মশ্‌রুর : জাঁহাপনা–

হারুন : গোলাম, তোর আস্পর্ধা আসমান ছাড়িয়ে গেছে। কুকুরের মত তোদের জিভ ছিঁড়ে নিলে তবে গায়ের ঝাল মেটে।

তাতারী : জাঁহাপনা, বান্দা গোনাগার। আপনার যা মরজী, তা-ই করুন। বান্দার কোন দুঃখ নেই।

হারুন : আবু ইস্‌হাক, এ গোলাম ত চমৎকার কথা বলে। ঠিক তোমার মত।

ইস্‌হাক : হ্যাঁ, আলম্পানা। যারা ভাল কথা বলতে পারে, তারা ভাল হাসতে-ও পারে।

 হারুন : কেন, আবু ইস্‌হাক?

ইস্‌হাক : আলম্পানা, সাধারণ কথা নয়, ভাল কথার মূল কি? ভাল কথা হচ্ছে রুহের (আত্মার) প্রতিধ্বনি–সেখানেই জমে থাকে, তারপর ঝর্নার মত বেরোয়। অনাবিল হাসি হচ্ছে ভাল কথারই শারীরিক রূপ। তাই জিল্লুল্লাহ, যারা ভাল কথা বল্‌তে পারে, তারা ভাল হাসতেও পারে। হাসি আর কথার মূল উৎস এক জায়গায়।

হারুন : ও আবু ইস্‌হাক, তুমি ফল্‌সাফা-দর্শন শুরু করে দিলে। এত বোঝার মত ধৈর্য এখন আমার নেই। এই বাঁদী–তোর কিছু বলার আছে?

তাতারী : না, জাঁহাপনা। গোনাগার, নাফরমান–আমাদের কতল করুন।

হারুন : মশ্‌রুর, তৈরি হও। আমার ফরমান মোতাবেক এদের শাস্তি দেবে। এক চুল না এদিক-ওদিক হয়।

মশ্‌রুর : যো হুকুম আলম্পানা।

হারুন : হাজেরান (সমবেত), মজ্‌লিস–মশ্‌রুর, কবি আবু ইস্‌হাক এবং কোতোয়ালগণ, এই দুই বান্দা এবং বান্দী কানুনের খেলাপ যে কাজ করেছে, তার জন্য এদের শাস্তি কী? তলওয়ারে গর্দান গ্রহণ করা যায়, অঙ্গচ্ছেদ করা চলে, একদিকের পাঁজর নামিয়ে নেওয়া চলে। কিন্তু তলওয়ারের আরো শক্তি আছে। তলওয়ারে লোহার জিঞ্জির ছিন্ন করতে পারে। আমি এই মজলিসে ঘোষণা করছি–আজ থেকে এই দুই বান্দা-বান্দীর গোলামীর জিঞ্জির ছিন্ন হোক। এ দুই জনে মুক্ত–আজাদ, আমার রাজত্বের দুই জন স্বাধীন নাগরিক।

[সকলে : মারহাবা। মারহাবা।]

তাতারী : হে আমিরুল মুমেনীন, আপনার মেহেরবানী সীমাহীন, আপনার হৃদয় বিশাল, আমরা উভয়ে আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। হে জিল্লুল্লাহ, আপনার দুই বাহুতে আরো শক্তি সঞ্চিত হোক যেন সিকান্দার শা’র মত আপনি পৃথিবীর অধীশ্বর হন। আমিরুল মুমেনীন জিন্দাবাদ।

[সকলে : মারহাবা। মারহাবা।]

হারুন : আমি আরো ঘোষণা করছি, এই মুহূর্ত থেকে হাব্‌সী তাতারী–কয়েক মুহূর্ত আগে যে গোলাম ছিল, বগ্‌দাদ শহরে পশ্চিমে আমার যে বাগিচা আছে সেই বাগিচা এবং তার যাবতীয় গোলাম বান্দী, মালমাত্তা, আসবাব সব কিছুর সে মালিক। তার সমস্ত লেবাস ও দিনগুজরানের খরচ আজ থেকে খাজাঞ্চীখানা বহন করবে।

[সকলে : মারহাবা। মারহাবা।]

তাতারী : জাঁহাপনা, আপনার করুণার ঋণ আমরা কোনদিন শোধ দিতে পারব না।

হারুন : যাও, কোতোয়াল–এখন-ই হাব্‌সী তাতারীকে আমার বাগিচায় নিয়ে যাও। লেবাস সেখানে প্রচুর আছে। এই বেশে যেন কোনদিন ওকে আমি না দেখি।

[সকলে : সোবহান আল্লা, সোবহান আল্লা।]

হারুন : একটু সবুর করো, কোতোয়াল। তোমাদের হাসির জন্য আমি এই ইনাম দিলাম। দাঁড়াও দুইজনে। আর একবার সেই হাসি হাসো।

 তাতারী : জাঁহাপনা, বান্দাকে অনেক কিছু দিয়েছেন। তার বোঝায় বান্দার ঘাড় ক্লান্ত। আজ হাসি আসতে পারে না, জাঁহাপনা।

হারুন : বেশ। কিন্তু মনে রেখো, হাসি তোমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। এই হাসিই আমি শুনতে চাই। হ্যাঁ, আমি শুনতে চাই। আমার বুক যখন ভারাক্রান্ত থাকবে, তখনই তোমার হাসি আমি কামনা করব। যাও, এখন নাই-বা হাসলে। কোতোয়াল, একে নিয়ে যা। বাঁদী, তুমি মহলে ফিরে যাও।

ইস্‌হাক : জাঁহাপনা, গোলাম ত চলে গেল। এখন আবু ইসহাকের কথা শুনুন। এই আরমেনী বাঁদী, তৌবা–এই আরমেনী আওরতের জন্য কি ইনাম দিবেন? কান শোনার জন্য পাগল।

হারুন : সে আরো বড় ইনাম। চলো মেহেরজান। আমাদের সঙ্গে চলো। তুমি বেগম জুবায়দার কাছে ফিরে যাও। তবে তুমি আর বাঁদী নও।

মেহেরজান : জাঁহাপনা, আপনি অশেষ মেহেরবান। আপনার মরজীই আমার মরজী।

হারুন : মেহেরজান, তুমিও এত মিষ্টি কথা বলতে পারো। আজব দুনিয়া। রাত্রি প্রায় শেষ। চলো মশ্‌রুর। আবু ইস্‌হাক, তোমার গজল-শোনা রাত্রি আবার আসবে। নিরাশ হয়ো না, কবি।

ইস্‌হাক : আলম্পানা, আবু ইস্‌হাক আশা মানে না–নিরাশা জানে না। আবু ইস্‌হাক বিশ্বের মুসাফির। সে যা দেখে, তারই গান করে। চলুন, জাঁহাপনা।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *